কার্নিশ_ছোঁয়া_অলকমেঘ পর্ব-২৮+২৯+৩০

0
187

#কার্নিশ_ছোঁয়া_অলকমেঘ
লেখনীতে: মিথিলা মাশরেকা

২৮.

গলায় শীতল কিছুর স্পর্শ পেয়ে কেপে উঠলো তাথৈ। গলায় তাকিয়ে ও হাত ছোয়ালো চেইনে ঝুলতে থাকা লকেটটায়। ওটা দেখে দৃষ্টি প্রসারিত হলো ওর। এটা ওর সেই নাম লেখা লকেটটা, যেটা প্রথমবার তাশদীদের সাথে দেখা হওয়ার সময় রাগে ছুড়ে ফেলেছিলো ও। তাশদীদ সাইকেল থেকে নামলো। ডাববিক্রেতার দোকানের কাছে পৌছে সাইকেল থামিয়েছে ও। তাথৈয়ের চেইনটা এতোদিন ওর কাছেই ছিলো। সে রাতে তাথৈ লকেটটা ছুড়ে ফেলার পর ও সেটা কুড়িয়ে নিয়েছিলো। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো কোথাও দান করে দেবে। কিন্তু তারপরও তাথৈয়ের সাথে দেখা হয়ে যাওয়ার পর ও সিদ্ধান্ত বদলায়। এভাবে নাম লেখা লকেটটা নিসন্দেহে ওর কোনো আপনজনই দিয়েছে ওকে। তাই চেইনটা তাথৈকে ফিরিয়ে দেওয়ার কথা ভেবে নেয় ও। যেহেতু তাথৈকে সামনে বসিয়ে সাইকেল চালিয়ে ফিরেছে ও, ওকে চেইনটা পরিয়ে দেওয়ার জন্য এ সময়টাই যথাপোযুক্ত মনে হয়েছে তাশদীদের। সাইকেল থেকে নেমে ঠিকমতো সাইকেলটা দাড় করালে তাশদীদ। তাথৈকে ইশারা করলে নামার জন্য৷ তাথৈ নামলো। তবে ওর বিস্ময়ের রেশ কাটে না। তাশদীদ নিজের হুডি ঠিকঠাক করতে করতে বললো,

– জানি অনেক উপকার করেছি তোমার৷ থ্যাংকিউ দিতে হবে না। রাগটা কমিও।

তাথৈয়ের চোখ ভরে ওঠে৷ লকেটটা তৈয়ব আলফেজের দেওয়া। শেষবার এই লকেটটাই তাথৈয়ের জন্য কিনেছিলেন তিনি। ওর খুব ইচ্ছে করছিলো তাশদীদকে শক্ত করে জরিয়ে ধরতে৷ সেটা করলো না তাথৈ। সকালসকাল সমুদ্র দেখতে অনেকেই এসেছে। আশেপাশে কোলাহল। তাথৈ লকেটটা ধরে পা বাড়ালো হোটেলের দিকে। তাশদীদ আরকিছু বললো না। পেছন থেকে ওকে চলে যেতে দেখলো। সামনে থেকে দেখলে হয়তো বুঝতে, কেবল রাগ দেখাতে জানা রাগান্বিতার মাঝে হাজারো নতুন অনুভূতি তৈরী করে দিয়েছে সে। তাথৈ মুগ্ধতায় হাসছে, খুশিতে কাদছে।
তাশদীদ ডাবওয়ালার দিকে এগিয়ে গেলো এবারে। সে বালির ওপর চট বিছিয়ে ডাব কাটছিলো। তাশদীদ তাকে সাইকেলটা দেখিয়ে বললো,

– এইযে মামা সাইকেল। যেভাবে নিয়েছি, ওভাবেই ফেরত দিয়ে গেলাম। এবার আমাকে কতো ফেরত দেবেন দিন।

ডাব কাটা বাদ দিয়ে তাশদীদের দিকে আহম্মকের মতো হা করে তাকিয়ে রইলো লোকটা। কি বলছে কি এই ছেলে? কিসের টাকা ফেরত চাইছে সে? পাঁচ হাজার পুরোটা তাকে সে একেবারে দেয়নি? প্রেমিকা নিয়ে সাইকেলে চরে মজা নিলো, বিনিময়ে পাঁচ হাজার টাকা দেবে না সে? ফেরত চাইছে আবার? তাশদীদ তার চাওনি দেখেই বুঝলো তার মনে কি চলছে। একটা ছোট্ট দম ফেলে বললো,

– এই মামা শোনো, ও আমার কোনো গার্লফ্রেন্ড টার্লফ্রেন্ড না। টাকাটা তোমার কাছে বন্দক হিসেবে রেখে গিয়েছিলাম। এখন সাইকেল ফেরত দিয়েছি, টাকাটা দাও। আমার বাড়ির জন্য শপিং করা লাগবে। আর সবচেয়ে বড় কথা, ভার্সিটি-ট্যুরে এসেছি। খরচ আছে। আমার পকেটে আরকোনো টাকা নেই।

ভার্সিটির স্টুডেন্ট শুনে ডাববিক্রেতা আর একমুহূর্তও দেরি করলো না। কতো ছেলেপেলেরা এসে ভয় দেখিয়ে বিনা টাকায় ডাবেরজল খেয়ে যায়। ওদের সুবিধার মনে হয় না তার। কথা বাড়ালে ঝামেলা হতে পারে ভেবে পুরো টাকাটা তাশদীদকে দিয়ে দিলো সে। তাশদীদ টাকা গুনে দেখলো সেখানে পুরো টাকাটাই আছে। হেসে এক হাজারের একটা নোট আবারো দোকানদারকে ফিরিয়ে দিলো ও। বললো,

– এটা দিয়ে সাইকেলটা একটু ঘষেমেজে নিও। চেইনে জং পরেছে মনেহয়। আর বিকেলে বিশজনের একটা গ্রুপ নিয়ে আসবো। টাকা দিয়েই খাবো ডাব। এখানেই থেকো।

তাশদীদ হোটেলের দিকে পা বাড়ায়। খুশিমনে নিজের কাজে মন দেয় ডাববিক্রেতা। অভিজ্ঞতার খাতায় আজ আবারো জমা পরে, ‘সবাই এক না।’
তাথৈ রুমে ঢুকে দেখলো আলো সিনিয়রদের বিছানা ঠিকঠাক করছে। আর শার্লি সরু চোখে হাতের জামার দিকে তাকিয়ে আছে। তাথৈকে দেখেই ও বললো,

– সকালসকাল কোথায় গিয়েছিলি তুই?

– ওদের জিনিস কেনো গোছাচ্ছো?

আলোকে সরাসরি প্রশ্ন করলো তাথৈ। আলো নিজের কাজে মনোযোগ রেখে বললো,

– কাল দুপুর থেকে এই একই ড্রেসে আছো। যাও ফ্রেশ হয়ে চেন্জ করে নাও।

তাথৈ বুঝলো আলো ওর প্রশ্নকে পাশ কাটাতে চাইছে। শীতল দৃষ্টিতে শার্লির দিকে তাকালো ও। ওর চাওনি দেখেই ঘাবড়ে যায় শার্লি। গরগর করে বলতে লাগলো,

– সকালবেলা উঠে আমাদের কাজ ধরিয়ে দিয়ে, দুইটা ফেসপ্যাক লাগিয়ে ব্যালকনিতে বসে আরাম করছে। আলোকে বলেছে বেড গোছাতে, আমাকে বলেছে জামা ইস্ত্রি করতে। আমি কি এইসব পারি বল?

তাথৈয়ের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। শার্লির হাত থেকে জামা নিয়ে বিছানায় ছুড়ে মারলো ও। আলো ওকে থামাতে এগিয়েও পারলো না। তাথৈ হনহনিয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দেখে মেয়ে দুটো চেহারায় ফেইসপ্যাক লাগিয়ে সফটটুলে বসে। ফোনে একজন আরেকজনকে কিছু দেখাচ্ছে আর হাসছে। বারান্দার দরজায় নখে শব্দ করে বুকে হাত গুজে দাড়ালো তাথৈ। মেয়েদুইটা ওরদিক তাকালো। তাথৈ স্পষ্ট গলায় বললো,

– নিজেদের কাজ নিজেরা করতে পারেন না?

– পারি। কিন্তু করবো না। তোমরা থাকতে আমরা কেনো এতো কষ্ট করবো বলোতো?

নখ দেখতে দেখতে জবাব দিলো একজন। তাথৈয়ের গা জ্বলে ওঠে। ও জবাব দিলো,

– ওরা আপনাদের কাজ করবে না!

ওর জবাব শুনে আরেকজন মেয়ে উঠে দাড়ালো। এগিয়ে এসে একদম তাথৈয়ের সামনে দাড়িয়ে বললো,

– অনেক কথা বলতে জানো দেখছি। এই তুমি আগের সন্ধ্যায় ইচ্ছে করে আমাদের রুমে লক করে গিয়েছিলে। রাইট?

– জ্বী। অনেকবেশি আওয়াজ করে অনেক নির্লজ্জ কথাবার্তা বলছিলেন আপনারা। যাতে অন্যরুমে সাউন্ড না যায় তাই দরজা লক করে গিয়েছিলাম।

তাথৈয়ের যুক্তিতে আরকোনো কথা পায়না মেয়েটা। তবে রাগ হয় ওর। মেয়েটা চোয়াল শক্ত করে বললো,

– এতোই যখন ভেবেছো আমাদের নিয়ে, আমাদের কাজগুলো তুমিই করবে! এই তোমরা? সরো! বিছানাও ও গোছাবে, আর জামাগুলোও ওই…

মেয়েটা কথা শেষ করে না। তাথৈ একমুহূর্ত দাড়ালো না। হনহনিয়ে ভেতরে এসে বিছানার চাদর ধরে টান মারলো ও। ওর কাজ দেখে মেয়েদুইটা রীতিমতো পাথর হয়ে যায়। বিছানার ওপর থাকা ওদের একজনের ফোন, কয়েকটা সাজগুজের সরন্জাম নিচে পরে ভেঙে গেছে। ইস্ত্রি নিয়ে ওটা গরম করতে দিলো তাথৈ। একটা জামা নিয়ে উত্তপ্ত ইস্ত্রিটা তাতে ধরতে যাবে, এটা মেয়ে ছুটে এসে জামাটা কেড়ে নিলো ওর হাত থেকে। আরেকজন এসে নিচে পরে থাকা স্ক্রিনফাটা ফোনটা তুললো। জামা ধরে থাকা মেয়েটা বললো,

– এতোবড় সাহস তোমার! এইভাবে বেয়াদবী করছো! তোমার নামে কম্প্লেইন করবো আমি! বিছানা থেকে ফেলে ফোন ভেঙেছো, আমার জামাটাও পুড়িয়ে ফেলতে যাচ্ছিলে তুমি!

– কিন্তু আপনার বিছানার ধারেকাছে কেনো আসলাম আমি? আপনার জামাটাই বা আমার হাতে কি করে আসলো? আপনি কি আমাকে এমন কোনো কাজে বলেছিলেন?

দপ করে সবটুকো তেজ নিভে যায় মেয়েদুটোর। তাথৈ একদম গা ছাড়া ভাবে পাশ কাটিয়ে চলে আসলো ওদের। ব্যাগ থেকে নিজের জামাকাপড় বের করে ওয়াশরুমে যেতে গিয়ে, কি মনে করে ওদের সামনে থামলো। শান্তশীতল গলায় বললো,

– কেউ একজন আমাকে রাগ কমাতে বলেছে। তাই এটুকোতেই থামলাম। নইলে…এনিওয়েজ! নেক্সটটাইম, নট উইথ মি। প্লিজ! ওকে?

তাথৈয়ের কথা শুনে কথা বলা ভুলে যায় মেয়েদুটো। তাথৈ ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো। অনেকটা সময় শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে দেখে, রুমটা ঠিকঠাকমতো গোছানো। মেয়েদুটো রুমে নেই। আলো-শার্লি নিজেদের বিছানায় বসে মিটিমিটিয়ে হাসছে। যার মানে, ওরাই ঘর গুছিয়ে বেরিয়ে গেছে। মাথায় তোয়ালে চালিয়ে মুচকি হেসে ব্যালকনিতে গেলো তাথৈ। ঝলমলে আলোভরা চারপাশ দেখে মন খুশি হয়ে গেলো ওর। প্রথমবারের মতো ওর অনুভব হলো, বাইরের রোদ্দুরের মতো ওর মনটাও আজ উজ্জ্বল, সবুজের মতো ওর প্রাণটাও আজ সতেজ, সমুদ্রের নীলের মতো ওর সর্বাঙ্গে আজ স্নিগ্ধতা, মৃদ্যু বায়বের মতো ওর মস্তিষ্ক আজ শীতল।

তিনদিন দুইরাত ট্যুরের আজকেই শেষদিন। দুপুরের খাবারটা সেরে বিকেলে সবাই কেনাকাটা করতে বেরিয়েছে। ছন্নছাড়া হয়ে ইচ্ছেমতো জিনিসপত্র কিনছে সবাই। আলো ভিডিও কলে মা বোনকে দোকানের জিনিসপত্র দেখাচ্ছে। কোনটা ভালো লেগেছে জিজ্ঞেস করছে। কিন্তু ওরা কেউ কিছুই নিতে চাইছে না। কারন ওরাও জানে, আলোর কাছে টাকা নেই। আলো বুঝেছে ব্যাপারটা। আপাতত জিনিসপত্র দেখাতে লাগলো ও ওদের। যাওয়ার সময় কমদামী হলেও কিছু একটা নেবে এমনটা ভাবলো। শার্লি কেনার মতো কিছু পাচ্ছে না। এ দোকান, ও দোকান ঘোরার পরও কিছুই ওর মনমতো হচ্ছে না। তুল্য বাজার শুরুর দিকটায় এককোনে দাড়িয়ে সিগারেট টানছিলো। শার্লিকে দোকান ঘুরতে দেখছিলো চুপচাপ। শান্ত-তাশদীদ এখনো এদিকটায় আসেনি। একটা দোকানে ঝুলতে থাকা ঝিনুকের মালা চোখে পরে তুল্যর। বেশ সুন্দর ছিলো মালাটা। তুল্য এগোলো সেদিকে। মালাটা খুলে শার্লিকে ডাকলো ও। শার্লি চমকায়। তুল্য এগিয়ে এসে ঠোঁটে সিগারেট চেপে ধরলো। দুহাতে মালাটা শার্লির মাথার পেছনে ধরে একরাশ বিরক্তি বললো,

– এই খাটোখাটো চুলে কিচ্ছু মানাবে না। যা সর!

শার্লি মুখ ভেঙচিয়ে অন্যদিকে চলে গেলো। তুল্য দোকানীকে ফেরত দিলো মালাটা। আলো কয়েকটা দোকান ঘুরে এসে ওই মালাটাই হাতে নিলো। ছাড়া চুলগুলোতে গাজরার মতো করে গুজে ভিডিও কলে মাকে জিজ্ঞেস করলো কেমন দেখাচ্ছে? মায়ের সম্মতি পেয়ে মালাটা কিনে নিলো আলো।
কিছুটাসময় পর তাথৈ আসলো ওদিকটায়। মুলত তাশদীদকে খুজছিলো ও। ওর কেনার কিছু নেই। একসময় চোখে পরলো, তাশদীদ শুটকির দোকানগুলোর সামনে দাড়ানো। ফোনে কথা বলছে আর শুটকি দেখছে সে। ওপাশ থেকে মিসেস ওয়াসীর তাকে ফর্দ শোনাচ্ছে। বারো পদের শুটকি নেবার জন্য বলে কল কাটলেন তিনি। একটা লম্বা শ্বাস ফেলে দোকানে শুটকি প্যাকেট করতে বললো তাশদীদ। তাথৈ হাসলো নিশব্দে। ওকে হাসতে দেখে এগিয়ে আসলো শার্লি। বললো,

– তুই কখন এলি?

– সবেই।

তাশদীদদের দিক চেয়েই জবাব দিলো তাথৈ। ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে তাশদীদকে চোখে পরে শার্লির। ও তাথৈকে আনমনে পেয়ে বললো,

– হোয়াটস্ সো স্পেশাল আবাউট হিম তাথৈ?

– জানিনা। অল আই নো ইজ, এই মানুষটাকে দেখার পর আমি বাকি সবকিছু দেখার কথা ভুলে গিয়েছি।

খুশিতে শার্লির চোখ ভরে ওঠে। তাথৈয়ের এতো সহজ স্বীকারোক্তি শুনে ভেতরটা খুশিতে ঝুমঝুম করে ওঠে শার্লির। একটু সময় নিয়ে তাশদীদের দিকে তাথৈয়ের মুগ্ধ চাওনি দেখলো শার্লি। তুল্য ওকে ম্যাসেজে বলেছে, আগেররাতে তাশদীদের সাথে ছিলো তাথৈ। ওকে বেশি প্রশ্ন না করতে। আলতোকরে তাথৈয়ের কনুইয়ের ওপরদিকটা ধরে ওকে নিজের দিক ফেরালো শার্লি। তাথৈয়ের হুশ ফিরলো। শার্লি ওর স্বীকারোক্তি শুনেছে সেটা টের পেলো ও। তবে প্রতিক্রিয়া পাল্টালো না। শার্লি ফিসফিসিয়ে বললো,

– তুই প্রেমে পরেছিস তাথৈ…

– ইচ্ছে করে পরিনি। বিশ্বাস কর!

অসহায়ের মতোকরে জবাব দিলো তাথৈ। ওর চোখমুখে ফুটে ওঠা অসহায়ত্ব দেখে শার্লি বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো। এমন কাতর চেহারার তাথৈকে চেনেই না ও। যে তাথৈয়ের দৃষ্টি ফলার মতো তীক্ষ্ণ, যার হৃদয় পাথরের মতো কঠোর, যার কথার ভাজেভাজে বজ্রনাদ, ওর সামনে সেই তাথৈ না। ওর সামনে যেনো অন্য এক তাথৈ। যার চোখে এখন ওই একটা সাধারণ পুরুষের জন্য মুগ্ধতা, যার হৃদয়ে এখন তাশদীদের নামে শীতলতা, যার স্বরে এখন প্রেমসুলভ নম্রতা। একটু সময় নিয়ে হাসলো শার্লি। মাথা নেড়ে বললো,

– বলছিস কবে?

তাথৈ আবারো তাশদীদের দিকে তাকালো। ওরদিক একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললো,

– একজন আমাকে অনেকটা ভালোবেসেছিলো। তাকে হ্যাঁ বলেও কখনো ভয় হয়নি আমার। কিন্তু আজ যখন মনে হচ্ছে, আমি কাউকে ভালোবেসে ফেলেছি, প্রথমবারের মতো আমার ভয় হচ্ছে শার্লি।

শার্লির বিস্ময় বাড়লো। তাথৈয়ের চেহারায় সত্যিই ভয়ের রেশ। যে মেয়ে কখনো কোনোকিছু চাইলে তা নিয়ে আপোষ করতো না, আজ সে মেয়ে ভয় পাচ্ছে। পাওয়ার আগেই হারিয়ে ফেলার ভয়। তাথৈ বাহাত বুকে গুজে ডানহাতের কনুই বাহাতে ঠেকালো। গলার চেইনটার লকেটটা ধরে তাশদীদের দিকে তাকিয়ে রইলো ও।
তাশদীদের ফোন বাজে। রিংকির কল। শুটকির প্যাকেট হাতে নিয়ে কলটা রিসিভ করলো তাশদীদ। ওপাশ থেকে রিংকি বললো,

– কেমন আছেন তাশদীদ ভাই?

– আলহামদুলিল্লাহ ব্যস্ত। কোনো ইমারজেন্সি থাকলে দ্রুত বলো।

– আন্টি বললো আপনি শপিংয়ে গেছেন?

– হ্যাঁ। কেনো?

– আমার জন্য কিছু আনবেন না?

– কি চাই?

– আপনার পছন্দ করা ঝিনুকের মালা। ব্যস।

বিব্রত হলেও প্রকাশ করলো না তাশদীদ। ওকে বলে কলটা কাটলো। ঝিনুকের দোকানগুলোতে গিয়ে দুইটা একই মালা নিলো। রিংকি-রোজী দুজনের জন্য। চলে আসছিলো ও। হুট করে একটা বড় শঙ্খের দিকে নজর যায় ওর। তাশদীদ থামলো। আস্তেধীরে হাতে তুলে নিয়ে খুতিয়ে খুতিয়ে দেখতে লাগলো ওটা। শঙ্খটার ওপরের দিকে আটনয়টা খাজকাটা বাকা চুড়া আছে। একপাশ থেকে বড় থেকে ছোট হয়ে এসেছে খাজগুলো। হুবহু ঢেউয়ের মতো। খাজের আগা থেকে মাঝ অবদি আকাশী রঙটা হালকা হতে হতে সাদা হয়ে এসেছে৷ আর সেটা এতোটাই নিঁখুত যে, বোঝাই যাচ্ছে, শঙ্খের রঙটা সম্পুর্ন প্রাকৃতিক। তলার দিকে কোনো খাজ নেই৷ মৌখিক প্রান্ত দেখে নিয়ে মুচকি হেসে ওপরপাশ ঘুরাতেই একটুখানি থমকে যায় তাশদীদ। ওপরপাশের পিঠটায় বাকা হরফে খোদাই করা, ‘Tathai’. নাম খোদাই করা শঙ্খ নেওয়া তাশদীদের বিবেকে ঠেকলো। আবার এতো সুন্দর শঙ্খটা ছাড়তেও ইচ্ছে করছে না ওর। হাতে থাকা মালাদুটো দেখে পরমুহুর্তেই খুশি হয়ে যায় তাশদীদ। রোজীর মেয়ের কথা মনে পরলো ওর। হেসে দিয়ে দোকানদারকে শঙ্খটা প্যাক করে দিতে বললো ও।
একটা দোকান পরেই তাশদীদের বরাবর দাঁড়িয়ে ছিলো তাথৈ-শার্লি। তাথৈ স্পষ্ট দেখলো, তাশদীদ ওর নাম লেখা শঙ্খ কিনছে। ঠোঁটে হাসি ফোটে ওর। একটা দম নিয়ে ও শার্লিকে বললো,

– তবে আমি থেমে থাকবো না শার্লি। তাকে ভালোবাসার সাহসটা যখন দেখিয়েছি, ভালোবাসি বলে দেবার সাহসটাও আমি জোগার করে নেবো। ঠিক জোগার করে নেবো!

#চলবে…

#কার্নিশ_ছোঁয়া_অলকমেঘ
লেখনীতে: মিথিলা মাশরেকা

২৯.

ভ্রমনের শেষ সূর্যাস্তটা দেখতে লাবনী পয়েন্টে যাবে সবাই। কেনাকাটা শেষে আপাতত কফিশপ বসেছে বেশিরভাগই। শান্ত, টিটুদের সাথে তাশদীদ৷ তাথৈ-শার্লি একই টেবিলে। আলোকে দোকানে ঢুকতে দেখে থেকে হাত নাড়ালো শার্লি। আলো দেখলো তাথৈও সেখানে বসে। হাসিমুখে গিয়ে ওদের সাথে বসে গেলো আলো। কাধের ব্যাগটা নামিয়ে টেবিলে রেখে বললো,

– তোমাদের শপিং শেষ?

– আর শপিং! কিছুই পছন্দ হয়নি! কি কিনবো?

শার্লির জবাবে আলো হতাশ হলো৷ তবুও জোর গলায় বললো,

– আমাকে বলতে! আমি চুজ করে দিতাম! কি সুন্দর সুন্দর জিনিস সব, আর তোমার কিনা কিছুই পছন্দ হয়নি? এভাবে খালিহাতে বাসায় ফিরতে দিচ্ছি না তোমাকে। এখান থেকে বেরিয়ে আবারো দোকানে যাবো আমরা। ওকে?

– ছাড়ো মেরি মা! আমার এসব পোষায় না। আর ওমুখো হতে পারবো না! আমার কোনো ইচ্ছে নেই কিছু কেনার।

হাতজোড় করে বললো শার্লি। আলো তাথৈয়ের দিকে তাকালো। সে আয়েশে বসে মনোযোগ দিয়ে ওদের কথা শুনছে। আলো ওকে জিজ্ঞেসও করলো না কিছু কিনেছে কিনা। ও জানে, তাথৈ কিছু কেনে নি। নিজের কেনা দু তিনটে জিনিস ওদেরকে দেখাতে যাচ্ছিলো আলো। কিন্তু রিসেপশন থেকে টেবিলনম্বর বলায় ও শার্লির সাথে গেলো কফি আনতে। তাথৈ বাইরে তাকালো। কাচের দেয়াল পেরিয়ে ওর চোখে পরে কফিশপের সামনে। এক মহিলা ঝুড়িতে করে চুড়ি বিক্রি করছে। নিচে বসে তার কাছ থেকে চুড়ি দেখছে ওদের রুমের সেই মেয়েদুটো। এরমাঝেই তাশদীদ ফোনে কথা বলতে বলতে ওদের পাশ কাটিয়ে যায়৷ পরনে নেভি ব্লু শার্ট পরিহিত মানবকে চিনতে তাথৈয়ের দু সেকেন্ডও সময় লাগেনি। মেয়েদুটো কিছু একটা বলাবলি করলো। তারপর একজন একমুঠো চুড়ি নিয়ে দাড়িয়ে তাশদীদের পেছনপেছন এগোলো। তাথৈয়ের আগ্রহ বাড়ে। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালো ও। ঢোলাঢালা ছোট গোলজামাটার পকেটে দুহাত গুজে বেরিয়ে আসলো কফিশপ থেকে। বাইরে এসে দেখে মেয়েটা তাশদীদকে চুড়ি দেখিয়ে কিছু একটা বলছে। লজ্জা পাচ্ছে ও। মেয়েটা মুলত তাশদীদকে ওকে চুড়ি পরিয়ে দিতে বলছিলো। তাশদীদ জোরালো হেসে বললো,

– দোকানী খালা পরাতে পারে না?

– পারে। কিন্তু আমি আপনার হাত থেকে চুড়িগুলো পরতে চাইছি।

– কারন?

মেয়েটা একপা এগোয়৷ কিছুটা দুর থেকে তা দেখে তাথৈ হাতমুঠো করে নিলো। এই মেয়ে আসার পর থেকেই তাশদীদকে নিয়ে বলাবলি করে চলেছে। ও কেবল চুপচাপ শুনেছে। রাগ হলেও সেভাবে প্রকাশ করতে পারেনি। কারন কেনো রাগ হচ্ছে এ নিয়ে ও নিজের কাছেই নিরুত্তর ছিলো। কিন্তু এবার নিজের রাগের কারন স্পষ্ট বুঝলো তাথৈ। তবুও স্থির রইলো। এদিকে মেয়েটাকে দুরুত্ব ঘোঁচাতে দেখে বিব্রত হলো তাশদীদ। কিছুটা পিছিয়ে দাড়ালো ও। মেয়েটা তবুও ওর বেশ কাছাকাছি দাঁড়িয়ে বললো,

– ট্রেনে আপনার পাশের সিটটা আমার জন্য রাখবেন। কারনটা পথজুড়ে বলবো না হয়?

তাশদীদ বুঝলো ও কি বুঝাতে চাইছে। বাহাতে গালের ছোটছোট দাড়িগুলো ডললো ও। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে, বেশ শান্তস্বরে জবাব দিলো,

– লিসেন, আর অল্পকিছু মুহুর্ত এই সুন্দর জায়গাটায় আছি আমরা। ডোন্ট স্পয়েল ইট প্লিজ। তোমার হাতে চুড়ি পরানোর বা তার কারন শোনার, কোনোটারই ইচ্ছে আমার নেই। এন্জয় দ্যা ট্রিপ।

ফোনে তাকিয়ে মেয়েটাকে পাশ কাটিয়ে চলে যায় তাশদীদ। কিন্তু ওর কথা মেয়েটার গায়ে লাগলো না বোধহয়। হ্যান্ডসাম ছেলেদের এটিচিউড থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। হেসে আবারো চুড়িওয়ালার কাছে আসলো ও। মুঠোর বাকি চুড়িগুলো চাইলো। চুড়িওয়ালী মহিলা পাশে কাউকে দেখিয়ে জবাব দিলো,

– বাকিগুলা তো হেয় নিলো।

মেয়েটা পাশে তাকায়। কিন্তু সেখানে দাড়ানো তাথৈকে দেখে চেহারার রঙ পাল্টে যায় ওর। হালকা নীল রঙের জামা পরিহিত রমনীর হাতে ওর সেই গাঢ় নীল রেশমি চুড়িগুলোই। তাথৈ শক্তপোক্ত চেহারায় যৎসামান্য হাসিটা দেখে মেয়েটা থতমত খেয়ে যায়। তবুও নিজেকে সামলালো সে। জুনিয়রের সামনে ভয় তো আর প্রকাশ করা যাবে না। হাত বাড়িয়ে বললো,

– চুড়িগুলো দাও। এগুলো আমি আগে চুজ করেছি।

তাথৈ চুড়িগুলো তুলে ধরলো। কিন্তু সেগুলো দেবে বলে না। সর্বশক্তি প্রয়োগ করে একহাতেই ভেঙে ফেললো ও চুড়িগুলো। মেয়েটা বিস্ফেরিত চোখে একবার তাথৈকে দেখছে, তো একবার ওর হাত থেকে নিচে পরতে থাকা চুড়ির টুকরোগুলোর দিকে। সবগুলো চুড়ি ভেঙে নিচে ফেলে রক্তাক্ত হাতে পাঁচশ টাকার একটা নোট বের করে চুড়িওয়ালীকে দিলো তাথৈ। কাচের টুকরোয় ওর হাতের তালু ছিদ্র হয়ে গেছে কয়েকজায়গায়। তাথৈয়ের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। মেয়েটার দিকে একপা এগোলো ও। একদম সামনে দাড়িয়ে, ওর চোখে চোখ রেখে একবার ডানে, একবার নিজেরদিক, একবার মাথা কাৎ করে ঘাড় নাড়ালো। মেয়েটার বুঝতে বাকি রইলো না ও কি বুঝিয়েছে। নিরব সতর্কবাণী মেনে নিয়ে, আশপাশ দেখে দ্রুতপদে স্থানত্যাগ করলো সে। মাথায় কেবল ঘুরপাক খেতে লাগালো তাথৈ আলফেজের ইশারার পুর্ণরুপ, ‘তাশদীদ ওয়াসীর, আমার! বুঝেছো?’

ও চলে গেলে তাথৈ একটা ছোট্ট শ্বাস ফেললো। হাতের দিকে তাকিয়ে দেখে তালুতে ছোপছোপ কাটা দাগ। হাত ঝারা মারলো ও। তারপর কফিশপে ফেরত এসে চেয়ারে বসে গেলো। টেবিলে থাকা টিস্যু নিয়ে হাত মুছলো। এরমাঝে শার্লি কোথথেকে কফি নিয়ে ওর সামনে এসে বসে গেলো। তাথৈয়ের হাত তুলে ধরে বললো,

– তোর কষ্ট হয় না তাথৈ? ব্যথা লাগেনা?

– হচ্ছিলো। এজন্যই চুড়িগুলো ভেঙেছি। যাকগে। এসব ছাড়। আলো কোথায়?

নিজের মতো হাত মুছতে লাগলো তাথৈ। শার্লি জবাব দিলো না। কফি এনে তাথৈকে না পেয়ে আলো জিনিসপত্র রাখতে হোটেলে গেছে৷ আর আশপাশ দেখতেই শার্লির নজরে পরেছে সবটা। ও তেমনি খিচানো স্বরে বললো,

– দোষ ওই মেয়ের। আর তুই চুড়িগুলো ভাঙলি! নিজেকে কষ্ট দিলি!

– পৃথিবীর সবচেয়ে সুদর্শন, সুস্নিগ্ধ, সুপুরুষটাকে পছন্দ করাটা উন্নত রুচিবোধের প্রমান। এটাকে দোষ কি করে বলি বল? ওর তাশদীদকে পছন্দ, এজন্য চুড়ি ভাঙিনি আমি।

– এজন্যই ভেঙেছিস। আমি দেখেছি কি ঘটেছে ওখানে!

তাথৈ শার্লির দিকে একপলক তাকালো। শার্লি ওর চাওনি দেখে নিজের উত্তেজনা সামলালো। শান্ত উচ্চস্বরে সবাইকে তীরের দিকে এগোতে বললো। কফিশপ থেকে বেরিয়ে আসলো তাথৈ। তীরে শান্তদের ব্যাচের দশ বারোটা ছেলে হাসাহাসি করছে একজায়গায় দাড়িয়ে। তাশদীদও সেখানে। তাথৈয়ের সাথে শার্লিও বেরিয়ে এসেছে। তাথৈ কান্তিহীন হয়ে তাশদীদের হাসিমুখ দেখতে লাগলো। মৃদ্যুস্বরে বললো,

– রোদের মতো হাসতে জানা এই মানুষটাকে কার না পছন্দ হবে শার্লি বলতো? ঢেউয়ের মতো উচ্ছ্বল এই মানুষটাকে কে না পছন্দ করবে বল?

– ওকে শুধু ওই মেয়ে কেনো, পৃথিবীর বাকি সাতশো কোটি নিরানব্বই লক্ষ নিরানব্বই হাজার নয়শো নিরানব্বই জন মানুষও পছন্দ করুক। আমার তাতে কোনো আপত্তি নেই। কোনোদিন থাকবে না।

– কিন্তু হ্যাঁ। উদ্দেশ্য যাই হোক, যে তাশদীদের অস্বস্তির কারণ হবে, আমি তাকে মানতে পারবো না। ওর কাছে কেবল তারাই থাকবে, যারা ওর জন্য অনাকাঙ্ক্ষিত না, যাদের ও নিজের কাছে আসার অধিকার দিয়েছে। নয়তো ওর অনিচ্ছায় কেউ তাশদীদ কেনো, তাশদীদের ঘ্রাণটাও পাবে না। আমি পেতে দেবো না।

একহাত বুকে গুজে আরেকহাতে বুকের লকেটটা আঁকড়ে ধরে তাথৈ৷ তাশদীদরা সবাই সবাই গলাগলি করে সূর্যাস্ত দেখছে। তাদের সর্বডানে তাশদীদ। বা হাত টিটুর কাধে দিয়ে ডানহাত প্যান্টের পকেটে গুজে দাড়ানো ও। ওপারে সূর্যাস্ত হচ্ছে। উজ্জ্বল সূর্য ডুব দিচ্ছে ঢেউয়ের অতলে। পেছনে দাড়ানো তাথৈয়ের কেবল মুগ্ধতা বাড়ে। সুর্যাস্ত দেখতে এসে যেখানে সবার দৃষ্টি সীমা আঁকতে ভুলে যায়, তাথৈয়ের চাওনি স্থির রয় তীরে। তাশদীদ ওয়াসীরে।

হুল্লোড় বাধিয়ে নিজনিজ ব্যাগপত্র নিয়ে স্টেশন পৌছালো সকলে। ট্যুরের সময়সীমা শেষ। ফিরতি ট্রেন রাতের। স্টেশনের নামের সামনে আরেকদফা ছবি তুললো সবাই মিলে। গ্রুপ ছবিটাতে দেখা যায়, কিছু ছেলেমেয়ে অর্ধগোলাকার হয়ে দাড়িয়েছে। বাকিরা সামনে দিয়ে হাটু গেরে বসে গেছে। তাথৈ মেয়েদের পাশটায় শেষের দিকটায় দাড়ানো। তবে ও ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে না। ওর দৃষ্টি বরাবর। আর সেখানে শান্ত-টিটুর সামনে দুহাত ছড়িয়ে গায়ের ভর ছেড়ে বসেছে তাশদীদ।
ছবিপর্ব শেষ করে একেএকে ট্রেনে উঠে বসলো সবাই। বুক করা বগিটাতে সিট সামনাসামনি না। সবগুলো একমুখী। বগির প্রায় একেবারে পেছনে বসেছে তাথৈরা। উইন্ডো সিটটা তাথৈকে দিয়ে বাইরের দিকের সিটটায় বসলো শার্লি। কাধের ব্যাগ ধরে তুল্য ট্রেনে উঠে দেখলো শার্লি তাথৈয়ের পাশে বসেছে। আর সাতপাঁচ ভাবলো না ও৷ ঠিক পাশের সিটটায় গিয়ে বসে পরলো। শার্লির দিকে চেয়ে কাধ থেকে ব্যাগ নামালো তুল্য। তবে শার্লি ওরদিক তাকালো না। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে, নাক ডলার ভঙিমা করে হাসি লুকালো ও।
নিজের সিটটার পাশেরসিটেই তুল্যকে দেখে থেমে যায় আলো। ওপাশের জানালার সিটটা ওর। ট্রেন ছাড়ার আগে মায়ের সাথে একদফা ভিডিওকলে কথা বলবে বলে ব্যাগ রেখে নিচে নেমেছিলো ও। তুল্যকে দেখে আলো আমতাআমতা করে বললো,

– ত্ তুমি এখানে?

– কেনো? কোনো সমস্যা তোমার?

তুল্যর সরাসরি প্রশ্নে কি জবাব দেবে ভেবে পায়না আলো। তাথৈ একপলক ভাই-আলোর দিকে তাকিয়ে আবারো মোবাইলে মনোযোগ দিলো। শার্লি হাতলে হাত ঠেকিয়ে, সেহাতে ঠোঁটটুকু ঢেকে রেখে সামনে তাকিয়ে আছে। মুলত হাসি লুকাচ্ছে ও। আলো বললো,

– আব্…উ্ উইন্ডো সিটটা আমার তুল্য।

– তো? আমি কি তোমার সিটে বসেছি?

আলো আবারো আটকায়৷ অস্বস্তি নিয়ে শার্লির দিকে তাকালো ও। কোনোমতে বললো,

– শার্লি, তুমি ওই সিটটায় বসোনা। আমি এখানে তাথৈয়ের সাথে বসি।

– না না! আমি তাথৈয়ের সাথেই বসবো। কোনো সিটফিট চেন্জ করতে পারবো না।

একদম ঝারা গলায় জবাব দিলো শার্লি। এমন একটা ভাব নিলো, যেনো দুনিয়া উল্টালেও ও তুল্যর সাথে বসবে না। তুল্য শান্তমতোন ওর ভাবভঙিমা দেখলো শুধু। আলো পেছন ফিরে পুরো বগিটায় চোখ বুলালো। বাকিসব সিটে যে যার মতো বসে গেছে। সিট পাল্টে বসতে বলার মতো কাউকে খুজতে লাগলো ও। তুল্যর রাগ হলো। সিট থেকে বেরিয়ে আলোকে ধমক লাগিয়ে বললো,

– সমস্যা কি? ঢং কেনো করছো? আমি তোমার গায়ে পরতে যাবো নাকি?

ওর ধমকে চমকে ওঠে আলো। আশপাশ দেখে নিয়ে সিটে ঢুকে চুপচাপ বসে যায় ও। তুল্য শার্লির দিকে তাকালো। সামনে তাকিয়ে সেভাবেই মিটমিটিয়ে হাসছে ও। রাগে তুল্যর কপাল টনটন করতে শুরু করে দেয়। মনেমনে ওর জেদী সত্ত্বাটা তেজ দেখিয়ে বলে ওঠে,
‘দুরে থাকতে চাইছিস তো? থাক! তোকে যদি নিজে থেকে আমার কাছে আসতে বাধ্য না করি, আমিও তুল্য আলফেজ না! মনে রাখিস!’

ট্রেন ছাড়ার হুইসেল দিলো। মোবাইল থেকে চোখ না সরালেও মনোযোগ সরালো তাথৈ। চারপাশের কোলাহল কানে আসছে ওর। এতোগুলো ছেলেমেয়ের আওয়াজ। কিন্তু ও এতোজনের আওয়াজ শুনতে চাইছে না। এবার চোখ তুলে পাশে তাকালো তাথৈ। শার্লি কানে হেডফোন দিয়ে চোখ বন্ধ করে গান শুনছে। ওপাশে তুল্যও ফোন স্ক্রল করছে। তার ওপাশে আলো বই পড়ছে। ফোনটা অফ করলো তাথৈ। ঘাড় ঘুরিয়ে খোলা জানালায় তাকালো। বাইরে রাতের আধার। ট্রেন ছুটছে। পেছনে ফেলে যাচ্ছে কেবল আলোর ছোটছোট উৎসগুলো। এর বাইরে আর কিছুই দেখা যায় না। কিছুসময়ের ব্যবধানে সুরেলি আওয়াজ কানে আসে সবার।

তাথৈয়ের চোখ চকচক করে ওঠে। হাতের আঙুল ফোটানোর শব্দ, স্টিলের চামচ আর কাচের গ্লাসের টুংটাং, ট্রেনের দেয়ালের হস্ত-তবলা, খালিগলার বাদ্যযন্ত্র, হাতেতালি শুনতেই চঞ্চল শশকের মতো উঠে দাড়ালো ও। বগির সামনের দিকটায় চোখ বুলালো ব্যস্তভাবে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে দেখলো না। তাশদীদকে দেখা যাচ্ছে না ওখানে। শান্ত টিটুও নেই। সামনের একঝাঁক ছেলেমেয়ে তখন মিলিতকন্ঠে সুর তুলেছে, ‘তারা রারা রাততারা রাততারা…’
গানে যুক্ত হয় গিটার। তাথৈ বসে গেলো। জানালা দিয়ে মুখ বের করে অনুসরন করলো গিটারের শব্দকে। ট্রেন কিছুটা বাঁক নিয়েছে। ট্রেনের ভেতরের লাইটগুলো দরজা অবদি যায়। যারফলে তাথৈ স্পষ্ট দেখতে পেলো, সামনের দরজায় নিচেই বসে গেছে তাশদীদ। গায়ে একটা নেভি ব্ল শার্ট। সামনের বোতাম সবগুলো খোলা বলে ভেতরের সাদা টিশার্ট দেখা যাচ্ছে ওর। তাশদীদ কোলে গিটার নিয়ে, হেলান দিয়ে বসে। তালেতালে মাথা নাড়াচ্ছে, গিটার বাজাচ্ছে আর উচ্চস্বরে গাইছে,

‘ফিকে হয়ে আসা অন্ধকার,
প্লাটফর্মে ধোঁয়া ওঠা চায়ের ভাঁড় (ii)
জানলার কাঁচটাতে লেগে থাকা শূণ্যতা
সশব্দে ছুটে চলে ট্রেন!
ফেলে আসা মুখগুলো ভোরবেলায়
লুকোচুরি আর চোর চোর খেলায়(ii)
কুয়োতলা মুখোমুখি জড়তার বাধা ঠেলে
আমাকে কি কিছু বলছেন?
বলতে পারিনি তার যেটুকু যা ভাষা ছিল
কেঁপে ওঠা চোখের পাতায়
তারপর ভোরবেলা ডিঙিয়েছি চৌকাঠ
ভয়ানক সতর্কতায়!
এভাবেও ফিরে আসা যায়,
এভাবেও ফিরে আসা যায়! (ii)

জানালায় দুহাত হাত রেখে তাতে মাথা ঠেকালো তাথৈ। অপেক্ষা করতে লাগলো দ্বিতীয় কোনো বাঁকের। আবারো তাশদীদকে দেখবে বলে। গান শেষ করে তাশদীদ। ওর সামনে টিটু শান্ত বসে আছে। ওদের ক্লাসের মেয়েরা, জুনিয়ররাও গান গাইতে লাগলো। তাথৈ আর তাশদীদের গলা শুনতে পেলো না। একটাসময় দেখলো তাশদীদ ট্রেনের দরজায় পা ঝুলিয়ে বসেছে। কি ভেবে খুশি হয়ে যায় তাথৈ। সিট থেকে উঠে পেছনের দরজায় চলে যায় ও। তুল্য দেখলো ওকে চলে যেতে। তবে শার্লি টের পায়নি। বেশ কিছুটা সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরেও বোনকে ফিরতে না দেখে তুল্য কপাল কুচকালো। হাত বাড়িয়ে একটা চড় লাগালো শার্লির মাথায়। চমকে ওঠে চোখ মেলে শার্লি। তুল্য বললো,

– তোর বান্ধবী কোথায় গেলো?

শার্লি কানে না শুনেও ঠোঁট নাড়ানো দেখে বুঝলো তুল্য কি বলেছে। পাশে তাকিয়ে দেখে তাথৈ নেই। কান থেকে হেডফোন নামিয়ে পিছনের দরজায় চলে আসলো ওউ। এসে দেখে তাথৈ একহাতে দরজার হাতল ধরে চলন্ত ট্রেনে পা ঝুলিয়ে বসে আছে। চোখ বন্ধ করে যেনো গায়ে লাগা বাতাস অনুভব করছে সে। শার্লির চোখ কপালে উঠলো। চেচিয়ে উঠে পা ধরে টান মারে তাথৈয়ের। ওকে পিছিয়ে এনে উচ্চস্বরে বলে,

– কি করছিস টা কি তুই? পাগল হয়ে গ্…

তাথৈ জবাব দিলো না। নিজেনিজেই চুপ করলো শার্লি। তাথৈ আবারো এগিয়ে গিয়ে পা ঝুলিয়ে বসলো। দরজার হাতল ধরে, পূর্বের মতোই চোখ বন্ধ করে নিয়ে বললো,

– এই বাতাস তাশদীদকে ছুঁয়ে আসছে শার্লি। আমি ওদের উপভোগ করতে চাই, অনুভব করতে চাই। কিছু হবে না আমার। লেট মি বি।

শার্লি বিমূঢ় হয়ে চেয়ে রইলো তাথৈয়ের দিকে।
এতো প্রেম! এতো ভালোবাসা! হুট করে ভেতরটা চমকে ওঠে শার্লির। অজান্তেই ওর মন বলে ওঠে, ‘যে প্রেম এমন, তার পরিণয়টা যেনো আঘাতের না হয়। তাথৈ ভালোবেসে ভালো থাকুক। যে কোনো মূল্যে!’

#চলবে…

#কার্নিশ_ছোঁয়া_অলকমেঘ
লেখনীতে: মিথিলা মাশরেকা

৩০.

ঠিক দুপুর বারোটায় অম্বুনীড়ে ঢুকলো তাথৈ। বাসায় ঢুকেই ড্রয়িংরুমের সোফায় মাকে বসে থাকতে দেখে দাড়িয়ে গেলো ও। ভদ্রমহিলার পরনে পাতলা মেরুন শাড়ি, হাতাকাটা ব্লাউজ। কিছুটা দুরেই তৈয়ব আলফেজ পায়চারি করছেন। একহাতে সিগারেট ধরে আরেকহাতে মোবাইল স্ক্রল করছেন তিনি। তাথৈকে দেখে ওর মা দাঁড়িয়ে গেলো। হাসিমুখে এগিয়ে এসে, তাথৈয়ের মুখের দিকে হাত বাড়িয়ে বললো,

– এসে গেছো তুমি? কেমন আছো বেইবি? ট্যুর কেমন…

– দুরে থাকুন।

একপা পিছিয়ে বললো তাথৈ। ওর এমন শক্ত ব্যবহারে মহিলার হাসি কমে আসছিলো। তবুও জোরপুর্বক হাসলো সে৷ তৈয়ব আলফেজ মেয়ের গলা শুনে তাকিয়ে দেখলেন তাথৈ ফিরেছে। ফোন নামিয়ে সিগারেটে টান দিলেন উনি একটা। তাথৈ একপলক বাবার দিকে তাকিয়ে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াচ্ছিলো। তৈয়ব আলফেজ বললেন,

– দাড়াও তাথৈ।

– টায়ার্ড আমি। মেলোড্রামা চাইছি না।

সিড়িতে দাড়িয়ে, কিঞ্চিৎ ঘাড় ঘুরিয়ে জবাব দেয় তাথৈ। তৈয়ব আলফেজ সিগারেট শেষ করলেন। এ্যাশট্রেতে সিগারেটের শেষটুকো রেখে এগিয়ে এসে বললেন,

– আমিও চাইছি না। তোমার জন্মদাত্রী তোমাকে কিছু বলতে চায়। তার কথা শুনে, তাকে বিদায় দিয়ে, দেন গো হোয়ারএভার ইউ ওয়ান্ট।

বাবার গম্ভীর কথাগুলো তাথৈ ফেলনা করে দিতে পারলো না। পেছন ফিরে মাকে বললো,

– কি চাই?

মহিলা আবারো হেয়ালী হাসি ফুটালেন ঠোঁটে। তার ধূর্ত মুখ দেখে হাত মুঠো করে নিলেন তৈয়ব আলফেজ। ঘুম থেকে উঠে প্রাক্তন স্ত্রীকে দেখে পায়ের তলা রি-রি করে উঠেছিলো তার। যে স্ত্রী কিনা টাকার লোভে ডিভোর্সপেপারে সই করে তাকে ছেড়ে গিয়েছিলো, এতোগুলো বছর পর তাকে দেখে অতিকষ্টে নিজেকে সামলেছেন তিনি। শুধুমাত্র তর্কে যাবেন না বলে ওই মহিলাকে অম্বুনীড়ে ঢুকতেও দিয়েছেন। মা হিসেবে তার অধিকার আছে নিজের সন্তানদের সাথে দেখা করার। তাথৈয়ের ফেরা অবদি ধৈর্য্যও রেখেছেন। তিনি জানেন, তাথৈ কখনোই ওর মায়ের কথাকে গুরুত্ব দেবে না। বরং এতোদিন পর ফিরে আসা মাকে নিসন্দেহে অপমান করবে। আর সেটাই হবে ওই মহিলার মুক্ষম প্রতিত্তোর। ভদ্রমহিলা তাথৈয়ের দিকে এগোলেন। তাথৈয়ের ‘কি চাই’ প্রশ্নের জবাবে একটা গা-জ্বালানো হাসি দিয়ে বললেন,

– তোমাকে।

তাথৈয়ের কপাল কুঁচকে আসলো। কথাটা শুনে বাবার দিকে তাকালো ও। তৈয়ব আলফেজ নিজেও অবাক। তিনি ভেবেছিলেন তার প্রাক্তন স্ত্রী কেবল ছেলেমেয়ের সাথে দেখা করার জন্যই এসেছে। কিন্তু সে যে তাথৈকে দাবী করে বসবে, এমনটা ধারনা করেননি তিনি। নিজের বিস্ময় সামলে তৈয়ব আলফেজ গম্ভীর স্বরে বললেন,

– মানে কি?

– আমি তাথৈকে আমার সাথে নিয়ে যেতে চাই তৈয়ব। আজ থেকে ও আমার সাথেই থাকবে।

– কি বলছো টা কি তুমি?

হুংকার ছাড়লেন তৈয়ব আলফেজ। তবে তার ধমক ভদ্রমহিলা গায়ে মাখলেন না। গায়ে মাখালে চলবে না তার। কেননা তাথৈকে তার প্রয়োজন। কোনোরুপ ভনিতা না করে ভদ্রমহিলা বেশ স্বাভাবিক স্বরে বললেন,

– দেখো তৈয়ব, তুল্য-তাথৈ আমার গর্ভজাত। এতোগুলো বছর আমি দেশে ছিলাম না, তুমি ওদের দেখাশোনা করেছো। কিন্তু এখন যেহেতু আমি দেশে, আমি চাইছি ওদের একজনের দায়িত্ব নিতে। ভেবে দেখলাম তোমার নিজের ব্যবসা আছে, উত্তরাধিকার হিসেবে তুল্যকে তোমার প্রয়োজন। তাই ওকে নিয়ে কিছু বলছি না। কিন্তু তাথৈয়ের কাস্টাডি আমি নেবো। তাথৈ এখন থেকে আমার কাছেই থাকবে। ইভেন আজ থেকেই ও আমার কাছে থাকবে। আমি ওকে নিতে এসেছি।

তৈয়ব আলফেজ নিজের কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। কতোটা নির্লজ্জ হলে কোনো মা তার সন্তানদের ছেড়ে গিয়ে আবার ফিরে এসে এমন দাবী করতে পারে তার জানা নেই। বাসায় ঢুকে এমন কথা শুনে পায়ের গতি কমে আসে তুল্যর। চোখ বুলিয়ে বাবা-বোনের প্রতিক্রিয়া পরখ করলো ও। স্টেশন থেকেই ও সরাসরি বুজোকে আনতে গিয়েছিলো। বাসায় ঢুকে এই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির শুরু বোঝার চেষ্টা করতে লাগলো তুল্য। বুজো ওর কোল থেকে নেমে ছুট লাগালো৷ সোজা কয়েকসিড়ি বেয়ে উঠে তাথৈয়ের পা শুকতে লাগলো ও। বুজোকে দেখে ভদ্রমহিলা উৎসাহে বললো,

– আরে বুজো! ও তোমার কাছে ছিলো তাথৈ?

তাথৈ জবাব দিলো না। দাঁতে দাঁত চেপে, শক্তমুঠো করে সিড়ির হাতল আঁকড়ে ধরে আছে ও। মহিলা বুজোকে কোলে তুলে নিলেন। আদুরে গলায় বললেন,

– ও মাই বেটা! কোথায় ছিলে তুমি? কতো খুজেছি তোমাকে! চলো বাসায় যাবো আমরা।

বুজো শরীর মোচড়াচ্ছে। থাকতে চাইছে না তার কোলে। ভদ্রমহিলা ছেড়ে দিলো বুজোকে। ও আবারো গেলো তাথৈয়ের পায়ের নিচে। মহিলা হেসে বললো,

– আচ্ছা বাবু, তাথৈয়ের কাছেই থেকো তুমি। আমরা একসাথে থাকবো সবাই ওকে?

বুজো তাথৈয়ের পায়ের আশপাশে ঘুরতে থাকে। ভদ্রমহিলার কথা-তামাশা সহ্য হলো না তুল্যর। সোজা বাবার দিকে এগোলো ও। হাত বাড়িয়ে মাকে দেখিয়ে বললো,

– এই মহিলা অম্বুনীড়ে কেনো? আপনার কি আবার নতুন করে সংসার গড়ার শখ হয়েছে মিস্টার আলফেজ? ইনি…

তৈয়ব আলফেজ এমনিতেও রেগে ছিলেন৷ ছেলের কথায় তিনি জ্বলে উঠলেন আরো। তুল্যর দিকে ভয়ানক চাওনি রেখে, ওর নাম ধরে গর্জন তুললেন অম্বুনীড়ে। একপ্রকার কেপে ওঠে অম্বুনীড়। তুল্যও এই প্রথমবার বাবার ধমকে ভয় পেয়ে যায়। বিচলিত হয়ে পরে কিছুটা। তৈয়ব আলফেজ ওর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তাথৈয়ের দিকে তাকালেন। স্পষ্ট গলায় বললেন,

– আর তুমি! তুমি চাইলেই ওর সাথে চলে যেতে পারো। কিন্তু একটা কথা মাথায় রেখো তাথৈ! ওর সাথে গেলে তুমি আলফেজ গ্রুপের কিছুই পাবে না! এই সম্পত্তির এক কানাকড়িও তোমাকে দেবো না আমি!

– তার প্রয়োজনও হবে না তৈয়ব। তাথৈয়ের মায়ের তোমার চেয়ে কোনোঅংশে কম নেই যে ওকে তোমার সম্পত্তির আশা করতে হবে।

স্ত্রীর উচ্চস্বরের জবাবে আরো ক্ষেপে যান তৈয়ব আলফেজ। জবাব দিতেই শুরু হয় তাদের কথা কাটাকাটি। তুল্য মা-বাবার ঝগড়া ছাপিয়ে বোনের দিকে তাকালো। এতোক্ষণ অটল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও বাবার কথার যেনো গায়ের জোর কমে এসেছে তাথৈয়ের। দুনিয়ার সবচেয়ে অসহায় মেয়ের মতো দেখাচ্ছে ওকে। যার মা নিজের উদ্দেশ্যের জন্য ওকে নিয়ে যেতে চাইছে, আর বাবা সম্পর্কের পরোয়া না করে সম্পত্তির দোহাই দিচ্ছে। শক্ত চোখমুখ নেতিয়ে পরেছে তাথৈয়ের। বাবার দিকে অসহায়ের মতো করে তাকিয়ে আছে ও। তুল্য স্পষ্ট দেখলো, তাথৈয়ের চোখ জলে ভরা। সে চোখজোড়া চেচিয়ে বলছে, ‘আমাকে কি কেবল সবার উত্তরাধিকার বানাতেই দরকার? আমার প্রয়োজনীয়তা এটুকোই?’ চোখ বেয়ে টুপ করে একফোঁটা জল গরায় তাথৈয়ের। তৎক্ষনাৎ হুশে ফেরে ও। একটা দম নিয়ে আবারো নিজেকে শক্ত করে সিড়ি থেকে নেমে আসলো। তারপর সিড়ির পান্তে থাকা ফুলদানীটা তুলে আছাড় মারলো।
ভাঙার আওয়াজ শুনে থেমে যান তৈয়ব আলফেজ আর তার মিসেস। তাদের থামতে দেখে তাথৈ মায়ের দিকে এগোলো। অতি শান্তশিষ্টভাবে বললো,

– আমি আপনার সাথে যাচ্ছি না।

– তাথৈ…! এ্ এ কি বলছো তুমি বেইবি? মমির সাথে চলো? আমি অনেক আদর করবো তোমাকে। তুমি *** ইন্ডাস্ট্রিজের নাম শুনেছো তো। ওটার ফিফটি পার্সেন্ট হোল্ডার আমি তাথৈ! আই হ্যাভ মাচ মোর দ্যান ইউর ড্যাড বেইবি। আর আমার সবই তো তোমার। চলো তুমি? আমার…

– গেট আউট।

তাথৈয়ের বলা এই দুইশব্দে অনর্গল বলতে গিয়ে থেমে যায় ভদ্রমহিলা। অবিশ্বাসে চেয়ে রয় তাথৈয়ের দিকে। তাথৈ তেমনি শান্ত ভঙ্গিতে বললো,

– আপনি ভদ্রভাবে না বেরিয়ে গেলে আমি অভদ্রতা দেখাতে বাধ্য হবো। এন্ড ট্রাস্ট মি, তৈয়ব আলফেজের সংবরনশক্তির চেয়ে তাথৈ আলফেজের ক্ষোভ কয়েকসহস্র গুন বেশি। দেখাতে শুরু করলে আপনি টলারেট করতে পারবেন না।

ভদ্রমহিলা চুপ করলেন। সাথে রাগও করলেন। মেয়ের অবাধ্যতা আগেও দেখেছিলেন তিনি। কিন্তু আজ সেই মেয়ে তাকে ধমকিও দিচ্ছে, অপমানও করছে। তুল্য বিশ্বজয়ের হাসি দিলো একটা। ওর মা যে ওর বিষয়ে কিছু ভাবেনি এ নিয়ে ওর আফসোস নেই। বরং কিছু বললেই আজ ও কান্ড ঘটিয়ে দিতো। ডাইনিং টেবিল থেকে একগ্লাস পানি খেলো তুল্য। তারপর চেয়ারে পায়ের ওপর পা তুলে বসে আঙুর চিবোতে লাগলো। তাথৈ বাবার সামনে গিয়ে বললো,

– আলফেজ গ্রুপের কানাকড়ির লোভে আমি আমার গর্ভধারীনী মা কে ত্যাগ করলাম ড্যাড। ধন্য তোমার শিক্ষা। টাকার লোভে আমি সব ছাড়তে পারি।

তাথৈ নিজের ঘরে চলে আসছিলো। কিন্তু বুজো আবারো ওর পা আগলে দাড়ায়৷ প্রথমবারের মতো তাথৈ বুজোর দিকে নমনীয়ভাবে তাকালো। মাকে বললো,

– আর হ্যাঁ! বুজোও আর আপনার কাছে ফিরছে না! তাথৈ, বুজো কেউই আপনার খেয়ালী ইচ্ছার দাস দাসী না যে যখন আপনার খুশি তখন আপনার কাছে থাকবে, যখন আপনার ভাল্লাগবে না তখন অন্য কোথাও। কাম বুজো।

সিড়ি বেয়ে ওপরে চলে যায় তাথৈ। বুজোও ওর সাথে দৌড়াতে দৌড়াতে চলে গেলো৷ তৈয়ব আলফেজ ক্লান্ত পায়ে সোফায় এসে আয়েশে বসলেন। পুনরায় সিগারেট ধরিয়ে তাতে কয়েকটান দিলেন। ধোয়া ছেড়ে স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

– তোমার মাতৃত্ববোধ তো কাজে লাগেনি। এখন কি করবে?

ভদ্রমহিলা এমনিতেও রাগে, দুঃখে, অপমানে ফুসছিলেন। স্বামীর কথায় তারদিক তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছুড়লেন তিনি। বললেন,

– যেকরেই হোক, তাথৈকে আমি নিয়ে যাবো তৈয়ব। ওর জন্য এরচেয়ে বেশি লাক্সারিয়াস একটা ভবিষ্যৎ ভেবেছি আমি। আর তার জন্য যা করার, আমি সেই ব্যবস্থাই করবো।

মহিলা হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলো। কিন্তু তার বলা ‘বেশি লাক্সারিয়াস ভবিষ্যৎ’ কথাটা তৈয়ব আলফেজের কানে বাজছে। টাকাপয়সায় কোনোদিকে কমতি নেই তাথৈয়ের। তাহলে ওই মহিলা ভবিষ্যৎ বলতে কি বুঝালো? তুল্য আঙুল দিয়ে দাঁত খোচাতে খোচাতে বাবাকে বললো,

– সম্পত্তির কথা তাথৈকে না বললে চলছিলো না?

– তোমাদের ও ছাড়া আর কোনো পিছুটান আছে?

একপলক চোখ তুলে বাবার দিকে তাকালো তুল্য। সে চোখে যেনো বাবাকে বুকে জড়িয়ে ধরতে না পারার কষ্ট, ভালোবাসা প্রকাশ না করার পিছুটান। তৈয়ব আলফেজ বুঝলেন, সে দৃষ্টিতে আবেগ লেখা ছিলো। তবুও মানলেন না। সোফায় রাখা কোটটা তুলে অম্বুনীড় থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনিও।

বাসায় আসতেই তাশদীদের ব্যাগ খুলে বিছানায় ছড়িয়ে বসেছে তামজীদ। কক্সবাজার থেকে ভাই কি কি এনেছে সব বের করে দেখছে ও। মিসেস ওয়াসীর খাবারের ট্রে হাতে করে রুমে ঢুকে দেখলেন তাশদীদ রুমে নেই। তবে ওয়াশরুম থেকে কল ছাড়ার আওয়াজ আসছে। মিসেস ওয়াসীর টেবিলে খাবার ট্রে টা রাখলেন। ছোটছেলেকে শাষনের স্বরে বললেন,

– এসব কি তামজীদ? তোর এখনই এসব বের করা লাগবে? ছেলেটা আমার ফ্রেশ হয়ে এসে যে বসবে, সে জায়গাটাও রাখিস নি!

তামজীদ চকলেট একটা ছিড়ে খেতে লাগলো। আরেকহাতে আরেকটা পাপড়ির প্যাকেট ছিড়তে ছিড়তে বললো,

– তোমার ছেলের চয়েজ ভালো। ভালোভালো জিনিসই এনেছে।

– সেটা আপনাকে বলতে হবে না। এইযে যে কয়েকটা মুখে পুরেছেন, এক্ষুণি এসব নিয়ে বিদেয় হন। ছেলেটা আমার ক্লান্ত! ও এসে একটু রেস্ট…

মিসেস ওয়াসীর বিছানা গোছাতে লাগলেন। তাশদীদ গোসল শেষে শুধু ট্রাউজার পরে খালি গায়ে রুমে ঢুকলো। মাথায় তোয়ালে চালিয়ে বসে গেলো টেবিলে। মায়ের আনা খাবার খেতে খেতে বললো,

– বাবা কোথায় মা? কলেজে?

– হুম।

– তোমার শুটকির ব্যাগটা পেয়েছো? ওটা আমি আলাদা এনেছিলাম।

মিসেস ওয়াসীর বিছানা গুছিয়ে ছেলের কাছে আসলেন। তাশদীদের মাথা ঠিকঠাক মুছতে মুছতে বললেন,

– হ্যাঁ পেয়েছি। তুই বল, কেমন কাটলো তিনদিন?

– ভালোই কেটেছে। বাট মিসড ইউ।

মিসেস ওয়াসীরকে যাত্রাবর্ণন শুনাতে লাগলো তাশদীদ। তামজীদ মা ভাইয়ের কথোপকথনে মনোযোগী হলো না। ব্যাগের বোতল রাখার জায়গাটায় হাত ঢুকিয়ে একটা বোতল খুজে পেলো ও। ভেতরে শেওলা সদৃশ কিছু দেখা যায়। তামজীদ বোতল পরখ করে বললো,

– কিরে ভাইয়া? শুনেছি তুই নাকি নিজেই ব্রিলিয়ান্ট। এখন তোরও কারো পা ধোঁয়া পানি লাগে নাকি?

খাওয়া থামিয়ে ভাইয়ের দিকে তাকালো তাশদীদ। হিসেব করে দেখলো, সত্যিই বোতলের পানিটা কারো পা ধোঁয়া পানি। কথা না বাড়িয়ে বললো,

– তুই ঠিক কি খুজছিস আমার ব্যাগে?

– তোর ফোন। ছবি দেখা!

তাশদীদ টেবিল থেকে ফোনটা ছুড়ে মারে তামজীদের দিকে। তারপর খাওয়ায় মনোযোগী হয়। মিসেস ওয়াসীর ভেজা তোয়ালে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। এরমাঝেই তামজীদ ফোনের দিকে তাকিয়ে চেচিয়ে বলে ওঠে,

– ও মা! দেখো তোমার বউমা!

বেলা এগারোটার ঝলমলো রোদ সুইমিংপুলের নীল পানিতে পরে ওর চোখে প্রতিফলিত হচ্ছে। টাইলসকৃত কিনারায় ডানহাতে মাথা ঠেকিয়ে উপুর হয়ে শুয়ে আছে তাথৈ। পলকহীন চোখে সেই রোদ দেখছে আর বা হাতের আঙুলে পানির ওপরিভাগে আঁকিবুকি করছে ও। মাঝেমাঝে ঘাসের মাঝখান থেকে ছোটছোট বুনোফুল পানিতে ভাসিয়ে দিচ্ছে। দুদিন অম্বুনীড় থেকে বেরোয়নি ও। বাবা-ভাইকে এড়িয়ে বুজোকে নিয়ে আনমনে বসে থেকেছে কেবল। কল্পনায় বেচে থাকাকে প্রাধান্য দিয়েছে। তাথৈয়ের মনে হলো এই নীল পানির উচিত ওকে সমুদ্রকে মনে করানো, এই রোদের উচিত দুদিন আগের সেই সূর্যোদয়কে মনে করানো, এই ভাসমান ফুলগুলোর উচিত সেই সোনালু ফুলের কথা মনে করানো, এই প্রতিফলনের উচিত সেই ঝুলতে থাকা আয়নাগুলোকে মনে করানো। কিন্তু তার কোনোটাই হচ্ছে না। সমুদ্রের পরিবর্তে তাশদীদের উচ্ছলতা ওর চোখে ভাসছে। ঝলমলো সূর্যোদয়ের পরিবর্তে তাশদীদের অবয়ব ওর সামনে ফুটে উঠছে। ওই সোনালু ফুল, আয়না, বায়োলুমিনেসেন্স সবকিছু ভুলিয়ে দিয়ে ওর চারপাশে কেবল তাশদীদ আর তাশদীদ। বুজো পানি থেকে দুরে, তবে ওর আশেপাশেই ঘুরঘুর করছিলো। তাথৈ পানিতে আঙুল চালিয়ে বললো,

– হোয়াট ডু ইউ থিংক বুজো? আমার রুক্ষ জীবনে এই শীতলতা ঠিক কেনো এসেছে? আমাকে ডুবাতে নাকি ভাসাতে?

বুজো জবাব দেয়না। ও ঘাস শুকছে আর ছোটাছুটি করছে। তাথৈ এবার ঘাসের মাঝে চিৎ হয়ে শুয়ে পরলো। প্রকট রোদের দিকে তাকিয়ে হাতে আড়াল করলো রোদ। আঙুলের ফাঁকফোকরে রোদ মুখে মেখে বললো,

– আচ্ছা বুজো? এই রোদ এতো সুন্দর কেনো? এই সুন্দর রোদ কি আমাকে ঝলমলে করে তুলতে এসেছে? নাকি ঝলসাতে এসেছে?

বুজো এবারেও জবাব দেয়না। তাথৈ পাশ ফিরলো। কানে,মুখে ঘাসের ডগা লেগে শিরশির করে ওঠে ওর। দুহাত কানের নিচে নিয়ে কাৎ হয়ে শুয়ে পরলো তাথৈ। বললো,

– এইযে ঘাসেরা আমার শিহরনের কারন, ওরা কি৷ কখনো আমাকে আঘাত করবে বুজো?

বুজো এবারে এগিয়ে আসলো তাথৈয়ের কাছে। তারপর নিজেও ঘাসের মধ্যে গরাগরি দিতে লাগলো। তাথৈ মৃদ্যু হাসলো। এরমাঝেই আওয়াজ আসলো,

– কি হইছে তোমার মনি? এইহানে ক্যান তুমি?

তাথৈ ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে তাকালো। দাড়োয়ান দেলোয়ার হোসেন একটা গাছসহ টব আর শাবল হাতে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে আছেন ওর দিকে। তাথৈ উঠে হাটু জরিয়ে বসলো। সুইমিংপুলের পানির দিকে তাকিয়ে একদন্ড চুপ থেকে বললো,

– কখনো প্রেমে পরেছো চাচা?

দেলোয়ার হোসেন শব্দ করে হেসে ফেললেন। হাতের টবটা নিয়ে রাস্তার একপাশে রেখে বললেন,

– আমাগো সময়ে কি প্রেম করার চল ছিলো নাকি মনি? বাপু বগলে কইরা নিয়া গেলো বিয়া করাইতে, ব্যস! বিয়া কইরা ফেললাম তোমার চাচীরে। প্রেম করিনাই। তয় হ, বিয়ার পর অনেক ভালোবাসছি তোমার চাচীরে। এহনো বাসি।

– কি করে বুঝলে ভালোবাসো?

তাথৈ পুতুলের মতো পাশ ফিরে শুধায়। দেলোয়ার হোসেন শাবল দিয়ে মাটি খুড়তে খুড়তে বললেন,

– তোমার চাচী তো ছোটমানুষ আছিলো। বুঝতোসুজতো কম। আমার মা-বাপুর লগে থাকতো গেরামে। আর আমি শহরে। একবার গেরামে ফেরার সম তোমার চাচীর লাগি একমুঠো চুড়ি আর চুলের ফিতা কিনছিলাম। ওয়ে সেকি খুশি! জানো মনি? ওর খুশি দেইখা আমার তহন মনে হইলো, ওরে খুশী দেখলে আমার খুব শান্তি লাগে৷ তারপর থাইকা আমি সবসময় চেষ্টা করি ওরে একটু খুশী রাখার। তোমার চাচী খুব অল্প জিনিসেই খুশি হইয়া যায়। এইযে ওরে খুশি দেখলে আমার শান্তি লাগে, আমার কাছে এইডাই ভালোবাসা। ভালো না বাসলে অন্য আরেকটা আত্মার খুশিতে আমার আত্মায় এতে শান্তি কেমনে আসে কওতো! এইডা ভালোবাসা না তো কি?

দেলোয়ার হোসেন নিজের কাজে ব্যস্ত রইলেন। তাথৈ আস্তেধীরে উঠে দাড়ায়। মৃদ্যুমন্দ পায়ে নিজের ঘরে চলে আসে। আজোবদি ওর জীবনের একমাত্র প্রাধান্য ছিলো পড়াশোনা। সেই পড়াশোনাতেও ও প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিছু ভাবেনি। অথচ আজ ওর ভাবনাজুড়ে তাশদীদ। আর সে ভাবনাদের একটাই মন্তব্য, ‘তাশদীদ ওর শান্তি। তাশদীদ ওর ভালোবাসা।’
বুজো করিডোর দিয়ে হেলতেদুলতে তাথৈয়ের রুমের দিকে এগোচ্ছিলো। তুল্য কোত্থেকে এসে ওর সামনে কোমড়ে হাত দিয়ে দাড়িয়ে গেলো। কপাল কুচকে বললো,

– কি জনাব? ব্যস্ত আপনি? দুদিন হলো দেখছি শুধু তাথৈয়ের কোলে চড়ে বেড়াচ্ছেন, আমাকে চিনছেনই না! কাহিনী কি?

বুজো লেজ নাড়তে নাড়তে ওকে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। তুল্য বোধহয় জবাব পেয়ে গেলো। কিছু না বলেও বুজো যেনো ওকে শেষলাইনটাই বলে গেলো। ‘কে তুমি? তোমাকে তো আমি চিনি না।’

#চলবে…