কার্নিশ ছোঁয়া অলকমেঘ পর্ব-৫৭ এবং শেষ পর্ব

0
429

#কার্নিশ_ছোঁয়া_অলকমেঘ
লেখনীতে: মিথিলা মাশরেকা
অন্তিম পর্ব.

– হি ইজ আউট অফ ডেঞ্জার। পেশেন্টকে কোনোরকম উত্তেজিত না করে, দেখা করতে পারেন।

ডাক্তারের কথা শুনে আশ্বস্ত হয়ে স্বামীর বুকে মাথা ঠেকালেন মিসেস ওয়াসীর। ছেলেকে কোলে ফেরত পাবেন জেনে রবের শুকরিয়া আদায় করলেন তিনি। পুরো তিনদিন হলো তাশদীদ আইসিইউ তে। সে রাতে জেইনের ওকে আঘাতের কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে উপস্থিত হয় পনেরো বিশজনের এক মুসলিম কাফেলা। জেইন গা ঢাকা দেওয়ার জন্য তাড়াহুড়ায় নিজের সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে চলে যায়। তাশদীদকে জ্ঞান হারাতে ওরা দেখে ধরে নিয়েছিলো, ও মৃত্যুর কোলে ঢলে পরেছে। তাথৈ ছাড়া পেয়ে ধপ করে বসে যায় তাশদীদের নিথর দেহটার সামনে। কয়েকদন্ড সময় নিয়ে তাশদীদকে জরিয়ে চিৎকার করে কাদতে থাকে ও। ওকে কাদতে দেখে গাড়ি থামায় কাফেলাটা। তাশদীদকে পরখ করে দেখে ওর পালসরেট ক্ষীণ, তবে তখনো চলছে। ওরাই হাসপাতালে নিয়ে আসে তাশদীদকে। অতঃপর ওপরওয়ালার ইচ্ছা, আর ডাক্তারদের হাজারো প্রচেষ্টার পর জ্ঞান ফেরে তাশদীদের।
এ তিনদিনে কেবিনের বাইরে থেকে একচুল সরেনি তাথৈ। ওকে নড়াতেও পারেনি কেউ। ডাক্তারের কথায় সবাই স্বস্তির শ্বাস ফেললেও একটা বড় দম নিলো তাথৈ। ওকে উঠে দাড়াতে দেখে শান্ত সরে দাড়িয়ে ওর কেবিনে ঢোকার জায়গা করে দিলো। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে তাথৈ কেবিনে না গিয়ে সোজা পা বাড়ায়। বাবার হাতে থাকা ওয়ালেট আর গাড়ির চাবি নিয়ে হাটা লাগালো ও।
তাথৈয়ের এভাবে চলে যাওয়ায় কিছুটা থমকে যায় সবাই। মিসেস ওয়াসীর ওকে আড়াল হতে দেখে কেবিনে ঢুকলেন। সবাই থেমে থাকলেও রুমন থানলো না। ও ছুট লাগালো তাথৈয়ের পেছন পেছন। দৌড়াতে দৌড়াতে বললো,

– তাথৈ? দাড়া তাথৈ! তাশদীদ ভাইয়ের জ্ঞান ফিরেছে! কোথায় যাচ্ছিস তুই এখন? তাথৈ? তাথৈ!

তাথৈ এক শুনলো না। হনহনিয়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসলো ও। রুমনও ওর পেছন পেছন ছুটলো। তাথৈকে আজ কোথাও যেতে দেবে না ও। তাথৈ গাড়ির কাছে আসলো। লক খুলতে খুলতে, ফোন কানে তুলে কাউকে শক্তকন্ঠে বললো,

– জেইন কোথায়?

তাথৈয়ের কথায় রুমনের পা থামে। ও গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলে, গর্বের হাসি হাসলো রুমন। দ্রুতগতিতে চলে যাওয়া গাড়িটাকে দেখে নিজেনিজেই বললো,

– লোকে ঠিকি বলে। যা হয়, ভালোর জন্যই হয়। এখন মনে হচ্ছে তোর আসাটা দরকার ছিলো জেইন।
কনগ্রাচুলেশনস তাশদীদ ভাই। তাথৈ আলফেজ, ইজ ব্যাক!

দড়ি হাতে তিনজন কন্সটেবলকে জেলের ভেতরে ঢুতে দেখে অবুঝের মতো তাকিয়ে রইলো জেইন। এ কদিন হলোই বাবার সাথে যোগাযোগ ছিন্ন ওর। হয়তো পুলিশ ভেতরে আসতে দেয়নি তাকে। তাশদীদকে আঘাত করে সে রাতেই গা ঢাকা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলো ও। লাভ হয়নি। ধরা পরার পর ইনচার্জের কাছে শুনেছে ক্রাইম ব্রাঞ্চ থেকে ওকে ধরার জন্য নাকি আলাদা চাপ দেওয়া হয়েছিলো। পুলিশ, গোয়েন্দা কেউই বাদ যায়নি ওকে ধরার জন্য মাতোয়ারা হতে। ওর সাথের ছেলেগুলো একই গ্যাঙের হওয়ায় ধরা পরে যায়। যারফলে পালিয়ে বেরানো সম্ভব হয়নি জেইনেরও।
কনস্টেবলের তিনজনের তিনজনই এসে জেইনকে ধরে ওর দুহাত পেছনে বাধা শুরু করলো। ‘কি হচ্ছেটা কি?’ বলতে বলতে জেইন নড়চড় শুরু করে। বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলো ওদের। কিন্তু লাভ হলো না। ওরা ওর হাত বাধলো, পা-ও বাধলো। নড়তে গিয়ে জেইন মেঝেতে পরে যায়৷ একজন ওর মুখে স্কচটেপ মেরে দিলো। ষাটোর্ধ্ব ইনচার্জ কারাকক্ষের বাইরে নিজস্ব ডেস্কের সামনের চেয়ারে বসে ছিলেন। পান চিবোতে চিবোতে খবর পড়ছিলেন তিনি। জেইনের পরে যাওয়ার আওয়াজ শুনে লোক টুথপিকে দাঁত খুচিয়ে বললেন,

– যতো নড়াচড়া করতে জানিস, করে নে। এ দুদিন তো কিছু বলিনি। তিনদিনের রিমান্ডের আজকেই শেষদিন। তোর আপ্যায়ন করার জন্য স্পেশাল গেস্ট আসছে।

জেইন তার কথার অর্থ বুঝলো না। কনস্টেবল তিনজন মিলে ওকে দড়িতে বাধলো। অতঃপর ছাদে দড়ি বাঝিয়ে, উল্টো করে ঝুলিয়ে দিলো। মাথা নিচদিক, পা উপরদিক রেখে ঝুলতে গিয়ে জেইনের মাথা ঘুরে ওঠে। আর চোখের সামনে দৃশ্যমান হয় শুভ্র স্কার্ট পরিহিত মানবীর খালি পা। দৃষ্টি উনিত করতে শুরু করে জেইন। সামনেরজনের সাদা লম্বা স্কার্টটায় ছোপ ছোপ মাটি, রক্তের দাগ, ডান হাতে একটা লোহার দন্ড, গাঢ় নীল ফতুয়া। পরিচিত অবয়বের মুখ না দেখেই বুকের ভেতরে ভয় এবারে জেঁকে বসে জেইনের। সামনেরজনের চেহারা অবদি চোখ আসতেই অনিয়মিত আকারে প্রসারিত হয় ওর চোখ। জেইনের মুখের স্কচটেপ খুলে দেয় সে। ওর মুখ দিয়ে অস্ফুটস্বরে বের হয়,

– তাথৈ আলফেজ…

একদম চোয়াল বরাবর লোহার দন্ডের বারি পরে জেইনের। উচ্চস্বরে আর্তনাদ করে ওঠে ও। ঘলঘলিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসে ওর মুখ থেকে। জেইন দড়ির সাথে শূণ্যে ঘুরে উঠেছে। ভেতরে দাড়ানো কনস্টেবল তিনজনের একজন এসে কোমড় ধরে ওকে স্থির করে, আবারো সরে দাড়ালো। তাথৈয়ের তীক্ষ্ণ চোখের তারায় জেইনের রক্তাক্ত মুখটা প্রতিফলিত হয়। দুদন্ড সে দৃশ্য মনভরে দেখলো তাথৈ। অতঃপর তীক্ষ্ম আওয়াজে বললো,

– তাশদীদের সবেমাত্র জ্ঞান ফিরেছে জেইন। ওরসাথে দেখা না করে আমি আগে এখানে এসেছি হিসেব মেটাতে। সো ঘোরাঘুরি না করে, কো অপারেট প্লিজ।

বলা শেষ করে আবারো জেইনকে বারি লাগায় তাথৈ। এবারেও ব্যথায় চেচিয়ে ওঠে জেইন। টালমাটাল হয়ে পরে অনেকটা। তাথৈ ওর ঝুলতে থাকা কাধে লোহার দন্ড ঠেকিয়ে ওর ঘুরে ওঠা ঠেকালো। জেইন টেনেটুনে চোখ খোলা রেখে তাথৈয়ের দিকে তাকালো। তাথৈ কিঞ্চিৎ ঘাড় কাৎ করে বললো,

– চাইলেই এই শরীরটাতে থাকা দুইশো ছয়টা হাড় গুড়োগুড়ো করে, গলিয়ে-জমিয়ে ঠিকঠাক শেইপ দিয়ে আমি তাশদীদকে ওয়াকিং স্টিক বানিয়ে দিতে পারি। ক্যান ইউ ফিল দ্যাট জেইন? ক্যান ইউ ফিল দ্যাট?

আরো একটা বারি পরলো জেইনের থুতনি বরাবর। কাশি দিয়ে জেইন মুখের রক্ত বের করে দেয়। তাথৈ লাঠিটা নিচে ছুড়ে ফেলে দিলো। তার আওয়াজে চমকে ওঠে কনস্টেবল তিনজন। রাগে তাথৈয়ের চোখ রক্তলাল হয়ে গেছে, চোখ বেয়ে পানি ঝরছে। হিংস্র বাঘিনীর মতো একহাতে জেইনের কলার মুঠো করে নিলো ও। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

– কিন্তু আমি সেটা করছি না। দয়া করলাম তোকে। জীবনে অনেক খারাপ কাজ করেছিস জেইন৷ পৃথিবীর তোকে কোনো কালেই দরকার ছিলো না। আর না ভবিষ্যতে কখনো দরকার হবে। সো আ’ম গোয়ানা মেক শিওর, তুই এই সেল থেকে বেরিয়ে সোজা ফাঁসির মঞ্চে পৌছে যাস। এন্ড দিস ইজ আ প্রমিস ফ্রম তাথৈ আলফেজ। হ্যাভ আ সুইট জার্নি টু হেল। টা টা।

ঝারা মেরে জেইনের কলার ছেড়ে দিলো তাথৈ। কোনোদিক না তাকিয়ে ওখান থেকে বেরিয়ে আসে। যাওয়ার আগে ইনচার্জের টেবিলে রেখে যায় একটা চেক। ভূড়িবিশিষ্ট লোক এতোক্ষণ টেবিলের উপরে বসে মোবাইল ঘাটছিলেন। চেকটা হাতে পেয়ে ফোকলা হাসলেন তিনি। হাঁক ছেড়ে বললেন,

– ওটাকে আরো কয়েকঘা মার। কালকে কোর্টে চালান করার আগে ওর গায়ে প্রতি দুইইঞ্চি পরপর মারের দাগ থাকা আবশ্যক। না হলে আমার অবৈধ টাকাটা আরো অবৈধ হয়ে যাবে। মার!

তাশদীদ বেডে হেলান দিয়ে বসে। ওর কেবিনটা মানুষে পরিপূর্ণ। মিসেস ওয়াসীর ওর বেডের পাশে টুলে বসে, ওয়াসীর সাহেব তার কাধে হাত রেখে দাড়ানো। তামজীদ বেডের আরেকপাশে রোজির মেয়েকে নিয়ে দাড়ানো। আলো, শার্লি আর তৈয়ব আলফেজ সোফায় বসা। রুমন সোফার হাতলে বসেছে, শান্ত আর টিটু কাধ ধরে একপাশে দাড়িয়ে তাশদীদকে দেখছে। মাথায়, হাতেপায়ে, মোটকথা সর্বাঙ্গে ব্যান্ডেজ ওর। কোথাও আঘাতপ্রাপ্ত না হওয়ার অবশেষ নেই। কোনোমতে প্রাণ নিয়ে বেচে আসা যাকে বলে। তবুও মায়ের দিকে তাকিয়ে আশ্বস্তের হাসি হাসছে তাশদীদ। অথচ সবাই জানে, সবার মাঝে তাথৈয়ের না থাকাটা ওর ভেতরটাকে ঠিকই চুরমার করে দিচ্ছে। একবারের জন্যও ও তাথৈয়ের কথা জিজ্ঞেস করেনি। অথচ ওর নিশ্বাসটা চলছেই তাথৈয়ের। শার্লি ক্ষীণস্বরে বললো,

– আপনার মেয়ে আজও চলে গেলো আঙ্কেল।

তৈয়ব আলফেজ ছোট একটা শ্বাস ফেললেন। তাশদীদকে কিছু বলার ভাষা তার কাছে নেই। তাথৈ চলে যাওয়ার পরও উনি এখানে এখনো কেনো আছেন, কোন মুখ নিয়ে আছেন, সেটাও হয়তো জানেন না তিনি। শার্লি আবারো বললো,

– তাথৈ হয়তো অনেক ভালোবাসতে পারে। হয়তো না, ও আসলেও অনেক ভালোবাসতে পারে। কিন্তু যে ভালোবাসায় ও কেবল নিজেকে দুরে সরিয়েছে, কি লাভ তেমন ভালোবেসে?

– ও তো এসেছিলো শার্লি। ও তো বলবে বলেই এসেছিলো।

আলো জবাব দেয়। শার্লি অন্যদিকে দৃষ্টি ফেরালো। রুমন কিছুই বললো না। ও কেবল অপেক্ষা করছিলো তাথৈয়ের ফেরা। ঠিক তখনই দরজা খোলার আওয়াজ হয়। ঘরের সবগুলো চোখের চাওনি চলে যায় সেদিকে।
নিশব্দে কেবিনে ঢুকলো তাথৈ। ভেতরে ঢুকে সবার আগে তাকালো বিছানায় বসা তাশদীদের দিকে। কয়েককদম দুরে থাকা বিধ্বস্ত মেয়েটাকে দেখে বুকের ব্যথাটা পুনরায় জেগে ওঠে তাশদীদের। এতোক্ষণ জোর করে ধরে রাখা হাসিটা মিলিয়ে যায় ওদের দৃষ্টিবিনিময়ে। শার্লি, উঠে দাড়িয়েছে। একটা বুকভরা দম নিয়ে শ্বাস ছাড়লো তাশদীদ। ঘাড় হালকা কাৎ করে অসহায়ের মতোকরে চাইলো। যেনো বুঝালো, ‘কোথায় গিয়েছিলে তাথৈ? কেনো গিয়েছিলে? তুমি কি এখনো বোঝো না, তুমি ছাড়া আমি নিঃস্ব? এখনো বোঝো না?’
তাথৈ হয়তো বুঝলো সে চাওনির ভাষা। কিছুটা পেছনদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে শান্ত ভঙিতে বললো,

– ভেতরে আসুন।

দুজন মাঝবয়সী অচেনা লোক কেবিনের ভেতরে ঢোকে। একজনের পরনে স্যুটবুট, হাতে কাগজপত্র, আরেকজন হুজুর। তাদের দেখে বাকিসব অবাক হলেও তৎক্ষনাৎ হাসি ফোটে শার্লি রুমনের চেহারায়। খুশিতে চোখ ভরে ওঠে অশ্রুতে। তাশদীদ স্থির। তাথৈ লোকদুটোকে হাত দিয়ে ইশারা করে এগোতে বললো। ওনারা তাশদীদের পাশে এসে দাড়ালো। তাদের মধ্যে একজন ফাইলে কিছু লেখালেখি করে তাথৈকে বললো,

– কাবিনের টাকা কতো লিখবো?

সবাই হতভম্ব। অনাকাঙ্ক্ষিত সুখে ভরে ওঠে প্রত্যেকের চোখ। শার্লি কাদতে গিয়ে হেসে ফেললো শব্দ করে। রুমন তৈয়ব আলফেজকে ধরে ছিলো। তৈয়ব আলফেজ নিজেকে ছাড়িয়ে চোখ মুছে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। ওয়াসীর সাহেব তাকে বাধা দিতেই উনি বললেন,

– আমাকে একটু সময় দিন ওয়াসীর ভাই। এক্ষুনি আসছি আমি। দু মিনিটে আসছি।

চলে যায় সে। তাশদীদ কিছুই বলছে না। তাথৈ ওরদিকে চেয়ে কাজীকে বললো,

– কাবিন কি?

– বিয়ের সময় স্বামীর স্ত্রীকে দেওয়া নগদ অর্থ। এটাকে দেনমোহরও বলে।

তাথৈ আশপাশে চায়। ওর চোখ যায় রুমের একপাশে হ্যাঙ্গারে ঝোলানো রক্তাক্ত পান্জাবীটায়। ওটা তাশদীদের। কোনোকিছুর তোয়াক্কা না করে নিজে গিয়ে ওটার পকেটে হাত ঢুকায় তাথৈ। সেখান থেকে পাওয়া মানিব্যাগ খুলে দেখে, তাতে একটা এক হাজার টাকার নোট, একটা পাঁচশো টাকার নোট আর দুটো বিশ টাকার নোট। চল্লিশ টাকা রেখে তাথৈ পনেরোশো টাকা হাতে নিলো। কাজীকে দেখিয়ে বললো,

– পনেরোশো লিখুন।

– আলহামদুলিল্লাহ।

মুচকি হেসে কাজী নিজের কাজে মনোযোগ দিলেন। তাশদীদ এতোক্ষন কেবল চুপচাপ দেখছিলো। কিন্তু এবার বললো,

– আমি আরো এফোর্ড করতে পারবো।

– হি সেইড, নগদ!

– আমার একাউন্ট থেকে তুলে…

– সময়ের সাথে আমার হারানোর তালিকা বাড়ে তাশদীদ। তোমাকে আমি আর বাড়তি একটা মুহূর্তও দিতে পারবো না। টাকার জন্য তো আরো না!

তাশদীদ হাসলো। ওকে হাসতে দেখেই তাথৈ কাবিননামা আর কলমটা একপ্রকার কেড়ে নিলো কাজীর কাছ থেকে। তাশদীদের সামনে দিয়ে বললো,

– সাইন ইট!

– কি হলো তাকিয়ে আছো কেনো? সাইন ইট!

– এভাবে তো বিয়ে হবে না ম্যাডাম!

তাথৈয়ের তেজ আর কাজীর বারন শুনে নিচের ঠোঁট কামড়ে পুনরায় হেসে ফেললো তাশদীদ। চোখ বেয়ে গরানো জল আড়াল করতে মুখ ঢাকলো, অন্যদিক তাকালো। কেবিনের বাকিসবের অবস্থাও করুন। তারা হাসছেও, কাদছেও। তাথৈ একবার ওয়াসীর সাহেব আর তার মিসেসের দিকে প্রশ্নসূচক তাকালো। যার অর্থ, কারো এ বিয়েতে অমত আছে কিনা? শার্লি এসে ওর কাধ ধরে পাশে দাড়ালো। মিসেস ওয়াসীর তাথৈয়ের সামনে এসে ওর মাথায় হাত বুলালেন। তাথৈ সবার সম্মতির প্রমান দেখিয়ে আবারো তাকালো কাজীর দিকে। তিনি আমতা আমতা করে বললেন,

– ইয়ে, আমি বলতে চাইছিলাম, একটু সময় দিন। লেখা শেষ হয়নি আমার।

লোকের দিকে তাথৈ এমনভাবে তাকালো, সে লোক তাড়াহুড়ায় কলম ভেঙে ফেলে এমন অবস্থা। তামজীদ আলোকে একা পেয়ে রোজির মেয়েকে ওর কাছে দিলো। তাথৈয়ের সামনে গিয়ে বললো,

– ভাইয়া বিয়ের জন্য রাজী, জলদিই তোমায় প্রীতিকার্নিশ নিয়ে আসবে, এটা বলতে কল করেছিলাম তোমায়। আর তুমি তখনই আমাকে ভাবী ডাকতে মানা করে দিলে! অনেক শাস্তি আছে তোমার ভাবী! ভাবী ডাকতে ডাকতে তোমার কান পচিয়ে ফেলবো আমি! একবার চলো প্রীতিকার্নিশ!

তাথৈ ওর চুলে আঙুল চালালো। এরমাঝে তৈয়ব আলফেজ ফিরে আসলেন। তার একহাতে কয়েকপ্যাকেট মিষ্টি আর খেজুর, আরেকহাতে একটা লাল টকটকে বউ ওড়না। ওড়নায় কোনোরকম ভারী কারুকাজ নেই। শুধু জর্জেটের ওড়নার চারপাশে আরবিতে কিছু লেখা। রুমন গিয়ে মিষ্টি আর খেজুরের প্যাকেটগুলো ধরলো। তৈয়ব আলফেজ ওয়াসীর সাহেবকে হাতজোড় করে বললেন,

– সবই রাস্তার দোকান থেকে কেনা। শাড়ীর দোকান তো পাইনি, ঘোমটাটা এক মহিলা দাড়িয়ে দাড়িয়ে বিক্রি করছিলো। এই বর্ডার নাকি তার নিজে হাতে করা। মেয়ের বাবা হিসেবে আপাতত আমার সামর্থ্য এটুকোই। আপনারা আমার এটুকো স্বীকার করা করলে আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকবো ওয়াসীর ভাই।

– আমার ঘরে মেয়ে নেই। আপনি নিজের মেয়েকে আমার মেয়ে করে আমার ঘরে পাঠাচ্ছেন। সে হিসেবে আমি আপনার কাছে ঋণী তৈয়ব সাহেব। এভাবে বলে আমাকে আর ছোট করে দেবেন না প্লিজ।

তৈয়ব আলফেজের হাত ধরে জবাব দিলেন ওয়াসীর সাহেব। শান্ত বললো,

– অনেক তো হলো। এবার কান্নাকাটি ছাড়ুন আঙ্কেল। আপনাদের ছেলেমেয়ের বিয়ে। খুশি হোন, উৎসব করুন!

তৈয়ব আলফেজ চোখের জল মুছলেন। শার্লি তাথৈকে এনে তাশদীদের বেডের পাশের টুলটায় বসালো। তারপর তৈয়ব আলফেজের আনা ঘোমটাটা ওর মাথায় পড়িয়ে দিলো। বিধ্বস্ত তাথৈয়ের কোনো সাজ ছাড়াই কনেসাজ নয়নভরে দেখলো তাশদীদ। ও তো তাথৈকে আপন করার সিদ্ধান্ত নিয়েই অম্বুনীড় থেকে প্রীতিকার্নিশ ফিরছিলো। প্রয়োজন পরলে তাথৈকে জোর করবে, সেটাও ভেবে নিয়েছিলো। মাঝখান থেকে এতোসব কিছু হবে, তা কে জানতো? তাশদীদের মনে হতে লাগলো, লাল টকটকে বউঘোমটা তাথৈয়ের ফ্যাকাশে চেহারায় যেনো পৃথিবীর সব সৌন্দর্য এনে দিয়েছে। দুই পরিবার, বন্ধুবান্ধবের উপস্থিতিতে, ধর্ম, আইন সবদিক মেনে বিয়ে শেষ হয় ওদের। মোনাজাত শেষে তাশদীদের দুহাত ধরলো তাথৈ। সে হাতজোড়া নিজের চোখে ছুইয়ে, তাতে ঠোঁট ছুইয়ে, মুঠো করে ধরলো শক্ত করে। বললো,

– আ’ম সরি তাশদীদ। ভালোবেসে ভালোবাসাকে আঁকড়ে ধরার পরিবর্তে, সে ভালোবাসাকে ছেড়ে পালানোর জন্য, যতোটা ভালোবেসেছি, ততোটা সরি।

– আর যতোটা সরি, তারচেয়েও বেশি, ভালোবাসি।

তাশদীদ ব্যথাসমেত শরীরটা নিয়ে অতিকষ্টে এগোলো। তাথৈয়ের দুগাল ধরে, আলতোকরে তাথৈয়ের কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বললো,

– আমিও ভালোবাসি। যতোটা ভালোবাসা যায়, তারচেয়েও বেশি।

★✰পরিশিষ্ট✰★

– এন্ড ফাইনালী, বায়োলুমিসেন্স সিকোয়েন্সিংয়ের রিএকশন মডিফায়ার, মাত্র একবছরে তিন তিনটে সেমিস্টার ড্রপ কাটিয়ে, বায়োকেমে গত দশবছরের সর্বোচ্চ সিজিপিএর সাথে গ্রাজুয়েট হওয়া, তাথৈ আলফেজ! এট প্রেজেন্ট, মিসেস তাথৈ তাশদীদ ওয়াসীর। গিভ ইট ফর হার, এভ্রিবডি!

উপস্থাপকের মুখে নিজের নাম শুনে তাথৈ বুকভরে দম নিলো। স্টেজের মাঝে এগোলো ধীরপায়ে। সমাবর্তনে দেশের সর্বোচ্চ সম্মানীয় মানুষটার হাত থেকে হাতে তুলে নিলো সার্টিফিকেট। ওর পরনে হালকা নীল শাড়ির ওপরে লম্বা কোট, মাথায় গ্রাজুয়েশন হ্যাট, হাতে সার্টিফিকেট। সামনের দর্শকসারীতে দাড়িয়ে হাততালি দিচ্ছে ওর গর্বিত স্বামী। তাশদীদ পরনে গাঢ় নীল ইনড শার্ট, কালো প্যান্ট, শু। উচ্ছ্বল চুল, শার্টের হাতা কনুইয়ে পরিপাটিভাবে ভাজ দেওয়া, হাতে মোটা ফিতের ঘড়ি। ওর আশেপাশে বাকিসবাইও আছে। তাথৈয়ের গ্রাজুয়েশন পিছিয়ে গেলেও সমাবর্তন আলো রুমনদের সাথে সাথেই হচ্ছে। অনুষ্ঠানে এসেছে প্রত্যেকেই। তৈয়ব আলফেজ অশ্রুসজল চোখে নিজের ফোনে তাথৈয়ের ছবি তুলছেন। তাথৈ সে ক্যামেরায় তাকিয়েছে। এরইমাঝে ওর কানে আসে,

– মাম্মাম! এইদিত এইদিত!

মঞ্চের সবাই সে ছোট্টস্বরের আওয়াজটা অনুসরণ করে তাকালো। মঞ্চের সামনের একপাশে বছর দুই আড়াইয়ের একটা বাচ্চা ছেলে। পরনে ইন করা সাদা শার্ট, তার ওপর গাঢ় নীল ব্লেজার, শার্টের বড় হাতা কনুই অবদি ভাজ দেওয়া, কালো প্যান্ট আর শু। গায়ের রঙ ফর্সা, সমমাপের চুলে তার কপাল পুরোটা ঢাকা। ছেলেটা ফোন নিয়ে দাড়ানো। তাথৈ হাসি প্রসারিত করে সেদিকে তাকালো। তৈয়ব আলফেজ মনটা ছোট করে, ফোন পকেটে পুরতে পুরতে বললেন,

– তাশদীদকে পেয়ে তাথৈ আমার কোলে ফিরেছিলো। আর এই ছেলেকে কোলে পেয়ে আমার মেয়ে আবারো পর হয়ে গেছে৷

ওয়াসীর সাহেব হেসে তার কাধে হাত রাখলেন। তাথৈ নেমে আসলো মঞ্চ থেকে। তাশদীদ গিয়ে ছেলের পাশে হাটুগেরে বসলো। ফোনে উঁকি দিয়ে বড়সড় হেসে বললো,

– মাশাআল্লাহ আমার বউ!

– আমাল মাম্মাম!

ছেলের জবাবে তাশদীদের মুখটা চুপসে যায়। বলতে বলতে ফোনটাও সরিয়ে নিয়েছে সে। তাথৈ স্টেজ থেকে নেমে হাসিমুখে এগোলো স্বামী সন্তানের দিকে। দুজনকে দুজনের দিকে কপাল কুচকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ওর নিজের কপালও কুচকে আসলো। বাবা ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বললো,

– কি ব্যাপার মিস্টার ওয়াসীরস্? কোনো ব্যক্তিগত ঝামেলা চলছে নাকি আপনাদের? হু?

– তোমার ছেলে তোমার চেয়েও হিংসুটে হয়েছে তাথৈ। ছবিগুলো দেখে আমি একটু বলেছি আমার বউ, কথাটা মাটিতেও পরতে দিলো না। সাথেসাথে বলছে আমার মাম্মাম!

তাশদীদের কথায় তাথৈ ঠোঁট চেপে হাসি আটকালো। নিজের মাথার টুপিটা ছেলের ছোট্ট মাথায় কোনোরকমে বাঝিয়ে, ওর মুখের দিকে উঁকি দিয়ে বললো,

– বাবাই সত্যি বলছে? আপনি কি কোনোভাবে জেলাস? মিস্টার তীব্র ওয়াসীর?

তীব্র মায়ের কথায় পাত্তা দিলো না৷ ছোটছোট হাতে মাথার টুপিটা ধরার চেষ্টা করতে লাগলো। একাধারে তামজীদ, ওয়াসীর সাহেব, তার মিসেস, তৈয়ব আলফেজ এসে তাথৈকে অভিনন্দন জানালো। তৈয়ব আলফেজের সাথে আরো একজন ছিলো। ছোট্ট তাথৈ। মেয়েটা একদম রোজির মতোই হয়েছে দেখতে। নামে তাথৈয়ের নাম পেলেও স্বভাবে রোজি-আলোর সংমিশ্রন হয়েছে সে। তাথৈ-তাশদীদের বিয়ের পর নিজের একাকিত্বকে কাটাতে রোজির মেয়েকে নিজের কাছে এনেছিলো আলো। তাশদীদের ইচ্ছে ছিলো না। কিন্তু আলোরও তো বেচে থাকার উদ্দেশ্যের প্রয়োজন ছিলো৷ বিদেশে স্কলারশিপে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলো ও। যায়নি তৈয়ব আলফেজের কথা ভেবে। অম্বুনীড়ে স্বামী ছাড়াই সন্তান, শশুড় নিয়ে সংসার সাজিয়েছে আলো। ছোট্ট তাথৈ এসে তাথৈকে মিষ্টি হেসে বললো,

– কনগ্রাচুলেশনস মিতামনি।

– থ্যাংকিউ মিতাপাখি।

তাথৈ হেসে ওর থুতনি ধরে বললো। আলো এসে মেয়ের পেছনে দাড়িয়ে ওর দু কাধে হাত রাখলো। তৈয়ব আলফেজ এসে আলোর মাথায় হাত রাখলে মৃদ্যু হাসলো আলো। এরমাঝে মাথার টুপি সামলাতে সামলাতে রুমন কোত্থেকে হাজির হলো সেখানে। ওর হালকাপাতলা শরীরের জন্য গাউন সবদিক দিয়ে ঝুলছে। রুমন এসে ব্যস্তভাবে তাশদীদকে বললো,

– কাল ফ্রি আছেন তাশদীদ ভাই?

– কলেজে তো যেতে হতো৷ তবে সমস্যা নেই।ছুটি নিতে পারবো। তুমি বলো কি কাজ।

– আমার সাথে একজায়গায় যেতে হবে আপনাকে। মা মেয়ে দেখতে যেতে বলছে। ইনফ্যাক্ট আজকে এই গ্রাজুয়েটের বেশেই নিয়ে যেতো। অনেককষ্টে ম্যানেজ দিয়েছি।

তাশদীদ হাসলো। কথাবার্তা বলে জানালো ও যাবে। এরইমাঝে সেখানে আসে শান্ত-শার্লি৷ শার্লি আর পড়াশোনা করেই নি। ওর করা ডিজাইনের ড্রেসের ফ্যাশন শো ছিলো ঢাকায়। তাই এসেছে ও। তাথৈ এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো শার্লিকে। শান্ত-তাশদীদও একে ওপরকে আলিঙ্গন করলো। শার্লি তীব্রকে কোলে নিয়ে চুমু দিলো একটা। তীব্র তখনতখন ওর গাল ডলে মুছে ফেলার ভঙিমা করলো। শার্লি কাদোকাদো হয়ে বললো,

– কি বাবাই? তোমার খালামনির চুমু পছন্দ হয়নি? গাল মুছে ফেললে যে?

– মাম্মার আদল দিলে!

শার্লির কোল থেকে নেমে যায় তীব্র। শার্লি অবুঝ হয়ে দাড়িয়ে রয়। আর তাথৈ কপাল চেপে ধরে। কেউ না বুঝলেও ও তো বুঝেছে, শার্লি ওকে জড়িয়ে ধরেছে বলে এ ছেলের আর শার্লিকে পছন্দ হচ্ছে না। শার্লির ছেলে এসে তীব্রর গালের আঙুল দিয়ে আস্তেকরে খোঁচা মারলো একটা। হেসে মাকে বললো,

– আম্মু দেখো? তীব্রর গাল ফর্সার জন্য কেমন লাল দেখায়!

তীব্র এমনিতেও গাল ফুলিয়ে ছিলো। শার্লির ছেলের কাজে আরোবেশি গাল ফুলালো ও। কেউ ওর গালে খোঁচা মারলে ওর সেটা পছন্দ না। শার্লির ছেলের গালে ওউ আঙুলে খোঁচা মারলো একটা। আধোআধো আওয়াজে রাগ বুঝিয়ে বললো,

– পতা থেলে!

তাথৈ দ্রুততার সাথে গিয়ে হাত চেপে ধরে তীব্রর। কিছুটা শাষনের মতো করে বুঝালো ওকে। শার্লি হেসে ফেললো শব্দ করে। হাসতে হাসতেই বললো,

– যাই বলিস তাথৈ। তোর ছেলে কিন্তু তাশদীদ ভাইয়ের এতোটুকোও পায়নি। এর ভালো রাগ আছে। পুরোটাই তোর মেল ভার্সন!

সবার মাঝে থেকেও হাসিটা মিলিয়ে যায় তাথৈয়ের। আড়চোখে আলোর দিকে তাকালো ও। আলোর চোখ ছলছল করছে। এ পর্যন্ত যতোবার তীব্রর সাথে দেখা হয়েছে, আলোর বুকটা হাহাকার করে উঠেছে। তীব্রর দিকে ঠিকঠাক তাকাতে পারেনা ও। তীব্রর হাটা, কথা, ভাব, এটুকো বয়সেই তা ‘তুল্য আলফেজ’ নামক সত্ত্বার হুবহু। তৈয়ব আলফেজ তীব্রকে কাধে করে নিয়ে অম্বুনীড়ে হাটাহাটি করেন আর কথায় কথায় বলেন, ‘নানুভাই? তুইতো একদম মামার মতো হাসিস, তুইতো একদম মামার মতো রাগ করিস, তুইতো মামার মতোই…’বলতে বলতেই থেমেও যেতেন তৈয়ব আলফেজ। আর আলো কান্না লুকাতো।

– বাবা আমি তাথৈকে নিয়ে গাড়িতে। আপনারা আসুন।

তৈয়ব আলফেজকে এটুক বলে অডিটোরিয়াম থেকে বেরিয়ে আসে আলো। আসার সময় দেখে নোমান দরজাতেই দাড়িয়ে ছিলো। আলো মাথা নিচু করে ওকে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। নোমান তাচ্ছিল্যে হাসলো। বরাবরের মতো আজও আলোর উপেক্ষা স্বীকার করে নিলো ও। আর কিই বা করার আছে ওর? তৈয়ব আলফেজের ইন্ডাস্ট্রিতে জয়েন করার পর তারসাথে ওঠাবসা বেড়েছে নোমানের। না চাইতেও আলোর প্রতি দূর্বল হয়ে পরেছে ও। এ বিষয়ে অবগত সবাই। ওর চাওয়া পূর্ণতা পাক, আলো ওর সঙ্গে ভালো থাকুক, এমনটা সবাই চেয়েছিলো। কেবল আলো চায়নি। এতোগুলো দিনেও আলোর কাছে ওর সত্ত্বা গুরুত্ব পায়নি। হয়তো কোনোদিন পাবেও না। একবুক দীর্ঘশ্বাস নিয়ে নোমান চলে যায় ওখান থেকে।
তাথৈ দেখলো সবটাই। অতঃপর স্টেজের দিকে তাকালো আক্ষেপভরা চোখে। সমাবর্তনে আসা মেধাবী মুখগুলো দেখে চোখ বেয়ে জল গরায় ওর। তাথৈ আস্তেকরে বললো,

– আমার পক্ষে কোনোদিনও তোর রেজাল্ট টপকানো সম্ভব ছিলো না তুল্য। আজ তুই থাকলে এই রেকর্ডটা তোর হতো। আরো অনেককিছুই হতো যা…

চোখ বেয়ে টুপটাপ দুফোটা জল গরায় তাথৈয়ের। তখনই তীব্র ওর গাউন ধরে টান মারে। ধ্যান ভাঙলো তাথৈয়ের। চোখ মুছে ছেলেকে কোলে নিলো ও। তীব্র মায়ের মাথায় টুপিটা পরাতে পরাতে বললো,

– মাম্মাম বেস্ত!

তাথৈ কষ্টের মধ্যেও হাসলো। তাশদীদ পাশ থেকে মা ছেলের কিছু মুহুর্ত মোবাইলে বন্দি করলো। অতঃপর এসে একহাতে জড়িয়ে ধরলো তাথৈকে। আরেকহাতে তীব্রকে নিজের কোলে নিয়ে বললো,

– শুধু মাম্মাম বেষ্ট কেনো? বাবাই কি তীব্রকে ভালোবাসে না? বাবাই বেস্ট না?

– বাবাই বেস্ত, বাবাই দেলাত।

– আচ্ছা? বাবাই দেলাত? আমি জেলাস? ওকে। আমি এক্খন তোর সামনে তোর মাম্মামকে আদর করবো। দেখি কে জ্বলে, কে দেলাত হয়।

তাথৈয়ের কপালে চুমো দিলো তাশদীদ। তীব্র গালজোড়া ফুলিয়ে, কপাল কুচকে বাবার দিকে তাকিয়ে রইলো। ভাবখানা এমন, ওর মাম্মামকে কেউ কেনো আদর করবে? ওর মাম্মামকে শুধু ও আদর করবে। তাথৈ ছেলের প্রতিক্রিয়া দেখে হেসে ফেললো। তীব্রর নাক টিপে দিলো। কিছুটা দুরে দাড়ানো শার্লি, রুমন চোখ মোছে৷ ব্যস এটুকোই তো চাওয়া ছিলো ওদের। তাথৈ ভালোবেসে ভালো থাকুক। হাজারো ঝঞ্জা পেরিয়ে হোক, সৃষ্টিকর্তা ভালো রেখেছে ওকে। প্রীতিকার্নিশের চার পুরুষের আলাদা আলাদা ভালোবাসায় আজ সিক্ত তাথৈ। মিসেস ওয়াসীরের আঁচলতলের শান্তিতে ওর নসিব টুইটুম্বর। আর কিছুই চাওয়ার নেই।

রাতের খাবারটা একসাথে বাইরে খেলো সবাই। আলোদের অম্বুনীড়ের উদ্দেশ্যে বিদায় জানিয়ে প্রীতিকার্নিশ ফিরলো তাথৈরা। ওরা পৌছাতে পৌছাতে তীব্র ঘুমিয়ে যায়। তাশদীদ রাস্তায়ই তীব্রর ব্লেজার, শু খুলে শার্টের কয়েকটা বোতাম খুলে দিয়েছে। তাথৈ পেছনে হাটতে হাটতে দেখলো তীব্র বাবার কাধে মাথা রেখে নির্বিঘ্নে ঘুমোচ্ছে। তাশদীদ একহাতে কোলের ছেলেকে ধরেছে, আরেকহাতে তাথৈয়ের উচু হিলটা৷ গাড়ি থেকে নামতেই একটার খুঁড় ভেঙে গেছে বলে সেটা তাশদীদ হাতে তুলে নিয়েছে। তামজীদ ঘরে ঢুকতে গিয়ে বুঝলো ইলেকট্রিসিটি নেই। মা বাবার ঘরে গিয়ে আগে সেঘরের লাইটটা জ্বালালো ও। প্রীতিকার্নিশের এ ঘরেই কেবল চার্জার ফ্যান। তাশদীদ সে ঘরে গিয়ে তীব্রকে বিছানায় শুইয়ে দিলো। তামজীদও এসে হাতপা চারদিকে ছড়িয়ে তীব্রর পাশে শুয়ে পরলো। তাশদীদ বাবাকে বললো,

– তোমরা চেন্জ করে রেস্ট নাও। ইলেক্ট্রিসিটি আসলে আমি তীব্রকে নিয়ে যাচ্ছি।

ওয়াসীর সাহেব সম্মতি দিলেন। নাতিকে নিজের কাছে রাখার ইচ্ছে করে তার। কিন্তু তাশদীদ ছেলে ছাড়া কিছুই বোঝে না। এককথা বলে, ওর নাকি তীব্রকে ছাড়া ঘুম হয়না। এজন্য তাথৈও তাশদীদকে ছাড়া অম্বুনীড়ে থাকতে পারেনি। তাশদীদ শার্টের গলার দিকের বোতাম খুলতে খুলতে নিজের ঘরের দিকে এগোলো। ঘরে ঢুকে দেখে তাথৈ মোবাইলের ফ্লাশ জ্বালিয়ে, আয়নার সামনে দাড়িয়ে গ্রাজুয়েশন গাউন খুলছে। দরজায় হাত ঠেকিয়ে দাড়ালো তাশদীদ। মুগ্ধচোখে চেয়ে রইলো তাথৈয়ের দিকে। তাথৈ গাউন খুলে, মুখ দিয়ে দম ছেড়ে বললো,

– এই লোডশেডিং! এসময়ই হতে হবে?

তাশদীদ মুচকি হেসে হেলেদুলে এগোলো। তাথৈয়ের হাত ধরে ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে বললো,

– বাইরে চলো। ঘরে গরম।

তাথৈ বাধা দিলো না। তবে অপ্রস্তুতিতে হাটতে হাটতে বললো,

– তীব্র?

– মা বাবার ঘরে। ওখানে চার্জার ফ্যানের নিচে ঘুমোচ্ছে।

আর কথা বাড়ালো না তাথৈ। তাশদীদ ওকে নিয়ে চলে আসলো পুকুরপাড়ে। প্রাকৃতিক বাতাসে গা জুড়িয়ে যায় তাথৈয়ের। তাশদীদ প্যান্টের নিচদিকটা ভাজ দিতে দিতে বললো,

– ফিলিং বেটার?

জবাব না দিয়ে তাথৈ কেবল নিশব্দে হাসলো। তাশদীদ পাড়বাধানো সিড়িতে বসে পানিতে পা ডোবায়। আশেপাশে কোথাও কেউ নেই। এমনকি আকাশে চাঁদটাও নেই। কিন্তু মেঘে ঢাকা চাঁদের না থাকা আলোতেও চারপাশ যেনো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। জোসনায় ভরে আছে কোনা কোনা। পুকুরের পানি অতি স্বচ্ছ। সেখানে মেঘের প্রতিফলন অবদি দেখা যায়। পুকুরের ওপাশের কোনায় ঝোঁপের মতো হাসনাহেনার গাছ। সেখানে মিটমিটিয়ে তারার মতো জোনাকি জ্বলছে। তীব্র ঘ্রাণও ভেসে আসছে সেখান থেকে। তাশদীদ তাথৈকেও ইশারায় বসতে বলে। তাথৈ শাড়ি উচালো বসবে বলে। কিন্তু ও শাড়ি উচু করতেই তাশদীদ পা ধরলো ওর। চমকে ওঠে তাথৈ। তাশদীদ ওর পা নিজের পায়ের ওপর তুলে বুকপকেটে হাত ঢুকালো। একজোড়া নুপুর বের করে তাথৈয়ের পায়ে পরিয়ে দিতে দিতে বললো,

– কলেজ থেকে তোমার সমাবর্তন ভেন্যুতে যাওয়ার সময় এটা চোখে পরেছিলো। দেখোতো তোমার পছন্দ হয় কিনা?

তাথৈ মুচকি হেসে বসে গেলো সিড়িতে। শাড়ি কিছুটা উচিয়ে, পানিতে পা দিয়ে বারি লাগালো দুবার। ওর পায়ে থাকা নুপুরজোড়া পানির কনাগুলোর সাথে ঝলমলিয়ে ওঠে। তাথৈ তাশদীদের দিকে তাকিয়ে বললো,

– আকাশের তারাদের আমার পায়ে জড়িয়ে দেওয়ার জন্য, থ্যাংকিউ।

তাশদীদ মুগ্ধ হয়ে ওকে দেখতে থাকে। কেউ কি কোনোদিন ভেবেছিলো? রাগী, বদমেজাজী, অসহনশীল তাথৈ আলফেজ, যে কিনা অম্বুনীড়ের মতো রাজপ্রাসাদে বড় হয়েছে আলফেজ ইন্ডাস্ট্রির কোটি কোটি টাকার একমাত্র উত্তরসূরী, সে ওর মতো কোনো সাধারন ছেলেকে এতোবেশি ভালোবাসবে? কেউ ভেবেছিলো ওকে ভালোবেসে সে এতোটা পাগলামি করবে? কেউ ভেবেছিলো, সে বিলাসবহুল জীবনের তোয়াক্কা না করে কখনো টিনের চালের প্রীতিকার্নিশে মানিয়ে যাবে? কি ভেবে পাশের ঘাসের মধ্যে গজানো ছোট্ট একটা ভৃঙ্গরাজ ছিড়লো তাশদীদ। তাথৈয়ের কানে গুজে বললো,

– এবার বলো, আকাশের সূর্যকে তোমার কানে গুজে দিয়েছি?

– বললে তা একবিন্দুও ভুল হবে না। ভালোবাসায় পরিপূর্ণ করে তুমি আমার ইহজনমকে সার্থক করেছো তাশদীদ। তার তুলনায় আমি যাই বলি না কেনো, সেটা কমই পরবে।

তাথৈয়ের জবাবে তাশদীদের বুক ভরে ওঠে যেনো। আলতোকরে তাথৈয়ের দুগাল ধরলো ও। উষ্ণ ঠোঁটের ছোঁয়ালো জীবনসঙ্গীনের কপালে।চোখ বন্ধ করে রয় তাথৈ। তাশদীদ সরে এসে ওরদিক চেয়ে বললো,

– ওপরওয়ালা তার সৃষ্ট সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস, সবচেয়ে সুন্দর মানুষটার হাত ধরে আমায় দান করেছে। জিনিসটা ভালোবাসা, আর মানুষটা তুমি। আজীবন শুকরিয়া আদায় করেও আমি তার সে রহমতের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ শেষ করতে পারবো না।
বাট থ্যাংক ইউ তাথৈ। আমাকে ভালোবাসার জন্য, এ নগন্যের ভূমিসম কার্নিশে অলকচুম্বী প্রেম ছোঁয়ানোর জন্য। থ্যাংক ইউ সো মাচ!

তাথৈ আরকিছুই বললো না। মুচকি হেসে দুহাতে তাশদীদের একহাত জড়িয়ে ধরলো ও। তাশদীদের কাধে মাথা ঠেকিয়ে রাতের আকাশপানে চাইলো। ওর মাথায় মাথা ছুঁইয়ে সামনে তাকালো তাশদীদও। আকাশের চাঁদ মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছে। সেভাবেই জীবনের দুঃসহ অতীতে ছাপিয়ে, সুখ গোনার অধ্যায়ে তাশদীদ তাথৈ। পুকুরের পানিতে পা ভিজিয়ে, সিড়ির পাড়ে বসে রইলো ওরা দুজন। নিরবে, নিভৃতে…
একজোড়া হৃদয়ের সন্ধি দেখে প্রকৃতিও হাসলো বোধহয়। মৃদ্যুমন্দ বাতাসে উড়ে ওঠে প্রীতিকার্নিশের নেমপ্লেটে থাকা নকল মানিপ্লান্টগুলো। দৃশ্যমান হয় সবার অলক্ষ্যে নেমপ্লেটে তৈরী হওয়া নকশাটা। নেমপ্লেটের কার্নিশ লেখাটার ওপর কিছু বাতাসে ভাসা আকন্দর বীজ আটকে গেছে। পেজো তুলোর মতো স্তর পরে গিয়ে তাদের একফালি শুভ্র মেঘের মতোই দেখাচ্ছে। এভাবেই হয়তো প্রকৃতিও অনাকাঙ্ক্ষিত গল্প লেখে। বাতাসে উড়ে উড়ে, দুর আকাশে ভেসে বেরানোর চেয়ে, অপরিকল্পিতভাবে থেমে যাওয়াটাকেই কেউকেউ হয়তো ভালোবেসে ফেলে। হয়তো এতোবেশিই ভালোবেসে ফেলে যে, অলকমেঘও আর অলক চায় না, ভেসে বেরাতে চায় না। কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত কার্নিশ ছুঁয়ে, সেখানেই চিরতরে বাধিয়ে নেয় নিজেকে। হয়তো এভাবেই নিজের নামকরণ করিয়ে নেয়, কার্নিশ ছোঁয়া অলকমেঘ।

~ সমাপ্ত 🪟☁