কালিনী পর্ব-০৯

0
1

#কালিনী
#আরেব্বা_চৌধুরী
#পর্ব_সংখ্যা ০৯

কেটে গেছে এক মাস।
এই এক মাসে আমি আমার মনকে বোঝাতে শিখেছি প্রয়োজন নেই কারো মুখোমুখি হওয়ার, প্রয়োজন নেই কোনো সম্পর্কের ব্যাখ্যা চাওয়ার।
তবুও গ্রামের ছোট ছোট বাচ্চাদের মুখে মাঝে মাঝে ভেসে আসে একটি নাম ফাহিম।
শুনেছি, সে নাকি অনেকবার এখানে এসেছিলো, চুপিচুপি, কারও চোখ এড়িয়ে।

কেন এসেছিলো?
ক্ষমা চাইতে?
না কি শুধুই জানতে আমি বেঁচে আছি কিনা?
তবে সে কখনো আমার সামনে আসেনি।
আমার দুয়ারে তার পায়ের শব্দ পড়ে নি একবারও।
শুধু গাঁয়ের বাতাসে ঘুরে বেড়িয়েছে তার উপস্থিতির খবর,
যেমনভাবে শুকনো পাতা বাতাসে উড়ে এসে কিছু সময় টিকে থাকে, তারপর আবার মিলিয়ে যায় নিরুদ্দেশে।

আমি কোনো প্রশ্ন করিনি।
কারণ আমি জানি, যাদের চোখে একবার তুমি অপ্রয়োজনীয় হয়ে যাও,
তারা হাজারবার ফিরলেও তোমার কাছে তাদের জন্য আর কোনো অপেক্ষা জমে না।

তবুও, বুকের এক কোণে একটুখানি কাঁপন ওঠে,
এই ভেবেই যে সে এসেছিলো,
তবে মুখোমুখি হয়নি কেন?
ভয় পেয়েছিলো?
না কি আমার চোখের গভীর নীরবতাকে মাফ করতে পারেনি?

আমি এসব প্রশ্নের উত্তর জানি না,
জানার প্রয়োজনও নেই আর।

নিজের কল্পনায় যতই রঙ মিশিয়ে নিই না কেন, বাস্তবতার নির্দয় দেয়ালে এসে তা যেন প্রতিবারই ধাক্কা খায়, ভেঙে পড়ে শব্দহীন বেদনায়।

চাচি, ভাবিরা এখন কানে কানে কথা বলেন,
-ছেলের জন্মের তো মাস পার হয়ে গেল, ফাওয়াদের দাদা-দাদি তো দূরে থাক, স্বামীটাকেও তো একবার আসতে দেখলাম না।
-তুই ঠিক আছিস তুরিন? ও বাড়িতে কিছু হয় নি তো?

ওদের প্রশ্ন আমি প্রতিদিন এড়িয়ে চলি।
কিন্তু আজ পারলাম না।
ভাবি এমন এক শঙ্কামিশ্রিত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলেন, যেন চুপ থাকলেই আমি অপরাধী হয়ে উঠি।
বললেন,
-শুনলাম ফাহিম চারবার এসেছে গ্রামে, কিন্তু তোর সাথে একবারও দেখা করেনি? নিজের ছেলেটার মুখ পর্যন্ত দেখলো না? এটা কীসের আলামত রে?

আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকি।
তারপর একরাশ লজ্জা, ক্ষোভ আর অভিমান গিলে মুখ কাচুমাচু করে বলি,
-আসলে আমি একেবারেই এখানে চলে এসেছি ভাবি, আর যাবো না ওবাড়ি।

এইটুকু বাক্য যেন মুহূর্তেই সবার মুখের ভাষা কেড়ে নেয়।
চোখেমুখে ছড়িয়ে পড়ে অবিশ্বাস, বিস্ময় আর নিঃশব্দ সমবেদনা।

সবার গলায় যেনো ঝরতে লাগলো আফসোসের সুর,
-আহারে, মেয়েটার সংসার টিকলো না রে।
-আমি তো আগেই বলেছিলাম, আবেগের বশে বউ করে নিয়ে যাচ্ছে,, আবেগ কেটে গেলে ফিরিয়ে দেবে।
-মেয়েটা কালো, তাই বলেছিলাম কোনো বিপত্নীক পুরুষের গলায় গছিয়ে দাও, কিন্তু মেয়ের বাবা শুনলেন না।

শেষের কথাটা যেন বিষাক্ত তীর হয়ে এসে বিদ্ধ করলো বুকে।
চাচির চোখে চোখ রেখে আমি বলেই ফেললাম,
– আপনার মেয়ে তো খুব সুন্দর ছিলো চাচি, তবু সে কেনো সংসার করতে পারলো না? বিয়ের মাত্র দুই মাসের মাথায়ই ফিরে এসেছিলো কেনো?

চাচির মুখ নিমেষেই কালো হয়ে গেলো, ঠোঁটের কোণে থমকে গেলো যত কথা।
আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালাম না, সোজা পা বাড়ালাম ঘরের দিকে।

হয়তো এটাই ছিলো শুরু,
অপমান আর অবহেলার এক দীর্ঘ, পাথুরে পথের।
আবারও আমার নামের পাশে বসবে করুণার ট্যাগ,
আবারও আমি হয়ে উঠবো গল্পের অতৃপ্ত, অপয়া এক চরিত্র।
দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারি,
এই সমাজ ব্যর্থ মেয়েদের ক্ষমা করে না,
আর কালো মেয়েদের তো প্রশ্নই উঠে না।

আমার ফাওয়াদের যখন দুই মাস পূর্ণ হলো, তখন হঠাৎ একদিন বিকেলের শান্ত সময়ে ফাহিম আর শাশুড়ী এসে হাজির হলেন উঠোনে।
আমি তাদের আগমনে চমকে গেলাম, কিন্তু ভদ্রতার খাতিরে মুখে কোনো অনাগ্রহ না দেখিয়ে শান্ত স্বরে বললাম,
-ভেতরে আসুন।

শাশুড়ী ঢুকলেন, পেছনে পেছনে ফাহিমও, যে মানুষটা কখনো ছেলের জন্মের খবরটাও জানতে চায়নি, একবারও ফিরে তাকায়নি, আজ সে মায়ের সাথে এসেছে।

আমি আমাদের সাধ্যের মধ্যে যা সম্ভব, তা-ই সামনে এগিয়ে দিলাম।
চা, বিস্কুট, আর নিজের সমস্ত ক্ষত লুকানোর চেষ্টা।
তবে ফাওয়াদকে সামনে আনলাম না।
যে মানুষগুলো এই নিষ্পাপ প্রাণটাকে দুনিয়ার আলো দেখাতে চায়নি, জন্মের আগে থেকেই অস্বীকার করেছিলো তার অস্তিত্ব, তাদের সামনে ছেলেকে তুলে ধরার কোনো অর্থ খুঁজে পাই না।

তাদের উপস্থিতি যতটা আকস্মিক, ততটাই অস্বস্তিকর।
এই হঠাৎ আগমন নিশ্চয়ই কোনো স্বার্থের কারণেই।

ঘণ্টাখানেক চুপচাপ বসে থাকার পর শাশুড়ী হঠাৎ গলা তুলে বললেন,
– আমাদের বংশের ছেলে কোথায়? দেখি তো তাকে।
আমি ঠাণ্ডা হেসে বললাম,
– কোন ছেলে?
-ফাহিমের ছেলে।
-উনার ছেলে কোথায়, সেটা আমি জানি না।
-তোমার কাছেই তো আছে, ওকে নিয়ে এসো।

আমি এবার আর সংযম ধরে রাখতে পারিনি।
শান্ত কণ্ঠে কিন্তু তীক্ষ্ণ কথায় বললাম,
-খবরদার! তাকে নিজের বংশধর বলার সাহস করবেন না। সে শুধুই আমার সন্তান। তার মা আমি, বাবাও আমি। সে আপনাদের কেউ না।

শাশুড়ীর চোখে জ্বলে উঠলো রাগের আগুন, গলার স্বর কেঁপে উঠে বললেন,
-আমার ছেলে যদি বাবা না হয়, তবে কি আকাশ থেকে উড়ে এসে তোমার পেটে ঢুকেছে বাচ্চাটা?

মায়ের সমান বয়সী একজন নারীর মুখে এমন নিকৃষ্ট কথা শুনে আমার শরীরটা কেঁপে উঠলো।
গা ঘিনঘিন করতে লাগলো ঘৃণায়।
তবু নিজেকে কষ্ট করে সামলে নিলাম।

শাশুড়ী আবার বললেন,
-তোমার বাবাকে ফোন করে ডেকে আনো তো। এখনই।

আমি কিছু না বলে বাবাকে ফোন দিলাম।
বাবা বিশ মিনিটের মাথায় চলে এলেন, ক্লান্ত মুখে।
তবে চোখে তার চিন্তার ছাপ স্পষ্ট।

শাশুড়ী শুরু করলেন অভিযোগের পাহাড়,
– আমাদের ছেলের ছেলেকে আমাদের দেখতে দিচ্ছে না।
বাচ্চাটাকে বাপের পরিচয় ছাড়া মানুষ করবে, এটা কি কোনোভাবে সম্ভব?
ছেলের গায়ের গন্ধ মুছে ফেলতে পারবে? এই ছেলেকে ফাহিম ছাড়া কেউ চিনবে?

বাবা অনেকক্ষণ চুপ থেকে হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
– তুরিন, অযথা কথা বাড়িয়ে লাভ নেই।
ফাওয়াদকে একবার তাদের কোলে দিয়ে দাও।
সেও না হয় শেষবারের মতো বাবার গন্ধ মেখে নিক।

বাবার কথা শুনে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো।
যাকে আঁকড়ে ধরে আমি বাঁচি, যার মুখের হাসি আমার জীবনের শেষ আশ্রয়,
তাকে কি এত সহজে তুলে দেওয়া যায়?

তবু বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে সংযত রাখলাম।
আমি জানি, এখান থেকেই শুরু হবে আরও কঠিন কোনো পর্ব।
এখানেই হয়তো আমার সহ্যশক্তির নতুন পরীক্ষা শুরু হবে।

তবু নিজেকে শক্ত করলাম।
কারণ আমি জানি, এ গল্পে শুধু আমি নই,
আমার মতো আরও অনেক তুরিন আছে,
যারা প্রতিদিন বুকের পাঁজরে লুকিয়ে রেখে দেয় হাজারটা কষ্ট,
তবু হাসে, তবু বাঁচে,
আর বাঁচায়।

আমি ফাওয়াদকে দাদির কোলে তুলে দিলাম।
শাশুড়ীর মুখে ফুটলো একটি অমোঘ আনন্দ, যত্ন আর মায়ায় সে নাতিকে আদর করতে করতে বলল,
– আমার কুতুকুতু দাদুভাই, আমার সোনা, আর তোকে এই এসি-বিহীন দুর্গন্ধময় পরিবেশে রাখা যাবে না। আজই তোমাকে নিয়ে যাওয়া হবে।
তোমার দাদিমা তোমাকে নিতে এসেছে, এই গহ্বর থেকে মুক্তি দেবে।
এখানে থাকলে তুমি কালো হয়ে যাবে, তোমাকে এখানে আর ফেলে রাখা চলবে না।
তোমার দাদুভাই তো পুরো বাড়িটা সাজাতে ব্যস্ত, যেন তোমার জন্য একটি স্বপ্নের আবাস তৈরী করতে পারে।

শাশুড়ীর কথাগুলো শুনে আমার চোখের কোণা ভিজে উঠলো,
কিছু বলতে চাইলেও গলাটা বাধা দিলো, গলা আটকে গেলো।

পরক্ষণেই ফাহিম ছেলেকে মায়ের কোলে থেকে নিজের কোলে তুলে নিলো।
তার চোখ-মুখে ছিল এক অদ্ভুত উচ্ছ্বাস, এক মায়াময় মায়া যা আমি আগে কখনো দেখিনি।
সে বার বার ছেলের মুখে হাতে বুলিয়ে বলল,
– আমার ছেলে আমার মতোই হইছে তাই না মা?

এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো, হয়তো সকল বাবাই এমন হয়।
সন্তানকে কাছে পাওয়ার আনন্দে সব গ্লানি, সব কষ্ট, সব ভুলে যাওয়ার ক্ষমতা তাদের আছে।

কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো,
যদি ফাওয়াদ কালো হতো, যদি তার চেহারা অন্যরকম হতো, তাহলে কি তারা এত আদর করতো?
অবশ্যই না।
সেই কালোত্বেই তাদের অবজ্ঞা, তাদের দূরত্বের জন্ম,
তারা কখনো ছুটে আসতো না, কখনো এমন ভালোবাসায় ভাসাতো না।

এই সমাজের অন্ধ বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ছেলেকে আদর করা থেকে বিরত রাখতো।

শাশুড়ীর সোনালী হালকা কেশের মাঝে ঠোঁটের কোণে খুনসুটি হাসি ফুটে উঠল,
-বলেছিলাম তো বেয়াই মশাই, আমাদের ছেলেকে আমরা বাড়ি নিয়ে যেতে চাই।

বাবার মুখে যেনো সব মান-অভিমান, সব কষ্ট ভুলে যাওয়ার ছায়া নেমে এল।
তিনি ধীরে বললেন,
– হ্যাঁ, তোমাদের বউ, তোমাদের নাতি, তোমাদের বাড়ি তো অবশ্যই যাবেই।
তবে আমার একটাই আকুল অনুরোধ, আমার মেয়ের সঙ্গে এমন কোনো অভিচার আর যেনো কেউ না করে।
গরীব হতে পারি, কিন্তু সেও আমার আদরের রাজকন্যা, আর সে তার মর্যাদা হারাবে তা আমি সহ্য করতে পারবো না।

আমি বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম,
– এসব কি বলছো বাবা, আমাকে আবারও ওবাড়ি পাঠাবে?

বাবা হেসে মুখের কোণে খানিকটা কাঁপুনি নিয়ে বললেন,
– এই বাচ্চার উছিলায় দেখবি ওরা বদলে যাবে।
আগের মতো এত অন্যায়, এত অবিচার আর করবে না, দেখিস।

শাশুড়ী আবার মুখে হাসি ফোটালেন,
-আপনার মেয়েকে কে নিয়ে যাচ্ছে?
আমরা তো শুধু আমার দাদুভাইটাকে নিয়ে যেতে এসেছি।
আপনার আদরের রাজকন্যাকে বরং আপনার কাছেই রেখে দিন।
সেদিনকের অপমান আমরা ভুলিনি,
এমন মেয়েকে আমি কখনোই ঘরে তুলবো না।
সে কি ভেবেছে ছেলে জন্ম দিয়েছে বলে তাকে মাথায় তুলে রাখবো?

শাশুড়ীর কথাগুলো কানে ধুলোর মতো লাগল,
কিন্তু বাবার চোখে ভেসে উঠল মায়ার এক অমলিন দীপ্তি,
যেন তার মেয়ের জন্য এখনও বেঁচে আছে অগাধ ভালোবাসার স্রোত।

তাদের তির্যক কথাবার্তার মাঝে আমি আর সহ্য করতে পারিনি। রক্তে আগুন জ্বলে উঠলো। শাশুড়ির কোলে নিশ্চিন্তে ঘুমন্ত ছেলেটাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম বুকে, যেন বুকের গভীর কোন গহীন আশ্রয়ে লুকিয়ে ফেলি তাকে।

উচ্চস্বরে বলে উঠলাম,
-এতোদিন কোথায় ছিলেন আপনারা? কোথায় ছিল আপনাদের ভালোবাসা, কোথায় ছিল দায়িত্ব?
একটিবারও ফিরে তাকাননি, কেউ জিজ্ঞেস করেনি, তুরিন, তোমার কেমন চলছে? এই ছোট্ট শিশুটি কেমন আছে?
আজ হঠাৎ কেন এমন স্নেহ-ভরা মুখোশ পরে এসে ছেলেকে নিয়ে যাওয়ার অধিকার জাহির করছেন?

আমার চোখ দুটো জল আর আগুনে একসাথে জ্বলছিল,
-যদি কেউ এক পা-ও বাড়ায় আমার ছেলের দিকে, তবে আমি তুরিন ভুলে যাবো, কে আমার শাশুড়ি আর কে আমার স্বামী।
আমি এমন এক মা, যে সন্তানের জন্য নিজের দেহ থেকে আত্মা আলাদা করে ফেলবো, দরকার হলে নিজের সবকিছু ছিন্ন করে ফেলবো, তবুও আমার ছেলে কে আমার থেকে আলাদা হতে দেবো না।
আমি আবারও বলছি, এক পা যদি কেউ আগায়, আমি প্রত্যেকের মাথা আলাদা করে ফেলবো এই মা’র ভালোবাসার সামনে কোনো সম্পর্ক, কোনো রক্তের বাঁধন টিকবে না।

ঘরটা স্তব্ধ হয়ে গেলো, সবাই যেনো জবাকুসুমের মতো লাল হয়ে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে একজন মায়ের দম্ভ, দ্রোহ আর ভালবাসায় ভেজা চোখের দিকে।

আমি থেমে রইলাম না অপমানের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে যখন বুকের ভেতরটা পাথরের মতো শক্ত হয়ে এলো, আমি দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠলাম,
-এক্ষুণি আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান! নাহলে যা হবে তা কারোর পক্ষেই ভালো হবে না।
আর শোনেন, ফাহিম সাহেব, আপনি যত তাড়াতাড়ি পারেন ডিভোর্সের কাগজ পাঠিয়ে দিন।
আপনার মতো এক কাপুরুষের ছায়াতেও আমি থাকতে চাই না। সেই সম্পর্ক, যে সম্পর্ক সন্তান জন্মের আগেই মরে গেছে, তার কবর এখন আমার হাতেই হবে।

ফাহিম কিছু বলতে যেয়ে থেমে গেল, শাশুড়ির মুখে বিস্ময়ের রেখা খেলে গেল হয়তো এমন তুরিনকে কখনও দেখেননি তারা।
চোখের কোণ দুটো জ্বলে উঠেছিল আমার, তবুও মুখটা ছিলো দৃঢ় পাথরের মতো।

ওরা দুজনেই ধীরে ধীরে বাড়ির চৌকাঠ পেরিয়ে চলে গেলো।
আমি ধপ করে বিছানায় বসে পড়লাম। বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো ঠিকই, কিন্তু বাইরে থেকে নিজেকে কঠিন রাখলাম।
বাবা এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন,
-তুই কি ঠিক করলি মা?

আমি চোখ মুছে মাথা নাড়িয়ে বললাম,
-এখন ভাঙলে চলবে না বাবা। এখন নিজেকে গড়তে হবে, আমার আর ফাওয়াদের জন্য।

তারপর বাবাকে বললাম,
-গ্রামের সবাইকে বলে দিও, কারো কিছু সেলাইয়ের দরকার হলে যেনো আমাকে বলে। আমি কাজ শুরু করবো আজ থেকেই।

বাবা বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করলেন,
-তুই পারবি নানুভাইকে সামলে এইসব?

আমি মৃদু হেসে বললাম,
-পারবো কেনো না বাবা? আমাদের নিয়েও তো মা সবকিছু একা হাতে সামলেছেন। ফাওয়াদ তো একা, আমরা তো ছিলাম তিন বোন। আমি মা’র মেয়ে, পারতেই হবে আমাকে।

বাবা আর কোনো কথা বলেননি, শুধু মায়াভরা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন।
সেই রাতেই মায়ের পুরোনো রুমটা আমি ঝেড়ে মুছে নতুন করে গুছিয়ে নিলাম, একটা নতুন শুরুর ঠিকানা করে রাখলাম।

পরদিন সকাল বেলা উঠোনে বের হতেই দেখি চাচি দৌড়ে এসে বলছেন,
-তুই ঘরে যা তুরিন, এখন বাইরে কেন? যা ঘরে যা।

আমি অবাক হয়ে বললাম,
-ঘরে যাই? কেন চাচি?

চাচি কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, তখনই দাদি গম্ভীর গলায় বললেন,
-অলক্ষী ঘরে যা! নিজের সংসার তো ভেঙেছিসই, এবার আমাদের ঘরেও অমঙ্গল বয়ে আনবি না!

আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। চারদিক কেমন থমথমে হয়ে উঠলো।

মিন মিন করে জিজ্ঞেস করলাম চাচিকে,
-চাচি, কী হয়েছে?

চাচি ফিসফিস করে বললেন,
-কাল থেকে সকালে তুই ঘর থেকে বের হবি না। পুরুষ মানুষ কাজের উদ্দেশ্যে ঘর ছাড়ার সময় যদি ডিভোর্সি বা বিধবার মুখ দেখে যায়, তবে তাদের অমঙ্গল হয়, তাদের রুজি-রোজগারে ব্যাঘাত হয়। সংসারে অশান্তি নামে।

আমি আর কিছু বললাম না। শুধু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তাকিয়ে রইলাম আকাশের দিকে।
মানুষ আজও কুসংস্কারে বিশ্বাস করে, আজও মেয়েদের ভাঙা সংসারকে ‘অলক্ষুণে’ তকমা দিয়ে দেয়।
আমার দোষ আমি স্বামীর গায়ের গন্ধ না মেখে ছেলের গায়ের ঘ্রাণকে ভালোবেসেছি, আমি নিঃশব্দে স্বপ্নের কবর কেটেছি, আমি কেবল একজন মা হয়েছি।
আর এই সমাজ ঠিক সেই ‘মা’কেই আজও অপবিত্র ভাবে, অলক্ষী ভাবে।
❝আজ পর্ব একটু ছোট হয়ে গেলো, আপনারা সাড়া দিলে আগামীকাল বড় করে পর্ব দিবো, তুরিনের নতুন সংগ্রামের।❞

চলবে,,,,,