#কার্নিশ_ছোঁয়া_অলকমেঘ
লেখনীতে: মিথিলা মাশরেকা
৫২.
ঝুম বৃষ্টির আওয়াজ কানে আসছে তাথৈয়ের। গায়ের ওপরে থাকা চাদরের উষ্ণতায় শরীরজুড়ে জেঁকে বসেছে আরামপ্রিয়তা। চোখজোড়া খুলতে বাধ সাধছে। কিন্তু টিনের চালে বৃষ্টি পরার শব্দ তাথৈয়ের চোখের অবাধ্যতাকে প্রশ্রয় দিলো না। আস্তেধীরে চোখ মেললো ও। বরাবর তাকাতেই সবার আগে চোখে পরলো কাচসদৃশ জানালার বাইরের বিদ্যুতের ঝলকানি আর তার সামনে উল্টোপাশ হয়ে দাড়ানো এক পুরুষালী অবয়ব। ঘরে একমাত্র আলোর উৎস ছোট্ট একটা টেবিলল্যাম্প। আশপাশটা তাই তেমন বোঝা যাচ্ছে না। ছোট্ট ছোট্ট শ্বাস নিয়ে তাথৈ বোঝার চেষ্টা করলো, ও ঠিকঠাক চোখ খুলেছে কিনা। সোজাভাষায়, বেচে আছে কিনা। আরো সেকেন্ড পাঁচেক সময় নিয়ে টের পেলো, ভুল দেখছে বা শুনছে না ও। ওর প্রাণবায়ু তখনো অবশিষ্ট। চোখ বন্ধ করে আগেররাতের ঘটনা মনে করার চেষ্টা করলো তাথৈ। লাভ হলো না। দূর্বল শরীরটা টেনে তুলে, বসার চেষ্টা করলো এবারে ও। কিন্তু পারলো না। দৃষ্টিক্ষেপ করলো ঘরের প্রান্তে দাড়ানো একমাত্র মানবের দিকে।
গাঢ় খয়েরী রঙের শার্ট পরিহিত মানবের প্রশস্ত কাধ দৃশ্যমান। শার্টের কোথাওকোথাও ভেজা। উল্টোপাশ হয়ে সুনিপুণ ভঙিতে চামচ-বাটি নিয়ে ব্যস্ত মানুষটা। কথা বলার শক্তিটুকোও পাচ্ছে না তাথৈ। আশপাশটায় আরেকবার চোখ বুলিয়ে যা বুঝলো, ও সোফায় শোয়া। ঘরজুড়ে বড়বড় শেলফ। তাতে বই, বিকার, টেস্টটিউব, রিয়জেন্টের বোতলসহ ছোটছোট লতানো গাছ। গাছ দেখে মাথায় ব্যথা অনুভব হলো তাথৈয়ের। মাথা দুহাতে ধরে, চোখ বন্ধ করে নেয় ও। আর তখন চোখের সামনে ভেসে ওঠে একই পেশিবহুল হাত। আর সেহাতে ছিন্নপ্রায় আখ। বিপরীতমুখী হয়ে দাড়ানো সে মানুষটার পরনে গাঢ় খয়েরী শার্ট। হাতাজোড়া কনুই অবদি গুটানো। ঠিক তার সামনে জড়োসড়ো হয়ে হাত জোড় করে দুজন মধ্যবয়স্ক বসে। উভয়েরই গেন্জি ছিড়ে গেছে হাতে, কাধের দিকে। তাদের মুখে আকুতি, “ভুল কইরা ফেলছি বাবা। এবারের মতো যাইতে দেও। এবারের মতো ছাইড়া দেও।”
তাথৈ তৎক্ষনাৎ চোখ মেললো। এনারা আর কেউ নয়, ওর সম্ভ্রমহানী করতে চলা সেই ট্রাকচলকেরা। কয়েকঘন্টা আগে ঠিক কি ঘটেছে কিছু বুঝে না উঠে আবারো ঘরের মানুষটার দিকে তাকালো তাথৈ। সে লোক ফিরেছে ওর দিকে। অন্ধকারের জন্য হাতে বাটি নিয়ে দাড়িয়ে থাকা দীর্ঘদেহীর চেহারা দেখতে পেলো না তাথৈ। মনেমনে ভয় দানা বাধার আগেই একটা শ্বাসের সাথে সাহস সঞ্চার করলো ও। মৃদ্যুস্বরে বললো,
– কে?
লোক একপা এগোয়। আর বাইরের বিদ্যুত চমকানোর আলোয় তার চেহারা দৃষ্টিগোচর হয়। শ্বাস আটকে আসে তাথৈয়ের। দৃষ্টি প্রসারিত হয় অস্বাভাবিক হারে। তবে ওকে অবাক হতে দেখে অকল্পনীয়, অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটি অবাক হলো না। অতি সরল প্রতিত্তর করলো,
– তাশদীদ ওয়াসীর।
তাথৈয়ের চোখ বেয়ে টুপটাপ জল গরায়। ঝাপসা চোখজোড়ায় ভেসে ওঠে আগেররাতের কিছু অঘোষিত মুহুর্ত। মৃত্যুকে স্বীকার করতে তখন হাতে কাটা ফুটিয়েছিলো ও। কিন্তু ওপরওয়ালার হয়তো ভিন্ন পরিকল্পনা ছিলো। কাটা দিয়ে কোনোরুপ গভীর আঁচড় কাটার আগেই জ্ঞান হারিয়েছিলো তাথৈ। মাঝে যখন জ্ঞান ফিরলো, নিজেকে রাস্তাতে পরা অবস্থায় আবিষ্কার করেছিলো ও। নড়চড় করতে গিয়ে বুঝলো, দেহে শক্তি নেই। শুরুতেই নজরে পরলো হাতের কবজিতে থাকা বাধন। অতঃপর চোখের সামনে আসে সেই খয়েরী শার্ট পরিহিত মানব। তাশদীদ ওয়াসীর। আবছা চোখেও তাথৈয়ের তখন সে মানুষটাকে চিনতে ভুল হয় না। কিন্তু পরিস্থিতি বুঝে আসেনি ওর। ট্রাকে আটি করা আখের বোঝা ছিলো। সেখান থেকে টেনে একটা আখ বের করলো তাশদীদ। ডানহাতে ধরে, বা হাতে ডানহাতের হাতা ভাজ দিতে রাস্তায় পরে থাকা লোকদুটোর দিকে এগোলো ও। শপাং শব্দে একজনকে বারি লাগিয়ে অতি সাবলীলভাবে বললো,
– ওর এই অবস্থা কেনো?
শক্ত আখের বারি খেয়ে আর্তনাত করে ওঠে লোকটা। মাথা আরো ধরে যায় তাথৈয়ের। চোখ বন্ধ করে নিলো ও। কান বাজতে থাকে শপাং, শপাং! আখের প্রহারের শব্দ, আর্তনাদ, আর আকুতি, ‘ভুল হইছে বাবা। ছাইড়া দেও। ছাইড়া দেও।
তবে সেগুলো তাশদীদের কানে যাচ্ছিলো না হয়তো। প্রথম প্রশ্নের জবাব না পেয়ে এলোপাথাড়ি বারি লাগাতে থাকলো সমানে। কাউকে বলার সুযোগ দিলো না। গায়ের জোর আর ক্ষোভ দেখাতে গিয়ে তাশদীদের শার্টের ডানহাতা নেমে যায়। পুনরায় তা টান মেরে গুটালো তাশদীদ। তাথৈকে দেখিয়ে বললো,
– কি হয়েছে ওর সাথে?
– আমরা কিছুই করি নাই বাবা! আমরা কিছুই করি নাই! একাই অজ্ঞান হইছে ও। একাই!
একপলক চোখ মেলে এ জবাবটুকো শুনেছিলো তাথৈ। পুনরায় সবটা আধারে মিলিয়ে যায় ওর। নড়চড়ের বিন্দুমাত্র শক্তি নেই শরীরে। চোখ খুলে রাখাটাও দায়। ওটুকো জীবনীশক্তিতে কেবল শুনতে পেলো মার আর আর্তনাতের আওয়াজ। হাতের কবজির ব্যথা সর্বোচ্চ পর্যায়ে। তাথৈয়ের মনে হতে থাকে, ও মারা যাচ্ছে। শেষবারের মতো তাশদীদকে দেখবে বলে টেনেটুনে আরো একবার চোখ মেললো ও। কিন্তু চোখ ঝাপসা। কারো চেহারা বুঝে আসছে না। তাশদীদ হাটু গেরে বসা থেকে উঠে দাড়িয়েছে। আর লোকদুটো ওভাবেই রাস্তায় পরে কাতড়াচ্ছে। তাদের গেন্জি ছেড়া, রক্তাক্ত হাতকাধ। সামনেই পরে আছে ছিন্নভিন্ন আখের ছোবড়া। কিছুক্ষণ আগোবদি যেটা কিনা বাঁশের মতোই শক্ত ছিলো। সুনিপুনভাবে তার ব্যবহার করে আরেকজন। তাথৈয়ের পরিপূর্ণভাবে চোখ বন্ধ হয়ে আসে। নিউরনেরা সঞ্চালন হারায়। এরপর কি হলো, ওকে কোথায়, কিভাবে আনা হলো, তার কিছুই মনে নেই।
স্তব্ধ তাথৈয়ের দিকে এগোলো তাশদীদ। সোফায় শয়নরত তাথৈয়ের সামনে একটা টুল টেনে বসলো। তাথৈ বুঝলো, যা ঘটছে, পুরোটাই বাস্তব। কোনো ভ্রম নয়। সৃষ্টিকর্তা আরো একবার তাশদীদের কাছে ওর মৃত্যুকে থামিয়ে দিয়েছে। উঠে বসার চেষ্টা করলো তাথৈ। কিন্তু উঠতে গিয়ে মাথা ঘুরে ওঠে ওর। তাশদীদ তৎক্ষনাৎ ঝুঁকে একহাতে ওর মাথার পেছন দিকটা ধরলো। আরেকহাতের বাটিটা টেবিলে রেখে, সোফার হাতলে বালিশ ঠেকালো। তারপর তাথৈকে দুহাতে আগলে নিয়ে ওকে আধশোয়া করে বসিয়ে দিলো। পুনরায় টুলে বসে বললো,
– এমন কেমন ফিল করছো?
তাথৈ জবাব দিলো না। তাশদীদের দিকে তাকিয়ে নিজের তকদীরকে ঘৃণা করতে লাগলো। আপনদের সম্পর্কের ঝঞ্ঝাটে ওর দুনিয়া এলোমেলো। এই বিষাক্ত পৃথিবী তাই ছাড়তে চেয়েছিলো ও। কিন্তু পারলো না। ওপরওয়ালা ওকে সে শক্তিটুকোও দিলো না। আরো একবার বাচিয়ে নিলো ওকে। আর সেটাও ঠিক কাকে উছিলা করে? তাশদীদ ওয়াসীর। যার নাম তাথৈয়ের জীবনের সবচেয়ে বড় ঘূর্ণি। যার প্রতি প্রেম ওকে আজ মৃত্যুযন্ত্রণা দিচ্ছে। তাশদীদ জবাব না পেয়ে আরকিছু জিজ্ঞেস করলো না। বাইরের বজ্রপাতের আওয়াজ শুনে পেছন ফিরে একপলক জানালায় তাকালো। টেবিলে একটা মোম জ্বালিয়ে দিলে আরেকটু আলোকিত হয় জায়গাটা। বাটি নিয়ে আবারো খাবার নাড়ানোতে মনোযোগ দিলো তাশদীদ। তাথৈ সোফা থেকে একপা নামাতে যাচ্ছিলো। তাশদীদ প্রতিক্রিয়া না করে টুল নিয়ে সোফা ঘেষে বসে গেলো। তাথৈ বুঝলো, ওকে আটকানো হলো। এই ধরে রাখার চেষ্টাটুকো সহ্য হলো না তাথৈয়ের। কড়া আওয়াজে বললো,
– আমি এ মুহুর্তে এখান থেকে চলে যেতে চাই।
তাশদীদ বাটি থেকে চোখ তুলে ওরদিক তাকালো। ওর আকস্মিক চাওনি দেখে তাথৈ ভেতরেভেতরে দমে যায়। তবুও আগের মতো শক্তকন্ঠেই বললো,
– উপকারের জন্য থ্যাংকস। তবে অন্যের উপকার পেতে পেতে আপাতত আমি ক্লান্ত। আর কারো উপকার নিতে পারছি না। আমাকে যেতে দিলে খুশি হবো।
তাশদীদ চামচ তুলে ধরলো ওর মুখের সামনে। সেদিকে তাকালো তাথৈ। বাটিতে দুধ আর কর্নফ্লেক্স। সাথে বেদানা, আঙুর, আপেল, স্ট্রবেরি, ড্রাগনের মতো কয়েকপ্রকারের ফল ছোটছোট করে কেটে দেওয়া। তাশদীদ স্বাভাবিকভাবে বললো,
– যাওয়া তো দুর, পা ফেলার শক্তিটুকোও তোমার নেই। আর ইন্সট্যান্ট এনার্জি ক্রিয়েট করার মতো কোনো সুপারপাওয়ারও আমার কাছে নেই। তারচেয়ে বরং খাবারটা শেষ করো। ততোক্ষণে ভোরও হবে, বৃষ্টিও কেটে যাবে আর তুমি পায়ে চলে যাওয়ার মতো জোরও পাবে।
তাথৈ অন্যদিক মুখ ফিরিয়ে নিলো। বললো,
– খিদে নেই।
– চুয়াল্লিশ ঘন্টা আঠারো মিনিট না খেয়ে থাকলে খিদে থাকে কি থাকে না, সেটা আমি তোমার কাছে জানতে চাইছি না। শেষ করো এটা।
তাশদীদের কথায় তাথৈ অবাক চোখে চাইলো ওর দিকে। তাশদীদ খাবারের চামচ ওর মুখের দিকে আরেকটু এগিয়ে ধরলো। তাথৈ বললো,
– আপনি বুঝছেন না আমি খেতে চাইছি না? এখানে থাকতে চাইছি না?
নিজের বিরুদ্ধে গিয়েই নিজের কথা পারলো তাথৈ। কখনো তাশদীদের সঙ্গ ওর এমন অসহনীয় লাগবে, সেটা কখনো কল্পনাও করেনি ও। অথচ আজ সেটাই হচ্ছে। বারবার মনে হচ্ছে, ওর জন্য সবাই অসুখে। যে তাশদীদের প্রতি ওর একতরফা ভালোবাসা এতোগুলো জীবনে এমন ভয়ানক বাঁক এনেছে, সে তাশদীদের সাথে ওর আর একমুহূর্ত কাটানো সম্ভব না। তাশদীদ তাথৈয়ের চেহারা পরখ করলো। তারপর মেনে নেওয়ার মতো করে সোজা হয়ে বসলো ও। টেবিল থেকে ফোন নিয়ে, একটা ছবি বের করে দেখালো তাথৈকে। তাথৈ দেখলো সেখানে ছবি দিয়ে ওকে নিখোঁজ বলা। ওর হদিশ জানলে দুটো নম্বরে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে। তাথৈ বুঝলো, এটা তৈয়ব আলফেজ অথবা তুল্যর কাজ। প্রচন্ড অসহায় অনুভব করে মাথার চুল উল্টে ধরলো তাথৈ। তাশদীদের চোখ যায় ওর জামায় লেগে থাকা শুকনো কাদামাটির দিকে। সবসময় টিপটাপ সাজে থাকা মেয়েটাকে এমন বিভ্রান্ত, ছন্নছাড়া অবস্থা কেউ হয়তো কোনোদিন কল্পনাও করেনি। চোখ বন্ধ করে যেনো নিজেকে সামলালো তাশদীদ। পরপরই চোখ মেলে তাথৈকে সোজাসাপ্টাভাবে জিজ্ঞেস করলো,
– তুমি খাচ্ছো? নাকি আমি এই নম্বরে কল করবো?
দু দন্ড সময় নিয়ে খাবার মুখে নেয় তাথৈ। ওর সবকিছু থেকে ছুটি চাই। ও জানে, একবার অম্বুনীড়ে গেলো আর বেরোতে পারবে না ও। তুল্য, আলো, তৈয়ব আলফেজ, কেউই ওকে বেরোতে দেবে না। তাশদীদ ফোন পকেটে পুরে মনোযোগ দিয়ে ওকে খাওয়াতে লাগলো। ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও খাবার গলাধঃকরণ করে তাথৈ। খাওয়া শেষে তাশদীদ পানির বোতল এগিয়ে দিলো ওকে। ঢকঢক করে বোতলের পুরো পানি শেষ করলো তাথৈ। তাশদীদ নিস্পলক দৃষ্টিতে ওকে দেখলো। তাথৈ বোতল রেখে জামার হাতায় মুখ মুছলো। এরপরও বা গালের দিকে একটুখানি খাবার লেগে ছিলো ওর। সাতপাঁচ না ভেবে তাশদীদ হাত বাড়ালো সেদিকে। কিন্তু তাথৈকে তৎক্ষণাৎ অন্যদিক ফিরতে দেখে থেমে যায় ও। একধ্যানে কিছুক্ষণ তাথৈয়ের দিকে চেয়ে রইলো তাশদীদ। হঠাৎই বলে উঠলো,
– রাগ করো রাগান্বিতা। তোমার রাগ জায়েজ।
পুনরায় অবাকচোখে চায় তাথৈ। কিন্তু তাশদীদের চোখে ওর চাওনি এবারো দীর্ঘস্থায়ী হয় না। দৃষ্টি সরিয়ে বললো,
– একা থাকতে চাই।
তাশদীদ কিছু বললো না। সেভাবেই তাকিয়ে রইলো তাথৈয়ের দিকে। মোমের হলুদাভ আলোতে তাথৈয়ের মুখ স্পষ্ট। দরজা-জানালা সব লাগানো। তবুও কোথাকার কোন বাতাসে রুক্ষ চুলগুলোর একটাদুটো গালে পরছে ওর। আস্তেধীরে হাটু ভাজ করে বসলো তাথৈ। যত্ন করে করে দেওয়া কবজির ব্যান্ডেজটা দেখতে থাকে। দুই মানব মানবীর অগ্রাহ্যে বাইরের বজ্রপাতের আওয়াজও যেনো অপমানিতবোধ করলো। ধরনী কাপিয়ে আরো বেশি গর্জে উঠতে থাকে সে। বেশ কিছুক্ষণ কেটে যায় নিরবতায়৷ তাশদীদ উঠে দাড়ালো। সরাসরি হাতের তালু মোমের জ্বলন্ত শিখার ওপর চাপ দিয়ে, নিভিয়ে দিলো মোমটা। চমকে ওঠে তাথৈ। ঘরের এদিকটা আবারো আবছা আধারে ডুবেছে। তাশদীদ সরে আসতে আসতে বললো,
– তোমার রেস্ট দরকার। শুয়ে পরো।
স্থির হয়ে সেভাবেই বসে রইলো তাথৈ। ছায়াময় মানব ঘরের অপরপ্রান্তে পৌছেছে। একহাতে কপাল চেপে ধরে সেখানে থাকা চেয়ারে বসে গেলো সে। তাথৈয়ের চোখ ফেটে জল গরায়। ওর নিরব অশ্রুবিসর্জন আর অম্বুর তোলপাড় করা বর্ষনে কেটে যায় আরো ঘন্টাখানেকের মতো। টেবিলে থাকা চার্জের আলো কমে এসেছে অনেক আগেই। দুবার করে জ্বলে নিভে চার্জ শেষ হওয়ার পূর্বাভাস দিলো সে। ধপ করে নিভেও গেলো কয়েক সেকেন্ড পরেই।
আরো অনেকটা সময় কাটলো অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরটায়। বাজের হুংকারে আর দুজনের নিরবতায়। কারো না বলা অভিমানে। আর হয়তো কারো না বলা অভিযোগে। তাশদীদ কপাল চেপে ধরে আগের মতোই চেয়ারে বসে আছে। অন্ধকারের জন্য ওর চেহারা দেখা যায় না। কেবল অবয়ব বোঝা যায়। সময় নিয়ে চোখ মুছলো তাথৈ। নিশিরাতের এ ঝড় যেনো ওর জীবনের প্রতিরুপ। এ ঝড়ের শেষে সব ধ্বংস। এ আধার কাটলেই ওর মুক্তি৷ তাথৈয়ের গলা শুকিয়ে আসে। অন্ধকারে কিছুর হদিশ পাবে না জেনেও ঘাড় ঘুরিয়ে আশপাশ দেখলো তাথৈ। হঠাৎই অনিয়মিত কিছু চোখে পরলো ওর। খেয়াল করলো, বন্ধ জানালার এপারের ধারে একটা জোনাকির মিটিমিটি আলো। তাথৈ অবুঝের মতো সেদিকে তাকিয়ে রয়। ছোট্ট আলোটা জ্বলছে নিভছে৷ কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে হুবহু একই আলো আসে শেলফের ওপর থাকা একটা জারের মধ্য থেকে। তবে সেটা আকারে আরেকটু বড়।
নড়েচড়ে বসলো তাথৈ। সময়ের সাথে রাজ্যের বিস্ময় চেপে বসে ওর দৃষ্টিতে। ঘরজুড়ে অন্ধকার, বাইরের অনিয়মিত বেগের বৃষ্টি, টিনের চালে শব্দ, নিউরন ছিড়ে নেওয়ার মতো একেকটা বাজ পরার আওয়াজ। তবুও সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করা তো দুর, নিজের চোখজোড়াকে পলক ফেলার সুযোগটুকোও দেয়নি তাথৈ। চোখের সামনে ভেসে ওঠা অপার্থিব দৃশ্যকে কি করে উপেক্ষা করবে ও? আলোর উৎসের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। বিকারে আলো জ্বলছে, একুরিয়ামে আলো জ্বলছে, পানির বোতল, তাতে থাকা গাছেও একই অবস্থা। তাদের আকার বলে দিচ্ছে সেগুলো বিভিন্ন রকমের ফুল, ইনডোর প্লান্ট, এ্যকুরিয়ামে থাকা প্রাণী, আর প্রজাপতির ডানা থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে। আর তাতে যে দৃশ্যায়ন ঘটেছে, নিসন্দেহে ওপরওয়ালার সৃষ্ট সব সৃষ্টির পর তা সবচেয়ে সুন্দর সৃষ্টি। তাথৈ আলো বিচ্ছুরণকারী প্রাণীগুলোর নড়চড়ে শিউরে উঠতে থাকে বারংবার। এমন প্রাণী পৃথিবীতে আছে বলে ওর জানা ছিলো না। কয়েক মুহুর্তের ব্যবধানে ওর বিস্ময়ের পাহাড় আকাশ ছুঁয়ে যায়। জানালার সেই একবিন্দু আলোটুকো স্থির নেই। মানিপ্লান্টের গা বেয়ে তা ছড়িয়ে পরছে অনেকটা জুড়ে। পুনরায় জলে ভরে ওঠে তাথৈয়ের দুচোখ। তাদের তারায় প্রতিফলিত হয় আলো বিচ্ছুরনকারী মানিপ্লান্ট। তারা যেনো আলোকীয় হরফে সাজিয়েছে নিজেদের। জ্বলতে থাকা সে লতানো গাছে ইংরেজী বর্ণে স্পষ্টরুপে ফুটিয়ে তোলা, ❝TATHAI❞
#চলবে…
#কার্নিশ_ছোঁয়া_অলকমেঘ
লেখনীতে: মিথিলা মাশরেকা
৫৩.
ঝড়-ঝঞ্ঝার রাত শেষ প্রায়। তবে অন্ধকার ক্ষীণ হতে শুরু করেনি এখনো। ভেজা মাটির ঘ্রাণ নাকে আসছে। ঠেস দিয়ে তুলে রাখা জানালা দিয়ে শীতল বাতাস ঘরে ঢুকছে। আর তার সামনে স্তব্ধ, পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে তাথৈ। দেয়ালে থাকা বিষয়বস্তু যেনো সবকিছু ভুলিয়ে দিয়েছে ওকে। নড়চড় করতে না জানা শরীরটা সোফা থেকে তুলে এনে অনেকক্ষণ হলোই এভাবে দাড়ানো ও। জানালার মানিপ্লান্ট টেনে পাশের দেয়ালেও আটকানো। গাছের আলোর বিচ্ছুরণে দৃশ্যমান হয়, সে দেয়ালে প্রায় অর্ধশতো ছবি আটকানো। আর তাদের নিচে সময়, তারিখ লেখা। বিস্ময়ের সব সীমা পার করিয়ে অশ্রুতে ভরে ওঠে তাথৈয়ের চোখ।
দেয়ালে আটকানো সবগুলো ছবিই তাথৈয়ের। ওরই অজান্তে অগোচরে তোলা কিছু সুন্দর মুহুর্তের। সারির শুরুতে কক্সবাজার ভ্রমনের সেই বায়োলুমিনিসেন্সের রাতের তিনটে ছবি। তাথৈ জ্বলতে থাকা সমুদ্রের পানি নিয়ে খেলছে, হাসছে। তারপরের কিছু ওদের ভার্সিটির ল্যাবের। গগোল পরিহিত তাথৈ রিয়জেন্টের বোতল পরখ করছে, খাতায় লিখছে। পরের ছবিগুলো বসন্ত উৎসবের। তাথৈ ওপরতলায় ওড়না উড়িয়ে নাচছে তার একটা নিচ থেকে তোলা ছবি। কোনো গ্রুপ ছবি থেকে কেটে নেওয়া আরো কিছু ছবি। পরের কিছু ছবির তারিখটা ভর্তি পরীক্ষার দিনের। সেটাও কেটে রাখা। তাথৈয়ের মনে পরে, সেসময় রিংকির দিকে তাকিয়ে ছিলো ও। এরপর একাধারে আরো চার-পাঁচটে ছবি। সে সবগুলোই তাথৈয়ের প্রীতিকার্নিশ থাকাকালীন। দুটো যখন ও তাশদীদের ঘরে ছিলো, তখন জানালার বাইরে থেকে তোলা, বুজোর সাথে হাটুগেরে ঘাসের মাঝে বসা অবস্থায়, তাশদীদ যখন টেবিলে বসে তাথৈকে দিয়ে বিক্রিয়া ব্যাখা লেখাচ্ছিলো, তখনকার। পরের ছবিগুলোর কোনোটা আইডিকার্ডের, কোনোটা ক্যাফেতে উল্টোপাশ হয়ে বসা অবস্থায়, কোনোটা ক্লাসের জানালা দিয়ে তোলা, কোনোটা বুজো, শার্লি বা রুমনের সাথের, তো কোনোটায় তাথৈ আর ওর গাড়ি।
তাথৈ প্রতিক্রিয়াবিহীন হয়ে পরে। চোখ বেয়ে জল গরায় ওর। আস্তেধীরে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে, ওর পাশে দাড়ানো তাশদীদের মুগ্ধতাভরা চাওনি সে ছবিগুলিতেই স্থির। তাথৈয়ের মস্তিষ্ক অচল হয়ে পরে একপ্রকার। ও কেবলই ভাবতে লাগলো, তাশদীদ কি সত্যিই মুগ্ধ হয়ে ওর ছবিগুলো দেখছে? ওর এই ছবিগুলো তাশদীদের তোলা? এমন মুগ্ধতা নিয়েই কি এই ছবিগুলো তুলেছে তাশদীদ? তাহলে তা ওর সামনে কেনো ছিলো না? এ মুগ্ধতা কেনো ওর আগে চোখে পরেনি? প্রতিটা ছবি তোলার আগেপরে, কয়েকসেন্ডের ব্যবধানে ওউ তো তাশদীদকে এভাবেই দেখেছে। তাহলে কি করে সে চোখে চোখ পরলো না ওর? কি করে সময়টা এক হলো না ওদের জন্য? তাশদীদ বিকারে থাকা আলোকীয় প্রাণীগুলোর দিকে এগোলো। তাকটা তাথৈকে দেখিয়ে বললো,
– আমি প্লান্টগুলোতে লুমিনেন্সিং ঘটাতে পেরেছিলাম। কিন্তু এগুলোর সিকোয়েন্সিংয়ে তোমার লেখা রিয়্যাকশন ইউজ করতে হয়েছে। এগুলোর ক্রেডিট তোমার। অল ইওরস্…
‘সবকিছু তোমার!’ বলে তাশদীদ পেছন ফিরলো। তাথৈয়ের মনে হলো, এই সবকিছু শব্দটার মধ্যে তাশদীদ নিজেকেও গণনা করেছে। আর সেটাই মানতে পারলো না ও। সাময়িক আশ্রয় ব্যতিত এখানকার আর কিছুই হতে পারে না ওর। জবাব দিলো,
– মোডিফিকেশন আপনার করা৷ এসবের কিছুই আমার না। আমার কোনোদিন কিছু ছিলোই না।
বলা শেষ করে তাথৈ। অকস্মাৎ পায়ের ব্যথা বাড়ে ওর। প্রায় পরেই যাচ্ছিলো। কিন্তু তার আগেই তাশদীদ ধরে ফেললো ওকে। তাশদীদের হাতজোড়াকে শেষ সম্বলের মতো আঁকড়ে ধরলো তাথৈ। দুহাতে আগলে নেওয়া তাথৈয়ের দৃষ্টিতে দৃষ্টি স্থির করে তাশদীদ। বহুদিন এ চোখে চোখ রাখা হয়নি ওর। যখন থেকে নিজের অনুভূতির সাথে পরিচিত হয়েছে, তখন থেকে। কক্সবাজারের বায়োলুমিনেন্সের তোলা তাথৈয়ের তিনটে ছবি কোনো কারন ছাড়াই নিজের কাছে রেখেছিলো ও। কিন্তু তারপর থেকেই তো অনেককিছু ঘটে গেছে ওর সাথে। সবসময়, সবকিছুতে তাথৈকে মনে করে, বারবার ওকে দেখতে চাওয়া, ওর থেকে দুরে থাকাকে মানতে না পারা…আরো কতো কি ঘটেছে তার হিসেব তাশদীদের নিজের কাছেও নেই। তবে তাশদীদ এটা জানে, ট্যুর পরবর্তী সময়ে তাথৈয়ের সামনে ও নিজেকে যতোটা স্বাভাবিক রেখেছে, তাথৈয়ের দৃষ্টির আড়ালে ও ততোটাই অস্বাভাবিক ছিলো। যা অন্য কোনো নারীর ক্ষেত্রে হয়নি। ‘ভালোবাসা’ ব্যতিত এতোসব অদ্ভুত অনুভূতির অন্যকোনো নাম পায়নি তাশদীদ। কিন্তু শান্তর কাছে কিছুটা তাথৈ-অন্তুর বিষয়ে জেনেছিলো ও। ধারনা করেছিলো, প্রেম-ভালোবাসা তাথৈয়ের কাছে বিষ বলে মনে হতেই পারে। তাই ওর মনে কি আছে, তা না জেনে ওকে বলারও সাহস করতে পারেনি। তবে তাশদীদ এটাও জানে, সেখানেই ওর সব ব্যর্থতা। জীবনে প্রথমবার নিজের ওপর নিজেরই ঘৃণা অনুভব হলো তাশদীদের। আর তাথৈ অনুভব করলো, তাশদীদের চোখজোড়া ওর কথার জবাবে স্পষ্ট বলছে, ‘আমি ছিলাম তাথৈ। আরকিছু না থাকলেও, আমি তোমার ছিলাম। ব্যস কখনকখন ছিলাম, তা তুমি জানতে পারোনি।’ তবে সে জবাবকে মানলো না তাথৈ। শক্ত আওয়াজে বললো,
– ছাড়ুন…
– সম্ভব না। আ’ম সরি।
সহজাত জবাব দিলো তাশদীদ। তাথৈয়ের দৃষ্টি প্রসারিত হয়। বুকের হাহাকার আরো গাঢ় হয়ে ওঠে। এতোগুলো দিন ও যে মানুষটার ভালোবাসা পাওয়ার লোভ করে এসেছে, আজ ও তার বাহুডোরে। সে মানুষটা কতো সহজে আজ ওকে আগলে নিচ্ছে। কিন্তু কেনো? ওর দূরাবস্থা দেখে? ওকে করুনা করে? তাথৈ নিজেকে সামলে তাশদীদের বাহুবন্ধন থেকে বেরোনোর চেষ্টা করে। তাশদীদ শ্বাস ফেললো। একটা চেয়ার টেনে দিলো তাথৈয়ের দিকে। তাথৈ বসলো না। চেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে রইলো ও।তাশদীদ অপরাধীর মতোকরে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। তাথৈ শরীর ধরে রাখতে পারছে না আর। চেয়ারের হাতল হাতড়ে বসে গেলো ও। তাশদীদ পুনরায় ওর কাছে আসলো। বসে গেলো তাথৈয়ের পায়ের কাছে। অপ্রস্তুত হয়ে অন্যদিক মুখ ফিরিয়ে নিলো তাথৈ। তাশদীদ ওর হাত ধরলো। ক্যানোলার কারনে ক্ষত হয়ে থাকা জায়গাটা শুকিয়ে ওঠা জায়গাটায় ঠোঁট ছোঁয়ালো অতি সন্তর্পণে। শরীর ঝাঁকি দিয়ে ওঠে তাথৈয়ের। তাশদীদ একফোঁটা চোখের জল ঝরিয়ে ওর হাতের দিক চেয়ে বললো,
– যে সময়টায় ছিলাম না, তার জন্য সরি।
অবুঝের মতো বসে রয় তাথৈ। তাশদীদ পুনরায় ওর হাতে ঠোঁট ছোঁয়ালো। আস্তেকরে বললো,
– বুজোকে হারানোর পরবর্তি প্রতিটা মুহুর্তের জন্য সরি।
…
– আলো-তুল্যর বিয়ের জন্য তুমি কষ্ট পেয়েছো, সেজন্য সরি।
…
– শার্লি-রুমন দুজনেই আজ তোমার থেকে দুর, সেজন্য সরি।
…
– আমার অনুপস্থিতিতে তোমার শরীরের এতোগুলো আঘাত, সেজন্য সরি।
একাধারে আরো চারবার তাথৈয়ের কবজিতে চুমু আঁকলো তাশদীদ। তাথৈ টু শব্দটাও করলো না। তাশদীদ চোখ তুলে তাকালো ওর দিকে। তাথৈ অস্পষ্ট আলোয় দেখলো, তাশদীদের চোখজোড়া লালচে হয়ে আছে। তাশদীদ দুহাতে হাত ধরলো ওর। স্বরে তেমনই অসহায়ত্ব রেখে বললো,
– আমি তোমায় ভালোবাসি তাথৈ।
কাঠের চেয়ারের হাতল খামচে ধরলো তাথৈ। নিজকানে শোনা এই চারটে বর্ণকে বিশ্বাস করতে পারে না ও। ওর বিশ্বাসের সীমা ভাঙচুর করে তাশদীদ পুনরায় বললো,
– ভালোবাসি বলে সরি তাথৈ। যখন নিজে বুঝলাম ভালোবাসি, তখন তোমাকে বোঝার চেষ্টা করার জন্য সরি। যখন তুমি অস্বীকার করলে ভালোবাসো না, তখন নিজের স্বীকারোক্তি দেওয়ার সাহস না করার জন্য সরি। তোমার অগোচরে যতোটা তোমাকে চেয়েছি, ততোটা সরি। তোমাকে না বলায় তোমাকে যতোটা ভালোবাসি, ততোটা সরি। আ’ম সরি তাথৈ। আ’ম সরি!
তাথৈয়ের হাত ধরে রেখে তাতে কপাল ঠেকালো তাশদীদ। কয়েকদন্ড থমকে রইলো তাথৈ। পরিস্থিতি যেনো ওর মস্তিষ্কে প্রবেশের অনুমতি পায়নি। সময় নিয়ে বুঝে উঠতেই শরীর কেপে ওঠে তাথৈয়ের। আর সহ্য করতে পারলো না ও। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুহাতে তাশদীদের কলার চেপে ধরলো তাথৈ। ফুপিয়ে কেদে উঠে বললো,
– ব্যস? শেষ তোমার ভালোবাসি বলা? শেষ স্বীকারোক্তি দেওয়া?
…
– কেনো? এতোগুলো দিন পর আজ হঠাৎ করে আমাকে এসব কেনো বলছো তাশদীদ? কেনো? আমাকে এই অবস্থার জন্য করুণা করে? হু? আমার প্রতি করুণা হচ্ছে তোমার? হু? করুণা হচ্ছে? ভালোবাসি বলে দয়া করছো আমায় তুমি? হু? দয়া দেখাচ্ছো?
– রুডিকে চেনো?
তাথৈয়ের হাতের জোর কমে আসে। তাশদীদ জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজালো নিজের। শার্টের গলার দিকের দুটো বোতাম খুলে ফেলে ও। তাথৈ শুকনো ঢোক গিললো একটা। কিছু না বলে তাশদীদ উঠে দাড়ালো। তারপর টেবিলের ড্রয়ার টেনে একটা সংবাদপত্রের কাটা অংশ বের করে তাথৈয়ের দিক এগিয়ে দিলো ওটা। তাথৈ কাগজ হাতে নিলো না। সেদিকে দৃষ্টিক্ষেপ করতেই ওর চোখে পরে সেখানে একজন শ্বেতাঙ্গের সাদাকালো ছবি। অদ্ভুত তার চুলের ছাট। কানে রিং, কবজিতে স্টিলের সরু চুড়ির মতো তিনচারটে বস্তু, হাতে, গলায় ট্যাটু করা। আর ছবিটার নিচে মোটা হরফে লেখা, ‘Canadian Criminal Rudy, spotted in Bangladesh.’
তাশদীদের দিকে ফের চোখ তুলে তাকালো তাথৈ। তাশদীদ কাগজটা টেবিলের ওপর রাখতে রাখতে বললো,
– গেইস হোয়াট, এই বিদেশী সন্ত্রাসী বিডিতে কেনো এসেছে?
তাথৈ জবাব দিতে পারে না। এমন অহেতুক প্রশ্নে কথা বাড়ানোর ইচ্ছেও ওর নেই৷ দৃষ্টি সরিয়ে অন্যদিক তাকালো ও। তাশদীদ পেছনদিকের টেবিলে হাত রেখে তাতে ভর করে দাড়ালো। কিঞ্চিৎ ঘাড় বাকিয়ে বললো,
– টরোন্টোর জেলে বসে, মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে হায়ার করে, রুডিকে জেইন এদেশে পাঠিয়েছে। তোমার ক্ষতি করার জন্য।
তাথৈ বিস্ফোরিত চোখে তাকালো তাশদীদের দিকে। তাশদীদ বললো,
– আমার এগেইনিস্টে হওয়া পোস্ট নিয়ে সুবোধ স্যার আর আফিফকে তুমি কেনো ধমকি দিয়েছিলে তাথৈ? তুমি তো আমাকে ভালোবাসো না। তাহলে?
– দ্ দুবার প্রাণ বাচিয়েছিলে তুমি আমার। তারই প্রতিদান হিসেবে তোমার মান বাচিয়েছি। পে ব্যাক করেছি ব্যস! আর কিছুনা।
তাশদীদের প্রশ্নে অবাক হয়েছিলো তাথৈ। কিন্তু এতোবড় মিথ্যেটা বলতে দু সেকেন্ডও সময় নেয়নি ও। কথাটা বলার পর চোখ বেয়ে আপনাআপনি জল গরালো ওর। আবারো নিজের ওপর করুনা হলো প্রচন্ডরকমভাবে। শুরুতে তাশদীদের ভালো না বাসার ভয়, এখন তাশদীদের ভালোবাসার ভয় ওকে ভালোবাসা অস্বীকার করতে বাধ্য করছে। ভাগ্য যে ওকে কতোভাবে যন্ত্রণা দিচ্ছে, তার তালিকা যেনো ক্রমশ বেড়েই চলেছে। ওর জবাব শুনে অন্যদিক তাকালো তাশদীদ। নিচের ঠোঁট কামড়ে তাচ্ছিল্যে হাসলো। অতঃপর বললো,
– হোয়াটএভার…তুমি আমাকে পে ব্যাক করতে স্যারকে ধমকি দিয়ে আসবে, তার আর তার ছেলের ক্যারিয়ার শেষ করে দিয়ে আসবে, এরপর তোমার জন্য স্যার এখানে লাঞ্ছনা নিয়ে বাচবে, ওখানে টরোন্টোর জেলে তার ছেলে দৈনিক মরতে মরতে বাচবে…কি ভেবেছিলে তুমি তাথৈ? ওরা তোমায় এতো সহজে ছেড়ে দেবে? ইজ’ন্ট ইট টু ইনকম্প্যাটিবল উইথ দেয়ার ক্যারেক্টারিস্টিকস?
তাথৈয়ের অবুঝের মতো চেয়ে রইলো শুধু। তাশদীদ স্বাভাবিক গলায় বললো,
– যে স্যার আমার তৈরী করা রিয়্যাকশন, মোডিফিকেশন চুরি করে নিজের ছেলের নামে চালিয়ে দিলো, প্রেস কনফারেন্সে সেই সুবোধ স্যারের স্বীকারোক্তি আমার কাছে প্রচন্ডকরমের অস্বাভাবিক ছিলো। ব্যাপারটা এতো সহজে নিতে পারছিলাম না। তাই চলে যাই স্যারের বাসায়। তাকে জিজ্ঞেস করি, এমন সুবোধের উদয় হওয়ার কি কারন। সে লোক তোমার পরিচয় দিতে না পারলেও এটুকো বলেছিলো, বাড়ি বয়ে তাকে হেনস্তা করে আসা মেয়েকে সে ছাড়বে না। যে করেই হোক, সে মেয়েকে সে খুঁজে বের করে সে নিজের মানহানির, ছেলের শাস্তিভোগের হিসেব নেবে। বিশ্বাস করো তাথৈ, মেয়ে শব্দটা শোনার পর জানিনা কেনো ওইমুহুর্তে আমার তোমার কথাই মনে পরেছে। কিন্তু পরপরই মনে হয়, এটা অসম্ভব। আর যাইকিছু হয়ে যাক, তুমি আমার জন্য সুবোধ স্যারকে ধমকাবে, এমনটা কোনোমতেই হতে পারে না। নিজেকে সামলে আমি পাল্টা সতর্কবার্তা দিয়ে আসি স্যারকে।
কিন্তু ওরা থেমে থাকেনি। রুডি এদেশে আসতেই আমি জেইনের একটা ভয়েজ মেইল পাই। যাতে বলা ছিলো, ওর আমার সাথে শত্রুতা নেই। তবে যে মেয়ে আমার পক্ষধারী, সে মেয়েকে ও ছাড়বে না। কেউ আমার উপকার করেছে বলে তার হওয়া ক্ষতিই যে আমার জন্য বেশি অসহনীয় হবে, সেটা জেইন আর ওর বাবার আন্দাজে ছিলো। ঘটনা ঘটছিলোও ওদের পরিকল্পনামাফিক। ওরা আমার আশপাশ এমনভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিলো…রুডি রিংকিকে অবদি সন্দেহ করে পাকড়াও করেছিলো। কিন্তু ওর জবাবে হয়তো এমন কিছু পায়নি যাতে ওকে আমার লাইফে এটাচড বলে মনে করবে। কোনো এক বিদেশী রিংকিকে আমার বিষয়ে জেরা করছে, রোজির কাছে এবিষয় জানার পর আমি নিজের করনীয় বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
পাওয়ার আগেই আমার হারানোর ভয় ছিলো তাথৈ। হয়তো তাই নিজেকে তোমার থেকে দুরে রাখতে শুরু করি। ভয় হতো, তোমার সামনে আসলে কখনো আমি তোমায় বলে না ফেলি, দ্যাট আই লাভ ইউ। কখনো তোমার না মনে হয়, দ্যাট ইউ লাভ মি। যদি দুটোর একটাও ঘটতো, আর সেটা রুডি কোনোভাবে জানতে পারতো, ও ধরেই নিতো, আমার জীবনের একমাত্র রমনী তুমি। তুমিই সুবোধ স্যারকে ধমকেছো, জেইন তোমার ক্ষতি করতেই ওকে হায়ার করেছে। আর ঠিক তখনতখনই ও হয়তো তোমাকে…
থেমে যায় তাশদীদ। তাথৈ খেয়াল করলো, ওর চোখেমুখে অসহায়ত্ব জেঁকে বসেছে। তাশদীদ গলার স্বর খাদে নামিয়ে বললো,
– আমার কাছে তোমার-আমার দুরুত্বটুকোই তোমাকে সেইফ রাখার একমাত্র উপায় ছিলো তাথৈ। আর অজ্ঞাত সে মেয়েকে সুরক্ষা দেওয়ার উপায় ছিলো রুডি সে মেয়েকে খুঁজে পাওয়ার আগে আমারই রুডি বা সে মেয়ে অবদি পৌছানো। রুডিকে ধরার জন্য পুলিশের চেষ্টা ছিলো। আমিও আমার মতো করে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। ওপরওয়ালার মর্জিতে সবটা শর্ট আউট হয়ে আসে ফেসবুক পেইজে আমার ডকুমেন্টস পোস্টকারী কে সেটা জানার পর। আমি আফিফকে প্রশ্নতাক করি। অবাক করার বিষয় হলো, ও আমার কাছে তোমার নাম নিলেও, সুবোধ স্যার বা রুডির কাছে তোমার নাম বলেনি। তোমার ভয়ে ওদের কাছে বলেছে, ওকে ধমকানোর সময়ও তুমি মাস্ক পরিহিতা ছিলে। যার জন্য সুবোধ স্যার তোমার পরিচয় জানতে পারেনি, রুডিও তুমি অবদি পৌছাতে পারেনি….
তাশদীদ একটু থেমে বা পায়ের গোড়ালী দিয়ে টেবিলের নিচদিকটায় লাথি ছুড়লো। শব্দ শুনে চমকে ওঠে তাথৈ। তাশদীদের পায়ের দিকে তাকাতেই চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম হয় ওর। টেবিলের নিচে কাবার্ড। তার ভেতরে মুখে স্কচটেপ, হাতপা বাধা একজনকে ঠেলেঠুসে রাখা। তাথৈ ঠিকঠাক পরখ করে বুঝলো, ওটা পেপারকাটিংয়ের ছবির মানুষটাই৷ রুডি। অজ্ঞান হয়ে নিস্তেজ হয়ে আছে সে। তাশদীদ তাথৈয়ের দিকে চেয়ে রইলো। জেইনের ভয়েজমেইলের নম্বর থেকে সিমের ক্রয়কারীকে খোঁজা থেকে শুরু করে তার পেছনে ছায়ার মতো লোক লাগিয়ে রাখা, এই রুডিকে ধরতে ওকে কতোদুর অবদি যেতে হয়েছে, তা শুধু ওই জানে। আফিফের আগে রুডিকে পেয়ে যাওয়াটা ওর জন্য বিশ্বজয়ের মতোই ছিলো। এ কদিনে রুডির ওপর যা গেছে, সবকিছুর মধ্যে ওর জন্য সেটুকোই ছিলো মানসিক শান্তি। তাথৈকে স্বাভাবিক করতে পা দিয়ে ঠেলে কাবার্ডের পাল্লা আটকালো তাশদীদ। নিজের স্বাভাবিক ভঙ্গিমা ধরে রেখে বললো,
– আর না কখনো পারবে।
তাথৈয়ের গায়ের জোর পুনরায় কমে আসতে থাকে। প্রসারিত নয়নে ও চেয়ে রয় কাবাডটার দিকে। চোখেমুখে বিস্ময় সাজিয়ে, আস্তেধীরে দাড়িয়ে যায়। তাশদীদ বললো,
– আফিফের কাছে তোমার নাম শুনে আমি তোমার খোঁজ করতে রুমনকে কল করেছিলাম। বুজোর এক্সিডেন্ট, তুল্যর আলোকে বিয়ে করা আর শার্লির চলে যাওয়া, এসব…এসব আমাকে ওই বলেছে। বুজোর এক্সিডেন্টের পর থেকেই তুমি অসুস্থ। আমি এখন বুঝতে পারছি, আমার এ জীবনে করা সবচেয়ে বড় ভুল হলো নিজেকে তোমার থেকে দুরে রাখা। সেটা যে কারনেই হোক না কেনো। যদি আমি তোমার না শুনে নিজেকে গুটিয়ে না নিতাম, এই এক্সপেরিমেন্ট নিয়ে এতোটা ব্যস্ত হয়ে না পরতাম, আফিফকে খুঁজতে সময় নষ্ট না করতাম, রুডিকে হাতে পাওয়ার জন্য এতো পাগল না হতাম, তাহলে…তাহলে হয়তো আমি তোমার খেয়াল রাখতে পারতাম তাথৈ। যা ঘটতে চলেছে তা থামাতে না পারলেও অন্তত তোমার পাশে থাকতে পারতাম। সে তুমি চাও বা না চাও। উপকার ভাবো বা প্রতিদান, আমি তোমায় সর্বাবস্থায় আগলে রাখার চেষ্টা করতাম। তোমার ওপর কোনো আঁচ আসতে দিতাম না।
…
– কিন্তু আজ আমার সাহসী হতে বাধা নেই তাথৈ। তোমার জানা উচিত, আমি তোমাকে ভালোবাসি। সারাজীবন তোমাকে ভালোবাসতে চাই, ভালোবেসে আগলে রাখতে চাই।
…
– হবে তুমি আমার তাথৈ? হবে আমার? আজন্মের জন্য?
তাথৈ জবাবহীন। ঘাড় উচু করে অশ্রুসজল চোখে চেয়ে রইলো তাশদীদের দিকে। তাশদীদ এগিয়ে একদম সামনে গিয়ে দাড়ালো তাথৈয়ের। ওর চোখে চোখ রেখে বুঝলো, ওরও চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে, গলা ধরে যাচ্ছে, কন্ঠনালী রুদ্ধ হয়ে আসছে। নিজেকে সামলাতে দুহাত শক্তমুঠো করে নেয় তাশদীদ। একটা ঢোক গিলে পুনরায় বলে উঠলো,
– অডিটোরিয়ামে তোমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘ভালোবাসো কিনা?’ সেদিন তোমার জবাব না সূচক ছিলো। কিন্তু আজ আমার প্রশ্ন পাল্টেছে তাথৈ। আজ তোমার জবাব পাল্টানোও কিন্তু আবশ্যক। তোমার অস্বীকার কেবল আমায় যন্ত্রণা দিয়েছিলো। কিন্তু তোমার প্রত্যাখান আমাকে শেষ করে দেবে তাথৈ। আজ সাহস করে, সবদিক ঘুচিয়ে তোমাকে চাইছি, শুধু তোমাকে চাইছি। আজ আমাকে ফিরিয়ে দিও না প্লিজ। প্লিজ!
#চলবে…
#কার্নিশ_ছোঁয়া_অলকমেঘ
লেখনীতে: মিথিলা মাশরেকা
৫৪.
ঢাকার বাইরের এক ছোট্ট উপশহর। সকালের ঝলমলে রোদ এসে পরছে এপার্টমেন্টের পূর্বমুখী বারান্ধায়। ছোট্টখাট্টো একটা কিচেন, চার চেয়ারের ডাইনিং টেবিল, সোফাসেট, টিটেবিল, মাঝারি আকারের ঝাড়বাতি মিলিয়ে একটা ড্রয়িংরুম, আর দুটো শোবার ঘর। ছয়তলার এই ছোট্ট বাসাটা অতি ছিমছামভাবে সাজানো। দেয়ালে রঙবেরঙের পেইন্টিং, কৃত্রিম ফুল পোড়ামাটির ফুলদানী, দেয়ালের শোপিস, সব মিলিয়ে বাসাটার কোনায় কোনায় শৌখিনতার ছোঁয়া। শোবার ঘরে বিছানায় বসে শান্ত ল্যাপটপে ব্যস্ত। ওর কানে হেডফোন গোজা। আশপাশের কিচ্ছু খেয়ালে নেই ওর। আওয়াজ শুনে ওয়াশরুমের দরজায় তাকালো শান্ত। মাথায় তোয়ালে পেঁচাতে পেঁচাতে ওয়াশরুম থেকে বের হওয়া রমনীর পরনে হালকা গোলাপী রঙের শাড়ি। ভেজা চুল সামলাতে সামলাতে সে আয়নার দিকে এগোচ্ছে। শান্ত মুচকি হেসে ল্যাপটপে চোখ নিলো। গলা উচিয়ে বললো,
– ভাবছি ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ের কোর্সটা এবার আমিও করে ফেলবো। এ বিষয়ে তোমার কি মত শার্লি?
শার্লি টুলে বসে গিয়ে আয়নায় তাকালো। শান্ত মুচকি মুচকি হাসছে, আর ল্যাপটপ ঘাটছে। প্রায় দু বছর হলো আউটসোর্সিংয়ে কাজ করে কিবোর্ডে পটু হয়ে ওঠা মানুষটা সময় নিয়ে নিয়ে কিবোর্ডের বোতাম টিপছে। ও জানে, শান্তর কাজে মনোযোগ নেই। ও সামনে থাকলে কাজে মনোযোগ দিতে পারে না শান্ত। এমনটাই হয়ে আসছে এতোগুলো দিন হলো। শার্লি মাথা থেকে তোয়ালে খুললো। মুখে ক্রিম মাখতে মাখতে বললো,
– তা হঠাৎ জনাবের এমন ইচ্ছার কারন?
– শার্ট-প্যান্ট থেকে শুরু করে শাড়ি, তুমি যাই পরো, দেখতে সুন্দর লাগে। এই সবকিছুতে এমন সুন্দর লাগার রহস্য কি হতে পারে? কি এমন কারন আছে তোমার এতোএতো সুন্দর লাগার?
‘কারন আমার বরের দৃষ্টি সুন্দর।’
মনের জবাবটা মুখে দিলো না শার্লি। কনিষ্ঠা আঙুলে চোখের কোনে কাজল ছুঁইয়ে বললো,
– নজর দিচ্ছেন?
– একদমই না। নজর কেনো দেবো? আমিতো বউয়ের প্রসংশা করে ভালোবাসা জাহির করছি।
শার্লি গম্ভীরতা বজায় রেখে আরেকচোখে কাজল দিতে যাচ্ছিলো। শান্তর কথায় লজ্জা পেয়ে এবারে হেসে ফেললো ও। উঠে গিয়ে বিছানার পাশে দাড়িয়ে বললো,
– দেখুন কি করেছেন! অল্পের জন্য কাজল লেপ্টে যায়নি আমার। গেলেপরে মামলা দিতাম আপনার নামে।
– হ্যাঁ হ্যাঁ! তা তো দেবেই! তোমারই তো জোর! তোমার ভাই লীগের সাধারণ সম্পাদক! আমিতো রাজনীতি ছেড়ে দিয়েছি। দুচারটে খবরকাগজে হেডলাইন তো আমাকে নিয়েও হওয়া উচিত বলো? বউয়ের টানে রাজনীতি ছাড়লো শান্ত। ওয়াহ!
শার্লি ঠোঁট চেপে হাসলো। আচলের আড়ালে হাতে থাকা বক্সটা শান্তর ল্যাপটপের ওপর রাখতেই কপাল কুচকে তাকালো শান্ত। ভ্রু নাচিয়ে শুধালো, থার্মোমিটার সদৃশ বস্তুটা বক্সে করে তার সামনে দেওয়ার কি কারন? শার্লি অল্পবিস্তর লজ্জা পেয়ে মাথা নোয়ালো। একদমই নিচু আওয়াজে বললো,
– আপনার ভালোবাসায় ভাগ বসাতে আরেকজন আসছে।
শান্ত কিছু না বুঝে সেকেন্ড পাঁচেক তাকিয়ে রইলো শার্লির দিকে। পরপরই ‘বাবা হচ্ছে’ ব্যাপারটা বুঝে উঠতেই ঝলমলিয়ে ওঠে ওর চোখ। ল্যাপটপ নামিয়ে বিছানা ছেড়ে দ্রুততার সাথে উঠে দাড়ালো শান্ত। জাপটে জড়িয়ে ধরলো শার্লিকে। ওর গালে, চুলে চুমু দিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,
– থ্যাংকিউ সো মাচ শার্লি। সবকিছুর জন্য থ্যাংকিউ।
স্বামীর বুকে মাথা রেখে দুফোটা অশ্রুবিসর্জন দিলো শার্লি। সে অশ্রু সুখের। কিন্তু সে সুখ অবদি আসা ওর জন্য মোটেও সহজ ছিলো না। যদি না সাথের মানুষটা শান্ত হতো, হয়তো কখনো সেটা সম্ভবও হতো না। শার্লি এই মানুষটাকে দেখে আর অবাক হয়। ভালোবাসা নামক অনুভূতি ওকে একসময় এক রাগী পুরুষকে দেখতে বাধ্য করেছিলো। যার রাগ দেখে, কি করে সামলাবে ভেবে ভেবে ক্ষণেক্ষণে ওকে হতাশ হতে হতো। আজ জীবনও ওকে এক রাগী পুরুষ উপহার দিয়েছে। তবে তাকে সামলাতে হয় না। পুরো দুনিয়ার সাথে লড়াই করে, এক মহাবিশ্ব রাগের কারন মাথায় বয়ে এনে, সে ঘরে এসে মিষ্টি করে বলবে, ‘তোমায় দেখলে আমার সমস্ত রাগ উবে যায় শার্লি।’
যতোটা অভিযোগ নিয়ে শার্লি ঢাকা ছেড়েছিলো, সৃষ্টিকর্তা তার কয়েকসহস্রগুন সুন্দর উপহারে ওর জীবন মুড়িয়ে দিয়েছে। বছরদেড়েক আগে পড়াশোনা ছেড়েছুড়ে বাড়ি আসার পর ও যে মা, বাবা, ভাই, সবার চিন্তার কারন হয়ে উঠেছিলো, তা বুঝতে বেগ পেতে হয়নি শার্লিকে। কারো তোয়াক্কা না করে অনেকটা সময় নিজেকে ঘরবন্দি করে রেখেছিলো ও। ঠিক তখনই ভাইয়ের বন্ধু হিসেবে শান্ত আরেকদফায় ওর জীবনে আসে। একদম হুট করেই বিয়ের প্রস্তাবও পাঠায়। শার্লির পরিবারের কারো এ সম্পর্কে অমত ছিলো না। সবাইমিলে রাজি হওয়ার জন্য বোঝাতে থাকে ওকে।
জেদ করতে চেয়েছিলো শার্লি। কিন্তু সময় আর জীবনের তাগিদে একসময় বুঝতে পারে, এভাবে জীবনকে থামিয়ে দিলে চলবে না। তুল্য যদি অন্যকাউকে জীবনে এনে সুখী হতে পারে, ও কেনো নয়? অনেককষ্টে নিজেকে বুঝিয়ে জীবনকে দ্বিতীয় সুযোগ দিয়েছিলো ও, বিয়েতে রাজি হয়ে গিয়ে। রুমনকে জানিয়েছিলো। আসেনি সে। আর তাথৈয়ের সাথে যোগাযোগই পারেনি। শুনেছে শান্ত নাকি তাশদীদকে অনেক অনুনয় করেছিলো। ব্যস্ততা দেখিয়েছে সেও। শুরুতেই শান্ত শার্লিকে জানিয়ে দিয়েছিলো, তুল্য আর ওর ব্যাপারে ও সবটাই জানে, এবং তাতে ওর কোনো সমস্যা নেই। স্বামী হিসেবে সবরকমের দায়িত্ব পালন করেছে শান্ত। শার্লির ইচ্ছা ছিলো ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ের। শান্ত সেখানেও ওর পাশে ছিলো। শার্লির গ্লানিবোধ ছিলো। তাই একসময় এসে ওউ চায়নি, শান্ত তার স্বামীর অধিকার থেকে বঞ্চিত হোক, ওর গ্লানি আরো বাড়ুক। শান্তর পাশে থাকা আর শার্লির নিজের সাথে অদৃশ্য যুদ্ধজয়, এই দুয়ের পরিনামই আজ এই সাজানো গোছানো সংসার৷ শার্লি আর ঘুরে তাকায় নি। তাকাতে চায় না। যার জীবন স্বয়ং ওপরওয়ালা এতো যত্নে গুছিয়েছে, তার কেনো অন্যত্র তাকাতে হবে? ব্যস আফসোস একজায়গাতেই। ওর জীবনে তাথৈ নেই। কারো জীবনে তাথৈ নেই!
ডোরবেলের আওয়াজ শুনে ধ্যান ভাঙে শার্লির। চোখের কোনা মুছলো ও। শান্তও ওকে ছেড়ে নাক টানলো। হয়তো কাদছিলো ওউ। শার্লি ওর চোখ মুছে দিতে গেলে শান্ত নিজেই হাতেরপিঠে চোখ মুছতে মুছতে বললো,
– দুটো ওয়াল পেইন্টিং অর্ডার করেছিলাম। ওটাই কিনা দেখোতো!
শার্লি বুঝলো সে লোক তার কান্না লুকাছে। নিজেকে সামলে, শাড়ি ঠিকঠাক করে এগোলো দরজায়। দরজা খুলতেই বুঝলো কুরিয়ার থেকে লোক এসেছে। লোকটা হাতের কাগজ পড়ে বললো,
– মিস্টার এন্ড মিসেস শান্ত?
– জ্বী। আমি মিসেস শান্ত।
– ম্যাম একটা এনভেলপ এসেছে আপনাদের জন্য। কাইন্ডলি আপনার এনআইডি দিয়ে সহয়তা করুন।
অবাক হলো না শার্লি। ওর ডিজাইনিংয়ের অর্ডারগুলো এভাবেই আসে। তবে কোনো খামই শান্তর নামে আসে না। সাতপাঁচ না ভেবে মাথা নেড়ে ভেতরে চলে আসে ও। আইডি নিয়ে এসে লোককে দেখিয়ে খামটা নিলো। তাকে বিদায় দিয়ে রুমে ঢুকতে ঢুকতে ছিড়লো খামটা। শান্ত তখন টিস্যুতে নাক মুছছে আর কলে কথা বলছে। শার্লিকে দেখে কান থেকে ফোন নামিয়ে বললো,
– অফডে তেও অর্ডার?
শার্লি কিছু বললো না। খাম খুললো ও। ভেতরের কাগজের ওপরপিঠ দেখেই বুকটা ধক করে ওঠে ওর। চোখ ভরে ওঠে অজানা অনুভূতিতে। ভাজ পরে কপালে। অস্ফুটস্বরে মুখ দিয়ে বেরোয়,
– আলো…
শান্ত তৎক্ষনাৎ এগোলো। শার্লির চোখে জল টলমল করছে। কাঁপাকাপা হাতে কাগজের ভাজ খুললো ও। চিঠিটাতে থাকা একটা একটা বাক্য পড়তে গিয়ে শিউরে ওঠে। গায়ের জোর নেতিয়ে আসতে থাকে। জল গরাতে থাকে দুচোখ বেয়ে। চিঠি পড়ে শান্ত নিজেও বিমূঢ়। শক্ত করে দুহাতের মাঝে শার্লিকে ধরে রাখলো ও।
•
পড়া শেষ হতেই হাতের কাগজটা পরে যায় রুমনের। জলে ভরে ওঠা চোখ থেকে টুপ করে জল গরিয়েই পরে এবারে। হতবিহ্বলের মতো ফ্লোরে পরে থাকা কাগজটার দিকে তাকিয়ে রইলো রুমন। কি ভেবে হুমড়ে বসে পরলো মেঝেতে। কাগজটা হাতে নিয়ে সেটার উল্টোপিঠ দেখলো। পরে আশপাশ হাতড়ে বের করলো চিঠি বয়ে আনা খামটা। পুনরায় পড়লো তার ঠিকানা। চিঠির উদ্দেশ্য স্থির, এটা বুঝে আসতেই মাথায় হাত দিয়ে সোফায় হেলান দিয়ে বসে পরলো রুমন। কাদতে থাকে খেলনা হারানো শিশুর মতো করে। অনেকটা সময় এলোমেলোভাবে কান্নার পর ফোন হাতে নিলো ও। কল লাগালো নির্দিষ্ট নম্বরে। রিসিভ হলে, নাক টেনে ইংরেজীতে বললো,
– স্যার আমার একটু আগে বাংলাদেশে ফেরাটা জরুরি। আমি কি প্রথম ব্যাচের সাথে সকালের ফ্লাইটটায় যেতে পারি?
ওপাশ থেকে হ্যাঁ সূচক জবাব আসে। বিনয়ের সাথে ধন্যবাদ দিয়ে কল কাটলো রুমন। অতঃপর আবারো তাকালো হাতে থাকা চিঠিটার দিকে। এই ভিনদেশে ভীনদেশীদের ভিন্নধারার নিজেকে আবদ্ধ করে নিজের জীবনের পুরো একটা বছরকে গলা টিপে মেরে দিয়েছে ও। তবে এ একটা বছর ওর জীবন থেকে কেবল সময় কাড়েনি। এ এক বছর ওর থেকে কেড়ে নিয়েছে ওর সমস্ত ভালো থাকার উৎসকে। বাবার জোরাজুরিতে দেশ ছেড়ে ও ক্যারিয়ার গুছিয়েছে ঠিকই, কিন্তু তাতে বলি হয়ে গেছে জীবনের সবচেয়ে মুল্যবান জিনিসটাই। বন্ধুত্ব। শার্লির সাথে যোগাযোগ থাকলেও তাথৈকে কোনোভাবেই খুঁজে পায়নি রুমন। নিজের দিক থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে চেষ্টা করেও লাভ হয়নি। হতোই বা কি করে? ও নিজেই তো দেশে নেই। আজ এতোগুলো দিন পর যখন ওর দেশে ফেরার সময় এসেছে, সুযোগ এসেছে, ঠিক সে সময় দোরগোড়ায় এসে পৌছালো আলোর চিঠিটা। পায়ের কেডসজোড়া খুলে এলোমেলোভাবে মেঝেতে পরে রইলো রুমন। পৃথিবীর এ প্রান্তে সূর্য ডুববে বলে পশ্চিমে হেলতে শুরু করছে। রাজকীয় হোটেলটার স্বচ্ছ জানালা দিয়ে তার রক্তিম আভা দেখা যায়। রুমনের ফোন বাজে। মায়ের নাম দেখেও কল রিসিভ করলো না ও। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো বাইরে।
•
– এন্ড দ্য এওয়ার্ড গোজ টু, মিস্টার তাশদীদ ওয়াসীর *** ইউনিভার্সিটি, সেশন ***, ফর হিজ আউটস্ট্যান্ডিং মোডিফিকেশন অন বায়োলুমিন্যান্ট এন্ড নন-বায়োলুমিন্যান্ট প্লান্ট এন্ড ওর্গানিজমস্।
দর্শকশ্রোতায় ভরপুর জায়গাটা তাশদীদের নামে মুখোরিত হয়। করতালিতে ছেয়ে যায় অডিটোরিয়াম। কিন্তু যার নামে এতো উদ্দীপনা, তার দেখা নেই। আরো একবার উপস্থাপক নাম নিলেন তাশদীদের। সময় গরালেও, দেখা মেলে না তার। সবার চোখেমুখে বিস্ময়, আকুলতা। দেশসেরা বিজ্ঞানীর হাত থেকে স্বর্ণপদক সম্মাননা নেওয়ার দিনটাতে কেউ কিকরে অনুপস্থিত থাকতে পারে? মঞ্চে বিভিন্ন গণ্যমান্য ব্যক্তি অপেক্ষারত। উপস্থাপকের সহযোগী এসে তার কানে ফিসফিসিয়ে কিছু বললেন। সহযোগীর কথা শুনে ভদ্রলোক মৃদ্যু হাসলেন। পুনরায় মাইকের সামনে দাড়িয়ে বললেন,
– সরি সরি। আই হ্যাড আ মিস্টেক। আসলে এটা জয়েন্ট এক্সপেরিমেন্ট ছিলো। সো দ্য এওয়ার্ড গোজ টু মিস্টার তাশদীদ ওয়াসীর এন্ড মিস তাথৈ আলফেজ ফর দেয়ার এক্সট্রাওর্ডিনারী মোডিফিকেশন অন বায়োলুমিন্যান্ট এন্ড নন বায়োলুমিন্যান্ট প্লান্ট এন্ড অগানিজমস্। হিউজ রাউন্ড অফ আপ্লোজ ফর দেম প্লিজ!
হাতের ফোনটা বন্ধ করে ফেললো তাশদীদ। দুহাতের কনুই হাটুতে ঠেকিয়ে, চোখ বন্ধ করে রইলো দু দন্ড। ভেতরটা চুরমার হয়ে আসলেও বাইরটা স্তব্ধ। বাহিরকে সামলে তাশদীদের ভেতরটা দামামা বাজিয়ে বলছে, ‘আমায় এতোবড় শাস্তি না দিলেও পারতে তাথৈ।’ ওর বন্ধ চোখের সামনে তখন দেড়বছর আগের দৃশ্যপট। শেষবারের দেখায় তাথৈয়ের প্রতিচ্ছবি আর একবুক আকুলতা নিয়ে দাড়ানো ও। তাশদীদের মন, মস্তিষ্ক, মুখে অস্থিরচিত্ত্বের প্রশ্ন, ‘আমার হয়ে যাও তাথৈ।’ আর তাথৈয়ের সুস্পষ্ট জবাব,
– আমি তোমার হতে চাইনা তাশদীদ। ইনফ্যাক্ট আমি কারোর হতে চাইনা। আমার কেবল মুক্তি চাই। সবকিছু থেকে মুক্তি চাই।
তাশদীদ মুষড়ে যায়৷ একপা পিছিয়ে টেবিল ধরে নিজেকে সামলালো ও। অথচ তাথৈ শক্ত হয়ে দাড়িয়ে। গলায় দিয়ে বেরোতে না চাওয়া আওয়াজের ওপর জোর খাটালো তাশদীদ। অবিশ্বাসী চেয়ে কোনোমতে বললো,
– এটা তোমার মনের কথা না।
– তাথৈ আলফেজের মনই নেই। ইউ শ্যুড নো দ্যাট। তুমি আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিও না। লেট মি গো।
– তুমি আমাকে ভালোবাসো তাথৈ।
– ইউ আর ওয়েস্টিং মাই টাইম।
তাশদীদ নিজেই অধৈর্য্য হয়ে পরলো এবারে। কান্ডজ্ঞান হারিয়ে, তাথৈয়ের একহাতের কনুইয়ের ওপরদিকটা চেপে ধরলো ও। বললো,
– না তুমি ভালোবাসো আমাকে! তুমিও আমাকে ভালোবাসো। কেনো স্বীকার করছো না তাথৈ? কেনো বলছো না তুমিও আমার হতে চাও। সে ইট না? সে ইট!
– আই সেইড হোয়াট আই সেইড! আর তোমার এইসব ভালোবাসা বাসির ন্যাকামো আমার অসহ্য লাগছে, বিরক্ত লাগছে তাশদীদ। এসব শেষ করো, এন্ড লেট মি গো। এখানে বসেবসে তোমার প্রেম নিবেদন শোনার সময় আমার নেই।
তাছাড়া তুমি কি এক্সপেক্ট করছো? কি একটা উপকার করেছি বলে তার মানে সামহাও আমি তোমাকে ভালোবাসতে পারি? তৈয়ব আলফেজের কোটি কোটি টাকার উত্তরসূরী হয়ে আমি তোমার মতো একটা নগন্য ছেলের প্রোপোজালে রাজি হয়ে যাবো? অম্বুনীড়ের মতো রাজপ্রাসাদে বড় হয়ে আমি তোমার ওই টিনের চালের প্রীতিকার্নিশে এসে মাথা ঠুকবো তাশদীদ? রিয়েলী?
হাত ছাড়িয়ে নেয় তাথৈ। তাশদীদ বিমুঢ় হয়ে পরে। উদ্ভ্রান্তের মতো নিচে এদিক ওদিক চায়। কয়েকমুহুর্ত সময় নিয়ে দম নেয় একটা। অতঃপর চোয়াল শক্ত করে এগিয়ে যায় দরজার দিকে। দরজা খুলে দিয়ে, সেখানে দাড়িয়ে তাথৈকে বললো,
– চলে যাও!
…
– দ্বিতীয়বার তাশদীদ ওয়াসীর নামক এই নগন্য মানবের তোমার মুখোমুখি হবে না তাথৈ আলফেজ। ওর ভালোবাসা বাসিও শুনে বিরক্ত হতে হবে না তোমাকে। নাইবা টিনের চালের ওই প্রীতিকার্নিশকে কখনো স্মরন করতে হবে। তুমি বরং নিজের রাজপ্রাসাদে ফিরে যাও। দুয়া করি, সর্বাবস্থায় ভালো থাকো। সব চাওয়া পেয়ে সুখী হও।
প্রতিত্তরে আর টু শব্দটাও করেনি তাথৈ। ঝড়, রাতের আধার উভয়ই কেটে যাওয়ায় অসুস্থ শরীর নিয়েই তখনতখন বেরিয়ে যায় ল্যাব থেকে। নিরবে, নিভৃতে।
কল বাজতেই চোখ মেললো তাশদীদ। নম্বর দেখে, কল রিসিভ করলো। করিডোরে দাড়িয়ে কথা বলা শেষ করলো ও। এরইমাঝে কানে আসে,
– কনগ্রাচুলেশনস স্যার!
তাশদীদ পেছন ফিরলো। খয়েরী রঙের লম্বা টিশার্ট, জিন্স পরিহিত এক রমনী হাতে একটা লাল গোলাপ নিয়ে হাসিমুখে দাড়ানো। তাশদীদ মোবাইল স্ক্রলিংয়ে চোখ রেখে বললো,
– ল্যাবওয়ার্ক মিটেছে?
– অনেক ভালোভাবে। দেশের এমন নামকরা বিজ্ঞানী, মেডেলিস্ট যাকে বলে, সে আমাকে ল্যাবওয়ার্কে হেল্প করবে আর তা মিটবে না, তা কি করে হয় বলুন? উই গট দ্য রেজাল্ট।
তাশদীদ কিছু বললো না। মেয়েটা কিছুক্ষণ চুপচাপ দেখলো এই কোনোদিক না তাকানো মানুষটার দিকে। ওর চোখজুড়ে তৃষ্ণা। তাশদীদের চোখের পাল্টা চাওনি না পেয়ে হয়তো মনেমনে হতাশ হলো মেয়েটা। হাতের ফুলটা এগিয়ে দিয়ে বললো,
– ফুলটা নেবেন না?
তাশদীদ একবার ফুলটা দেখে ওর দিকে তাকালো। কিছু বলার আগেই ভিডিও কল আসে তাশদীদের ফোনে। জোরপুর্বক ঠোঁটে হাসি ফোটায় ও। ওর হাসিতে মেয়েটা একদফা শীতল হাওয়া অনুভব করে যেনো। সাথে অবাকও হলো। লোকমুখে কতো শুনেছে, এই মানুষটার মতো হাসিখুশি মানুষ নাকি আর দুটো নেই। অথচ এখানে আসার পর একদিনের জন্যও তাশদীদকে হাসতে দেখেনি ও। কাজ আর পড়ার বাইরে একটা কথাও বলেনা সে কারোর সাথে। আজকে সম্মাননা পাওয়ার অনুষ্ঠানে অবদি যায়নি সে। সেই তাশদীদ হাসছে দেখে কলদাতা কে জানার আগ্রহ জন্মে ওর মনে। তাশদীদ কল রিসিভ করতেই ফোনের স্ক্রিনে ভেসে ওঠে এক ফুটফুটে চেহারা। তাশদীদ মেয়েটাকে আদুরে গলায় বললো,
– এইত্তো আমি মা! কাদছো কেনো তুমি? আমি আসছি তো! বাবাই পাঁচ মিনিটের মধ্যে প্রীতিকার্নিশ চলে আসবে। এসে এত্তোগুলো হামি দেবে তোমাকে। তুমি আর কান্না করবে না ওকে? ওকে???
আরো অনেক আদুরে কথায় কথা শেষ করে তাশদীদ। ওরদিক বড়বড় চোখে চেয়ে রয় মেয়েটা। নিজের এতোবড় অসেচনতা মানতে চায় না ও। সে প্রশ্নগুলো নিয়ে ঠায় রয়, যেগুলো হয়তো ওর আগে জানার চেষ্টা করা উচিত ছিলো। তাশদীদ বিবাহিত? ওই গহীন চোখজোড়ার অধিকারীর ওপর অন্যকারো অধিকার আছে তবে? এতোগুলো দিন হলো ও যার লোভ করে চলেছে, সে সুপুরুষ অন্য নারীর আচ্ছাদন? এ কথাগুলো কি করে জানলো না ও? কি করে তাশদীদের নামে এতোটাই মত্ত্ব হয়ে গেলো যে ওর নাম অন্য কোনো নারীর উপনাম কিনা তা জানতে চাওয়াটাই ভুলে গেলো ও? এখন অনুভূতির সাগরের এতোদুর এসে, কুলকিনারা হারিয়ে, এই নির্মম সত্য শুনতে হবে ওকে? মেয়েটার মন মানতে চায় না৷ অস্থিরচিত্ত্বে ও তাশদীদকে প্রশ্ন করে বসে,
– বাচ্চাটা…বাচ্চাটা কে স্যার?
ফোন পকেটে পোরে তাশদীদ। সহজাত ভঙিতে জবাব দেয়,
– আমার মেয়ে।
#চলবে…