কালিনী পর্ব-১৪

0
1

#কালিনী
#আরেব্বা_চৌধুরী
#পর্ব_সংখ্যা ১৪

আমি তার কটুকথা কানে না তুলে,
মাথা উঁচু করে নিজের মতো এগিয়ে চললাম।

দিনের পর দিন পেরিয়ে গেলো,
এক মাস কেটে গেছে,
কিন্তু এখনো গ্রামের কোনো নারী
একটিও কাজের উদ্যোগ নেয়নি।

মনে হলো, এভাবে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে
সব স্বপ্ন ধুলোয় মিশে যাবে।
তাই পরদিন আবারও সবাইকে ডেকে নিলাম।
গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করলাম,
-আপনারা এভাবে থেমে আছেন কেন?

সবাই একসাথে যেন এক সুরে বললো,
-সাহস পাচ্ছি না, ভয় লাগছে।

আমার বুকের ভেতর দীর্ঘশ্বাস জমে উঠলো।
বুঝে গেলাম, এবার যা করার সব আমাকেই করতে হবে,
নিজ উদ্যোগে, নিজের শক্তিতে।
কিন্তু কিভাবে? কোথা থেকে শুরু করবো?

অনেক ভেবে বললাম,
-যা করার, আমি করবো।
আপনারা শুধু আমার নির্দেশ মতো কাজ করবেন,
আর আপনাদের শ্রম অনুযায়ী প্রাপ্য পারিশ্রমিক পাবেন।

আমার দৃঢ় কণ্ঠে আত্মবিশ্বাসের সুর ছিলো।
সেই সুরে ভর করে যেন সবার চোখে নতুন আলো জ্বলে উঠলো।
কারণ, ভেতরে ভেতরে সবাই-ই তো চায়
সমাজের মাঝে বুক ফুলিয়ে হাঁটতে,
নিজের অস্তিত্বের গর্ব নিয়ে বাঁচতে।
তাই এবার, তুরিনের ডাকে আর কেউ পিছিয়ে রইলো না।

এদিকে মেঘলার নিত্যদিনের খেয়ালখুশি,
আজ এই রেস্টুরেন্টে খেতে যাবে,
কাল ওখানে ঘুরতে চাইবে,
মাঝে মাঝেই অনলাইনে নিজের ইচ্ছে মতো
দামী দামী জিনিস অর্ডার করে বসে।
প্রত্যেকটা পয়সা ফাহিমের পকেট থেকে ঝরে যায়,
আর শাশুড়ি দাঁতে দাঁত চেপে সব হজম করেন,
কিন্তু মনে জমতে থাকে অভিমান আর ক্ষোভ।

আজ শাশুড়ি একটু কঠোর স্বরেই বললেন,
-বিয়ের তো এক মাস হয়ে গেলো,
এখন রান্নাঘরের দিকেও নজর দাও।

মেঘলা তখনো হাতে মেহেদি লাগিয়ে
আলতো ফুঁ দিচ্ছে, যেন কথাগুলো তার কানে পৌঁছায়ইনি।

শাশুড়ি আবারও বললেন,
-যাও, রান্নাঘরে গিয়ে এক কাপ চা করে আনো।

মেঘলার মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি,
-আমাকে দেখে কি আপনার কাজের মেয়ে মনে হয়?
আমি এবাড়ির বউ, কাজের মেয়ে নই।

শাশুড়ির কণ্ঠে ধৈর্য্য আর কঠোরতা মিলেমিশে উপচে পড়লো,
-সংসারের কাজ কর্ম বাড়ির বউয়েরাই করে।
এ দায়িত্ব সকল বউয়ের নিতে হয় আমিও নিয়েছিলাম।

মেঘলার কণ্ঠে বিদ্রূপ,
-দায়িত্ব মানে কি শুধু ঘরের কাজ?
আমি তো তাতে রাজি নই।
দায়িত্ব যদি আমার হাতে তুলেই দেন,
তবে টাকা-পয়সা থেকে শুরু করে
সবকিছুর কর্তৃত্বও আমার হাতে দিন।

শাশুড়ি আর স্থির থাকতে পারলেন না,
-বেয়াদবের মতো মুখে মুখে কথা বলো না।
তুমি না করলে এবাড়ির কাজ কে করবে?
এই বুড়ো বয়সে আমি করবো নাকি?
ভাব দেখে মনে হচ্ছে বাপের বাড়ি থেকে
দাসী-বাঁদী নিয়ে এসেছো।

মেঘলা তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে উঠলো,
-প্রথমত, আমি বেয়াদবি করিনি,
শুধু চোখে আঙুল দিয়ে সত্য দেখিয়ে দিয়েছি।
দ্বিতীয়ত, আমি যেমন কাজ করি না,
তেমনই আপনাকেও করতে বলিনি,
সবসময়ই বলেছি, কাজের মানুষ রাখুন।
এখন আপনি যদি সখ করে নিজে কাজ করেন,
তবে তাতে আমার কিছু বলার বা করার নেই।
আর হ্যাঁ, এখানে এসে আমি যথেষ্টই করেছি,
যদিও আমার নিজের বাড়িতে এক গ্লাস পানিও
নিজ হাতে ঢেলে খাই না।

তৃতীয়ত, আমি বাপের বাড়ি থেকে দাসী-বাঁদী আনবো কেন?
আপনার ছেলে যদি বউ খাওয়ানোর সামর্থ্য না রাখে,
তবে বলুন, আমার সাথে আমার বাপের বাড়িতে ঘর জামাই হয়ে থাকতে।
সেখানে থাকলে তার সব খরচ আমি বহন করবো।
কিন্তু এখানে থেকে এক কানাকড়িও
আমার বাপের বাড়ি থেকে আনবো না।
আমার বাবা যদি আমাকে পালতেই হয়,
তবে এখানে রেখে কেন পালবে?
নিজের বাড়িতেই ভালো করে পালুক!

মেঘলার কথা যেন কাঁটার মতো বিঁধলো শাশুড়ির গায়ে,
ঘরের বাতাস ভারী হয়ে এলো,
শাশুড়ির চোখে ক্ষোভ।

শাশুড়ি রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললেন,
-এতো বড় কথা মুখে আনতে পারো? আজ ফাহিম বাড়ি ফিরুক,
সব কথা আমি তাকে বলবো।

মেঘলা ঠোঁট বাঁকিয়ে উত্তর দিল,
-হ্যাঁ, বলুন। ছেলের কানে কথা ঢোকানোই তো আপনার সবচেয়ে প্রিয় কাজ।
আপনাদের মতো শাশুড়িদের কারণেই
অনেক বউ চাইলেও সংসার টিকিয়ে রাখতে পারে না।

শাশুড়ির মুখ লাল হয়ে উঠলো,
রাগ যেন গলার স্বর ভেদ করে বেরিয়ে এলো,
-খাল কেটে কুমির এনেছি!
আমার কপালটাই পোড়া।
মানুষ কত সুন্দর সুন্দর বউ পায়,
আর আমার ভাগ্যে জুটেছে অলক্ষী, অপয়া।
আমার সাধের সংসার আজ ভেঙে পড়ছে চোখের সামনে।

মেঘলা শাশুড়ির কথাগুলো উপেক্ষা করলো,
মনে হলো যেন কোনো অচেনা আওয়াজ কানে লাগছে।
শান্তভাবে হাত ধুয়ে নিজের ঘরে গিয়ে
বিছানায় শুয়ে পড়লো।
বাইরের ঘরে শাশুড়ির ক্ষোভে ভারী বাতাস
ধীরে ধীরে জমে উঠলো,
আর ভেতরের ঘরে মেঘলার চোখে
ছিল অদ্ভুত এক নিস্পৃহ প্রশান্তি।

গ্রামের মেয়ে-বউরা একে একে চলে যাওয়ার পর,
তুরিনের চোখে ভেসে উঠলো অনিশ্চয়তার ধূসর মেঘ।
এখন কী করবে সে?
সবাইকে তো দৃঢ় কণ্ঠে আশ্বাস দিয়েছে,
স্বপ্ন দেখিয়েছে নতুন দিনের,
কিন্তু সেই স্বপ্নে পৌঁছানোর সিঁড়িটা এখনো
তার কাছে অস্পষ্ট আর অদৃশ্য।

সারা দিন যেনো বুকের ভেতর এক অদৃশ্য ভার নিয়ে হাঁটলো তুরিন।
কাজের মাঝে মন বসলো না,
কথার জবাব দিলেও মনে হলো,
সেটা যেন অন্য কেউ বলছে তার হয়ে।

ছেলেকে খাওয়ানো, গোসল করানো
সব কাজই করেছে, এক ধরনের গভীর ঘোরের মধ্যে,
যেনো হাত চলছে,
কিন্তু মন কোথায় যেন হারিয়ে গেছে
কোনো দূর অচেনা দিগন্তে।

ফাহিম ঘরে পা রাখতেই যেনো হঠাৎ বিস্ফোরিত হলো অভিযোগের ঝড়।
এক প্রান্ত থেকে মায়ের কণ্ঠ, অন্য প্রান্ত থেকে বউয়ের চেঁচামেচি,
দুটো স্রোত একে অপরের সঙ্গে মিশে গিয়ে
ঘরের বাতাসকে ভারী করে তুললো।

প্রথমেই শাশুড়ি তীর্যক সুরে আক্রমণ করলেন,
-তোর বউ শুধু বেয়াদবই নয়, হাড়ভাঙা পরিশ্রম করি আমি একা, সে তো ঘরের এক চিলতে কাজও করে না।
আমি বলি ভোরে উঠো, রান্নাঘরে যাও, ও তখনো বিছানায় গা এলিয়ে থাকে।
চায়ের জন্য বললে বলে, আপনার তো হাত-পা ঠিক আছে নিজেই করে নিন না।
অতএব আমি যদি না করি, তবে তো ঘরের কুকুর-বিড়ালকেও না খেয়ে থাকতে হবে।
উল্টো প্রতিবেশীদের কাছে আমার নামে অপবাদ দেয়,
যেন আমি নাকি তার জীবন নষ্ট করে দিচ্ছি!
দিনে দিনে মাথা যেনো একেবারে আকাশে তুলে ফেলেছে,
শাশুড়ি বলে কোনো মর্যাদাই দেয় না,
আমাকে যেনো চাকরের মতো চোখ রাঙিয়ে কথা বলে।

মেঘলা তাতে চুপ রইলো না, বরং আরও জোরে সুর তুললো,
-আপনার মা আমায় কাজের মেয়ে ভেবে রেখেছেন।
সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এটা করো, ওটা করো,
খাবার মুখে তুলতে না তুলতেই নতুন হুকুম।
একটু বসে চুল বাঁধতে গেলেই তির্যক চোখে তাকান,
যেনো আমি কোনো অপরাধ করছি।
আমি বাজার করতে বললে বলেন, টাকা খরচ করার দরকার নেই, ঘরে যা আছে তাই খাও।
আমার নিজের কোনো মতামত রাখারও সুযোগ নেই।
অতএব আমি যেনো তার বদ্ধ কারাগারে বন্দি!
এমনকি শাড়ি না পরলেই মুখ ভার করে বসে থাকেন,
বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে গেলেও প্রশ্নের পাহাড় তুলে দেন।
এই বাড়িতে শ্বাস নিতে গেলেও যেনো অনুমতি নিতে হয়!

দুটো কণ্ঠ একে অপরকে ছাপিয়ে উঠছে,
আর ফাহিম মাঝখানে দাঁড়িয়ে
বুঝতে পারছে না,
কার দিকে তাকাবে, আর কার কথা বিশ্বাস করবে।

সারারাতের গভীর চিন্তা-ভাবনার পর অবশেষে তুরিন যেন এক অটল সংকল্পে দৃঢ় হলো।
ভোরবেলায় উঠে বাবা’কে বললো,
-বাবা, ব্যাংকে জমির দলিল রেখে আবারও লোন নিতে চাই।
বাবার মুখে চিন্তার ছাপ ফুটে উঠলো,
-এতো লোন তুই কী করে পরিশোধ করবে?
-আল্লাহর ওপর ভরসা রেখেছি, তিনি নিশ্চয় পথ দেখাবেন।
বাবা বললেন,
-ভেবে দেখ তু’ই।
-ভেবেই তো দেখেছি, বাবা।

দুপুরের সময় তুরিন ফাওয়াদ আর তার বাবাকে নিয়ে ব্যাংকের পথে রওনা হলো।
লাইটিংয়ের হালকা আলোয় ব্যাংকের গেটে দাঁড়িয়ে মনে পড়ে গেলো কতটা লড়াই করে আজ সে এ পথে এসেছে ।
অবশেষে সব বাধা পেরিয়ে, নির্ধারিত নিয়ম মেনেই এক লক্ষ টাকা লোন গ্রহণ করলো সে।
বাবার বুক ভারী, বারবার বলে উঠলেন,
-তুই পঞ্চাশ হাজারই নে, এতো টাকা তো তুই ফেরত দিতে পারবি না, তার মধ্যে আমিও এখন আর গাড়ি চালাই না।
তুরিন দৃঢ়তার সঙ্গে বললো,
-না, বাবা, এক লক্ষ টাকা প্রয়োজন। আরেকটু কমে চলবে না।
বাবার চোখে আশার আলো ফুটে উঠলো, মনে হলো হয়তো এই মেয়ে একদিন দুঃসময়ে আমাকেও বাঁচাবে।

তুরিনের মনের অদম্য জেদ আর বিশ্বাস যেনো নতুন করে বাতাসে ভাসছে,
সফলতার পথ কঠিন হলেও সে হাঁটবে সাফল্যের তরে,
অতীতের আঁধারে থেমে থাকবে না,
নতুন সূর্যের আলোয় নিজেকে গড়ে তুলবে,
আর নিজের মতো করে এক নতুন দিশা গড়বে।

ফাওয়াদকে বাবার সাথে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে তুরিন ফিরে এল নিজের কাজের কাছে।
দশ হাজার টাকা বাজেট করে বাবার জন্য একটা ছোট টং দোকান কিনে নিলো,
সাথে বাহার ভাইয়ের দোকান থেকে ডাল, চিনি, দুধ, মশলা, পাতি সবই দুই থেকে তিন কেজি করে নিলো, বাকিটা পরে পরিশোধ করবে।

বাহার মুচকি হাসি দিয়ে বললো,
-বেগম রোকেয়ার দেখা পাওয়া এখন আর আগের মতো সহজ নয়।
সারাদিন তো গ্রামের মেয়ে বউদের জীবন গড়ার তাড়া,
আর আমার জীবনটা কেউ গড়ার কথা ভাবেনা,
অন্য গ্রামে থাকি বলে কি আমি পরাধীন?

তুরিন ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,
-আপনার জন্য আমি কী করতে পারি?
বাহার একটু হেসে, একটু কষ্ট নিয়ে বললো,
-তুমি চাইলে এই ছন্নছাড়া জীবনটাকে গুছিয়ে দিতে পারো আমার জন্য।

তুরিনের গলায় নেমে এলো কঠোরতা,
-আপনাকে এতদিন সহজ সরল ভেবে এসেছি,
কিন্তু আপনার মনের অজানা লুকনো কথাগুলো শুনে মন ভেঙে গেল।
আরেকবার যদি এমন কথা শোনাতে চান,
তবে আমি আর আপনার দোকানে মাল নিতে আসবো না।

বাহার মাথা নিচু করে নীরবে দৃষ্টিটা ঝুলিয়ে রাখলো।
তুরিন নিজের ব্যাগ টেনে ভ্যানে উঠে বসল,
একই ভ্যানে টং দোকান আর মালামাল এবং দোকানের নতুন সম্ভাবনা নিয়ে চললো সে।

ভ্রু কুঁচকে, মনে ভাবলো, এতোটুকু সাহস তবু তার ভেতর আছে,
নিজের স্বপ্ন আর গর্বের জন্য লড়াই করার জেদ তার মনকে তীব্র করলো।
এই ছোট ছোট সোপানগুলোই একদিন বড় পর্বতের সমান হবে।
আর সে জানে, তার পথ আর পেছনে ফিরে যাওয়ার সুযোগ নেই।

বাড়ি ফিরতেই বাবার কৌতূহলী প্রশ্ন,
-এই ছোট্ট দোকানের মতো টিন কাঠের ঘরটা কেন আনলি? আর এই বিশাল ব্যাগের ভেতরই বা কী আছে?

তুরিন মিষ্টি হেসে বললো,
-আগে ভ্যান থেকে নামাতে সাহায্য করো, তারপর সব বলছি।

রমিস মিয়া পাশের তিনজন লোককে ডেকে আনলেন।
চারজনে মিলে শক্ত হাতে ধরে দোকানটাকে বাড়ির একপাশে বসিয়ে দিলেন।
গাঁয়ের বাতাসে নতুন কাঠের গন্ধ ছড়িয়ে পড়লো,
মনে হচ্ছিল যেন এই ছোট ঘরটা নতুন স্বপ্নের বাসা হয়ে উঠছে।

দোকান বসানোর পর তুরিন বাবাকে বললো,
-মায়ের ঘরে যত দোকানের জিনিস আছে সব এখানে এনে রাখো।
আজ থেকে এই দোকান হবে তোমার দায়িত্ব,
আর মায়ের ঘর হবে আমার স্বপ্নের প্রথম ঠিকানা।

বাবার মুখে ফুটে উঠলো তৃপ্তির হাসি।
তুরিন ব্যাগ খুলে একে একে ডাল, চিনি, আটা, মশলা, লবণ।
সব সাজিয়ে দিলো বাবার হাতে তুলে।
-আজ সামান্যই এনেছি বাবা, কিন্তু এভাবেই ধীরে ধীরে দোকানটা পূর্ণ করবো।
একদিন এমন সময় আসবে,
যখন মানুষ বলবে,
-রমিস মিয়ার দোকানে নেই শব্দের জায়গা নেই।

বাবা মৃদু মাথা নেড়ে যেন আশীর্বাদ করে বললেন,
-তুই শুরু কর মা, আল্লাহ তোকে সফল করুক।

দোকান গুছিয়ে তুরিন ছেলেকে বুকে টেনে নিলো।
কিছুক্ষণ বুকের দুধ পান করিয়ে মমতার হাত বুলিয়ে বাবার কোলে দিয়ে বললো,
-বাবা, ওর খেয়াল রেখো। আমি চেষ্টা করবো তাড়াতাড়ি ফিরতে।

তারপর দৃঢ় পদক্ষেপে রওনা হলো বড় বাজারের দিকে।
সেখানে গিয়ে প্রথমেই কিনে নিলো তিনটি নতুন সেলাই মেশিন,
ঝকঝকে, শক্তপোক্ত, যেন নতুন জীবন গড়ার যন্ত্র।
তারপর ঢুকলো কাপড়ের দোকানে,
যেখানে সারি সারি রঙিন থান কাপড়, নরম ফেব্রিকস, ঝলমলে রেশমি সুতা
দেখে মুহূর্তেই মন ভরে গেলো।
নিলো নানা রঙের কাপড়,
সাথে সেলাই মেশিনের জন্য দরকারি সুই-সুতা, মাপজোকের ফিতা, বোতাম, চেইন, যত কিছু একজন দর্জির দরকার হতে পারে, সবই।

কিনতে কিনতে বুঝতে পারলো,
হাতের সমস্ত টাকা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে।
মন বললো, আরও কিছু নিলে ভালো হতো,
কিন্তু সাথে সাথেই নিজেকে সামলে নিলো,
-যা দরকার, পরে তো আনা যাবে।
আজ শুধু শুরুটা হোক শক্ত ভিত্তির ওপর,
তারপর ধীরে ধীরে বাকিটা গড়ে উঠবেই।

বাড়ি ফিরতেই বাবা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন।
এতসব সেলাই মেশিন, রঙিন কাপড় আর বাহারী জিনিসপত্র,
এ যেন এক ছোট্ট দোকানের সমান ভাণ্ডার!

কৌতূহল সামলাতে না পেরে তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
– এতো মেশিন, কাপড় আর জিনিসপত্র দিয়ে কি করবি তুই, তুরিন?

তুরিনের চোখে জ্বলে উঠলো দৃঢ় আলোর ঝিলিক।
-আজ থেকে আমি একা লড়বো না বাবা, আমার সাথে গ্রামটার নারীরাও লড়বে।
তুমি তো জানো, একা একজন যতই চেষ্টা করুক, সমাজের পাহাড়সম প্রতিবন্ধকতা সরাতে কষ্ট হয়।
কিন্তু দশজন মিলে যে কাজ করে, তা পাহাড় ঠেলে সরানোর মতোই সহজ হয়ে যায়।
এটাই হবে আমাদের শক্তি, আমাদের নতুন পথচলা।

বাবা নীরবে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন,
তার সেই সাহসী মুখে যেন এক নতুন ভবিষ্যতের নকশা আঁকা।
মমতার হাত বাড়িয়ে মেয়ের মাথায় আলতো করে বুলিয়ে দিলেন।
-সফল হস রে মা, আল্লাহ তোকে সহায় হোন।
মুহূর্তেই তুরিনের বুক ভরে গেলো অদম্য প্রেরণায়,
কারণ বাবার এই আশীর্বাদই তার স্বপ্নপথের প্রথম বিজয়ের চাবিকাঠি।

রাতে বিছানায় শুয়ে তুরিনের চোখে ঘুম আসছিল না।
চাঁদের আলো জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকে তার ভাবনার সমুদ্রে ঢেউ তুলছিল।
মায়ের পুরনো মেশিন মিলিয়ে এখন ঘরে মোট চারটি সেলাই মেশিন,
কালই সবাইকে ডেকে বসাবে,
দেখে নেবে কার কোন কাজে দক্ষতা আছে,
যে যা ভালো পারে, সেটাই হবে তার দায়িত্ব।
একসাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করলে
অভাবের এই অন্ধকার খুব শিগগিরই দূর হয়ে যাবে, এই বিশ্বাসে বুক ভরে উঠলো তুরিনের।

শান্ত ঘুমে তলিয়ে থাকা ছেলেটিকে বুকে টেনে নিলো সে।
নরম কানের লতি আলতো করে ছুঁয়ে আদর করলো।
মনের গভীরে ফিসফিসিয়ে বললো,
-জানি সোনা, আজকাল তোর সাথে সময় কাটাতে পারি না,
তবুও মা যা করছে, সবই তোর জন্য।
কাল থেকে মা আর এদিক-ওদিক ছুটবে না,
তোকে আঁকড়ে ধরেই লড়বে,
তোকে নিয়েই গড়ে তুলবে আমাদের নতুন ভোর।

এদিকে শাশুড়ি বিছানায় এপাশ-ওপাশ করতে করতে নিঃশ্বাস ফেললেন।
একাকীত্ব যেন তাকে ধীরে ধীরে গ্রাস করছে,
এই নীরবতার ভার সহ্য হয় না।
মেঘলা সারাদিন নিজের দুনিয়াতেই ডুবে থাকে,
আমার সাথে বসে দু’টো কথা বলারও সময় তার নেই।
মনটা হাহাকার করে উঠলো,
ফাওয়াদ যদি আমার কাছে থাকতো,
আমার নাতিটা হলে অন্তত একজোড়া খেলার সাথী পেতাম,
হাসি-ঠাট্টায়, গল্পে, দুষ্টুমিতে
দিনের ক্লান্তি যেন হারিয়ে যেত।

ভাবনার ভেলায় হঠাৎ ভেসে এলো তুরিনের মুখ।
মেঘলার তুলনায় তুরিন ছিলো কতটা আলাদা,
গায়ের রঙ হয়তো শ্যামলা,
কিন্তু শাশুড়িকে সম্মান দেওয়া জানতো,
বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠদের কথা শুনে চলতো।
এই বেয়াদব মেয়ের মতো তীক্ষ্ণ জবাব দিত না,
দেখাশোনার অজুহাতে দায়িত্ব এড়িয়ে যেত না।
হৃদয়ের গভীরে একপ্রকার আক্ষেপ জমে উঠলো,
হায়, যদি তুরিন এখনো এই ঘরে থাকতো,
হয়তো এই নিঃসঙ্গতা আমাকে এভাবে গ্রাস করতো না।

পরক্ষণেই মনে দৃঢ়তা এলো,
তুরিন নেই তাতে কি?
আমি তো আমার দাদুভাইকে নিয়ে আসতেই পারি,
সে হবে আমার দিনের সঙ্গী,
আমার নিঃসঙ্গতার দেয়ালে ফোটাবে হাসির ফুল।
কালই উকিলের সাথে বসে সব কথা বলবো।

কিন্তু হঠাৎ মনে কাঁপন ধরালো এক প্রশ্ন,
যদি তুরিন ছেলেকে দিতে না চায়?
চোখে এক মুহূর্তের জন্য অন্ধকার নেমে এলো।
তবুও পরক্ষণেই নিজেকে সান্ত্বনা দিলেন,
দেবে না কেন?
ফাওয়াদকে কি সে তার বাপের বাড়ি থেকে এনেছে নাকি?
ও তো আমারই ছেলের রক্ত,
আমার বংশের আলো,
যার শিকড় এই বাড়িতেই গাঁথা।
তার ওপর বাবা, দাদা-দাদির
ভালোবাসা
কেউ কাড়তে পারে না,
এই বিশ্বাসে বুক ভরে উঠলো।
❝তারপর বলুন, আপনারা রেসপন্স না করার কারণ কি? লাইক কমেন্ট করতে কতটুকুই বা সময় লাগে?❞

চলবে,,,,,,