কার্নিশ_ছোঁয়া_অলকমেঘ পর্ব-১৬+১৭+১৮

0
359

#কার্নিশ_ছোঁয়া_অলকমেঘ
লেখনীতে: মিথিলা মাশরেকা

১৬.

নভেম্বরের বৃষ্টিভেজা ক্যাম্পাস। পুরোটা সকাল ঝুমঝুমিয়ে থেকে, কিছুক্ষন আগে বৃষ্টি থেমেছে। তবে আকাশ এখনো মেঘলা। গুমোট ভাবটা পুরোপুরিভাবে কাটেনি। সবুজ ঘাসের ডগায় লেগে আছে পানিকণা। তাথৈ এপ্রোনের পকেটে হাত দিয়ে একধ্যানে বাইরে তাকিয়ে আছে। আজকে ল্যাবওয়ার্ক আছে ওদের। ক্লাসের বেশিরভাগ আড্ডায় ব্যস্ত। আলো একপাশে দাড়িয়ে ফাইলে কিছু লিখছে। তুল্য এককোনে হাইবেঞ্চে বসে। দাঁতে ম্যাচের কাঠি ধরে রেখে শার্লিকে দেখছে ও। শার্লি ল্যাবের একটা একটা জিনিস হাতে নিচ্ছে, বিজ্ঞের মতো পরখ করছে, আবার রেখে দিচ্ছে। তুল্য অপেক্ষায় আছে, কখন শার্লি একটা কিছু নষ্ট করবে, আর ও গিয়ে এ নিয়ে ঝামেলা করবে। ল্যাবের সহকারী খবরকাগজ থেকে চোখ তুললেন। চশমার ওপর দিয়ে তাকিয়ে, পুরো ক্লাসের উদ্দেশ্যে বললেন,

– মলিকিউলার ল্যাবে এসেছেন। একটু সতর্কতা মেনে চলুন কেমন?

ক্লাসের কেউ কিছু না বললেও কথাটা শার্লির গায়ে লাগলো। স্কেল হাতে ছিলো ওর। এগিয়ে এসে ওটা কাধে ঠেকালো ও। পঞ্চাশোর্ধ ভদ্রলোকের সামনে বেশ ভাব নিয়ে বললো,

– কি মশাই? কথাটা কি আমাকে বললেন? টাকে নতুন চুল গজিয়েছে নাকি? হু?

শার্লির এ হেন আচরনে লোকটা থতমত খেয়ে যায়। আলো মাথা নেড়ে নিজের কাজে মন দিলো। তুল্য একপাশ থেকে উচু গলায় বললো,

– হোই তাথৈ? তোর বন্ধুরুপী বান্ধবীকে সামলাবি? নাকি আমি দায়িত্ব নেবো?

আলো তুল্যর দিকে চোখ তুলে তাকালো। শার্লি হচকিয়ে যায়। দুপা পিছিয়ে গুটিয়ে দাড়ায়। এই ছেলেটাকে দেখে শুরু থেকেই ভয় ওর। কিন্তু ইদানীং ওর ভয়ের ধরন বদলেছে। খালি মনে হয়, তুল্য কেমন একটা অদ্ভুতভাবে কথা বলে ওর সাথে। তাথৈ পকেট থেকে ফোন বের করলো। ক্লাস শুরু হবার কথা ছিলো আরো দশমিনিট আগে। অথচ এখনো টিচার ক্লাসে আসেননি। বিরক্তি নিয়ে ব্যাগের কাছে গেলো ও। বই বের করলো পড়বে বলে। তখনই ম্যাম ক্লাসে ঢুকলেন। তার সাথে আরো একজন ছিলো। ডেনিম রঙের শার্টের ওপর সাদা এ্যাপ্রোন, সিনথেটিক মাস্ক, আর হাতে গ্লাভস পরিহিত পুরুষালি অবয়বকে দেখে কপালে ভাজ পরে বেশিরভাগেরই। ম্যাম বোর্ডে নক করে বেশ দ্রুততার সাথে বললেন,

– এটেনশন গাইস! আমার একটু জরুরি কাজ পরে গেছে। আনফরচুনেটলি, তোমাদের এই প্রোজেক্টটা আমি নিতে পারছি না।

তাথৈ প্রচন্ড বিরক্ত হয়। বুকে হাত গুজে অন্যদিকে তাকালো ও। প্রোজেক্ট না নিলে একাডেমিক পিছিয়ে যাওয়ার সম্ভবনা থাকে। যেটা ও মোটেও চাইছে না। ওর তো গ্রাজুয়েশন শেষ করা চাই। যতো দ্রুত সম্ভব! তুল্য টিচারকে ঢুকতে দেখে ম্যাচের কাঠি ফেলে না দিয়ে, পুরোটাই মুখে নিয়ে নিয়েছিলো। কিন্তু তার কথা আবারো গা ছাড়া হয়ে যায় ও। আলো ধীর আওয়াজে বললো,

– ম্যাম প্রোজেক্টটা তাহলে কবে নাগাদ কন্টিনিউ করবেন?

– ওকে৷ লেট মি এক্সপ্লেইন। আমি বলেছি প্রোজেক্ট আমি নিতে পারছি না। তারমানে এই না যে প্রোজেক্টটা পেন্ডিং থাকবে। তোমরা রিয়্যাকশন চেক করতে থাকো। শুধু অবসার্ভেশনে আমি থাকবো না। ও থাকবে।

সবাই তার পাশের ছেলেটার দিকে তাকালো। ছেলেটা নিজের চেহারা দেখাচ্ছে না। ফলশ্রুতিতে সবার আগ্রহ বাড়ছে। টিচার বললেন,

– ও তোমাদের সিনিয়র ব্যাচের। তোমরা তো কোর্স কন্টেন্ট মেনে, মার্কসের জন্য ল্যাব করছো। ও এগুলো অবসার্ভ করবে৷ মোডিফিকেশন নিয়ে ওর…

ছেলেটা থামিয়ে দিলো তাকে৷ ম্যাম জানালেন, তার রিপোর্ট, আর ওদের প্রোজেক্টে নাকি মিল আছে। তাই প্রোজেক্ট অবসার্ভেশনে সে থাকছে। এমনটা প্রতিনিয়ত হয়। তবে ছেলেটা পরিচয় দিলো না। পরিপুর্ণ রিপোর্ট তৈরীর পর নাকি পরিচয় দেবে সে। ম্যাম সবটা গুছিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। নতুন অবসার্ভেটরকে নিয়ে আশেপাশে গুনগুন শুনলেও, তাথৈ গুরুত্ব দিলোনা। ওর কাছে শুধুমাত্র নম্বর বিবেচ্য বিষয়। মোডিফিকেশন রিয়্যাকশন না। ছেলেটা আগে মাল্টিমিডিয়ায় কিছু বিষয় দেখালো। তারপর ক্লাসকে চারটে গ্রুপে ভাগ করে কাজ বলে দিলো। পুরোদমে কাজে লেগে যায় সবাই। আলো, তুল্য ওদের দল নিয়ে ছিলো। তাথৈ ওর নমুনা পরখ করতে করতে শার্লিকে বললো,

– অক্সিডিটি চেইক আমাদের সিলেবাসে নেই। তাহলে ল্যাবে এটা কেনো করানো হচ্ছে? বুঝলামনা।

– নমুনা প্রাণীতে সাইটোক্রোম অক্সিডেস এনজাইম আছে কি নেই, সেটা অক্সিডেস পজিটিভ প্রজাতি নাকি অক্সিডেস নেগেটিভ, এইটুক না জানলে প্রোজেক্ট এগোতে পারবেন না ম্যাডাম।

তাথৈয়ের একদম পাশ এসে বললো ছেলেটা। তাথৈ কিছুটা অবাকচোখে তাকায় তার দিকে। এই গলার স্বরটা ওর চেনা। চেহারা চিনতে ছেলেটার মাস্কের দিকে তাকিয়ে রইলো ও। ছেলেটা টেবিলের ওপরপ্রান্তে থাকা বিকার নিতে নিতে বললো,

– তোমার সমস্যা কোথায়? সবসময় নজরটা আমার ঠোঁটের দিকেই কেনো থাকে?

তাশদীদের কথা শুনে তাথৈ বিস্ফোরিত চোখে চায়। ছেলেটা তাশদীদদ, টের পেয়ে হাতে থাকা কাচের ছোট্ট পিপেটটা শক্তমুঠো করে নেয় ও৷ এতটাই জোরে যে, ওটা ভেঙে ওর হাতে ঢুকে পরে। তাথৈ সেদিকে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ না দিলো মা। কড়া গলায় বললো,

– তাশদীদ ওয়াসীর।

তাশদীদের হাত থামে। তাথৈয়ের দিকে ফেরে ও। আশেপাশে তাকিয়ে দেখে শার্লি ব্যতিত সবাই নিজের মতো ব্যস্ত। ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে ও একহাত বুকে গুজলো। আরেকহাত সেহাতে ঠেকিয়ে, থুতনির কাছে নিলো। তারপর তাথৈয়ের দিকে ঝুকে, ফিসফিসিয়ে বললো,

– তোমার সৌভাগ্যবশত, হ্যাঁ।

সের্ফ এটুক বলে তাশদীদ সরে দাড়ায়৷ অন্য গ্রুপের কাজকর্ম চেক দিতে চলে যায় ও। তাথৈ চোখ বন্ধ করে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে৷ পুরো ইউনিভার্সিটিতে আর কেউ ছিলো না? বেছেবেছে এর রিপোর্টটাই কেনো ওদের প্রোজেক্টের সাথে মিলতে হবে? প্রোজেক্টটা আট সপ্তাহ চলবে। আর প্রতি সপ্তাহে একটা করে ল্যাবক্লাস। সে হিসেবে, মোট আটটা ক্লাস তাশদীদকে সহ্য করতে হবে ওকে! শার্লি শুনেছে সবটাই। শার্টের কলারের ভাজ ঠিক করতে করতে ও হেসে বললো,

– ছেলেদের দিক তাকিয়ে থুতু ফেললেও ওরা ভাবে মেয়েটা আমাকে পছন্দ করে। আর তুইতো মাস্কের নিচের ঠোঁটের দিকে তাকিয়েছিস!

তাথৈ অগ্নিচক্ষু করে তাকালো ওর দিকে। ওর দৃষ্টি দেখেই গলা ঝেরে, নিজের কাজে মন দিলো শার্লি। তাথৈ হাতের ভাঙা কাচ পাশের বিনে ফেলে টিস্যু মুঠো করে নেয়। সব রাগ এবার ওর নিজের ওপর এসে পরছে। বাকিদের মতো তাশদীদকে না চিনতে পারলেই ভালো হতো। আর যাই হোক, ক্লাস চলাকানীন, মেজাজটা তুঙ্গে থাকতো না ওর। একধ্যানে মাইক্রোস্কোপের দিকে তাকিয়ে রইলো তাথৈ। সত্যিই তাশদীদকে চেনে ও। খুব সহজে ল্যাবের নম্বর হাতে পাবে বলে ওর মনে হচ্ছে না।

ক্লাসে ঘন্টাখানেক দেরি আছে। তাথৈ বেরিয়েছে। এ ফাকে ল্যাবের পিপেট কিনতে যাবে ও। ল্যাবে যে ওটা ভেঙেছে, সেটা কারো চোখে পরেনি। শার্লি ক্যান্টিনে বসেছে দুপুরের খাওয়া খেতে। কার্জন পেরিয়ে কিছুটা এগোতেই এক মহিলা তাথৈয়ের সামনে এসে দাড়ায়। বাধ্য হয়ে দাড়িয়ে চোখ তুলে তাকালো ও। কিন্তু সামনেরজনকে দেখে কিছুটা থমকে যায়। পাঁচফুট চার উচ্চতার ভদ্রমহিলার পরনে জলপাই রঙের সিল্কের শাড়ী। বড়গলার সরুহাতা ব্লাউজ, গলায় ডিজাইনার নেকলেস, হাতে এ্যান্টিকের চুড়ি, মাঝসিথি করে খোপা করা চুল। বাহাতে হ্যান্ডব্যাগ আর ডানহাতে খুব পরিপাটিভাবে অবাধ্য আঁচল ধরে রাখা মহিলাকে দেখে কেউ বলবে না, তার বয়স চল্লিশোর্ধ্ব। চেহারা, সাজগোজে নেই বয়সের রেশ। যা আছে, তাকে স্মার্টনেস-ই বলে। ভদ্রমহিলা তাথৈকে আপাদমস্তক দেখে নিলো। কিছুটা বিস্ময়ে বললো,

– বাইশ বছর! সময় কতো দ্রুত চলে যায়!

তাথৈয়ের চোখ ছলছল করে ওঠে। জীবনে প্রথমবারের মতো বুকফাটা কান্নারা ‘মা!’ আওয়াজ করে বেরিয়ে আসতে চায়। যে মাকে ছোঁয়ার কোনো স্মৃতি নেই ওর কাছে। ছবিতে যার চেহারা চিনেছে ও। যে মায়ের সঙ্গ বলতে পেয়েছে কেবল তার গর্ভজাত হওয়ার সময়টুকুন, সেই মা আজ ওর সামনে। ভদ্রমহিলা মৃদ্যু হেসে আরেকপা এগোলো তাথৈয়ের দিকে। ওর গালে হাত রেখে বললো,

– কেমন আছো বেইবি? মমিকে চিনতে পেরেছো? হুম?

তাথৈ কেবল বিস্ময়ে তাকিয়ে রয়। যদিও কল্পনায় ওর বসবাস নেই। তবুও ওর মনের কোনে এক ক্ষীণ ধারনা ছিলো। কখনো ওর মা ফিরে আসলে, সবারআগে ওকে জাপটে জরিয়ে ধরবে, গালেমুখে পাগলের মতো চুমু দেবে, আদরে আদরে ভরিয়ে দেবে ওকে। কিন্তু এখানে ঠিক তার উল্টো ঘটছে। ভদ্রমহিলা তাথৈয়ের গাল থেকে হাত নামালেন। আবারো আঁচলটা তেমন পরিপাটি করে দাড়িয়ে বললেন,

– লান্ডান থেকে গতকালই ফিরেছি। এসেই তোমার ছবি, ইনফো জোগাড় করেছি। সি! চলে এসেছি তোমার সাথে দেখা করতে! কত্তো বড় হয়ে গেছো তুমি! সো হ্যাপি টু সি ইউ!

– কিন্তু আপনাকে দেখে ও মোটেও খুশি না ম্যাডাম। বিনা দাওয়াতে চলে আসা আগুন্তকের আগমনে কেই বা সুখী হয় বলুন?

তাথৈ পাশে তাকায়। ওর ঠিক পাশ থেকে জবাব দেয় তুল্য। প্যান্টের পকেটে হাত গুজে একদম স্বাভাবিক হয়ে দাড়িয়ে আছে ও। এতোগুলো বছর পর নিজের মাকে দেখার কোনো উত্তেজনা ওর মাঝে নেই। ভদ্রমহিলা একটু সময় নিয়ে তুল্যকেও চিনে ফেললেন। হাসিমুখে বললেন,

– তুল্য? ওহ বেটা! কেমন আছো মাই সন? মমি…

– এক্সকিউজ মি ম্যাডাম। বেটা, বেটি, বেইবি, নিজের এইসব লেইম ডাকগুলো নিজের কাছেই রাখুন। আমি কোনো বেটা নই আপনার। আ’ম তুল্য আলফেজ।

তুল্যর জবাব শুনে ভদ্রমহিলা দমে যায়। হাসি কমে আসলেও আবারো জোরালো হাসে সে। বলে,

– আই নো বেটা, মমির ওপর অনেক অভিমান তোমাদের। বাট হোয়াট আই ডিড, ওয়াজ এবসুলেটলি…

– আপনি কি করেছেন, কেনো করেছেন, তার কোনো কৈফিয়র আমাদের চাইনা ম্যাডাম। আর যেহেতু আপনার সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই, সেখানে আপনার অভিমানের তো প্রশ্নই ওঠেনা! ইউ মে লিভ!

– তুল্য, লুক! আমি তোমাদের…

মহিলা বলা শুরুর আগে একটা বিদেশী কুকুর এসে তাথৈয়ের পা শুকতে থাকে। তাথৈ নড়চড় না করে ওরদিক তাকিয়ে রইলো। তুল্য চড়া গলায় বললো,

– নিজের বাচ্চাকে ফেলে লন্ডন গিয়ে কুকুরের বাচ্চা পেলেছেন? তুলনা হয়না আপনার কোনো।

ভদ্রমহিলা বুঝলো, তুল্য তার বিপরীতেই বলবে। ওকে বোঝানো সহজ হবে না। তারচেয়ে নিরব থাকা তাথৈকে বোঝানো সহজ হবে হয়তো। উনি বেশ উদগ্রীব হয়ে বললেন,

– ত্ তাথৈ? দেখো বুজো তোমার আদর চাইছে! ও অনেক কিউট জানো! আমি…

– আমাদের না আপনার প্রতি ইন্টারেস্ট আছে, না এই বুজোর প্রতি। আপনার এই বিলেতী কুত্তারবাচ্চা কোলে তুলুন, আর দফা হন।

তুল্যর মুখে কুত্তারবাচা শব্দটা শুনে ভদ্রমহিলা আবারো দমে যান। দেশে ফিরে তৈয়ব আলফেজের নামডাক দেখে অনেকটাই অবাক হয়েছেন তিনি। যে টাকার জন্য স্বামী সন্তান ছেড়েছিলেন, সে স্বামী সন্তান এখন আলাদা আলাদা করে তারচেয়েও কয়েকগুন বেশি টাকার মালিক। প্রাক্তন স্বামীর কাছে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে নেই তার। শুধু চেয়েছিলেন ছেলেমেয়েদুটোর সাথে যোগাযোগ রাখতে। তাই ওদের খোজ নিয়ে দেখা করতে এসেছিলেন তিনি। কিন্তু তুল্যর ব্যবহারে তার প্রতি বিষাক্ততা স্পষ্ট। এদিকে তাথৈ নিরব। ওকে বুঝাতে পারবেন আন্দাজ করে ভদ্রমহিলা ধৈর্য্য রাখলেন। বুজো লেজ নাড়াতে নাড়াতে তাথৈয়ের পা ঘুরলো। তাথৈকে চুপ থাকতে দেখে তুল্য অবাক হয়। তাথৈ সহনশীলদের দলভুক্ত না। ক্ষমা করা, ক্ষমা চাওয়া, এসব ওর স্বভাব বহির্ভুত। তুল্যও চায় না, যে মা মাতৃত্বের চেয়ে টাকাকে বড় করে দেখেছে, সেই মা কে তাথৈ ক্ষমা করুক। তাথৈ অতি শান্তভাবে বললো,

– এটাকে সরাও। নয়তো আমিই ওকে সরানোর ব্যবস্থা করবো।

ওর জবাব শুনে ভদ্রমহিলা বিস্ফোরিত চোখে তাকায়। বিশ্বজয়ের হাসি দিলো তুল্য। সে হাসিতে গর্বও ছিলো। বোনকে চিনতে একবিন্দুও ভুল নেই ওর। এতোগুলো বছর যে মা ওদের কথা একবারো ভাবেনি, একটাবারো খোজ নেয়নি, একদিনে সামনে চলে আসলেই তাকে মেনে নেওয়ার মতো মেয়ে তাথৈ না৷ বুজো তখনো তাথৈয়ের পায়ের আশপাশ ঘুরছে আর ওর পা শুকছে৷ তাথৈ মায়ের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো। বললো,

– পরের দশসেকেন্ডে ও যদি আমার কাছ থেকে না সরে, আই সয়্যার আমি ওকে এমন জায়গায় সরাবো…বাইশবছর পর আমার খোজ তো পেয়ে গেলে। কিন্তু ওর খবর সারাজীবনেও পাবে না। ট্রাস্টমি!

ভদ্রমহিলা তাথৈয়ের এমন হিংস্র জবাব মোটেও আশা করেননি। ওমন আদুরে জীবটাকে নিয়ে কেউ এভাবে বলে, তার মন কতোটা পাথুরে হয়ে আছে, আন্দাজ হলো তার। দ্রুততার সাথে বুজোকে কোলে তুলে নিতে যাচ্ছিলেন উনি। কিন্তু বুজো ছুট লাগায়। মহিলা সেদিকে খেয়াল করার আগে তাথৈ একপা এগোলো। শক্ত গলায় বললো,

– নিজের সন্তানদের কথা তো ভাবোনি৷ এটলিস্ট এই কুকুরটাকে আগলে রাখো? যেভাবে আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলে, ওকে সেভাবে ছেড়ে দিও না। এন্ড ইয়েস, এটাও জেনে রাখো, আমার জীবনে তোমার কোনো দরকার নেই। কারোর দরকার নেই। তাথৈ আলফেজ ইজ এনাফ ফর হার! আ’ম, এনাফ ফর মি!

জোর গলায় বলে ভদ্রমহিলাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো তাথৈ। তিনি বিমুর্ত চোখে দেখলেন মেয়ের ঔদার্য। তুল্য তখনও ওখানে দাড়িয়ে। আয়েশের সাথে একটা সিগারেট ধরিয়েছে ও। ধোয়া ছেড়ে বললো,

– ভুল নম্বরে ডায়াল করেছেন ম্যাডাম। আপনার তাথৈ বেইবি একটু আলাদা। ওর লাইফে এইসব মমি-বেইবি নাটকের জায়গা নেই।

মহিলা আর একদন্ড দাড়ালেন না। এতোগুলো বছর পর নিজের সন্তানের মুখোমুখি হয়ে, তাকে এইভাবে অপমান হতে হবে, এমনটা ভাবেননি তিনি। বাঙালীরা বেশিই অনুভূতিপ্রবণ হয়। সে হিসেবে দুই ছেলেমেয়ে তাকে দেখে আবেগে পরবে, এমনটা আন্দাজ করেছিলেন তিনি। কিন্তু ঘটেছে তার উল্টোটাই। তিনি ছুটলেন বুজোকে খুজতে৷ তুল্য সিগারেট টানতে টানতে মায়ের চলে যাওয়া দেখলো। তাচ্ছিল্যে হেসে নিজেনিজেই বললো, ‘শাহরুখ ডায়লগটা ভুলই দিয়েছিলো। কিসমাত কুত্তি চিজ নেহি হ্যায়। কিসমাত, কুত্তো কা হি চিজ হ্যায়।’

#চলবে…

#কার্নিশ_ছোঁয়া_অলকমেঘ
লেখনীতে: মিথিলা মাশরেকা

১৭.

তাশদীদকে জীনপ্রকৌশলের এক শিক্ষকের কেবিন থেকে বেরোতে দেখে, করিডোরে দাড়িয়ে গেলো শান্ত। হাতে একটা নীল রঙের ফাইল নিয়ে, কেবিন থেকে বেরিয়ে আস্তেধীরে দরজাটা ভিড়িয়ে দিলো তাশদীদ। তবে সামনে শান্তকে দেখে থেমে গেলো ও। হাতের ফাইলটার দিক তাকিয়ে একটা ছোট্ট শ্বাস ফেললো। আর শান্ত উত্তোজিত হয়ে সামনে এগোলো। নেমপ্লেটে থাকা শিক্ষকের নামপরিচয় দেখে নিয়ে, বিস্ময়ে বললো,,

– তুই এখনো…

তাশদীদ শান্তর হাত ধরতে যায়। তৎক্ষনাৎ সরে দাড়ায় ও। একপ্রকারে জোর করে, তবুও ওকে কেবিনের সামনে থেকে সরিয়ে আনলো তাশদীদ। কিছুটা দুরে এসেই শান্ত ঝারা মেরে হাত ছাড়িয়ে নিলো নিজের। বললো,

– আমি ভেবেছিলাম তুই এসব থেকে সরে এসেছিস! কিন্তু তুইতো…

– এই প্রোজেক্টের জন্য তোকে কি কি ফেইস করতে হয়েছে, কি কি হারাতে হয়েছে, তা আমার চেয়ে তুইই ভালো জানিস তাশদীদ! আমি ভাবতেও পারছি না, এতোসবের পরও তুই পিছু হটিসনি। বরং এখনো চেষ্টায় আছিস কিকরে…

– দুচারটে শিক্ষিত, ক্ষমতাধর, দূর্নীতিগ্রস্ত, চোরের জন্য আমি আমার লক্ষ্য থেকেই পিছিয়ে আসবো কেনো? আমার উদ্দেশ্য এতোটাও ফেলনা না।

দীপ্ত দৃষ্টিতে হাতের ফাইলটার দিকে তাকিয়ে রইলো তাশদীদ। শান্ত নিজের মাথা চেপে ধরে। এদিকওদিক দুকদম পাইচারী করে। আবারো তাশদীদের সামনে এসে, একটু সময় নিয়ে বলে,

– কি চাইছিস তুই?

– অনেককিছু। কিন্তু তোকে বলবোনা।

মাসুম একটা হাসি দিয়ে, নির্ভাবনায় শান্তকে পাশ কাটায় তাশদীদ। শান্ত কোমড়ে দুহাত দিয়ে দাড়িয়ে ওর চলে যাওয়া দেখলো। তাশদীদ এক আঙুলের ওপর ফাইল ঘোরাতে ঘোরাতে যাচ্ছে। ওর এমন গা ছাড়া স্বভাব দেখে, শান্ত বুঝে উঠলো না, ওর ঠিক কোন কারনে দুঃখ করা উচিত? এই প্রোজেক্টে এখনো তাশদীদ জড়িত জেনে? নাকি এমন রাঘব-বোয়ালদের বিপরীতে ওর এমন গা ছাড়া স্বভাব দেখে?
ক্লাসে এসে ব্যাগ কাধে নেয় তাশদীদ। বাড়ি ফিরবে বলে ভার্সিটির বাসে চড়ে বসে। কিন্তু ফেরার পথে বৃষ্টি শুরু হয় আরেকদফা। ক্যাম্পাস এরিয়াতেই ওদের বাস জ্যামে দাড়িয়ে ছিলো। জানালার পাশের সিটটা থেকে তাশদীদের চোখে পরলো, রাস্তার ধারে একটা বসারমতো জায়গা করা। আর তার নিচে একটা কুকুর কোনোমতে বৃষ্টি থেকে গা বাচানোর চেষ্টা করছে। লোমশ ক্ষুদ্র শরীরটা ভিজে একাকার হয়ে গেছে ওর। তাশদীদ দেখেই বুঝলো, ওটা পমেরিয়ান কুকুর। কারো অতি সযত্নের পোষ্য। আশপায়ে উঁকি দিয়ে কাউকে চোখে পরলো না তাশদীদের। কি ভেবে বাস থেকে নেমে আসে ও। বৃষ্টির মাঝে ছুট লাগিয়ে এসে বসে কুকুরটার সামনে। কুকুরটা আরো গুটিয়ে যায়। তাশদীদ কপালে হাত ঠেকিয়ে ওর গলার ব্যাজটা লক্ষ্য করলো। সেখানে বুজো লেখা। তাশদীদ হাত বাড়িয়ে বললো,

– বুজো? কাম?

বুজো আরো গুটিয়ে যায়। তাশদীদ ভিজছে। তবুও আদুরে গলায় বললো,

– তোমার মালিক এখানে নেই। আর বৃষ্টি অনেক বেশি বুজো। আমার সাথে আসাটাই তোমার জন্য ভালো হবে। এটুক বুঝো? বুজো?

এবারেও বুজো এগোলো না। তবে তাশদীদও আর অনুমতির জন্য সময় নিলো না। দুহাতে আগলে নিলো ও বুজোকো। ছুটে এসে আবারো বাসে চড়ে বসলো। ওর এক ব্যাচমেট রুমাল এগিয়ে দিলো। বুজোকে কোলে নিয়ে, ওর গা যতোটুকো সম্ভব মুছে দিলো তাশদীদ। কাদা, পানির সংস্পর্শ কিছুটা কাটিয়ে উঠতেই ওর গায়ে গা ঘষতে লাগলো বুজো। তাশদীদ হেসে বললো,

– ওকে ওকে। আর কৃতজ্ঞতা জানাতে হবেনা।

বাসের সবাইকে বুজোকে পাওয়ার খবরটা ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে দিতে বলে তাশদীদ। ওর প্রীতিকার্নিশ পৌছাতে পৌছাতে সন্ধ্যে নামে। ততোক্ষণে বৃষ্টিও থামে। কিন্তু বাসার দরজায় এসে থেমে যায় ও। তাশদীদের মনে হয়, ওয়াসীর সাহেব বুজোকে ভেতরে রাখাটা পছন্দ করবেন না। ব্যাপারটা ও নিজেও মেনে চলে। শখ করে কুকুরপালনে ধর্মীয় নিষেধ আছে। তবুও একটা দম নিয়ে বাসায় ঢুকলো তাশদীদ। তামজীদ ব্যাট কাধে ঠেকিয়ে সবে বারান্দা থেকে রুমের দিকে রওনা হচ্ছিলো। ভাইয়ের কোলে বিদেশী কুকুর দেখেই ও বলে উঠলো,

– আবার কার দায়িত্ব ঘাড়ে করে নিয়ে আসলি তুই? রিংকি আপু কি কম ছিলো?

মিসেস ওয়াসীর রান্নাঘরে ছিলেন। গলা উচিয়ে ‘তামজীদ’ ছোটছেলেকে বলে শাষন করলেন তিনি। ওয়াসীর সাহেব মসজিদের উদ্দেশ্যে বেরোচ্ছিলেন। তাশদীদকে কুকুর কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন,

– এটা কার?

– জানিনা। রাস্তায় ভিজছিলো দেখলাম, তাই…যারই হোক কালকে ক্যাম্পাসে গিয়ে ফেরত দিয়ে দেবো বাবা।

ওয়াসীর সাহেব হাসলেন। এগিয়ে এসে ছেলের কাধে হাত রাখলেন তিনি। হেসেহেসেই বললেন,

– সৃষ্টিকর্তার সব সৃষ্টিকে যদি ভালোবাসতে না পারো, সৃষ্টির সেরা জীব কি করে হবে তাশদীদ? ওকে তামজীদের ঘরে রাখো৷ তামজীদ? তুমি আজকে ভাইয়ার ঘরে শিফট হয়ে যাও।

তামজীদ ঘাড় নাড়ালো। ওয়াসীর সাহেব বেরিয়ে গেলেন। তাশদীদ বুজোকে তামজীদের ঘরে ঢুকিয়ে দিলো। মাকে রান্নাঘরে গিয়ে বুজোর কথা বলে, পা বাড়াচ্ছিলো ওয়াশরুমের দিকে। তামজীদ ওর পাশে হাটতে হাটতে বললো,

– ওইদিন রিংকি আপু নাকি প্রীতিকার্নিশ এসে ড্রাইফ্রুটস খেয়ে গেছে। বুজোকে ওগুলোই দেবো? নাকি ডগফুড আনা লাগবে?

তাশদীদ অতিকষ্টে হাসি আটকায়। ভাইয়ের মাথায় চাটি মেরে, ঢুকে যায় ওয়াশরুমে। তামজীদ মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে সাইকেল বের করলো। বুজোর খাবার আনতে সুপারশপ যাবে বলে।
পরদিন সকালে বুজোকে সাথে করে ভার্সিটির জন্য রওনা হলো তাশদীদ। ক্যাম্পাসে গিয়ে খোজ নিলো, কেউ বুজোর খোজ করেছে কিনা৷ কিন্তু লাভ হয়নি। কেউই নাকি খোজেনি ওকে। তাশদীদ আরেকটু সময় নিলো। আজ ওর ক্লাস নেই৷ বাস্কেটবল টুর্নামেন্টের জন্য আসা। চেন্জ করে, বুজোকে নিয়ে কোর্টের দিকে এগিয়ে গেলো ও। শান্ত দলের বাকিসবদের নিয়ে আগে থেকেই ছিলো সেখানে। তাশদীদকে দেখে উচু গলায় ওদেরদিকে যেতে বললো। বুজোর বেল্টটা কোর্টের পাশের একটা খামে আটকে দেয় তাশদীদ। পরে এগিয়ে যায় দলের দিকে। ওরা নিজেরা কথা বলছিলো। তাশদীদের কানে আসলো,

– কুকুরটা কোথায় পেয়েছেন তাশদীদ ভাই?

তাশদীদ পাশ ফেরে। জার্সি পরিহিত তুল্যকে দেখে, হাসিমুখে বলে,

– আরে তুল্য! কেমন আছো?

– জ্বী ভালো। কুকুরটা…?

– কাল রোডসাইডে বৃষ্টিতে ভিজছিলো। আমি ওকে পাওয়ার পরপরই ভার্সিটির গ্রুপসহ সবজায়গায় খোজ পাঠিয়েছিলাম। তোমার এটা?

তুল্য একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো বুজোর দিকে। জন্মদাত্রী নামক মহিলার মনে মায়া নামক বস্তুটা যে বিন্দুমাত্রও নেই, তাতে আর সন্দেহ রইলো না ওর। সে নিশ্চয় ভেবেছে, একটা হারিয়েছে তো কি, টাকা দিয়ে আরেকটা কিনে নেবো। বুজোকে নিজের কাছে রাখার সিদ্ধান্ত নেয় তুল্য। যদি ভদ্রমহিলা ওকে খুজেও থাকে, ও ফেরত দেবে না এমনটা ভেবে রাখে। অতি স্বাভাবিক গলায় বললো,

– হ্যাঁ। বুজো আমার পেট। কাল প্রথমবার ক্যাম্পাসে এসেই হারিয়ে গেছে।

তাশদীদ ভ্রুকুচকে তাকালো। রাগের পাশাপাখি দু ভাইবোনের কুকুর পালার সময় আছে জেনে খুশিই হলো হয়তোবা। হেসে বললো,

– অনেক শান্তশিষ্ট পেট তোমার।

তুল্য বুঝলো, তাশদীদ আলাদা করে বুজোকে শান্তশিষ্ট বলে, ওকে রাগী সম্বোধন বুঝিয়েছে। একপা এগিয়ে, ও তাশদীদের দিকে মাথা উচু করে তাকালো। চোখে চোখ রেখে বললো,

– রাগের সাথে তুল্যর জেদও আছে তাশদীদ ভাই। ও জেতার জন্যই মাঠে নামে।

– তুমি মনেহয় দেবের ফ্যান?

তাশদীদের এমন প্রশ্নে হচকিয়ে যায় তুল্য। মুচকি হাসলো তাশদীদ। তুল্যর কাধে হাত রেখে বললো,

– আবারো অল দ্যা বেস্ট। যাওয়ার সময় মনে করে বুজোকে নিয়ে যেও।

স্থির হয়ে দাড়িয়ে রইলো তুল্য। তাশদীদ চলে আসলো নিজের দলের কাছে। টিটু কলা মুখে পুরতে পুরতে বললো,

– তুল্য কি তোকে লেকচার দিলো তাশদীদ? অবশ্য ওর আত্মবিশ্বাসের কারন আছে। শুনেছি কলেজে দুবছর বাস্কেটবল জিতেছে। ভার্সিটিতে এসেও সিনিয়রদের হারিয়ে কাপ নিয়েছে। এটুক কনফিডেন্ট তো হবেই!

তাশদীদ নিশব্দে হেসে জুতোর ফিতে বাধলো। কিছু বললো না। শান্ত ব্যাগ থেকে তোয়ালে বের করলো। পানির বোতলটা টিটুর কোলে ছুড়ে মেরে বললো,

– তাশদীদের রেকর্ড জানিস?

মাথা নেড়ে না বুঝালো টিটু। মুখে বললো,

– তবে আগেরদিন তো ফাটিয়ে দিয়েছে! আমি তখনই বুঝে গেছি, আজ তো আমরাই জিতবো!

– অভার-কনফিডেন্সি নিয়ে পানি একঢোক কম করে খা। গলায় আটকাবে।

টিটুর কাছ থেকে বোতল নিয়ে বললো তাশদীদ। কিছুসময়ের মধ্যেই বাশির আওয়াজে কোর্টে ঢুকে যায় ওরা। শুরু হয় অন্তঃবিভাগ বাস্কেটবল ফাইনাল। তাশদীদ খেয়াল করলো, শুরু থেকেই তুল্য নিজস্ব ক্ষিপ্রতা নিয়ে খেলছে। তবে ফাউল করছে না। আর আফিফের খেলার ভঙিমা এমন, যেনো ও ফাউল করে অভ্যস্ত। তাশদীদ ওর দলের শান্তসহ বাকি তিনজনকে বলো রাখলো, হারলে সমস্যা নেই। কিন্তু বিপরীত দলকে ফাউল করার সুযোগ না দিতে। তুল্য বা আফইফ দুজনেই যেভাবে খেলছে, তাতে কেউ আঘাত পেলে তা গুরুতর আঘাতই হবে। বাধ্য হয়ে তাশদীদের দল ডিফেন্ডে যায়। গেইম প্যাটার্ন ঘুরে যেতেই সুবিধা হয় তুল্যর। অতি সহজেই সাথে বাস্কেট করতে থাকে ওরা। রুমনের ডাকে তাথৈ লাইব্রেরি থেকে বেরোলো। মন মেজাজ ঠিক নেই ওর। আগেররাতে ঘুম পড়া কোনোটাই হয়নি। শার্লিও রুমনের সাথেই ছিলো। তাথৈকে বেরোতে দেখে রুমন উত্তেজনা নিয়ে বললো,

– তাথৈ চল শর্টস পরা ছেলে দেখতে যাই?

ঠাস করে নিজের কপালে চড় লাগালো শার্লি। তাথৈ নিজের ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করলো। তলানীতে অল্প কিছু পানি ছিলো বোতলটার। বোতলের মুখ খুলে ও রুমনের মুখে পানি ছুড়ে মারলো। উত্তেজনা হারিয়ে থম মেরে যায় রুমন। তাথৈ বললো,

– হুশে ফিরেছিস?

হাতে মুখ মুছলো রুমন। মিনমিনে গলায় বললো,

– চল বাস্কেটবল টুর্নামেন্ট দেখতে যাই। আজ ফাইনাল ম্যাচ চলছে।

একপলক শার্লির দিকে তাকালো তাথৈ। শার্লি অন্যদিক ঘুরে, ‘আমি কিছুই জানিনা’ টাইপ প্রতিক্রিয়া দেখালো। রুমন আবারো উত্তেজিত হয়ে বললো,

– চল না তাথৈ! দেখে আসি! আজকে খেলা তো জমজমাট! ওইদিন ওই হ্যান্ডসামটা তো খুব ভালো খেললো। আর আজ তুল্যবাবু বাস্কেটের ওপর বাস্কেট করছে! চল না!

অন্যসময় তুল্য বাস্কেট করেছে শুনলে হয়তো আগ্রহ দেখাতো না তাথৈ। কিন্তু তুল্য তাশদীদের বিপরীতে বাস্কেট করছে শুনে, হাসি ফুটলো ওর ঠোঁটে। তাথৈ ব্যাগ কাধে নিয়ে, বই বুকে জড়িয়ে বললো,

– চল!

রুমন খুশি হয়ে যায়। কিন্তু শার্লি কিছুটা অবাক, কিছুটা শোকাহত হয়। তাথৈ আর ও, দুজনে মিলে প্রতিবার তুল্যর হার চায়। অথচ এবার তাথৈও তুল্যের জিত চাইছে। যতোযাই হোক, রক্ত কথা বলে। মনকে বুঝ দিয়ে, মন খারাপ করে পা বাড়ালো ওউ। ওরা তিনজন এসে দেখে হাফটাইম খেলা শেষ। ফলাফল, ১২-৮. তাশদীদরা পুরো চার বাস্কেট পিছিয়ে। মনেমনে খুশি হলেও, প্রকাশ করলো না তাথৈ। সেমিফাইনালে তাশদীদ কিভাবে খেলার মোড় ঘুরিয়েছিলো, ভোলেনি ও। রুমন তুল্যকে দেখে চেচিয়ে বললো,

– তুল্যবাবু? অল দ্যা বেস্ট!

তুল্য পানি খাচ্ছিলো। রুমনের অল দ্যা বেস্ট শুনে হিচকি উঠে যায় ওর। পানির বোতল সর্বশক্তিতে ছুড়ে মারে ও রুমনের দিকে। ‘আউচ’ উচ্চারন করে সরে দাড়ায় রুমন। যে বেগে বোতল এসে পরেছে, ওই বোতল ওর গায়ে লাগালে, ওর একটা হাড়গোড়ও অবশিষ্ট থাকতো না। তাশদীদ রুমনের গলা শুনে সেদিকে তাকালো। সবার আগে ওর চোখ পরলো তাথৈয়ের দিকে। পরনে কোমড় অবদি কমলা রঙের গোল কুর্তা, গিটের অনেকটা ওপর অবদি ভাজ দিয়ে রাখা জিন্স, উচু পেন্সিল হিল। মাথার সবগুলো চুল উচুতে ঝুটি করে বাধা। কাধে থাকা ব্যাগের ফিতা দুহাতে ধরে রেখে, চুইংগাম চিবাচ্ছে তাথৈ। তাশদীদ দৃষ্টি সরালো। টিটু এনার্জী ড্রিংক এগিয়ে দিলো ওকে। হাতের আঙুল দুবার মুঠো করে, খুলে, তাশদীদ জবাব দিলো,

– লাগবে না।

শুরু হয় দ্বিতীয়ার্ধের খেলা। তুল্যরা ডিফেন্ড পেয়ে একটানা আরো ছয়টি বাস্কেট করে ফেলে। তাশদীদরা কোনোমতে তিনটি। আটারোতম বাস্কেট করে, তুল্য বল বাউন্ড করাতে করাতে এগিয়ে আসলো তাশদীদের দিকে। বললো,

– আপনাদের না এ্যাটাকে খেলার কথা ছিলো তাশদীদ ভাই?

তাশদীদ কোনো জবাব দিলো না। কেবল হাসি দিলো একটা। কিন্তু শান্তর মেজাজ খারাপ হচ্ছে। দল লিড দেওয়ার সময় শুরুতে এ্যাটাকে খেলার কথা বলেছিলো তাশদীদ। এখন ডিফেন্ডে খেলতে গেলে তো হারবেই! ও বেশ রেগে তাশদীদকে বললো,

– কি বা*র গেইমপ্লান করিস তুই! এ্যাটাকে খেলবো বলে ডিফেন্ডে কেনো যাচ্ছিস?

– ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড শান্ত। ওরা পাঁচজনই অনেক এগ্রেসিভ হয়ে আছে। একমুহুর্তের জন্য ডিফেন্ডে যাচ্ছে না। শুধু আছে বল গ্র্যাব করবে কিভাবে, সে ধান্দায়। এতে সামনেরজন মরুক বাচুক, ওদের আসে যায় না। এখানে আমরাও যদি এ্যাটাকে খেলি, এটা খেলা না, রণক্ষেত্র হবে।

– হলে হবে! ফাটুক না একটার নাকমুখ! অনার্সের চারবছরের জন্য টিম থেকে ব্যান করে দেওয়ার ব্যবস্থা করবো। ওই শোন, সবাই এ্যাটাকে খেলবি! দেখি এই ছানাপোনারা কেমনে জেতে!

তেজ দেখিয়ে বললো শান্ত। অশান্ত বন্ধুকে চেনে তাশদীদ। ও বুঝলো এবার ব্যাপারটা বিগড়াবে। উপায়ন্তর না দেখে বললো,

– ওকে। তাহলে মিডল থেকে আমি ড্রিবলিং করবো। আর তোরা ফ্রন্টে না থেকে বাস্কেটের কাছাকাছি থাকবি।

রাজি হয় সবাই। খেলা শুরু হয় আবারো। তুল্য-তাশদীদের ১১-১৮ বাস্কেট। তুল্য বরাবরের মতো এবারো বল ছিনতে উদ্যত হয়। কিন্তু তাশদীদ ছাড়লো না। এগিয়ে গিয়ে তুল্যকে সুযোগ দেওয়ার চেয়ে, কোর্টের মিডপয়েন্ট থেকে বাস্কেট করাকেই ওর ভালো মনে হলো। ও করলোও তাই। বারোতম বাস্কেটটা বেশ দুর থেকে এসে বাস্কেটে পরে।
হৈ হৈ করে ওঠে তাশদীদের দল। তুল্য এক আঙুলে কপালের ঘাম মুছলো। তাশদীদের কথা অনুযায়ী ওর ফ্রন্টে খেললো না। নিজেদের বাস্কেটে ডিফেন্ডে রইলো ওরা। তুল্যরা একটা বলও বাস্কেট করার সুযোগ পায়নি। বলা যায়, বল হাতেই পায়নি ওরা। শান্ত-তাশদীদ মিলে আরো চারটে বাস্কেট করলো। স্কোরবোর্ডে ওদের দলকে এগোতে দেখে হাত মুঠো করে বুকে গুজলো তাথৈ। তবে শার্লি খুশি হলো। দাঁত কেলিয়ে বললো,

– ঠিক হয়েছে। সবসময় সবজায়গায় এটিচিউড চলে না!

তাথৈ সামনে তাকিয়েই ওর কলার চেপে ধরে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

– বদদোয়া দেওয়া অফ যা ঘষেটি! তুল্য হারলে, আমাদের ব্যাচ হারবে।

– তুই আবার কবে থেকে ব্যাচ নিয়ে ভাবতে শুরু করলি?

শার্লি বিস্ময়ে বললো। রুমন পাশ থেকে ঠিক ততোটাই বিস্ময়ে বললো,

– তুই আবার কবে থেকে নিজেকে ঘষেটি মানতে শুরু করলি? মিরজাফর না তুই?

তাথৈ ছেড়ে দেয় শার্লিকে। ছাড় পেতেই শার্লি রুমনের হাতে কিল বসিয়ে দেয়। ঝোক হারিয়ে কয়েকপা পিছিয়ে যায় রুমন। ব্যথাতুর শব্দও করে। এমন অদ্ভুত আওয়াজ শুনে আশপাশের বাকিরা ওর দিকে তাকালো। তাথৈ বড় দম নেয়। চেচিয়ে বলে, ‘খেলা কোর্টে হচ্ছে!’
ওর ধমকে চোখ সরিয়ে নেয় সবাই। খেলার আর তিন মিনিট বাকি। দুদলই বাস্কেট করার চেষ্টা করছে। তাশদীদ বল ড্রিবলিং করাচ্ছে, তুল্য তা নেওয়ার চেষ্টায়। অনেকবেশি ক্ষিপ্ত হয়ে আছে ও। তাশদীদ খেলতে খেলতে বললো,

– তুল্য কন্ট্রোল ইওরসেল্ফ। এটা জাস্ট একটা খেলা। তুমি এভাবে খেললে যে কেউ ইন্জারড হতে পারে।

তুল্য মানলো না। তাশদীদ সবে উচু হয়েছে বল বাস্কেটের উদ্দেশ্যে ছুড়বে বলে, ঠিক পাশ থেকে অনেক জোরে ওকে ধাক্কা দেয় তুল্য। তাশদীদের পায়ে পারাও মেরেছে ও। বল ছেড়ে, তৎক্ষনাৎ নিচে পরে যায় তাশদীদ। পা চেপে ধরে শুয়ে পরে কোর্টের মাঝে। প্রচন্ড ব্যথায় কুকড়ে যায়। ওর দলের বাকি চারজন ছুটে আসে তখনতখন। কোর্টের বাইরে থেকে টিটুও ছুট লাগায়। এতোক্ষণ ঠিকঠাক থাকলেও, হুট করে আঁতকে ওঠে তাথৈ। বুকের ভেতরটা অকস্মাৎ খামচে ধরে ওর। বাকিসবের চেহারায় আতঙ্ক তৈরী হলেও, শক্ত হয়ে তাথৈ দাড়িয়ে রইলো। তুল্য শুধু দেখলো, ওর গেমপ্লান এবারে কাজে দেয়নি। তাশদীদের বেসামাল অবস্থায় ছেড়ে দেওয়া বলটাও, বাস্কেট করেছে।

#চলবে…

#কার্নিশ_ছোঁয়া_অলকমেঘ
লেখনীতে: মিথিলা মাশরেকা

১৮.

তাথৈ কোর্টের এককোণে শক্ত হয়ে দাড়িয়ে আছে। মুলত নিজেকে সামলাচ্ছে ও। ওর মন আজ অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। বারবার তাশদীদের অবস্থা কেমন তা দেখতে চাইছে। কিন্তু মস্তিষ্ক তা মানতে নারাজ। জেদ করেই নিজেকে স্থির রাখলো তাথৈ। শার্লিও ওর পাশে দাড়িয়ে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। কোর্টের অপরপ্রান্তে কি হচ্ছে তা বোঝার চেষ্টা করছে৷ তবে রুমন ওদের ধারেকাছেও নেই। তাশদীদ নিচে পরে যাবার পরপরই বুকে হাত দিয়ে ছুট লাগিয়েছে ও। দশ বারোজন মিলে তাশদীদকে ঘিরে রেখেছে। মেডিকেল সেন্টার থেকে ডাক্তার এসে ওর বাম পায়ে ব্যান্ডেজ পরাচ্ছে। তুল্য কিছুটা দুরে কোমড়ে হাত দিয়ে দাড়ানো। ওর কপালেও চিন্তার ভাজ। ঘটনাটা ওর ইচ্ছাকৃত ছিলো না৷ ওর তো খেলার ধরনই এমন। আর সেটা বুঝেই বিপরীত-পক্ষ গা বাচিয়ে চলে। আফিফ ভিড়ের দিক তাকিয়ে বাহাতে চোয়াল মুছলো। তুল্যকে বললো,

– একদম ঠিকঠাক লাগিয়েছিস তুল্য। এটা একটা রেড ফ্লাগ। একা অনেকগুলো বাস্কেট করেছে। ইন্জুরিতে ঠেকে গেলে…

তুল্য আফিফের দিকে রোষদৃষ্টিতে তাকালো। কিছুটা ভয় পেয়ে আফিফ থেমে যায়। তুল্য দৃষ্টি সরিয়ে বিরবিরিয়ে বললো,

– ইচ্ছে করে করিনি।

তাশদীদ নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে ব্যথা সামাল দিচ্ছিলো। ব্যান্ডেজ শেষে পা ছাড়লো ডাক্তার। টিটু নোয়ানো স্বরে জিজ্ঞেস করলো,

– ভেঙেছে?

– না না। ফ্র্যাকচার নেই। দৌড়ঝাঁপ না করলেই ঠিক হয়ে যাবে।

স্বস্তির শ্বাস ছাড়লো টিটু। শান্ত ক্ষিপ্ত হয়ে ছুটলো তুল্যর দিকে। হনহনিয়ে গিয়ে, ওর গলার নিচের গেন্জি খামচে ধরলো শান্ত। চেচিয়ে বললো,

– ইচ্ছে করে করেছিস এমন তাইনা?

তুল্য চুপ ছিলো। ও জানতো কথা ওকে শুনতেই হবে। তাছাড়া তাশদীদ আঘাত পেয়েছে, ব্যাপারটা ওরও ভালো লাগছে না। কিন্তু শান্ত ওর গায়ে হাত দিয়েছে দেখে ওর রক্ত গরম হয়ে যায়। হাত মুঠো হয়ে আসে। তুল্য নিজেও উদ্যত শান্তর গায়ে হাত তুলবে বলে। এরইমাঝে তাশদীদের গলা কানে আসে ওদের। টিটুর কাধে ভর করে উঠে দাড়িয়েছে তাশদীদ। টিটুকে ছেড়ে খুড়িয়ে এগোলো ও। শান্তর কাধে হাত রেখে বললো,

– আমি ঠিকাছি। রিল্যাক্স।

– তাশদীদ…

– রেজাল্ট কি?

– একমিনিট পয়তাল্লিশ সেকেন্ড বাকি। বাস্কেট ১৬-১৮.

তাশদীদের প্রশ্নে তুল্য জবাব দেয়। মুচকি হাসলো তাশদীদ। মুঠো করা ডানহাত তুল্যর দিলে বাড়িয়ে বললো,

– গ্রেইট! গেইম ইজ অন!

টিটু, শান্তসহ সবাই বিস্ফোরিত চোখে তাকালো। তুল্যও অবাক হয়। আবারো তাশদীদের ব্যান্ডেজ করা পা দেখে নিয়ে বলে,

– আপনি খেলবেন?

– না! তুই খেলবি না! ডক্টর দৌড়াতে মানা করলো তোকে। তাছাড়া এই পা নিয়ে তুই ছুটবি কিকরে? খেলা লাগবে না তোর। টিটু? ওকে কোর্টের বাইরে যা!

স্পষ্টভাবে বললো শান্ত। তাশদীদ কিছু বলতে যাবে, এরমাঝে রেফারি এসে বললো,

– তাশদীদ খেললেও, তুমি খেলছো না তুল্য। ফাউল করেছো। এন্ড ইউ আর ব্যানড ফ্রম ফিনালে।

তুল্য স্থির রইলো। কিন্তু ওর দল রেফারির কথায় উত্তেজিত হয়ে পরতে যাচ্ছিলো। তুল্য ফাউল করেছে, ওরা মানতে নারাজ। শান্ত টিটুও এবার উদ্যত হয় আফিফসহ বাকিদের গায়ে হাত তুলবে বলে। কিন্তু তাশদীদ আটকে দিলো শান্তকে। অতিকষ্টে পরিস্থিতি সামাল দেয় ও। ওর কথা ছিলো, ও ইন্জুরি নিয়েই খেলবে। আর ও যেহেতু খেলার মতো অবস্থায় আছে, তারমানে তুল্য ব্যান হওয়ার মতো কোনো ফাউল করেনি। যা হয়েছে তা পুরোটাই অনিচ্ছাকৃত। রেফারি, দুজন টিচার বারবার বারন করা সত্ত্বেও তাশদীদ মানলো না। শেষ পর্যন্ত ওর যুক্তিই থাকে। বাকি একমিনিট পয়তাল্লিশ সেকেন্ডের খেলা শুরুর জন্য কোর্টে অবস্থান নেয় দশজনই।
কোর্টের বাইরে থেকে পুরোটা দেখলো তাথৈ।
ওপরপ্রান্তে তাশদীদ কোনোমতে পা ফেলছে। রেফারি বাঁশি দিলে, তুল্য মাঝখান থেকে বল ড্রিবলিং করানো শুরু দিলো। তাশদীদের দল প্রাণপণে চেষ্টা করলো বল কাড়ার। জিততে হলে, এই দেড়মিনিটে দুটো বল বাস্কেট করতে হবে ওদের। একটা বল কোনোমতে তাশদীদের দলের হাতে আসে। সেটা তৎক্ষণাৎ তাশদীদের দিকে ছুড়ে মারে ছেলেটা৷ আর তাশদীদ কোর্টের মাঝমাঝি থেকে বাস্কেট করে। আরো একটা পয়েন্ট হয় ওদের। ওর খেলা দেখে তাথৈ নিজেনিজেই বললো, ‘ভাঙবে, তবু মচকাবে না।’ রুমন ততোক্ষণে আবারো ওর পাশে এসে দাড়িয়েছে। তাথৈয়ের কথাটা শুনে ও বললো,

– নারে। তুই উল্টো বুঝছিস। ডক্টর বললো হ্যান্ডসামের পা ভাঙেনি। মচকেছে।

নিজেকে সংবরন করলো তাথৈ। রুমনকে আর মারতে ইচ্ছে করছে না ওর। শার্লি বললো,

– হি ইজ সামথিং এলস। ইন্জুরি নিয়েও খেলছে। জেতাটা এতে জরুরি?

– তাশদীদের কাছে জেতাটা জরুরি না। ও খেলছে যাতে তুল্য খেলা থেকে ব্যান না হয়, এজন্য। শান্ত যেভাবে ক্ষেপেছিলো, আজকে তুল্য ব্যান হলে, ওকে নেক্সট দু বছরের জন্যও ব্যান করে রাখার ব্যবস্থা করতো ও।

টিটুর কথায় পাশ ফিরলো তাথৈরা তিনজন। টিটু ওদেরকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে যেতে বললো,

– সবজায়গায় উদারতা দেখানো ওর অভ্যাস। এটাই তাশদীদ ওয়াসীর।

টিটুর কথা শুনে তাথৈ একপা দুপা করে পেছোতে থাকে। পরপরই ঘুরে উঠে পা বাড়ায় ক্লাসের দিকে। পেছন থেকে শার্লি ওকে ডাকতে থাকে। কানে নেয়না তাথৈ। দ্রুতপদে চলে যায়। যেনো ওখান থেকে যেতে পারলে ওর রক্ষা৷ ও কয়েকপা এগোতেই পেছন থেকে হুল্লোড়ের আওয়াজ আসে। মানে খেলা শেষ। কোনো এক দল জিতেছে। একমুহূর্তের জন্য দাড়ায় তাথৈ। চোখ বন্ধ করতেই ওর কর্ণকুহরে ধ্বনিত হয়, ‘তাশদীদ! তাশদীদ!’

তাথৈ ব্যাগের ফিতা ধরে করিডরে হাটছিলো। ওর পেছনপেছন শার্লিও ছিলো। কানে হেডফোন দিয়ে গান শুনছিলো ও। তুল্যর হারার খুশিতে মন ভালে ওর। মোবাইল দেখতে দেখতে সাইড দিয়েই এগোচ্ছিলো ও। অকস্মাৎ কারো সাথে ধাক্কা লাগে। শার্লি চোখ তুলে চাইতেই তুল্য ওর হাত মুচড়ে পেছনে কোমড়ের সাথে চেপে ধরে। তুল্যর আরেকহাত থেকে বুজো ছাড় পেয়ে ছুট লাগায়। ও কিছু বলতে যাবে, শার্লি খালি হাতে নিজের কানের হেডফোন খুলে দিলো। বললো,

– আজ সব দোষ তোর! আমি সাইড দিয়েই যাচ্ছিলাম!

– টুর্নামেন্টের পর এতো খুশি হচ্ছিলি কেনো তুই? হু? আমি হারলে খুব খুশি লাগে তোর? খুব খুশি লাগে?

তুল্য শক্তপোক্ত কন্ঠে শুধালো। আর শার্লি কপাল কুচকালো। তুল্যর হার নিয়ে সত্যিই ও বেশি উত্তেজনা দেখিয়েছে। কিন্তু সেটা তুল্যের নজরে আসবে, এটা ভাবেনি। একহাতে তুল্যর বুক ঠেলে, নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো শার্লি। বললো,

– আমার প্রতি তোর যা বিহেভিয়ার, তুই হারলে আমার ইদ লাগবে, এটাই স্বাভাবিক নয়কি? হাত ছাড় আমার! ছাড়!

– বিহেভিয়ার? আমার কাছ থেকে কেমন বিহেভিয়ার এক্সপেক্ট করিস তুই? হু? কেমন? প্রেমিকা হস আমার? তোর সাথে বাবু জানু বলেবলে বিহেভ করতে হবে আমাকে? আন্সার মি!

আরো শক্তিতে শার্লির হাত মুচড়ালো তুল্য। এবার ব্যথায় আওয়াজ করে ওঠে শার্লি। তুল্যর হুশ হয়, কোথাকার রাগ কোথায় এসে খাটাচ্ছে ও। তৎক্ষনাৎ শার্লির হাত ঝারা মেরে ছেড়ে দেয় ও। এতোটাই জোরে যে, কয়েকপা পিছিয়ে যায় শার্লি। তুল্য জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজালো। সিগারেট খাওয়া দরকার এখন ওর। তাকিয়ে দেখে, ছাড় পেয়ে বুজো করিডোরের অপর প্রান্তে পৌছে গেছে। তুল্য চলে আসছিলো। কি ভেবে আবারো শার্লির দিক আঙুল উচিয়ে বললো,

– আমার দেখে দুরে থাক!

হনহনিয়ে চলে গেলো তুল্য। শার্লি আহম্মকের মতো ওর চলে যাওয়া দেখলো। নিজেনিজেই বললো, ‘আমি কখন তোর কাছে আসলাম?’
তাথৈয়ের কোনোদিকে খেয়াল নেই। আপাতত এক্সট্রা ক্লাসের জন্য ক্লাসে এগোচ্ছে ও। যেহেতু ক্লাসটা শিডিউলের বাইরে, বিভাগের যে ক্লাস ফাঁকা থাকে সেখানেই ক্লাসটা হবে। সেমিনারে আলো ওকে বলেছিলো, করিডোরের প্রথম রুমটাই নাকি ফাঁকা। তাই বাড়তি না ভেবে, তাথৈ নিচদিক তাকিয়ে ঢুকে যায় ক্লাসে। তিনসারির সর্ববামের ফার্স্ট হাইবেঞ্চে বসে একটা ক্ষুদ্র শ্বাস ফেলে। কিন্তু হুট করেই ওর মনে হয়, একজোড়া চোখ ওর দিকে আগ্রহে তাকিয়ে আছে। তাথৈ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। চক্ষুসম্মুখে ভ্রুকুচকে থাকা মানুষটা দেখে কপাল শিথিল হলো ওর। একেবারে ডানের দ্বিতীয় বেঞ্চটাতে তাশদীদ বসে। ওর ব্যান্ডেজ করা পা সামনের বেঞ্চের ওপর তোলা। তাথৈ নিজেকে সামলে বললো,

– এখানে এখন আমাদের ক্লাস হবার কথা।

তাশদীদ বেঞ্চ থেকে আস্তেধীরে পা নামালো। পায়ের ব্যথাটা অনেক বেশি। এটা নিয়ে যদিও ও দৌড়ায়নি, কিন্তু দাড়িয়ে থাকতে তো হয়েছিলো। ওদের আজ কোনো ক্লাস নেই৷ খেলা জেতার হৈ-হুল্লোড় শেষে শান্ত-টিটুসহ বাকিসব হলে চলে গেছে। ও তাই ক্লাসে এসে বসেছিলো। একেবারে ভার্সিটির বাসে যাবে বলে। পাশের বেঞ্চে হেলান দিয়ে রাখা এলবো সাপোর্ট ওয়াকিং স্টিকটা হাতে লাগিয়ে উঠে দাড়ালো তাশদীদ। টুর্নামেন্টের পরপরই টিটু কিনে এনেছে এটা। তাশদীদ খুড়িয়ে পা বাড়ালো। সবসময় উচ্ছ্বল থাকা মানুষটাকে লাঠির সাপোর্টে হাটতে দেখাটা, কোনো অজানা কারনে সহ্য হলো না তাথৈয়ের। দৃষ্টি সরিয়ে নিলো ও। তাশদীদ তাথৈয়ের সামনে এসে দাড়ালো। বললো,

– কিন্তু এটা তো আমাদের ক্লাসরুম।

চোখ তুলে চাইলো তাথৈ। ওর মনোযোগ নেই কিছুতে। কোনটা কাদের ক্লাস, ক্লাসে ঢোকার সময় সে বিষয়ে খেয়াল হয়নি। তাথৈ দেখলো তাশদীদ ঠোঁট চেপে হাসি আটকাচ্ছে। হাইবেঞ্চ থেকে, নিচে নেমে দাড়ালো ও। বললো,

– কিন্তু আপনাদের এই আওয়ারে ক্লাস নেই। এজন্য ম্যাম আমাদের পেন্ডিং ক্লাস এখানে নেবেন বলেছেন।

– ক্লাস আছে আমাদের। তুমি ভুল শুনেছো।

বেশ স্বাভাবিক গলায় বললো তাশদীদ। তাথৈ দু দন্ড তীক্ষ্ণচোখে ওর দিকে চেয়ে রইলো। তারপর তাশদীদদের ক্লাসরুটিন দেখবে বলে, পা বাড়ালো হোয়াইটবোর্ডের দিকে। কিন্তু একপা এগোতেই পেছন থেকে ব্যাগে টান পরে ওর। তাথৈ পেছন ফেরার আগেই তাশদীদ ওর ব্যাগ ধরে টান লাগায়। মুহুর্তের ব্যবধানে দেয়ালে পিঠ ঠেকে তাথৈয়ের। তাশদীদ ডানহাতে তাথৈয়ের ব্যাগ দেয়ালে চেপে ধরেছে। ওকে এতোটা কাছে দেখে তাথৈ বড়বড় চোখে তাকালো। নড়েচড়ে উঠে, চেচিয়ে বললো,

– হোয়াট দ্যা…

– আহ…

মৃদ্যু আওয়াজে আর্তনাদ করে ওঠে তাশদীদ। তৎক্ষনাৎ নড়চড় থেমে যায় তাথৈয়ের। ওকে স্থির হতে দেখে, তাশদীদ ওরদিক উঁকি দিয়ে তাকালো। বললো,

– আমার ব্যথায় তোমার কষ্ট হয় তাথৈ আলফেজ?

তাথৈ দাঁতে দাঁত চেপে গেলো। মুচকি হেসে ওকে ঘুরিয়ে দিলো তাশদীদ। তারপর ওর ব্যাগ থেকে একটা বই বের করে, একপা পিছিয়ে দাড়ালো। তাথৈ নিস্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। তাশদীদ একহাতে বই উল্টেপাল্টে দেখতে দেখতে বললো,

– বইটা ইমারজেন্সি লাগবে। সেমিনারে ছিলো না। তবে লাস্ট এন্ট্রিতে তোমার নাম ছিলো। এখন দেখা যখন হলোই, ভাবলাম তোমার কাছ থেকেই নিয়ে নেই।

বলাশেষে চোখ তুলে তাকায় তাশদীদ। তাথৈ হাত মুঠো করে নিলো নিজের। তাশদীদ উকি দিয়ে ওর মুঠো করা হাত দেখলো। বললো,

– এক্সাক্টলি। আমি জানি আমার সোজা কথায় বই দেবার মেয়ে তুমি নও। তুমি আমার ইমার্জেন্সীও বুঝবে না, উল্টো রাগ দেখিয়ে, ভস্ম করে দেবে। তাই…

– ইউ…

– হ্যাঁ। যতো খুশি রাগ করো। বই নিয়েছি তো কি? রাগের সমাহার মনটা তো নেইনি।

তাথৈকে পাশ কাটিয়ে চলে যায় তাশদীদ। যাওয়ার আগে তাথৈয়ের উচিয়ে রাখা আঙুল বই দিয়ে ঠেলে নামিয়েও দিয়েছে ও। তাথৈ পিছু ফিরে হতভম্ব চোখে ওকে চলে যেতে দেখে। হালকা নীল রঙের শার্ট পরিহিত মানব, খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাটছে। তাথৈয়ের আজ রাগ হয় না। রক্তের উষ্ণতা বাড়ে না। বরং ওর শীতল মস্তিষ্ক আরো একবার ওকে জানান দেয়, মন না নিলেও, এই লোক ওর রাগকে বশ করে নিতে শুরু করেছে।

#চলবে…