#কালিনী
#আরেব্বা_চৌধুরী
#পর্ব_সংখ্যা ০৫
রাস্তা দিয়ে ধীর পায়ে হাঁটছিলাম আমরা।
চারপাশে শহরের কোলাহল, তবু আমাদের চারপাশে যেন এক ধরনের অদৃশ্য নিস্তব্ধতা।
তিনি হঠাৎ খুব নরম গলায় জিজ্ঞেস করলেন
– কিছু খাবে?
আমি একটু চমকে তাকালাম তাঁর দিকে, তারপর নিঃশব্দে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললাম।
তিনি ঠোঁটের কোণে একফোঁটা হাসি এনে বললেন
– কী খাবে?
আমার গলা যেন শুকিয়ে এসেছিল, তবুও মুখ নরম করে বললাম,
– আপনি যা খাওয়াবেন।
তিনি আমার দিকে না তাকিয়েই রাস্তার পাশের এক ফুচকার দোকানের দিকে এগিয়ে গেলেন।
আমি চুপচাপ অনুসরণ করলাম তাকে।
হাত বাড়িয়ে নেকাবটা খুলে ফেললাম, যেন নিজেকেই একটু হালকা করি।
ফুচকার ঝাল পানি মুখে যেতেই চোখ দুটো একটু জ্বলতে শুরু করলো, ঠিক তখনই টের পেলাম,
চারপাশে অনেক চোখ আমাদের দিকে স্থির হয়ে আছে।
কিছু মেয়ে কানে কানে হাসাহাসি করছে, কেউ আবার গলা টেনে ফিসফিসিয়ে বলছে,
– ওমা, এই ছেলের পাশে এই কালিনী!
– না না, মানাচ্ছে না একদম।
-ছেলে দেখতে হিরোর মতো, মেয়েটা তো যেনো কোথাকার কুৎসিত এক জীব!
আমার বুকটা ধ্বসে যেতে চাইলো।
একবার মেয়ে গুলোর দিকে তাকালাম, আরেকবার ওনার দিকে।
উনিও তাকিয়ে ছিলেন।
তবে ওভাবে নয়, খুব অন্যরকম একটা দৃষ্টিতে যেনো তার দুচোখে একসাথে রাগ, অপমান, আর প্রচ্ছন্ন এক অবিশ্বাস।
হঠাৎ উনার মুখখানা কেমন কঠিন হয়ে উঠলো।
চোখেমুখে একধরনের অস্থিরতা।
গলার স্বরটা এবার কঠিন ও অচেনা শোনালো।
ধমকে বললেন,
– নেকাব পরো।
আমি কিছু বলতে গেলেও ঠোঁটে শব্দ জড়াল না।
হাত কাঁপতে কাঁপতে নেকাবটা আবার মুখে চাপালাম।
আর মনে হলো, ফুচকার ঝালের থেকেও বেশি জ্বালা ধরছে আমার মনে।
এখান থেকে ফিরেই তিনি যেনো অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলেন।
ঘরে ঢুকেই তীব্র চিৎকারে ভেঙে দিলেন ঘরের নির্জনতা,
-এই কালিনীকে আর কোনোদিন, কোথাও, কারো সামনে নিয়ে যাবো না আমি!
তোমার দরকার হলে তুমি নিয়ে যেও মা, আমার দরকার নেই!
তার চোখের ভাষা ছিল আরও নির্মম, শব্দের থেকেও বেশি ধারালো।
তার সেই এক বাক্যেই যেনো আমার সমস্ত পরিচয়, সম্মান, অস্তিত্ব সবকিছু খণ্ডবিখণ্ড হয়ে গেলো।
সেই দিন থেকেই আমার একটা নতুন নাম হলো “কালিনী”।
এ নাম আমার রক্তের নিচে জেগে থাকা আত্মবিশ্বাসকে প্রতিদিন ক্ষয়ে দেয়।
এ নাম আমার হাসির মধ্যে ঢেউ তুলে দেয় কান্নার,
এ নাম আমার প্রতিবিম্বকে করে তোলে অপরাধী,
শুধু ফর্সা না হওয়ার অপরাধে, শুধু সৌন্দর্যের তথাকথিত মানদণ্ডে ‘অযোগ্য’ হয়ে উঠার কারণে।
আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম,
একফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে গিয়েছিল, কারো চোখে পড়েনি।
কারণ কালিনীর কান্না গননা করার মতন সময় ক’জনেরই বা থাকে?
শাশুড়ি জিজ্ঞেস করলেন,
-ওষুধ এনেছো?
আমি মাথা নেড়ে বললাম,
– না মা, আনতে পারিনি।
তিনি কপালে ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞেস করলেন,
-কেনো?
– ওষুধ কেনার আগেই কয়েকজন মানুষের কটু কথা শুনে উনি এতটা রেগে গেলেন যে, হাতের ব্যাগ ফেলে, মুখ কালো করে সোজা বাড়ি ফিরে এলেন।
– ঠিক আছে, আমি আনিয়ে দেবো।
তিনি কয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে হঠাৎ থেমে দাঁড়ালেন।
কোনো এক অস্পষ্ট চিন্তার রেখা যেনো মুখে ছায়া ফেললো। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে গম্ভীর স্বরে বললেন,
– সমস্যাটা কী হয়েছিলো বলো তো?
আমি কিছুটা সংকোচে, কিছুটা লাজুক হেসে বললাম,
– মা, আপনাদের বংশধর আসতে চলেছে।
এই ছোট্ট বাক্যটায় আমি ভেবেছিলাম একটুখানি আশীর্বাদ, হয়তো চোখের কোণে একটু স্নেহের জল খুঁজে পাবো। কিন্তু না।
তার মুখ যেনো মুহূর্তে পাথর হয়ে গেলো।
চোখে একরাশ ধিক্কার আর ঠোঁটে কাটা কাটা কথার আগুন,
– এই সন্তান নষ্ট করে ফেলো।
আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম।
ধীরে জিজ্ঞেস করলাম,
-কেনো মা?
তিনি দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
– কাজকর্ম না করার বাহানা খুঁজছো তাই না? একটা পেট বাঁধিয়ে বসে থাকলেই তো আর কাজ করতে হবে না।
তুমি কি ভেবেছো শুধু খেয়ে খেয়ে ঘরে পড়ে থাকলে আমার ছেলে ঘরধনী হয়ে যাবে? বংশধর ঘর মাথার উপর তুলে দেবে?
উনার কথাগুলো শিরায় শিরায় কাঁটার মতো বিঁধে গেলো।
শুধু শরীর না, মনটাও যেনো রক্তাক্ত হলো।
একটা প্রাণের অস্তিত্ব জানিয়ে আমি একটু ভালোবাসা চেয়েছিলাম।
সেটাই হয়ে উঠলো সবচেয়ে বড় অপরাধ।
আমি চোখ নামিয়ে এক চিলতে হেসে শুধু বললাম,
-মা, আমি আসলে মা হতে চেয়েছিলাম, অভিশপ্ত হতে নয়।
ঘরে ফিরে বালিশে মুখ গুঁজে অঝোরে কাঁদতে লাগলাম, যেনো নিজের সমস্ত দুঃখ লুকিয়ে ফেলতে চাইছি নরম কাপড়ের গভীরে। বুকের ভেতর জমে থাকা প্রশ্নগুলো তখন থরথর করে কাঁপছিলো।
মানুষ এমন নিষ্ঠুর হয় কীভাবে?
কালো মেয়েদের কি স্বপ্ন দেখা নিষেধ?
তারা কি ভালোবাসার আশা করতে পারে না?
ভালোবাসা চাওয়া কি তবে অপরাধ?
ঘরের নিস্তব্ধতা আমার কান্নার শব্দে থরথর করে উঠছিলো। মনে হচ্ছিলো, আমার এই অশ্রুসিক্ত আত্মার যন্ত্রণাও কেউ দেখবে না, বুঝবে না।
মানুষের ঠাট্টা, বিদ্রুপ আর কটূক্তির ভারে আমার জীবন থেকে যেন সুখ নামক শব্দটাই মুছে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।
তবে কি সত্যিই মানুষ শুধু গায়ের রঙ আর বাহ্যিক সৌন্দর্য দিয়েই একজনের মূল্য নির্ধারণ করে?
তাদের চোখে হৃদয়ের ঔজ্জ্বল্য, চরিত্রের ঋজুতা, ব্যবহারের কোমলতা এগুলো কি কোনো মূল্যই রাখে না?
একটা কালো মেয়ে যেনো জন্ম থেকেই বিচারাধীন থাকে সমাজের রঙিন মানদণ্ডে।
সেখানে না থাকে ভালোবাসার অধিকার, না থাকে স্বপ্ন দেখার অনুমতি।
তবে কি এই জীবন কেবল লাঞ্ছনার বোঝা বয়ে বেড়াবার নাম?
তবে কি আমি মানুষ নই, শুধুই একটা ছায়া?
বিছানায় শুয়ে এক সময় চোখের জলে ভিজে ওঠা বালিশটা আঁকড়ে ধরলাম, যেন সেটাই একমাত্র সাক্ষী আমার নিঃশব্দ আর্তনাদের।
আর নিজেকেই বলে ফেললাম।
একদিন আমি প্রমাণ করবো, রঙ নয়, মনটাই আসল পরিচয়।
আর সে দিন, এই সমাজের চোখে আমি শুধু কালো মেয়ে থাকবো না,
হবো এক প্রতিবাদী নাম।
এদিকে বড় আপার মনে ক্ষোভের সুরে জমে থাকা অভিমান ধীরে ধীরে আগুন হয়ে জ্বলছিলো।
কেনো বাবা একজন বিত্তশালী মানুষ হয়ে জন্মানন
কেনো তিনি মেয়ের শশুরবাড়ির লোকদের সন্তুষ্ট রাখতে পারেন না রকমারি উপহারে, বাহারি মিষ্টিতে?
অভিমানে গলায় কান্না চেপে রেখে ফোনটা হাতে তুলে নিলেন আপা।
-হ্যালো বাবা।
– হ্যাঁ মা বল।
-আমার বাড়ি একবার এসে আমায় দেখে যেও, বাহারি মিষ্টি নিয়ে।
– তোর শরীর খারাপ নাকি?
– না।
-তাহলে?
– এমনি।
– মা, মেয়ের শশুরবাড়ি খালি হাতে যাওয়া কি সাজে?
আর তুই তো জানিস, তোর এই বাপ এখন কতটা কষ্টে দিন গুনছে।
ক’দিন আগেই তো তোর বোনের বিয়ে দিলাম।
বাবার কণ্ঠে ছিলো ক্লান্তির মিশ্রণ, ছিলো অক্ষমতার হাহাকার।
কিন্তু অভিমানে অন্ধ হয়ে থাকা বড় আপা তা শুনলো না।
বাবার কথা শেষ হওয়ার আগেই কাঁপা আঙুলে কল কেটে দিলো।
আর ফোনের ওপাশে থেকে যাওয়া নিঃশব্দতা যেন বাবার ঘরে ছড়িয়ে দিলো এক অদৃশ্য বিষাদের ধোঁয়া।
ভাঙা বুক নিয়ে একা বসে থাকলেন বাবা, আর মনে মনে বললেন,
“তিন তিনটে কন্যা বড় করলাম, কিন্তু ভালোবাসার চেয়ে দামি হয়ে গেলো বাহারি মিষ্টি।”
রাতে অন্ধকার ঘরে নিঃশব্দে শুয়ে ছিলাম। বাতাসের সু সু শব্দে মনে হচ্ছিল, চারপাশের নিস্তব্ধতাও যেনো আমার প্রশ্ন শুনে থমকে গেছে। ধীরে ধীরে জিজ্ঞেস করলাম তাকে।
-আমি কি শুধুই কালো হওয়ার অপরাধে আপনার কাছে এতো অবহেলার পাত্রী? যদি আপনার সন্তানের গায়ের রঙও আমার মতো হয়, তখন কি আপনি তাকে ফেলে দেবেন?
আপনি কি তখনও রঙের নামে ভালোবাসায় শর্ত টানবেন?
তিনি মুখ ঘুরিয়ে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বললেন,
-তুমি কালো, বাচ্চাটাও কালোই হবে। আর আমি কালো বাচ্চা চাই না।
তাঁর কথাগুলো যেনো ছুরি হয়ে বুকে বিঁধে এলো। একবারের জন্যও তিনি ভাবলেন না, তিনি শুধু একজন স্বামী নন একজন আসন্ন পিতা।
আমি নিঃশব্দে চেয়ে রইলাম অন্ধকারে।
চোখে জল আসলো না, কারণ যাকে ভালোবেসে চোখে রেখেছিলাম, সে মানুষটিই আজ এতটা নির্মম!
সেই রাতেই আমি বুঝে গিয়েছিলাম,
রঙের চেয়ে কালো হয় মানুষের মন।
আর সেই কালো অন্ধকারের থেকে অনেক ভয়ংকর।
গোটা রাত যে নীরবতায় ডুবে ছিল, তার রেশ যেনো সকালেও রয়ে গেলো চারপাশে।
মনের ভেতর কেমন ভার ভার লাগছিল, ঠিক যেন এক পাহাড় বয়ে বেড়াচ্ছি বুকে।
ইট-পাথরের এই শহরে মানুষগুলোও যেনো হৃদয়হীন, নিঃস্ব, একেকটা হাঁটছে যেনো কংক্রিটের মুখোশ পরে।
যেখানে কেউ কাউকে জড়িয়ে ধরে না,
ভালোবাসার একটুখানি উত্তাপ দেয় না।
ভোরে উঠে প্রতিদিনের মতো নিঃশব্দে কাজে লেগে গেলাম।
চা বসাতে বসাতে কানে এলো শাশুড়ির কণ্ঠস্বর, উনার মেয়ে মেহরিনকে উপদেশ দিচ্ছেন।
তার কথাগুলো যেনো তীরের মতো বিঁধে যাচ্ছিলো আমার হৃদয়ে।
-হে’রে মা, জামাইকে আঁচলে বেঁধে রাখিস, শাশুড়ির কাছে বেশি যাইতে দিবি না।
তোর শাশুড়ি কান পড়া দিতে পারে।
আর ঘরের কাজে হাত দিবি না একদম, কে মরলো কে বাঁচলো, তাতে তোর কী!
তুই তো চাকরানি না, ওবাড়ির বউ!
তুই তো ও বাড়ি রাজরানীর মতো থাকবি।
আমি থমকে গেলাম। মুখে একরাশ তিক্ত হাসি।
কি আশ্চর্য!
যে মানুষটি মেয়েকে শিখাচ্ছেন রাজরানীর মতো থাকতে,
তিনিই তো আমাকে এখানে দাসীর মতো খাটিয়ে চলেছেন।
একবার ইচ্ছে করলো, মাকে ডেকে বলি,
-মা, আপনি কী দিয়েছেন আপনার ছেলেকে বউয়ের আঁচলে বেঁধে রাখতে?
আপনি যদি আমাকে আপনার মেয়ের মতো কাছে টানতেন, আমি হয়তো আপনাকেও হৃদয় থেকে মা বলে ভাবতে পারতাম।
মেয়ে আর বউয়ের ভেদাভেদ কেনো মা?
বউ কি ঘরে আলো জ্বালাতে আসে না?
আমিও তো কারো কন্যা, কারো প্রাণের টুকরো!
আপনি যদি ভালোবাসার একটু জায়গা করে দিতেন,
তবে এই ঘরকে আমি তাজমহল বানিয়ে রাখতাম।
ভালোবাসা শুধু পেতে নয়, দিতে শিখলে তবে তা ফুল ফোটায়।
অথচ এ ঘরে, ভালোবাসা কেবল একতরফা দাবি।
দেওয়ার কেউ নেই, বুঝবার কেউ নেই।
চুপচাপ শাশুড়ির দিকে এক কাপ চা এগিয়ে দিলাম।
তিনি চায়ে চুমুক দিতে দিতে আমায় বললেন,
-তৈরি থেকো, বেলা এগারোটায় বের হবো।
আমি ধীরে জিজ্ঞেস করলাম,
-কোথায়?
ঠোঁট শক্ত করে তিনি বললেন,
-ডাক্তারের পরামর্শে ওষুধ আনতে হবে, এই বাচ্চা নষ্ট করে ফেলো।
বুকটা ধক করে উঠলো, যেন কারো নির্মম হাত বুকের ভেতর ঢুকে মুঠো করে ধরলো আমার হৃদয়টা।
একটা শ্বাস নিচ্ছি, আবার ছেড়ে দিচ্ছি; তবু কেমন শূন্য লাগছে ভেতরটা।
একটা প্রাণ, যে এখনও পুরোপুরি গড়ে ওঠেনি,
তবু আমার ভেতরে সে প্রতিটি নিঃশ্বাসে জানান দিচ্ছে তার অস্তিত্ব।
আমি কি পারবো সেই নিষ্পাপ প্রাণটাকে এমন অনায়াসে মুছে ফেলতে?
আমি আর নিরব থাকতে পারলাম না, শাশুড়ির চোখে চোখ রেখে বলেই ফেললাম,
-আমি এ বাচ্চা নষ্ট করবো না, আমি তাকে পৃথিবীর আলো দেখাতে চাই।
-কাজ না করার জন্য বাহানা খুঁজো? বাচ্চা পেটে নিয়ে সারাদিন শুয়ে থাকলে ঘরের কাজ করবে কে? বাপের বাড়ি থেকে কি দাসীবাঁদী নিয়ে এসেছো?
আমি চোখ নামিয়ে ধীরে বললাম,
-আমি করবো মা, আমি আগে যেমন করতাম, এখনো তেমনই করবো।
একটু সময় দিন শুধু, আমি নিজের সাথে আরেকটা প্রাণ নিয়ে নতুনভাবে জেগে উঠবো।
এই গর্ভে যে স্পন্দন করছে, সে শুধু আমার সন্তান নয়, আমার স্বপ্ন, আমার সাহস, আমার ভালোবাসা।
শাশুড়ির মুখে বিরক্তির ছায়া নেমে এলো,
কিন্তু আমি জানি, এই যুদ্ধে এখন আমাকে একাই লড়তে হবে একটা ছোট্ট প্রাণের জন্য, যে এখনো পৃথিবীর মুখ দেখেনি, তবু আমার হৃদয়ের একমাত্র দাবিদার হয়ে গেছে।
কিছুক্ষণ পর ফাহিম ঘুম থেকে উঠতেই যেন বাসার বাতাস ভারী হয়ে উঠলো। শাশুড়ির কণ্ঠে যেন বিষ ঢালা শুরুর অপেক্ষায় ছিল। তিনি আর এক মুহূর্ত দেরি না করে তীক্ষ্ণ স্বরে বলে উঠলেন,
-তোর বউয়ের তো পাখা গজিয়েছে রে ফাহিম! ভেবেছিলাম গরীব ঘরের মেয়ে ধৈর্য ধরবে, সবকিছু মানিয়ে গুছিয়ে বুঝে চলবে, কিন্তু না, এই মেয়ের তো অহংকারে পা মাটিতে পড়ে না! এমন দাম্ভিকতা আমার জীবনে আর দেখিনি।
আমি নতমুখে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কোনো উত্তর দেবো কিনা বুঝে উঠতে পারছিলাম না। ঠিক তখনই ফাহিম বিরক্তির সুরে বলে উঠলো,
-এসব আমাকেও শোনাও কেনো মা? এই মেয়েকে কি আমি তুলে এনেছি? তোমরাই তো একে ঘাড়ে চাপিয়ে এনেছো। এখন যখন বুঝতে পারছো কী ভুল করেছো, তখন দোষ আমার ঘাড়ে চাপিয়ে লাভ কী?
একটু থেমে সে আবার বললো,
-আমার জীবনটা এমনিতেই হাল ছেড়ে দিয়েছে মা, বাইরে গেলে কারো চোখে চোখ রেখে চলতে পারি না, সাথে একে নিয়ে গেলে তো আর কোনো কথা-ই নেই।
তুমিই বলো মা আমার পাশে কি একে মানায়? বাইরে গেলে তো মানুষ হাসাহাসি করে, আর ঘরে এসেও যদি শান্তি না পাই, তাহলে বাঁচবো কীভাবে?
শাশুড়ি হতবাক হয়ে চুপ করে গেলেন কিছুক্ষণ। আর আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারলাম, এই ঘরটায়ও আমার ঠাঁই নেই,
কোলের ভিতর গুটিসুটি মেরে থাকা সেই নিষ্পাপ প্রাণটার কথা মনে হলো, বুকের ভিতর হাহাকার উঠলো।
নিজেকে শক্ত করলাম।
শুধু মনে মনে বললাম,
এই লড়াই এখন শুধু বেঁচে থাকার নয় এই লড়াই একজন মায়ের, যে তার অনাগত সন্তানকে পৃথিবীতে নিয়ে আসার শপথ করেছে।
চোখের কোণে জল জমে উঠলেও, মুখে দৃঢ়তা রেখে দাঁড়িয়ে থাকলাম কারণ আমি জানি, আমার ঘুম না আসা রাতগুলো কেবল শুরু হলো মাত্র।
আমার জীবনের সব লড়াই যেন এই গর্ভের প্রথম মাস থেকেই শুরু হলো।
একটা জীবন বাঁচিয়ে রাখার সংগ্রামের পাশাপাশি এখন লড়তে হচ্ছে প্রতিটি নিঃশ্বাস, প্রতিটি কামড়ে।
কথায় আছে না? হাতে না পারলে ভাতে মারো। আমার শাশুড়িও ঠিক সে পথেই হাঁটলেন।
আমার শরীরের দুর্বলতাকে, মনোবলের ক্লান্তিকে যেন তিনি নিজের শত্রু ভেবে প্রতিশোধ নিতে থাকলেন।
আগে সকালেই দিনের রান্না শেষ করতাম,
কিন্তু এখন,
তিনি তিনবেলা তিন রকম রান্না চান।
নতুন, গরম, ঝাঁঝালো, বৈচিত্র্যময়।
একটুও পুরনো হলে তার মুখে বিষ যেন।
একটুও কম হলে চিল্লাচেঁচামেচি।
একটুও দেরি হলে চোখ রাঙানি।
গৃহস্থালির প্রতিটি কাজ যেন তার চোখে পরীক্ষা।
মেঝেতে ধুলোর দাগ? অপমান।
কাপড় ধোয়া হয়নি? অপবাদ।
শরীরের ক্লান্তিতে টান পড়লে,
তিনি বলেন, শুরু হয়ে গেছে বাহানা।
আমি অসুস্থ, আমি গর্ভবতী,
এসব যেন তার চোখে বাহানা।
আর ফাহিম?
সে কেবল মোবাইল আর অফিসের ভেতরে ব্যস্ত।
আমার দিকে তাকানোর ফুরসত তার নেই,
আর কিছু বললে উত্তর একটাই,
-তুই মায়ের সাথে পেরে উঠিস না তো বিয়ে করেছিলি কেন?
আজ রাতে মাংস রান্না করেছিলাম।
এই একটা জিনিস, যেটা আমার খুব পছন্দের,
ভেবে ছিলাম অন্তত এক টুকরো মাংস দিয়ে পেট ভরে খাবো।
কিন্তু শাশুড়ি ঠিক জানতেন,
এই খাবারটা আমার খুব পছন্দের।
তাই তিনি ইচ্ছে করেই তার প্লেটে, শ্বশুরের, ফাহিমের, সব প্লেটে ঢেলে দিলেন মাংস।
এক চামচ ঝোলও রাখলেন না।
আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম,
ভাবলাম কেউ হয়তো ডাকবে,
এক টুকরো তুলে বলবে,
“তুই খাসনি তো, নে খেয়ে নে মা।”
কিন্তু আমি ভুলে গেছিলাম, এটা বাবার বাড়ি না, এটা শশুর বাড়ি এখানে মেয়েদের কোনো চাওয়া পাওয়া থাকতে নেই।
কেউ বলল না, নে তুইও খেয়ে নে।
শুধু দেখলাম,
শেষে শাশুড়ী নিজেই না খেতে পেরে
বেশ কিছুটা মাংস তুলে ফেলে দিলেন ময়লার ঝুড়িতে।
আমার চোখের সামনে
আমার অধিকারটা যেন একে একে
পঁচে ফুরিয়ে যাচ্ছে।
কথা বলার শক্তি নেই,
শুধু চোখের কোণে নীরব কান্নার একটা রেখা টেনে
নিজেকে বললাম,
তুই কাঁদিস না, তোর গর্ভের সন্তানের জন্য হলেও এখন বাঁচতে হবে। এখনই হারলে চলবে না।
❝আজ 1k হয়ে গেলে আগামীকাল নেক্সট পর্ব আসবে, তাই সবাই রেসপন্স করুন।❞
চলবে,,,,,