কার্নিশ_ছোঁয়া_অলকমেঘ পর্ব-০২

0
207

#কার্নিশ_ছোঁয়া_অলকমেঘ
লেখনীতে: মিথিলা মাশরেকা

২.

গুলশানের আলিশান বাড়িটার মুল গেইটের পাশেই নেমপ্লেট। তাতে থাকা, ‘অম্বুনীড়’ লেখাটা আবছা আধারেও বোঝা যায়। ফজরের আযান কানে যেতেই ঘুম ছুটে যায় দেলোয়ারের হোসেনের। চমকে উঠে নিজের অবস্থান যাচাই করলো জীর্ণশীর্ণ দেহের লোকটা। গেইটে পাহাড়ারত তিনি। দেলোয়ার টের পেলেন, চেয়ারে বসেই ঘুমিয়ে গিয়ো সে। চোখটা ডলে আধোআধো চোখে সামনে তাকালো দেলোয়ার হোসেন। চমকে উঠলো তৎক্ষনাৎ। গেটের সামনে একটা হেডলাইট ভাঙা গাড়ি ঠেকানো। খয়েরী রঙের বিলাশবহুল গাড়িটা দেখে তার চিনতে সময় লাগলো না। হন্তদন্ত হয়ে উঠে ছুট লাগালো সে। এগিয়ে গিয়ে দেখে, ড্রাইভিং সিটে গা এলিয়ে বসে আছে তাথৈ। জানালার কাচে মাথা ঠেকিয়ে, একধ্যানে তাকিয়ে আছে কোনোকিছুর দিকে। কপালে কাটা দাগ, জমাটবাধা রক্ত, চোখের কোনে জল শুকানো। দেলোয়ার হোসেন আঁতকে উঠলেন। ব্যস্তকন্ঠে বললেন,

– মনি? কি হইছে তোমার? কপাল কাটছে কেমনে? বাসায় কখন আইছো? হরেন দেও নাই ক্যান?

তাথৈয়ের ধ্যান ভাঙে। মৃদ্যু নড়েচড়ে দেলোয়ার হোসেনের দিকে ফাকাদৃষ্টিতে তাকায় সে। ও পৌছেছে ঘন্টাখানেক আগেই। গেইট খোলার জন্য হর্ন দিতে যাবে, তখনই চোখে পরে দাড়োয়ান গেইটের সামনে চেয়ারে বসে, দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে ঘুমোচ্ছে। নিশ্চিন্ত ঘুম! তাথৈ নিস্পলক দৃষ্টিতে কিছুক্ষন দেখলো শুধু। ওর মনে পরে গেলো, অনেকদিন পেরিয়েছে, ও এমন নিশ্চিন্তে ঘুমায় না। শান্তিতে বিছানায় মাথা ঠেকায় না। ইচ্ছে করেই দেলোয়ার হোসেনকে আর ডাকেনি ও। গাড়ি নিয়ে বাইরেই দাড়িয়ে ছিলো। বুঝলো এখন আযান শুনে তার ঘুম ভেঙেছে। তাথৈ বসে যাওয়া কন্ঠে জবাব দিলো,

– ব্যস্ত হয়ো না চাচা। ঠিকাছি আমি। গেইট খোলো।

দেলোয়ার হোসেন দ্রুতপদে এসে গেট টেনে খুলে দিলো। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ভেতরে ঢুকলো তাথৈ। গ্যারেজে গাড়ি রেখে নেমে আসলো। পায়ের উচু জুতো জোড়া খুলে হাতে নিয়ে বাসার দরজায় কলিংবেল দিলো। দুবার বেল বাজাতেই খুলে গেলো দরজা। দরজায় থাকা পঞ্চাশোর্ধ লোকটাকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকলো তাথৈ। ভদ্রলোক মুখ থেকে সিগারেট নামিয়ে গম্ভীরকন্ঠে বললেন,

– কোন ভদ্র ঘরের মেয়ে বাইরে সারারাত কাটিয়ে ভোরবেলা বাসায় ফেরে তাথৈ?

– কোন ভদ্র ঘরের বাবা ফজরের সময় নামাজ পরতে না গিয়ে মুখে সিগারেট গুজে থাকে ড্যাড?

তাথৈ সিড়িতে উঠতে উঠতে জবাব দিলো। তৈয়ব আলফেজ থেমে গেলেন। স্থির দৃষ্টিতে মেয়েকে চলে যেতে দেখলেন শুধু। ওর বেখেয়ালিপনা সয়ে গেছে তার। কি মনে সিড়ির প্রান্তে থামলো তাথৈ। পুরোপুরিভাবে পেছন না ফিরে শান্তস্বরে বললো,

– অন্তু বিয়ে করে নিয়েছে ড্যাড। আমি নিজে আজ ওর বউকে ওর ঘরে তুলে দিয়ে আসলাম।

চোখ বন্ধ করে নিলেন তৈয়ব আলফেজ। চোখ খুলে আবারো মেয়ের বিধ্বস্ত মুখপানে চাইলেন তিনি। তার চোখে পরলো, কপাল কেটে রক্ত জমাট বেধে আছে তাথৈয়ের। ওর চোখ ছলছল করছে। তাথৈ অতিকষ্টে বললো,

– জীবনে প্রথমবার তুমি ঠিক ছিলে। অন্তু আমাকে ভালোবাসেনি। হি চিটেড অন মি।

– আর সেই শোকে তুই সুইসাইড করতে গিয়েছিলি। তাইতো?

তাথৈ পাশ ফিরলো। পাশে দাড়ানো ছেলেটার পরনে হাফহাতা গেন্জি, হাটুর নিচ অবদি হাফপ্যান্ট। একহাতে থাকা জুসের গ্লাসে চুমুক দিয়ে, আরেকহাতের ফার্স্ট এইড বক্সটা তাথৈয়ের সামনে তুলে ধরলো সে। অথচ তার চোখেমুখে তাথৈয়ের জন্য চিন্তার লেশ নেই। তাথৈ আস্তেকরে ওর হাত সরিয়ে দিলো। বললো,

– রক্ত জমাট বেধে গেছে। সবরকমের আঘাত আমার এখন গা সওয়া হয়ে গেছে তুল্য।

তুল্য দৃষ্টি নামিয়ে নিয়ে নিরবে হাসলো। তাথৈয়ের জমজ ভাই সে। বয়সে তাথৈয়ের চেয়ে বাইশ সেকেন্ডের বড় ও। কিন্তু যতোদুর ওর মনে পরে, বাইশ বছরেও দুরুত্ব মেটেনি ওর-তাথৈয়ের। একই মায়ের গর্ভে দশমাস থেকেছে ওরা। কিন্তু ওদের মাঝে আরপাঁচটা ভাইবোনের মতো দশ মিনিটের আদর-খুনশুটি হয়না। তাথৈয়ের কথা শুনে তুল্য কৃত্রিম অবাক চাওনি বানালো। কন্ঠে একরাশ বিস্ময় মিশিয়ে বললো,

– এতো সহজে তোর সব গা সওয়া হয়ে গেলো?

– যাক! ভালোই হলো! তাহলে এটা দেখে তুই এখন আর রিয়্যাক্ট করবি না। নে! এটা দেখ!

আরেকহাতের একটা কাগজ তাথৈয়ের দিকে বাড়িয়ে দিলো তুল্য। তাথৈয়ের চেহারায় রাগ ফুটে উঠলো আবারো। কাগজটা না দেখেই ওটা তুল্যর হাত থেকে ছিনিয়ে নিলো ও। নিচে ফেলে দিয়ে চেচিয়ে বললো,

– কতোবার বলবো? হু? কতোবার বললে বুঝবি তুই? আই হ্যাভ নো ইন্টারেস্ট ইন ইওর দিস বুলশিট! গো টু হেল! জাস্ট গো টু হেল!

দ্রুতপদে নিজের ঘরে চলে গেলো তাথৈ। শব্দ করে দরজা লাগিয়ে দিলো। তুল্য ওর বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে জুসের গ্লাসে চুমুক দিলো। তারপর উকি দিয়ে নিচে পরে থাকা কাগজটা দেখলো ও। তৈয়ব আলফেজ পুনরায় সিগারেট মুখে পুরলেন। ধোয়া ছেড়ে কিঞ্চিৎ আফসোসের স্বরে বললেন,

– ও তোর কথা কোনোদিনই বুঝবে না তুল্য। বোঝার চেষ্টাও করবে না।

– মাইন্ড ইওর ওন বিজনেস মিস্টার আলফেজ। আমাদের ভাইবোনের বিষয়ে আপনার নাকটা না গলালেও চলবে।

স্পষ্টগলায় বলে দিয়ে বাবাকে পাশ কাটিয়ে আসে তুল্য। গ্লাসের জুস পুরোপুরি শেষ করে, রাগ নিয়ে গ্লাস ছুড়ে মারে ফ্লোরে। ফোন কানে তুলে হনহনিয়ে বেরিয়ে যায় বাসা থেকে।

যন্ত্রযানের ঢাকা পেরিয়ে সাভারের এক গ্রাম। গ্রাম বললে ভুলই হবে। এখানকার বাসিন্দারা শহরের চেয়ে কোনো অংশে কম সুবিধাভোগী না। রাজধানীবাসীর চেয়ে এরা বরং বেশিই সুখে আছে। জীবিকার তাগিদে এদের যেমন যেমন ঢাকায় ছোটা সহজ, তেমন মন চাইলেই গ্রাম্য পরিবেশে ডুব দিতে পারে এরা। সেখানকারই এক বাড়ির বারান্দার দরজায় লেখা, ‘প্রীতিকার্নিশ’। ইটের দেয়ালবিশিষ্ট টিনশেড বাড়িটা আকারে ইংরেজী L অক্ষরের মতো। ভেতরে তিনটে শোবার ঘর। বাইরে গ্রিল করা বারান্দার একপাশে রান্নাঘর, ডাইনিং টেবিল রাখা৷ ঠিক উল্টোপাশে ওয়াশরুম। বাড়িতে সামনে বড়সর একটা উঠান। ভেতরের তিনটে ঘরের একটার বিছানায় উপুর হয়ে শুয়ে আছে তাশদীদ। ঘরটায় বড়বড় দুটো জানালা। আলোবাতাসের একবিন্দু অভাব নেই। বেশ ছিমছামভাবে গোছানো পুরো ঘর। টেবিলের সামনের জানালার ওপারে মানিপ্লান্ট গাছ ঝুলছে। বাইরে তাকালে চোখে পরে এক পুকুর। বর্গাকার পুকুরটার চারপাশে সুপারী গাছ লাগানো। সেদিক তাকালে সবুজ আর সবুজ ছেয়ে থাকে চোখে। খোলা জানালা দিয়ে ভোরের পাখির কিচিরমিচির পুরোটা ঘরে ঢোকে। সুখময় এক আলোড়ন তুলে দেয় কর্ণকুহরে। মাথায় আলতো ছোঁয়া অনুভব করে তাশদীদ নড়েচড়ে উঠলো। চোখ বন্ধ রেখে মাথা তুলে দিলো উপস্থিত মমতাময়ীর কোলে। তার আঁচলের ঘ্রানে নাক ডুবিয়ে ঘুমুঘুমু কন্ঠে বলে,

– গুড মর্নিং মা।

– মর্নিং।

আরো আয়েশে মাকে জরিয়ে ধরলো তাশদীদ। শামীমা বেগম ছেলের চুলে আঙুল চালালেন। আদুরে গলায় বললেন,

– উঠবি কখন? নয়টা বাজছে।

– হুম? নয়টা বেজে গেছে? আচ্ছা আর দশমিনিট।

তাশদীদ আরো ভালো করে মায়ের কোলে শুয়ে পরলো। শামীমা বেগম নিশব্দে হাসলেন। এই দশমিনিটের নাম করে, তার কোনে আরো ঘন্টা চারেক ঘুমিয়ে নিতে জানে তাশদীদ। মুখে বললেন,

– না ওঠ। ফ্রেশ হয়ে খাবি চল। রাতে দেরি করে ফিরেছিস। কি না কি খেয়েছিস কে জানে?

মায়ের মুখে দেরি করে ফেরার কথা শুনে টেনেটুনে চোখ খুললো তাশদীদ। মায়ের মুখখানা দেখে সুন্দর একটা হাসি দিলো। শামীমা বেগমের এই স্নিগ্ধ মুখটা বলে দিচ্ছে, ও যে ফজরের নামাজ পরে বাড়িতে ঢুকেছে, তা তিনি ঘুনাক্ষরেও জানেন না। তার ওপর ডাক্তারের কড়া নির্দেশ আছে, দশটার মধ্যে ঘুমিয়ে যাওয়ার। আর ছেলের ওপর আছে তার অগাধ বিশ্বাস। দেরি করে ফেরাকে ওর বাবা যে নিসন্দেহে রাত এগারোটা বানিয়েছে, সেটা টের পেতে বেগ পেতে হয়নি তাশদীদের। কথা না বাড়িয়ে মাথা সরিয়ে নিলো তাশদীদ। উঠে বসে আশ্বস্তের স্বরে বললো,

– আসছি। এগোও তুমি।

ছেলের মাথার চুল এলোমেলো করে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন শামীমা বেগম। তাশদীদ বিছানা ছেড়ে গোসল করে নিলো একেবারে। টিশার্ট-ট্রাউজার পরে, মাথায় তোয়ালে চালিয়ে আয়নার দিকে এগোতে যাচ্ছিলো ও। তখন মোবাইলে ম্যাসেজের আওয়াজ হলো। তাশদীদ বিছানায় এগিয়ে মোবাইলটা হাতে নিলো। সেখানে থাকা ম্যাসেজটা দেখেই ঠোঁটে হাসি ফুটলো ওর। ঘর থেকে বেরিয়ে ডাইনিংয়ে বসে গেলো তাশদীদ। খেজুর মুখে দিয়ে বললো

– ছোটজন কোচিং থেকে আসেনি এখনো?

আওয়াজ শুনে খবরকাগজ নামিয়ে চশমাআটা চোখজোড়া বের করলেন ওয়াসীর সাহেব। একপলক কিচেনে তাকিয়ে বললেন,

– সে সময় হলে ঠিকই আসবে। কিন্তু আপনি কাল এতো বেশি দেরি করলেন কেনো?

– আর বলো না। লোকাল স্মৃতিসৌধের ওখানেই নামিয়ে দিয়েছে। যাত্রী নেই বলে আর এগোয় নি। এটুক হেটেহেটে এসেছি।

– লোকাল কেনো? কতোদুর গিয়েছিলে?

– সলিমুল্লাহ হলে।

– ওখানে কেনো?

ওয়াসীর সাহেবের বিস্ময়। পেপারটা নামিয়ে রাখলেন তিনি। তাশদীদের অকস্মাৎ যেনো কিছু মনে পরে গেলো। ও ফোনটা বের করে কল লাগালো কাউকে। কল রিসিভ হলে বললো,

– হ্যাঁ মামা? আমি যে সাইকেলটা দিয়ে আসলাম, ওটা ঠিক করা গেছে?

ওপাশের নাসূচক জবাব শুনে সন্তুষ্ট হলো না তাশদীদ। তাথৈয়ের ভেঙে দেওয়া সাইকেলটা মুলত ওর বন্ধুর ছিলো। তার টিউশনে যাতায়াতের মাধ্যম। সেটা ভেঙে যাওয়াতে মোটেও ভালোলাগছে না ওর। ওকে কল কাটতে দেখে ওয়াসীর সাহেব বললেন,

– কার সাইকেল? সেটার আবার কি হয়েছে?

– সিগমা রুল। প্রাণের বিনিময়ে যান। এক রাগান্বিতার সুইসাইড রুখতে বেচারা সাইকেলকে আত্মহুতি দিতে হয়েছে।

ঘাড় চুলকে বিরবিরিয়ে বললো তাশদীদ। ওয়াসীর সাহেব ছেলের দিকে ভ্রুকুচকে চেয়ে রইলেন। তাশদীদ পুনরায় ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বললো,

– এসব ছাড়ো। খুশির খবর শোনো। তোমাকে বলেছিলাম না, আমি মাস্টার্স কোর্সে এডমিশন এক্সাম দিয়েছি? ওটার রেজাল্ট দিয়েছে আজ। সিলেক্ট হয়ে গেছি।

– আলহামদুলিল্লাহ।

ওয়াসীর সাহেব খুশি হয়ে গেলেন। উনি রিটায়ার্ড মানুষ। তাশদীদ অনার্স শেষ করলো। কিন্তু ওর প্রচন্ড শখ ছিলো সেরা জায়গাটায় পড়ার। তাই সেখানের মাস্টার্স ভর্তি পরীক্ষায় বসেছিলো ও। চান্স পেয়ে যাবে, এমনটা ভাবেনি। কিন্তু ওয়াসীর সাহেবের পুর্নবিশ্বাস ছিলো তার ছেলের ওপর। ছেলের স্বপ্ন পুরন হবে জেনে কোন বাবা না খুশি হবে? শামীমা বেগম কিচেন থেকে রুটি আর আলুরদমের বাটি এনে ডাইনিং টেবিলে রাখলেন। আবারো কিচেনের দিকে পা বাড়ালে ওয়াসীর সাহেব খোশমেজাজে বললেন,

– শুনছো শামীমা? তাশদীদের এডমিশন হয়ে গেছে!

শামীমা বেগম থামলেন। খুশিতে জ্বলজ্বল করে উঠলো তার চোখ। তাশদীদ পেছনদিক ঘুরে বসলো। চেয়ারের পেছনে কনুই ঠেকিয়ে দৃষ্টিতাক করলো মায়ের প্রতিক্রিয়া দেখবে বলে। শামীমা বেগম দ্রুত এগিয়ে আসলেন। উত্তেজিত হয়ে বললেন,

– সত্যি?

তাশদীদ হেসে দিলো। মায়ের হাত ধরে তাকে বসালো পাশের চেয়ারটায়। আনন্দঅশ্রুতে ভেঙে পরলেন শামীমা বেগম। এটুকের জন্য তাশদীদ কতো রাত জেগেছে, কতো পরিশ্রম করেছে তা তার অজানা নয়। তাশদীদ মাকে থামানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু লাভ হলো না। স্ত্রীকে কাদতে দেখে ওয়াসীর সাহেব হেসে বললেন,

– এই বয়সে তোমার নাতিপুতির দাদীমা ডাক শোনা উচিত শামীমা। আর তুমি কিনা ছেলের ভর্তি কনফার্ম শুনে লাফাচ্ছো? পারোও!

তাশদীদ কপালে হাত ঠেকিয়ে মাথা নামিয়ে নিলো। এই একটা কথাতেই ওকে হার মানতে হয়। শামীমা বেগমের কাছে তাশদীদের বিয়ের টপিক মানেই দুনিয়ার বাকিসবকিছু বাদ। অথচ তিনি এটাও জানেন, তাশদীদ পড়াশোনা শেষ না করা অবদি বিয়ে করবে না। তবুও! ছেলের কাছে একমাত্র আবদার করার অবকাশ রাখেন না তিনি। আর এবারেও তার ব্যতিক্রম ঘটলো না। স্বামীর কথায় তৎক্ষনাৎ কথা পারলেন শামীমা বেগম। ছেলের দিকে ফিরে বললেন,

– ঠিকই তো! অনেক তো পড়াশোনা করলি বাবা। এবার তো একটা মেয়ে এনে দে আমাকে? তোদের তিনপুরুষকে আমি একাহাতে আর কতোদিন সামলাবো বল?

তাশদীদ কপাল থেকে হাত না সরিয়ে চোখ তুলে বাবার দিকে তাকালো। ওয়াসীর সাহেব খুশিমনে নিজের প্লেটে রুটি আর আলুরদম বাড়ছেন। তার হাসিটা দেখে তাশদীদের একটা কথাই মনে পরলো, ‘ধুরন্দর লোক একটা! বউয়ের কান্না থামাতে ছেলেকে চিপায় ফেলতে দ্বিতীয়বার ভাবলো না!’ শামীমা বেগম আবারো ছেলে বললেন,

– কিরে? কিছু বলছিস না কেনো? বলনা? গ্রাজুয়েশন তো শেষ! এবার তো বিয়েটা কর?

– ছাব্বিশ বছরে একটা প্রেম অবদি করতে পারলো না৷ তাকে কিসব বিয়েটিয়ের কথা বলছো মা? ওর দ্বারা হবেনা এসব। ছাড়োতো! পারলে আমার বিয়ের কথা ভাবো।

বছর চৌদ্দ-পনেরোর এক ছেলে ব্যাগ নিয়ে ভেতরে ঢুকলো। তাশদীদ চেয়ারের পেছনে পিঠ ঠেকিয়ে আরামে বসলো৷ ছেলেটা ব্যাগটা অন্য চেয়ারে রেখে, টেবিলে রাখা রুটিগুলোর দিকে হাত বাড়াতে যাচ্ছিলো। শামীমা বেগম ওর হাতে চাটি মেরে বললেন,

– একদম না তামজীদ! আগে…

তামজীদ মায়ের বলা শেষের আগেই রুটিগুলোর ওপরের একটা থেকে এককোনা ছিড়লো। বড় আলুরদমের বাটিটায় চুবিয়ে সেটা মুখেও পুরলো। তারপর চেয়ারে বসতে বসতে, রুটি চিবিয়ে বললো,

– তুই বেশি লেইট করলে এভাবেই ছোঁ মেরে তোর আগে বিয়ে করে ফেলবো ভাইয়া। রাজি আছিস কিনা বল?

– আমার সমস্যা নেই। সমস্যা হলো, মেয়ে যখন জানবে ছেলে জেএসসিতে অটোপাশ, তখনই ভাগবে। আমি নাহয় বিয়ে করছি না বলে হচ্ছে না। কিন্তু তোর তো ব্যাকগ্রাউন্ডের জন্য মেয়েই জুটবে না। স্যাড! ভেরি স্যাড!

ভাইয়ের কথায় চিবানো কমে আসলো তামজীদের। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ও তাশদীদের দিকে। যেনো সত্যিই ওর কপালে মেয়ে নেই, বিয়ে নেই। তাশদীদ হেসে নিজের প্লেটে খাবার নিতে লাগলো। শামীমা বেগম এবারেও হার মানলেন। চোখ পাকিয়ে তামজীদকে ফ্রেশ হতে আসতে বললেন তিনি। তামজীদ হেরে যাওয়া সেনার মতো করে উঠে গেলো। শামীমা বেগম নিজের খাবার সামনে নিলেন। ছেলেকে বললেন,

– তোর বাবা ইন্টারপাশ করে আমাকে বিয়ে করে এনেছিলো। আর তুই কিনা পড়াশোনা শেষ না করা অবদি বিয়ে করবি না বলে বসে আছিস? এমনও তো না যে তুই একেবারে হাত গুটিয়ে বসে আছিস, বেকার আছিস। তুই জানিস? আমার অনেক ইচ্ছে, আলতা পায়ে, বেনারসি পরে লাল টুকটুকে এ বাড়িতে তোর বউ আসবে। আমি তাকে মেয়ের আদর করবো৷ হাতে ধরে ধরে সব শেখাবো। একটু পরপর মেয়েলি আওয়াজ আমায় মা বলে ডাকবে। এই ছোট্ট প্রীতিকার্নিশ তার নুপুরের আওয়াজে রমরম করবে। বউ-শাশুড়ি সম্পর্ক পেরিয়ে, আমরা দুজন মিলে সখীদের মতো আড্ডা দেবো। এই বেপরোয়া তিন পুরুষকে দুই মা মেয়ে মিলে একদম ঠিকঠাক নিয়ম রীতিতে বেধে রাখবো। দেখবো তখন, কিকরে তোরা এতো অনিয়ম করিস!

রুটি মুখে তুলে হঠাৎই আনমনা হয়ে যায় তাশদীদ। প্রথমবার মায়ের বলা কথাগুলো মস্তিষ্কে নাড়া দেয় ওর। তাশদীদ মাথা ঝারা মারে, চোখ বন্ধ করে নেয় সম্মোহন ফিরে পেতে। কিন্তু তৎক্ষনাৎ চমকে উঠে চোখ খুলে নিতে বাধ্য হয় ও। অস্বাভাবিকভাবে হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেছে ওর। একটা শুকনো ঢোকে গলা ভেজানোর চেষ্টা করে, পানি মুখে নিলো তাশদীদ। কেমন যেনো দিনদুনিয়া ঘুরে ওঠা টাইপ অনুভূতি হচ্ছে ওর। কারন? মায়ের বলা আলতা আর নুপুরপরা পা, লাল টুকটুকে বউয়ের পরিবর্তে, অনাকাঙ্ক্ষিত কেউ ওর অতিনিকটে আগমন ঘটিয়েছে। আর সেটা অন্যকেউ নয়! শ্বাস শুনতে পাওয়া দুরুত্বে, ওর বুকপকেটে আঙুল বাঝিয়ে তীব্ররাগ নিয়ে দাড়িয়ে থাকা রাগান্বিতা, তাথৈ আলফেজ!

#চলবে…