কার্নিশ_ছোঁয়া_অলকমেঘ পর্ব-৩১+৩২+৩৩

0
218

#কার্নিশ_ছোঁয়া_অলকমেঘ
লেখনীতে: মিথিলা মাশরেকা

৩১.

মোবাইলে থাকা তাথৈয়ের তিনটি ছবি কয়েকবার ঘুরেফিরে দেখলো তাশদীদ। এই ছবি নিয়ে তামজীদ কতো আকাশকুসুম ভেবে নিচ্ছিলো ভেবে মুচকি হাসলো ও। তামজীদ ছবিগুলো মিসেস ওয়াসীরকেও দেখাতে যাচ্ছিলো। কিন্তু মিসেস ওয়াসীর আগে তাশদীদের চেহারা পরখ করলেন। ছবিটা যে রাতের আধারে সমুদ্রের পানিতে থাকা তাথৈয়ের ছিলো, তা বুঝতে তাশদীদের সময় লাগেনি। তবুও বিন্দুমাত্র প্রতিক্রিয়া না করে খাওয়ায় মনোযোগী হলো ও। জবাব দিলো,

– ফোনে অনেকেই ছবি উঠেছে। তোমার ছোটছেলের বোধহয় কাউকে মনে ধরেছে দেখো।

– খেয়ে রেস্ট নে।

মিসেস ওয়াসীর মুচকি হেসে বেরিয়ে যান। তামজীদ ওনাকে আবারো ডাক লাগাতে যাচ্ছিলো। তাশদীদ খাওয়া ছেড়ে চেয়ারের পেছনের দিকটায় হাত ঠেকালো। ওকে ওভাবে তাকাতে দেখেই ফোকলা হাসি দিলো তামজীদ। ও জানে, তাশদীদের এই চাওনির মানে, ‘এদিকওদিক কিছু বলবি, তো আমার দুইমিনিট লাগবে না তোকে পুকুরে ছুড়তে।’ ঠোঁটের জোরালে হাসিটা বাড়ালো তামজীদ। বিরবিরিয়ে উঠে এসে ফোনটা তাশদীদকে ফেরত দিয়ে দিলো ও। আমতা আমতা করে বললো,

– ইয়ে, আপুটার নাম কিরে ভাইয়া? তোর ফোনে এই আপুর ছবি কি করে?

– ওর ফোনের ক্যামেরা খারাপ তাই আমারটায় ছবি তুলে দিতে বলেছিলো। ছবি তুলে দিয়ে আর ডিলিট করার সময় পাইনি। আরকিছু?

এমন স্পষ্টভাবে মিথ্যেটা বলে নিজেই অবাক হলো তাশদীদ। তবে সেটা প্রকাশ করলো না। তামজীদ ভাইয়ের বলা প্রতিটা বর্ণ সত্যি মেনে নিলো। এবার ওর ঠোঁটে সত্যিকারের হাসি ফুটলো। তবুও ভাইয়ের সামনে কিছুটা জড়তা দেখিয়ে বললো,

– ইয়ে ভাইয়া? একটা আবদার করি?

– কি?

– ছবিটা ডিলিট করিস না। আপুটাকে আমার সত্যিই পছ্…

তামজীদ কথা শেষ করতে পারেনা। ওর চোখে পরে তাশদীদ টেবিলের স্কেলটার দিকে বা হাত বাড়িয়েছে। তামজীদ আর একমুহূর্ত দাড়ায় না রুমে। একছুটে বেরিয়ে যায়। তাশদীদ আরেকদফা ফোনের ছবিগুলো দেখে মুচকি হাসলো। তিনটে ছবি খুব আহামরি ক্ষতি করবে না ওর ফোনের। কিন্তু তাথৈ এগুলো দেখলে খুশি হয়ে যাবে নিশ্চিত। সময় সুযোগ করে তাথৈকে দিয়ে দেওয়া যাবে, এমনটা ভেবে ফোন সরিয়ে খাওয়ায় মনোযোগ দিলো ও।
একটাদিন বিশ্রাম নিয়ে তাশদীদ রিংকিকে পড়াতে ওর বাসায় গেলো। রোজি মেয়েকে কোলে নিয়ে গেইট খুলে দেয়। ওদের দেখে তাশদীদের হাসিটা আরো বেড়ে যায়। আর রোজীর মনে আরো একবার দীর্ঘশ্বাসেরা উকি দেয়, ‘পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর হাসতে জানা মানুষটা আমার না।’ নিজেকে সামলায় রোজি। তাশদীদ ভেতরে ঢুকে ওর মেয়ের গাল আলতোকরে ছুইয়ে দিলো। আদুরে গলায় বললো,

– কেমন আছেন ম্যাডাম? দিনকাল কেমন যাচ্ছে আপনার?

রোজির মেয়েটা ঝকঝকে চোখে চায়, নড়েচড়ে ওড়ে, হাত নাড়ায়। রোজি ওকে ঠিকঠাক কোলে নিয়ে বললো,

– ওর দিনকাল কেমন যাচ্ছে? বলো আমাদের দিনকাল কেমন যাচ্ছে! এইটুকুন মেয়ে! কি পরিমানে যে জেদী হয়েছে তাশদীদ, কি বলবো তোমাকে! তার কান্না উঠলে পুরো বাসা ঝমঝম করে। কিছুতেই থামানো যায় না! এংরিবার্ড একটা!

– নামটা রাখার সময় একটু ভেবেচিন্তে রাখলে মনেহয় এমনটা হতো না।

কপালটা ডলে বিরবিরিয়ে বললো তাশদীদ। রোজির কানে গেলোনা কথাটা। না বুঝে ও প্রশ্নসূচক চেয়ে রইলো তাশদীদের দিকে। তাশদীদ পরমুহূর্তেই হাতে থাকা শপিং ব্যাগটা থেকে কক্সবাজার থেকে আনা শঙ্খটা বের করলো। রোজির মেয়েকে দেখিয়ে বললো,

– এই দেখো ম্যাডাম! কি এনেছি তোমার জন্য!

– আমার জন্য কিছু আনেননি তাশদীদ ভাই?

পাশেরঘর থেকে রিংকি বেরিয়ে আসে। বোনের হেয়ালীতে রোজি নিজেই বিরক্ত হয়। তাশদীদ রিংকিকে হাতের ব্যাগদুটো বাড়িয়ে দিয়ে বললো,

– সবার জন্যই আছে এতে।

রিংকি শুধু ছোট ব্যাগটা নেয়। ও জানে, ওর জিনিস বড়ব্যাগে নেই। সত্যিই তাই। ব্যাগে দুটো ঝিনুকের মালা। রিংকির মা এসে অন্য বাগটা হাতে নিলো। সেখানে কিছু শুটকি আর শুকনো খাবার। রিংকি মালাদুটো দেখে নিয়ে বললো,

– একই মালা দুইটা এনেছেন যে?

– এ বাসায় আমার বোনও তো দুইটা।

স্পষ্টভাবে জবাব দিলো তাশদীদ। রোজির দিকে তাকিয়ে হেসে বুঝালো, একটা ওর। রিংকি মালা মুঠো করে নেয়। রাগটা পুরোটা ওর গিয়ে পরে রোজির ওপর। ওর জন্যই এই বোন শব্দটা শুনতে হলো ওকে। তাশদীদ কথা শেষ করে রিংকিকে পড়াতে বসলো। পড়তে বসার আগে রিংকি ওকে মালাটা দেখিয়ে বললো,

– পরিয়ে দেবেন?

– না।

এবারেও স্পষ্ট জবাব দেয় তাশদীদ। রিংকি নিজেনিজেই মালাটা গলায় পরে নেয়। ছুটির পড়াগুলো দিয়ে একসময় তাশদীদকে প্রশ্ন করে,

– পরশু সূর্যোদয়টা আপনি কোন জুনিয়রের সাথে দেখেছেন তাশদীদ ভাই?

তাশদীদ ওর খাতা দেখছিলো। চোখ তুলে রিংকির দিকে তাকালো ও। তারপর চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে বুকে হাত গুজে বললো,

– কেনো? সে বিষয়ে তোমার এতো আগ্রহ কেনো?

রিংকি জবাব দেয় না। তাশদীদ একটা ছোট শ্বাস ফেললো। সোজা হয়ে বসে টেবিলে হাত রেখে বললো,

– লিসেন রিংকি, আমি তোমাকে শেষবারের মতো বলছি। আঙ্কেলের রিকুয়েষ্টে আমি তোমাকে পড়াতে আসছি। তাছাড়া তুমিও বলেছিলে তুমি আর এমন কিছু বলবে বা করবে না যাতে আমি এ বাসায় আসা বাদ দেই। এ সপ্তাহে তোমার এডমিশন। সেদিকে ফোকাস করো। বুঝেছো আমি কি মিন করেছি?

রিংকি রোবোটের মতো মাথাওপরনিচ দুলালো। তাশদীদ ওকে পড়ানোতে মনোযোগ দিলো। কিন্তু দৃষ্টিটা খাতার দিকে থাকলেও রিংকির মনটা খাতায় ছিলো না। ওর বিক্ষিপ্ত মনে কেবল এটুকোই, ‘এডমিশন পর আপনার ভার্সিটি আমার হবে কিনা জানিনা, কিন্তু আপনি আমার হবেন তাশদীদ ভাই। ওই একটা সূর্যোদয় আপনি যাকেই দিয়ে থাকেন না কেনো, আপনার জীবনের প্রতিটা সূর্যোদয় আপনার আমাকে দিতে হবে। আমার চাই আপনাকে! ব্যস!’

তুল্য ভার্সিটির সামনের এক টংয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে। ওর চোখমুখ বিরক্তিতে কুঁচকানো। সেমিস্টার ফাইনালের পর ছুটি না দিয়ে প্রজেক্টে ঢুকিয়ে দেওয়া কোর্সটিচারকে পারলে এইমুহুর্তে কুচিকুচি করে কাটে ও। ওদের প্রজেক্টটা ডেডলাইনের আগে শেষ হয়নি। এর পুরোটা দায় টিচারের। হেয়ালী করে সে শুরুই করেছে দেরিতে। সেটাও নিজে করছে না। অন্যএক সিনিয়র স্টুডেন্টকে রেখেছে ইনচার্জে। যেখানে সময় লাগবে আরো চারদিন! ছুটির পরিবর্তে চারদিন ক্যাম্পাসে আসতে হবে ভেবে রাগে তুল্যর শরীর জ্বলছে। সিগারেট কয়েকটান দিতেই শেষ হয়ে যায় ওর। সিগারেটের শেষটুকো মাটিতে ফেলে আরেকটা সিগারেট চাইতে যাচ্ছিলো তুল্য। তখনই কানে আসে,

– সেমিস্টার ব্রেক না পাওয়ার রাগ ফুসফুটার ওপর দেখাতে হবে?

তুল্য পেছন ফিরলো। খয়েরীরঙা লং টিশার্ট, জিন্স পরিহিত শার্লি বুকে হাত গুজে ওর পেছনেই দাড়ানো। ছোটছোট চোখ করে ওরদিক চেয়ে আছে। তুল্য গায়ে লাগালো না। সিগারেট হাতে নিয়ে আগুন ধরালো। ধোঁয়া ছেড়ে বললো,

– ফুসফুস ছাড়া আমার আর রাগ দেখানোর জায়গা নেই। হৃদপিণ্ডটা একজন নিয়ে নিয়েছে।

শার্লি আজ লজ্জা পেলোনা। তাথৈ এখনো ক্যাম্পাসে আসেনি। তাই ও তুল্যকে খুজতে টংয়ে চলে এসেছে৷ ধারনা ঠিক ছিলো ওর। তুল্য এখানেই। আপনমনে সিগারেট ফুঁকছে। শার্লি দুইপা এগিয়ে দাড়ালে এবারে। বললো,

– যাকে হৃদপিণ্ড দিয়ে দিলি, তার জন্য সিগারেটটা ছাড়তে পারবি না তুল্য?

– আমি দেইনি। সে নিয়েছে।

– ওই একই হলো। তোর হৃদপিণ্ডটা তার কাছে হলে, তার হৃদপিণ্ডটাও তো তোর কাছে বল? সেটার খেয়াল রাখবি না? সিগারেট ছেড়ে দিতে পারবি না?

‘যে আমার জন্য সামান্য ট্রেনের সিট ছাড়েনি, তার জন্য আমি সিগারেট ছাড়বো?’
ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও জবাবটা এভাবে দিলো না তুল্য। মুখে বললো,

– না!

শার্লি হাল ছেড়ে দেয়। এমন স্পষ্ট জবাবে হয়তো কিছুটা অপমানিতও হয়। এই ছেলের কাছে ঠিকঠাক জবাব আশা করাটা ওর উচিত হয়নি। আশপাশ দেখে ও বেরিয়ে আসে টং থেকে। শার্লি কিছুটা দুর যেতেই সদ্য ধরানো সিগারেটটা ফেলে দিয়ে পায়ে পিষলো তুল্য। কিন্তু ওর সে মনোভাব দশ সেকেন্ডের জন্যও স্থায়ী হলোনা। আবারো তেজ নিয়ে আরেকটা সিগারেট ধরালো ও। অস্থিরচিত্ত্বে পেছন ফিরে দৃষ্টি সরালো। ঠিক শার্লি বেরিয়ে যাওয়ার সময়ই শান্ত আর টিটু টংয়ে ঢুকছিলো। আর তুল্য স্পষ্ট দেখেছে, শান্ত শার্লির দিকে তাকিয়েছে। ওদের দুজনের চোখাচোখি হয়েছে।

তাথৈ পার্কিং এরিয়ায় গাড়ি থামিয়ে গাড়ি থেকে নামলো। গাড়িতে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে চোখের সানগ্লাসটা খুললো ও। তারপর হাটু অবদি টপসটার পকেটে দুহাত গুজে, চুইংগাম চিবোতে চিবোতে বাস্কেটবল কোর্টের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। গাড়ির ভেতর থেকে বুজো ডেকে ওঠে। দরজা খোলা রেখে তাথৈ এগোয় ফাঁকা কোর্টের দিকে৷ বুজো ওর পেছনপেছন নেমে আসে। বেলা বারোটার রোদে দাড়িয়ে তাথৈ ওপরের বাস্কেটটা দেখতে থাকে। তারপর একপাশে রাখা বলগুলো থেকে একটা হাতে নেয়। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে থাকে বলটা। আফিফ ওখান দিয়েই পাশ কাটাচ্ছিলো। তাথৈকে বল হাতে নিতে দেখে কোর্টে ঢোকে ও। টিপ্পনী কেটে বলে,

– বাস্কেটবল মেয়েদের জন্য না। দে বল দে!

তাথৈ জবাব না দিয়ে আঙুলে বল ঘোরালো। পরমুহূর্তেই আফিফের মাথা বরাবর বলটা মারলো। বলটা আফিফের মাথায় ড্রপ দিয়ে সোজা গিয়ে বাস্কেটে পরে। তখনই ওখানে আসে শার্লি। ঘটনা দেখে শব্দ করে হেসে দেয় ও। হচকিয়ে যায় আফিফ। বুজো তাথৈয়ের বসে ছিলো। বল বাস্কেট হতে দুবার আওয়াজ করে ও। আফিফ মাথায় হাত দিয়ে পেছন ফেরে। টের পায় কি ঘটেছে। তাথৈ দুইপা এগোলো ওর দিকে৷ চোখমুখে তীব্র অহম নিয়ে বললো,

– তুই এখনো চিনিস নি আমাকে আফিফ। তাথৈ আলফেজের যাতে ইন্টারেস্ট জুড়ে যায়, তার জন্য ও সব পারে!

আফিফ চোখমুখ শক্ত করে দাড়িয়ে রইলো। শার্লি এগিয়ে আসলো ওদের দিকে। তাথৈকে বললো,

– সিআর সবাইকে ল্যাবে ডাকছে। চল।

তাথৈ একটা চাওনি রেখে চলে যায়। ও চলে গেলে রাগে হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে আসে আফিফের। রাগের বশে মনেমনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করে বসে ও, ‘তাহলে একদিন তোর ওই ইন্টারেস্টের জিনিসটাতেই আমি কালি লেপে দেবো তাথৈ আলফেজ। তৈরী থাকিস!’
শার্লি-তাথৈ ল্যাবে ঢুকলো। তাথৈ ভেতরে চোখ বুলিয়ে বুঝলো, তাশদীদ এখনো আসেনি। আলো এগিয়ে এসে ওকে একটা খাতা দেখিয়ে বললো,

– দেখোতো তাথৈ, এখানকার কোনো রিয়্যাকটেন্ট ভুল আছে কিনা? আমার কিছুতেই মডিফিকেশন হচ্ছে না।

শার্লি চোখ উল্টে গিয়ে ওদের গ্রুপের টেবিলের সামনে দাড়ালো। এই পড়াশোনা ওর কর্ম না। তাথৈ মনোযোগ দিয়ে দেখলো আলোর খাতাটা। তুল্য সেসময়েই ভেতরে ঢোকে। আলো-তাথৈকে পাশ কাটানোর সময় আলোর খাতায় চোখ যায় ওর। সোজা চোখ পরে ভুলটায়। তুল্য ওদের পাশ কাটাতে কাটাতে বললো,

– লাস্ট রিয়্যাকশনে ইনচার্জ পটাশিয়াম ইউজ করতে বলেছিলো। বইয়ে সোডিয়াম দিয়ে করা। আপনিও ম্যাডাম সোডিয়াম লিখেছেন।

জবাব শুনে আলোকে খাতাটা ফেরত দেয় তাথৈ। আলো খাতা নিয়ে নিজের টেবিলে চলে আসে। তুল্যর এই ছোটছোট জবাব, ডাক, আশেপাশে থাকাতে ওর মন যেনো প্রজাপতির মতো ছোটাছুটি শুরু করে দেয়। ও অনেক চেষ্টা করেছে নিজেকে স্বাভাবিক করার। পারেনি। পারছে না। শার্লি দাঁতে নখ কাটতে কাটতে তাথৈকে বললো,

– তোরা তিনটা কোন ভাষায় পড়াশোনা করিস রে তাথৈ? আমার কিছুই বুঝে আসেনা কেনো বলতো?

তাথৈ জবাব দিলো না। নিজের খাতা বের করতে ব্যস্ত ছিলো। শার্লি বললো,

– এবারও আলোর পরীক্ষা বেশ ভালো গেছে। পারবি ওকে টপকাতে?

– আলো কোনোকালেই আমার কম্পিটিটর ছিলো না। বরং ওই সেই একমাত্র মেয়ে, যারজন্য আমি কম্প্রোমাইজ করতে পারি।

তাথৈ তেমনি ব্যস্ত থেকে জবাব দিলো। টেবিলে থাকা যন্ত্রটায় হাত দিয়েছে ও। শার্লির আগ্রহ বাড়লো। উচু টেবিলে কনুই ঠেকিয়ে হেলান দিয়ে দাড়ালো ও৷ বললো,

– ও আচ্ছা! তারমানে তোর কাছে ওর পাত্তা আমার চেয়ে বেশি! তাইতো?

– সেটা বলিনি। তবে আমার কাছে ওর পাত্তা আমার চেয়ে বেশি।

শার্লি কথা বাড়ায় না। এরমাঝেই তাশদীদ ল্যাবে ঢোকে। ছয়দিনের ল্যাব চারদিনে শেষ করাতে ম্যাডাম বেশ তাড়া দিয়েছে ওকে। নিজের দোষে ম্যাডাম নিজেও বিপাকে পরেছেন, পুরো একটা ব্যাচকেও টানাপোড়েনে ফেলেছেন। বেচারারা ছুটিটাও শান্তিতে উপভোগ করতে পারছে না। তাশদীদ উচ্চস্বরে বললো,

– এক্সকিউজ মি এভরিওয়ান। যেহেতু এখন আপনাদের ছুটির সময়, আমি প্রজেক্টটাকে দ্রুত শেষ করতে চাইছি। এখানকার রিয়্যাকশন সবগুলো ট্রায়াল দেওয়ার সময় পাইনি আমি। যেহেতু আমাদের মডিফিকেশন দরকার, সো সবাই একটু কো অপারেট করুন। নেক্সট দুদিন আপনাদের টাস্ক একটু বেশি থাকবে। আমরা তিনদিনে প্রজেক্টটা শেষ করবো ইনশাআল্লাহ।

এতোক্ষণে তুল্যের রাগ কিছুটা কমে আসে। সবাই কাজে লেগে পরে নিজেদের মতো। তাথৈ কিছুটা সময় নিয়ে তাশদীদকে দেখলো। মাস্ক পরিহিত মানবের আজ প্রচুর ব্যস্ততা। হাতেহাতে সবাইকে এটাওটা দেখিয়ে দিচ্ছে তাশদীদ। এ টেবিল ও টেবিল ছুটছে সে। ইনডেক্স চেক করলো তাথৈ। সেখানে কিছু অতিরিক্ত সংযোজন আছে। তাথৈ বুঝলো, এই অতিরিক্ত সংযোজন আর কম সময় নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে পরেছে তাশদীদ। মুচকি হেসে নিজের মতো করে পরীক্ষণ-বিক্রিয়া শুরু করে দিলো তাথৈ। যে তাথৈ কখনো সিলেবাসের বাইরে কিছু পড়েনি, সেই তাথৈ ইনডেক্সের অতিরিক্ত সংযোজন সমাধাতে লেগে পরে। সবার মতো একটানা পরীক্ষণ না করে, হিসেব করে, বেছেবেছে বিক্রিয়া করতে থাকে ও। বাকি তিনটে দল যখন একটা-দুইটা পরীক্ষণ করতে ব্যস্ত, তাথৈ সে সময়ে চারটে শেষ করে। শার্লি কেবল লেখার দায়িত্বে ছিলো। চতুর্থ পরীক্ষণে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পেয়ে তাথৈ শার্লির থেকে কাগজটা হাতে নেয়। তাশদীদ তখন অন্য আরেকটা দলের টেবিলে ছিলো। তাথৈ কাগজটা সে টেবিলে রেখে বললো,

– এই প্রসিডিওরে করলে ইজি হবে। নতুনকরে সিকুয়েন্স খুজতে আকাশপাতাল এক করতে হবে না।

তাশদীদ অবাক হলো। মনোযোগ দিয়ে কাগজটা পড়লো ও। লেখায় কোনোরকম ভুল খুজে পেলো না। তাথৈয়ের দিকে তাকিয়ে দেখে ও নিজের টেবিলে গিয়ে আবারো নিজের কাজে মনোযোগ দিয়েছে। তাশদীদ হাতের কাগজটার দিকে তাকিয়ে রইলো একদৃষ্টিতে। তাথৈয়ের এই সিকোয়েন্সিং যদি ব্যবহারিকভাবেও ঠিক হয়, তবে ওর এই ল্যাবে ইনচার্জ হিসেবে আসা স্বার্থক। তাথৈয়ের সিকোয়েন্সিং এখানকার কাজের সাথে ওর কাজটাও হয়তো অনেক সহজভাবে মিলাতে চলেছে। ওর প্রচেষ্টা হয়তো আরেকধাপ এগোতে চলেছে। সর্বোপরি, প্রাণরসায়ন হয়তো পৃথিবীকে আরো চমৎকার কিছু উপহার দিতে চলেছে।

#চলবে…

#কার্নিশ_ছোঁয়া_অলকমেঘ
লেখনীতে: মিথিলা মাশরেকা

৩২.

ক্যাম্পাসে বসন্তের ছোঁয়া লেগেছে। ফুল-রঙে মেতে উঠেছে যুবক-যুবতীরা। বাসন্তী শাড়ী-পান্জাবী পরুয়া জুটি আর পলাশ আজ ক্যাম্পাসের শোভাবর্ধক। নিউজফিড ভর্তি এইসব পোস্ট দেখে ফোনটা পাশে ছুড়ে মারলো তুল্য। খালি গায়ে বিছানায় উপুর হয়ে শুয়ে ছিলো ও। এরমাঝে দুবার বুজোর আওয়াজ কানে আসে তুল্যর। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে বুজো এতিমের মতো ওর দরজায় বসে। তুল্য উঠে বসলো। টিশার্ট গায়ে দিতে দিতে বললো,

– আজ সূর্য কোনদিকে উঠেছে? তাথৈ আলফেজের পেট স্বয়ং বুজো এসে আমার দোরগোড়ায় পদধূলি দিচ্ছে যে!

বুজো আরো দুবার আওয়াজ করলো। তুল্য বিছানা থেকে নেমে এসে টেবিল থেকে জুসের বোতল হাতে নিলো। দুইচুমুক দিয়ে, বুজোর সামনে হাটুগেড়ে বসে বললো,

– হোয়াট? তোর উৎলানো ভালোবাসা-সিক্ত সৎবোন তোকে খেতে দেয়নি?

বুজো জিভ দিয়ে নিজের সামনের পা ভেজাতে লাগলো। দরজা খোলার আওয়াজ শুনে তুল্য রুমের বাইরে উকি দিলো। তাতে যা দেখলো মুখ আপনাআপনি হা হয়ে গেলো ওর। পাশেররুমের দরজা থেকে বুজোকে ডেকেছে তাথৈ। বুজো তখনতখন ছুটে গেলো। তাথৈ ওকে ঘরে নিয়ে গিয়ে খেতে দিলো। তুল্য বিস্ময়ে বোনের দিকে তাকিয়ে রইলো। এরমাঝে পাশ থেকে কেউ একজন বলে ওঠে,

– তোর বোন প্রেমে পরেছে তুল্য।

‘সেটা আমার চেয়ে ভালো আর কে জানে?’
তুল্যর সচেতন মন নিজেনিজেই বললো। দরজার পাশে তাকালো ও। শার্লি বুকে হাত গুজে করিডোরে দাড়ানো। হলুদ কামিজ আর সাদা ধুতি ওর পরনে। তুল্য বুঝলো, শার্লি তাথৈকে নিতে এসেছে। ওকে চুপ দেখে শার্লি আবারো বললো,

– ক্যাম্পাসে যাবিনা?

– না! এসব রঙঢঙ আমার ভালো লাগে না।

শার্লি আজও হতাশ। প্রেমে পরে তাথৈয়ের মতো মেয়েও আজ ক্যাম্পাসে যেতে রাজি হয়েছে। ওকে শার্লি শুধু এটুকো বলেছে, বসন্ত উৎসবের আয়োজনে তাশদীদকে দেখেছে ও। ব্যস! এটুকোতেই তাথৈ মেনে নিয়েছে, আজ ক্যাম্পাসে গেলে তাশদীদের সাথে দেখা হবে ওর। দুজনে মিলে একসাথে ভার্সিটি যাবে এজন্য অম্বুনীড়ে আসতে বলেছে ওকে। অথচ তুল্য? ওকে দেখেও তার কোনো ভাবান্তর নেই। তাহলে কি তুল্যর মনে ওরজন্য কিছুই নেই? পাশ কাটাচ্ছিলো শার্লি। কিন্তু তুল্য পেছন থেকে ওর কবজি চেপে ধরলো। শার্লি কিছু বলার আগেই বললো,

– তোর রঙঢঙ-ও আমার ভালো লাগছে না শার্লি।

– তোর ভালোলাগাকে আমি কেনো পাত্তা দেবো?

হাত মুচড়িয়ে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো শার্লি। তুল্য ওর হাত ছেড়ে দিলো। শার্লি বেশ কড়া গলায় বললো,

– বল! আমি কেনো তোর ভালো লাগা, না লাগাকে পাত্তা দেবো? তুই আমার কে?

– আমি তোর কি হলে আমার ভালো লাগা না লাগা তোর কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হবে?

– তোদের ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ’ টপিকের ওপর আলোচনা শেষ হলে নিচে আয় শার্লি। আমি গাড়ি বের করছি।

এটুকো বলে দিয়ে তাথৈ নিচে চলে গেলো। শার্লি চমকে ওঠে ওর গলা শুনে। একপলক ডুল্যর দিকে তাকিয়ে দেকে ওউ আটকে আছে। শার্লি দৌড় লাগায় তাথৈয়ের পিছুপিছু। অম্বুনীড়ের বাইরে এসে দেখে তাথৈ গাড়ি বের করেছে। ড্রাইভিং সিটে বসে। চোরের মতো আঁকুপাঁকু করতে লাগলো শার্লি। তাথৈয়ের বলে আসা কথাটার মানে স্পষ্ট, ওর আর তুল্যর বিষয়ে কিছু আন্দাজ করেছে ও। কিন্তু আদৌও কি কিছু আছে ওদের? দরজা খুলে ফ্রন্টসিটে বসে গেলো শার্লি। তাথৈ বেশ স্বাভাবিক গলায় বললো,

– দুজন দুজনকে পছন্দ করিস, তাহলে কথাটা বলে দিচ্ছিস না কেনো? সমস্যা কোথায়?

শার্লি আবারো চমকায়। তাথৈ নিমীলিত চোখে চাইলো ওর দিকে। এ কদিনে ঘটে যাওয়া তুল্য-শার্লির মুহুর্তগুলো ওর চোখ এড়ায়নি। শার্লির কপালের টিপ থেকে শুরু করে, ট্যুরের সময় স্টেশনে দুজনের ইশারার আলাপ, ঘোরাঘুরির সময়ের একে ওপরের আড় চাওনি, ট্রেনের সিটে বসা নিয়ে কাহিনী, সবই খেয়াল করেছে তাথৈ। ওরা যে পরস্পর দুর্বল হয়ে পরেছে, সেটাও ও ধরতে পরেছে। ভাইয়ের স্বভাব ভালোমতোই জানে তাথৈ। তাই শার্লিকেই বলেছে অম্বুনীড়ে আসতে। তাথৈ নমনীয় স্বরে বললো,

– এমন মাথামোটাকে চুজ করেছিস, জীবনেও স্বীকার করবে না ওর তোকে পছন্দ।

শার্লি তখনো নিশ্চুপ। বিস্ময়, ঘোর দুটোই ওর মুখকে তালাবন্ধ করে দিয়েছে যেনো। তাথৈ মুচকি হেসে গাড়ি স্টার্ট দিলো। ড্রাইভিংয়ে মনোযোগ রেখে বললো,

– ওকে ফাইন! যতোদিন তোরা নিজেরা নিজেদের ভালোলাগার কথা বলতে না পারছিস, ততোদিন আমি তোদের বিষয়ে কিছু জানিনা। স্বাভাবিক হ!

শার্লি চেষ্টা করলো স্বাভাবিক হওয়ার পারলো না। লজ্জায়, অস্বস্তিতে কুঁকড়ে যাচ্ছে আরো। তাথৈ একপলক ওকে দেখে নিয়ে বললো,

– তুল্য তোকে পছন্দ করে, এট জেনেও তুই নিজের মনের কথা ওকে বলতে পারছিস না। আমার পরিস্থিতিটা ভাব তাহলে? কোন অকুল পাথারে ডুব দিলাম, কে জানে!

তাথৈ আনমনা হয়ে যায়৷ শার্লির মুখ থেকে আর একবর্ণ বেরোলো না। নিরবতাতেই দুজনে মিলে ক্যাম্পাস পৌছালো। হাজারো রঙিন চেহারার ভীড়ে তাথৈ খুজতে শুরু করে দিলো সে কাঙ্ক্ষিত হাসিমুখ। প্রাণরসায়নের দেয়ালে দেয়ালে বসন্তের সজ্জা। তাশদীদ বা কাধের রঙ ঝারতে ঝারতে তিনতলার ওয়াশরুম থেকে বেরোচ্ছিলো। ক্লাসের সবগুলো ছেলে মিলে রঙ মাখিয়েছে ওকে আজ। চোখেমুখে কোনোঅংশে বাদ নেই আবির লাগানো। একটু সুযোগ পেয়ে ও চলে এসেছে তিনতলায়৷ আপাতত এখানে নেই কেউই। সবাই নিচে আবির খেলছে আর স্টেজ শো এর মজা নিচ্ছে। বিভাগীয় ভবনের সামনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য স্টেজ করা হয়েছে। সেখান থেকে গান ভেসে আসছে, ‘চাতক প্রায় অহর্নিশি…’

ওয়াশরুমের বাইরে এসে চোখ তুলে সামনে তাকাতেই পা থেমে যায় তাশদীদের। করিডোরের শেষ প্রান্তে তাথৈ দাড়ানো। পরনে হলুদ রঙের আনারকলি, সাদা চুড়িদার, বা কাধের ওপর পাতলা সাদা ওড়না, পায়ে উচু হিল। চেহারায় একবিন্দু সাজসজ্জা নেই। এমনকি কোমড় অবদি ছাড়া চুলগুলোতেও আলাদা কোনো স্টাইল করা নেই। আধভেজা চুলগুলো কিছুটা বা দিকে সিঁথি করে অনর্থকভাবে ছেড়ে দেওয়া। তাথৈও একদৃষ্টিতে তাশদীদকে দেখছিলো। হলুদ পান্জাবী, সাদা পায়জামা পরা মানবের চেহারাজুড়ে কয়েকরঙের আবির। পান্জাবীর হাতা কনুই অবদি গুটানো, এলোমেলো চুল। তাশদীদ মৃদ্যু হাসলো। একপা দুপা করে ও এগোতে থাকে তাথৈয়ের দিকে। কিন্তু তাথৈ স্থির রয়। ওর অনুভব হয়, তাশদীদের গায়ে লেগে থাকা এই সব রঙ ওকেও রাঙিয়েছে, ওকেও ছুঁয়েছে। কানে বাজতে থাকা লাইনটার সাথে ওর মনও বলে ওঠে,
‘আমি হবো বলে চরণ দা-সী…’

তাশদীদ এগোতে এগোতে করিডোরের টেবিলে থাকা প্লেট থেকে ডানহাতের মুঠো ভরে আবির নেয়। ওকে আবির নিতে দেখে গানের বাকি লাইনগুলো ভুলে যায় তাথৈ। তাশদীদ এসে ওর সামনে দাড়ায়। পশ্চিমমুখী ভবনের তিনতলার বারান্দায় তীর্যক রোদ পরেছে। অবশ্য সম্পুর্ন রোদ পরেছে বললে ভুল হবে। দেয়ালের ষড়ভুজাকৃতির ফোঁকর দিয়ে রোদ পরেছে বারান্দায়। সে রোদ করিডোরে দাড়ানো দুই মানব-মানবীকে ছুঁয়ে দিচ্ছে তীব্রভাবে। অথচ গানের কথা এগোয়,
‘মেঘের বিদ্যুৎ মেঘে যেমন,
লুকালে না পায় অন্বেষণ…’
আবিরভরা হাত তাথৈয়ের সামনে তুলে ধরলো তাশদীদ। মাথা নেড়ে ইশারায় অনুমতি চাইলো আবির লাগানোর জন্য। তাথৈ মুখে জবাব দিলো না। ওর আর তাশদীদের মাঝে হাতদুইয়ের দুরুত্ব ছিলো। গানের কথা আবারো মস্তিষ্কে আঘাত করে ওর। ‘আমি কালারে হারায়ে তেমন…’
তাথৈ সময় নেয় না। একপা এগিয়ে তাশদীদ আর নিজের মাঝের দুরুত্ব ঘোচায়। সাহসী চোখে চেয়ে রয় তাশদীদের দিকে। ওর জবাব বুঝে যায় তাশদীদ। হাত তুলে তাথৈয়ের কপাল থেকে পুরোমুখে আবির মাখায় ও। পাশের দেয়ালজুড়ে রঙবেরঙের কাগজের শিল্প। আর শেষ কোনাটায় আড়াআড়িভাবে একটা আয়না রাখা। কারুকাজকরা আয়নায় প্রতিফলিত হয়, তাথৈ চোখ খিচে বন্ধ করে রেখেছে, আর তাশদীদ ওর চেহারাজুড়ে আবির মাখাচ্ছে। নিচ থেকে তখন গায়েন গেয়ে উঠলো,
‘ওইরুপ হেরিয়ে দর্পণে…
আমার মনের মানুষেরও সণে…’

তাথৈ চোখ মেললো। হাসিমুখে ‘ফাগুনের শুভেচ্ছা ম্যাডাম!’ বলে ওকে পাশ কাটিয়ে চলে যায় তাশদীদ। মৃদ্যুবেগে দৌড়ে নিচে নেমে আসে। আবারো হুল্লোড় বাধিয়ে দেয় শান্ত-টিটুদের সাথে। তাথৈ নিজের গালে হাত দিয়ে থমকে রইলো দু দন্ড।
‘যখন ওই রুপ স্মরণ হয়
থাকে না লোক লজ্জার ভয়…’
অকস্মাৎ কি হলো তাথৈয়ের, পাশের আবিরের প্লেট থেকে হাত ভর্তি করে আবির নিলো ও। উচ্ছ্বলতা নিয়ে তা সর্বশক্তিতে ছুড়ে মারলো বাতাসে। কাধ থেকে ওড়না খুলে দুহাতে ধরে তাথৈ। ওড়নার দুপ্রান্ত আবিরের প্লেটে ডুবিয়ে ওড়নাও বাতাসে ওড়াতে থাকে ও। হলুদ আবিরে ছেয়ে যায় ওর চারপাশ। একাকী করিডোরে প্রজাপতির মতো হাসতে থাকে, নাচতে থাকে তাথৈ। তিনতলার শূণশান করিডোরে ওড়না নাড়িয়ে, রঙ উড়িয়ে ঘুরেফিরে এক ছায়াময়ী নাচছে। নিচে তখনো গানের উৎসব। একদল তরুনতরুনী, গায়কের সাথে তখন একসাথে গলা ছেড়ে গাইছে,
‘লালন ফকির ভেবে বলে স-দাই(ii)
ওই প্রেম যেই করে সেই জানে…’

শুক্রবারের সকালটাতে উচ্চমাত্রার ব্যস্ততা পরে গেছে প্রীতিকার্নিশে। তাশদীদ শার্টের হাতা গুটাচ্ছে আর মিসেস ওয়াসীর ওর মুখে ভাজি-পরোটা তুলে দিচ্ছে। তাশদীদ মুলত তৈরী হচ্ছে ক্যাম্পাস যাবে বলে। গত তিনদিনে তাথৈদের প্রজেক্ট শেষ করে দিয়েছে ও। আজ ক্লাস নেই। তবে রিংকির ভর্তি পরীক্ষা। যেহেতু তাশদীদের ভার্সিটিতে পরীক্ষা, রিংকিকে সাথে করে নিয়ে যাওয়ার দায়টা ওর ওপরেই পরেছে। তাশদীদ মানা করার কোনো কারন পায়নি। হাতঘড়ি পরতে পরতে তাশদীদ মাকে বললো,

– আঙ্কেল সাথে গেলেও পারতো।

– আমিও সেটা বলেছিলাম। কিন্তু ভাই বললেন তার নাকি অন্যকোথায় জরুরী কাজ আছে। আর ভাবীতো জার্নি করতেই পারে না।

মায়ের দিকে একপলক তাকালো তাশদীদ। মানিব্যাগ আর ফোনটা নিয়ে পকেটে পুরতে পুরতে বললো,

– আচ্ছা যা হয়েছে হয়েছে। ব্যস আজকের দিনটাই! এরপর আমি দায়মুক্ত!

নিজেনিজেই বলে তাশদীদ ঘর থেকে বেরোলো। বারান্দার সোফায় ওয়াসীর সাহেবের সাথে রিংকি বসা। রিংকিদের বাসার থেকে প্রীতিকার্নিশ বেশি সম্মুখে। তাই ও চলে এসেছে আগেই। তাশদীদকে দেখে রিংকি দাঁড়িয়ে গেলো। কালো শার্টে কোনো পুরুষকে এতো বেশি সতেজ দেখায়? হয়তো সেটা তাশদীদ বলেই সম্ভব! তাশদীদ হাত বাড়িয়ে ইশারায় বুঝালো, ‘এগোও’। তারপর ডাইনিংয়ে বসে পানি খেলো। ওয়াসীর সাহেব আর তার মিসেসকে ‘আসছি’ বলে এগোয় রিংকি। মেইনরোডে এসে লোকাল বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলো দুজনে। তাশদীদ বললো,

– আঙ্কেলের কি এমন কাজ পরে গেলো যে আজ তোমার সাথে যেতে পারলো না?

– সে আমার জন্য ইমারজেন্সি না তাশদীদ ভাই।

রিংকির জবাবে বরাবরের মতো বিরক্ত হলো তাশদীদ। অন্যদিক ফিরে নিজেকে সামাল দিলো ও। বাস আসলে রিংকিকে ড্রাইভারের সামনেরদিকের সিটটায় বসিয়ে নিজে গিয়ে পিছনে বসে পরলো। রিংকি বুঝলো, ইচ্ছে করেই দরজার কাছের ফাঁকা দুইসিটগুলোতে বসেনি তাশদীদ। কেননা দুইসিটে বসলে ওদের পাশাপাশি বসতে হতো। মনেমনে হাসলো রিংকি। ভেবেও নিলো, কদিন পর ও তাশদীদের ঠিক কতোটা কাছে থাকবে।
ফোনের কর্কশ রিংটোনে ঘুম ছুটে যায় তাথৈয়ের। শোয়া থেকে উঠে বসে ও। গত কদিনে প্রজেক্ট নিয়ে অনেকবেশি খাটাখাটুনি গেছে। শুক্রবার আরামসে ঘুমানোর কথা ওর। ব্যালকনিতে তাকিয়ে দেখে সেখানে উজ্জল আলো। মানে বেলা হয়েছে অনেকটাই। তালুর উল্টোপিঠ গলায় ঠেকালো তাথৈ। টের পেলো, ও ঘেমে উঠেছে। পাশে বাজতে থাকা ফোনটার দিকে তাকালো তাথৈ। কলে রুমনের নাম দেখে কল রিসিভ করে হ্যালো বললো ও৷ ওপাশ থেকে রুমন বললো,

– কইরে তুই?

– স্পেসে। কেনো?

– ও। পৃথিবীর বাইরে? তাহলে থাক। আমি ভাবলাম শুক্রবার আজ, তুই বোধহয় অম্বুনীড়ে। থাকলে পরে বলতাম, ক্যাম্পাস চলে আয়, দেখা করি। ঢাকা ফিরছি।

তাথৈ খুশি হয়ে গেলো। শব্দহীন হেসে বললো,

– জলদি আয়। আমি শার্লিকে নিয়ে পৌছাচ্ছি!

কল কেটে শার্লিকে ম্যাসেজ করে দিলো তাথৈ।
শার্লি ক্যাম্পাসেই ছিলো। শানবাধানো সিটে বসে হেডফোনে গান শুনছিলো ও। হলে থাকে বলে ওর বেশিরভাগ সময় ক্যাম্পাসেই কাটে। তাথৈয়ের ম্যাসেজ পড়ে খুশি হয়ে যায় ওউ। কান থেকে হেডফোন নামালো শার্লি। তখনই ওর কানে আসে,

– ওই পিচ্চি মেয়ে তোর ভালোমানুষির সুযোগ নিচ্ছে তাশদীদ! ওকে কিন্তু তুই একটু বেশিই ছাড় দিয়ে ফেলছিস!

তাশদীদের নাম শুনে শার্লি কপাল কুঁচকালো। গলার আওয়াজটা যে শান্তর, তা ও শতভাগ নিশ্চিত। শার্লি বুঝলো, তাশদীদ-শান্ত ওর বসার জায়গার উল্টোপাশেই বসে। তাশদীদ ক্যাম্পাসে জেনে শার্লি খুশি হলো। অন্যকোনো সময় হলে তাথৈ কোনোমতেই শুক্রবারে ক্যাম্পাসে আসতো না। আজ যখন ও ক্যাম্পাসে আসছে, আজই তাশদীদও ক্যাম্পাসে এসেছে। পরিস্থিতি কতোটা মোহনীয়তার সাথে বারবার ওদের কাছাকাছি নিয়ে আসছে ভেবে হাসলো শার্লি।কিন্তু তাশদীদের কথায় কৌতুহল বাড়ে ওর। পেছনে বসা তাশদীদ বলছে,

– আই হ্যাড নো চয়েজ। রিংকি আমাকে এমন কোনো পরিস্থিতিতে ফেলেনি যেখানে আমি রিয়্যাক্ট করতে পারতাম।

শার্লির বিস্ময় বাড়ে। তাশদীদ ওয়াসীর, যার কাছে কিনা সবরকমের সমাধা থাকে, সেই তাশদীদ বলছে সে নিরুপায়! কৌতুহল নিয়ে ওদের দুজনের আরোকিছু কথাবার্তা শুনলো ও। তাতে স্পষ্ট বুঝলো, রিংকি নামের আপদটা বেশ ভালোমতোই জ্বালাচ্ছে তাশদীদকে। শার্লি মাথা নেড়ে তাচ্ছিল্যে হাসলো। রিংকি নামক মেয়েটার জন্য করুনা হলো ওর। মনেমনে আন্দাজ করতে লাগলো, তাশদীদ ওয়াসীরের অস্বস্তির কারন, এই রিংকির সাথে তাথৈ আলফেজ ঠিক কি কি করতে পারে। হিসাব করে শার্লি ফলাফলে যা পেলো, ‘সব!’
রিংকি পরীক্ষা শেষ করে বেরিয়ে তাশদীদকে খুজতে শুরু করে। একটুপর তাশদীদই ওকে ডাক লাগায়। রিংকি এগোলো। তাশদীদের সাথে শান্ত টিটুও এসেছে। তাশদীদ ওদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো রিংকিকে। রিংকি বললো,

– পরীক্ষা কেমন হলো জানতে চাইবেন না তাশদীদ ভাই?

– যা গেছে, গেছে। রেজাল্টে দেখা যাবে।

স্বতঃস্ফূর্ত জবাব দিলো তাশদীদ। টিটু উৎসাহভরে বললো,

– তুই পড়িয়েছিস না ওকে? ও ঠিক চান্স পাবে!

– তাশদীদ কি পড়িয়েছে সেটা ম্যাটার করে না। ও কি পড়েছে, সেটা ম্যাটার করে। তা রিংকি মামুনী? এক্সাম কেমন গেলো তোমার? লিখেছো সব?

শান্তর সম্বোধনে কপাল কুচকে আসলো রিংকির। ঠোঁট চেপে ধরে, অন্যদিক ফিরে, তীব্র কষ্টে হাসি লুকালো তাশদীদ। রিংকি বললো,

– জ্ জ্বী ভাইয়া। সব লিখেছি।

– সব লিখেছো? তা মামুনী, এইযে যারা হল থেকে বেরিয়েই বলে সব লিখেছি, একশোই দাগিয়েছি, চান্সটা কিন্তু তাদের কপাল থেকেই আগে ফসকে যায়। এটা জানোতো?

রিংকি এবার জবাব দিলো না। তেমনি কপাল কুচকে চেয়ে রইলো। তাশদীদ শান্তর কাধে হাত রেখে ওকে থামালো। গলা ঝেরে বললো,

– আব্, তুমি কিছু খাবে রিংকি? বেলা অনেক হয়েছে।

– উহুম। খাবো না কিছু। কিন্তু আপনার ক্যাম্পাসটা ঘুরে দেখতে চাই।

রিংকি তৎক্ষনাৎ স্বাভাবিক হয়। ওর আবদারে তাশদীদ বারন করলো না। বারনের সুযোগ নেই। ইশারায় শান্ত-টিটুকে বললো, চল যাই। টিটু রাজি হলো। কিন্তু বাধ সাধলো শান্ত। ও গেলো না। তাশদীদ টিটু আর রিংকিকে নিয়ে এগোলো।
ক্যাম্পাসে ঢুকেই তাথৈয়ের চোখে পরলো তাশদীদকে। শুক্রবারের ক্যাম্পাস এমনিতেও ভরাট থাকে। তারওপর ভর্তি পরীক্ষা ছিলো। এতো মানুষের ভীড়েও কালো শার্ট পরিহিত মানুষটাকে দেখাটাকে সৌভাগ্য নাম দেওয়ার ইচ্ছে হলো তাথৈয়ের। সুঠামদেহী সে পুরুষের ডানহাতে কালো সানগ্লাস। দুপুরের রোদেও সেটা চোখে আটেনি তাশদীদ। পাশের মেয়েটাকে আঙুল দিয়ে এটাওটা দেখাচ্ছে ও। তাথৈ বাকিসব ভুলে গেলো। শার্লি কোত্থেকে ওর পাশে এসে দাড়ালো। চুইংগাম চিবাতে চিবাতে গরগরিয়ে বলতে লাগলো,

– মেয়েটা রিংকি। তাশদীদ ভাইয়ের এলাকাততো বোন। এডমিশনের জন্য বোনকে কয়েকমাস পড়িয়েছেন তিনি। কিন্তু ম্যাডাম রিংকি তাকে ব্রোর পরিবর্তে বরের নজরে দেখছে। আর এ নিয়ে তাশদীদ ভাই বহুত ডিসটার্বড।

#চলবে…

#কার্নিশ_ছোঁয়া_অলকমেঘ
লেখনীতে: মিথিলা মাশরেকা

৩৩.

– মেয়েটা রিংকি। তাশদীদ ভাইয়ের এলাকাততো বোন। এডমিশনের জন্য বোনকে কয়েকমাস পড়িয়েছেন তিনি। কিন্তু ম্যাডাম রিংকি তাকে ব্রোর পরিবর্তে বরের নজরে দেখছে। আর এ নিয়ে তাশদীদ ভাই বহুত ডিসটার্বড।

একপলক শার্লির দিকে তাকালো তাথৈ। শার্লি তেমনি চুইংগাম চিবাতে চিবাতে ওকে ইশারা করলো সামনে দেখার জন্য। মুখে বললো,

– শুধু তাশদীদ ভাইকে না দেখে, তার আশপাশটাও দেখ?

তাথৈ এতোক্ষণে রিংকির দিকে চাইলো। ওর মুগ্ধতা ভরা দৃষ্টি দেখতে টের পেলো, এ মুগ্ধতা ক্যাম্পাস নিয়ে না। ক্যাম্পাস দেখানো মানুষটা নিয়ে। রিংকি প্রচন্ডরকমের চেষ্টা করছে তাশদীদের খুব কাছাকাছি থাকার। আর ঠিক ততোটাই নিপুনভাবে ওর সাথে দুরুত্ব বজায় রাখছে তাশদীদ। হুট করেই শার্লির চোখে পরলো, একটা রোগাপাতলা ছেলে এসে তাশদীদের সাথে কথা বলছে। পরনে শার্ট-প্যান্ট। সবচেয়ে বড় কথা, ছেলেটাকে রুমনের মতো দেখাচ্ছে। শার্লির নিজের চোখকে বিশ্বাস হয়না। মুখের চুইংগাম ফেলে দুইবার চোখ ডললো ও। এরপরও যখন দৃশ্য বদলালো না, শার্লি বিস্ময়ে বললো,

– রুমন?

তাথৈয়ের কানে গেলো কি গেলো না, পা বাড়ালো ও। শার্লিও হাটা লাগালো ওর পেছনপেছন।
রুমনকে দেখে খুশি হয়ে যায় তাশদীদ। উল্লাসে জড়িয়ে ধরলো ওকে। টিটু ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে আছে রুমনের দিকে। ছেলেটাকে চেনাচেনা লাগছে ওর। তবে পরিচয়টা মনে করতে পারছে না। তাশদীদ রুমনের কাধে হাত রেখে বললো,

– হ্যান্ডসাম হয়ে গেছো রুমন! কেমন আছো?

তাশদীদের মুখে রুমনের নাম শুনে টিটুর চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম হয়। রুমনের আপাদমস্তক চোখ বুলায় ও। ঢোলাঢালা শার্ট প্যান্ট, ঠিকঠাক মাপের চুলের ছাট, আগের পান্জাবীওয়ালা রুমনের সাথে এর লক্ষ্যনীয় তফাৎ। রুমন হেসে বললো,

– জ্বী ভাই। আছি ভালো। আপনি কেমন আছেন?

টিটু আরেকদফায় চমকায়। শুধু বেশভুষায় না, রুমনের স্বরেও বদল ঘটেছে। সেই হেলে-দুলে কথা বলার স্বভাবটা ওর আর নেই। আগের মেয়েলী ভাবগুলো অসম্ভব রকমের সামাল দিয়ে তাশদীদের সাথে কথা বলছে ও। টিটুকে দেখে ওকেও সালাম দিলো রুমন। বললো,

– আপনি কেমন আছেন টিটু ভাই? দিনকাল কেমন যাচ্ছে?

– এতোক্ষণ তো ঠিকঠাকই ছিলাম। কিন্তু তোকে দেখে শকে আছি। তুই কেমন আছিস?

– জ্বী ভালো।

সৌজন্যতার সাথে জবাব দিলো রুমন। তখনই তাথৈ-শার্লি আসলো সেখানে। তাশদীদ একপলক দেখলো তাথৈকে। তার পরনে কালো টপসের ওপর খয়েরিরঙা কটি। টপস-জিন্সে মেয়েটাকে মন্দ লাগে না। তবুও অজান্তেই ওর মনে তুলনা জাগলো, বসন্তে হলুদ আনারকলি-ওড়নায় তাথৈকে অপ্সরী লাগছিলো। হয়তো সেজন্যই ওর নিজেকে সংবরন করা হয়ে ওঠেনি। আবির মাখিয়েছিলো ও তাথৈকে। তাথৈ একবারের জন্যও তাশদীদের দিকে তাকালো না। ওর দৃষ্টি কেবল রিংকির দিকে। এমনকি রুমনকেও দেখলো না তাথৈ। শার্লি সালাম দিলো ওদের। রুমনের দিকে ঘুষি ছুড়ে বললো,

– হোই! কেমন আছিস?

তাশদীদ সালামের উত্তর নিলো। রুমন লাফিয়ে পিছিয়ে যায়। হেসে বললো,

– তোদের পরে দেখছি। তাশদীদ ভাই? আপনার সাথে আলাদাকরে একটু কথা ছিলো।

তাশদীদ জবাব দেওয়ার আগেই শার্লি রিংকিকে দেখিয়ে বললো,

– এটা কে তাশদীদ ভাই? আপনার আত্মীয়?

– হ্যাঁ। বোন হয় আমার। এডমিশন দিতে এসেছে। রিংকি? ও শার্লি, আর ও তাথৈ। থার্ড ইয়ারে ওরা। বায়োকেমেই। আর ও রুমন, নাট্যকলাতে।

রিংকি কিছু বললো না। ওর এসবে আগ্রহও নেই। তাশদীদ হাতঘড়ি দেখে নিয়ে বললো,

– আচ্ছা তোমার একটু কথা বলো, আমি আর রুমন দুমিনিটে আসছি। চলো রুমন।

রুমনকে নিয়ে হাটা লাগায় তাশদীদ। কয়েকপা দুরে গিয়ে কথা বলতে থাকে দুজনে। টিটু ফোন দেখছিলো, রিংকি তাশদীদকে দেখছিলো, আর তাথৈ রিংকিকে। একটা চা-ওয়ালা পাশ কাটাচ্ছিলো ওদের। শার্লি বললো,

– চা খাওয়ান টিটু ভাই?

চা ওয়ালাকে থামালো টিটু। তিনকাপ চা নেয় তিনজনে। রিংকি চা নিলো না। ও তেমনি তাশদীদকে দেখছে আর মুচকি হাসছে৷ টিটুর কল আসে। চা হাতে কিছুটা পাশে গিয়ে ফোনে কথা বলতে লাগলো ও। শার্লি চায়ের কাপে ফু দিয়ে বললো,

– এক্সাম কেমন দিলে রিংকি?

– জ্বী আপু ভালো।

‘কেলো করেছে। তাথৈ সিনিয়রদের সাথেই যা করেছে, বেটা তুমি জুনিয়র হয়ে আসলে তো…’
অস্ফুটস্বরে আফসোস করতে করতে চায়ে চুমুক দিলো শার্লি। ঠিকঠাক শুনতে না পেয়ে রিংকি বললো,

– জ্বী আপু? কিছু বললেন?

– হুম? হ্যাঁ হ্যাঁ! জিজ্ঞেস করলাম কেমন বোন হও তুমি তাশদীদ ভাইয়ের? আপন বোন?

প্রশ্নটা শুনে রিংকি আবারো তাকালো দুরে দাড়ানো তাশদীদের দিকে। একহাত প্যান্টের পকেটে বাঝিয়ে রুমনের সাথে কথা বলছে সে। তাথৈ তখনো রিংকির দৃষ্টি পরখ করছে। আসার পর একমুহূর্তের জন্যও অন্যদিক তাকায়নি ও। রিংকি তাশদীদের দিকে তাকিয়ে থেকেই বললো,

– আমার আর তাশদীদ ভাইয়ের কেমন সম্পর্ক, সেটা কদিন পরে বলি আপু?

– কেনো? কদিন পরে তোমাদের বর্তমান সম্পর্ক বদলে যাবে নাকি?

– মনে করুন তাই।

রিংকির জবাব শুনে চায়ে চুমুক দেওয়ার মুহুর্তেই কাশি উঠে যায় শার্লির। রিংকি ওকে সামলাতে সবে মুখ খুলেছে, ‘আপু সামলে…’ তৎক্ষনাৎ ওর গায়ের ওপর চা এসে পরে। শার্লি আটকে যায়। সাথে রিংকিও। উবু হয়ে দেখলো, পছন্দের জামাটায় চায়ের দাগ পরে গেছে। বিস্ফোরিত চোখে পাশে তাকায় রিংকি। যা বুঝলো, হাতে থাকা কাপের পুরো চা ওর জামায় ছুড়েছে তাথৈ। তবে এমনটা করেও তার বিন্দুমাত্র হেলদোল নেই। তেমনি স্থির চাওনিতে তাথৈ চেয়ে আছে রিংকির দিকে। রিংকি তীব্র বিস্ময়ে বললো,

– এটা কি করলেন?

– কথা পছন্দ হয়নি।

তাথৈয়ের জবাব মাথায় ঢোকে না রিংকির। ও আরো দ্বিগুণ বিস্ময়ে বললো,

– কিহ?

– চ্ চা! চা পছন্দ হয়নি ওর! চা পছন্দ হয়নি!

শার্লি তাথৈয়ের রাগ ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করলো। রিংকি কানে তুললো না সেটা৷ নিজের জামা ঝাড়তে ঝাড়তে, কাদার মতো করে ন্যাকিস্বরে বললো,

– তাই বলে এভাবে ছুড়বেন? পুরোটা আমার জামায় লেগে গেলো!

– ও। চা তোমার জামার ওপর পরেছে? তুমি এখানেই দাড়ানো?

তাথৈয়ের বিস্ময়ের স্বর। এমন প্রশ্নে রিংকিই যেনো আকাশ থেকে পরলো। বলে কি এই মেয়ে? ও ওখানে সেটা কি তাথৈ দেখেনি? সব ভুলে অবাকচোখে চেয়ে রইলো ও। তাথৈ একমুহূর্তে বিস্ময় কমালো। নিস্প্রভ কন্ঠে জবাব দিলো,

– বাচ্চা মেয়ে তো, তাই নজরে আসোনি। ইওর ব্যাড।

‘নজরে আসেনি তাই যেমন, নজরে আসলে তো তুই ওকে বৃন্দাবন-ই দেখাবি। বেচারী!’
কপাল চুলকে আস্তেকরে বললো শার্লি। কিছু কানে না গেলেও কথা বোঝার জন্য রিংকি ওর দিকে তাকালো। এরমাঝে তাশদীদ আর রুমন এগোলো ওদের দিকে। রিংকিকে জামা ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাশদীদ ভ্রুকুচকালো। শার্লি তৎক্ষণাৎ জোরালো হেসে বললো,

– ইয়ে তাশদীদ ভাই, আসলে হয়েছে কি, আমার না হিচকি উঠলে চোখেমুখে পানির ছিটা দেওয়া লাগে। তাথৈ এটা জানে। চা খেতে গিয়ে আমার হিচকি উঠে গিয়েছিলো। আর সেটা দেখতেই ও হাতের কাছে যা পেয়েছে, ছুড়ে মেরেছে। আর ঠিক ওইসময়ই রিংকিও এগিয়েছে আমার টেককেয়ার করতে৷ তাই চা টুকো ওর জামায়…

শার্লিকে পুরোদমে উল্টো জবাব দিতে দেখে মুখ কিঞ্চিৎ হা হয়ে যায় রিংকির। একটু আগে তো উল্টো বাহানটাই দিয়েছে সে। তাশদীদ একপলক তাথৈয়ের দিকে তাকালো। সে বুকে হাত গুজে সেই চিরাচরিত ডোন্ট কেয়ার ভাবে দাড়িয়ে। পকেট থেকে টিস্যু বের করে রিংকিকে এগিয়ে দিলো তাশদীদ। রিংকি জামা মুছতে লাগলো। তাথৈ তুখোড় নজরে ওরদিক তাকিয়ে থেকে বললো,

– মরাল অফ দ্যা টোরি, আমি যাদের টেককেয়ার করি, তাদের থেকে দুরে থাকো। তাহলে আর সমস্যা হবে না।

রিংকি থেমে গেলো। চোখ তুলে, কপালে ভাজ ফেলে তাকালো ওর দিকে। এই মেয়েটার গলার স্বর ওর সুবিধের ঠেকছে না। নাইবা তাথৈয়ের চাওনি ওর সুবিধার ঠেকছে। রিংকি তাশদীদের দিকে তাকিয়ে তাড়া দেখিয়ে বললো,

– ব্ বাসায় চলুন তাশদীদ ভাই। অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে।

তাশদীদ মাথা নেড়ে হ্যাঁ বুঝালো। ইশারা করলো এগোনোর জন্য। রিংকি ওদের পাশ কাটালে সোজা হয়ে দাড়ায় তাথৈ। তাশদীদ ওকে উদ্দেশ্য করে বললো,

– কারো কোনো বিষয় অপছন্দ হলে তাকে হেনস্তা করার মানে হয়না। সবাই তোমার মনমতো হবে না, এটাই স্বাভাবিক।

– কেউ আমার মনমতো বিষয়কে হেনস্তা করলে আমার তাকে অপছন্দ হবে, এটাও স্বাভাবিক।

তাশদীদ জবাব খুজে পায় না। প্রথমবারের মতো তাথৈকে দেবার মতো জবাব ওর কাছে নেই। তবে ও এটা বেশ বুঝেছে, রিংকি এমন কিছু একটা করেছে যেটা তাথৈয়ের পছন্দ হয়নি। তাই ইচ্ছে করে ও চা ছুড়েছে রিংকিকে। ওকে চুপ দেখে একপা এগোলো তাথৈ। একদমই নমনীয় গলায় বললো,

– মাইন্ড ইওর ওন রেসপন্সিবিলিটি মিস্টার তাশদীদ ওয়াসীর। আমারটা আমি সামলে নেবো।

তাশদীদ সানগ্লাসটা চোখে এটে আরেকপলক শার্লি-রুমনের দিকে তাকালো। তারপর চলে আসলো ওখান থেকে। ঘাড় বাকিয়ে ওর চলে যাওয়া দেখে মুচকি হাসলো তাথৈ। নিজেনিজেই বললো,

– তোমাকে এতো ভালো হতে কে বলেছে মিস্টার? বাট ডোন্ট ইউ ওয়ারী। অলিগলিতে যতো ডিস্টার্বেন্স কুড়িয়ে রেখেছো, এগুলোর সবগুলোর দায়িত্ব এখন আমার। এন্ড হোয়াট আই সেইড, আই সেইড। আমার দায়িত্ব আমি বেশ ভালোমতো সামলে নেবে।

ওর কথা শুনে শার্লি শব্দ করে হেসে দিলো। রুমন এতোক্ষণ কেবল চুপচাপ সবটা দেখছিলো। কিছুই বুঝে আসেনি ওর। এবারে চেচিয়ে বললো,

– তোরা দুইটা কি বলবি আমাকে কি হয়েছে? নাকি আমি তাশদীদ ভাইকে ডেকে জিজ্ঞেস করবো?

তাথৈ তেমনি তাশদীদের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। শার্লি হাসি কমালো। কিছুসময় পর ক্যাফেটেরিয়ায় গিয়ে বসলো তিনজনে। শার্লির মুখে সবটা শুনে রুমন বড়বড় চোখে তাকিয়ে রইলো তাথৈয়ের দিকে। তাথৈ প্রেমে পরেছে, কথাটা কোনোমতেই বিশ্বাস হচ্ছিলো না ওর। তাথৈ ওর চাওনিকে একবিন্দু পাত্তা না দিয়ে স্ট্র তে চুমুক দিলো। বললো,

– এবার বল, তাশদীদের সাথে তোর এতো গোপন কথা কিসের?

রুমন হচকিয়ে যায়। নড়বড়ে কন্ঠে জবাব দেয়,

– গ্ গোপন কথা? গোপন কথা মানে কি?

– এইযে ওকে দেখেই ‘তাশদীদ ভাই’ বলে ছুট লাগালি, এর কারন কি?

– দ্ দেখ তাথৈ, আমি ভালো হয়ে গেছি। উল্টাপাল্টা ভাববি না একদম!

রুমনের সতর্ক-স্বর। তাথৈ টেবিলে দুহাত রেখে ঝুকলো। মিষ্টি হেসে বললো,

– জানি৷ আর তুই ভালোটা কি করে হলি, সেটাই জানতে চাইছি।

– তাশদীদ ভাই বলে ছুট লাগিয়েছি কারন আমার চেন্জেজ গুলোতে তার অনেকটা অবদান আছে। কনসালটেশন সেন্টারে যাওয়ার আইডিয়াটা তারই ছিলো।

স্পষ্ট জবাব দেয় রুমন। ওর জবাব শুনে তাথৈ চেয়ারে হেলান দিয়ে আয়েশে বসলো। এই একটা নামে কতোরকমের মুগ্ধতা জমা হতে পারে ভেবে ভেতরবাহির পুলকিত হতে থাকে ওর। শার্লি অবাক হয়ে বললো,

– কি? এখানেও তাশদীদ ভাই?

– হু। ওইদিন আফিফকে চড় মারার পর ভাই আমার ডিপার্টমেন্টে গিয়েছিলো। অনেকক্ষণ কথা হয় তারসাথে আমার। সে আমাকে বুঝায়। আমার সাথে যা ঘটছে, এসবের কারন, ফল। । ছোটবেলা থেকে আমাকে সবাই খুঁচিয়েছে। আর পরিবারের কেউ বুঝাতে আসলেই জ্ঞান দিতে এসেছে ভেবে ক্ষেপে যেতাম। কিন্তু বিশ্বাস কর শার্লি, সেদিন তাশদীদ ভাই আমাকে যা যা বলেছে, কেনো যেনো তার একহরফ নজরান্দাজ করতে পারিনি আমি। ধর্মীয় অনুশাসন ভুলতে বসেছিলাম। সেদিন প্রথমবারের মতো আমার অপরাধবোধ হয়। অনুধাবন হয়, যে লাইফটা আমি লিড করছিলাম, তা আমার লাইফ না। ওপরওয়ালা আমাকে যেভাবে সৃষ্টি করেছে, আমি সেটাই। একটাসময় হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিলাম। আমার মনে হতে লাগলো, আমি এই জীবনটা থেকে বেরোতে চাই। সাহস করে সেটা বলেও ফেললাম তাশদীদ ভাইকে। বাকিটা উবিই সামলেছেন। তার পরিচিত এক কনসালটেন্টের কন্টাক্ট দিলেন আমাকে। বাসায় জানিয়ে পারি জমালাম ওনার রিহ্যাব সেন্টারে। মেডিসিন, মেন্টাল থেরাপি দুটোই চলেছে এতোদিন। এখনো চলছে। ডক্টর বলেছে এখন আমার রেগুলার পরিবেশ দরকার। নিজেকে কতোটুকো বদলাতে পেরেছি তা যাচাইয়ের জন্য। তাই ঢাকায় এসেছি। যদি মানিয়ে নিতে না পারি, আবারো যাবো। মেবি এই সেমিস্টার গ্যাপ যাবে। বাট ব্যাপার না। অল আই নিড ইজ, আ চেইন্জ। এন্ড আ’ম লাভিং মাইসেল্ফ রাইট নাও।

একনাগাড়ে বলে দম নেয় রুমন। শার্লি খুশি হলো ওর কথায়। তাথৈ গলার লকেটটা আকড়ে ধরে বসে রইলো। ও বুঝছে, তাশদীদকে ঘিরে ওর মুগ্ধতা সীমাপার করেছে, ওর ভালোবাসা সীমাপার করেছে। আর এতে কোনো সন্দেহ নেই, তাশদীদের জন্য ওর পাগলামীও সব সীমা পার করতে চলেছে। সে পাগলামীতে আকাশ-পাতাল এক করতেও ওর বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ হবে না। ভূমিতল আকাশ ছুঁতে চাক বা না চাক, দুর আকাশের অলকমেঘ ঠিক এসে ভূমিতলের কার্নিশ ছুঁয়ে দেবে।
ভালোবাসায় সব সম্ভব! সব!

#চলবে…