কালিনী পর্ব-০৪

0
2

#কালিনী
#আরেব্বা_চৌধুরী
#পর্ব_সংখ্যা ০৪

শাশুড়ি একে একে আমার বাপের বাড়ি থেকে আনা সামান্য কিছু উপহার নাড়িয়ে চাড়িয়ে দেখছিলেন।
তাঁর চোখেমুখে একটা চাপা তাচ্ছিল্য, যেনো বলতে চেয়েও নিজেকে সংবরণ করলেন।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে শুধু বললেন,
– এইটুকুই এনেছো?
তার স্বরটি কঠোর নয়, তবু কানে যেন বিদ্ধ হলো।

আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম।
বাবার কষ্টার্জিত টাকায় কেনা সেই কম দামি শাড়িটার কথা মনে পড়লো,
যেটা কিনে বাবা নিজের জন্য কিছু আনেননি,
বলেছিলেন,
-তোর শ্বশুরবাড়িতে মুখ দেখাতে হবে তো, একটু ভালো শাড়ি পরিস।

আমি শাড়ির আঁচলটা একটু ভালো করে গুছিয়ে নিলাম।
ভেতরে ভেতরে গা ছমছম করছিল,
কেবল ভাবছিলাম,
এই বাড়ির কারো চোখে কি কখনো নিজেকে “আপন” বলে ভাবতে পারবো?
এই দেয়ালের মাঝে আমি কি কেবলই একজন অনাহূত অতিথি?

এদিকে বাবা যেন নিজের সত্তাটাকেই গিলে ফেলেছেন চুপিসারে।
দিনরাতের খাটুনি, হাড়ভাঙা পরিশ্রম সবই যেন একটাই উদ্দেশ্যে,
মেয়েকে কাঠের জিনিস দিতে হবে, শাশুড়ির সামনে মেয়েটার মুখটা যেন না ঝুঁকে পড়ে।
কারণ মেয়েটার বিয়ে তো হয়েছে শহরের এক প্রভাবশালী পরিবারে,
যেখানে প্রতিটি আসবাবেও গন্ধ থাকে গর্বের, আর অলক্ষ্যেই মাপা হয় বাপের সামর্থ্য।

তবু এসব করতে গিয়ে কী যেন হারিয়েছেন তিনি, সেটা বুঝতে হলে ঘরের একাকীত্বকে ছুঁয়ে দেখতে হয়।
ঘরে ঢুকলেই নীরবতা যেন আচ্ছন্ন করে রাখে তাকে।
আর আগে যেখানে দরজায় দাঁড়িয়েই পেতেন এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি,
সেইখানেই এখন নিজেকেই হাঁসুয়া চালিয়ে চুলায় হাঁড়ি চাপাতে হয়।

রান্নাঘরের ধোঁয়ার মাঝে মিশে থাকে তাঁর নিঃশব্দ দীর্ঘশ্বাস,
যেটা কেউ শোনে না, বোঝেও না।

প্রতিবেশীরা কেউ কেউ সহানুভূতির খাতিরে একটুখানি ভাত পাঠিয়ে দেয়,
কিন্তু যে স্বাদ এক সময় স্ত্রীর হাতে রান্না করা ভর্তা-ভাজিতে ছিল,
তা ওই চালে থাকে না।

স্ত্রীহারা এক পুরুষের জীবন কেমন হয়,
তা বলে বোঝানো যায় না, শুধু অনুভবেই টের পাওয়া যায়।
সারা দিন বাইরে দুনিয়ার হাজারো বোঝা বইতে পারলেও
একটি নির্ভরতার কাঁধ না থাকলে সন্ধ্যায় ঘরে ফেরা পুরুষটা ভেতর থেকে চুপচাপ ভেঙে পড়ে।

ঘরে ফিরে কথা বলার মতো কেউ না থাকলে,
সুখ-দুঃখের ভাগীদার না থাকলে,
ঘরের প্রতিটি দেয়াল যেন তখন আয়নায় পরিণত হয়,
যেখানে প্রতিফলিত হয় শুধুই নিঃসঙ্গতা, অভাব আর এক অতৃপ্ত ভালোবাসা।

সারাদিন ঘরের প্রতিটি কোণে নিঃশব্দে ছুটে বেড়াই কখনো রান্নাঘরে ধোঁয়া, কখনো সংসারের অগোছালো দায়িত্বে নিজের অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলি।
রাত এলে মনে হয় হয়তো আজ একটু কাছে টানবেন, হয়তো একটিবার বলবেন, “তুমি কেমন আছো?”
কিন্তু সেই আশা আর ফিরে আসে না।

এই সংসারটা যেন একটা নাটমঞ্চ, যেখানে আমি নীরব চরিত্র।
চারপাশে দামি আসবাব, ঝকমকে আলো, ব্যস্ততা আর লোক দেখানো হাসি সবই আছে,
শুধু একটুকরো সত্যিকারের মমতা নেই,
শুধু নেই সেই চোখ দুটো, যেখানে চোখ রেখে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলা যায়।

মাঝে মাঝে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশ দেখে
ভাবি, এই শহরের আকাশটা এতটা একঘেয়ে কেন?
আকাশও কি জানে, আমি ভালো নেই?

বাবা হয়তো জানেনই না, তার মেয়ে আরাম নয়, অভিমান বয়ে বেড়ায় প্রতিদিন।
তিনি হয়তো গর্ব করেন, তাঁর মেয়ে বড় ঘরে আছে।
কিন্তু কি করে বুঝবেন, মেয়ের মনটা আটকে আছে ছোট্ট একটা ভালোবাসার ঘরে,
যেটা এই ইট পাথরের ঘরে নেই?
টাকা কি সত্যিই সুখ এনে দিতে পারে? তবে আমায় কেনো এই ঐশ্বর্য ভালো রাখতে পারে নি।
সব কিছুর পরেও ভালো থাকার জন্য প্রয়োজন একটা বিশ্বস্ত হাত, একজন ভালোবাসার মানুষ।
যেটা এ ঘরে নেই।
যেখানে ভালোবাসা নেই, সেখানে কি ভালো থাকা যায়?

আমারও তো স্বপ্ন ছিল,
স্বামী থাকবে পাশে, কথা বলবে, ক্লান্ত হাতে এক কাপ চা তুলে দেবে।
সেই চায়ের স্বাদে যতই কম চিনি থাকুক, মায়ার ভাগ যেন কখনো কম না হয়।
কিন্তু এখানে, আমি শুধু রান্না করি, হাসি দেই, সেজে থাকি।
আর ভেতরে ভেতরে প্রতিদিন একটু করে নিভে যাই।

একফোঁটা ভালোবাসা থাকলেই হয়তো এই অট্টালিকা নয়, একটা কুড়েঘরেও গায়ে বাতাস লাগতো শান্তির মতো।
ভালোবাসা ছাড়া সংসার মানে শুধু দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেওয়া একটা বোঝা,
যা কেউ দেখে না, কেউ বোঝেও না।

বড় আপার শাশুড়ি তীব্র কণ্ঠ জড়িয়ে বললেন,
-বাপের বাড়ি থেকে তো কিচ্ছু আসে না! আশপাশের দিকে তাকিয়ে দেখো, তারা কি না আনছে! ওমুকের বউয়ের বাপের বাড়ি থেকে তো প্রতিদিন কিছু না কিছু আসে শাড়ি, হাড়ি, গহনা! আর তোমাদের? ফকিন্নিদের দল! ভুল তো আমারই সেই রূপ দেখে ভাবলাম রাজবাড়ির মেয়ে, আসলে নিঃস্ব আত্মীয়তা জুটেছে কপালে!

বড় আপা দমে যাওয়ার মেয়ে নন, চুপ করে থাকলেই যেন নিজের সম্মান বিসর্জন দিতে হয়।
চোখ দুটো জ্বলে উঠল অভিমানে, ঠোঁটে ফুটে উঠল তীব্র উত্তর,
-জিনিসপত্র দিয়ে যদি সম্পর্কের দাম চুকিয়ে দেওয়া যেত, তাহলে আপনি নিজেই হয়তো সবচেয়ে দামী শাশুড়ি হতেন।
কেউ যখন মেয়েকে দেয়, মন ভরে দেয়। কিন্তু কেউ যদি বিয়ের পরেও লোভের থলি খুলে বসে, সেখানে আত্মীয়তা নয়, শুধু হিসেব চলে।
আর হ্যাঁ, রূপ দেখে যদি ভুল করে থাকেন, তবে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চোখকে দোষ দিন। ফকিন্নিদের সঙ্গে আত্মীয়তা না হলে তো আপনার ছেলে এই রূপবতী ‘ফকিন্নিকে’ ঘরের বউ করে আনতো না!

শাশুড়ির মুখ কাঁচুমাচু হয়ে গেল, যেন নিজের ছায়াকেও তখন অপরাধী মনে হয়।
আর বড় আপার চোখে সেই অদম্য দীপ্তি, যে দীপ্তি কারো দয়ার ভিক্ষায় নয়, নিজের আত্মমর্যাদায় জন্ম নেয়।

রাতের নিস্তব্ধতা ঘন হয়ে উঠেছে, ঘরে নিভু নিভু আলো।
তিনি ক্লান্ত শরীরে বিছানায় শুয়ে পড়েছেন।
আমি নিঃশব্দে পাশে বসে তার পা দুটো নিজের কোলের উপর তুলে নিয়ে স্নেহভরে তেল মালিশ করতে লাগলাম।
মাথার চুলে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে কপালে একটা চুমু এঁকে দিলাম।
তার ঘুম নেমে এলো চুপিসারে।
গায়ের উপর কাঁথাটা গুছিয়ে দিলাম ভালো করে, যেন ঠান্ডা না লাগে,
তারপর পা টিপে টিপে ফোনটা হাতে তুলে নিলাম বাবাকে একটা ফোন না দিলে যেন মনটা শান্তি পায় না।

দুবার রিং হওয়ার পর ফোন ধরলেন বাবা।
জিজ্ঞেস করলাম,
-কেমন আছো বাবা?

ওপাশ থেকে ভেসে এলো ক্লান্ত এক সুর,
– মা’রে, এখন আমি গাড়িতে আছি। একটা রিজার্ভ ট্রিপ পেয়েছি তো, এখন রাখি, কাল কথা বলবো।

শব্দগুলো কানে গিয়ে বুকের ভেতর একটা মোচড় তুলে দিয়ে গেল।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি, কাঁটা ঠিক বারোটায় এসে দাঁড়িয়েছে।
বাবা এখনো রাস্তায়, চোঁখে ঘুম নেই, গায়ে ক্লান্তির ভার।
শুধু মেয়েদের মুখে হাসি ফুটবে বলে আজও রাতভর সিএনজি চলছে।

কিন্তু বাবা কি জানেন?
তার সেই ঘামে গড়া, স্বপ্নে বোনা মেয়েটা আজও সুখের মুখ দেখেনি।
অসহ্য এক ভারে গলা ধরে আসে।
চোখের কোণে জমে ওঠে অশ্রু,
আকাশের দিকে তাকিয়ে শুধু একটাই প্রশ্ন আসে মুখে।

-আল্লাহ, কেনো আমাদের একটা ভাই দিলেন না?
একটা ভাই থাকলে হয়তো আজ এই বয়সে এসেও বাবাকে রাত বারোটায় গাড়ি চালাতে হতো না,
আমাদের মুখে হাসি ফোটাতে গিয়ে বাবার নিজের মুখটা এমন বিবর্ণ হয়ে যেত না।

পায়ের কাছে বসে, ঘুমন্ত স্বামীর পায়ের পাতায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতেই
হঠাৎ মনে হলো,
এই সংসারে আমার আপন বলতে কেউ আছে তো?
নাকি বাবার কাঁধই আমার একমাত্র আশ্রয়, যে দিন দিন ভারে ঝুঁকে পড়ছে।
আর আমি তা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছি।

চুপিচুপি নিজের অশ্রু মুছে ফোনটা বালিশের পাশে রেখে নিঃশব্দে শুয়ে পড়লাম।
কিন্তু ঘুম এলো না, বাবার ক্লান্ত মুখটা বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠলো।
তার মুখে একফোঁটা শান্তির হাসি ফুটাতে না পারলে এই জীবনের সব আয়োজন যেন বৃথা লাগে।

নিরিবিলি দুপুর। উঠোনে সুনসান নীরবতা। পাশের বাড়ির দাদি এসে বাবার পাশে বসেই একগাল মিষ্টি হেসে বললেন,
-ও রমিস মিয়া, তোরে তো আজকাল পাওয়াই যায় না রে বাবা!

বাবা হেসে মাথা নিচু করে উত্তর দিলেন,
– ওই তো চাচি কাজের চাপটা একটু বেশি। ঋণের কিস্তি মাসে মাসে শোধ দিতেই তো প্রাণ বেরিয়ে যায়।

দাদি একটু গম্ভীর স্বরে বললেন,
– আমি বলি কি রমিস মিয়া, তুই একটা বিয়েশাদি কর, এভাবে একা একা ক’দিন আর চলবি? দিনশেষে তো একটা মানুষ দরকার পাশে বসে দুটো কথা বলার জন্য, একটু মাথায় হাত রাখার জন্য।
রান্না, কাপড় ধোয়া, অসুখ-বিসুখ সব কিছুই একার কাঁধে তুলে নিয়েছিস, বয়স বাড়লে শরীর তো আর সেই আগের মতো থাকে না। এখনই সময়।

বাবা একটু নরম গলায় বললেন,
-এখন কি আর সেই বয়স আছে চাচি? মেয়েরা বড় হয়েছে, ঘরসংসার করছে, আমি যদি এখন আবার বিয়ে করি লোকে তো বলবে বুড়ো বয়সে লজ্জা নাই রমিস মিয়ার! আমার মেয়েগুলার মুখে ছাই পড়ে যাবে।

দাদি চোখে-মুখে বিরক্তি ঝরিয়ে বললেন,
-ধুর! লোকে কি না বলে বলতো? তোর ঘর একা চালিয়ে যাচ্ছিস তুই, লোকে তো তোর পেছনে দাঁড়িয়ে ভাত তুলে দিচ্ছে না! লোকের কথায় তো জীবন থেমে থাকে না রে।

বাবা এবার একটু নরম হেসে বললেন,
-তবু চাচি, নিজের মেয়েদের চোখের দিকে তাকাইতে পারবো না। তারা যদি ভাবে, আব্বা আমাদের মায়ের জায়গা অন্য কাউকে দিলো, আমি তো চাই না তারা মনে মনে কষ্ট পাক।
সংসার একা টানছি বটে, কিন্তু মনের কোণায় কোথাও একটা দায় আছে, আমার স্ত্রীর প্রতি, আমার মেয়েদের প্রতি।

দাদি চুপ করে গেলেন। ভাঙা চোয়ালের কোণে এক বিন্দু সম্মান মিশ্রিত দীর্ঘশ্বাস জমে রইল।
একটা নীরবতা ভেসে রইল উঠোন জুড়ে। বাবার মাটি ছোঁয়া চোখের কোণে কেমন যেন পুরনো দিনের আলো-আঁধারি মেখে রইলো নিঃশব্দে।

একটা বিয়ের দাওয়াত আসলো,
সেখানে শ্বশুর-শাশুড়ি, জামাই, আমি আমরা সবাই যাবো।

যাওয়ার আগে তিনি বারবার করে বলে গেলেন,
-তুমি আমার পাশে ঘোরাঘুরি করবে না একদম, সবসময় দূরে দূরে থাকবে।

আমি চুপচাপ শুনছিলাম।
তবু জানতে ইচ্ছে হলো,
-কেনো? আমি কি আপনার স্ত্রী নই?

তিনি চোখ নামিয়ে বললেন,
-তোমাকে স্ত্রী পরিচয় দিতে লজ্জা লাগে, মানুষ হাসবে আমার পেছনে।

আমি আর কোনো প্রশ্ন করিনি।
শুধু নিজের মধ্যেই একরাশ কান্না গিলে ফেললাম।
তারপর চোখের কোনায় টানটান একটা হাসি এঁকে দাঁড়িয়ে রইলাম তাদেরই ভিড়ে,
যেখানে তিনি হাসিমুখে একের পর এক ছবি তুলছেন,
আত্মীয়দের সঙ্গে গল্প করছেন প্রাণ খুলে।

আর আমি?
আমি ছিলাম দূরের এক কোণে,
জড়সড়, নিঃশব্দ, নিঃসঙ্গ এক প্রাণ।

একটা ছবিও তোলেননি আমার সাথে,
একবারও ফিরে তাকাননি,
হাসেননি, প্রশ্ন করেননি,
তবু আমি ভেঙে পড়িনি।

মাটি কামড়ে পড়ে রইলাম,
কেননা ভিড়ের ভেতরেও আমি তার হয়ে থাকি,
যদিও তিনি আজও আমায় নিজের বলে ডাকেন না।

তবু আমি স্ত্রী,
হয়তো কাগজে-কলমে,
কিন্তু হৃদয়ের পাতায়?
সেখানে আমি শুধুই এক পরিত্যক্ত প্রলেপ।

কিছুদিন পর আমার শরীরে একের পর এক অজানা পরিবর্তন আসতে শুরু করল।
প্রথমে হালকা মাথা ঘোরা, তারপর বমি বমি ভাব, শরীরে যেন কোনো শক্তিই অবশিষ্ট নেই।
ঘর মোছা কিংবা বসে থালাবাসন মাজা সবই যেন পাহাড় টলানোর মতো কষ্টসাধ্য হয়ে উঠলো।

এক সন্ধ্যায় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
চোখের নিচে কালি, গাল ভেঙে গেছে, ত্বক যেন নিস্তেজ হয়ে গেছে।
আমি আর আগের মতো নেই একটা নিঃস্ব, ক্লান্ত, অবহেলিত ছায়া মাত্র।

আমার এই নিঃশ্বাসহীন দিনগুলো শাশুড়ির কাছে ছিল “কাজ এড়ানোর কৌশল”।
তিনি একটিবারও ভাবেননি, হয়তো আমার শরীরটা সত্যিই ভালো নেই।

রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে অনেক সাহস সঞ্চয় করে উনাকে বললাম,
-শুনোন না, আজকাল খুব মাথা ঘোরে, কিছু খেতে পারি না বমি বমি লাগে সবসময়।
তিনি নির্লিপ্ত স্বরে বললেন,
-তো আমি কি করবো?

তার এই ঠান্ডা উত্তর শুনেও আমি হেসে ফেললাম।
না, আনন্দের হাসি নয়, আত্ম-অপমানের এক ক্ষীণ বিদ্রুপ ছিল তাতে।
বললাম,
-যেহেতু ঘরের সব কাজ আমি একাই করি, তাই আমার শরীর খারাপ মানায় না।
তবুও ভাবলাম যদি আপনি একটিবার আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান, হয়তো একটু সাড়া পাই।

কিছুটা নিঃশব্দ থেকে তিনি বললেন,
-আচ্ছা, কাল সকালে যাবো।

আমি জানি, এটা কেবল তাঁর কৌতূহল নয়, অন্য কোনো হিসেব কষছেন মনে মনে।
তবুও, সেই হঠাৎ আসা সামান্য সাড়া যেন আমায় একটুখানি আশ্বাস দিলো,
হয়তো, হয়তো আমার শরীর খারাপটা এখন কেউ স্বীকার করছে।
একমুঠো যত্ন না হোক, অন্তত একটুখানি বিশ্বাস।
সেইটুকু নিয়েই আমি আবার বাঁচতে চাইলাম।

পরদিন সকালে উনি শাশুড়িকে বললেন সব কিছু।
তিনি অবাক হলেন না বরং একপ্রকার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। বললেন,
-যদি তার শরীর-ই ভালো না থাকে, সব কাজ তো জমে যাবে। নিয়ে যা, ডাক্তার দেখিয়ে আন।

তিনি আমার সাদা বোরখাটা বের করে নিজেই গায়ে পরিয়ে দিলেন।
তারপর আমার হাত ধরে নিয়ে গেলেন স্থানীয় এক নারী বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের চেম্বারে।
সব টেস্ট শেষ করে রিপোর্ট হাতে নিয়ে আমরা আবার ডাক্তারের সামনে বসলাম।

ডাক্তার ম্যাডাম চশমার ফ্রেমে চোখ রেখে একবার রিপোর্টের কাগজ দেখলেন, তারপর আমার মুখ, তারপর আমার স্বামীর মুখের দিকে তাকালেন।
একটা মৃদু, কোমল হাসি খেলে গেল তাঁর ঠোঁটে।

-অভিনন্দন।
-আপনার গর্ভে একখানা হৃদপিণ্ড ধুকধুক করে চলেছে, ছোট্ট একটা প্রাণ।

আমার কানে যেনো শঙ্খ ধ্বনি বাজল।
এক মুহূর্তের জন্যে আমার মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠলেও, সঙ্গে সঙ্গে চোখ ছুটে গেল তার মুখের দিকে।
সে তো বসে আছে একদম নিঃস্পৃহ, মুখটা যেনো আরও কালো হয়ে এসেছে।
যেনো কেউ কোনো অপ্রীতিকর সংবাদ শোনাল তাকে।

ডাক্তার বুঝে গেলেন পরিবেশটা।
তিনি কিছুক্ষণ চুপ থেকে আমায় সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন,
-কোনো সমস্যা হচ্ছে?

আমি মাথা নাড়িয়ে না বললাম, কিন্তু চোখ যেনো বিশ্বাসঘাতকতা করে ফেলল, একটু কেঁপে উঠল।
তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন,
-মন খারাপ কেন?

তখন নিচু স্বরে বললাম,
-উনি হয়তো এই বাচ্চা চান না।
যে মানুষটা আমাকে এখনো স্ত্রী বলে মেনে নেয়নি, সে-ই বা কীভাবে একটা অনাগত প্রাণকে নিজের সন্তান বলে ভাববে?

ডাক্তার ম্যাডাম এবার একটু গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসলেন, চোখের চশমাটা একটু নামিয়ে তার দিকে তাকালেন,
তারপর স্বাভাবিক ভঙ্গিতে, কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠে বললেন,
-শোনো ভাই।
আমি তোমার বড় বোনের মতো, তাই একটু বলি।
এই মেয়েটার গায়ের রং হয়তো শ্যামলা,
কিন্তু মুখের যে কোমলতা,
চোখের যে ভাষা,
দেহের যে গঠন সেসব কোনো অংশে কম নয়।ফর্সা ত্বক দিয়ে সংসার চলে না।
যে মেয়ে নিঃশব্দে সব সহ্য করে যাচ্ছে, বুকের ভিতর সন্তান লালন করছে,
তাকে ভালো না বেসে তুমি কাকে ভালোবাসবে?

একটু থেমে তিনি আমার দিকে তাকিয়ে কোমল গলায় বললেন,
-তোমার শরীরে এখন আর একজন বেড়ে উঠছে।
এই সময়টায় তুমি শুধু একজন নারী নও, তুমি একজন মা।
নিজেকে ভালোবাসো। আর তোমাকেই বলি ভাই,
এই সংসারের দায়িত্ব এখন তোমার হাতে।
ভুলে যাও পুরনো সব এগিয়ে চলো এই মেয়েটার পাশে দাঁড়িয়ে।

আমি মাথা নিচু করে বসেছিলাম।
তবে মনে হলো অনেকদিন পর যেন কেউ আমার হয়ে কথা বললো।
কান্না আটকে রাখা গেল না।

আর সে?
সে একবার ডাক্তারের মুখের দিকে,
একবার আমার চোখের জলে ভেজা মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল।
নীরব, থেমে থাকা এক সন্ধ্যার মতো।
❝আপনারা একটু রেসপন্স করলে কি হয় বলুন তো? আপনারা যারা গল্পটা পড়েন সবাই রেসপন্স করলে লিখার আগ্রহ ও বাড়তো আর গল্পটা ও নিয়মিত আসতো।❞

চলবে,,,,,