#কালিনী
#আরেব্বা_চৌধুরী
#পর্ব_সংখ্যা ০৬
দিন পেরোচ্ছে, আর আমার শরীরটা যেনো কেমন একটা ভার হয়ে উঠছে। কখনো কখনো বুকের ভেতরটা জ্বালা করে, হাত-পা অবশ হয়ে আসে তবুও থেমে থাকা চলে না। রান্না, কাপড় ধোয়া, ঘর মোছা সব কিছু একা হাতে সামলে নিতে হয়, যেন আমি কোনো যন্ত্র, অনুভূতিহীন এক মেয়ে।
এতটুকু চেষ্টাতেও মেলে না কারো একটা ভালো কথা।
বরং পিছে পিছে রটে আমি নাকি অলস, আমি নাকি কুলক্ষণা, আমি নাকি কালো বলে সংসারটা অশুভ হয়ে গেছে!
এভাবে দিনে দিনে ভুলে গিয়েছিলাম, আমারও একটা আলাদা অস্তিত্ব ছিল একটা পরিচয়, একটা নাম আছে তুরিন।
মা-বাবার আদরে রাখা সেই নামটা কেউ আর উচ্চারণ করে না।
এখানে আমার নাম শুধু একটাই ‘কালিনী’।
আয়নায় তাকালেই মনে হয়, যেন এক কলঙ্কিত ছায়া দাঁড়িয়ে আছে।
ভালোবাসাহীন এই সংসারে আমি যেন কেবলই এক উপেক্ষিত উপস্থিতি,
যার কথা, যন্ত্রণা বা কান্নারও কোনো মূল্য নেই।
মন মাঝে মাঝে চিৎকার করে বলতে চায়
আমি মানুষ, আমিও ব্যথা পাই, আমিও স্বপ্ন দেখেছিলাম একটু ভালোবাসার, একটু সম্মানের,
কিন্তু এখানে কান নেই সে কান্না শোনার, এখানে আমি শুধু সহ্য করার জন্যই জন্মেছি।
আর ওই ভেতরের আগুন,
যেটা দিন দিন আমাকে পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে,
তা কাউকে বলে হালকা হওয়া যায় না,
এমনকি সেই আগুনের লেলিহান শিখাও কারো চোখে পড়ে না।
তবু বাঁচি কারণ, মেয়েরা না কি সব সহ্য করতেই জন্মায়।
আর আমি তো তার মধ্যে এক ‘কালিনী’।
এদিকে বাবা খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাতেন। মুখটা এতটাই শুকিয়ে গিয়েছিলো যে, দেখে যেন মনে হতো হাড়ের ওপর মাংস নেই বললেই চলে শুধু চামড়ার আবরণে একটা জীবন্ত কঙ্কাল।
আশপাশের মানুষজন প্রায়ই গলায় উদ্বেগ মেশানো দয়া ঝরিয়ে বলতো
-এভাবে আর কত দিন, রমিস মিয়া? মানুষ একা থাকতে থাকতে শুকায় যায়, একটা সঙ্গী তো দরকার। বিয়েটা করেই ফেলুন এবার।
কিন্তু বাবা ছিলেন একগুঁয়ে, এক কথার মানুষ। মুখে স্থিরতা, গলায় নরম অথচ অটল সুর,
-এই বয়সে নতুন করে সংসার পাতার বয়স নেই আমার। লোকজন ছি ছি দিবে, মেয়েগুলা শশুরবাড়িতে মাথা তুলে থাকতে পারবে না। আমার তো এমনিতেই কিছু দরকার নেই, যেমন আছি, তেমনই থাকি।
সেই একাকীত্বে ভরা জীবনেই তিনি খুঁজে নিতেন একরাশ শান্তি, যেনো নিজের দুঃখগুলো নিয়েই একটা ছায়াময় সংসার গড়ে তুলেছেন।
মাঝরাতে বিছানায় নিঃশব্দে পাশ ফিরতেন, যেন কেউ পাশে নেই কিন্তু হৃদয়ের কোণে প্রতিটি সন্তানকে জড়িয়ে রাখতেন নিঃশব্দ এক ভালোবাসার কোলাজে।
একা ঘর, নিভু আলো, আর পুরনো দিনের কিছু স্মৃতি ছিল তাঁর সাথী।
তবুও তিনি ছিলেন দৃঢ়, যেন একটা পোড় খাওয়া গাছ, যা হাজার ঝড়েও মাটি ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় না।
রাতের নিস্তব্ধতায় ফাহিমের পাশে নিঃশব্দে শুয়ে আছে তুরিন।
যে মানুষটা দিনের আলোয় মুখের গড়ন, গায়ের রং, চোখের ভাষা মেপে দেখে,
রাতের আঁধারে সেই মানুষটা কেনো খুঁজে না হৃদয়ের আকুলতা, চোখের লুকানো জল?
ভাবছিলাম, বিয়ের পিঁড়িতে বসা মানেই বুঝি সুখের নতুন ঠিকানা,
কিন্তু সে সুখ যেন আমার ভাগ্যছাড়া কোনো আলোকছায়া,
দূর থেকে হাতছানি দেয়, কাছে এলেই মিলিয়ে যায়।
শাশুড়ির প্রতিটি কটু বাক্য যেন বুকে বিষের ছুরি,
প্রতিদিন একটু একটু করে নিঃশেষ করে দেয় আত্মসম্মান।
মন চায় সব ছেড়ে ছুটে যাই সেই চেনা উঠোনে,
যেখানে বাবার ক্লান্ত মুখে লুকিয়ে থাকে নিঃশর্ত ভালোবাসা।
কিন্তু পরক্ষণেই বুক ধকধক করে ওঠে, মনে পড়ে,
বাবা যে মানুষটা লোন তুলে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন,
যে এখন একবেলা খেয়ে অন্য বেলা না খেয়ে
ঋণের বোঝা টানছেন,
তার গলায় কীভাবে আবার ঝুলে পড়ি শুধুই নিজের অসহায়তা নিয়ে?
তাই এই ঘরে যেখানে কেবল নিরবতা আর সহ্য করাই সঙ্গী,
তাতেই নিজেকে বোঝাই,
এই বুঝি মেয়েদের নিয়তি,
সুখ না হোক, কমপক্ষে বাবা যেন লজ্জিত না হন,
এই দায়টুকু তো পালন করতেই হয়।
সকাল সকাল শাশুড়ি গলা চড়িয়ে বললেন
-আজ ফাহিম বলেছে মাংস খাবে, তুমি মাংস রান্না করো।
আমি নিঃশব্দে মাথা নেড়ে কাজ শুরু করলাম।
গত দুই দিন ধরে শরীরটা বেশ খারাপ যাচ্ছে গা যেন একরাশ ক্লান্তির চাদরে ঢাকা, ক্ষুধা বলে যেন কিছু নেই।
তবু মনে মনে ভাবলাম, মাংস রান্না হলে হয়তো আজ একটু ভাত নামবে গলায়।
না খেয়ে থাকলে শুধু আমারই নয়, আমার গর্ভের শিশুটারও ক্ষতি হবে।
এই চিন্তাটাই এখন আমার সবচেয়ে বড় অবলম্বন।
রান্না শেষে, আর অপেক্ষা না করে আমি নিজেই খেতে বসে গেলাম।
জানি, তাদের খাওয়া শেষ হতে হতে পাতের কোণে হয়তো এক ফোঁটা ঝোলও অবশিষ্ট থাকবে না আমার জন্য।
তাই সবার আগে নিজেই নিজের পাত সাজালাম।
দু-চার পিস মাংস তুলে নিলাম পাতে।
মাত্র দুই লোকমা মুখে দিয়েছি, এমন সময় পেছন থেকে শাশুড়ির কণ্ঠ কাঁপিয়ে উঠল,
-এই কি! রান্না শেষ হতে না হতেই খেতে বসে পড়েছো? একটুও তো লজ্জা নেই তোমার!
আমি মুখ না তুলে খাওয়া চালিয়ে গেলাম।
শরীর ক্লান্ত, মন ক্লান্ত, তবু আজকে আর মাথা নত করিনি।
নিজের ভেতরের কণ্ঠে যেন কোনো এক শক্তি বলল,
অনেক তো তাদের দিকে তাকিয়ে ছিলাম।
প্রতিদানে পেয়েছি অবহেলা, উপেক্ষা আর অনন্ত অভিমান।
আজ থেকে আর নয়।
আমি খাচ্ছি, আমার জন্য না হোক আমার সন্তানের জন্য।
তার শরীর যেন দুর্বল না হয়, তার পৃথিবীতে আসার পথ যেন না হয় কষ্টের।
এই যুদ্ধ শুধু আমার একার নয় এটা এক মা’র যুদ্ধ, যে নিঃশব্দে নিজের ভেতর গড়ে তোলে আরেকটি জীবন।
আজ থেকে সে জীবনের কাছে আমি দায়বদ্ধ।
রাতে সবাই একসাথে খেতে বসতেই শাশুড়ির মুখমণ্ডলে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়লো। চোখমুখ কুঁচকে গলায় অভিমান মেশানো কাঁপুনি নিয়ে তিনি বললেন,
-আমি খাবো না।
শশুর জিজ্ঞেস করলেন,
-কেনো কি হয়েছে? খাবে না কেনো?
তিনি মুখ ঘুরিয়ে কাঁটা গলায় বললেন,
-খাল কেটে ঘরে কুমির এনেছি আমরা। এই কালিনী রান্না করেছে ঠিকই, কিন্তু সবার আগে মাংসের ভালো ভালো পিসগুলো নিজের পাতে তুলে খেয়ে নিয়েছে।
আমি থমকে গেলাম। যেন মাটির নিচে দাঁড়িয়ে আছি, অথচ পায়ের নিচে কোনো ভিত্তি নেই।
শাশুড়ির কথায় আমি অবাক হয়ে বললাম,
-এখনো তো অনেক মাংস রয়েছে মা। আমি তো মাত্র তিনটা পিস নিয়েছি।
তিনি সাফ গর্জে উঠলেন,
-তিনটা পিস-ই কেনো খাবি? বাপের বাড়ি কখনো দেখিসনি নাকি?
আমি শান্ত কণ্ঠে জবাব দিলাম,
-মা, আমার বাপের বাড়ি বছরে হয়তো একদিন মাংস রান্না হতো। কিন্তু সেই একদিনও আমরা সবাই মিলে ভাগ করে খেতাম। কেউ কারও ভাগ মেরে খায়নি। কেউ কারও পাতে হিংসে করে চেয়ে থাকেনি।
শাশুড়ি রাগে মুখ কালো করে উঠে গেলেন। দরজার শব্দে মনে হলো যেন এই ঘরটা আর ঘর নেই, এক একটা সম্পর্কের দেয়াল চুড়মার হয়ে যাচ্ছে।
তার সঙ্গেই উঠে গেলেন তার আদরের ছেলে আমার স্বামী। প্লেটের অর্ধেক খাবারে পানি ঢেলে রেখে গেলেন যেনো সবকিছুর প্রতি বিতৃষ্ণা প্রকাশ করে।
আমি আর কাউকে কিছু বললাম না। একবারে নীরব হয়ে গেলাম।
শুধু ভেতরে একটা চিনচিনে ব্যথা রয়ে গেলো যে ব্যথা কোনো শব্দে প্রকাশ হয় না।
অনেক তো সহ্য করলাম। প্রতিদিন নিজেকে ভেঙে আবার জোড়া লাগিয়েছি। প্রতিটি মুহূর্তে অন্যের খুশির জন্য নিজের অভিমান গিলে ফেলেছি।
আর না।
আমি মাংস দিয়ে কয়েক লোকমা ভাত খেয়ে, বাকি খাবারগুলো টেবিলের উপর ভালোভাবে ঢেকে রেখে দিলাম।
যার মন চাইবে, এসে খেয়ে নেবে।
আমি আর সেই মেয়েটি নই যে অন্ধভাবে সবার মন রক্ষা করতে গিয়ে নিজেকে শেষ করে ফেলবে।
আমাকে এখন ভালো থাকতে হবে, কারণ আমার গর্ভে এক ছোট্ট প্রাণ আলোর অপেক্ষায় আছে।
সে-ই আমার সবচেয়ে বড় যুদ্ধজয়।
এই লড়াইয়ে হার মানা মানে তার স্বপ্নগুলোকে ভেঙে দেওয়া।
আর আমি তা কখনোই হতে দেবো না।
তাকে নিয়ে বাঁচতে হবে স্বাভাবিক নয়, শক্তভাবে।
নিজেকে ভালোবেসেই আমাকে রক্ষা করতে হবে আমার সন্তানকে।
রুমে ঢুকতেই উনি চোখ রাঙিয়ে বললেন,
-দিন দিন তুমি বেয়াদব হয়ে যাচ্ছো।
আমি হালকা একটা মুচকি হেসে বললাম,
-এ আর নতুন কী? আমি তো কখনওই ভালো ছিলাম না।
উনি মুখ কুঁচকে চুপ করে গেলেন, আমি থামলাম না।
শব্দগুলো যেন নিজের ওজনেই গড়িয়ে পড়ছিল ঠোঁট থেকে।
-খেয়ে না খেয়ে যখন এ ঘরের সব কাজ করেছি,
নিজেকে হারিয়ে সবার সঙ্গে মানিয়ে চলার চেষ্টা করেছি,
তখনো আমাকে শুনতে হয়েছে আমি খারাপ,
আমি বেয়াদব, আমি অহংকারী, আমার পায়ে নাকি মাটির ছোঁয়াই লাগে না।
অথচ কখনো কি কেউ দেখেছে, আমার এই পায়ের নিচে কত কাঁটা বিছানো?
কত অপমান, কত না-বলা চোখের জল চাপা পড়ে আছে নীরব পায়ের শব্দে?
দিনের পর দিন মিথ্যে হাসি মুখে পরে থেকেছি,
মনে হয়েছে, হয়তো ভালোবাসলে সব ঠিক হয়ে যাবে,
কিন্তু ভালোবাসা যদি কেবল একতরফা হয়, তাহলে সে তো কষ্টের আরেক নাম।
বিয়ের দিনটার কথা মনে আছে,
আমার চোখে তখনও স্বপ্ন ছিল, সংসার হবে ছোট্ট, তবু শান্তির।
কিন্তু এখন তো জানি, সেই স্বপ্নটা ছিল কাঁচের মতো,
যেটা তোমাদের কথায়, ব্যবহারেই একে একে চুরমার হয়ে গেল।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তুরিন আবারও বলতে শুরু করলো।
-আমি কাউকে জবাব দিইনি মানেই কি আমি দুর্বল?
আমি চিৎকার করিনি মানেই কি আমার গলা নেই?
আমি চুপচাপ সহ্য করেছি, কারণ আমি ভেঙে পড়িনি এখনও।
তবে মনে রেখো, চুপ থাকা মেয়েরাও একসময় বিদ্রোহ করে,
আর সেই বিদ্রোহ কোনো শব্দে হয় না, হয় একেবারে নিরব বিচ্ছেদে।
তারপর তুরিন জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল।
রাতের আলো-আঁধারিতে তার মুখে ছিল শান্তি,
কিন্তু চোখদুটো যেন বলে যাচ্ছিল,
সে শান্তি নয়, নিঃশেষ হওয়ার চিহ্নমাত্র।
সকালটা যেন সবসময় একটু তাড়াতাড়ি শুরু হয়।
চোখ মেলতেই শাশুড়ির গলার আওয়াজ কানে আসে,
-এই ঘরের বউ বুঝি রানি হয়ে এসেছে? সাতটায় ঘুম থেকে উঠবে?
তুরিন তাড়াহুড়ো করে উঠে পড়ে। নিজেকে আয়নায় দেখে মনে হয়, এই মুখটার ক্লান্তি কেউ কি দেখে?
ভোরবেলায় ঘুম ভাঙার পরও শরীর যেন আর উঠতে চায় না।
কিন্তু এই বাড়িতে বিশ্রাম শব্দটা যেন নিষিদ্ধ।
সবার আগে রান্নাঘরে ঢুকতে হয়, হাঁড়ির ভাপে ঘেমে ভিজে যায় চুল,
তারপর কাপড় ধোয়া, ঘর মোছা, ফাহিমের নাস্তা, শাশুড়ির ওষুধ।
এই সব করতে করতেই কখন দুপুর হয়, কখন নিজে খেয়েছে সেটা তুরিনের মনেও থাকে না।
একটা সময় দাঁড়িয়ে থমকে যায় তুরিন।
চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই মানুষটার মুখ, যিনি নিজের ভাত না খেয়ে মেয়ে বিয়ে দিয়েছিলেন।
যার চশমার কাঁচের ওপারে গ্লানির কুয়াশা, অথচ মুখে একটুকু অভিযোগ নেই।
তুরিনের মনে পড়ে যায়,
বিয়ের দিন বাবার চোখটা ছিলো টলমল,
হয়তো আনন্দে, হয়তো অজানা আশঙ্কায়।
লোনের টাকা হাতে পাওয়ার দিন যে হাসি বাবার মুখে দেখেছিলো তুরিন,
সেই হাসি যেন ছিলো দায়বদ্ধতার,
আর মেয়ে সুখে থাকবে এই বিশ্বাসের।
আজ সেই বাবাই এখনও লোন শোধ করে যাচ্ছেন,
সকালে পান্তা ভাত আর পেঁয়াজ কুচি খেয়ে কাজে বের হন,
রোদে পুড়ে ঘরে ফিরে ফোনে জিজ্ঞেস করেন,
-তোর শ্বশুরবাড়িতে ঠিকমতো খাইছিস তো মা?
তুরিনের বুকটা হু হু করে ওঠে।
নিজের হাতের ছ্যাঁকা খাওয়া দাগের চেয়ে বাবার কষ্ট যেন হাজার গুণ বেশি পোড়ে।
কেউ বুঝে না, এই মেয়েটার বুকেও একখণ্ড বাবার পৃথিবী গেঁথে আছে।
স্বামী-সন্তান নিয়ে মেজো আপা মাত্র সাত দিনের জন্য দেশের বাইরে যাবেন এইটুকু খবরেই শাশুড়ির চোখ ভরে উঠলো জলে। যেনো ছেলেমেয়ে-নাতি-নাতনির সংসারটা এক মুহূর্তেই শূন্য হয়ে যাচ্ছে।
কে বলবে, মেজো আপা এই মেয়েটা কখনো তার নিজের বাবার মনের ভাষা বুঝে উঠতে পারেনি? অথচ শশুরবাড়ির ছোট-বড় সব কথা তার মুখস্থ।
ঘরের কোন খোপে কী জিনিস রাখা আছে, কোনটা কবে শেষ হবে, কোন ওষুধ শশুর সময়মতো খায় সব কিছুই যেনো তার মগজে গেঁথে আছে।
সংসারের প্রতিটি ইট-পাথরে তার ছোঁয়া।
শাশুড়ির শাড়ির কোঁচা নুয়ে গেলে সে নিজ হাতে ভাঁজ করে রাখে,
শশুরের পাঞ্জাবি মলিন হলে মনের ভেতর তোলপাড় লাগে।
বুয়ার অনুপস্থিতিতে ঝাঁট, মোছা, রান্না সব নিজের হাতে সারে।
ছেলে মেয়ের স্কুলের ব্যাগ গোছানো থেকে শুরু করে শাশুড়ির পায়ের ফাটা পর্যন্ত সবই তার নজরে।
এই সংসারটাকে সে নিজের আত্মার মতো বুকে টেনে নিয়েছে।
হয়তো বাবার বাড়িতে কেউ কোনো দায়িত্ব তার হাতে দেয়নি,
কিন্তু শশুরবাড়িতে সে যেনো এক অনিবার্য, অদৃশ্য বন্ধন হয়ে উঠেছে।
কেউ না বললেও বোঝা যায়, তার এই ভালোবাসা, এই যত্ন আদতে একধরনের অধিকার।
যে অধিকার জন্ম নেয় মায়ার শিকড় ছুঁয়ে।
আর তাই তো, মাত্র সাত দিনের দূরত্বে শাশুড়ির চোখ ঝাপসা হয়ে আসে,
তাকে ছাড়া যেনো এই সংসার এক মুহূর্তও চলে না।
চুলগুলো হাত খোঁপা করে বাঁধলাম, যেন ঘুম ভাঙা মুখে সবার আগে দিনের শুরুর কাজটা সেরে নিতে পারি। রান্নাঘরে ঢুকে ডিম সিদ্ধ করলাম, সঙ্গে টোস্ট, পনির, মধু দিয়ে বানানো বাটার টোস্ট, আর হালকা করে ভাজা সসেজ। ছোট একটা বাটিতে কিউব করে কাটা পেয়ারা, কলা আর আপেল রেখে দিলাম সবার জন্য।
তখনই পেছন থেকে শাশুড়ির কাশি শুনতে পেলাম। আমি ভাবলাম বুঝি ঠান্ডা লেগেছে, মুখ ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
-আপনার কি শরীর খারাপ?
তিনি কঠিন গলায় বললেন,
-কিছু হয় নি, আজ আমি এসব নাশতা খাবো না, আমার জন্য নতুন কিছু বানিয়ে আনো।
আমি একটু থমকে গিয়ে ধীরে ধীরে বললাম,
– আগে যদি বলে দিতেন তাহলে হয়তো অন্য কিছু তৈরি করতাম। এখন তো রান্না হয়ে গেছে, ঠিক আছে, আপনি একটু অপেক্ষা করুন, আমি নাশতা সেরে আপনাকে আলাদা কিছু তৈরি করে দিচ্ছি। এতোগুলো খাবার তো আর ফেলে দেওয়া যায় না।
তিনি মুখটা কাঁটার মতো করলেন, যেন আমি ইচ্ছে করে তাঁর অনিচ্ছার বিপরীতে গেছি। হঠাৎ গলায় বিষ মিশিয়ে বললেন,
-তোমার তো সব কিছুতেই অগাধ জ্ঞান, এইটুকু বুঝলে না আমি আজ কিছু হালকা খেতে চাই? কারও মনের মতো কিছু করতেই পারো না।
আমি তখন আর চুপ করে থাকতে পারিনি। স্পষ্ট স্বরে বললাম,
-কাঁটা বিছিয়ে যদি হাঁটা হয়, আমি হাঁটব। কিন্তু প্রতিবার পথচলার আগে কেউ যদি কাঁটা বিছায়, তবুও আমি মুচকি হেসেই হাঁটব। কারণ আমি কারো মন রক্ষার জন্য নিজের মন ভাঙতে শিখে গেছি।
শাশুড়ির মুখটা রক্তবর্ণ হয়ে গেলো। আমি মাথা নিচু করে আবারও বললাম,
-আপনি একটু বসুন, আমি নাশতা সেরে আপনাকে অন্য কিছু বানিয়ে দিচ্ছি।
শাশুড়ী ঝাঁজালো স্বরে বললেন,
-সব সময় শুধু নিজের খাওয়াটা বুঝো।
-তো কি করবো মা, আপনারা তো আমার বা আমার অনাগত সন্তানের কথা চিন্তা করেন না, তাই নিজের টা নিজেকেই করতে হয়।
তাছাড়া এই খাবার গুলো আমি নিজের জন্য বানাই নি আপনাদের জন্যই বানিয়েছিলাম।
আপনারা যখন খাবেন না তখন তো আর এতোগুলো খাবার ফেলে দিতে পারি না।
তাই আমি খেয়ে নিচ্ছি।
শাশুড়ির মুখ তখন নীরবতায় ঢেকে গেলো। আর আমার বুকের ভেতর জমে থাকা ধোঁয়ারা জানালার ধারে গিয়ে একবার নিঃশ্বাস নিলো। তবুও একটা শান্তি, কারণ আমি কারো কষ্ট না বাড়িয়ে নিজের কথাটুকু বলেছি।
চলবে,,,,,