কালিনী পর্ব-১১

0
1

#কালিনী
#আরেব্বা_চৌধুরী
#পর্ব_সংখ্যা ১১

বাড়ি ফিরে এলাম।
বুকের ভেতর যেন একটা ভার বসে গেছে নিস্তব্ধ, অদৃশ্য এক বোঝা।
রান্নার কথা মনে হতেই যেন ঘৃণা ধরলো, কিছুই খেতে ইচ্ছে করলো না।
ফাওয়াদকে নরম করে জড়িয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে আমিও পাশে শুয়ে পড়লাম।
চোখের পাতায় ক্লান্তির ছায়া, মনেও একরাশ অন্ধকার।
কখন যে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে গেল, তা টেরই পাইনি।

ঘুম ভাঙলো বাবার মৃদু কণ্ঠে,
-উঠে পড় তুরিন।
তড়িঘড়ি করে উঠে পড়লাম।
রাতের রান্না বসাতে গিয়ে বাবা জিজ্ঞেস করলেন,
-বিয়ে বাড়ি কেমন লাগলো মা?

আমি একদম ছোট করে, একটিমাত্র শব্দে উত্তর দিলাম,
-ভালো।

রান্নার প্রস্তুতি নিতে নিতে চালের হাঁড়িতে হাত দিলাম।
হঠাৎ কী এক অদ্ভুত তাগিদে হাড়ির ভেতর থেকে এক মুঠো চাল আলাদা করে একটা ছোট কৌটায় তুলে রাখলাম।
কেন করলাম জানি না, কিন্তু মনে হলো, এ এক নিরবে গড়া প্রতিজ্ঞা।

সেই রাত থেকেই এটা আমার অভ্যেসে পরিণত হলো।
প্রতিদিনের রান্নার আগে এক মুঠো, কখনো বা দু’মুঠো চাল তুলে রাখি কৌটায়।
মা’কেও দেখেছি এমন করতেন,
চুপিচুপি, কারও অগোচরে, যেন এক নিঃশব্দ সঞ্চয়।

তখন বুঝিনি, এখন বুঝি,
শুধু পেটের ক্ষুধা নয়, পৃথিবীর অনেক ক্ষুধার জবাব হয় না,
তবু কিছু না কিছু তুলে রাখা যায়, যেন একটুখানি ভালোবাসা বাঁচিয়ে রাখা যায় আগামী দিনের জন্য।

আজ আমারও তাই মনে হয়,
এই মুঠো চালগুলো শুধু চাল নয়,
এ আমার নীরব প্রতিবাদ, নিঃশব্দ সঞ্চয়,
আর এক চিলতে আশার আলো,
যা আমাকে প্রতিদিন একটু একটু করে মানুষ করে তোলে।

সেলাই আর দোকান এখন আমার ভরসার জায়গা।
জামা-কাপড় কাটা-ছেঁড়া, ডিজাইন থেকে শুরু করে হিসাব-নিকাশ সব একা হাতে সামলাচ্ছি।
বাবা গাড়ি নিয়েই থাকেন, কিন্তু এখন আর আগের মতো প্রাণ নেই তাঁর শরীরে।
শুকনো মুখ, ক্লান্ত চোখ।
তাঁর দিকে তাকিয়ে মনে হয়, এ বয়সে আর কতই বা পরিশ্রম করবেন?

ভাবলাম, এবার বাবাকে একটু বিশ্রাম দিতে হবে।
তাঁকে দায়িত্ব থেকে মুক্ত করে দিতে হবে,
যেন সকালের আলোটা আরেকটু দীর্ঘ হয় তাঁর জীবনে।

তাই মনে মনে ঠিক করলাম,
দোকানটা আরও একটু বড় করবো।
আরেকটু গুছিয়ে নেবো সবকিছু।
তখন না-হয় বাবা শুধু দোকানে বসে নজরদারি করবেন,
আর আমি মন দিয়ে আমার সেলাইয়ের কাজে ডুবে থাকবো।

রাত গভীর, সেলাই শেষ করে শুয়েছি মাত্র, হঠাৎ বড় আপার ফোন।

-তোর শ্বশুরবাড়ি যাবি কবে?

আমি এক মুহূর্ত থেমে উত্তর দিলাম,
– ওবাড়ি আর ফেরা হবে না আপা, ফাহিমের সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবে।

ওপাশ থেকে বিস্ময়ের সুর,
– কেন রে?

আমি বললাম,
– ওদের প্রতিটা আচরণ আমাকে গিলে খাচ্ছিলো।
আমার অস্তিত্ব, আমার আত্মসম্মান সবকিছু ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাচ্ছিলো।
সেখানে একটা কাজের মেয়েরও যতটুকু সম্মান থাকে, আমার তাও ছিলো না।
বুঝলাম, আমার নীরবতা আমার শেকল হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আপা তখন একটু হেসে, শান্ত কণ্ঠে বললেন,
-তুই হেরে গেলি বলেই তো ওরা জিতেছে।
জানিসই তো, নরম মাটি খুঁড়তে সবার সাহস হয়,
কিন্তু শক্ত মাটিতে কেউ কোপ দিতে চায় না,
কারণ সেই কোপে মাটি না, বরং কূপটা নিজেই আঘাত খায়।

– শুরুতে আমিও প্রতিবাদ করিনি, ভাবতাম সময় বদলাবে।
কিন্তু সময় তো বদলায় না, বদলাতে হয় আমাকেই।
এই যে এখন আমি নিজের অধিকার বুঝে নিচ্ছি।

– প্রথম প্রথম বাবার উপর খুব অভিমান হতো,
ভাবতাম বাবা কেনো আমার শশুর বাড়ি বাহারি খাবার-দাবার জামা-কাপড় পাঠায় না!
কিন্তু আজ আমি বুঝি, বাবার অসহায়তাও ছিলো বড় বাস্তব।
এই তো সেদিন শাশুড়ি বলছিলেন,
‘ফকিন্নি ঘরের মেয়েকে এনেছি, বাপেরবাড়ি থেকে কিছু আসে না।’
আমি মুখের ওপর বলে দিয়েছি,
‘বিয়ের আগে এই কথাটা ভাবা উচিত ছিলো,
আপনি তো আমাকে কোনো রাজপ্রাসাদ থেকে তোলে আনেননি,
ফকিন্নি ঘর দেখেই তো এনেছেন!’

শাশুড়ি চুপ হয়ে গিয়েছিলেন,
তারপর থেকে অনেকটাই পাল্টে গেছেন।
যেন বুঝে গেছেন নীরবতা মানেই সম্মতি নয়।

আপা একটানা বলেই যাচ্ছিলেন, আর আমি চুপচাপ শুনছিলাম।
তার কথার মধ্যে যেন আমার নিজেরই এক অদৃশ্য প্রতিবিম্ব দেখতে পাচ্ছিলাম।

শেষে আপা বললেন,
– নিজেকে বিলিয়ে দিস ঠিক সেখানেই,
যেখানে নিজের মূল্যটুকু পাওয়া যায়।
অন্যথায় শুধু নিজেকে হারাবি, কিছুই পাবি না।

আমি ফোঁটা ফোঁটা করে আসা চোখের জলে ফোনটা বালিশের পাশে রাখলাম।
মনে হলো, নিজের গল্পটাই যেন আজ অন্য কারো মুখে শুনলাম।

পরের দিন বিকেলেই, এক অচেনা ভার কাঁধে নিয়ে ফাহিম এলো।
উকিলসহ ডিভোর্সের কাগজ হাতে যেন সবকিছুই আগেভাগেই নির্ধারিত ছিলো, শুধু সইটা বাকি।

আমি প্রথমে কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
তারপর যখন ফাহিম ভেতর থেকে বের করে আনলো মোহরানার হিসেব,
নরম গলায় বললো,
– তুমি যদি চাও, আমি আমার ব্যক্তিগত জমানো টাকা থেকে এই টাকাটা মিটিয়ে দেবো, মাকে কিছুই জানাবো না।
কারণ আমি জানি, মা কখনোই রাজি হবেন না এই অর্থ দিতে।

আমি বিস্ময়ের সাথে হাসলাম।
একটা ছেলে কতটা মা-ভক্ত হলে, স্ত্রীকে ছেড়ে দেয়, নিজের রক্ত মাংসের সন্তানকে ছেড়ে দেয়,
তবুও মায়ের অমতে একটুকু মোহরানার ঋণ শোধ করার সাহসও প্রকাশ্যে করতে পারে না!
যেখানে ভালোবাসাই নেই সেখানে এই টাকা দিয়ে আমি কি করবো।

আমি তার চোখে চোখ রেখে বললাম,
– আমি মাফ করে দিলাম।
আপনারা টাকা পয়সায় হয়তো অনেক ধনী,
কিন্তু অনুভবের দিক দিয়ে বড় অভাবী।
আপনাদের ঐশ্বর্য শুধু বাড়ির দেয়ালে আটকে আছে, হৃদয়ে পৌঁছায়নি।

সে মাথা নিচু করে বললো,
– আমি অন্তত আমার সন্তানের খরচটা দিতে চাই।

আমি এবারেও শান্ত গলায় হেসে বললাম,
– যে মা মোহরানার টাকা ভিক্ষার মতো ফিরিয়ে দিয়েছে,
সে কি নিজের সন্তানের জন্য সেই একই হাত বাড়াবে?
মনে রাখবেন, এই মায়ের শরীরে এখনো রক্ত বয়ে চলে,
আর সেই রক্তে আছে আত্মমর্যাদার দীপ্তি।

সে আর কিছু বললো না।
চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো হয়তো লজ্জায়, নয়তো অপারগতায়।

আমি কাগজে কলম ছুঁইয়ে সই করে তার দিকে এগিয়ে দিলাম।
সে কাগজ নিতে নিতে একবার আমার আঙুল ছুঁয়ে দেখলো,
সেই ছোঁয়ায় কোনো স্পর্শ ছিল না,
ছিল কেবল এক বোবা অনুশোচনা।

আমি তৎক্ষণাৎ নিজের হাত গুটিয়ে নিলাম।
চোখে চোখ রাখলাম না আর।

সে দাঁড়িয়ে ছিলো, চোখে একরাশ না বলা কথা,
যার মানে বোঝার দায় এখন আর আমার নয়।
হয়তো ছেলের মুখ ভেসে উঠেছিলো তার চোখে,
হয়তো সংসারটা টিকিয়ে রাখার শেষ চেষ্টাটুকু করছিলো সে,
কিন্তু সে তো সেই ছেলেটাই,
যে ছোটবেলা থেকেই মায়ের ছায়ার বাইরে হাঁটতে শেখে নি।
তাই হয়তো আজও, একজন মা-র কথার কাছে
সে এক স্বামী, এক পিতা হয়ে উঠতে পারলো না।

বুকের গহীনে জমে থাকা দীর্ঘশ্বাসটা চেপে রেখে আমি দরজার দিকে তাকালাম,
সামনের পথটা কঠিন হলেও অন্তত নিজের ছিলো।
কোনো মায়া ছাড়া নয়,
শুধু একফোঁটা চোখের জল আড়ালে গড়িয়ে পড়লো,
হৃদয়ের একটুখানি জায়গা দখল করে হলেও সে তো আমার হয়ে ছিলো।

নিঃশব্দে সে প্রশ্ন করেছিলো,
– ফাওয়াদকে দেখা যাবে?
তার কণ্ঠে ছিলো এক আশ্চর্য নরমতা, যেন কোনো অপরাধী অনুমতির অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে।

আমার বুকের গভীরে কোথাও যেন কেঁপে উঠলো কিছু,
তবু নিজেকে সামলে নিয়ে নিঃশব্দে পেছন ফিরে ভেতর ঘরে গেলাম।
ঘুমন্ত ফাওয়াদকে কোলে তুলে এনে তার দিকে এগিয়ে দিলাম।

সে সন্তানের মুখে চোখ রাখলো।
দীর্ঘদিন পরে পাওয়া মুখ যেন তার বুকের ভেতর কতগুলো ব্যর্থতার লালচে দাগ ফেলে গেলো।
ফাওয়াদও তাকিয়ে রইলো একদৃষ্টিতে।

আমি দেখলাম, ফাহিমের চোখের কোণ ভিজে উঠেছে।
তা অনুশোচনার নাকি অভিমানের, আমি বুঝে উঠতে পারিনি।

দশ-পনেরো মিনিট পর সে উঠে দাঁড়ালো।
ফাওয়াদ তখন হঠাৎ করেই কেঁদে উঠলো,
মনে হলো, সেই ছোট্ট মনটাও টের পেয়ে গেছে, এই গন্ধমাখা কোলটাই হয়তো তার বাবার শেষ স্পর্শ।

রাতে বাবা ঘরে ফিরে এলেন।
চোখে ক্লান্তির রেখা, কিন্তু মুখে প্রশান্ত এক শান্তি।

আমি নরম স্বরে জানালাম,
-আজ সে এসেছিলো, ডিভোর্সের কাগজ নিয়ে। আমি সই করে দিয়েছি।

বাবা চুপ করে শুনলেন।
তারপর মৃদু গলায় বললেন,
– যা কখনো জোড়া লাগার নয়, তা বয়ে বেড়ানো বৃথা, সই করে দিয়েছিস, ভালো করেছিস মা।

আমি মাথা হেঁট করে রইলাম।
তারপর তিনি ফাওয়াদকে কোলে তুলে নিলেন।
বাবার বুকের সাথে লেপ্টে রইলো ছোট্ট ফাওয়াদ,
আর আমি একপাশে বসে চানাচুর, মটর, বাদামের ছোট ছোট প্যাকেট গুছাতে লাগলাম।

এই ছোট্ট সংসারের ছোট ছোট কাজগুলোতেই যেন লুকিয়ে আছে আমাদের নতুন করে বাঁচার চেষ্টাগুলো।
অতীতের ছায়া দীর্ঘ হলেও, জীবনের আলো ছুঁয়ে যেতে জানে, ঠিক এমন নিঃশব্দ সন্ধ্যায়।

সেলাই আর দোকান সামলে যদি একটুখানি নিঃশ্বাস নেওয়ার সময় পাই, তবে সেই সময়টাই যেন সমাজ আমার শ্বাসরোধ করে।
জামাই ছেড়ে দিলো, অলক্ষী, অপয়া, সেলাই করে ক’দিনই বা চলবে।
আমি সেসব কানে তুলি না, এক মনে এক ধ্যানে সেলাই আর দোকানের কাজ করতে থাকি।

সেলাইয়ের নকশা একটু ব্যতিক্রম, সবকিছু নিয়েই তীক্ষ্ণ দৃষ্টির মতো কটুকথার ধার বয়ে যায় গ্রামের বাতাসে।
সমাজের এই সীমাহীন কৌতূহল আর অন্ধবিশ্বাস আমাকে প্রতিদিন নতুন করে ক্লান্ত করে তোলে।

তবে এবার মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম,
এই বাঁধা নিয়ম, এই গায়ের জোরে চাপিয়ে দেওয়া শাসনের বিপরীতে আমিই দাঁড়াবো।
আমিই হবো প্রথম নারী, যে মাথা উঁচু করে বলবে, জীবন মানে শুধু সহ্য করে বেঁচে থাকা নয়, নিজেকে প্রমাণ করে ভালোবেসে বাঁচার নামই জীবন।

এদিকে প্রতিদিনই অনেক কাপড় আসে সেলাইয়ের জন্য।
রাত গভীর হলেও কাজ ফুরোয় না, পা ব্যথায় ঝিম ধরে আসে তবু আমি দম নেই না।
কারণ আমি জানি, বাজারের দর্জির থেকে ২০-৩০ টাকা কম রাখি বলে আজ গ্রামজুড়ে সবাই আমার কাছেই কাপড় দেয়।
কে না চায় ভালো সেলাই, কম খরচে?

গ্রামটা বড়, মানুষগুলো বিচিত্র, আর প্রত্যেকের চাওয়া আলাদা,
কিন্তু আমিও তো আজ সেই চাহিদার একমাত্র ঠিকানা।

তবুও এই সবকিছুর মাঝেও যখন একটু বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন হয় তখনই সময় বাঁধা দেয়, দায়িত্ব চেপে বসে।
তার উপর ফাওয়াদ, যার একটানা খেয়াল রাখা চাই।
তাকে চোখের আড়াল করা যায় না, মা বলে কথা।

তাই বাবাকে একদিন বলেই ফেললাম,
-তুমি আর গাড়ি চালিয়ো না, দোকানে বসো তুমি।
তোমার হাতের ওপর আমি দোকান তুলে দিতে চাই।
আমি একা আর পারছি না, সেলাইয়ের কাজও যেন সময়মতো শেষ করতে পারি না।

বাবা চুপচাপ আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
তার চোখে যে ভরসার আভা ফুটে উঠেছিলো, সেটা আমার এই সংগ্রামী জীবনকে যেন এক নতুন ছায়া দিলো।
আমি জানতাম, এই জীবন একা টানতে হবে তবু পাশে কেউ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকলে, তা-ও একটা আশ্রয় হয়ে ওঠে।

আর আমিও তো সেই নারী, যে শূন্য হাতে সংসার তো গড়বেই, সমাজের চোখেও আঙুল তুলে বলবে,
“দেখো, মেয়েরা শুধু কান্না নয়, তারা জিতে নিতে জানে গোটা পৃথিবীও।”

পরদিন থেকে বাবা আর কাজে গেলেন না।
আমার ভেতরে যেনো এক টুকরো প্রশান্তি নেমে এলো অন্তত এবার বাবা আমার চোখের সামনেই থাকবেন।
অসুস্থ শরীর নিয়ে বাবা যখন রাস্তায় নামতেন, তখন আমার প্রতিটি মুহূর্ত কেটেছে উৎকণ্ঠায়।
ফোন বেজে উঠলেই বুক কেঁপে উঠতো কিছু হয়ে গেল না তো? মাঝপথেই হঠাৎ যদি কিছু হয়ে যায়?
এমন ভয় নিয়েই তো প্রতিটি দিন পার করছিলাম।

সেদিন সকালে বাবা দোকান ঘুরে বললেন,
-দোকানে আরও কিছু বাচ্চাদের খাবার আনা দরকার, অনেকে এসে এটা ওটা চায়, দিতে পারি না।
আমি তখন মেশিনের পাশ থেকে ছোট্ট একটা লোহার বক্স খুলে বের করলাম জমিয়ে রাখা তিন হাজার টাকা।
বললাম,
-এই টাকা দিয়ে অল্প অল্প করে সবকিছুই হয়ে যাবে। তুমি বসো, আমি যাচ্ছি।

বাজারের সেই চেনা দোকানে ঢুকতেই ছেলেটা তাকিয়ে একটু মুচকি হাসলো।
চোখে ক্লান্তির ছাপ থাকলেও তার হাসিটা ছিলো স্বস্তির মতো, যেনো আমাকে দেখে একধরনের নিশ্চিন্তি হলো।
আমি তিন হাজার টাকা এগিয়ে দিয়ে বললাম,
-সব অল্প অল্প করে দিও তো।

প্রতিদিনের কেনাকাটার এই নিরব অভ্যেসে আমাদের কথার প্রয়োজন খুব কম।
সে জানে কোন কোন চকলেট বাচ্চারা বেশি পছন্দ করে, কোন লজেন্স দোকানে রাখতে হয় নিচের তাকের ডান পাশে।
এই নিরব বোঝাপড়ার মাঝেই হঠাৎ সে বললো,
-তুরিন, নতুন লটারি এসেছে। খেলনা দেওয়া আছে। দিই না? ১০-১৫ প্যাকেট?

আমি চোখ বড় করে তাকালাম।
-এই লটারি কিনতে গিয়ে যদি পুরো টাকা উড়িয়ে দিই, বাকি খাবারগুলো কী দিয়ে আনবো? আর এতগুলো বিক্রি করবোই বা কাদের কাছে?

সে একপাশে তাকিয়ে মাথা চুলকে নিয়ে মৃদু হাসলো।
-আজকেই বিক্রি হয়ে যাবে। খেলনাগুলো দেখলেই বাচ্চারা হাত বাড়ায়।
তার কণ্ঠে ছিলো চাপা এক ধরণের আশ্বাস যেনো আমার কাঁধে হাত না রেখেও বলছে, ভরসা রাখো।

আমি অনিচ্ছাসত্ত্বেও বললাম,
-এত টাকা নেই ভাই, তুমি বরং কম দাও।

সে এবার সরাসরি চোখে চোখ রাখলো না, কিন্তু গলায় এমন এক আত্মবিশ্বাস ঢেলে বললো,
-টাকার চিন্তা করো না তুরিন। বাকিতে নাও, পরে দিয়ে দিও।

বলেই সে পাঁচ হাজার টাকার মালামাল গুছিয়ে হাতে দিলো।
তার চোখে তখনও কোনো দাবি ছিলো না, ছিলো শুধু একধরনের চুপচাপ সঙ্গ দেওয়া, যেমনটা কাছের মানুষ দেয় দূর থেকে, কিছু না চেয়ে।

দোকান থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে আমি মনে মনে বললাম, কিছু মানুষ থাকে যারা না বলে পাশে থাকে,
যাদের ভালোবাসা শব্দে নয়, সহায়তায় প্রকাশ পায়।

কখনো কখনো দূরের মানুষও কত নিঃশব্দে আমাদের পাশে দাঁড়ায়,
যাদের আমরা ভালো করে চিনি না, আবার চিনেও বুঝি না।
তাদের হাসি, তাদের চোখের ভাষা কিংবা ছোট ছোট সহানুভূতির মাঝে লুকিয়ে থাকে একধরনের নরম আশ্রয়,
যা অভাবের বাজারে দাঁড়িয়ে, ক্লান্ত দুপুরে কিংবা হতাশ সন্ধ্যায় হঠাৎই আশার আলো হয়ে ওঠে।

সে তো আমার আপন কেউ নয়, তবুও প্রতিবার বাজারে এলে একরকম নির্ভরতায় তাকাই তার দোকানের দিকেই।
সে জানে আমার হিসাব কষে কেনা, জানে আমার ভয়ে চেপে রাখা আতঙ্ক।
তবুও কিছু না বলেই সে নিজে বোঝে, কোনটা বেশি প্রয়োজন, কোনটা একটু পরে এলেও চলে।

আজও যেমন হাতে গুঁজে দিলো দুই প্যাকেট বাড়তি বিস্কুট,
বললো না কিছু, শুধু বললো,
-বাজারে নতুন এসেছে, দেখো যদি বিক্রি হয় তবে কাল এসে আরও কয়েক প্যাকেট নিয়ে যেও।।

আমি কিছু বলি না, কেবল একটু নিচু গলায় বলি,
-বাকির খাতায় লিখে রাখো, কাল দিয়ে যাবো।

সে মাথা নেড়ে হেসে বলে,
-তোমার তো দেওয়ার থেকেও দেওয়ার মানুষ বেশি, কাল নয়, যেদিন পারো দিও।

এইসব মানুষরা পরিচয়ের খাতায় নাম লেখায় না,
তারা থাকে ব্যস্ততার আড়ালে, আর্থিক হিসাবের পাতার ফাঁকে।
তবে হৃদয়ের খুব গোপন কোনে একদিন ঠিকই জায়গা করে নেয়।

বাড়ি গিয়ে সব মাল গুছিয়ে রাখলাম।
দিনের খাটুনির ক্লান্তি তখনো গায়ে লেগে আছে, তবুও মনে হলো,
চোখে স্বপ্ন থাকলে ক্লান্তিও যেন আলতো হয়ে আসে।

হঠাৎ দেখি আধা কেজি চাল হাতে একটা পিচ্চি এলো,
বয়স সাত কি আট মুখে ধুলো মেখে, কিন্তু চোখে খুশির ঝলক।
দোকানে ঢুকেই এদিক-ওদিক ভালো করে চোখ বুলিয়ে, দশ টাকা দামের দুটো লটারি কিনলো,
তারপর আবারও প্যান্টের পকেট টেনেটুনে জমানো দশ টাকা বের করে আরও একটি লটারি কিনলো।
তার চোখেমুখে একধরনের তৃপ্তি, যেন কোনো রাজ্য জয় করেছে।

তারপর যেন একের পর এক ঢেউ উঠলো,
আরও একজন, তারপর দুইজন, তিনজন, তারপর তো পুরো একটা ভিড়!
-আমি পুতুল পাইছি, তুই কি পাইছস?
– হা হা হা, আমি বল পাইছি।
-আমি প্লাস্টিকের ব্যাংক পাইছি।
-আমি তো স্টিকার।
বাচ্চাদের হাসির শব্দে দোকানের চারপাশ এক অদ্ভুত আনন্দে ভরে উঠলো।

চোখের পলকেই যেন শেষ হয়ে গেলো দশ প্যাকেট লটারি।
হাতে রইলো আর মাত্র পাঁচ প্যাকেট।

মনে মনে ভাবলাম,
আশ্চর্য! লোকটা ঠিকই বলেছিল,
সে হয়তো বেশি কিছু বলেনি,
তবে বুঝিয়ে দিয়েছিল ঠিক কোনটা রাখলে দোকানে প্রাণ ফিরে আসে।
আসলে দোকানে প্রতিদিন বসে থাকার মধ্যেই যে একধরনের অভিজ্ঞতা জমে,
যা বইয়ে লেখা থাকে না, শুধু চোখ দিয়ে শেখা যায়।

তার চোখ দিয়ে দেখা সেই অভিজ্ঞতা আজ আমার কাজে লাগলো।

চলবে,,,,,