#কার্নিশ_ছোঁয়া_অলকমেঘ
লেখনীতে: মিথিলা মাশরেকা
৪৯.
– আমাকে ডিভোর্সটা কবে দিচ্ছো তুল্য?
তুল্য আলোর দিকে প্রসারিত চোখে চায়। বিয়ের পর অনেকেরই ছাড়াছাড়ি হয়। কিন্তু বিয়ে নামক বন্ধনে আবদ্ধ হবার ঠিক পূর্বমুহূর্তে, সেই নিশ্চিত বিয়ে থেকেই আজোবদি কোনো মেয়ে মুক্তি চেয়েছে বলে ওর মনে হয়না। আশপাশের কেউ কথাগুলো শোনেনি হয়তো। সবাই মিলে জবরদস্তি করেই আলোকে বসিয়ে দিয়েছে কাবিননামায় সই করার জন্য। এক লোক ওকে দ্রুত সই করার জন্য তাড়া দিলো। কিন্তু আলোর ভাবান্তর নেই। ও কাবিননামায় কলম ধরে স্থির হয়ে বসে আছে। সই করছে না। তুল্যর জবাব না পেয়ে পাশে তাকালো আলো। পাশে বসা মানুষটার মুখ দেখতেই ঘৃণায় চোখ ভরে ওঠে ওর। তবুও দৃঢ় কন্ঠে বললো,
– কবে দিচ্ছো ডিভোর্স?
– ডিভোর্স দেওয়ার জন্য আমি তোমাকে বিয়ে করছি না আলো।
– তাহলে কেনো করছো বিয়ে?
– সেটা তোমার জানার বিষয় না। এই প্রশ্নের জবাব তুমি কখনো পাবেও না আলো। দ্রুত সাইনটা করো।
– এই বিষাক্ত সম্পর্ক আমি কখনোই মানতে পারবো না তুল্য। তাই যতোক্ষণ না এই সম্পর্ক থেকে মুক্তির নিশ্চয়তা পাচ্ছি, আমি সাইন করবো না।
আলোর তেমনই জোরালো কন্ঠ। অন্যত্র দৃষ্টি সরিয়েছে ও। তুল্য ধৈর্য্য হারায়। নিজেও এবার জেদ নিয়ে শক্তকন্ঠে বলে,
– বেশ। দিয়ে দেবো তোমাকে ডিভোর্স! এই সম্পর্কে থাকতে হবেনা তোমাকে! ওকে? সন্তুষ্ট তুমি? খুশি? নাও সাইন!
আলো একপলক তাকালো তুল্যর দিকে। পুনরায় চোখ ভরে ওঠে ওর। তুল্যকে কখনো ওকে এভাবে ঘৃণা করতে হবে, তা কল্পনাও ছিলো না ওর। ওই হয়তো প্রথম, যে কিনা ভালোবাসার মানুষটাকে আপন করে পাওয়ার আগমুহুর্তে তাকে ঘৃণা করতে বাধ্য হচ্ছে। বিয়ে নামক পবিত্র সম্পর্কে জড়ানোর আগেই সে সম্পর্ককে অসম্মান করে বিচ্ছেদ চাইছে। কান্না সংবরন করে কাবিননামায় সই করলো আলো। কবুল করে নিলো তুল্যকে। সবাই যখন সদ্য বিয়ে হওয়া দম্পতির যখন মোনাজাত করছিলো, আলো স্তব্ধ হয়ে বসে ছিলো চৌকিতে। কাজির কথায় তুল্য মোনাজাত ধরলেও মোনাজাত ধরেনি ও। ওর বোনদুটো মুখ লুকিয়ে কাদছে, মা নিথর। বিয়ে শেষ হলে একেএকে আলোদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে থাকে সব। আলোর মা এবারে কাছে আসলেন মেয়ের। তুল্য উঠে দাড়ালো। একহাত প্যান্টের পকেটে গুজে বললো,
– চলো আলো, শশুড়বাড়ি চলো। বেরোতে হবে আমাদের এখন।
– আমি কোথাও যাবো না।
তুল্য ভ্রু কুচকালো। আলোর মায়ের দিক তাকিয়ে বললো,
– মেয়ে কি বলে আপনার? বিয়ের পর যে মেয়েদের শশুড়বাড়ি যেতে হয় তা মেয়েকে শেখাননি?
ভদ্রমহিলা একনজর তাকালেন তুল্যর দিকে। মলিন শাড়ি পরিহিত মহিলার চাওনি দেখে আটকে যায় তুল্য। অনুভব করে, তার চোখজোড়া চেচিয়ে বলছে, ‘আমার মেয়ের শিক্ষায় আঙুল তোলার মতো যোগ্যতা তোমার নেই!’ মহিলা দৃষ্টি সরিয়ে মেয়ের শুকনো চেহারার দিকে তাকালেন। কাধে হাত রেখে নরম স্বরে বললেন,
– পরিস্থিতি যাই হোক। বিয়েটা হয়ে গেছে আলো। এবার নিজের দায়িত্ব পালন কর মা। পিছিয়ে আসার কোনো সুযোগ নেই তোর।
আলো টলোমলো চোখে মায়ের দিকে চাইলো। করুন স্বরে বললো,
– তুমিও একথা বলছো মা? তুমিই তো বলতে, ভালোবাসা না থাকলেও একটা মানুষের সাথে এক ছাদের নিচে থাকা যায়, তারসাথে সংসার করা যায়। কিন্তু যাকে ঘৃণা করি, তার সাথে একমুহূর্তও থাকা সম্ভব হয় না। আমার পক্ষেও ওর সাথে যাওয়া সম্ভব না মা! এই ছেলেকে আমি ঘৃণা করি মা! একে আমি ঘৃণা করি!
আলো সশব্দে কেদে দিলো। ওদিকে ওর বলা ‘ঘৃণা’ শব্দটা তুল্যর আত্মসম্মানে তীব্র আঘাত করে যেনো। কিশোর বয়স থেকেই অনেক মেয়ের স্বপ্নের নায়ক ছিলো ও। আজোবদি কোনো মেয়ে ওকে ‘ঘৃণা করি’ বলেনি। দোষী বলে আলো যখন ওকে চড় মেরেছিলো, সেটাতেও চুপ ছিলো তুল্য। কিন্তু এই ‘ঘৃণা করি’ শব্দদুটো ওকে আর চুপ থাকতে দিলো না। ভেতরের পুরুষালি গৌরব মাথাচাড়া দিয়ে উঠতেই এগিয়ে গিয়ে আলোর হাত চোপে ধরে ও। তুলে দাড় করিয়ে বললো,
– অনেক শুনেছি! নাও লিসেন! তুমি ঘৃণা করলেও আমি তোমার বর, ঘৃণা না করলেও আমি তোমার বর! তোমার এইসব ন্যাকামোতে এই সত্যিটা বদলে যাবে না গট ইট? চলো এবারে!
তুল্য আলোকে নিয়ে পা বাড়াচ্ছিলো। কিন্তু আলোর মা ওর পথ আগলে দাড়ালো। নিজের বরাবরের দৃঢ়তা বজায় রেখে গম্ভীর কন্ঠে বললো,
– আমার মেয়েকে আমি চিনি তুল্য। আমি জানি, ও কখনো এমন কিছু করবে না যাতে ওর বর বা ওর শশুড়বাড়ি, কখনো কারো কোনো অসম্মান হয়। কিন্তু আমি তোমাকে চিনি না। আজ তুমি আমার মেয়েকে যেভাবে অসম্মান করেছো, তা আমার সারাজীবন মনে থাকবে। তাই তুমিও একটা কথা মনে রেখো, আজকের পর যদি আমার মেয়ে কোথাও, কোনোভাবে অসম্মানিত হয়, আমি তোমাকে ছেড়ে কথা বলবো না। আলো তোমার বিবাহিতা স্ত্রী। কোনো কেনা দাসীবাদি না যে জোর করে তুলে নিয়ে যাবে। ওকে নিয়ে যেতে চাইলে সম্মানের সাথে নিয়ে যাও।
তুল্য এবারেও দমে গেলো। জেদে শক্ত হয়ে থাকা চোখমুখ নেতিয়ে আসলো ওর। আলোর হাত ছেড়ে দরজায় গিয়ে দাড়ালো ও। আলোর মা ব্যাগ থেকে একটা হার আর একজোড়া বালা বের করে মেয়ের গলায়, হাতে পরিয়ে দিলেন। বুক ফেটে আসা কান্নাকে নিরবে বিসর্জন দিতে লাগলেন। মেয়েকে দেখতে আসবে, বিয়েও হয়ে যেতে পারে ভেবে এই গয়না আনতে আগেরদিন বিকেলে যদি তিনি না যেতেন, তাহলে হয়তো এমন দিন তার মেয়েকে দেখতে হতো না। আলো মাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাদতে থাকে। ওর বোনেরাও এসে জরিয়ে ধরলো ওকে। চোখের জল মুছে মেয়েকে বিদায় দিলো আলোর মা-বোন। ছোটছোট ঘরদোর আর গলি পেরিয়ে মুলসড়কে থাকা তুল্যর গাড়ি অবদি আসলো তারা। আলো যন্ত্রমানবীর মতো পেছনের সিটে বসলো। লুকিং মিররটা আলোর দিকে ঠিকঠাক করলো তুল্য। গলায় আটকানো ঝকঝকে সোনার গয়নাটা ব্যতিত, সুতির থ্রি পিস, নত দৃষ্টি, শুষ্ক চোখমুখ, কপাল গালে এলোমেলোভাবে পরে থাকা দুচারটে চুল, দৃষ্টিগোচর হওয়া গলার রগে ঘামের কনারা, মাথায় হালকা নীল রঙের ওড়না তুলে দেওয়া বধুকে কোনোদিক থেকেই বধু বলে মনে হচ্ছে না। তুল্য দৃষ্টি সরালো। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে গরগর করে বলতে থাকে,
– আমরা দুজন দুজনকে ভালোবাসি। একদম ফার্স্ট ইয়ার থেকেই আমাদের প্রেম। হুট করেই তোমার বিয়ে ঠিক হয়, তাই দুজনে এভাবে বিয়েটা করতে বাধ্য হয়েছি।–এই মিথ্যেটা মুখস্থ করে নাও আলো। যদি সত্যিই তুমি চাও যতো দ্রুত সম্ভব ডিভোর্সটা হোক, তাহলে দুনিয়ার সামনে এটাই বলতে হবে তোমাকে।
•
– ত্ তোমাদের আর আলোর বাড়িতে যেতে হবে না ওয়াসীর। আলোর আজ সকালেই বিয়ে হয়ে গেছে।
ফোনের ওপাশ থেকে এমন একটা কথার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না ওয়াসীর সাহেব। ওপাশের ভদ্রমহিলা বেশ শান্তশিষ্টভাবে বুঝিয়ে বলতে থাকে তাকে। তিনি কল কাটতেই একটা ক্ষুদ্রশ্বাস ফেললেন ওয়াসীর সাহেব। কিছুদিন আগে তাশদীদকে চাকরির চিঠিতে প্রতিত্তর করতে দেখেছিলেন তিনি। যেহেতু জানতেন ছেলে চাকরি পেলে তবেই বিয়ের জন্য রাজি হবে, তাই মিসেস ওয়াসীর খুশি হয়ে তাশদীদকে শুধিয়েছিলেন, ‘বিয়ে নিয়ে এবারে ও কিছু ভাববে কিনা?’ তাশদীদের জবাব হ্যাঁ সূচক ছিলো। ‘হ্যাঁ, বিয়েটা করেই নেবো এবারে।’ ছেলের মুখে এমন জবাব শুনে একটু বেশিই খুশি হয়ে যান দুজনে। তাশদীদের পছন্দ সম্পর্কে ধারনা আছে বলে আলোকে পছন্দ করেছিলেন ওয়াসীর সাহেব। আগে থেকে বললে তাশদীদ রাজি হতো না। তাই আজ ওকে নিয়ে একবার আলোকে দেখতে যেতে চেয়েছিলেন তিনি। সেখানে হুট করে পাওয়া এমন অনাকাঙ্ক্ষিত খবরটায় তিনি নিরাশই হয়েছেন বটে। ওয়াসীর সাহেব পেছন ফিরে আটকে যান। অফহোয়াইট টিশার্ট পরনে, একহাত প্যান্টের পকেটে গুজে ছোট ওয়ারড্রেবটায় হেলান দিয়ে দাড়ানো তাশদীদ বাবাকে ফিরতে দেখে সোজা হয়ে দাড়ালো। স্নিগ্ধ এক হাসি উপহার দিয়ে, স্বাভাবিক স্বরে বললো,
– সুমি ম্যাম তোমাকে কি করে চেনেন বাবা? তোমাকে কেনো কল করেছিলেন উনি?
ওয়াসীর সাহেব একবার হাতের ফোনের দিকে তাকালেন। কল বাজছিলো বলে বারান্দা থেকে ফোনটা তাশদীদই তাকে এনে দিয়েছে। এরপর রুম থেকে বেরিয়েও গেছে। নম্বরটা সুমি নামে সেইভ করা। কিন্তু সেটা যে তাশদীদের ম্যাম, তা তাশদীদের জানার কথা না। তাশদীদ তেমনই হাসিমুখে বললো,
– প্রায় সাড়ে সাত মাস ওনার সাথে প্রজেক্টে ছিলাম। কন্টাক্ট নম্বর মুখস্থ হয়ে যেতেই পারে বাবা। এটা কিন্তু কোনো ভাবনার বিষয় না।
ওয়াসীর সাহেব জোরপূর্বক হাসলেন। মোবাইল পাঞ্জাবির পকেটে পুরতে পুরতে বললেন,
– আরে, তোমার ম্যাম আমার ক্লাসমেট ছিলো। একই কলেজে পড়েছি দুজনে।
– আর আমার দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর?
ওয়াসীর সাহেব কিছুটা ইতস্তত করতে লাগলেন এবারে। তাশদীদ বাবার দিকে এগোলো। ঠোঁটের সৌজন্য হাসিটা রেখে, স্পষ্ট গলায় বললো,
– প্রথম প্রশ্নের উত্তরটাও পুরোপুরি দাওনি তুমি। সমস্যা নেই। আমিই বলছি। তোমার কলেজের ক্লাসমেট যে আমারই ভার্সিটির প্রফেসর, এটা তুমিও জানতে না। কিন্তু ম্যাম যখন আমাকে প্রজেক্টে ফেরানোর জন্য কনভিন্স করাতে তোমাকে ক্যাম্পাসে ডাকলো, সেখানে গিয়ে তুমি জানতে পারলে, সে তোমার ক্লাসমেট৷ তোমাকে ডেকে নিয়ে, আমি যাতে এই লাস্ট স্টেজে প্রজেক্টটা না ছাড়ি, এ নিয়ে তোমার কলেজের ক্লাসমেট তোমাকে প্রচুর অনুনয় করলো। তুমি আর মানা করতে পারলে না। রাজি হয়ে গেলে আমাকে রাজি করানোর জন্য। এখন তোমার সেই রাজি করানোর প্রোগ্রেস কতোদুর, সেটা জানতেই ম্যাম তোমাকে কল করেছিলো। তাইতো?
ওয়াসীর সাহেব বিস্ময়ে চাইলেন ছেলের দিকে। তাশদীদের বলা একটা বর্ণও মিথ্যে নয়। তবে শেষলাইনটা বাদে। সত্যিই তাশদীদকে মানানোর জন্য ডাকা হয়েছিলো তাকে। কেবিনে প্রফেসর সুমির সাথে কথা বলার সময়ই আলো একবার এসেছিলো। কোনো এক পড়ার বিষয়ে। নম্র-শালীন স্বভাব আর মিষ্টিভাষী মেয়েটাকে ছেলের জন্য প্রথম দেখাতেই বেশ পছন্দ হয়ে যায় তার। প্রফেসরের সাথে সেদিনই আলোর বিষয়ে কথা বলে আসেন তিনি।
আলোর বিষয়ে না জানলেও ছেলের এতোবড় সিদ্ধান্তের বিপরীতের ভাবনা ওর কাছ থেকে লুকিয়ে গেছেন, আর সেটা তাশদীদ জেনে গেছে ভেবে ওয়াসীর সাহেব লজ্জিতবোধ করলেন। তার চেহারায় অন্ধকার নেমে আসে। প্রথমবারের মতো বাবার চেহারায় এমন অনুশোচনা দেখে তাশদীদ। অকস্মাৎ বাবাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ও। ওয়াসীর সাহেব চমকালেন। বিস্ময়ে আস্তেধীরে তাশদীদের পিঠে হাত রাখতেই ও স্পষ্টভাবে বললো,
– আ’ম সরি বাবা। তোমার অসম্মান, অনুশোচনা কোনোটাই হোক, আমি সেভাবে কিছু বলতে চাইনি বিশ্বাস করো। ব্যস তুমি আমার থেকে কোনো কথা লুকিয়ে গেছো, এটাই মানতে পারছিলাম না। তুমি যে প্রজেক্ট নিয়ে ম্যামের সাথে কথা বলেছো, সেটা তুমি আমাকে বলতেই পারতে। বলোনি যখন, তাহলে আমিই কোনোভাবে তোমার ভরসা থেকে সরে গেছি হয়তো। সেটা সম্পুর্নই আমার ব্যর্থতা। সে দুরুত্বের জন্য আমি দায়ী। আমিই দোষী বাবা। তুমি মন খারাপ করে আমার দোষ আর বাড়িও না প্লিজ। আ’ম সরি এগেইন।
ওয়াসীর সাহেব নিজেও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন ছেলেকে। চোখ বন্ধ করে অনুভব করলেন, কতো বড় একটা ভুল করতে চলেছিলেন তিনি। ভালো হয়েছে আলোর বিয়েটা হয়ে ওনাদের যাওয়াটা বাতিল হয়েছে। নয়তো ছেলের কাছে হয়তো আরো অনেকবেশি ছোট হয়ে যেতে হতো তাকে।
•
ব্যস্তভাবে সিড়ি বেয়ে নামার সময় ড্রয়িংরুমে ছেলের সাথে অপিরিচিতা মেয়েকে দেখে পায়ের গতি কমে আসে তৈয়ব আলফেজের। ব্রিফকেস হাতে স্যুটবুট পরিহিত বাবাকে দেখে তুল্য বুঝলো, অফিসের জন্য বেরিয়ে যাচ্ছে সে। বাবার ভাজ পরা কপাল দেখে পাশে দাড়ানো আলোর হাত চেপে ধরলো তুল্য। আলো মাথা নিচু করে দাড়ানো। তৈয়ব আলফেজ সিড়ি থেকে নেমে এসে তুল্যর আলোরা হাত ধরে রাখা পরখ করলেন। গুরুগম্ভীর আওয়াজে বললেন,
– কে ও?
– ও আলো। আমার বউ। তোমার বউমা।
ছেলের উচ্চারন করা চারটে শব্দ তৈয়ব আলফেজের কাছে বিষের মতো অনুভব হলো। আলো দৃষ্টিনত রেখেই মৃদ্যুস্বরে সালাম দিলো তাকে। তৈয়ব আলফেজ হুংকার ছেড়ে বললেন,
– বউমা মানে? কিসের বউমা? হুট করেই তুমি যাকেতাকে ধরে আনবে আর বলবে সে তোমার বউ, এই করলেই সে আমার বউমা হয়ে গেলো?
– ধরে আনিনি, বিয়ে করে এনেছি। ফার্স্ট ইয়ার থেকে প্রেম ছিলো। ভেবেছিলাম পরে তোমাকে জানিয়েই বিয়েটা করবো। তুমি মানো বা না মানো সেটা তোমার বিষয়। কিন্তু হুট করেই ওর ফ্যামিলি ওকে অন্যজায়গায় বিয়ে দিয়ে দিচ্ছিলো। তাই কোনো উপায় না পেয়ে আজই দুজনে বিয়ে করে নিয়েছি।
তৈয়ব আলফেজ বিস্ময়ের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌছালেন যেনো। তুল্যর কোনো কাজে তিনি কোনোদিনই সন্তুষ্ট ছিলেন না। কিন্তু আজকে সব সীমা পার করেছে সে। বিলাসবহুল জীবন নিশ্চিত করতে তার প্রাক্তন স্ত্রী যখন তাথৈকে দাবী করেছিলো, সেদিন থেকেই ছেলেমেয়েকে বিত্তবান পরিবারে বিয়ে দেওয়ার জেদ ছিলো তৈয়ব আলফেজের। সেখানে তুল্য চাল চুলোহীন কোথাকার কোন মেয়েকে এনে অম্বুনীড়ে তুলছে, তা কখনোই তারপক্ষে মানা সম্ভব না। ‘ছেলেমেয়েদের গরিবের ঘরে বিয়ে দিয়ে ওদের জীবন শেষ করে দিয়েছো।’ দুনিয়া উল্টে গেলেও প্রাক্তন স্ত্রীর কাছ থেকে এমন কথা শুনতে নারাজ তিনি। তেজী স্বরে বললেন,
– কিসের বিয়ে? আমি কোনো বিয়ে মানিনা তুল্য। ওকে যেখান থেকে এনেছো, সেখানে ফিরে দিয়ে এসো যাও৷
– টায়ার্ড লাগছে ড্যাড৷ তর্কের এনার্জী নেই। তাছাড়া তর্ক করলে সত্যিটা বদলাবেও না। ও এখন থেকে অম্বুনীড়েই থাকবে। অভ্যাস করে নাও।
– অভ্যাস করতে হবে না বাবা। আমি অভ্যাস হতে আসিনি।
এতোক্ষণে এগিয়ে আসলো আলো। তুল্য তাকালো ওর দিকে। আলো ওর কথায় সায় দেবে কি না এ নিয়ে সন্দেহ আছে ওর। বলার সুযোগ থাকলে ও হয়তো আলোকে বলতো, কথা না বলতে। তৈয়ব আলফেজের রাগ বাড়লো কেবল। বুঝলেন, আর একদন্ড থাকলে যেকোনোকিছু করে ফেলতে পারেন তিনি৷ নিজেকে শান্ত করতে দ্রুততার সাথে বেরিয়ে গেলেন তিনি।
তাথৈ ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসে একদৃষ্টিতে নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখমুখ শুষ্ক। চেহারার সাথে ফর্সা শরীরটা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে ওর। যেনো দেহে একবিন্দু রক্তেরও সঞ্চালন নেই। ওড়নাবিহীন গলায় উচু হয়ে থাকা বিউটি বোন সৌন্দর্যের পরিবর্তে জীর্ণতার জানান দিচ্ছে। নিচ থেকে বাবার চেচানো অস্পষ্টভাবে শুনলেও কারন বুঝলো না তাথৈ৷।বোঝার চেষ্টাও করলো না। বরং মানসিক প্রস্তুতি নিতে থাকলো ও। কিছুক্ষণের মধ্যেই আলো হয়তো কল করবে ওকে, কেনো ও এখনো পৌছালো না ওর বাড়ি, তাশদীদের সাথে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে ওর। তাশদীদের কথা ভাবতেই পুনরায় চোখ ভরে ওঠে তাথৈয়ের। কানে আওয়াজ আসে,
– তাথৈ?
আয়নাতেই দরজায় দাড়ানো তুল্যর দিকে তাকালো তাথৈ। ঠিক একসেকেন্ডের মাথায় ওর দৃষ্টিসীমায় অবতীর্ণ হয় আলো। ওড়না দেওয়া নতমস্তকের আলোকে অম্বুনীড়ে দেখে নিজের চোখকে বিশ্বাস করলো না তাথৈ। তুল্য কিঞ্চিৎ ঘাড় ঘুরিয়ে আলোকে দেখে নিলো। একদম স্বাভাবিক ভঙিতে বললো,
– তোর ভাবী। ওয়েলকাম কর ওকে।
তাথৈ প্রতিক্রিয়া করা ভুলে যায়। কি ঘটছে বুঝে না উঠে একবার ভাইয়ের দিকে তো একবার আলোর দিকে তাকায় ও। অনুভূতিশুণ্য হয়ে এগোয় তুল্য-আলোর দিকে। বিস্ময়ে বলে,
– কি বলছিস তুই এসব?
– কখনো এভাবে তোমার সামনে দাড়াতে হবে, তা আমি জীবনেও কল্পনাও করিনি তাথৈ। তিনবছরের প্রেমকে পরিনতি দিতে পরিবারের অবাধ্য হতে আর তোমার বন্ধুত্বের জলাঞ্জলি দেওয়ার মতো পাপ করতে বাধ্য হয়েছি। উপায় ছিলো না আমার। পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও।
মন্ত্রপুতের মতো বলে দেয় আলো। ওর জবাব শুনে টপটপ করে জল গরাতে থাকে তাথৈয়ের চোখ দিয়ে। সর্বোচ্চ ঘৃণা নিয়ে ভাইয়ের মুখপানে চাইলো ও। বুঝতে বাকি রইলো না, বিয়েটা তুল্যর জেদের ফল। যেহেতু ও বলেছিলো কাউকে কিছু জানালে ও আত্মহনন করবে, তাই তাশদীদের সাথে আলোর বিয়ে আটকাতে আলোকে নিজেই বিয়ে করে অম্বুনীড়ে নিয়ে এসেছে তুল্য। বোনের কান্না দেখে তুল্য হয়তো কিছু বলতে যাচ্ছিলো। আর তার আগেই ওকে চড় মারতে উদ্যত হয় তাথৈ।
এরইমাঝে ঘটে যায় আরেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। মুহুর্তের ব্যবধানে কি হয়েছে তা অনুভব করে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে যায় দু ভাই বোন। ওদের মাঝখানে কিঞ্চিত ঘাড় বাকিয়ে চোখ বন্ধ করে দাড়ানো আলো। তাথৈয়ের দেওয়া চড় তুল্যর গায়ে পরার আগেই আলো ওদের মাঝে এসে দাড়িয়েছে। ফলশ্রুতিতে চড়টা ওর গালেই পরেছে। হতবিহ্বল তাথৈ তৎক্ষণাৎ বাহাতে ডানহাত চেপে ধরলো নিজের। কঠোরস্বরে বললো,
– আলো!
আলোর ভাবান্তর হলো না। আস্তেধীরে চোখ খুলে তাথৈয়ের দিকে তাকালো ও। নাক টেনে, মলিন আওয়াজে বললো,
– বিয়েটা যদি দোষ হয়, তাহলে চড়টা আমারো প্রাপ্য তাথৈ। আর যেহেতু তুল্য আমার স্বামী, ওর প্রাপ্য চড়টাও তুমি বরং আমাকে মারো।
– কি বলছো তুমি এসব?
– ঠিকই বলছি। ভালো যখন বেসেছিই, এটুক শাস্তি তো পেতেই হতো।
তাথৈয়ের বিস্ময় কাটে৷ বুঝতে পারে, তুল্য আলোকে বুঝিয়েই এনেছে। বাধ্য করেছে ওকে নিজের কথামতো করতে, বলতে। নিজেকে সামলে তাথৈ জোর গলায় বললো,
– তুল্যেকে ডিফেন্ড করতে এসো না আলো! ও এসব ডিজার্ভ করে না! আর তুমি কতোবড় মিথ্যে বলছো, সেটা তুমিও জানো! তুমি…
– মিথ্যে বলছি না তাথৈ। একবর্ণ মিথ্যে বলছি না। এতোদিন কেবল সত্যিটা লুকিয়েছি। তাই তুমি জানোও না, এ সত্যির গভীরতা কতোখানি।
তাথৈ কাদছে। আর বলার জোর পায় না ও। ওর মনে হতে থাকে, একা ওর জন্য কতোগুলো জীবন নষ্ট হয়ে গেলো। চারপাশ ঘুরতে থাকে তাথৈয়ের। হাতপা অসাড় হয়ে আসতে থাকে ক্রমশ। এখনো অবদি ওর ভালোবাসায় পাগলামো ছিলো। কিন্তু সে ভালোবাসা এখন হয়ে গেছে অপরাধ! শার্লি, তুল্য, আলো, তাশদীদ, চার চারটে মানুষের ভালোবাসা ভালো থাকাকে গলাটিপে হত্যা করেছে ওর ভালোবাসা। এমন সর্বনাশা ভালোবাসা তো ও চায়নি। তাহলে সেটা কেনো এলো ওর জীবনে? তাথৈ নিজের সাথে নিজের অদৃশ্য যুদ্ধে হেরে যায়। শরীরের ভর ছেড়ে দিয়ে মেঝেতে ঢলে পরলো ও।
তুল্য ছুটে এসে বোনকে ধরলো। কোনোমতে নিয়ে শুইয়ে দিলো বিছানায়৷ আলো দ্রুত গিয়ে পানির গ্লাস এগিয়ে দিলে ওকে। বিছানায় বসা তুল্য পুরোটা সময় যেনো একটা ঘোরের মধ্যে ছিলো। তাথৈকে বলা আলোর একটা কথাও, কেনো যেনো একবারের জন্য মিথ্যে মনে হয়নি ওর। এতো জোর গলায় কখনো মিথ্যে বলা যায় না। আলোর পক্ষে তো সেটা আরো অসম্ভব হবার কথা। তুল্য পানির গ্লাস হাতে নিয়ে তেজ দেখিয়ে বললো,
– আমার সামনে চলে এসে, চড় খেয়ে উদারতা না দেখালেও চলতো। এর কোনো প্রয়োজনীয়তা ছিলো না।
আলো সোজা হয়ে দাড়ালো। তাচ্ছিল্য করে বললো,
– প্রয়োজনীয়তা অনেক কিছুরই ছিলো না তুল্য৷ তাছাড়া তাথৈয়ের দেওয়া চড় আর এমন কি? আমার জীবনের সবচেয়ে বড় চড়টা তো তুমি আমাকে মেরেছো। আফসোসের বিষয় হলো, সেই তোমার সাথেই আমাকে এক ছাদের নিচে থাকতে হবে। দুনিয়ার সামনে নাটক করতে হবে, উই আর হ্যাপিলি ম্যারিড কাপল। মেড ফর ইচ আদার!
#চলবে…
#কার্নিশ_ছোঁয়া_অলকমেঘ
লেখনীতে: মিথিলা মাশরেকা
৫০.
শহরে সন্ধ্যে নেমেছে। সবেমাত্র ল্যাম্পপোস্ট জ্বলা রাস্তা দিয়ে হলের দিকে এগোচ্ছে শার্লি। ক্যাশ আউট করাতে দোকানে গিয়েছিলো ও। হাতের মুঠোয় থাকা ছোলাবুট একটু পর পর ওপরে ছুড়ে দিচ্ছে, হা করে সেটা মুখে নিচ্ছে, আবারো মোবাইল দেখতে দেখতে গেইট অবদি আসলো ও। ভেতরে ঢুকবে, হুট করেই ওর মনে হলো কিছুটা দুরে গাড়ির হেডলাইট দুবার জ্বলে উঠেছে। আবছা অন্ধকার আর অন্যমনস্ক বলে গাড়ির রঙ বোঝেনি শার্লি। তবুও কি ভেবে ছোলাবুট মুখে পুরে পেছন ফিরলো ও।
গাড়ির ভেতরের লাইট অফ। শার্লিকে দাড়াতে দেখে ড্রাইভিং সিট থেকে বেরিয়ে আসে এক পুরুষালি অবয়ব। ঈষৎ আগ্রহ নিয়ে, কপাল কুচকে দুইপা এগোলো শার্লি। অবয়ব নিজেও এগোলো। কিছুদুর এগোতেই ল্যাম্পপোস্টের আলোয় দৃশ্যমান হয় তার মুখ। তুল্য!
শার্লি দাড়িয়ে যায়। তুল্যকে এখানে কল্পনাও করতে পারে না ও। অথচ মানুষটা তুল্যই। শার্লি মনেমনে খুশি হলো হয়। আগেরদিন অম্বুনীড়ে আলফেজ পুত্র যে ব্যবহারটা করেছিলো ওর সাথে, তার দায় মেটাতে মহোদয় ওর হল অবদি চলে আসবে, এটা ভাবেনি ও। তবুও চোখেমুখে রাগ দেখিয়ে চলে আসছিলো শার্লি। তুল্য পেছন থেকে ডাক লাগালো,
– শার্লি শোন!
পা থামে শার্লির। তুল্য ওকে এভাবে ডেকেছে, আর ও থামেনি, এমন একবারো হয়নি। কিন্তু ওর রাগটাও তো মূল্যহীন না। তাই দাড়ালেও পেছন ফিরলো না ও। তুল্য ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে কোনোমতে ওর পাশে এসে দাড়ালো। শার্লির মুখে ল্যাম্পপোস্টের হলুদাভ আলো পরেছে। কালো ঢোলাঢালা টিশার্ট, ঢোলা পালাজো, ছোটছোট চুল, আর সেই অভিমানে ফুলে থাকা নাক। এই দুদিনে এতেটুকোও বদলায়নি শার্লি। অথচ তুল্যর সবটা বদলেছে। ঝড়ের মতো বদলে গেছে সবটা। শার্লি ফিরলো না ওর দিকে৷ গম্ভীর আওয়াজে বললো,
– কি হয়েছে? শুধু অম্বুনীড়ে অপমান করে শান্তি পাচ্ছিলি না? এখন হলেও এসেছিস আমাকে অপমান করতে?
তুল্য জবাব দেয় না। ও একদৃষ্টিতে দেখে চলেছে শার্লিকে। জবাব না পেয়ে শার্লি বিরক্ত হলো। বুকে হাত গুজে বললো,
– এভাবে দাড়িয়ে থাকতে তো আসিসনি। কি বলবি দ্রুত বল! যেতে হবে আমাকে!
…
– তোর মৌণব্রতের সাক্ষী হওয়ার সময় আমার নেই তুল্য! তুই বরং থাক এভাবেই দাড়িয়ে, আমি যাচ্ছি!
– আমি আলোকে বিয়ে করে নিয়েছি শার্লি।
শার্লি পা বাড়াচ্ছিলো। পেছন থেকে তুল্যর বলা কথাটা যেনো বুঝে উঠলো না ও। ঠিকঠাক শুনতে পায়নি ভেবে, তুল্যর দিকে তাকালো ও। তুল্যর গায়ের রঙ প্রায় তাথৈয়ের মতোই। বেশ ফর্সা মুখটায় কেমন কালশিটে ভাব। চোখ গর্তে। সিগারেটের সাথে পুড়ে যাওয়া ঠোঁটজোড়া বরাবর কালো। সে ঠোঁট আজ অনিয়মিতহারে শুষ্ক। কফি রঙের টিশার্ট পরিহিত মানবের মাঝে সর্বদা যে অহংকারী ভাব থাকে, তা আজ নেই। তার চোখমুখে কেবল অসহায়ত্ব। শার্লি এগোলো। কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত হেসে বললো,
– কি বললি তুই?
– আমি আলোকে বিয়ে করে নিয়েছি। আজ সকালেই অফিসিয়ালি বিয়ে হয়েছে আমাদের।
শার্লির হাসি হারায়৷ আবারো জোরপূর্বক হাসে ও। স্বরে কৌতুক মিশিয়ে প্রশ্ন করে,
– মজা করছিস? আমাকে জেলাস ফিল করাতে? তাও আবার আলোকে নিয়ে?
তুল্য জবাব দেয় না। দিশেহারার মতো এদিকওদিক চায় ও। ঢোক গিলে সাহস সঞ্চারের চেষ্টা করে। তারপর কোমড়ের পেছনে গোজা কাবিননামা বের করে তুলে ধরে শার্লির সামনে। শার্লির হাসিটা এবার পুরোপুরি হারায়। শ্বাসের গতি বাড়ে। ভেতরে অদ্ভুত এক ভয় শুরু হয়। তুল্যর হাতে কাগজ, চোখে জল। কাঁপা কাঁপা হাতে কাগজটা হাতে নেয় শার্লি। ওটা পড়তে পড়তে চোখ জ্বলতে শুরু করে ওর। ভেতরে রাজ্যের কষ্টেরা তান্ডব শুরু করতে থাকে। শার্লি টের পায়, ওর বুকের বা পাশটায় রক্তভরা যন্ত্রটা কোনো অদৃশ্য ধাড়ালো আঘাতে রক্তাক্ত হয়ে যাচ্ছে। ওর শ্বাসেরা থেমে যেতে চাইছে। কাগজের শেষাংশে আলো, তুল্যর সই দেখতেই গায়ের জের সব শেস হয়ে যায় ওর। হাতে থাকা কাগজটা পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী বস্তুটা বলে মনে হয়। কাবিননামা হাত থেকে পরে যায় শার্লির। সমগ্র শরীর ঝাঁকি দিয়ে ওঠে। চোখের জলকে আটকাতে না পেরে শার্লি দুহাতে মুখ চেপে ধরলো। দুনিয়ার সমস্ত অবিশ্বাস এক করে তুল্যর দিকে তাকালো ও।
তুল্য উবু হয়ে রাস্তা থেকে কাবিননামা তোলে। শার্লির দিকে তাকানোর সাহস হয় না ওর। মাথা নিচু করে দাড়িয়ে রয়। ওকে ওমন নিশ্চুপ দেখে শার্লির দুনিয়া আরো ভাঙচুর হয়ে আসে। বাস্তবতা বুঝতেই বাধভাঙা স্রোতস্বিনীর মতো তুল্যর ওপর ঝাপিয়ে পরে ও। তুল্যর টিশার্টের গলার দিকটা দুহাতে মুঠো করে নিয়ে চেচিয়ে বললো,
– কেনো?
তুল্য জবাব দেয় না। চোরের মতো দৃষ্টি লুকাতে থাকে শার্লির থেকে। ওর হাত থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু প্রথমবারের মতো তুল্য টের পায়, এই সামান্য জোরটুকো ওর গায়ে নেই। শার্লি আহত বাঘিনীর মতো আবারো চেচালো,
– জবাব দে তুল্য! কেনো করলি তুই এটা? কেনো?
– কজ…কজ আই লাভ হার! আমি ওকে ভালোবাসি…তাই…
তৎক্ষনাৎ তুল্যকে ছেড়ে দেয় শার্লি। আটকে রয় কয়েকদন্ড। ঘাড় বাকিয়ে বিস্ময়ে তাকিয়ে রয় তুল্যর দিকে। পরমুহূর্তে আবারো ঝাঁপিয়ে পরে ও তুল্যর বুকে। সমস্ত শক্তিতে জড়িয়ে ধরে, ওর বুকে মুখ গুজে বলতে থাকে,
– না না! তুই মিথ্যে বলছিস তুল্য! তুই আলোকে ভালোবাসিস না! আমি জানি তুই আলোকে ভালোবাসিস না! তোর ভালোবাসা আলো কেনো হবে? আলো তো কখনো কোথাও ছিলোই না! আমি ছিলাম! তুইতো আমাকে ভালোবাসিস তুল্য! তাহলে এগুলো কি বল? কিসের শাস্তি? কি করেছি আমি? তুই একবার বল? আমি তোর সব কথা শুনবো তুল্য! তুই শুধু একটাবার বল?
অবুঝ শিশুর মতো হাউমাউ করে কাদতে থাকে শার্লি। তুল্য ঠোঁট চেপে ধরে ওকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে থাকে। লাভ হয়না। ওর গায়ে আজ সত্যিই জোর নেই। শার্লি তেমনই বলে চলেছে, কেদে চলেছে। তুল্য গায়ের জোরে না পেরে বললো,
– যা তা বলছিস তুই। তোকে আমি একবারো বলেছি আমি তোকে ভালোবাসি?
– তোর বলতে হবেনা! আমি জানি তুই আমাকে ভালোবাসিস! তুই আমাকেই ভালোবাসিস তুল্য!
– না বাসি না! আমি তোকে ভালোবাসি না শার্লি! আমি তোকে বাসিনা ভালো!
তুল্য নিজেই এবার জোরালো আওয়াজে বললো। কর্ণগোচর হতেই চমকে ওঠে শার্লি। তুল্যকে ছেড়ে কয়েককদম পিছিয়ে যায় ও। এতোক্ষণ পাগলের মতো কাদতে থাকলেও এবার কথা না বলা মুর্তির মতো নিশ্চুপ হয়ে যায়। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে শান্তস্বরে শুধায়,
– তাহলে এতোদিন যা ছিলো, তা কি ছিলো?
– যা ছিলো তা ভুল ছিলো। ভুলে যা।
– তুই এখানে কেনো এসেছিস? সেই ভুল স্বীকার করতে?
– না। যাতে তুই আর কোনো ভুল না করিস, সেটা বলতে।
এই মুহুর্তেও তুল্যর কথার ভাজে ভাজে আত্মঅহংকার। শার্লির আর সহ্য হয় না। এগিয়ে এসে সর্বশক্তিতে তুল্যর গালে চড় লাগিয়ে দেয় ও। যে কষ্টটা এতোক্ষণ ভালোবাসা হারানোর ছিলো, ভালোবাসা ঘৃণায় পরিনত হওয়ার কষ্টটা হয়তো কয়েশগুন বেশিই হয়। সহ্য করা যায় না। তুল্য গাল ধরে চুপ করে রইলো। শার্লি দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
– ঘেন্না করি আমি তোকে! ঘেন্না করি! এন্ড ইউ নো হোয়াট? আমার জায়গায় অন্যকেউ হলে হয়তো আলোকে অভিশাপ দিতো। কিন্তু আলোর জন্য আমার করুণা হচ্ছে! কারণ আমি জানি, ওর অভিশাপের প্রয়োজন নেই। তুইই ও বেচারীর জীবনের সবচেয়ে বড় অভিশাপ! সবচেয়ে বড় অভিশাপ!
•
ভোর হয়েছে। তৈয়ব আলফেজের চোখে ঘুম নেই। প্রায় মাঝরাতে বাসায় ফিরে বাকি রাতটুকো সিগারেটের সাথে কাটিয়ে দিয়েছেন তিনি। বেশ কিছুক্ষণ হলো টের পাচ্ছেন, ভোরের আলো ঘরে ঢুকেছে। সারারাতের চিন্তাকে ঝেরে ফেলতে ইজিচেয়ার থেকে উঠে দাড়ালেন ভদ্রলোক। আলমারী থেকে চেকবই নিয়ে তাতে সই করলেন একটা। তারপর বেরিয়ে আসলেন রুম থেকে। তুল্যর ঘরের সামনে আসতেই দেখেন দরজা খোলা। ভেতরে এককোনে মেঝেতে আধশোয়া হয়ে আছে তুল্য। সামনে মদের বোতল, সিগারেটের অবশিষ্টাংশ, হাতপা এলোমেলো, চোখ বন্ধ, চুল উশকোখুশকো। তৈয়ব আলফেজ ভেতরে আর দেখলেন না। কি ভেবে তাথৈয়ের ঘরের সামনে আসলেন তিনি। সেখানে আসতেই চোখে পরলো তাথৈ বিছানায় নেই। তবে ওয়াশরুম থেকে পানি ছাড়ার আওয়াজ আসছে। আলো মেঝেতে বসে। বিছানায় হাত রেখে তাতে মাথা ঠেকিয়ে ঘুমোচ্ছে।
তৈয়ব আলফেজ ভেতরে ঢুকলেন। গম্ভীর ভাবভঙ্গিতে এসে দাড়ালেন আলোর সামনে। তারপর বিছানার পাশে থাকা টেবিলে নখ ঠুকিয়ে আওয়াজ করলেন। আওয়াজ শুনে তখনতখন আলোর ঘুম কেটে যায়। চোখ খুলে দেখে তাথৈ বিছানায় নেই। আগেরদিন অজ্ঞান হবার পর ওকে স্যালাইন পুশ করা হয়েছে। বিকেলে ডাক্তার ডেকে দিয়ে শেষরাতের দিকে অম্বুনীড় ফিরেছে তুল্য। তাও মাতাল হয়ে। সে ঘরে আর যায়ই নি আলো। সারাটা রাত তাথৈয়ের সাথে ছিলো ও। বিছানার ওপর স্যালাইনের সূচ পরে আছে, ওপাশে স্ট্যান্ডে ঝুলতে থাকা স্যালাইনে এখনো এক চতুর্থাংশ বাকি, অথচ তাথৈ নেই বিছানায়। কিছুটা অস্থিরতা শুরু হয় আলোর ভেতরেভেতরে। কিছু বলার আগেই ওর চোখে পরে তৈয়ব আলফেজকে। ভদ্রলোক চেকটা বিছানায় রাখলেন। আলো ভ্রুকুটি করে তাকালো ওটার দিকে। তৈয়ব আলফেজ গুরুগম্ভীর স্বরে বললেন,
– চেক সই করে দিয়েছি। অ্যামাউন্টটা বসিয়ে নিও। বাসায় ফিরে আজ আমাকে যেনো তোমার মুখ না দেখতে হয়।
ভোরের আলো ফোটার পরপরই এমন অপমানটা আলোর সহ্য হলো না। চোখ ফেটে জল গরালো ওর। সে জলকে বিন্দুমাত্র পাত্তা দিলেন না তৈয়ব আলফেজ। চলে গেলেন ঘর থেকে। বসেবসে কিছুক্ষণ অশ্রু বিসর্জন দিলো আলো। একপলক তাকালো ওয়াশরুমের দিকে। পরপরই শক্ত করলো নিজেকে। চোখের জল মুছে চেকটা হাতে করে এগোলো তুল্যর ঘরের দিকে। তুল্য তখনও মেঝেতে আধশোয়া। চোখ বন্ধ রেখে অদ্ভুতভাবে হাসছে আর বিরবিয়ে কিছু বলছে ও। আলো ওয়াশরুমে গেলো। মগ ভর্তি করে পানি এনে, ছুড়ে মারলো তুল্যর মুখ বরাবর।
মুখে পানি পরতেই হুঁশে ফেরে তুল্য। চোখ খিচে বন্ধ করে নিলো ও। পরে হাত দিয়ে মুখচোখের পানি ঝাড়লো। চোখ মেলে মগ হাতে আলোকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই দিনদুনিয়া তেতে ওঠে তুল্যর। হিংস্র পশুর মতো ছুটে এসে আলোর ডানহাতের কনুইয়ের চেপে ধরলো ও। দেয়ালে চেপে ধরে চেচিয়ে বললো,
– হাউ ডেয়ার ইউ টু ডু দ্যাট? হাউ ডেয়ার ইউ?
আলো ব্যথায় চোখ বন্ধ করে নিলো। দেয়ালের সাথে পিঠের হাড়ে ও কি পরিমানে ব্যথাটা পেয়েছে তা কেবল ওই জানে। ওর হাতও রীতিমতো ছিড়ে নিচ্ছে তুল্য। কাদতে কাদতে অতিকষ্টে চোখ মেললো আলো। তুল্যর বুকে চেকটা ঠেকিয়ে বললো,
– চেক সই করা আছে। অ্যামাউন্টটা বসিয়ে নিও। আজ বাবা অম্বুনীড় ফেরার আগে আমার সম্মান আমার ফেরত চাই।
তুল্যর হাত সরিয়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় আলো। তুল্য নিচে পরে থাকা চেকটা দেখলো। মাথা চেপে ধরে চিৎকার করে ওঠে ও। হাতের নাগালে টেবিলে থাকা কাচের পেপারওয়েটটা ছুড়ে মারে মেঝেতে। সশব্দে পরে, ভেঙে টুকরোটুকরো হয়ে যায় সেটা।
•
স্টেয়ারিং ধরে রাখা বাহাতের কবজি থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত বেরোচ্ছে। এ নিয়ে যে কতোবার তাথৈ সে রক্ত ডলা মেরে মুছেছে, তার হিসেব নেই। কিন্তু আবারো একই অবস্থা। রক্ত বেরোনো বন্ধ হচ্ছে না। জ্ঞান ফেরার পর একমুহূর্ত দেরি করে নি ও। তুল্য কেনো বিয়ে করেছে, সে বিষয়ে শার্লিকে জানাবে বলে ফোন আর গাড়ির চাবি নিয়ে তখনতখনই বেরিয়ে পরেছে ও। আসার সময় ওয়াশরুমের ট্যাপ চালু রেখে এসেছে। যাতে ঘুম ভাঙলেও আলো ভাবে ও ওয়াশরুমে আছে। কিন্তু স্যালাইনের ইনজেকশন খোলার সময় তাথৈ যে টান লাগিয়েছিলো, সেটা এদিকওদিক হওয়ার ফল এটা। পুশ করা রগটায় টনটনে ব্যথা। সারা হাতে ছড়িয়েছে সে ব্যথা। ড্রাইভিং করতে কষ্ট হচ্ছে। শরীরের অবস্থাও ওর সুবিধার না। তবুও দ্রুততার সাথে ড্রাইভ করতে থাকে তাথৈ। বারবার কল করতে থাকে শার্লির নম্বরে। কিন্তু ওর কল রিসিভ হয় না। তাথৈ হলে পৌছালো। গাড়ি থামিয়ে ছুট লাগায় শার্লির রুমের দিকে। সিড়ি বেয়ে চারতলা উঠে আসে দৌড়ে। হন্তদন্ত হয়ে রুমে ঢুকে পরে ও।
তাথৈকে হুট করে রুমে ঢুকতে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে যায় রুমের মেয়েটা। রুম ঝাড় দিচ্ছিলো ও। তাথৈ ঘরে চোখ বুলালো। আজ ক্লাস নেই ওদের। শার্লির হলেই থাকার কথা। রুমের মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলো,
– শার্লি কোথায়?
– আপনি তাথৈ আপু?
– শার্লি কোথায়?
জবাবের পরিবর্তে পুনরায় একই প্রশ্ন শুনে আর কথা বাড়ানোর সাহস হয়না মেয়েটার। ও তাই গরগরিয়ে বললো,
– আপু…আপুতো আজ সকালের ট্রেনেই বাড়ি চলে গেছে।
উত্তর শুনতেই তাথৈয়ের শরীরের সবটুকো শক্তি ফুরিয়ে যায় যেনো। দাড়িয়ে থাকা কঠিন হয়ে পরে ওর। একপা পিছিয়ে দরজা ধরে কোনোমতে নিজেকে দাড় করিয়ে রাখে তাথৈ। চোখ বেয়ে জল গরাতে থাকে ওর। জীবন ওকে দেবার মতো আহামরি কিছুই দেয়নি। শুধু বন্ধুত্ব ছাড়া। এতোএতো রাগী, অসহিষ্ণু মেয়েটার পাশে কি করে যেনো শার্লি, আলো জুড়ে গিয়েছিলো। কি করে যেনো ‘সব পরিস্থিতিতে পাশে আছি’ ভাবটা স্থির করে নিয়েছিলো ওরা। সেই দুই বান্ধবীও আজ হারিয়ে ফেললো ও। তাথৈ দরজার পাল্লায় পিঠ ঠেকিয়ে বসে পরে মেঝেতে। একদৃষ্টিতে শার্লির বিছানার দিকে তাকিয়ে থেকে কাদতে থাকে। রুমের মেয়েটা খুতিয়ে খুতিয়ে দেখছে তাথৈকে। শার্লি চেচিয়ে চেচিয়ে ফোনে কথা বলতো আর তাথৈ, তাথৈ করতো। ভোরে নিজের সুতোটাও গুছিয়ে চলে গেছে সে। আর যাওয়ার সময় কেবল এই একটা নামই নিয়ে গেছে। তাথৈ। মেয়েটারও মন খারাপ হয়ে যায় তাথৈয়ের অসহায়ত্ব দেখে। রুম ঝারা সমস্ত ধুলোবালি দরজার সামনেই জড়ো করেছিলো ও। তাথৈয়ের পায়ে ধুলো চিকচিক করছে। মেঝেতে বসে যাওয়ার দরুন ওর মেরুন কুর্তাটাতেও ধুলো লেগে গেছে। টেবিল থেকে একটা ভাজ করা কাগজ এনে তাথৈয়ের সামনে হাটুগেরে বসলো মেয়েটা। ধরা গলায় বললো,
– শ্ শার্লি আপু যাওয়ার সময় এটা আপনাকে দিতে বলেছেন।
তাথৈয়ের বুক চিরে হাহাকার বেরিয়ে আসতে চায়। দরজায় মাথা ঠেকিয়ে চিঠিটা হাতে নেয় ও। ভাজ খুলতেই শার্লির হাতের লেখা। তাতৈ বেশ কাটাকাটি করে লেখা,
❝কেমন আছিস তাথৈ? সরি রে। হয়তো বুজোর অনুপস্থিতিতে তোর সাথে আমার আরো বেশি সময় কাটানো উচিত ছিলো। কিন্তু পারলাম না। আমি জানতাম কল রিসিভ করছি না দেখে তুই ঠিক হলে এসে আমার খোজ করবি। তাই এটা রুমমেটের কাছে দিয়ে গেলাম। প্রচন্ড পরিমানে নিরুপায় হয়ে তোদের দৃষ্টির আড়ালে যেতে বাধ্য হয়েছি। কারনটা আর কেউ না জানলেও তুই জানিস আমি জানি। তোর ভাইকে আমি ভালোবেসেছিলাম, আর সে অন্যকাউকে বিয়ে করে নিয়েছে। বিষয়টা আমার জন্য কষ্টেরই। তুই এটা বুঝতে পেরেছিস আমি জানি। কিন্তু এমন নগন্য একটা কারনে তোর সাথে আমার বন্ধুত্ব শেষ, এমনটা ভাবিস না প্লিজ। আমি এতোটাও নিচ নই। এতোটাও স্বার্থপর নই। তুই এটা ভাবলে আমি নিজের কাছে কতোটা ছোট হয়ে যাবো, তা তুই কল্পনাও করতে পারবি না। তাই প্লিজ, তুল্যর বিয়ে, আমার চলে আসা আর আমাদের বন্ধুত্ব এই তিনটাকে এক করে ফেলিস না। প্লিজ! আমি কেবল এই বিষাক্ত শহর ছাড়লাম। আমাদের বন্ধুত্ব না। ব্যস একটু সময় চাইছি তোর থেকে। দিবি না? আমাকে কন্টাক্ট করার চেষ্টা করিস না। নিজেকে সামলে আমি নিজ থেকেই কল করবো তোদের। তবে হ্যাঁ, ‘ফিরে আয়’ বলে তখন আবার আবদার করে বসিস না। আমি আর ঢাকায় ফিরবো না। ঠিক করেছি একমাত্র তোর আর তাশদীদ ভাইয়ের বিয়ে হলে তখনই ঢাকায় যাবো। তোদের দোয়া করে আসতে। তাই যতো দ্রুত পারিস আমার চাওয়াটা পুরন করে দিস। ভালো থাক সবাই।
আর হ্যাঁ! গাড়িটা একটু আস্তে চালাস তাথৈ। শার্লি তোদের অনেক মিস করবে। ❞
কাগজ বুকে চেপে ধরে চিৎকার করে কান্না শুরু করে দেয় তাথৈ। আশপাশের রুম থেকে ছুটে আসে বাকি মেয়েরা৷ রুমের মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে তাথৈয়ের কান্নার কারন শার্লির চলে যাওয়া। বিস্ময়, সমবেদনায় চোখ ভরে ওঠে কারো কারো। বন্ধুত্ব এমনও হয়?
অনেকটা সময় কান্নার পর তাথৈ চোখ মোছে। নিথর দেহকে জোরপুর্বক তুলে হাটা লাগায় হলের বাইরে। বাইরে এসে নিজের গাড়িটার দিকে তাকাতেই শার্লির বলা ‘গাড়ি আস্তে চালাস’ কথাটা মনে পরে ওর। তাথৈয়ের চোখ বেয়ে পুনরায় জল গরায়। আশপাশ তাকিয়ে একটা গাছের ডাল চোখে পরে ওর। তাথৈ হাতে নেয় সেটা। একে একে ভেঙে ফেলে গাড়ির সব কটা কাচ। যে তাথৈ নিজের গাড়িতে একটু আঁচ আসলেও সহ্য করতো না, নিজ হাতে সে গাড়িটা নষ্ট করে ফেলে ও। তারপর একধ্যানে পিচঢালা রাস্তার দিকে তাকিয়ে হাটতে থাকে। পেছনে ফেলে আসা প্রতিটি মুহুর্ত মনে পরতে থাকে তাথৈয়ের। আলফেজ কন্যা হিসেবে তাথৈ আলফেজ নামটার পাশে সবাই প্রাপ্তির পূর্ণঝুলি কল্পনা করে নেয়। অথচ কেউ জানলোও না, ওর মতো নিঃস্ব আর দুটো নেই। ভালোবাসা নামক চার বর্ণের অনূভুতি ওর জীবনে এসে ওকেও নিঃস্ব করে দিয়ে গেছে, সাথে ওর ভালোবাসার মানুষগুলোকেও ভেঙেচুরে দিয়ে গেছে। মা, বাবা, ভাই, বান্ধবী, পোষ্য, ওর কেউ নেই। কিছুই নেই। এতোএতো বিচ্ছেদ, এতোএতো গ্লানি নিয়ে বাচা যায়? সম্ভব?
#চলবে…
#কার্নিশ_ছোঁয়া_অলকমেঘ
লেখনীতে: মিথিলা মাশরেকা
৫১.
গোধূলীর শেষ প্রহরে তৈয়ব আলফেজ অম্বুনীড়ে ফিরলেন। বাসায় ঢুকতেই অনুভব করলেন শ্বশানের মতো খাঁ খাঁ করছে চারপাশ। সদর দরজা দিয়ে ড্রয়িংরুমের মেঝেতে লালচে রোদ পরেছে। তুল্য সোফায় বসে সিগারেট টানছে আপনমনে। চোখ ঘুরিয়ে আলোকে খুজলেন তৈয়ব আলফেজ। ও নেই দেখে মনেমনে একটা স্বস্তি অনুভব করলেন যেনো। গলার টাই টেনে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন,
– গেছে ওই মেয়ে? কয় টাকায় বিদেয় হলো তোমার প্রেমিকা?
তুল্য বাবার দিকে চোখ তুলে চাইলো। জোরহীন শরীরটা নিয়ে উঠে দাড়ালো ও। শেষ হওয়া সিগারেটটুকো পায়ে পিষে, শান্ত ভঙ্গিতে বললো,
– আলো আমার বিয়ে করা বউ। প্রেমিকা না। আর ও কোনো বাজারু মেয়েও না যে টাকার বিনিময়ে অম্বুনীড়ে আসবে-যাবে। অবশ্য তুমি যদি অম্বুনীড়কে বাজার মনে করো, তোমার ছেলের বউকে টাকায় কেনাবেচা করতে ইচ্ছুক হও, তাহলে সেটা আলাদা কথা।
সদর দরজার বাইরে দাড়িয়ে সবটা শুনলো আলো। চোখ বন্ধ করে অশ্রুকে থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলো। কে বলবে, যে তুল্য ওকে বাজারু না বলে নিজের বাবার সাথে তর্ক করছে, সেই তুল্যই ওকে বাজারু প্রমাণ করে জোরপূর্বক বিয়ে করে এনেছে। আলোর দমবন্ধ লাগতে থাকে। নিজের পরিস্থিতি বুঝতে পারে না ও। আর ঠিক কি কি ওকে দেখতে হবে? কি কি শুনতে হবে? ছেলের মুখে এতোবড় কথাটা শুনে আপাদমস্তক রিরি করে ওঠে তৈয়ব আলফেজের। হুঁশ হারিয়ে সর্বশক্তিতে তুল্যকে চড় লাগালেন তিনি। ঠোঁট কেটে যায় তুল্যর। চমকে উঠে পিলার আঁকড়ে ধরে আলো। তৈয়ব আলফেজ কঠোর গলায় বললেন,
– আর একটা বাজে শব্দ বললে আমি তোমায় ত্যাজ্য করতে দুবার ভাববো না তুল্য!
তুল্য তাচ্ছিল্যে হেসে ঠোঁট মুছলো। আলো আর অপেক্ষা করলো না। ভেতরে ঢুকছিলো ও। তৈয়ব আলফেজ ওকে দেখে উচ্চস্বরে বললেন,
– এই মেয়ে! তোমাকে বলেছিলাম না এ বাসা ছেড়ে চলে যেতে? দেন হুয়াই আর ইউ স্টিল হেয়ার? যাওনি কেনো?
আলো থামে। শশুড়ের দিকে নিমীলিত চোখে চেয়ে জবাব দেয়,
– আমি বাসায় আছি সেটা ঠিকি লক্ষ্য করলেন। অথচ সকাল থেকে তাথৈকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, সেটা আপনার খেয়ালে নেই বাবা। তো যে শশুড় নিজের মেয়ের চেয়েও তার ছেলের বউকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে, সে শশুড়বাড়ি ছেড়ে কিকরে যাই বলুন? আমি, যাচ্ছি না!
কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত হয়ে পরেন তৈয়ব আলফেজ। বেরোনোর সময় তাথৈকে দেখতে গিয়েছিলেন তিনি। ও ওয়াশরুমে ছিলো। মেয়ে অম্বুনীড়ে নেই জেনে ছেলের দিকে তাকালেন তিনি। তুল্যর ঠোঁটের রক্ত থামেনি। ও টিস্যু নিয়ে ঠোঁট মুছতে মুছতে বললো,
– এমন চিন্তার অভিনয়ের প্রয়োজন নেই ড্যাড। তাথৈ বলেছে ও নিজের কোনো ক্ষতি করবে না। তাছাড়া আমি আন্দাজ করতে পারছি ও কোথায় গেছে। তুমি তোমার আসল রিল্যাক্স মুডটায় ফেরত আসো, আমি নিয়ে আসছি ওকে।
– তাথৈ শার্লির কাছে নেই তুল্য। নাইবা শার্লি হলে আছে।
তুল্য বেরিয়ে যেতে পা বাড়াচ্ছিলো। আলোর কথায় চকিত চোখে চায় ও। আলোর জলভরা চোখ দেখে বুঝতে পারে, ‘ওই চোখে ওর নামে কতো ঘৃণা। তারা যেনো চেচিয়ে বলছে, তোমার একটা ভুল আমাদের প্রত্যেকের জীবন তছনছ করে দিয়েছো তুল্য’। তুল্য নিভুনিভু কন্ঠে আলোকে শুধালো,
– তুমি হলে গিয়েছিলে?
মাথা ওপরনিচ করে আলো। তাথৈ কোথায় যেতে পারে, সে ধারনা ওরও ছিলো। শার্লির অবস্থা যেমন তাথৈ জানে, তেমনই ওউ কল্পনা করতে পারে। তাই তখনতখন তাথৈকে খুজতে হলে গিয়েছিলো ও। পায়নি। নাইবা শার্লিকে পেয়েছে। আলো থেমে থাকেনি। রুমনের ঠিকানা খুজতে ক্যাম্পাসেও গিয়েছিলো ও। অতঃপর রুমনের বাসায় গিয়ে ওর মায়ের কাছ থেকে জানতে পারে ওর বাবা দেশে ফিরেছে। ছেলেকেও বিদেশে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে সকালসকাল ছেলেকে নিয়ে পাসপোর্ট অফিসে চলে গেছেন তিনি। তাথৈ সেখানেও যায়নি। ব্যর্থ সৈন্যর মতো পুনরায় অম্বুনীড় ফিরতে বাধ্য হয়েছে আলো। তুল্য একমুহূর্ত দাড়ালো না। বাবার কোটের সামনের পকেটে থাকা চাবির গোছাটা নিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেলো ও। নিজের গাড়ির চাবি আনতে ঘরে যাওয়ার মতো সময় ওর নেই।
•
রাত সাড়ে দশটা। ছাত্রহলের সামনের বাস্কেটবল কোর্টটায় দু প্রান্তের লাইটদুটো জ্বলছে। সেকেন্ড দুই পরপর স্টিলের বোর্ডে আঘাতের আওয়াজ আসছে। কোর্টের মেঝেতে সুঠামদেহী যুবকের লম্বা ছায়া। তারই হাত থেকে ছোড়া বল শব্দ তুলছে বাস্কেটের পেছনের বোর্ডে। যুবক মনোযোগী হয়ে বল ছুড়ছে, বাউন্স করা বল হাতে লুফে নিচ্ছে, আবারো ছুড়ে মারছে বোর্ডকে লক্ষ্য করে। অনেকটা সময় পরপর কোর্ট পাশ কাটাচ্ছে একদুইটা ছেলে। কেউ সিগারেট হাতে দুঃখবিলাস করতে বেরিয়েছে, কেউ আড্ডাস্হল থেকে ফিরছে, তো কেউবা বেরিয়েছে রাতের আধার মাপতে। যাওয়ার সময় বোর্ডে বল আঘাতের শব্দ শুনে আড়চোখে কোর্টে তাকাচ্ছে প্রত্যেকেই। গাঢ় নীল আর খয়েরী চেকের শার্ট পরনের যুবক একা সেখানে। এলোমেলো ভাজে নেমে আসা শার্টের বড় হাতা, কালো প্যান্টের নিচদিকটা গিটের ওপরে ভাজ দিয়ে গুটানো, পায়ে স্লিপার। চেনা মুখটা দেখে সৌজন্য হাসি ফোটে পাশ কাটানো বেশিরভাগ ছেলেদের। হাসিমুখে যুবকের উদ্দেশ্যে গলা ছেড়ে সালাম জানায় কেউকেউ। বল ধরে দৃষ্টি বিনিয়ম করে সালামের উত্তর নেয় যুবক। আবারো ব্যস্ত হয়ে পরে নিজের মতো করে। একেএকে সবার চলে যাওয়ার পর বল হাতে ধরে রাখলো সে। কোর্টের পাশেই ইনডোর গেইমসের জন্য জায়গা করা। সেখানকার তিনটে দরজার সবচেয়ে পেছনের দরজাটা দিয়ে বেরিয়ে আসলো শান্ত। পরনে স্যান্ডেল গেন্জি, লুঙ্গি। এগিয়ে এসে বললো,
– ওটাকে কতোক্ষণ বসিয়ে রাখবো?
তাশদীদ শান্তর দিকে বল এগিয়ে দিলো। বল হাতে নেয় শান্ত। নেমে আসা শার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে তাশদীদ এগোলো ঘরের ভেতরে। জায়গাটা লুডু, দাবা, ক্যারাম, টেবিল টেনিসসহ নানান অন্তঃস্থ ক্রীড়াসামগ্রীতে ভরপুর। রুমের সমদুরুত্বে পরপর তিনটে হলুদ বাল্ব জ্বলছে। মাঝখানটায় বাল্বের বরাবর নিচে আফিফ বসা। ঘামে ভিজে উঠেছে ওর আপাদমস্তক। টুকটাক রাজনীতি ওউ করে। কিন্তু শান্ত আরোবেশি এক্টিভ বলে ওর সাথে তেমন ওঠাবসা নেই। কাজ আছে বলে হুট করেই শান্ত আজ ধরেছে ওকে। ক্যাম্পাস থেকে বেরোতেই দেয়নি। অথচ এ ভাই, ও ভাইকে সালাম দেওয়া ব্যতিত কিছুই করতে হয়নি আফিফকে। শান্ত ওকে রাতে হলে থাকতে বলেছিলো। কিছুক্ষণ আগে আবার এখানটায় ডেকে পাঠিয়েছে। মিনিট পাঁচেক বসে থাকার পর এখানে তাশদীদকে দেখে অবাক চোখে তাকালো আফিফ। ওর বিস্ময়ের চোখদুটো দেখে তাশদীদ এগিয়ে গিয়ে প্যান্টের পকেটে একহাত গুজে আরামে দাড়ালো। স্বাভাবিক গলায় বললো,
– হ্যাঁ বলো। পেইজে তোমাকে কাউন্টার পোস্ট কে করতে বলেছিলো?
আফিফ আরো অবাক হলো। প্রসারিত চোখে চাইলো তাশদীদের দিকে। শান্তর বন্ধু তাশদীদ। কিন্তু তাশদীদ তো রাজনীতিতে নেই। ও তো হলেও থাকে না। তাহলে ও এখানে কেনো আসলো? আর ওকে এ প্রশ্নই কেনো করছে? তারমানে কি তাশদীদ তাথৈয়ের বিষয়ে কিছু জানে না? আফিফের কিছু বুঝে আসে না। তাশদীদ ওর ওমন শূণ্য অভিব্যক্তিতে সময় অপচয় করলো না। ঘুরে গিয়ে পাশের টেবিল থেকে পুলস্টিক হাতে নিলো। টেবিলের মাঝের বলগুলোর দিকে তাক করে বললো,
– আইটি ব্রাঞ্চকে ঘুষ দেবো না বলে তোমার নামটা বের করতে দেরি হয়ে গেছে। এখন তুমি কি আমার আরো দেরি করাতে চাইছো?
আফিফ এবারে আর অবাক হলো না। পোস্টটা ওর ছিলো এটা যখন তাথৈ জানে, তাশদীদও জানবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাথৈ ওকে কাউন্টার পোস্ট করতে বলেছে এটা কেনো তাশদীদ জানে না? আফিফ পাশে তাকালো। সেখানে শান্ত টুথপিক দিয়ে দাঁত খোচাচ্ছে। ওর লুঙ্গি হাটুর অবদি উচিয়ে, ভাজ করে সামনে গিট দেওয়া। শান্তর ভাব আফিফের সুবিধের ঠেকলো না। তাথৈ এমনিতেও অনেক ভয়ানক পরিস্থিতিতে ফেলেছিলো ওকে। সদ্য মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে আসার পর আপাতত এই তাশদীদ-তাথৈ নামদুটোর আগেপরে থাকতে চাইছে না ও। তাই সোজা জবাব দেওয়াই উত্তম মনে করলো আফিফ। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বললো,
– তাথৈ বলেছিলো।
তাশদীদ পুলস্টিক ঠেলতে গিয়েও থেমে যায়। বলের পরিবর্তে চোখ তুলে আফিফের দিকে তাকালো ও। ওর জবাব শুনে শান্তর দাঁতের মাড়িতে টুথপিকের খোঁচা লেগেছে। মুখের ভেতরের এক দুফোঁটা রক্ত থুতুর মতে করে ফেললো শান্ত। ভ্রুকুটি করে বললো,
– কিহ! কোন তাথৈ? তাথৈ আলফেজ?
– হু।
শান্ত তাশদীদের দিকে তাকালো। আফিফ বলতে থাকে,
– ওই আমাকে বলেছিলো কাউন্টার পোস্টটা দিতে। আর আগের পোস্টটা প্রফেসর সুবোধ…
– তুমি যাও।
সোজা হয়ে দাড়িয়ে বললো তাশদীদ। আফিফ একবার ওকে দেখলো, আরেকবার শান্তকে। শান্ত ব্যস্ত হয়ে বললো,
– আর ও যে তোর এগেইনিস্টে পোস্ট করেছিলো। সেটা?
তাশদীদ বিষয়টাকে গুরুত্ব দিলো না। ঘাড় নাড়িয়ে আফিফকে আবারো ইশারা করলো চলে যাওয়ার জন্য। আফিফ সাথেসাথে উঠে দাড়ায়। দ্রুততার সাথে স্থানত্যাগ করলো। তাশদীদ ওর চলে যাওয়া দেখে আবারো টেবিলে পুলস্টিক ঠেকালো। বল আঘাত করে তাশদীদ। সেগুলোর বেশিরভাগই গিয়ে পরে টেবিলের বিপরীত কোনের পকেটদুটোতে। তাশদীদ স্থিরচোখে সেদিকে তাকিয়ে থেকে বললো,
– ভালোবাসে না।
– বাসলে কি হতো? আলফেজ কন্যার সাথে প্রেম করতি তুই?
জবাব না দিয়ে তাশদীদ শান্তর দিকে তাকিয়ে রইলো শুধু। শান্ত কিছু মনে পরার মতো করে বললো,
– ওহোহো! ভুলেই গিয়েছিলাম! তাশদীদ ওয়াসীর তো এখন প্রেমটেম করবে না! সে তো আবার বিয়ের পরে প্রেম করবে! আর বিয়ে করবে চাকরি পাওয়ার পর! তা তোর বিয়ের কি খবর রে তাশদীদ? এখনো বিয়ে করছিস না কেনো? মাস্টার্সের রেজাল্টের আগেই ছ ডিজিট ছুঁইছুঁই স্যালারির চাকরী পেলি। ও নিয়ে সন্তুষ্ট না? নাকি তোর বাবার পছন্দের সর্বগুনসম্পন্ন মেয়ে আলোকে পছন্দ হয়নি? কোনটা?
তাশদীদ এবারেও জবাব দিলো না। ফোন বের করে কানে তুললো ও। ওখান থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে ফোনে বললো,
– রাত অনেক হয়েছে। আমি আজকে হলেই থেকে যাবো মা। চিন্তা করো না সকালেই ফিরবো। রাখছি।
•
শূনশান সড়কটায় একাকী হাটছে তাথৈ। একধ্যানে সামনে তাকিয়ে পা চালাচ্ছে ও। গন্তব্য, পথ কোনোকিছু না ভেবে এগিয়ে চলেছে কেবল। জনমানবহীন আশপাশটার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। মাঝেমাঝে দু একটা প্রাইভেট কার আর বাস চলে যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে। পিচঢালা পথ সারা দিনের রোদে জ্বলন্ত কয়লার মতোই গরম হয়ে আছে অনেকটা। খালি পায়ে হাটতে হাটতে তাথৈয়ের এক পায়ের গোড়ালী ছড়ে গেছে। জ্বলছে সেখানটা। কবজির ব্যথা তো আছেই। আগের রাতে দেওয়া স্যালাইন ব্যতিত শরীরে শক্তি জোগানোর আরকিছু গত দুদিনে ওর পেটে পরেনি। শ্বাস নিতেও দুর্বল লাগছে। তবুও সেটা মাথায় নেই তাথৈয়ের। উদ্ভ্রান্তের মতো দিনভর এভাবেই রাস্তায় রাস্তায় হেটেছে ও। আর হিসেব কষেছে। ওর জন্য, ওর বিধ্বংসী ভালোবাসার জন্য কতোগুলো জীবনে ঘূর্ণি, কতোগুলো সুন্দর-গোছানো স্বপ্ন নষ্ট হয়ে গেলো। মা-বাবা, বুজো, শার্লি-তুল্যর সম্পর্ক, আলো-তাশদীদের ভবিষ্যৎ, ওর জন্য সব শেষ হয়ে গেছে। সব ধূলিস্মাৎ হয়ে বাকি ছিলো এক রুমন। আজ সেটুকোও ছেড়েছে ও। রুমনের মা ওকে কল করে জানিয়েছে, বিদেশী নাট্য-নির্মাতার সাথে রুমনের বাবা কথা বলে ছেলের ভবিষ্যত ঠিক করে ফেলেছেন। কিন্তু রুমন বিদেশে যেতে চাইছে না। তার ধারনা, এর কারন তাথৈ। তাই তিনি তাথৈকে কল করে বলে দিয়েছেন ও যেনো রুমনের সাথে আর যোগাযোগ না করে।
এর আগোবদি একজনের কলও রিসিভ করেনি তাথৈ। রুমনের মায়ের কাছে এমন কথা শোনার পর ফোনটা কোথাও একটা ফেলে দিয়ে এসেছে ও। ঠোঁটে তাচ।ছিল্যের হাসির সাথে চোখ বেয়ে পুনরায় জল গরায় তাথৈয়ের। ওর মনে হঠাৎ হানা দেয়, এ গল্পে জড়িত বলে আরো অনেককেই অনেককিছুর মুখোমুখি হতে হয়েছে। অন্তু, ওর স্ত্রী, রিংকি, টেরেন্স, আফিফ, সুবোধ এমনকি ভার্সিটির সেই সিনিয়র আপু, কেউ ছাড় পায়নি। কেউনা! সে হিসেবে ও একাই সবার ক্ষতির কেন্দ্রবিন্দু। আজকে তাথৈয়ের সবার প্রতি করুণা হচ্ছে। ওর জীবনে জড়িয়ে যাওয়া প্রত্যেকের অবস্থানের জন্য নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। যদি তাদের গল্পে ও কোথাও না থাকতো, তাহলে সবার জীবনচিত্র অন্যরকম হতো। সে ভালো-খারাপ যেমনই হোক, সেসবে অন্তত ওর একার দায় থাকতো না। নিজেকে এমন সর্বোচ্চ পর্যায়ের অপরাধী ভাবতে হতো না।
হৃদয়ের রক্তক্ষরণের মাত্রা এতোটাই বেড়েছে যে শারীরিক ব্যথাকে ভুলে গেছে তাথৈ। সর্বাঙ্গে ব্যথা আর দুর্বলতা নিয়েই এলোমেলো পায়ে হাটতে থাকে ও। হঠাৎ করেই একটা ট্রাক এসে থামলো ওর সামনে। বেখেয়ালি তাথৈ সেদিকে ফিরলোও না। পাশ কাটিয়ে আগের গতিতেই হাটতে থাকে ও। ট্রাকের সামনে থেকে নেমে এসে এবার তাথৈয়ের পথ আগলে দিলো কেউ। তাথৈয়ের পা থামে। চোখ তুলে দেখলো, ওর সামনে দুজন লোক। দুজনেরই পরনে লুঙ্গি, গেঞ্জি। কাচাপাকা চুলদাড়ি, মোছ মিলিয়ে উভয়েই মাঝবয়সী। তাথৈকে চোখ তুলতে দেখে দুজনেই দাঁত বের করে হাসি দিলো। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় তাদের পান খাওয়া হলুদাভ দাঁতগুলো স্পষ্ট দেখলো তাথৈ। লোকদুজনের একজন পান চিবানোর ভঙিতে বললো,
– কি মামুনি? কই যাও?
জবাব না দিয়ে তাথৈ পাশ কাটাচ্ছিলো। একজন লাফিয়ে ওর পথ আবারো আগলে দিলো। তেমনি সপাটে হেসে বললো,
– আরে আরে। কওতো কই যাইবা? চলো তোমারে পৌছাইয়া দেই। হাইটা হাইটা আর কতোদুর যাইবা।
– আমি পারবো।
তাথৈ বলতে বলতেই লোকটা খপ করে হাত ধরে ফেললো ওর। চমকে ওঠে তাথৈ। পাশেরজনের দিকে তাকিয়ে দেখে তার হাসিটাও তেমনই বিশ্রি। তাথৈয়ের হাত ধরে থাকা লোকটা বললো,
– আচ্ছা চলো দেহি কতোক্ষণ পারো। আমাগো লগে চলো।
কথার মানে বুঝে বিস্ফোরিত চোখে তাকালো তাথৈ। আশপাশ তাকিয়ে দেখে, দৃষ্টিসীমায় কোথাও কেউ নেই। ওর বুঝে আসে, আত্মগ্লানিতে ও এতোটাই ডুবে ছিলো যে ভুলেই গেছে মাঝরাতে এভাবে রাস্তায় বেরিয়ে পরাটা ওর সম্মানের ওপর আসতে পারে। লোকটা আরেকটু শক্ত করে হাত মুঠো করলো তাথৈয়ের। তাথৈ সেদিকে চায়। গায়ে জোর নেই, তবুও মুচড়াতে থাকে হাত। বলে ওঠে,
– ছাড়ুন!
– হেহে! কয় কি! এই মাইয়া! তোমার কি মনে অয়? আমরা তোমারে ছাড়ার জন্যি ধরছি নি?
তাথৈ সময় নেয়না। কামড় বসায় লোকটার হাতে। সে আর্তনাত করে ওর হাত ছেড়ে দিলো। ছাড় পেতেই ছুট লাগালো তাথৈ। কিন্তু কয়েকপা ছুটতেই মাথা ঘুরে ওঠে ওর৷ ভারসাম্য হারিয়ে পাকা সড়কটায় মুখ থুবড়ে পরে যায় তাথৈ। হাতে ভর করে উঠে দাড়াতে যাবে, টের পেলো পায়জামার হাটুর দিকে ছিড়ে গেছে। সেখানেও চামড়া ছড়েছে। এতোক্ষণে শারীরিক যন্ত্রণা কাবু করে ফেলে তাথৈকে। চোখ ফেটে জল গরায় হাত পায়ের অসহনীয় ব্যথা আর ক্ষতগুলোর জন্য। হাত দিয়ে পা টেনে, কোনোমতে উঠে দাড়ালো ও। টালমাটাল অবস্থায় দেখলো ওর সামনে সে দুই লোক দাড়ানো। তাদের হাসির মানে, এ বিপদ অতিক্রমের সামর্থ্য ওর নেই।
আশপাশ তাকিয়ে হাতের কাছে আত্মরক্ষার জন্য কিছুই পেলো না তাথৈ। পেছন ফিরে দেখে দুই রাস্তার মাঝে কাটাযুক্ত বাগানবিলাস। তাথৈয়ের চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। তবুও হাত বাড়ালো ও গাছের দিকে। ঠিকঠাক না দেখার দরুন কাটা ডানহাতে ফুটে তিন-চার জায়গায় জখম হয়। হাত দিয়ে রক্ত ঝরতে থাকে ওর। তবুও বড়সর একটা কাটা হাতে মুঠো করে নিলো তাথৈ। সামনে দাড়ানো দুই পুরুষের দিকে তাকিয়ে শক্ত করলো নিজেকে। কিন্তু লাভ হলো না। শরীরে কোনো শক্তি নেই ওর। ওকে টলতে দেখে লোকদুটো বিশ্রি হাসলো। তাথৈ বুঝলো, ওদের সে হাসিতে তাচ্ছিল্য, ‘এই বলহীন শরীরে আমাদের প্রতিহত করার সাধ্য তোমার নেই।’ লোকদুটো পা বাড়ালো ওকে ধরার উদ্দেশ্যে। নিরুপায় হয়ে কাটাটা নিজের বা হাতের কবজিতেই ধরলো তাথৈ। লোক দুটো থামে ওর কাজ দেখে। অদ্ভুতভাবে হেসে, হাতের কবজিতে কাটা ফোটায় তাথৈ। বড় কাটাটা চামড়া ভেদ করে গভীরে প্রবেশ করতেই তাজা রক্ত ঝরতে শুরু করে সেখান থেকে। তাথৈয়ের চোখ বেয়ে জল গরায়। বড়বড় দম নিয়ে ও বলে উঠলো,
– এমনিতেও বাচার কারণ ছিলো না। এখন…এখন যদি আমাকে অসম্মান থেকে বাচতে মরতে হয়, আমার জন্য এরচেয়ে ভালো আর কিছুই হতে পারে না। এভাবে ক্ষণে ক্ষণে মরার চেয়ে, একেবারে মরে গিয়ে বেচে যাওয়া ভালো। এন্ড আই চুজ দ্য সেকেন্ড ওয়ান!
#চলবে…