কালিনী পর্ব-০৩

0
1

#কালিনী
#আরেব্বা_চৌধুরী
#পর্ব_সংখ্যা ০৩

বাবা ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেলো।
চোখ দুটো কেবল বুজে এসেছিলো, ক্লান্তির চাদরে শরীর যখন ধীরে ধীরে ঢলে পড়ছিলো ঘুমের কোলে, তখনই হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে ধক করে জেগে উঠলাম।
ঘড়ির কাঁটা তখন প্রায় বারোটা ছুঁই ছুঁই।
ঘুম জড়ানো চোখে ধীরে ধীরে উঠে দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম।

চৌকাঠে দাঁড়িয়ে বাবা। চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ, ঘামে ভেজা কপাল, যেন কোনো যুদ্ধে হেরে ফেরা সৈনিক।
আমি উদ্বিগ্ন হয়ে বললাম,
-এত রাত করলে কেনো বাবা? খেয়েছো কিছু?
বাবা শুধু মাথা নাড়লেন।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কিছু বলার শক্তি যেন অবশিষ্ট নেই তার।
বুকে কেমন খোঁচা লাগলো,
বুঝলাম, আজও হয়তো ভালো কিছু হয়নি, হয়তো কোথাও আবার অপমানের বৃষ্টিতে ভিজতে হয়েছে আমাদের একমাত্র আশ্রয়টাকে।।
বাবার পায়ের শব্দ মিলিয়ে যেতে লাগলো।

আমি চুপচাপ নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। চোখ দুটো বারবার জ্বলজ্বল করছিলো, ঘুম আসছিলো না। কত কথা মনে ঘুরপাক খাচ্ছিলো, তবুও নিজেকে শক্ত করে বিছানায় পড়ে থাকলাম।

পরদিন সকালেই বাবা সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন,
-চারদিন পর আমার বিয়ে।
এই অল্প ক’দিনেই সব কিছু গুছিয়ে নিতে হবে।
বাড়িতে একটা ব্যস্ততা ছড়িয়ে পড়লো। বাবা যেনো মুখে কোনো কথা না বলেও হাজারটা দায়িত্ব নিয়ে ফেললেন।

সন্ধ্যার পর, বাবা ঘরে ঢুকে বললেন,
-তোর মায়ের গহনার বাক্স বের করে দে তো মা।

আমি মায়ের কাঠের সিন্দুকটা টেনে নিয়ে এলাম।
খুলতেই একটা পুরনো নাকফুল, ছোট্ট দুটো কানের দুল আর পাতলা সোনার বালা চোখে পড়লো।
গহনা বলতে এটুকুই, খুব দামি কিছু না হলেও, এই গহনাগুলোতে মায়ের দিনের পর দিন ঘাম লেগে ছিলো।

বাবা নিঃশব্দে গহনাগুলো হাতে নিলেন। চোখে এক অদ্ভুত দৃষ্টি।
-সাবরিন, জেরিন ভালো ঘরে আছে, সুখে আছে, ওদের কোনো কিছুতে অভাব নেই।
তুই তো আমার ছোট মেয়ে।
এই গহনাগুলো তোর মায়ের শেষ স্মৃতি, এগুলো তুই তোর সঙ্গে করে নিয়ে যাস।
তোর শ্বশুরবাড়ির লোকজন দেখলে বুঝবে, তোকেও আমরা যত্ন করে পাঠাচ্ছি।
আর মায়ের স্মৃতি তো তোকে আগলে রাখবেই।

বাবার কণ্ঠে কোনো গর্ব নয়, ছিলো শুধু একরাশ ক্লান্তি আর অপার ভালোবাসা।
আমার চোখে জল এসে গেলো, শব্দ করে কিছু বলতে পারলাম না, শুধু মায়ের নাকফুলটা হাতের মুঠোয় চেপে ধরে রইলাম।

পরের দিন সকাল হতেই বাবার ব্যস্ততা বেড়ে গেলো। টুকটাক বাজার সদাই করে আনলেন তিনি। আশপাশের কেউ না শুধু বরযাত্রীদের মুখে যাতে একফোঁটা অভাব না পড়ে, সেই চেষ্টাটুকুই যেনো তাঁর কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
বড় আপা মেজো আপাকে ফোনে জানিয়ে দিলেন, বিয়ের দিন সকালেই যেনো এসে পড়ে।
তারা তো আবার গ্রামের ধুলাবালি সহ্য করতে পারে না, তাই আগে আসার কথা বলা হলো না।

মেজো দুলাভাই অবশ্য চুপিচুপি আরেক কাজ সেরে ফেলেছেন।
লুকিয়ে বিকাশে দশ হাজার টাকা পাঠিয়ে দিলেন বাবার নাম্বারে।
সঙ্গে ছোট্ট একটা বার্তা,
-এই টাকাটা দিয়ে তুরিনকে ওর পছন্দ মতো কিছু কিনে দিয়েন।

এই দায়িত্বটা যে মূলত আপাদের পালন করার কথা ছিল, সেটা কারও অজানা নয়।
তবুও মেজো দুলাভাই প্রায়ই এমন নিঃশব্দে পাশে দাঁড়াতে চান। যেনো পরিবারের এক অভিভাবক, এক অদৃশ্য ছায়া।
তাঁর হৃদয়ে যেনো আলাদা একটা দায়বোধ কাজ করে, তুরিন তাঁর বোন না হয়েও যেনো আপন হয়ে গেছে।

তবে বাবা এমন মানুষ নন, যিনি সহজে কারও সাহায্য নিতে পারেন।
তিনি বিশ্বাস করেন,
যে সাহায্যে পরবর্তীতে মেয়ের সংসারে প্রশ্ন ওঠে, সে সাহায্য বিষের চেয়েও কম নয়।

তবুও আজ তিনি টাকাটা ফিরিয়ে দিলেন না।
কারণ, এটুকু ভালোবাসার উপহার,
এই টাকায় নেই কোনো শর্ত, নেই কোনো দেনাপাওনার হিসেব।

বাবা টাকাটা আমার হাতে দিয়ে বললেন,
-আজ না হয় তুই তোর নিজের প্রয়োজনীয় কয়েকটা জিনিস কিনে নিস এই টাকা দিয়ে।

আমি চোখ নামিয়ে আস্তে বললাম,
-এই টাকা তুমি অন্য কোনো কাজে লাগাও বাবা। আমার কিছু দরকার নেই।

বাবা মৃদু হেসে একমুঠো আশ্বাসে বললেন,
-এই টাকাটা না পেলেও আমার বাজারটা হতোই।
এটা তো আমার কল্পনায়ও ছিলো না।
যা কল্পনায় ছিলো না, তার কোনো হিসেব হয় না মা।
তার চেয়ে বরং দু-একটা শাড়ি কিনে নে।
ও বাড়িতে তো তোরও একটা মুখ আছে, গরিবের মেয়ে বলে কি খালি হাতে ওবাড়ি যাবি।

বাবার কণ্ঠে ছিলো না কোনো অভিযোগ, ছিলো না কোনো অভিমান,
ছিলো শুধু অপার স্নেহ আর অভিজ্ঞ জীবনের শান্ত গ্লানি।
সেই গলায় যেনো লুকিয়ে ছিলো এক অনুচ্চারিত প্রার্থনা,
এই সংসারযাত্রা যেনো মেয়ের জন্য মসৃণ হয়, সম্মানের হয়, মাথা উঁচু করে বাঁচার মতো হয়।

আমি চুপ করে রইলাম।
বাবার দিকে তাকিয়ে মনে হলো,
আমার এই সাদামাটা বিয়ের আড়ালে একটা রাজপ্রাসাদের মতো স্বপ্ন তিনি গড়ে তুলেছেন,
নিজের সমস্ত কষ্টের ইট দিয়ে।

হরহামেশা বাড়িতে পরার মতো আমি নিজের জন্য তিনটা সাধারণ শাড়ি কিনলাম মাটি ছোঁয়া রঙ, নরম সুতির ছোঁয়া।
সাথে প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস, যেগুলো এক নতুন জীবনের শুরুতে লাগে।

আশপাশের চাচিরাও পাশে দাঁড়ালেন, দু-একটা শাড়ি, থালা-বাটি, মগ, গামলা যে যা পেরেছেন, দিলেন।
বাবাকে বললেন,
-ভাই, মেয়েটার বিয়ে হচ্ছে না হচ্ছে না করেও যখন একটা ভালো পরিবার পেয়েছেন, তখন মেয়েকে সাজিয়ে দেন যাতে মেয়ে এবাড়ি আবার ফেরত না আসে।
বাবা কোনো উত্তর দিলেন না।

বিয়ের আয়োজনটা একেবারেই ছোট পরিসরে হলো, কোনো তামঝাম নয়, নেই জাঁকজমকও।
একটা ঘরোয়া আলোকছায়া, কয়েকজন আপনজন,আপা দুলাভাই আর দু’চোখ ভরা আশংকা আর আশীর ছায়া।
সবকিছুই দেওয়া হলো অল্প সল্প করে, শুধু কাঠের আসবাব বাদ ছিলো, সেগুলো সময়সাপেক্ষ।

বাবা কোলের পাশে বসে আমার মাথায় হাত রেখে বললেন,
-আমার দুই-তিন বছর লাগবে হয়তো, তবে আমি আমার তুরিনকে আস্তে আস্তে সব দেবো।
আমার মেয়েটাকে আমি পূর্ণ করবো, ঘাটতি রাখবো না কোথাও।

তার চোখে তখনো ঝাপসা জলরেখা, আর ঠোঁটে জেদি একটা অঙ্গীকার।

বিদায়ের সময়টা যেনো থমকে যাওয়া কোনো দুপুর।
চোখ ভেজা হলেও কেউ কাঁদলো না উচ্চস্বরে।
বাবা শুধু কপালে চুমু দিয়ে বললেন,
– ওদের ঘর আলোকিত করিস মা। ওরা তোকে পেয়ে যেনো ধন্য হয়।
আপারাও বললো,
-সবার মন রেখে চলিস, যেনো কেউ তোর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করতে না পারে, বাবাকে বিচারে বসিয়ে মাথা যেনো নিচু না করতে হয় সে খেয়াল রাখিস।

আমি গাড়ির দিকে পা বাড়ালাম, পেছনে তাকিয়ে দেখি মা নেই,
কিন্তু একঝাঁক চাচি আর পাড়ার মানুষ চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।
হাতে এক মুঠো ভাত, চোখে এক গুচ্ছ প্রার্থনা।

ও বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত অনেকটাই গড়িয়ে গেছে।
শরীর অবসন্ন, তবুও ঘরে ঢুকেই চুপিচুপি শাড়ি বদলে নিলাম, পাতলা, হালকা একটিকে বেছে নিলাম।
আয়নার দিকে এক ঝলক তাকাতেই মনে হলো যেন নিজের ছায়াকেও চিনতে পারছি না, অচেনা এক ভয়ে হৃদয়টা কেঁপে উঠলো।

তবে সবচেয়ে বেশি খটকা লাগছে যে বিষয়টা, তা হলো, তিনি বিয়ের আগে একবারও আমায় দেখেননি, এমনকি আজ, এই দীর্ঘপথ একসাথে পাড়ি দিয়েও তিনি একবার চোখ তুলে তাকাননি আমার দিকে।
চোখের দৃষ্টি যেন কোথাও আটকে ছিলো, শুধু আমি ছিলাম না সেখানে।

তবে কি তিনি এই বিয়েতে রাজি ছিলেন না?
আমার এই কালো চেহারা তার পছন্দ হয় নি?
নাকি কোনো অতীত জড়িয়ে আছে তাঁর নির্লিপ্ত চাহনিতে?

হৃদয়ের ভেতরটা অস্থির হয়ে উঠলো,যেন এক অনাগত ঝড়ের আভাস দিচ্ছে নিশুতি রাত।
নতুন জীবনের শুরু তো এমন হবার কথা ছিলো না।
কাঁপা কাঁপা হাতে ঘোমটা টেনে বিছানার এক প্রান্তে বসে পড়লাম।
মন বলছে, এ কি সত্যিই আমার জীবনের নতুন অধ্যায়ের সূচনা?
নাকি আরও একবার দুঃখের সাগরে ডুবতে হবে আমায়, নিঃশব্দে?

অবশেষে তিনি এলেন।
নীরব ঘরে পায়ের শব্দটুকুই যেনো প্রলয় তুলে আনলো আমার বুকের ভেতর।
আমি শীতল শ্বাস ধরে বসে আছি, আর ঠিক তখনই তিনি ঘোমটা সরালেন।

আমার চোখে চোখ পড়তেই যেন বিদ্যুৎ খেলে গেলো তাঁর চেহারায়।
তীক্ষ্ণ বিস্ময়ে ভ্রু কুঁচকে এক পা পিছিয়ে দাঁড়ালেন তিনি।
বিস্ময়ভরা কণ্ঠে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলেন,
– মা, মা কিভাবে পারলো আমাকে এভাবে ঠকাতে?

তারপর আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালেন না, যেন আমি এক অপরাধ, এক শাস্তি।
চুপচাপ দরজার দিকে ঘুরে গেলেন।
সেই রাতে আর ফিরে এলেন না।
আমি বসে রইলাম অন্ধকারে, অপমান আর অজানা আশঙ্কায় শরীর জমে গেলো।

সকাল হতেই শুনলাম, তিনি মা’র ঘরে গিয়ে বসে আছেন।
শরীর জুড়ে বিরক্তি, চোখ ভরা অভিমান আর ঠকে যাওয়ার কান্না।

তাঁর কণ্ঠ আকাশ ফাটানো অভিযোগে কান্না মেশানো,
-তোমরা বলেছিলে, তোমরা নাকি দেখেছো! কী-ভাবে পারলে আমায় এমনভাবে ঠকাতে?
এই মেয়ে কি আমার সঙ্গে মানায়? এই মেয়ে আমার পাশে দাঁড়ালে মানুষ হাসবে না?
একটা কালো ছেলেও তো আজকাল সুন্দর বউ পায়! সবারই তো স্বপ্ন থাকে, জীবনসঙ্গীটাকে দেখলেই চোখ জুড়াবে!
আমি ভেবেছিলাম, মা-বাবা তো আমার ক্ষতি চাইবে না, তারা নিশ্চয়ই আমার ভালোটাই চায়। সেই বিশ্বাসে চোখ বন্ধ করে বিয়ে করেছি, মুখটা পর্যন্ত দেখি নি।

মা দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
-আগে কয়েকটা দিন থাক, তারপরও যদি তোর বউয়ের প্রতি একটুও মায়া না জন্মায়, তখন অন্য কিছু ভাবা যাবে। গরীব ঘরের মেয়ে, তোর মতো ছেলে পেয়ে আকাশের চাঁদ ছুঁয়েছে সে। তার আবার কী অভিযোগ থাকবে! আর তুই, তুই আমাদের কথা শুনেই সব করবি, বুঝলি? আমরা তো তোর শত্রু না, তোর ভালো চেয়েই এমনটা করেছি। চুপচাপ মেনে নে, না হলে এই বাড়িতেও জায়গা হবে না।

তিনি রাগ দেখিয়ে দরজার আড়াল হয়ে গেলেন।

আমি সব জেনেও নীরব রইলাম। প্রতিবাদ করার মতো সাহস বা জায়গা কোনোটাই আর অবশিষ্ট নেই আমার। বুকে পাথর বেঁধে সিদ্ধান্ত নিলাম, যতই কষ্ট হোক, এই বাড়িতেই টিকে থাকতে হবে, নিজেকে খুব বেশি দুর্বল দেখানো চলবে না।

এই বিয়েতে আব্বার শেষ সম্বলটুকু খরচ হয়ে গেছে। এখনো পর্যন্ত সেই ঋণের একটি কিস্তিও পরিশোধ হয়নি, অথচ আমি যদি বিয়ের দ্বিতীয় দিনেই ফিরে যাই, তাহলে লোকে মুখে মুখে বলবে, আমরা আগেই জানতাম এই মেয়ে দু’দিনের মাথায় ফেরত আসবে, এমন কালো মেয়েকে কোন ছেলে-ই বা রাখবে।

ভাবলাম, একটা আশ্রয়ের খোঁজে ওখানেও তো আমি বোঝাই হয়েছিলাম, বরং এই নতুন ঘরেই নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করি। নিজের অস্থির মনকে বারবার বুঝাতে লাগলাম৷ সময় হয়তো এখন কঠিন, কিন্তু হয়তো একদিন এই শূন্যতা ভরে উঠবে, আর আমিও হয়ে উঠবো এই বাড়িরই একজন।

অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে ফিরে যাওয়ার কোনো পথই আর খোলা নেই।
মনে মনে বললাম,
-আমার ভাগ্যে বুঝি কোথাও আশ্রয় লেখা নেই, শুধু ঠাঁই চাইতে চাইতেই জীবন কেটে যাবে।

আস্তে আস্তে ঘরটার এক কোণে নিজেকে গুটিয়ে নিলাম।
মনে হচ্ছিল যেনো আমি এই বাড়ির কেউ নই, অচেনা একটা প্রেতছায়া হয়ে টিকে আছি শুধু।

ওদিকে রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছিল গমগম আওয়াজ।
কে যেনো বলছিল
-ওই মেয়েকে গিয়ে এখনই বলো, এবাড়ি রানীর হালে বসে খাওয়া চলবে না।

আরেকটা কণ্ঠ কটাক্ষ করে বললো
-গরীব ঘরের মেয়ে, বেশী সুবিধা দিলে মাথায় উঠে বসবে!

আমি দাঁতে দাঁত চেপে ওসব শুনতে লাগলাম।
নিজের আত্মমর্যাদাকে পাথরের নিচে চাপা দিয়ে শুধু ভাবলাম,
যদি কিছু না বলি, যদি চুপচাপ সব সহ্য করি, তাহলে হয়তো একদিন নিজের একটা ঠাঁই হবে এই বাড়িতে।

শাশুড়ি ডেকে পাঠালেন,
চুপচাপ রান্নাঘরে ঢুকতেই ঠান্ডা গলায় বললেন,
– আজ থেকে সব দায়িত্ব নিতে শিখো।

তারপর পাশেই থালা ধুচ্ছিলেন যে রিতার মা, তাকে উদ্দেশ করে বলে উঠলেন,
– রিতার মা, আপনি কাল থেকে আর কাজে আসবেন না, আমার ছেলের বউ তো এসে গেছে, এখন থেকে এই সংসারের সব দায়িত্ব তারই।

এই “দায়িত্ব” শব্দটার ভেতর যতটা না আস্থার ছোঁয়া ছিল, তার চেয়েও অনেক বেশি ছিল অবিশ্বাস আর বোঝা চাপিয়ে দেওয়ার কাঁটাচেরা গলায় এক চাপা কড়চড়ানি।

আমি কোনো প্রতিবাদ না করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম।
কেউ যেন হঠাৎ আমার বুকের ভেতর থেকে সমস্ত আলো শুষে নিলো,
তবুও মুখে একটুকুও বিরক্তির রেখা না এনে কাজের মাসির কাছ থেকে ধীরে ধীরে বুঝে নিতে লাগলাম সব কিছু।

কে কী খায়, কার কোনটা অপছন্দ, চাল কোনটায় রাখা, বাজার কতদিন পরপর আনতে হয়, দুধ কখন ফোটাতে হয়।
শাশুড়ির ওষুধ কোন ঘন্টায় দিতে হয়, সব যেন এক অদৃশ্য খাতার নিয়ম হয়ে ধরা দিলো আমার হাতে।

মাঝেমাঝে মনে হচ্ছিলো আমি যেন কোনো ঘরে আসিনি, এসেছি এক পরীক্ষার হলঘরে,
যেখানে প্রশ্ন তো আছে, কিন্তু কোনো বই, কোনো উত্তরপত্র আমার হাতে নেই।

তবু মুখে ক্লান্তি না দেখিয়ে গুছিয়ে নিতে লাগলাম,
কারণ আমি জানতাম, এই সংসার আমাকে সাদরে ডাকেনি,
কেবল দাঁড় করিয়ে রেখেছে দায়িত্ব আর নিঃশব্দ অভিযোগের কাঠগড়ায়।

গভীর রাতে তিনি ঢলতে ঢলতে বাড়ি ফিরলেন,
চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ, চলনে ভারসাম্যহীনতা।
জানলার ফাঁক গলে আসা মৃদু চাঁদের আলোয় আমি দেখতে পেলাম।
তার শরীর থেকে আসা এক ধরণের অস্বাভাবিক গন্ধ যেন বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে।
তবে কি তিনি নেশা জাতীয় কিছু খেয়ে এসেছেন?

আমি নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে তাঁকে খাটে বসালাম।
জুতা খুলে নিলাম ধীরে ধীরে,
তার পায়ের গাঢ় ছায়া যেন বলছিল দিনভর কতদূর হাঁটেন উনি, কত না অভিমান লুকিয়ে রাখেন এই নীরবতায়!

মাথার ঘন কালো চুলে হাত বুলিয়ে দিলাম কিছুক্ষণ।
তার মুখের চোখ পড়তেই বুকের ভেতর কেমন একটা হালকা ধাক্কা খেলাম।
এমন সুদর্শন যুবক, যেনো কোনো সাহিত্যের পৃষ্ঠা থেকে উঠে আসা এক চরিত্র,
উঁচু কপাল, ভ্রু গুলো ভাঙা ভাঙা, চোখে ধূসর ক্লান্তি আর চাপদাড়ির নিচে চাপা এক রহস্য।

তাঁর পাশে বসে নিজেকে একবার দেখে নিলাম।
ভাবলাম, সত্যিই তো, এমন রূঢ় সৌন্দর্যের পাশে আমাকে কি মানায়?
এই ঘরের নরম আলোতেও নিজেকে যেনো অচেনা লাগলো।
তবু, আজ রাতে তার এই সৌন্দর্য আমাকে টানলো অন্য এক অনুভূতির দিকে।

ভাবনা থেকে বেরিয়ে তার চোখেমুখে হালকা পানি ছিটিয়ে দিলাম।
তিনি কেঁপে উঠলেন, চোখ মেলে কিছুটা স্থির হলেন।
আমি জানি, এই চোখ দুটো শুধু ক্ষোভ বা গ্লানির জন্য নয়,
এর ভেতরেও লুকিয়ে আছে এক অন্যরকম ক্লান্তি যেটা কাউকে বলা হয় না।

তিনি ধরা গলায় ফিসফিসিয়ে বললেন,
-এত যত্ন করো কেন তুমি?

আমি কিছু বললাম না।
শুধু উনার গায়ে একটা পাতলা চাদর দিলাম,
তবে ওনার হাতটা থামিয়ে দিলো আমার হাত।
চোখে একরাশ অনুরোধ, একটুখানি অসহায়ত্ব,
আর এক অলিখিত আকুতি, এই নির্জনতার সঙ্গী হই, একটু শুধু অনুভব করি তাকে।

ধীরে ধীরে সময় থেমে গেলো,
জানলার বাইরে পূর্ণিমা নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলো,
আর ঘরের ভিতর একটানা নিঃশ্বাসে দুটো শরীর জড়িয়ে থাকলো,
শুধু ক্ষণিকের জন্য, যেনো এই অস্থির জীবনে একটু প্রশ্রয় খুঁজে নেয়।

ভালোবাসা যেন ছিলো শুধুই এক মুহূর্তের ভ্রান্তি, এক দেহমোহের ক্ষণিক ছায়া।
সেই রাতে আমাদের মাঝখানে যে নীরবতা ছুঁয়ে গেল,
তা শরীরের উষ্ণতা মুছে দিয়ে রেখে গেলো ঠান্ডা শীতল এক প্রাচীর।
সবকিছু ঘটে যাওয়ার পর,
তিনি নিঃশব্দে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে পড়লেন,
যেন আমি কোনো অস্তিত্বহীন ছায়া,
যার পাশে থেকেও পাশে থাকা হয় না।

ভোর হতেই সব যেন আবার আগের মতো,
নির্মমভাবে নির্বিকার।
একই ঘরের বাসিন্দা হয়েও আমরা যেন দুই বিপরীত দিকের পথিক।
আমার দিকে তাকান না তিনি, কথা তো দূরের কথা।
চোখে চোখ পড়লে যেন কোনো অপরাধ করেছি আমি এমন তীক্ষ্ণ অবজ্ঞায় মুখ ফিরিয়ে নেন।

একবার সাহস করে জিজ্ঞেস করেছিলাম,
আমি কি খুব অচেনা? খুব অপ্রিয়?
উত্তরে তিনি বলেছিলেন,
-তোমায় আমার ভালো লাগে না,
তোমার মতো মেয়ের সাথে আমি মানিয়ে নিতে পারি না।

শব্দগুলো তীব্র ছুরির মতো বুক ভেদ করে ঢুকে গেলো।
শরীরের যন্ত্রণা হয়তো সয়ে নেওয়া যায়,
কিন্তু আত্মার আঘাত?
তা সারিয়ে তোলার ওষুধ কোথায়?

তবু চুপচাপ পড়ে থাকি,
একটি মিথ্যে আশায়,
হয়তো একদিন, কোনো এক সকালে
তিনি হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে বলবেন,
-তুমি ছাড়া আর কেউই আমার নয়।
*নেক্সট না লিখে গঠনমূলক মন্তব্য করুন। গল্প সম্পর্কে আপনার ভালো লাগা, অনুভূতি প্রকাশ করুন।

চলবে,,,,,