#কালিনী
#আরেব্বা_চৌধুরী
#পর্ব_সংখ্যা ১০
বাড়ি ফিরে শাশুড়ির চোখ মুখ লাল হয়ে ওঠে রাগে।
চুল খোলা, আঁচলে ধুলো, পায়ের জুতোটাও যেন উনি রাগ সামলাতে পারছে না।
কাঁপা কাঁপা গলায় ধেয়ে এলো স্বামীকে উদ্দেশ করে,
-এই হলো তোমার বউ? ফকিন্নি ঘরের একটা মেয়ে আমাকে অপমান করে, বাড়ি থেকে বের করে দেয়!
জিভ কেটে বললেন,
-ওর কি আদৌ কোনো যোগ্যতা আছে এ বাড়ির বউ হবার?
আমি তো ভেবেছিলাম আমার কথায় উঠবে, আমার ইশারায় বসবে, নিজের গরিব মা-বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে সব কিছু মেনে নেবে।
সেই মেয়েই আজ আমার সামনে দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রাখে! আমার সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে?
আসলে আমি ভুল করেছি, বড় ভুল।
মেয়েটিকে আমি যতটুকু উঁচুতে তুলেছি, ওর জায়গা আদৌ এত ওপরে নয়।
আমি ভুলেই গেছিলাম,
সব গরিব মেয়ে নরম হয় না, কিছু কিছু বুকের ভেতর অহংকার নিয়ে জন্মায়।
আমি যাকে পায়ের নিচে রাখবো ভেবেছিলাম, সে তো আমার মাথার ওপর দাঁড়িয়ে গেছে!
মুখ ঘুরিয়ে আবার ফুঁসে উঠলেন,
-আমার জায়গা কেড়ে নিচ্ছে এখন, কালকে দেখো, আমার ছেলে-নাতি, বাড়ি জমিও কেড়ে নেবে।
এই মেয়ের চোখে এমন চাহনি, যেন এই বাড়ির মালিক সে-ই!
কথার ফাঁকে হঠাৎ থেমে গেলেন,
তবু চোখে জ্বলজ্বলে প্রতিজ্ঞার ছায়া,
-আমি ছাড়বো না তাকে, যতই তেজ হোক, তেজে তো আগুনও পোড়ে। আমি নিজে হাতে নিভিয়ে দেবো ওর এই অহংকারের আগুন।
বাবা যখন কাজে যাচ্ছিলেন, আমি আগেভাগেই মেশিনের সুই, সুতো, চেইন, তেল যা যা দরকার তা কাগজে লিখে হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললাম,
-আসার পথে এগুলো নিয়ে এসো বাবা।
বাবা মৃদু হেসে শুধু বললেন,
-আচ্ছা।
সারাটা দিন কেটেছে রান্নাবান্না আর ফাওয়াদকে ঘিরে।
আজকাল আর কেউ আগের মতো গল্পে মেতে ওঠে না।
উঠোনে একটু পা বাড়ালেই যাদের ভালোবাসা ঢলে পড়তো চোখে মুখে, এখন তারা শুধু করুণা মিশ্রিত দৃষ্টিতে তাকায়।
কেউ আর ডেকে বলে না,
-এই নে, গরম গরম লুচি করেছি, খেয়ে যা।
বরং মনে হয় যেন আমি এই বাড়ির নয়, এক অবাঞ্ছিত উপস্থিতি।
ভালোবাসা নয়, এখন কেবল পাওয়া যায় কিছু বিষণ্ণ দীর্ঘশ্বাস আর মাপে মাপে মাপা সহানুভূতি।
সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামার মুখে বাবা ফিরে এলেন।
আজ অদ্ভুতভাবে তাড়াতাড়ি ফিরলেন।
আমি একটু চমকে জিজ্ঞাসা করার আগেই বাবা হাঁপাতে হাঁপাতে বসলেন, চোখে কেমন এক ক্লান্তির ছায়া।
-শরীর ঠিক লাগছে না, বলে এক হাত কপালে রেখে নিচু স্বরে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললেন।
বাবাকে এই বয়সে এখনো এত খাটতে দেখে বুকটা হাহাকার করে ওঠে।
সারাদিন গরমের মধ্যে গাড়ি নিয়ে যিনি ঘুরেছেন, সন্ধ্যায় তাঁর পা যেন আর শরীরের ভার নিতে চায় না।
মনটা কেঁদে ওঠে।
আল্লাহ যদি আমাকে ছেলে করে পাঠাতেন!
তাহলে আজ হয়তো বাবাকে এই বয়সে এমন কষ্ট করতে হতো না।
এই সমাজে মেয়েদের রঙ, বর্ণ, দোষগুণ সব হিসাব হয়,
কিন্তু ছেলেদের নয়, তাদের শুধু টাকা থাকতে হয়।
আমি শুধু চুপচাপ বাবার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
বাবার কপালে তখনও ঘামের বিন্দু ঝলমল করছে,
আর আমার বুকের ভিতর নিঃশব্দে জমছে অপরাধবোধ,
অক্ষমতার এক অদৃশ্য বোঝা।
আজ নিজের হাতে বাবাকে খাইয়ে দিলাম। যেন চোখের সামনে আমার আরেকটা ফাওয়াদ নির্ভরশীল, নিশ্চুপ, শান্ত।
খাওয়ানো শেষে পায়ের কাছে বসে একটু তেল মালিশ করে দিলাম, যেন ঘুমটা আরও গভীর হয়, যেন শরীরটা একটু আরাম পায়।
সকাল সকাল বাইরে বের হওয়ার কথা থাকলেও পারলাম না।
গতকালকের সেই দৃশ্য মনে পড়তেই বুকটা ভার হয়ে এল।
বেলা আটটা পেরোতেই, অনেক না ভেবে বাড়ির দোর পেরোলাম।
আর তখনই,
হঠাৎ কেউ একজন হুমড়ি খেয়ে এসে দাঁড়াল সামনে।
চমকে তাকাতেই দেখি ফাহিম!
চোখের নিচে কালি, চুল এলোমেলো, যেন গোটা রাত না ঘুমিয়ে ছুটে এসেছে শুধু আমাকে খুঁজতে।
আমি শান্ত গলায় শুধোলাম,
– কী দরকার ছিল?
এক সময়ের হুংকার করা ছেলেটা আজ যেন থেমে গেছে।
কাঁপা কাঁপা হাতে একটা স্মার্টফোন আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
– এটা রেখে দাও, মাঝেমধ্যে আমি ফোন করে ছেলেকে দেখতে চাই।
আমি গভীরভাবে তার চোখে তাকালাম।
নির্দয়ভাবে বললাম,
– কিসের ছেলে? এখন হঠাৎ কোথা থেকে এই ভালোবাসা উথলে উঠলো?
যখন গর্ভে ছিল, তখন তো সবাই মিলে তাড়া দিয়েছিলে আমাকে এই সন্তানকে নষ্ট করে দিতে!
ডাক্তারের কাছে নিতে বারবার বলেছি, তোমরা কর্ণপাত করোনি।
তোমরা তো এই জীবনটাই চাওনি!
তার চোখে-মুখে তীব্র অপমানের ছাপ, কিন্তু আমি থামি না।
-এখন কেন এলে? কী দাবিতে?
আমি চাই না আমার ফাওয়াদ জানুক তার জন্মই কারো কাম্য ছিল না।
আমি চাই না সে জানুক তার অস্তিত্বের প্রথম যুদ্ধটা তার মা’কে একা লড়তে হয়েছে তারই রক্তের মানুষের বিরুদ্ধে।
আমি শুধু চাই সে জানুক তার মা ছিল অটল, একা হয়েও অটল।
আর তার বাবা?
সে ছিল একজন কাপুরুষ যে নিজের দায়িত্ব নিতে জানত না, সাহস করে পাশে দাঁড়াতে পারেনি।
এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে ফেলি।
তবুও বুকের গহীন থেকে হুহু করে কান্না এসে চেপে ধরে।
তবে আজ আর কাঁদি না।
আজ আমি দুর্বল নই, আজ আমি এক সন্তানের জন্য সব হারিয়ে বেঁচে থাকা এক মা এক শক্তি।
ফাহিম কাপা গলায় বললো,
– তুমি ফিরে আসো।
আমি গভীর চোখে তাকিয়ে বললাম,
– আমি ফিরে এলেই কি আপনার মা মেনে নেবেন? আর যদি না নেন, তবে আপনি কি পারবেন আপনার পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে আমার পাশে দাঁড়াতে?
আমার প্রশ্নে থমকে গেলো ফাহিম।
চোখ নামিয়ে ক্ষীণ কণ্ঠে বললো,
– ফাওয়াদের যত্ন নিও।
আসতে যখন মানা করছো, তখন আর আসবো না।
তারপর কোনো উত্তর না দিয়েই উল্টো দিকে পা বাড়ালো সে।
আমি নিঃশব্দে তাকিয়ে রইলাম তার চলে যাওয়ার পথে।
মুখে যতই বলি, ‘আর আসবে না’, কিন্তু মন থেকে কখনও চাইনি সে চলে যাক।
আমি চেয়েছিলাম, সমস্ত ভাঙাচোরা গল্পের মাঝেও তাকে আঁকড়ে ধরে থাকি।
চেয়েছিলাম, পৃথিবী ছিন্নভিন্ন হলেও সে শুধু আমার থাকুক।
কিন্তু সে কি আমায় সত্যিই চেয়েছিলো?
একটা মেয়ে যখন বিয়ের সিঁড়িতে পা রাখে, তখন সে শাড়ির আঁচলে স্বপ্ন বোনে,
একটা নিজের মতো ঠিকানা, একটু নির্ভরতা, একটু সম্মান, আর একটা ছায়াময় ভালোবাসা।
সে সংসার গড়তে আসে, ভাঙতে নয়।
তবুও কেন যেন কিছু গল্পের পরিণতি পূর্বেই লেখা থাকে।
ভালোবাসা থাকলেও সম্পর্কের কাঁধে চেপে বসে অসম্মান, অবহেলা আর তুচ্ছতাচ্ছিল্য।
ওদিকে শাশুড়ী কনে দেখতে শুরু করলেন।
দুই মাসের মধ্যেই ছেলের বিয়ে দিয়ে তিনি প্রমাণ করে দেবেন, এই কালো-মেয়ে কালিনী তো দূরের কথা, তার তো এই ঘরের কাজের মেয়েও হবার যোগ্যতা ছিল না।
এবার আর গ্রামের রঙহীন মুখ নয় পাত্রী হতে হবে গায়ের রঙে ঝকঝকে, শহুরে চালচলনে পরিপাটি।
হবে এমন এক মেয়ে, যাকে পাশে দাঁড় করিয়ে আত্মীয়সমাজে বুক ফুলিয়ে বলা যাবে এটাই আমার ছেলের বউ।
তার চোখে এখন শুধু একরাশ ক্ষোভ, অপমানের প্রতিশোধ আর হঠকারি আত্মঅহংকার।
তিনি ভুলেই গেলেন একটা মেয়েকে ঘরে তুলে এনে তাকে শুধু বউ নয়, মানুষ হিসেবেও সম্মান দিতে হয়।
আমি শুধু চুপচাপ ভাবলাম, কী অদ্ভুতভাবে একটা নারীর হাতে আরেক নারীর ভাগ্য খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে যায়।
তবু চোখের জলে নয় আমি লড়বো নীরবে।
আমি প্রমাণ করবো, কারো চোখে ‘কালো’ হলেও মনের ঔজ্জ্বল্যে আমি কারো চেয়ে কম নই।
ঘরের কাজের মেয়ের তকমা নয়, আমি নিজের পরিচয়ে বাঁচতে শিখেছি, নিজেকে সম্মান করতে শিখেছি।
অবশেষে নিঃশব্দে বদলাতে থাকলো আমার দিনলিপি।
আস্তে আস্তে গ্রামের মানুষজন ঘরের পর্দা, পুরনো জামাকাপড় কিংবা উৎসবের নতুন কাপড় হাতে নিয়ে এসে দাঁড়ায় আমার ছোট্ট কাজের ঘরে।
একেকটা কাপড়, একেকটা রঙ যেনো একেকটা গল্প হয়ে ধরা দেয় সুঁই-সুতার ছোঁয়ায়।
আমি মন বসিয়ে কাজ করি, আঁচলের প্রান্তে ফুল ফুটাই।
এই ব্যস্ততায় যেন নিজের বুকে জমে থাকা সব দুঃখ ধুয়ে যায়।
মনের ভিতরে একরকম প্রশান্তি জেগে ওঠে,
কেউ আর কথা কটু বলে না, বললেও কান পেরিয়ে হৃদয়ে এসে ঠেকে না।
মায়ের এই ছোট রুমটাই এখন আমার জগৎ,
যেখানে সূর্য ওঠে আমার সেলাইয়ের প্যাডেলে আর সন্ধ্যা নামে সুতো গুটিয়ে রাখার ক্লান্তিতে।
এই ঘরে আমি দিন গুনি না, গড়িয়ে যাওয়া সময়েরও কোনো হিসাব রাখি না।
একদিন বাবা নিজেই এসে আমার হাতে তার রোজগারের সবটুকু দিয়ে বললেন,
-আজ থেকে এই সংসারের দায়-দায়িত্ব তোর।
ভাঙাগড়ার খেলায় এখন তুই-ই খেলোয়াড়,
যা দরকার নিজেই কিনে নিস, কাউকে বলার দরকার নেই।
বাবার কণ্ঠে গর্বের ছায়া ছিলো,
আর আমার চোখে যেন জল ছিলো এক নতুন প্রতিজ্ঞার।
আমি জানতাম, আমি যদি নিজেকে গড়ে তুলতে পারি,
এই ছোট ঘর একদিন অনেক বড় হয়ে যাবে,
শুধু আয়তনে নয়, মানুষের চোখে সম্মানে।
সেলাই আর বাবার দেওয়া সামান্য কিছু টাকা মিলিয়ে হাতে জমলো মোটে দুই হাজার।
সেই রাতেই অনেক ভেবেচিন্তে একটা সিদ্ধান্ত নিলাম শুধু সেলাইয়ের আয়ের উপর নির্ভর করে বসে থাকলে হবে না, সময় এসেছে নিজেকে আরও একধাপ এগিয়ে নেওয়ার।
মায়ের এই ঘরটা যথেষ্ট বড়। একপাশে আমার সেলাই মেশিন, অন্যপাশটা তো অলসই পড়ে আছে। হঠাৎ মনে হলো, ওই জায়গাটুকু কাজে লাগিয়ে যদি ছোটদের জন্য চিপস, বিস্কুট, চকলেটের একটা ক্ষুদ্র দোকান দিই?
সেই ভাবনাই প্রাণ পেলো।
আমি তো এ গ্রামেরই মেয়ে, এখানকার শিশুদের পছন্দ-অপছন্দ আমার নখদর্পণে। জানি কখন তারা স্কুল ফেরত মায়ের হাত ছাড়িয়ে দোকানে ঢুকে পড়ে, জানি কোন শিশুটি মিষ্টির চাইতে টক খেতে ভালোবাসে।
হয়তো কারো কাছে হাস্যকর শোনাবে, তবে এটাই সত্যি, শুধু দুই হাজার টাকা নিয়ে এমন স্বপ্ন দেখা!
কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, শুরু যদি সৎ হয় আর ইচ্ছেশক্তি যদি অটুট থাকে, তবে সেই ছোট্ট দোকান একদিন বড় স্বপ্নের জানালা হয়ে উঠবেই।
সেদিনও আসবে, যখন মানুষ বলবে, এই দোকানটাই তার জীবনের প্রথম জয়, প্রথম লড়াইয়ের প্রতিচ্ছবি।
আমার চোখে জল আসে না, আসে একরাশ সাহস।
কারণ আমি জানি,আমি হেরে যেতে আসিনি।
এই দুই হাজারই হবে আমার নিজের পায়ে দাঁড়ানোর প্রথম সিঁড়ি।
অপরদিন ভোরেই বাজারে বেরিয়ে পড়লাম।
বড় এক প্যাকেট মটর, চানাচুর আর বাদাম তুলে নিলাম ঝুড়িতে।
ছোট ছোট বিস্কিটের প্যাকেট, ছোট ছোট কেক, লিচু আচার সবই অল্প অল্প করে কিনে নিলাম, যেন দোকানের তাক ভরলেও পুঁজি না ফুরায়।
জানি, আপাতত তেমন লাভ হবে না। একসাথে অনেক কিনলে দামটা তুলনামূলক কম পড়ে।
কিন্তু আমি তো এখনই লাভ খুঁজতে যাইনি আমি চাই, দোকানটা আগে দাঁড়াক, এই গ্রামের মানুষ জানুক, বিশ্বাস করুক এই দোকানের প্রতি।
বাড়ি ফিরেই বসে গেলাম প্যাকেট বানাতে।
মটর আর চানাচুর মেপে ছোট ছোট থলেতে পুরে ফেললাম।
বাদাম ভেজে শুকিয়ে নিখুঁতভাবে বেঁধে রাখলাম।
তারপর বাচ্চাদের ডেকে বললাম,
– শোনো, এখানে চাল , ডিম, টাকা তিনটে দিয়েই মজা কিনতে পাওয়া যায়।
যার যেটা পছন্দ এখান থেকে কিনে নিয়ে খেতে পারো।
সেই থেকেই শুরু।
কে যেন প্রথম একমুঠো চাল নিয়ে এলো, তার পরের দিন আরেক শিশু একটা ডিম হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো।
কেউ কেউ টাকা দিলো, কেউ কেউ কেবল হাসি দিয়ে বললো, এই দোকানটা ভালোই চলবে।
যে চাল আর ডিমগুলো দোকানে জমা হতে লাগলো, সেখান থেকেই আমাদের সংসার চলতে লাগলো।
বাবা আর আমি আর আলাদা করে চাল কিনিনি, ডিমও না।
যেটুকু ঘরের প্রয়োজন, সেখান থেকেই উঠতো, আর বাড়তি যা থাকতো, তা দিয়ে বিক্রি করে আবার নতুন পণ্য তোলা যেত।
আমার সেলাইয়ের রোজগার, বাবার গাড়িচালানোর টাকাও সব ঢেলে দিতে লাগলাম এই ছোট্ট দোকানটার ভিত শক্ত করতে।
মনে হতো এ শুধু দোকান নয়, এ যেন একটুকরো স্বপ্ন, আমাদের ঘরের প্রাণ।
সন্ধ্যা নামলে আলো জ্বালিয়ে বসতাম দোকানে,
এক কাপ চায়ের পাশে বসে থাকতো স্বপ্নগুলো,
আস্তে আস্তে বদলে যাচ্ছিল আমাদের দিনগুলো।
অভাব থেকে আত্মমর্যাদায়, হেরে যাওয়া থেকে মাথা উঁচু করে বাঁচার দিকে।
বাবা যখন বললেন, কাল তোর সেলিম চাচার মেয়ের বিয়ে, সেই খেয়াল আছে?
আমি মৃদু হেসে উত্তর দিলাম,
-দোকান, সেলাই, ঘর গোছানো আর ফাওয়াদের দেখভাল করতে করতেই তো সময় কেটে যায় বাবা, এসব খোঁজ রাখার ফুরসতই কই?
বাবা স্নেহভরা চোখে তাকিয়ে বললেন,
-জানি রে মা, কিন্তু এই কাজ-কর্মের বাইরে একটা জীবন আছে, একটু ফুরসতের প্রয়োজনও আছে। কাল একদিন ফোঁকা রাখ দোকানটা, নানু ভাইকে নিয়ে যাস বিয়ে খেতে। একটু হাওয়ায় দেহ মন চাঙ্গা হবে।
ভাবলাম ঠিকই তো, গত দশ পনেরো দিন ধরে একটানা খেটেই যাচ্ছি, বাইরের জগৎটাই ভুলে গেছি যেন।
কাল বরং ফাওয়াদকে নিয়ে একটু বের হই, মানুষের মুখ দেখি, নিজেরও মনটা হালকা হবে।
পরদিন সেলিম চাচার মেয়ের বিয়েতে হাজির হলাম, ফাওয়াদকে কোলে নিয়ে চুপচাপ এক কোণায় দাঁড়িয়ে ছিলাম।
মনটায় একটু প্রশান্তি খুঁজছিলাম কিন্তু যেই না চেনা মুখগুলো এগিয়ে এল, সেই শান্তি ভেঙে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলো।
একজন বলে উঠল,
-তুই তুরিন না? শুলাম তোর জামাই নাকি তোকে তালাক দিতে যাচ্ছে!
আরেকজন গালে হাত দিয়ে বলল,
-এই সুন্দর ছেলেটাকে দেখে তো বোঝাই যায় না, মনে হয়না এটাই তোরই ছেলে।
আরেকজন টিপ্পনী কাটল,
-নিজে ভালো হয়ে থাকলে সংসার ভাঙে? নিশ্চয় তোর মধ্যেই দোষ ছিল!
-আরে ও তো কালো!
-হ, কালো হইলেই বা কী, বাচ্চার মুখ দেখেও কি কেউ ফিরতে চায় না, নিশ্চয়ই কোনো রহস্য আছে, না হলে একটা নাতির মুখ দেখেও কেউ তাকে ঘরে টানে না!
সব শুনে চুপ করে ছিলাম, একসময় মুখ তুলে মৃদু হাসিতে বললাম,
-আসলে কি জানেন আপা, আপনাদের হাতে সময়টা খুব বেশি। দিনে রাঁধেন, রাতে ভাবেন, আর সেই ফাঁকে আমার জীবন নিয়ে গবেষণাও করে ফেলেন! অথচ আমি? নিজের খাওয়ার সময় পাই না, আপনারা কেমন করে এত সময় পান ভাবতে অবাক হই। কিছু মানুষ না অন্যের ক্ষত চুলকে না দেখলে, পেটের ভাত হজমই হয় না।
এতে মুখ চুপসে গেলো একেকজনের।
হঠাৎ এক ভাবি মুখ বাঁকিয়ে বললেন,
-এই দেখেই বুঝি গেলাম, তোর এই জ্বালাময়ী কথাতেই তুই সংসার করতে পারলি না। এত তেজ কিসের তোর?
আমি মুচকি হেসে বললাম,
-আরে ভাবি, ঠিকই ধরেছেন। আমার মধ্যে দোষ আছে তাই আমার স্বামী আমায় ত্যাগ করেছে। তবে ভাবি, আপনার মধ্যেও নিশ্চয়ই কোনো দোষ আছে, তাই তো ভাই আপনাকে রোজ চড়-থাপ্পড় মেরে নিজের পুরুষত্ব জাহির করে। তাও চলুক, আমার অন্তত নিজের উপার্জনের একটা পথ আছে, নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে বাঁচি। আপনি তো এখনো শাশুড়ি-জামাই-বউয়ের রগড়ানি সামলাতেই দিন কাটান। আমার সংসারে অন্তত এই নাটক ছিল না।
এবার আর কেউ কিছু বলেনি।
সবার মুখে থমথমে নীরবতা।
আমি কোলে ফাওয়াদকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে৷ কনের রুমের দিকে এগিয়ে গেলাম।
কনের পাশে বসতেই সেলিম চাচার বউ আমায় ধীর স্বরে ডাক দিলেন।
তাঁর কাছে যেতেই তিনি একপাশে সরিয়ে নিয়ে বললেন,
-মাগো, আজ আমার মেয়ের এক শুভ লগ্ন। আমি চাই না এই শুভ ক্ষণে কোনো অশুভ ছায়া ভিড়ে আসুক। তুমি বরং একটু দূরে থাকো, আমি আমার মেয়ের নতুন জীবনে কোনো অমঙ্গল টানতে চাই না।
তার কথায় বুকের ভিতরটা যেন ধ্বসে পড়ল। অপমান নয়, যেন নিজের অস্তিত্বটাই অস্বীকার করে দিলেন তিনি।
তবু মৃদু হেসে মাথা নুইয়ে তাঁর পাশ থেকে সরে এলাম, যেন কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে।
কিন্তু হৃদয়ের গভীরে একরাশ প্রশ্ন যেন দাউ দাউ করে জ্বলতে লাগল,
-এই কুসংস্কারের দেয়াল মানুষ কবে ভাঙবে?
ভাগ্যের লিখন কি কারও স্পর্শে বদলে যায়?
একজন বিধবা ডিভোর্সির উপস্থিতিই কি কারও জীবনে অমঙ্গল টেনে আনে?
আমার জীবনে যা ঘটেছে, তা তো আমার ইচ্ছায় হয়নি।
ভাগ্য যেমন লিখেছে, তেমনই বহন করছি আমি।
তবে কি সমাজ আমায় চিরকাল এই তুচ্ছতাচ্ছিল্যের চোখে দেখবে?
একটি সম্পর্ক ভেঙেছে বলে কি আমার আত্মাটাও ভেঙে গেছে?
আমি জানি, আমি অভিশাপ নই। আমি তো শুধুই এক সংগ্রামী নারী,
যার জীবনের গল্প একটু ছেঁড়া, একটু কাঁটায় গাঁথা,
তবু সেই গল্পে আছে সাহসের আলো, বেঁচে থাকার দীপ্তি।
আজ নয়, হয়তো একদিন এই সমাজ বুঝবে,
নারীর মর্যাদা তার বৈবাহিক অবস্থান দিয়ে নয়,
বরং তার চরিত্র, মনুষ্যত্ব আর আত্মসম্মানের গর্বে মাপা উচিত।
বিঃদ্রঃ দুই হাজার টাকার দোকান দেখে কেউ হাসবেন না, বা কেউ নেগেটিভ কমেন্ট করবেন না, হাজার খানেক টাকার মাধ্যমে নিচ থেকে উঠে দাঁড়াতে এমন অনেক-কেই দেখেছি আমি।
চলবে,,,,,