কালিনী পর্ব-১২

0
1

#কালিনী
#আরেব্বা_চৌধুরী
#পর্ব_সংখ্যা ১২

বাবাকে বললাম,
-দোকানে তো এখন বেশ কিছু চাল জমে গেছে,
তুমি বরং বিকেল নাগাদ ডিম আর চাল বাজারে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দিও।
বাজারের দোকানির পাওনা টাকাও তো দিতে হবে।

বাবা মাথা নাড়িয়ে মৃদু সায় দিলেন,
চোখে যেন একটা প্রশান্তির রেখা,
মেয়েটা এখন সংসার বোঝে,
তার চিন্তার ঘরে যেন বাবার ক্লান্তি গলে গেছে।

আমি ওদিকে বসে ভাবছিলাম,
আমারও তো এবার একটু বাইরে বের হওয়া দরকার।
অনেকদিন ধরে শুধু চার দেয়ালের ভেতর চলছি।
শুধু শরীর না, মনও যেন হেঁটে বেড়াতে চায়।
একটু রঙ, একটু হাওয়া, সাথে কিছু দরকারি কাজও সেরে নেওয়া যাবে।

কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই বাস্তবতা পিছু টান দিলো,
বাবা যদি বিকেলে বাজারে চলে যান,
তাহলে ফাওয়াদকে কে দেখবে?

আমি জানি, ওকে একা ফেলে যাওয়াটা সহজ নয়,
ওর ছোট ছোট হাত দুটো এখনো মায়ের আঁচলে বাঁধা।
তাই আজ হয়তো আর বের হওয়া হবে না,
নিজেকে বোঝালাম,
আগামীকাল,,,,হ্যাঁ, আগামীকাল নিশ্চয়ই সময় বের করে নেবো।

এদিকে শাশুড়ির চোখে এখনো একটাই স্বপ্ন
ছেলের ঘরে যেন এমন একটি মেয়ে আসে,
যার রূপে, গুণে, এবং ব্যবহারেই সমাজ মুগ্ধ হবে।
তাঁর চোখে পছন্দ হয়ে গেছে একটি মেয়ে
নির্ভেজাল সৌন্দর্য, দীপ্ত চেহারা, আর কাঁধ ছুঁয়ে নামা ঘন কালো চুল।
তাঁর চোখে যেন জ্বলজ্বল করে উঠলো আশার আলো।

অস্ফুটস্বরে শাশুড়ি বললেন,
-এমন মেয়েই তো আমাদের পরিবারের উপযুক্ত,
এই মেয়েই পারবে ফাহিমকে নতুন করে জীবন দিতে।

কিন্তু কনের পরিবারের দিক থেকে ততটা উষ্ণতা দেখা গেল না।
মেয়ের বাবা একটু ভিন্ন সুরে বললেন,
-“একবার বিয়ে হয়ে যাওয়া একজন ছেলের সঙ্গে আমার মেয়েকে আমরা কেনো বিয়ে দেবো?
আমাদের কি অভাব আছে? আমরা তো সবদিক থেকেই স্বচ্ছল।”

শাশুড়ি তখনও শান্ত গলায় উত্তর দিলেন,
-“বেশ, তবে ছেলে-মেয়েরা একটু নিজেরা কথা বলে নিক,
নিজেদের মনের কথা তো বুঝতে দেওয়া দরকার, তাই না?”

কিন্তু মেয়ের বাবা যেন সেই প্রস্তাবে একেবারেই নারাজ।
খোলসা করে বললেন,
-“কিসের কথা? যা হওয়ার তা তো আমরা ঠিক করেই নিয়েছি।”

ঠিক সেই মুহূর্তেই কনে নরম গলায় বললো,
-“আব্বু একটিবার শুধু কথা বলি না? তারপর যদি ভালো না লাগে, তাহলে বিয়ে হবে না, কথা বলতে তো দোষ নেই। ”

তার মৃদু কণ্ঠে ছিল এক ধরনের আত্মবিশ্বাস,
আর চোখে অদ্ভুত রকমের স্থিরতা।

মেয়ের কথায় তার বাবা আর কিছু বললেন না,
চুপচাপ বসে রইলেন।

আর সেই চুপ করে থাকাই যেন এক ধরনের সম্মতির ইঙ্গিত দিলো।
ফাহিম আর কনে উঠে পাশের ঘরে গেলো।

দুজনেই প্রথমে বেশ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ,
ঘরের ভেতরে যেন কথার চেয়েও বেশি গাঢ় হয়ে উঠলো নিঃশব্দতা।

ফাহিম একপ্রকার কুণ্ঠিত, চোখে এক ধরনের লজ্জা মেশানো ক্লান্তি।
সে জানে তার জীবনের অতীত বেশ ভারী,
আর এই মেয়ে, যেন একেবারেই হালকা বাতাসে ওড়া নতুন সকাল।

মেয়েটি প্রথমেই প্রশ্ন করলো না,
জিজ্ঞেস করলো না তার অতীত বা ডিভোর্সের গল্প।
বরং একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে বললো,

-আপনার নাম কি?
ফাহিম খানিক চুপচাপ থেকে একসময় নিরবতা ভাঙলো।
স্বরটা নরম, কিন্তু গলায় ছিল এক ধরনের চাপা দ্বিধা।

-ফাহিম,,, আমার নাম।
তারপর একটু থেমে জিজ্ঞেস করলো,
-আপনার নাম কী?

মেয়েটি হালকা হাসলো,
তার কণ্ঠ যেন কাশফুলের মতো কোমল।

-মেঘলা।

ফাহিম মৃদু মাথা নেড়ে বললো,
-বেশ সুন্দর তো, একদম আপনার মতো।

মেঘলা শুধু হাসলো, বললো না কিছুই,
কিন্তু চোখে জমে রইলো একরাশ স্থিরতা।

এরপর দু’জনের মাঝে নেমে এলো এক প্রকার অনুচ্চারিত সংলাপ,
যেখানে কথার চেয়ে অনেক বেশি ছিল অনুভবের আদানপ্রদান।
কখনো শুধু চেয়েও যে অনেক কিছু বলা যায়,
সেদিন তা বোঝা গেল নিঃশব্দের মাঝেও।

মেঘলা চেয়ার থেকে উঠে ধীরে দরজার দিকে পা বাড়ালো।
দরজার হাতলে হাত রাখার আগ মুহূর্তে একবার ফিরে তাকালো ফাহিমের দিকে,
চোখে ছিল প্রশ্ন নয়, বরং উত্তর।

বাইরে এসে সরাসরি বাবার সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
-আমি রাজি, আব্বু। এই বিয়েতে আমার আপত্তি নেই।
আমি ফাহিমকে বিয়ে করতে চাই।
তার গলায় ছিল না কোনো দ্বিধা,
ছিল দৃঢ়তা, আর কোথাও যেন একটুকরো মমতার ছায়া।

চারপাশটা হঠাৎ নিস্তব্ধ হয়ে গেল,
শুধু ভেতরে ভেতরে যেন সময় থমকে দাঁড়িয়ে শুনছিল,
একটি নতুন গল্পের শুরু হতে চলেছে।

মেঘলার বাবার মুখ কঠিন হয়ে উঠলো।
-তুই কি ভেবে বলছিস, মেঘলা?

মেঘলা চোখে চোখ রেখে দৃঢ় কণ্ঠে বললো,
-হ্যাঁ, আব্বু। আমি ভেবেই বলছি।
দুর্ঘটনা তো মানুষের জীবনে ঘটে যায়,
আর ফাহিমের আগের বিয়েটাও তো ছিল তেমনই একটা ভুল সময়ে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা।
তাই বলে কি একটা মানুষকে সারাজীবন একা করে দিতে হবে?
তার কি আর ভালো থাকার অধিকার নেই?

তার কথায় যেনো এক আশ্চর্য পরিপক্বতা ছড়িয়ে পড়লো ঘরজুড়ে।
বাবা থমকে গেলেন।
কিছুক্ষণ নীরব থেকে শুধু দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন,
সে নিঃশ্বাসে হয়তো সমাজের চাপ ছিল, আবার মেয়ের কণ্ঠে ভরসাও।

এই সুযোগেই শাশুড়ির মুখে ফুটে উঠলো রাজ্যজয়ের হাসি।
মেঘলার কথাগুলো যেনো তাঁর মনের কথাই বলে দিলো।
তিনি যেনো মুহূর্তেই কিছু না শুনেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন।

হাত জোড় করে বললেন,
-ভাইজান, মেয়ের মুখের ওপর কথা বলবেন না।
যা হয় ভালোই হয়।
বিয়েটা যদি আপনি আজ পাকা করে দেন, তাহলে আমার শান্তি হয়।
মেয়েটা আমার ঘরের ভাগ্য হয়ে আসবে, আমি জানি।

ঘরে উপস্থিত সবাই একরকম থম ধরে রইলো।
আর মেঘলা, সে তখন নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে ছিল,
মুখে স্থিরতা, আর মনে এক অনির্বচনীয় রকম আবেগ,
যেখানে ভবিষ্যতের নতুন পথে পা রাখার প্রস্তুতি ঠিক তখনই শুরু হয়ে গিয়েছিল।

অবশেষে বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক হলো।
আজ মঙ্গলবার, আর আগামী শুক্রবারেই হবে বিয়ে।
সময় হাতে মাত্র দু’টো দিন।

মেঘলার বাবা কপালে ভাঁজ ফেলে বললেন,
-এই অল্প সময়ের মধ্যে কীভাবে কী করবো ভাবতেই পারছি না। এত দ্রুত তো,,,

শাশুড়ী এক গাল প্রশান্তির হাসি হেসে বললেন,
-বিয়ে মানেই কি আতশবাজি, ঢাকঢোল আর লোক খাওয়ানো?
আজকাল তো খাওয়ানোর পেছনে খরচ করলেই মানুষ বেশি তৃপ্ত নয়, বরং কুৎসাই করে বেশি।
আজ খাবে, কালই হয়তো বলবে ঘি ছিল না, মাংস ঝাল ছিল, কিংবা আয়োজন কম।
আমি এমন লোক দেখানো বিয়ে একেবারেই পছন্দ করি না ভাইজান।

তার কণ্ঠে ছিল কুটিলতা।

তিনি আবার একটু এগিয়ে বললেন,
-আপনি বরং এক কাজ করুন, বিয়েতে যা খরচ করতেন তা দিয়ে যদি মেয়েকে গহনাগাঁটি কিনে দেন,
তবে সে সারাজীবন তা পরতে পারবে।
সেটাই তার কাছে স্মৃতি হয়ে থাকবে, আর সুখের সাথীও।

একটু থেমে তিনি কৌতুক ভরা গলায় বললেন,
-আমার কথায় আবার আপনি রাগ করেননি তো ভাইজান?

মেঘলার বাবা শান্তভাবে মাথা নাড়লেন।
-রাগ করবো কেনো? আপনি তো ঠিক কথাই বলেছেন।
আমি চাই মেঘলা যেনো যেখানে যায়, ভালো থাকে, সম্মান নিয়ে থাকে।

এদিকে রাত গভীর হয়ে এসেছে, চারপাশ নিথর নিস্তব্ধতায় মোড়া।
তবুও তুরিনের চোখে একফোঁটা ঘুম নেই।

চোখ বুজলেই যেন ফাহিমের মুখ ভেসে ওঠে
তার হাসি, তার চলা কিংবা কোনো এক বিকেলের নির্জন নীরবতা যেখানে ফাহিম বসেছিলো আর তুরিন মায়াভরা চাহনিতে তাকিয়ে ছিলো।

তুরিন ধীরে নিজেকে প্রশ্ন করে,
চাইলেই কি মানুষ তার স্মৃতির ভিতর থেকে কাউকে মুছে ফেলতে পারে?
যে মানুষের সাথে কাটিয়েছে এক বছর, না সেটা শুধু সময় ছিল না।
সেটা ছিল প্রতিটি নিঃশ্বাসে মিশে থাকা অনুভব,
একটা হাত ধরার নিশ্চয়তা, একটা সংসার গড়ার অপূর্ণ স্বপ্ন।

সে চায় ভুলে যেতে, চায় নিজেকে মুক্ত করতে সব কষ্ট থেকে।
কিন্তু অবাধ্য মন তার কথা শোনে না।
মনে হয়, হৃদয়টা এখনো ফাহিমের নামেই ধুকপুক করে চলে।

নিজের শরীর যেন আজ নিজের হয় না,
ভেতরের প্রতিটি অঙ্গ যেনো গেঁথে আছে সেই মানুষটার কিছু না বলা স্পর্শে।
তুরিন জানে, সম্পর্ক শেষ হয়ে গেলেও,
সম্পর্কের স্মৃতি কখনো শেষ হয় না।
সে কেবল রূপ বদলায় আলো থেকে ছায়ায়।

চাঁদের আলোর মতো ধোঁয়াটে এক ভাবনায় তুরিন তাকিয়ে থাকে জানালার ফাঁক দিয়ে,
ভেবেই চলে,
“আমি কি কখনো আসলেই ভুলতে পারবো তাকে?”

ফাহিম এখন স্বপ্নে বিভোর।
তার চারপাশে যেনো উৎসবের রঙ ছড়ানো এক নতুন সকাল অপেক্ষা করছে।
অবশেষে তার জীবনে আসতে চলেছে সেই রূপকথার রাজকন্যা,
যাকে নিয়ে সে বুক ফুলিয়ে বলতে পারবে,
-এই তো, এটাই আমার বউ!

যাকে নিয়ে কোনো ব্যাখ্যা দিতে হবে না,
কারো চোখে চোখ রেখে নিজেকে প্রমাণ করতে হবে না।
সে মনে মনে হাসে,
আমি তো এমনই কাউকে কল্পনা করেছিলাম, যার রূপে, ব্যবহারে আমি গর্ব করতে পারি।

তার চোখের সামনে মেঘলার মুখ ভেসে ওঠে
স্মার্ট, রুচিশীল, শহুরে ছাঁদের আধুনিক এক মেয়ে।
একটু ভাবলেশহীন, আবার কোথাও এক চিলতে স্নিগ্ধতা।

ফাহিম এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়লো তার নতুন জীবন গড়তে,
নতুন বিছানার চাদর, নতুন বউয়ের পছন্দমতো ঘর সাজানো,
ছোটখাটো আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে যেনো তার দিনরাত ঘুরপাক খায়।

এই ব্যস্ততায়,
নিমিষেই কোথায় যেনো মুছে গেলো ফাওয়াদ নামের শিশুটির অস্তিত্ব।
আর তুরিন?
সে যেনো কোনো দূরের পরিচিত,
অচেনা এক সময়ের গল্প।

ফাহিম একটিবারও ভাবলো না,
ফাওয়াদের চোখের কান্না,
তুরিনের নিরব সই,
বা তার মায়াভরা চাহনি।

সে শুধু ভাবলো,
নতুন জীবন, নতুন শুরু এইবার আমারও অধিকার আছে হাসতে, সমাজে বুক ফুলিয়ে বাঁচতে।

ভোরের আলো ফোটার আগেই তুরিন ব্যস্ত হয়ে পড়ে গৃহকর্মে।
রান্নাবান্না সেরে ফাওয়াদকে খাইয়ে গোসল করিয়ে যখন তাকে ঘুম পাড়ালো,
তখন সূর্য মধ্যাকাশে।

দুপুর নাগাদ ওড়নাটা গুছিয়ে বেরিয়ে পড়লো সে।
গ্রামের এক ঘর থেকে আরেক ঘরে,
চাচি, জেঠি, খালা যার কাছেই যাচ্ছে, বলছে একটাই কথা,

-চাচি, মেয়েটাকে একটু সময় দিন, বই হাতে দিন। বিয়ের চেয়ে বড় পরিচয় হচ্ছে জ্ঞান আর আত্মমর্যাদা।
একটা মেয়ে যদি স্বাবলম্বী হয়, তাহলে কেউ তাকে অমান্য করার সাহস পায় না। ছেলের পরিবারের লোকেরা তখন ভাববে এই মেয়েকে সম্মান না দিলে, নিজের মানহানিই হবে।
মেয়েরা শুধু কারো ঘরের বউ হয়ে জন্মায়নি, সে নিজেও একটা ঘর গড়তে পারে, একটা সমাজ গড়তে পারে।

তুরিনের কণ্ঠে আত্মবিশ্বাস, চোখে তীব্র অগ্নিশিখা।
কিন্তু তার এসব কথা যেনো বাতাসে মিলিয়ে যেতে থাকে।

কারো চোখে তুরিন উদ্ভট এক মানুষ,
কারো চোখে অহংকারী,
কারো চোখে গাঁয়ের মেয়ে হয়ে শহুরে আদব-কায়দা শেখানো এক ধৃষ্টতা।

অনেকে মুখ চেপে হাসে,
কেউ আবার সরাসরি বলেই ফেলে,
-তুই তো নিজেই সংসার করতে পারলি না, এখন আবার আমাদের শেখাতে এসেছিস?

তুরিন শুনে নেয়, গিলেও ফেলে।
কিন্তু দমে যায় না।

সে জানে, সত্য কথা প্রথমে কানে বাজে, পরে মনে জাগে।
এই হাহুতাশ, এই হাসাহাসির মাঝেই কোনো একদিন কারো হৃদয়ে তার কথা রোপণ করবে এক ক্ষুদ্র বীজ,
যা সময়ের সঙ্গে একদিন মহীরুহ হয়ে সমাজের ছায়া হয়ে দাঁড়াবে।

আর তুরিন?
সে ততদিন চলতেই থাকবে,
এক হাতে সন্তান, আরেক হাতে দীপ্ত সাহস নিয়ে।

তুরিন যখন বিকেলের শেষ রোদ মেখে নিজের বাড়ির দিকে হাঁটছিলো,
ঠিক তখনই পেছন থেকে চিরচেনা এক বিষাক্ত কণ্ঠস্বর কানে এলো,

-ডিভোর্স হইছে তো কী হইছে, মুখ লুকায়ে ঘরে বসে থাকার বদলে দোকান চালায়! আবার গায়ে গায়ে ঘুরে বুদ্ধির বাতিও জ্বালায়!

কথাটা যেনো কানের পর্দা চিরে হৃদয়ের গভীরে বিদ্ধ হলো।
তুরিন থেমে দাঁড়ালো।
ধীরে ধীরে ঘুরে তাকিয়ে বললো,

-আপনারা কেনো বারবার ভুলে যান চাচি, একজন ডিভোর্সি নারীও কিন্তু নারী আপনার মতোই।
সে অন্যায় করেনি, সে শুধু অন্যায়ের পাশে দাঁড়ায়নি।
তারও যেমন বাঁচার অধিকার আছে, তেমনি নিজেকে গড়ার স্বপ্ন দেখার অধিকারও আছে।
আর দোকান চালানো কোনো লজ্জার কাজ নয়। আমি ভিক্ষা করি না, চুরি করি না নিজের শ্রমে, নিজের ঘামে জীবন গড়ছি। এতে যদি লজ্জা থাকে, তাহলে সমাজের মুখ ঢাকাই ভালো।

চাচির মুখ বিকৃত হলো অপমানে,
কিছু না বলেই উল্টো দিকে মুখ ফিরিয়ে হাটা দিলেন।

তুরিন এক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলো তার পেছনে,
তারপর পা বাড়ালো নিজের ছোট্ট ঘরের দিকে।

হাঁটতে হাঁটতে তার মনে হলো,
“আমি শুধু এই গ্রামের মেয়েদের নয়,
প্রত্যেক অপমানিত, প্রত্যাখ্যাত, অবহেলিত ডিভোর্সি নারীর বুকের মাঝে ছড়িয়ে দেবো সাহসের আলো।
তারা যেনো নিজের মুখ লুকিয়ে না চলে,
বরং মাথা উঁচু করে বলে আমি তুরিনের মতো একজন!”

আকাশের পানে তাকিয়ে তুরিন শুধু মনে মনে বললো,

জীবনটা শেষ হয়নি,
এটা তো কেবল শুরু।

গোটা গ্রামে এখন একটাই আলোচনার বিষয়
তুরিন।
“ওই ডিভোর্সি মাইয়া না? এখন ঘরে ঘরে ঘুইরা জ্ঞান দ্যায়! কাণ্ড দেখছো? মনে হয় যেন কইত্থেকা আইছে প্রধানমন্ত্রী হইয়া!”

হাসাহাসি, চোখ রোলানো, কটু কথা,
যেনো গোটা গ্রামটাই এখন তুরিনকে উপহাসের মঞ্চ করে তুলেছে।
তুরিন যেখানে দাঁড়ায়, পেছনে ফিসফিস শব্দ, মুখ চেপে হাসি।
আর তার আড়ালে দৃষ্টিতে গলে পড়ে একরাশ ঘৃণা আর বিদ্বেষ।

সন্ধ্যার পর ঘরে ফিরে বসে আছে তুরিন,
চোখে ক্লান্তি, মুখে অপার নীরবতা।
ঠিক তখনই বাবার নরম হাতটা পড়লো তার কাঁধে।

-তুরিন, এসব কাজ বাদ দে মা।
গ্রামের মানুষ যেমন চলতেছে চলুক না তাতে আমাদের কি আসে যায়।
লোকে তোকে নিয়ে হাসাহাসি করে, বাবা হয়ে আমি সেটা মেনে নিতে পারি না।

তুরিন বাবার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল।
না, তা কষ্টের হাসি নয়,
বরং একরাশ যন্ত্রণাকে শক্তিতে রূপ দেওয়ার এক সাহসী প্রতিচ্ছবি।

-বাবা, জানো তো, সত্যের পথে হাঁটা কখনোই সহজ না।
এই সমাজ ভাঙা মানুষকে দেখতে চায় ঘুরে দাঁড়ানো মানুষকে না।
তাদের সহানুভূতি থাকে, যতক্ষণ তুমি কান্না করো।
তুমি যদি হেসে ওঠো, তাদের গায়ে যেনো আগুন লাগে।
আমি জানি বাবা, ডিভোর্সি বলেই আজ আমাকে নিয়ে এতো কটাক্ষ।
কিন্তু আমি চুপ থাকলে, মুখ লুকিয়ে পালিয়ে বাঁচলে,
তাহলে পরের তুরিনটা কী শিখবে?

বাবা চুপ করে তাকিয়ে রইলেন মেয়ের মুখে।
তুরিন আবার বলল,

-আমি চাই, প্রত্যেকটা মেয়ে বুঝুক
ডিভোর্স কোনো অভিশাপ নয়।
এটা এক জীবনের অবসান ঠিকই,
কিন্তু আরেকটা নতুন জীবনের শুরুও বটে।
নিজেকে গুটিয়ে নয়,
নিজেকে গড়েই বাঁচতে হবে।
মেয়েরাও বাঁচবে, বুক ফুলিয়ে, মাথা উঁচিয়ে।
ডিভোর্সি হোক, বিধবা হোক প্রত্যেক নারীর আছে সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার পূর্ণ অধিকার।
আর আমি আমি হবো তাদের জন্য এক জ্বলন্ত প্রদীপ।
পুড়বো ঠিকই, কিন্তু আলোও ছড়াবো।”

বাবা আর কিছু বললেন না।
তবে তার চোখের কোণে জমে থাকা জলরাশি বলছিলো,
তিনি গর্বিত,
তুরিন তার মেয়ে এটাই তার বড় পরিচয়।
❝ভুল ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।❞

চলবে,,,,,