কার্নিশ_ছোঁয়া_অলকমেঘ পর্ব-১৯+২০+২১

0
252

#কার্নিশ_ছোঁয়া_অলকমেঘ
লেখনীতে: মিথিলা মাশরেকা

১৯.

সন্ধ্যার আগমুহুর্তে তাথৈ অম্বুনীড়ে ঢুকলো। মন ভালো ছিলো না বলে ভার্সিটি থেকে ফাঁকা রাস্তা ঘুরে এসেছে। তুল্য বাগানে ছিলো। চিকন স্লিভসের গেন্জি পরে বাস্কেটে বল ছুড়ছিলো। একহাতে বল ছুড়ে, বারোবারের মধ্যে দশবার বাস্কেটে বল ঢুকিয়েছে ও। বুজো আশেপাশে ছোটাছুটি করছিলো। তাথৈয়ের গাড়ি দেখে তুল্য বল ধরে ফেলে। ঘাসের ওপর থেকে জুসের বোতলটা নিয়ে কয়েকঢোক খায়। তাথৈ গাড়ি থেকে নেমে শব্দ করে গাড়ির দরজা লাগালো। তারপর বুকে হাত গুজে, গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বললো,

– কি লাভ একহাতে বাস্কেট করে? সেইতো হেরেই এসেছিস।

তুল্য জবাব দেয় না। ম্যাচ নিয়ে কোনোরুপ তর্কে যাবার ইচ্ছে নেই ওর। ‘বুজো কাম’ বলে পা বাড়ায় বাসার ভেতরে। বুজো ডাক শুনে তাকিয়ে তাথৈকে দেখলো। একছুটে এসে তাথৈয়ের পায়ে গা ঘষতে শুরু করে দিলো ও। তাথৈ চমকে ওঠে কিছুটা। তৎক্ষণাৎ চেচিয়ে ডাক লাগায় তুল্যকে। তুল্য নিরস নজরে বোনের দিকে তাকায়। তাথৈ তেমনি চেচিয়ে বলে,

– এই বুলশিট এ বাসায় কেনো?

– তোর পছন্দ না এজন্য।

– এটাকে সরা তুল্য! সরা!

তুল্য পাত্তা না দিয়ে বাসার ভেতরে চলে যায়। তাথৈ কোনোমতে বুজোকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢোকে। বুজোও ওর পায়ের নিচনিচ দিয়ে আসছিলো৷ ভেতরে ঢুকে দেখে তুল্য ডগফুড দিয়ে রেখেছে। এবারে বুজো তাথৈকে ছেড়ে খাবারের দিকে চলে যায়। পায়ের নিচটা ফাঁকা হতেই তাথৈ যেনো ছাড় পায়। হনহনিয়ে গিয়ে সেন্টার টেবিলে থাকা পেপারওয়েট হাতে নেয় ও। দেয়ালে থাকা একটা কাচের ওয়ালমেটে ছুড়ে মারে ওটা। ওয়ালমেটটা নিচে পরে ভেঙে যায়। তাথৈ তেমনি রাগ নিয়ে বলে,

– ওকে বলবি আমার কাছে না আসতে!

নিজের ঘরে চলে গেলো তাথৈ। তুল্য আরেকঢোক জুসের বোতলে চুমুক দিলো। বুজো খাওয়া বাদ দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ওর চেহায়ায় প্রশ্ন, ‘আশ্চর্য! মেয়েটা রেগে গেলো কেনো?’ তুল্য প্রশ্ন বুঝে জবাব দিলো,

– আমার নিজের বোন, তাই যা ব্যবহার। তোরতো সৎ বোন হয়। আর কেমন ব্যবহার আশা করিস তুই?

বুজো কি বুঝলো, নিজের মতো আবারো খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। সোফায় গা এলিয়ে দিলো তুল্য। শরীরটা বেশ ব্যথা করছে। কিছুসময় পরই গাড়ির হর্ন কানে আসে ওর। তৈয়ব আলফেজ বাসায় কুকুর দেখে চমকে উঠলেও তুল্যকে দেখে স্বাভাবিক হলেন। তুল্যকে বললেন,

– এ আবার কোন নতুন নাটক?

– তোমার সৎ ছেলে।

– তুল্য!

গর্জে ওঠেন তৈয়ব আলফেজ। তুল্য বাবার হুংকার গায়ে লাগায় না। অগোছালো পায়ে এসে বুজোর বেল্ট ধরে। ওকে আবারো কোলে নিয়ে হাটা লাগায়৷ সিড়িতে উঠতে উঠতে বলে,

– ও আজ থেকে অম্বুনীড়েই থাকবে। বাট ডোন্ট ওয়ারী, সম্পত্তির দাবীতে তোমার পা চুমোবে না। এন্ড ইউ বুজো, লিসেন! শুধুমাত্র তোর বিলেতী মালকীন তোকে ছেড়ে গেছে বলে আমি তোকে করুনা করেছি। সৎ ব্যাপারটার বাইরে অম্বুনীড়ের কারো সাথে তোর কোনো সম্পর্ক নেই। সো লিমিটে থাকবি। বুঝে আসলো?

ওপরতলায় পৌছাতেই বুজো শরীর মোচড়াতে থাকে। নরম ছোট্ট শরীরটা নিয়ে, তুল্যর হাত পেরিয়ে নিচে নেমে আসে। লেজ নাড়িয়ে ঠিক তাথৈয়ের রুমের দড়জা অবদি পৌছে যায় ও। তুল্য ছুটে এসে আবারো ওর বেল্ট ধরলো। বললো,

– হ্যাঁ! এ ঘরের কাছেও ভিড়বি না! তোর সৎ বোন দ্য তাথৈ আলফেজের ঘর এটা। এন্ড শি ইজ আ রেড ফ্ল্যাগ! রাগের বশে তোকে তুলোর বালিশের মতো ব্যালকনি দিয়ে ছুড়ে মারতেও দুবার ভাববে না ও। গট ইট?

তুল্য বুজোকে নিয়ে রুমে চলে আসে। দরজা লক করে চিৎ হয়ে শুয়ে পরে বিছানায়। মনেমনে ভাবতে থাকে, প্রথমবার ম্যাচ হেরে ওর আফসোস করা উচিত। রাগ হওয়া উচিত। কিন্তু ওর আফসোস আসছে না। রাগ আসছে না। উল্টো যে ওকে হারিয়েছে, সেই তাশদীদের খোজ নিতে ইচ্ছে করছে। জানতে ইচ্ছে করছে, তার পায়ের ব্যথাটা এখন কেমন।

তাশদীদ বিছানার ওপর বসে ব্যান্ডেজ খুলছে আর ব্যথাতুর আওয়াজ করছে। মিসেস ওয়াসীর গম্ভীর চেহারা নিয়ে রুমে ঢুকলেন। সঙ্গেসঙ্গে চুপ হয়ে গেলো তাশদীদ। আওয়াজ না করে ব্যান্ডেজ খুলতে লাগলে আর আড়চোখে মাকে দেখতে লাগলো। ওর মা পানির গ্লাস আর ঔষধের বক্সটা টেবিলে রেখে চলে যাচ্ছিলেন। তাশদীদ মায়ের হাত ধরে ফেললো। মিসেস ওয়াসীর অভিমানী স্বরে বললেন,

– কাজ আছে আমার তাশদীদ। তুমি ঔষুধ খেয়ে ঘুম যাও। ফজর বাসায়ই আদায় করো। আমি ডেকে দেবোনে।

অভিমান বুঝে মাকে টেনে এনে সামনে বসালো তাশদীদ। পা নামিয়ে বসে, মায়ের কোলে মাথা গুজে দিলো। ঘুমুঘুমু স্বরে বললো,

– ঘুম আসছে না। ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে যাওতো মা।

– বড় হয়েছো তুমি। আমার ঘুম পাড়িয়ে দেবার বয়স নেই তোমার।

তাশদীদ জবাব না দিয়ে আরো ভালোমতোন মুখ গুজলো মায়ের কোলে। মিসেস ওয়াসীর হার মানলেন। লম্বা একটা শ্বাস ফেলে ছেলের মাথায় হাত রাখলেন উনি। আদুরে গলায় বললেন,

– এইভাবে পা খুড়ো করে নিয়ে বাসায় ফিরতে হয়। কেনো খেলতে যাস এমন খেলা তাশদীদ?

– যাতে তুমি গর্ব করে তোমার বউমাকে বলতে পারো, তোমার ছেলের কতো গুন!

– কাকে কি বললি রে ভাই? দেখ মা এই মাঝরাতে আবার রিংকি আপুদের বাসার দিকে রওনা হয় কিনা।

তামজীদ আপেল খেতে খেতে ঘরে ঢুকলো। মিসেস ওয়াসীর ছোটছেলের ওপর ক্ষিপ্ত হলেন। কিছু বলতে যাবপন, তখনই তাশদীদের ফোন বেজে ওঠে। তামজীদ উঁকি দিয়ে দেখে স্ক্রিনে রিংকির নাম। হে হে করে করে দিয়ে বললো,

– দেখো! পিশাচিনীর নাম লিয়া, য়ো হাজির!

মিসেস ওয়াসীর পিশাচিনী বুঝলেন শুধু। তামজীদকে চোখ রাঙালেন তিনি। তাশদীদ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে সত্যিই রিংকির ফোন। কল রিসিভ করে বললো,

– হ্যাঁ বলো।

– আজকে পড়াতে আসবেন না তাশদীদ ভাই?

– না। বাস্কেটবল ম্যাচ খেলতে গিয়ে পায়ে চোট পেয়েছি আজ। ওয়াকিং স্টিক নিয়ে হাটতে হচ্ছে। দু তিনদিন পড়াতে যাবো না তোমাকে। কাল অনলাইনে পড়াবো। পড়া করে রেখো।

একটানা বলে ফোন রেখে দেয় তাশদীদ। তামজীদ এবারো হতাশ হয়। এগিয়ে এসে চেয়ারে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে বলে,

– লে! তুইও তোর মায়ের মতোই! কাকে কি বললি? দেখ তোর পায়ের ব্যথা শুনে, ওইটা কাল প্রীতিকার্নিশ এসে না টপকায়।

তাশদীদ প্রতিত্তোর করলো না। মায়ের কোলে মুখ গুজলো আবারো। ও জানে ও কি করছে, তার পরিনতি কি হতে পারে, আর তা প্রতিহত কিভাবে করতে হয়। ভাইয়ের উল্টোমুখ দেখে তামজীদ ভ্রু কুচকালো। আপেলে আরেকদফা কামড় দিয়ে মাকে বললো,

– এ তোমার এ ছেলে কিন্তু সুবিধার না মা। ও ওপরেওপরে এমন ভালো দেখতে। কিন্তু ভেতরেভেতরে নিশ্চিত ওরকোনো ঘাপলা আছে। যেদিন ওর সেই ঘাপলামো বার হবে, ওইদিন বুঝবে, কি একটা ছেলে পেটে ধরেছিলো। এই আমি বলে রাখলাম। মিলিয়ে নিও।

এতোগুলো কথার একটা কথাও কানে তুললেন না মিসেস ওয়াসীর। অতি যত্নে তাশদীদের মাথায় আঙুল বুলাচ্ছেন তিনি। তামজীদ আপেলটা শেষ করছিলো। ওর কামড়ের আওয়াজে মিসেস ওয়াসীর ওকে ধমকে বললেন,

– উফ! আওয়াজ করিস না তো তামজীদ। ছেলেটা আমার ঘুমোচ্ছে।

তামজীদ বেকুবের মতো কিছুক্ষণ মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। বেহুঁশের মতো প্রশ্ন করে বসলো,

– আমাকে কি সত্যিই তোমরা সাভারের ময়লার গুদামে কুয়ায়া পাইছিলা মা?

দেশের প্রত্যন্তঅঞ্চলে শৈত্যপ্রবাহ চলছে। অথচ ঢাকার আকাশজুড়ে আজ উজ্জ্বল রোদ। দুটো ক্লাস শেষে, দুপুরের খাবারটা খাবে বলে শার্লির সাথে ক্লাস থেকে বেরোলো তাথৈ। শার্লি পরনে থাকা হাটুর ওপর অবদি কালো শার্ট টানতে টানতে বললো,

– শার্টটা কি ছোট হয়ে গেছে রে তাথৈ?

– এতোই যখন শর্টসে প্রবলেম, লংফ্রকে আসলেই তো পারিস।

ওরদিক না তাকিয়ে হাটতে হাটতে জবাব দিলো তাথৈ। শার্লি ফিক করে হেসে দিলো। বললো,

– ধুরু! আমি আর ফ্রক? ওইসব মানায় আমাকে?

তাথৈ জবাব দিলো না। ও জানে, জবাব দিয়েও লাভ নেই। ও যতোই বলুক না কেনো, শার্লি স্বাভাবিক পোশাকআশাক পরবে না। অবশ্য ওর এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথাও নেই। ও যা খুশি পরুক, অশালীন কিছু তো পরছে না। ঠিক সে সময়েই শার্লির নজরে পরলো বাইরের রাস্তা দিয়ে রুমন দৌড়াতে দৌড়াতে আসছে। ওদের দেখে সে এমনভাবে দাঁত কেলাচ্ছে, যেনে কয়জন্ম পর ওদের দেখা। রুমনের পরনে জলপাই রঙের শর্ট ফ্রক, সাদা টাইট পায়জামা। কোমড়ে সাদা ওড়নার মতো কিছু একটা প্যাচ দেওয়া। শার্লি নিরস কন্ঠে বললো,

– তবে এইটাকে ফ্রক ভালো মানায়৷

চোখ তুলে তাকালো তাথৈ। রুমনকে দেখে নিয়ে আরেকপলক শার্লির দিকে তাকালো। যে চাওনির মানে, আবার শুরু করলি? শার্লি গায়ে লাগায় না। রুমনের হাওয়ায় ভাসার মতো করে তাথৈদের সামনে চলে আসলো ও। ইয়া বড় একটা হাসি দিয়ে বললো,

– গার্লস! আমার পারফর্ম আছে এখন! চল দেখবি চল!

তাথৈ ঠোঁটে হাসি ফুটায়৷ আপাদমস্তক রুমনকে দেখে নিয়ে বললো,

– ভালো দেখাচ্ছে তোকে।

– হ্যাঁ। একদম আনারকলির মতো!

পাশে তাকায় তাথৈরা। চুইংগাম চিবোতে চিবোতে আফিফ কথাটা বলেছে। ওর সাথে আরো দুটো ছেলে। রুমন নিজেকে দেখে নিয়ে বললো,

– একচুয়ালী আমার রোল সেলিমের। কস্টিউম এখনো পুরোটা পরিনি। তাই এমন বলছো।

– তাই নাকি? সেলিম করবি তুই? কিন্তু সেলিম কেনো করবি? তোর ওপর তো আনারকলি ওয়ালা লুক উপচে পরে রে! আনারকলি কর গিয়ে! বেশ মানাবে!

রুমন অহেতুক খুশি হয়। কিন্তু খুশি হলো না তাথৈ-শার্লি। আফিফের চোখেমুখে রুমনকে ছোট করার ধান্দা। অথচ রুমন ব্যাপারটা ধরতেই পারছে না। উল্টো খুশি হচ্ছে। তাথৈ ‘চল রুমন।’ বলে তাড়া দিলো। কিন্তু রুমনের পথ আগলে দাড়ায় আফিফ। নিচের ঠোঁটের ডানদিকটা ডলে বললো,

– দাড়া রুমন। একটা প্রশ্ন করার ছিলো তোকে।

– হ্যাঁ বলোনা!

– তুই এলজিবিটি’র ঠিক কোনটা?

রুমন যতোটা খুশিতে প্রশ্ন জানতে চেয়েছিলো, ততোটাই স্তব্ধ হয়ে যায় আফিফের প্রশ্ন শুনে। ভাষাহীন চোখে চেয়ে রইলো ওর দিকে। তাথৈ হাত মুঠো করে নিলো। পাশ থেকে শার্লি ক্ষিপ্ত বাঘিনীর মতো বললো,

– মাইন্ড ইওর ল্যাঙ্গুইজ আফিফ! লিমিট ক্রস করছিস তুই!

– ওয় টমবয়? তুই নিজের লিমিটে থাক! আমি তোর সাথে কথা বলছি না! হ্যাঁ রুমন? তুই বল! তোর সাথে কি কি ঘটে?

– নাকি কিছু ঘটেনা বলে অপারেশন টপারেশন…

– আফিফ স্টপ।

নিজের রাগকে অতিকষ্টে সংবরন করে বললো তাথৈ। আফিফ খুশি হলো ওর ধৈর্য্য দেখে। বিশ্রি হেসে, পকেটে হাত গুজে আরামে দাড়ালো। আরো আয়েশী ভঙ্গিতে বললো,

– হুয়াই? আমি কেনো থামবো? আমি যা বলছি তা সত্যি না? বাইদাওয়ে! মিথ্যে হলেও সেটা তুই কি করে জানলি? রুমন তোর কাছে নিজেকে প্রমাণটমান করেছে নাকি?

তাথৈয়ের সহ্যের সীমা পার হয়ে যায় এবারে। ওয়াশরুমের গ্লাস ভাঙ্গা নিয়ে সেদিন প্রক্টর অনেক শাষিয়েছে বলে ও চুপ থাকবে ভেবেছিলো। কিন্তু আফিফের কথার ধরণ ঘৃণ্য পর্যায়ে চলে গেছে। তাথৈ উদ্যত হয় ওকে চড় লাগাবে বলে। কিন্তু ওর কিছু করে ওঠার আগেই সশব্দে চড় পরে আফিফের গালে। চড়ের আওয়াজ এতেটাই বেশি ছিলো যে, চমকে ওঠে তাথৈ। শক্ত চড়টা গালে পরায় আফিফ মুখ থুবড়ে মাটিতে পরেছে। ওর পেছনে দাঁত ক্যালাতে থাকা ছেলেদুটো থতমতে খেয়ে একপা পিছিয়ে গেছে। তাথৈ আর আফিফদের মাঝে হালকা খয়েরী শার্ট পরিহিত এক যুবক এসে দাড়ায়। তাথৈ পিছন থেকে যুবকের প্রশস্ত কাধের দিকে তাকিয়ে রইলো। মানুষটার উপস্থিতিতে অনিয়মিতভাবে ওর হৃৎস্পন্দন বাড়ছে। অতি ধীরগতিতে দৃষ্টি নামায় তাথৈ। ওর চোখে পরে, সামনেরজনের বা হাতে ওর চেনা বই। সে হাতেই লাঠিতে ভর করে দাড়িয়ে আছে মানুষটা। আফিফ মাটিতে পরে থাকা অবস্থাতে গালে হাত রেখে চোখ তুলে সামনে তাকালো। চড়দাতাকে দেখে অস্ফুটস্বরে উচ্চারণ করলো,

– তাশদীদ ভাই…

তাশদীদের চেহারায় স্থিরতা। কোনোরকমের রাগ, আক্রোশের উপস্থিতি নেই। চড় লাগিয়ে, ঘাড়টা কিঞ্চিৎ বাকিয়ে আফিফের দিকে তাকিয়ে ছিলো ও। যেনো পর্যবেক্ষণ করছিলো ওকে। আফিফের ডাক শুনে এবারে বললো,

– তোমার ঠোঁটের বা কোনায় কেটে গেছে।

আফিফ বোধহয় শুনতে পেলো না। কিছুটা অপ্রস্তুভাবে নিয়ে আশপাশ দেখলো তাশদীদ। নিচের ঠোঁটটা জিভ দিয়ে ভিজিয়ে নিলো। তারপর নিজের ঠোঁটে হাত লাগিয়ে ইশারায় আফিফকে বুঝালো, ওর ঠোঁট কেটে গেছে। আফিফ এবারে বোঝে, তাশদীদ কি বলেছে ওকে। কপালে ভাজ ফেলে গাল থেকে হাত সরায় ও। ঠোঁট স্পর্শ করে তরলের উপস্থিতি অনুভব করে। বুঝতে পারে, সত্যিই কেটে গেছে সেখানে। বা কানে নখ ঘুরিয়ে মাথা ঝারা মারে আফিফ। তাশদীদ আফিফের সাথে থাকা ছেলে দুটোর দিকে তাকালো। হাতের ইশারায় বুঝালো, তোমাদের বন্ধুকে তুলে দাড় করাও। ছেলেদুটো শুকনো ঢোক গিলে তৎক্ষণাৎ টেনে তুললো আফিফকে। তাশদীদের একটা চড়ে ও যে কানে শুনছে না, সেটা বুঝতে বাকি নেই ওদের। দাড়ানোর পর আফিফ ঠৌঁট মুছছিলো আর কান ডলছিলো। তাশদীদ ছেলেদুটোকে আবারো ইশারায় বলে, আরেকটু ডানে দাড়াতে। ও জানে বা কানে আফিফ কিছু শুনবে না।

ছেলেদুটো করেও তাই। তাশদীদ পেছনে তাকালো। জিনস, টপস পরিহিত তাথৈ, কাধের ব্যাগের ফিতা শক্তহাতে আঁকড়ে ধরে দাড়িয়ে আছে। তাথৈকে বই ফেরত দিতে এসেছিলো ও। আফিফের বিশ্রি কথাবার্তা শুনতে পেয়ে নিজেকে থামাতে না পেরে চড় লাগায় ওকে। বইটা তাথৈকে এগিয়ে দিলো তাশদীদ। তাথৈ হাতে নিলো ওটা। ওর ঠিক পাশে রুমন দাড়ানো। নমনীয়ভাবে চলাফেরা করা রুমনকে এমুহুর্তে বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। অবশ্য দেখাবেই না কেনো? মেয়েলি স্বভাবের জন্য এতোগুলো বছরের জীবনে কম কথা শুনতে হয়নি ওকে। নিজের পরিবারই ওকে ছাড় দেয়নি। তাই বাইরের কারো কাছেও ও সম্মান আশা করেনি। আবার নিজেকে বদলাতেও পারেনি। ও বুঝে গিয়েছিলো, বাকিসবের মতো মুফতে সম্মান মিলবে না ওর। এজন্য নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করতে হবে। তাইতো দেশসেরা বিদ্যাপিঠে জায়গা করে নিতে দিনরাত এক করে দিয়েছিলো ও।

ঘটেছেও ওর ভাবনার মতোই। বিশ্ববিদ্যালয় আত্মপ্রকাশের জায়গা। নাট্যকলা ওর শখকে ওর প্রতিভা হিসেবে গ্রহন করেছে। তার বাইরে ঠাট্টা মশকরায় যতোটুকই হোক না কেনো, সেসব কখনো পাত্তা পায়নি রুমনের কাছে। কিন্তু আজ আফিফ সব সীমা পার করেছে। ওর নিজের প্রতি রাগ হচ্ছে। ওর বেশভূষাসমেত ওকে গ্রহণ করেছে বলে তাথৈকে এইভাবে অপমানিত হতে হবে, ভাবেনি ও। অনুশোচনায় মুখচোখ লাল হয়ে আছে ওর। তাশদীদ ইশারায় রুমনকে ডাকলো। নাকটা ডলে, দিশেহারার মতো মাটিতে তাকিয়ে এগুলো ও। তাশদীদের কাছে এসে দাড়িয়েও নিচদিক তাকিয়ে রইলো। তাশদীদ আফিফকে বেশ স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,

– কার্বোহাইড্রেট মেটাবলিজমের সাইকেল কয়টা আফিফ?

আফিফ প্রত্যেকের চোখমুখের দিকে তাকায়। যেনো শব্দদুটো নতুন শুনেছে ও। তাশদীদ বুঝতে পারে, ও জবাব দিতে পারবে না। কিছুটা সাচ্ছন্দে হেসে বললো,

– ফার্স্ট সেমিস্টারের পড়া। ব্যাসিক অফ বায়োকেম। ভুলে গেছো?

আফিফ দৃষ্টি সরালো। তাশদীদ এবার রুমনকে জিজ্ঞেস করলো,

– নিঃসঙ্গ সম্রাট কার লেখা রুমন?

রুমন বড়বড় চোখে একপলক চাইলো তাশদীদের দিকে। ওদের পেছনে তাথৈ শ্বাস আটকে দাড়িয়ে আছে। রুমন আবারো মাথা নিচু করে নিলো। বলতে লাগলো,

– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের। নাটকটাকে বইয়ের পাতা থেকে টিভিতে তুলে ধরেছিলেন দেবেশ চট্টোপাধ্যায়। প্রযোজক ছিলেন পাইকপাড়া ইন্দ্ররঙ্গ নাট্য দলের ইন্দ্রজিৎ চক্রবর্তী। দেবেশ যখন নাটকটা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা শুরু করেছিলেন সে সময়ই সুনীল গত হন। দেবেশ চলে যান নাটকের জন্মদাতার স্ত্রী স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে। এরপর তার অনুমতিতে তৈরী হয় নিঃসঙ্গ সম্রাট। ওসময়…

রুমন বলতে থাকে। তাশদীদ মুচকি হেসে ডানহাতটা ওর কাধের ওপর রাখলো। আলতো চড় মেরে থামতে বুঝালো। তারপর আফিফকে বললো,

– কানে গেছে?

আফিফ মাথা উপরনিচ করে হ্যাঁ বুঝালো। তাশদীদ ওকে একশব্দের সবচেয়ে সহজ প্রশ্নটাই করেছিলো। তার জবাব দিতে পারেনি ও। কিন্তু রুমন দুইশব্দের প্রশ্নে পুরো অনুচ্ছেদ রচনা করে ফেলেছে। আফিফ দৃষ্টি নিচু করে নিলো। তাশদীদ আবারো বললো,

– মাথায় গেছে?

নিচদিক তাকিয়ে থাকায় এ কথাটা আফিফ শোনেনি। ওর পাশের ছেলেটা ওকে ধাক্কা লাগালো। আবারো চোখ তুলে তাশদীদের দিকে তাকায় আফিফ। তাশদীদ বললো,

– ভার্সিটিতে সবাই নিজ নিজ যোগ্যতায় পড়তে আসে। আর এই যোগ্য মানুষগুলোর একজনকেও, একবিন্দু অপমান অপদস্ত করার যোগ্যতা তোমার নেই। পরেরবার কাউকে একটুও ছোট করে কথা বলার আগে আমাকে স্মরণ করো। ম্যানার শেখানোর আমার বহুবছরের অভিজ্ঞতা আছে।

শেষ কথাটা বেশ জোর দিয়ে বলেছে তাশদীদ। বলা শেষে ঘাড় নাড়িয়ে বুঝালো, তাথৈ রুমনকে সরি বলতে। আফিফের রাগ এতোক্ষণে ওর চেহারায় ফুটে উঠলো। একপলক তাথৈয়ের দিকে তাকিয়ে, তেজী গলায় ‘সরি!’ বললো ও। তারপর একমুহূর্ত না দাড়িয়ে হনহনিয়ে চলে গেলো ওখান থেকে। তাশদীদ রুমনের কাধে হাত রেখে শরীরের ভর কিছুটা ছেড়ে দেয়। বা হাতটা লাঠি থেকে বের করে শার্টের ডানহাতা ঠিকঠাক করার চেষ্টা করে। আফিফকে চড় দিতে গিয়ে হাতা নেমে গিয়েছিলো। রুমন কেবল দেখছে তাশদীদকে। অতিকষ্টে কান্না করা থেকে নিজেকে আটকে রেখেছে ও। তাশদীদ হাতা ঠিক করে আবারো লাঠিতে ভর করে দাড়ালো। রুমনের কাধ থেকে হাত সরিয়ে হাসিমুখে বললো,

– নিজের মতো থাকো রুমন৷ কিন্তু এদের মতো কাউকে বলার সুযোগ করে দিও না। তোমার ব্যক্তিত্ব একান্তই তোমার! বুঝেছো?

রুমন চোখ বন্ধ করে নিয়ে মাথা ওপরনিচ করে। ওর দুচোখ বেয়ে জল গরায়। একটা ঢোক গিলে গলা ভেজালো ও। চোখমুখ মুছে নাক টেনে বললো,

– টিনেজ থেকে সত্যিই কিছু ফ্যান্টাসি আছে তাশদীদ ভাই। কিন্তু সেগুলো আমার আত্মসম্মানের সুপিরিয়র না। আমি ওদের কাউকে কোনোদিন সুযোগ দেবো না এমন কিছু বলার।

তাশদীদের হাসি প্রসারিত হয়। আরেকপলক তাথৈয়ের দিকে তাকায় ও। তারপর লাঠিতে ভর করে, খুড়িয়ে খুড়িয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যায় ওকে। তাথৈ স্থির রইলো। পেছন ফিরে তাকালো না। কিন্তু শার্লি-রুমন কৃতজ্ঞতার চোখে তাশদীদের চলে যাওয়া দেখলো। শার্লি একটা চমৎকার হেসে বললো,

– তাশদীদ ভাই ইজ দ্যা বেস্ট!

কথাটা কানে আসতেই কয়েকপা দুরে থেমে যায় তুল্য৷ আফিফ ক্লাসে গিয়ে হুলস্থুল বাধিয়েছে। নিজেরই বইখাতা বেঞ্চ থেকে ফেলে দিয়েছে। বারবার কান থাপড়াচ্ছে, মাথা ঝাড়া মারছে। ওর সাথের দুইটাকে জিজ্ঞেস করেও কেউ কিছু জানতে পারেনি। ক্লাসে তাথৈকে না দেখে তুল্যর সন্দেহ হয়। তাই তৎক্ষণাৎ ক্লাস থেকে বেরিয়ে এসেছে ও। আর করিডোরে এসে সবারআগে শার্লির কথাটা কানে যায় ওর। তুল্যর পেছনপেছন বুজোও এসেছে। তবে ও দাড়িয়ে গেলেও বুজো থামেনি। তাথৈকে দেখলেই যেনো রাজ্যের আদর পাওয়ার ইচ্ছা জাগে ওর। বুজো ছুটে এসে তাথৈয়ের পায়ে গা ঘষতে লাগলো। তাথৈ ওর দিকে স্থিরচোখে চেয়ে থেকে বললো,

– দুরে থাকো। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলেছি। আবারো দূর্বল হয়ে পরতে চাইছি না।

#চলবে…

#কার্নিশ_ছোঁয়া_অলকমেঘ
লেখনীতে: মিথিলা মাশরেকা

২০.

রিংকি বইখাতা সামনে নিয়ে চুপচাপ বসে আছে। ওর দৃষ্টি তাশদীদের পায়ের দিকে। ও পড়ছেও না, লিখছেও না। পড়া বুঝিয়ে দিয়ে দু মিনিট হলো ওর মৌনতা পর্যবেক্ষণ করছে তাশদীদ। তিনদিন পর রিংকিকে পড়াতে এসেছে ও। এ তিনদিনের একদিন ক্লাস থাকলেও ক্যাম্পাসে যায়নি। পায়ের ব্যথাটা এখন আর নেই। তাই পড়াতে এসেছে ও। রিংকির হেলদোল নেই দেখে এবারে মুখ খুললো তাশদীদ। একটা কলম হাতে নিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলো ও। বললো,

– তুমি কি পড়বে না আজ?

– আপনার পায়ে অনেকটা জখম হয়ে আছে তাশদীদ ভাই। অনেকটাজোরে চোঁট পেয়েছিলেন আপনি।

জবাব দিয়ে রিংকি তাশদীদের দিকে তাকালো। তাশদীদ নিজের পায়ের দিক তাকিয়ে পা কিছুটা গুঁটিয়ে নিলো। তামজীদের মতো ওউ ভেবেছিলো, তিনদিনে একদিন না একদিন রিংকি প্রীতিকার্নিশ যাবে ওকে দেখতে। আর সেটাকে ইস্যু করে আরেকদফায় রিংকির বাবার সাথে কথা বলবে ও। কিন্তু ওকে ভুল প্রমাণ করে তিনদিন বাধ্য মেয়ের মতো অনলাইনে পড়েছে রিংকি। মনেমনে খুশি হয়েছিলো তাশদীদ। ভেবেছিলো রিংকি সত্যিই হয়তো নিজেকে সামলে নিয়েছে। কিন্তু এ বাসায় আসার পর আবারো ওর ধারণা বদলাতে শুরু করেছে। তাশদীদ বললো,

– এখন ঠিক আছি আমি।

– কিন্তু এ তিনদিন ঠিক ছিলেন না আপনি।

অতি ধীরে বললো রিংকি। তাশদীদ শুনলো কেবল। কিছু বললো না। সামনেই রিংকির এডমিশন। অযাচিত ঝামেলা চাইছে না ও। আবার না পারছে এসপার ওসপার করতে। সেসময় দরজায় নক করে মেয়েকে কোলে নিয়ে ঘরে ঢুকলো রোজি। ওর পেছনে এক সহকারী খাবাটের ট্রে নিয়ে ঢুকলো। রিংকি অংক করতে লাগলো। তাশদীদ উঠে দাড়িয়ে রোজির মেয়েকে কোলে নিলো। ওর সাথে দুষ্টুমি করতে করতে বললো,

– আরে! তুমিতো দেখতে দেখতেই বড় হয়ে যাচ্ছো লি’ল গার্ল! বাট আম্মুর মতো হওনি। ও দেখতে একদমই তোমার মতো হয়নি দেখতে রোজি।

– ঠিকি বলেছো। আমার ননাসও বলছিলো, ও আমার মতো হয়নি। ও নাকি দেখতে ওর দাদীর মতো হয়েছে। দাদীর নামের প্রথমঅক্ষরে মিল রেখে নামও রেখে গেছে সে।

– তাই নাকি? কি নাম রেখেছে ওর? কি নাম তোমার হুম?

– তাথৈ।

রোজির জবাব শুনে, বাচ্চাটাকে দুলাতে দুলাতে হঠাৎই আটকে গেলো তাশদীদ। কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে রোজির দিকে তাকালো ও। জোরালো হেসে বললো,

– কিহ্?

– তাথৈ। তাথৈ শবনম। ওর দাদীর নাম ছিলো তহুরা শবনম, ওটাতে মিল রেখে ওর ফুপু রেখেছে নামটা। সুন্দর না?

তাশদীদ আবারো বাচ্চাটার দিকে তাকালো। হাত নাড়াচাড়া করে বাচ্চাটা খেলছে ওর কোলে। অজান্তেই চেনা নামটার সাথে ওকে মেলানোর চেষ্টা করতে লাগলো তাশদীদ। খেলতে খেলতে ওর শার্টের কলারের কাছের বোতাম আঁকড়ে ধরলো বাচ্চাটা। ছোট্ট মুঠোটাতে কলারের বোতাম দেখে তাশদীদ শব্দ করে হেসে ফেললো। আপনমনেই বলে উঠলো, ‘এই না হলে তাথৈ! নামের সম্মান রেখেছো বটে!’

টেবিলে থাকা নিজের পানির বোতলটা ঠেলে ফেলে দিয়ে, টুলে বসা থেকে দাড়িয়ে গেলো তাথৈ। উচু থেকে শব্দ করে ফ্লোরে পরলো বোতলটা৷ চমকে উঠে পুরো ক্লাস তাথৈয়ের দিকে তাকালো৷ তুল্য বাদে। বেশ স্বাভাবিকভাবে বইয়ে মুখ গুজে রইলো ও। ল্যাবে আধঘন্টা হলো অপেক্ষা করছে ওরা। তুল্য জানে, এই আধঘন্টা অপেক্ষার বিনিময়ে, কিছু তো ভাঙচুর করা জায়েজ ছিলো তাথৈয়ের। তাই বিন্দুমাত্র অবাক হলো না ও। আওয়াজ শুনে ল্যাব সহকারী আঁৎকে উঠলেন। হাঁক ছেড়ে বললেন,

– এই ছেলেমেয়েরা! কে কি ভাঙলে? এই ল্যাব ক্যাম্পাসের সবচেয়ে এনরিচড ল্যাবগুলোর একটা। তোমরা কি…

– আমার ফ্রেন্ডের বোতল ফ্লোরে পরেছে। কারো টাকের ওপর পরেনি!

খিচানো স্বরে জবাব দিলো শার্লি। সহকারী চুপ করে গেলেন। এবারে বই থেকে চোখ তুলে তাকালো তুল্য। শার্লি এপ্রোন গায়ে পরা বাদ দিয়ে কোমড়ের সাথে বেধে রেখেছে৷ টুলে বসেবসে দাঁত দিয়ে নখ কাটছে। তুল্যর কপালে ভাজ পরে। মনেমনে বলে ওঠে, ‘বেয়াদব মেয়ে একটা! অবশ্য মেয়ে বলছি কেনো? মেয়ের ম টাও নেই ওর মাঝে!’ একবার মোবাইলের ক্যামেরায় বুজোকে দেখে নিয়ে, নিজের পড়ায় আবারো মনোযোগ দেয় তুল্য। তাথৈ দেখলো আশপাশের সবাই ওরদিকে তাকিয়ে আছে। স্পষ্টভাবে বললো,

– ইয়াহ। এইভাবে বেকুবের মতো দেখা আর অপেক্ষা করা ছাড়া তো তোমাদের আর কোনো কাজ নেই রাইট?

– আমিতো ভাবলাম আপনারই কোনো কাজ নেই। এজন্যই আপনি বোতলটা ফেলে দিলেন, যাতে কাজ করতে পারেন। ফ্লোরে বোতল ফেলাটা একটা কাজ, ফ্লোর থেকে বোতল তোলাটাও একটা কাজ।

পাল্টা জবাব শুনে সামনে তাকায় তাথৈ। সেইসাথে বাকিসবারও নজর কারে মাস্ক, এপ্রোন, গ্লাভস পরিহিত যুবক। যুবক হাতের ফাইল কাগজপত্র ডাইসের সামনের টেবিলটায় রাখলো। তাথৈ সব ভুলে তার আশপাশে তাকিয়ে লাঠি খুজলো। পেলোনা। অবশ্য না থাকারই কথা। টুর্নামেন্টের পর বেশ কদিন পেরিয়েছে। আরো একবার যুবকের চোখে তাকায় ও। তার উজ্জ্বল চোখের তারারা যেনো ওকে বলে দেয়, মাস্কের আড়াল থেকে ওকে প্রতিত্তোরকারী অন্য কেউ নয়, তাশদীদ। এমন জবাব তাশদীদ ছাড়া আর কেই বা দেবে ওকে? তাশদীদ ক্লাসের সবার উদ্দেশ্যে বললো,

– প্রজেক্টের জন্য ম্যাম কেবিনে ডেকেছিলেন। এটাই আমার লেইট করার কারন। ওনার সাথে কথাবলার সময় সুযোগ ছিলো না আপনাদের সিআরকে এ বিষয়ে জানানোর। সরি ফর দ্যাট। যদি আপনাদের আরকোনো সমস্যা না থাকে, মে উই?

সবাই ঠিকঠাকমতো নিজেদের গ্রুপ নিয়ে দাড়িয়ে যেতে লাগলো। তাশদীদ প্রতিটা দলকে কাগজ দিলো একটা করে। তাথৈ বোতল তুলে কাজে মনোযোগ দিলো। আড়চোখে কয়েকবার দেখলো, তাশদীদ হাতে ধরে সবাইকে দেখাচ্ছে, শেখাচ্ছে। কিছুকিছু জিনিস নিজের খাতায়ও নোট করছে। শার্লি গা ছাড়াভাবে টেস্টটিউব ঝাকাছিলো। তাশদীদের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,

– এইভাবে হাতেকলমে ল্যাব করালে, অনার্সশেষে নিজেকে হ্যামিল্টন স্মিথের বংশধর বলে পরিচয় দিতে আমার একটুও বুক কাপবে না।

– ম্যাম যখন এনাকে প্রজেক্টের ইনচার্জে রাখছে, তারমানে এই ভাই নিসন্দেহে একজন ভালো স্টুডেন্ট। শুধু একটা জিনিস বুঝলাম না। উনি এখনো নিজের পরিচয়টা দিলো না কেনো? মুখও লুকিয়ে রেখেছে। পরিচয় দিলে কি সমস্যা?

দুদন্ডের জন্য তাথৈয়ের হাত থামে। পুনরায় কাজে মনোযোগ দিলো ও। শার্লির দিকে না তাকিয়েই বললো,

– এধরনের চিন্তা করার জন্য এক্সট্রা মার্কস আছে শার্লি। কিপ ইট আপ।

শার্লি থতমত খেয়ে নিজের কাজে মনোযোগ দেয়। কাজ করতে করতে হঠাৎই কিছু গরমিল লক্ষ করলো তাথৈ। ওর হুট করেই মনে হলো, ওকে দেওয়া এক্সপেরিমেন্টের সাথে প্রজেক্টের ফাইনাল লাইন মিলবে না। কাজ থামিয়ে, শুরু থেকে সবটা আবারো পড়তে থাকে ও। আর সবটা পড়ে আনমনেই বলে ওঠে, ‘মিলছে না।’
এটুকো শুনে শার্লিসহ ওর দলের বাকিরা কিছুটা অবাক হলো। তাথৈয়ের করা এক্সপেরিমেন্টে ফাইনাল রেজাল্ট আসবে না, এমনটা আশাতীত ছিলো ওদের। কারন তাথৈয়ের হাত পরীক্ষণে এতোটাই পাকা যে, আগের সেমিস্টারগুলোতে যেখানে আলো, তুল্যরও মেলাতে দুই থেকে তিনবার পরীক্ষণ দেখাতে হয়েছে, তাথৈয়ের সেটা প্রথমবারেই মিলে গেছে। কিন্তু এবার সেই তাথৈয়েরই মিলছে না। শার্লি বললো,

– মিলছে না মানে? তোর ভুল হয়েছে?

– না। আমাদের ফেইল করাতে ইনচার্জ ইচ্ছে করে হেডলাইনে উনিশবিশ করেছে।

শান্তশিষ্ট জবাব দিলো তাথৈ। শার্লির চোখ কপালে ওঠে। বড়বড় চোখ করে আশেপাশে তাকায় ও। বাকি দলগুলো বেশ মজায় মজায় নিজেদের কাজ করছে। ইনচার্জ আলোর দলকে কিছুএকটা শেখাতে ব্যস্ত। তাথৈ কিছুক্ষণ চুপ থেকে পেছন ফিরলো। আলোর কলম পরে গিয়েছে নিচে। ওটা তোলার জন্য নিচু হয়েছে ও। ওঠার সময় টেবিলের কোনায় মাথা লেগে যায় ওর। কিন্তু সৌভাগ্যবশত চোট লাগে না। কেননা তাশদীদ আগে থেকেই টেবিলের কোনে হাত রেখে কথা বলছিলো। শার্লি বিস্ময়ে বললো,

– এত্তো কেয়ারিং একটা মানুষ ইচ্ছে করে আমাদের ফেইল করাবে?

– এই এক্সপেরিমেন্ট আমি করবো না!

শার্লিকে জবাব না দিয়ে নিজের মত জানালো তাথৈ। উচ্চস্বর শুনে পুরো ক্লাস আরো একবার ওর দিকে তাকায়। এবারেও তুল্য হতাশ। বিরক্তি নিয়ে ঘাড় ডলতে ডলতে জবাব দিলো,

– তো বের হয়ে যা না ল্যাব থেকে! তোকে কে জোর করেছে?

তাথৈ হাত মুঠো করে দাড়ায়। তাশদীদ তুল্যকে নিজের কাজ করতে বলে তাথৈদের টেবিলে এগোলো। ল্যাবের এককোনে আফিফ আর ওর সাথের ছেলেগুলো মনেপ্রাণে চাইতে থাকে, এই তেজ দেখানোর জন্য ইনচার্জ ওকে বার করে দিক। তাশদীদ দেখলো তাথৈ পরীক্ষণের সবটা ঠিকঠাকই রেখেছে। বুকে হাত গুজে অতি নম্র গলায় বললো,

– ইয়েস? কি সমস্যা?

– গতসপ্তাহে ডিএনএ ইলেকট্রোফোরেসিস করিয়ে এ সপ্তাহে আমাদের আরএনএ ইলেকট্রোফোরেসিস টাস্ক দেওয়ার কি মানে?

তাথৈ টের পেলো, মাস্কের আড়ালে তাশদীদ হাসছে। তবে স্বাভাবিক ভঙিতে মুখে বললো,

– আপনাদের ফেইল করানের জন্য।

– আই নো দ্যাট। কিন্তু এমনটা আমি হতে দিচ্ছি না। আপনার এগেইনিস্টে ম্যামকে কম্প্লেইন করবো আমি। এই দশটা মার্কের দাম আপনার কাছে না থাকলেও আমার কাছে আছে।

– হ্যাঁ যান সমস্যা নেই। যাকে খুশি তাকে গিয়ে কম্প্লেইন করুন আপনি।

তাথৈ মুখের মাস্ক, গায়ের এপ্রোন খুলে ফেললো। বড়সর দম নিয়ে পা বাড়ালো ল্যাবের বাইরে আসবে বলে। তাশদীদ পেছন থেকে গলা উচিয়ে বললো,

– বাট ম্যাডাম, আপনি যাকে কম্প্লেইন করতে যাচ্ছেন, সেই আমাকে বলেছে আপনাদের হুবহু টাস্ক না দিতে। আপনার কম্প্লেইন কি তিনি আদৌও গ্রহন করবেন?

তাথৈ থামলো। পেছন ফিরে বললো,

– ম্যাম এটা বলতে পারেন না! এটা সিলেবাসে নেই! টোটাল ওয়েস্ট অফ টাইম!

– ম্যাম সবই পারেন। তাছাড়া এটাকে ওয়েস্ট অফ টাইম বলছেন কেনো? এটার দাম তো সেই দশ নম্বর, কিছুক্ষণ আগে যেটাকে আপনি মহামুল্যবান বলছিলেন।

তাথৈয়ের যুক্তি ফুরায়। তাশদীদ নিশব্দে হেসে আবারো বললো,

– ডিপার্টমেন্ট জানে, আপনারা শুধু নম্বরের লোভে মুখস্ত করছেন। শেখার উদ্দেশ্যে না৷ এতো ইজিলি আপনারা মুখস্তবিদ্যা চালিয়ে নম্বর পেয়ে যাবেন, ডিপার্টমেন্ট তো আর সেটা হতে দিতে পারেনা বলুন? সো দিস ওয়াজ কাহানী মে টুইস্ট। আমি এক্সপেরিমেন্ট করাবো একটা, আর টাস্কে দিবো রিলেটেবল আরেকটা। যদি মেইন থিওরিতে কোনো সমস্যা হয়, আই’ল বি দেয়ার। কিন্তু এই রিলেট করার প্রসিডির আপনারা নিজেরা আবিষ্কার করবেন। নাও কাম, এন্ড ফিনিশ দ্যা টাস্ক। আমার দেওয়া পেপারে মেইন থিওরি দেওয়া আছে।

তাথৈয়ের ম্যামের ওপর রাগ হলো। যে টাস্ক তাশদীদ করিয়েছিলো, তা করতে ওর তাশদীদের পেপারও লাগতো না। ওটা তো আগেই মুখস্ত করে এসেছে ও। কিন্তু নতুন টাস্ক করতে আলাদাকরে মাথা খাটাতে হবে। আর সেটা ফাইনালে আসবে না। এটুক ভেবেই রাগ হলো ওর। টেবিলের সামনে এসে দাড়ালো তাথৈ। পুরো পরীক্ষণটা পুনরায় করতে হবে ওর। দলের বাকিদের কাজ বুঝিয়ে দিয়ে, পরীক্ষণযন্ত্রটা খোলার জন্য রাগ নিয়ে হুঁক টানতে লাগলো ও। কিন্তু খুলতে পারছে না। বেশ জোরে টানাটানি করার পরেও হুক খুলছে না। হঠাৎই ওর ডানপাশ দিয়ে একটা হাত হুকটা ধরে৷ কেপে উঠে ঘাড় ঘুরায় তাথৈ। হাতের মালিক একদম ওর ডানকাধের ওপর মাথা এগিয়েছে। তাথৈ বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে রইলো তার দিকে। তাশদীদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সামনের যন্ত্রটায়। হুকটা দক্ষ হাতে খুলে দিয়ে তাথৈয়ের দিকে তাকালো ও। বললো,

– রাগ নামক এই অপ্রয়োজনীয় আবেগকে কন্ট্রোল করুন ম্যাডাম। অহেতুক রাগ দেখালে আমি আপনার নম্বর কাটতে বাধ্য হবো।

শান্ত ভঙিমায় রীতিমতো ধমকি দিয়ে সরে যায় তাশদীদ। তাথৈ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ওর চলে যাওয়ার দিকে। আজ প্রথমবারের মতো কারো ধমকি শুনে ওর রাগ হলো না। বরং রাগে উষ্ণ হয়ে থাকা রক্তস্রোত যেনো শীতলতা অনুভব করলো। প্রথমবারে প্রতিক্রিয়া করার সুযোগ পেয়েও ও প্রতিক্রিয়া দেখালো না। দমকা হওয়ার মতো উড়ে এসে মনজুড়ে ভর করলো স্থিরতা। প্রথমবারের মতো ওর মনে হলো, সত্যিই রাগ অপ্রয়োজনীয় আবেগ। অজান্তেই নিজেকে স্থির রাখা, অকারন রাগ দমন করতে শেখা, নিজের সবটা পরিবর্তন অনুভব করলো তাথৈ। তাশদীদ ওকে রাগানোর জন্যই কথাটা বলেছে সেটাও বুঝলো। কেবল বুঝে উঠতে পারলো না, এই অপ্রয়োজনীয় আবেগকে দমন করতে জানা প্রয়োজনীয় আবেগ ও কবে আয়ত্ত করছে। কার জন্য সেই প্রয়োজনীয় আবেগ ওর কাছে গুরুত্ব পাচ্ছে। পরিণতি কি সে আবেগের। তার শেষই কোথায়। সবচেয়ে বড় কথা, তাথৈ আলফেজকে দমিয়ে দেওয়া সে প্রয়োজনীয় আবেগের, নামই বা কি?

#চলবে…

#কার্নিশ_ছোঁয়া_অলকমেঘ
লেখনীতে: মিথিলা মাশরেকা

২১.

– আর ইউ সিরিয়াস? ওই আফিফের কথার জন্য চারদিন হলো ক্যাম্পাস যাসনা তুই?

তীব্র আক্রোশে কথাটা বললো শার্লি। রুমন বিছানায় মাথা নিচু করে বসে আছে। ওর পড়ার টেবিলের চেয়ারটায় তাথৈ বসে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। গত তিনদিন রুমন ক্যাম্পাসে যায়নি। কেবল টুকটাক ম্যাসেজে কথা হয়েছে ওদের। তাথৈ শার্লি ভেবেছিলো যাই হয়ে যাক, একটু সময় নিয়ে রুমন আগের মতো ঠিক হয়ে যাবে। তাই তিনদিন ওর ক্যাম্পাস না যাওয়াতেও ওরা বলেনি কিছু। কিন্তু আজকে যখন ক্যাম্পাসে গিয়ে দেখেছে রুমন আসেনি, দুজন মিলে সোজা বাসায় চলে এসেছে ওর। রুমনের বাবা ব্যবসায়ী মানুষ, মা গৃহিণী। ওর ছোট ভাই আছে একটা। তাথৈ শার্লিকে চেনে সবাই। ওরা বাসায় আসায় বেশ হয় রুমনের মা। দশমিনিট হলো ওরা রুমনের ঘরে এসেছে ওর সাথে কথা বলার জন্য। আর এটুক সময়ে রুমন শুধু বলেছে, ‘ওর ক্যাম্পাস যাওয়ার ইচ্ছে নেই।’ তারপর থেকে শার্লি অনেককথাই বলেছে। কিন্তু রুমন নিরব থেকেছে। তাথৈ মুখ খুললো এবারে। বললো,

– ক্যাম্পাস যাসনি কেনো?

– সেমিস্টার ব্রেক চলছে। অবশ্য ক্লাস থাকলেও আজ ভার্সিটি যেতাম না।

– পড়াশোনা ছেড়ে দিচ্ছিস?

– বেচে থাকার অবলম্বনকে কি করে ছেড়ে দেই বল? আমি শুধু সময় চাইছি।

– তোর মনে হয়না তুই আফিফের মতো কারো কথায় একটু বেশিই ভাবছিস?

রুমন চোখ তুলে চাইলো। মৃদ্যু হেসে বললো,

– ভাবার কারন আছে বলেই ভাবছি। ও আমাকে কিছু বললে আমি সেটা কানে তুলতাম না তাথৈ। কিন্তু ও তোকে নিয়ে…

রুমন কথা শেষ করে না। তাথৈ শার্লি প্রসারিত চোখে চেয়ে রইলো ওর দিকে৷ শার্লি কিছু বলতে যাবে, তাথৈ ওকে থামিয়ে দিয়ে বললো,

– তুই এটা ভালো করেই জানিস, আমি তা কানে তুলিনি।

– সেটা তোর ভুল।

রুমনের এ হেন স্পষ্ট জবাব শুনে তাথৈ শার্লির বিস্ময় সীমাপার করলো। থমকে রইলো তাথৈ। শার্লি রীতিমতো কথা বলাই ভুলে গেলো যেনো। তাথৈ আস্তেধীরে উঠে দাড়ালো। ওকে দাড়াতে দেখে রুমনও দাড়িয়ে গেলো৷ তাথৈ শক্ত কন্ঠে বললো,

– ফাইন৷ কিন্তু আমার ভুলটা তুই ঠিক কিভাবে শুধরাতে চাইছিস? আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়ে?

– প্রয়োজন হলে সেটাই করবো।

– তুই কি পাগল…

শার্লি তেড়ে এগিয়ে আসছিলো। সে সময় ওয়ারড্রোবের ওপরের একটা বড় ফাইল ওর হাতের সাথে লেগে নিচে পরে যায়। থেমে যায় শার্লি। ফ্লোরে পরে একটা ডকুমেন্ট ফাইলের বাইরে বেরিয়ে আসে। তাথৈয়ের চোখ যায় কাগজটায়। ওটা দেখেই চোখ ভরে উঠলো ওর। রুমন চুপচাপ এসে ফাইলটা তুললো। শার্লি আবারো কিছু বলতে যাবে, তাথৈ আটকে দিলো ওকে। রুমনের দিকে তৃপ্ত হেসে বললো,

– আ’ম প্রাউড অফ ইউ রুমন!

– আ’ম অলসো প্রাউড অফ মি তাথৈ।

শার্লির কিছুই বুঝে আসলো না। তাথৈ ওর হাত ধরে টেনে ওকে নিয়ে বেরিয়ে যায়। ওরা চলে যেতেই কল আসে রুমনের নম্বরে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, রুমন ম্যাসেজ চেক করলো৷ ওপাশের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়ে জবাব লিখলো,
‘সমস্যা নেই। আপনি যে কয়েকদিন বলবেন, আমি থাকতে পারবো ওখানে। সেমিস্টার ব্রেক চলছে। একজন অনেকবড় স্টেপ নিয়েছে আমার জন্য। আর আমি তাকে নিরাশ করবো না। আই’ল ডু মাই বেস্ট!’

তাশদীদ শান্ত, টিটুকে নিয়ে ক্যাফেটেরিয়ায় বসেছে। পড়া, পড়ানোসহ নানানদিক সামলাতে গিয়ে তাশদীদের কেটে গেছে এ কদিন। ক্যাফের টিভিতে নিউজ চলছে, সেদিকে শান্ত-টিটুর গভীর মনোযোগ। তাশদীদের কানেও আসছে খবরটা। সেরকম আগ্রহ না দেখিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিলো ও। শান্ত বললো,

– এ ব্যাটা তো নোবেল পেয়ে যাবে এ বছর৷

– দেখ! এরাও পড়াশোনা করে, আর আমরাও! এরা পড়াশোনার পাশাপাশি আবিস্কার করে। আর আমাদের দেশে পড়াশোনার পাশাপাশি কি শেখায়? ডিমভাজার প্রনালী! ছ্যাহ্!

টিটু টিপ্পনী কাটলো। শান্ত তাশদীদের দিকে তাকালো। ও অদ্ভুতভাবে হাসছে। ব্যাপারটা যেনো পছন্দ হলো না শান্তর। বললো,

– তুই হাসছিস?

তাশদীদ তেমনভাবেই হাসতে লাগলো। এবার টিটুও বললো,

– আসলেই। তুই হাসছিস কেনো তাশদীদ? এমন দুচারটে ইনভেনশন তো তোর মাথা থেকেও বের করতে পারিস। আমরা না হয় পড়াশোনা করিনা। পড়লেও মুখস্ত, গবেষণা টবেষনার ধার ধারিনা। কিন্তু তুই তো চুপা রুস্তম৷ আগের ভার্সিটিতে এতো না লুকিয়ে চুরিয়ে প্রজেক্ট করতি, এক্সপেরিমেন্ট করতি। কি পেলি তার বিনিময়ে?

– ওসবের বিনিময়ে আমাকে কিছু পেতেই হবে, আমি এমনটা ভাবিনি। তোরা কেনো ভাবছিস?

– কারন পেপেরোমিয়ার ডিএনএ তে বায়োলুমিনেন্টের ডিএনএ রিকম্বিনেশনের আইডিয়াটা তোর ছিলো।

শান্তর কথা শুনে হুট করেই তাশদীদের মুখের হাসিটা গায়েব হয়ে যায়। আশপাশ তাকিয়ে জোরালো হাসলো তাশদীদ। বললো,

– কি বলছিস? আমার আইডিয়া কেনো হবে? আর সেটা টরোন্টোতে কেনো?

– কেনো? যেতে পারে না? তোর ডিপার্টমেন্টের প্রফেসরের ছেলে তো টরোন্টোতে পড়ছে তাইনা? কি নাম যেনো তার? জেইন?

টিটু বড়বড় চোখে একবার তাশদীদের দিকে, একবার টিভিতে তাকালো। লুচিপাতায় জীবদ্যুতির উদ্ভাবক হিসেবে নিউজের হেডলাইনে জেইন নামটা ভাসছে। তাশদীদ একদৃষ্টিতে শান্তর দিকে তাকিয়ে আছে। টিটু কিছু বলার আগেই শান্ত কথা ঘোরালো। কোকের বোতলে চুমুক দিয়ে ট্যুরের পরিকল্পনা করতে লাগলো। কখন, কোথা থেকে, কিভাবে যাবে, খাবে, ঘুরবে, এইসব। সিনিয়র ব্যাচের রাজনৈতিক মুখ বলে পুরো গুরুদায়িত্বটা এসেছে ওর ওপর। ওকে বলতে দেখে টিটু কিছু বলার চেষ্টা করলো। কিন্তু এবার তাশদীদ থামিয়ে দিলো ওকে। বললো,

– প্লানের ফল্ট খোজ টিটু। যতোগুলো ফল্ট পাবি, ট্যুরে তার দশগুন ডিসকাউন্ট দেবো তোকে।

বাকিসব ভুলে গেলো টিটু। মনযোগী হলো শান্তর পরিকল্পনায় খুঁত ধরতে। শান্ত বলা শেষ করলে তাশদীদ টিটুকে বলতে বললো টিটু গলা ঝেরে বলতে শুরু করলো,

– আমি তোর হিসাবে দুইটা জায়গায় ফল্ট দেখলাম শান্ত। তুই যাওয়ার দিন ব্রেকফাস্টে কেক, আপেল আর জুস কেনো রাখলি? ডিম কেনো রাখলি না? আর ঝর্নায় যাওয়ার সময় বললি টংয়ে চা খাবি। ওখানে গেলে কি শুধু চা খাওয়া যাবে পাগল? কিছু এদিকসেদিকের জন্যও টাকা তোল?

কথাটা বলে ‘ক্ক্যা’ শব্দ করলো টিটু। ওর কথা শুনে তাশদীদ কপাল ডলার ভঙিমায় মুখ লুকালো। শান্ত কিছুক্ষণ অবিশ্বাস্য চোখে টিটুর দিকে তাকিয়ে রইলো। এরপর ওরদিক আঙুল তুলে তাশদীদকে বললো,

– এটাকে কি করা যায় বলতো? ওখানে গিয়ে সমুদ্রে ভাসিয়ে দেবো? নাকি পাহাড় থেকে নিচে ফেলে দেবো? কোনটা বেটার হবে?

– পাহাড় থেকে এমনভাবে ফেলবি যাতে নিচে সমুদ্রে পরে ভেসে যাই। প্লিজ এটা কর। আমি দুইটারই এক্সপেরিয়েন্স নিতে চাই।

টিটু দাত ক্যালালো। বোতল তুলেই ওকে মারার ভঙিমা দেখালো শান্ত। টিটু হুরমুরিয়ে চেয়ারসমেত পিছিয়ে যায়। শব্দ করে হেসে দিলো তিনজনে। তাশদীদ একটুপর হাসি কমিয়ে বললো,

– সেকেন্ড ইয়ারের ফাইনাল শেষ হয়েছে রে শান্ত?

– না। পরশু ভাইবা শেষ। এদের জন্যই ট্যুরের ডেইট ডিলে করছিলো টিচাররা।

তাশদীদ মাথা ঝাঁকালো। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বরাবর তাকাতেই দেখলো শার্লি সিনিয়র এক মেয়ের পেছনপেছন ক্যাফেটেরিয়ায় ঢুকছে। সবসময় আলাদা ভাবে চলা শার্লিকে আরেকজনের পেছনে ঘুরতে দেখে কপাল কিঞ্চিৎ কুঁচকে আসলো তাশদীদের। শার্লির সামনের মেয়েটা এসে ওদের পাশের টেবিলে বসলো। শার্লিও হন্তদন্ত হয়ে ওর পাশে বসে গেলো। কিছু বলতে যাবে, মেয়েটা বললো,

– যাও আগে চা আনো! তারপর শুনছি।

ওর এমন আদেশ শুনে শার্লি টু শব্দটাও করলো না। দ্রুত গিয়ে চা নিয়ে আসে ও। তাশদীদের আগ্রহ বাড়লো। ও মনোযোগী হলো শার্লির দিকে। এপাশে টিটু শান্তকে ট্যুরের টি-শার্টের ডিজাইন দেখাতে ব্যস্ত। ওপাশে শার্লি বললো,

– আপু বুঝতেই পারছেন, আমার সিজির অবস্থা করুন। ফার্স্ট ইয়ারের ভাইভাতে যে পরিমানে বাঁশটা খেয়েছি, সেটা আর এবছর খেতে চাইছি না। সেবার এক্সটার্নাল আমাকে মুখের ওপর এটিচিউড নিয়ে কথা শুনিয়েছিলো। টু আউট অফ ফোর দিয়েছিলো। এবারে একটু ভালো করতে চাই আপু, প্লিজ হেল্প করুন। প্লিজ! আপনি ছাড়া আর কোনো সিনিয়রের সাথে আমার তেমন যোগাযোগ নেই। আর আপনার গত সেমিস্টারের ভাইভাতে এ প্লাস। একটু আমাকে হেল্প করুন। প্লিজ। প্লিজ!

ব্যাপারটা বুঝে আসলো তাশদীদের। ভাইভা ম্যানার শেখার জন্য শার্লি এই মেয়ের পেছনে ঘোরাঘুরি করছে। মেয়েটা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে, গা ছাড়াভাবে বললো,

– ওকে ওকে। আমি তোমাকে কয়েকটা টপিক…

– আপু পড়ার টপিক নিয়ে ঝামেলা নেই। ওটা আমাকে তাথৈ কভার করে দেবে। আগেরবার যা হয়েছে তা শুধু আমার বিহেভ…

– এক্সাক্টলি! ঠিকই করেছে এক্সটার্নাল! বেয়াদ্দপের বেয়াদ্দপ তুমি! ডি কেনো দিয়েছে তারা তোমাকে? তোমার তো ফেইল করা উচিত!

হুট করে মেয়েটার ক্ষিপ্ত মেজাজ দেখে শার্লি পুরো বোকাবনে যায়। ওর বুঝে আসলো না এমুহূর্তে তার এমন ব্যবহারের কি কারন। আগেরলাইনেই তো ওকে হেল্প করবে এমনটা বলছিলো। শার্লি কপাল কুচকে বললো,

– কি সমস্যা আপু? একটুআগেই তো আপনি আমাকে হেল্প করতে চাইছিলেন। কি হলো হঠাৎ আপনার? কিসের আক্রোশ আমার ওপর ঝারছেন?

মেয়েটা আরো তেতে উঠলো এবারে। রাগ নিয়ে উঠে দাড়িয়ে বললো,

– যা খুশি করো তুমি! টপিক নাও তোমার ওই তাথৈয়ের কাছ থেকেই! আর ম্যানারটাও ওর কাছ থেকেই শিখে নিও! গো টু হেল! জাস্ট গো টু হেল!

ব্যাগ নিয়ে হনহনিয়ে চলে যায় মেয়েটা। মেয়েটার রাগের কারন বুঝে শার্লি কপাল চেপে ধরে। মেয়েটা চাইছিলো ওর দেওয়া টপিক পড়ে ভাইভা দিক ও। কিন্তু তার আগেই ও তাথৈয়ের কথা বলে ফেলেছে। বলবেই না কেনো? আগেরবার ভাইভাতে সবাই বলেছিলো, তাথৈয়ের বলা টপিকের বাইরে একহরফও আসেনি। শুধু ও সুযোগ পায়নি জবাব দেওয়ার। তারআগেই এক্সটার্নাল ওকে বেরিয়ে যেতে বলেছিলো। অকস্মাৎ ওর সামনের চেয়ারে এসে বসে যায় তাশদীদ। শার্লি চমকে তাকায়। তাশদীদ টেবিলে আঙুল দিয়ে শব্দ তুলে বললো,

– হোয়াটস আপ শার্লি? পরীক্ষার মাঝে ক্যাম্পাসে কেনো? কাল-পরশু ভাইভা না তোমাদের?

– আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন তাশদীদ ভাই?

নিজেকে সামলালো শার্লি। শান্ত-টিটু নিজেদের মধ্যেকার কথা থামিয়ে তাশদীদের দিকে তাকিয়ে আছে। তাশদীদ হাসিমুখে সালামের উত্তর নিলো। বললো,

– আলহামদুলিল্লাহ আমি ভালো। তোমার কি অবস্থা বলো! থিওরি কেমন গেলো?

– আর কেমন যাবে বলুন? যেমন স্টুডেন্ট, তেমনই গেছে।

দৃষ্টি নামিয়ে আস্তেকরে জবাব দিলো শার্লি। তাশদীদ মুচকি হাসলো। টেবিলের সামনে কিছুটা মাথা ঝুকিয়ে ধীরস্বরে বললো,

– টেল মি আ থিং শার্লি? তোমাদের ক্লাসের টপাররা হেল্পফুল না?

শার্লি তৎক্ষনাৎ চোখ তুলে চায়। তাশদীদের আগ্রহী চাওনি দেখে বুঝতে পারে, কিছুক্ষণ আগে ও যে মেয়ের পিছনে পড়াশোনার বিষয়ে ঘুরছিলো, সেটা টের পেয়েছে সে। শার্লি স্বাভাবিক হয়ে জবাব দিলো,

– না ভাই। এমনটা না। টপাররা প্রত্যেকেই অনেকবেশি হেল্পফুল। তাথৈ, আলো, তুল্য ওরা সবাই সবাইকে হেল্প করে। কিন্তু কেউ হেল্প তো তখনই করবে, যখন তার কাছে হেল্প চাওয়া হয় তাইনা? আর আমি এমন সমস্যায় পরেছি যে…

– একটা সিক্রেট বলি?

তাশদীদ শার্লিকে শেষ করতে দেয় না। ওর এমন নুয়ানো আওয়াজ শুনে কিছুটা চকিত চোখে চায় শার্লি। তাশদীদ মুখের কাছে হাত নিয়ে, গলার আওয়াজ আরো বেশি খাদে নামিয়ে বললো,

– আই হ্যাভ আ সুপারপাওয়ার। আমি যে কারো, যে কোনো প্রবলেম সলভ করতে পারি। আমার কাছে সবার সবরকমের সমস্যার সমাধান আছে।

তাশদীদের ছেলেমানুষি দেখে শার্লি শব্দ করে হেসে দিলো। তাশদীদ তেমনই ফিসফিসিয়ে বললো,

– আরে আরে! আস্তে হাসো! তোমার হাসি দেখে মানুষ যদি আমার এই সুপারপাওয়ার সম্পর্কে জেনে যায়, তাহলে সবাই সবার প্রবলেম নিয়ে চলে আসবে আমার কাছে। দেখা গেলো, চোর এসে বলছে, আমি চুরি করতে গিয়ে ধরা পরে যাই, এর সমাধান দিন। ডাকাত এসে বলছে, আমি ডাকাতি করতে গিয়ে ধরা পরে যাই, সমাধান দিন। তুমি বুঝতে পারছো? ব্যাপারটা জানাজানি হলে আমার শক্তির কেমন অপব্যবহার হতে পারে?

শার্লি মজা পেলো। নিজেও এবার ফিসফিসিয়ে বললো,

– ওকে…আমি কাউকে বলবো না। বিনিময়ে আমার প্রবলেমটা সলভ করে দিন তাশদীদ ভাই। প্লিইইইজজজ…

তাশদীদ পেছনের সিটে হেলান দিয়ে আয়েশে বসলো। শার্লি হেসে কথা বলছে ওর সাথে। পাশেরটেবিলে বসা শান্ত টিটু তাশদীদ আর শার্লির কথোপকথন শুনতে পেলো না। টিটু কপাল কুঁচকে বললো,

– কি চলে রে ওখানে শান্ত?

শান্ত শার্লির হাসিমুখ থেকে দৃষ্টি সরালো না। কেবল মুগ্ধ হেসে বললো,

– কি চলে সেটা জানিনা। তবে তাশদীদ একটা ম্যাজিক, এ কথাটার আবারো প্রমাণ পেলাম। ওর সংস্পর্শে এসে বায়োকেমের বিখ্যাত টমবয় শার্লিও গার্লি বিহেভ করতে শুরু করেছে দেখ!

#চলবে…