কালিনী পর্ব-১৮

0
1

#কালিনী
#আরেব্বা_চৌধুরী
#পর্ব_সংখ্যা ১৮

ফাওয়াদের শরীর জ্বরে কাঁপছে, ছোট্ট বুকটা যেন আগুনে পুড়ে যাচ্ছে।
মধ্যরাতে দিশেহারা তুরিন দৌড়ে বেড়াচ্ছে ঘরের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে।
জ্বরের ভারে ক্ষীণ দেহটা কাঁপতে কাঁপতে যখন কাতর সুরে কেঁদে উঠছে,
তখন মায়ের বুকের ভেতরটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে।

এক হাতে জলপট্টি চেপে ধরেছে সন্তানের কপালে,
অন্য হাতে আঁকড়ে ধরেছে আল্লাহর দরবার।
বাবা পায়চারি করতে করতে অস্থির,
কিন্তু এই রাতের আঁধারে ডাক্তার কোথায় পাওয়া যায়?

অসহায়ের মতো তুরিন ছুটে গেলো এ দরজায়, ও দরজায়,
কিন্তু কেউ দরজা খোলেনি,
কারও চোখে জেগে উঠেনি মানবতার আলো।
যেন সমাজের প্রতিটি মানুষ তার বিপদের মুহূর্তে ইচ্ছে করে কানে তুলো গুঁজে রেখেছে।

অবশেষে কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন ধরলো তুরিন,
ডাকলো বাহারকে।
বাহার সময় নষ্ট করলো না,
অন্ধকার রাত চিরে দৌড়ে এলো,
তার পরিচিত ডাক্তারকে ঘুম থেকে জাগিয়ে নিয়ে এলো নিজের বাইকে করে।

ওষুধ, ইনজেকশন, ফি সবকিছু নিজের পকেট থেকে মিটিয়ে দিলো নিঃশব্দে।
কাজ শেষ হলে ডাক্তারকে এগিয়ে দিয়ে,
শান্ত ভঙ্গিতে বসে পড়লো ফাওয়াদের মাথার কাছে।
তার শক্ত হাতের স্পর্শে যেন মমতার নদী বয়ে গেলো,
চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ফিসফিস করে বললো,
কিছু হবে না, আমি আছি।

তুরিন স্থির চোখে তাকিয়ে রইলো বাহারের দিকে,
চোখের কোনায় জমে থাকা জল এবার গড়িয়ে পড়লো অবিরাম।
সে যেন ভাবছিলো,
একটা মানুষ কি সত্যিই এতোটা নিঃস্বার্থ হতে পারে?
যে মানুষ কেবল দেয়, কিন্তু নিজের জন্য কিছুই চায় না।

গোটা রাত ভয়ার্ত আঁধারে কেটে গেলো নিঃসঙ্গতায়।
দরজায় কড়া নেড়ে নেড়ে যখন হাত অবশ হয়ে আসছিলো,
তখন কোনো মুখ দরজা খুলে দেয়নি,
কেউ হাত বাড়িয়ে পাশে দাঁড়ায়নি।
কিন্তু ভোরের আলো ফুটতেই আবার সেই বিষাক্ত গুঞ্জন,
-বাজারের ব্যবসায়ী আজ রাতেও তুরিনের ঘরে এসেছিলো, দেখো, এখনো আছে।
কথাগুলো যেন আগুন হয়ে ছুটে এলো তুরিনের কানে।

অসহ্য হয়ে উঠলো প্রতিটি শব্দ।
হঠাৎ তুরিনের চোখ লাল হয়ে উঠলো রাগে,
কণ্ঠে জ্বালা মিশে উচ্চস্বরে বলে উঠলো,
-এসব কাদা ছোড়াছুড়ি কবে শেষ হবে?
আমাকে নিয়ে দিনের পর দিন নোংরা অভিযোগ করেছেন, চুপ থেকেছি।
কিন্তু শোনেন, এই মানুষটাকে নিয়ে
এক মুহূর্তের জন্যও জিভে বাজে কথা আনবেন না। এটা আমি সহ্য করবো না।

তার কথায় কেউ ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো,
কেউ গলা উঁচু করে ব্যঙ্গ ছুড়ে দিলো,
-বাবা মেয়েকে দিয়ে ব্যবসা করছে।
নাহলে কোন মেয়ের এত দুঃসাহস হয়
বাবা ঘরে থাকতে পরপুরুষকে ঘরে রাখতে?

তুরিন আর নিজেকে সামলাতে পারলো না।
বুকের ভেতর জমে থাকা দুঃখ ক্ষোভ ফেটে বের হলো চিৎকারে,
-রাতের আঁধারে যখন অসহায়ের মতো
প্রতিটি দরজায় কড়া নাড়ছিলাম,
তখন কোথায় ছিলেন আপনারা?
কোথায় লুকিয়েছিলেন আপনাদের মানবতা?
কেউ হাত বাড়াননি, এক ফোঁটা সহানুভূতিও দেননি।

আজ আসছেন বদনাম করতে?

যে মানুষটা কিছু চায়নি,
নিজের স্বার্থ ভুলে আমার সন্তানের জীবন বাঁচাতে ছুটে এসেছে,
আজ তাকে নিয়েই আপনাদের কুৎসা রটনা!
লজ্জা করেন না?
এ সমাজ যদি সত্যিই ন্যায়ের কথা বলতো,
তবে এমন মানুষের পায়ের ধুলোও
আপনারা মাথায় তুলে নিতেন।

তুরিনের কণ্ঠ যেন বজ্রাঘাতের মতো ছড়িয়ে পড়লো চারপাশে।
কেউ চোখ নামিয়ে নীরব হলো,
কেউ আবার কানে কানে ফিসফিস করে সরে গেলো।
কিন্তু বাতাসে তুরিনের বুকভাঙা যন্ত্রণার সেই কথা
দীর্ঘক্ষণ ভেসে রইলো।

বাহার এতোক্ষণ পর্যন্ত নীরব দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে সব শুনছিলো।
কিন্তু একসময় বুকের ভেতর জমে থাকা সাহস এক ঢেউ হয়ে বেরিয়ে এলো কণ্ঠে।
নিস্তব্ধতা ভেঙে সে রমিস মিয়ার দিকে তাকিয়ে দৃঢ় স্বরে বললো,

-চাচা, আমি তুরিনকে বিয়ে করতে চাই। আপনি যদি সম্মতি দেন তবে আজই আমি আমার বাড়িতে কথা বলতে পারি।

এক মুহূর্তেই চারদিক স্তব্ধ হয়ে গেলো।
কেউ চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো,
কেউ ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে উঠলো,
“এই কালো কুচকুচে, তার উপর ডিভোর্সি মেয়েকে নাকি গ্রামের বড় ব্যবসায়ী বিয়ে করবে? আহা, এ তো স্পষ্ট ছলনা!”

রমিস মিয়া চুপ করে রইলেন খানিকক্ষণ।
কী উত্তর দেবেন, তা যেন তিনিও খুঁজে পাচ্ছিলেন না।
অবশেষে ধীরে ধীরে বললেন,
-তুমি বরং তুরিনের সাথে ওই ঘরে গিয়ে একটু বোঝাপড়া করো, পরে আমি তার সাথে আলাদা করে কথা বলবো।

রমিস মিয়ার কথায় অন্য ঘরে পা বাড়ালো বাহার।
পিছন পেছন গম্ভীর মুখে ঢুকে গেলো তুরিনও।
কিছুক্ষণ দু’জনের মধ্যে নীরবতা নেমে এলো।
শুধু বুকের ভেতরকার নিঃশ্বাসের শব্দ যেন কানে বাজছিলো।

অবশেষে বাহার ভাঙলো সেই নীরবতা।
মৃদু কণ্ঠে বললো,
-দেখো তুরিন, কলঙ্ক একবার নারীর গায়ে লেগে গেলে তা মুছে ফেলা বড় কঠিন।
যতই তুমি আমাকে দূরে সরিয়ে রাখো, তবুও মানুষ তোমাকে আমায় নিয়ে প্রতিদিন কটূক্তি করবে।
আমি পুরুষ আমার বদনাম সমাজের চোখে তেমন কিছুই না।
কিন্তু তুমি নারী, তুমি দোষ না করলেও এই সমাজ তোমাকেই দোষী বানাবে।
তাই বলছি, এই বিয়েতে তুমি দ্বিমত করো না।

তুরিন চমকে তাকালো বাহারের চোখে।
স্বরে কাঁপন নিয়ে বললো,
-আপনি… আমাকে বিয়ে করতে চান কেনো?

বাহার নির্ভীক দৃষ্টিতে উত্তর দিলো,
-কারণ আমি তোমায় ভালোবাসি।

তুরিনের গলায় কান্না আটকে এলো।
-কেনো ভালোবাসেন আমাকে?

বাহারের ঠোঁটে একরাশ অচেনা হাসি ফুটে উঠলো,
চোখে ভেসে উঠলো গভীর এক স্নিগ্ধতা,
-কেনো ভালোবাসি, তার উত্তর আমার জানা নেই।
ভালোবাসার সঠিক সংজ্ঞা হয়তো আমি জানি না।
কিন্তু এটুকু বলতে পারি, তুরিন
আমি তোমায় সত্যিই ভালোবাসি, কারণে কিংবা অকারণে, অকারণেই হয়তো সবচেয়ে বেশি।

তুরিন মাথা নিচু করে রইলো।
চোখের কোণে গড়িয়ে পড়লো অশ্রু,
কিন্তু সেই অশ্রুর ভেতরেও যেন
এক অদ্ভুত শান্তি মিশে ছিলো।

বাহার কাঁপা হাতে এগিয়ে এসে স্নেহভরে আঙুলের ডগায় তুরিনের চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রু মুছে দিলো।
তারপর স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো,
দীর্ঘক্ষণ ধরে শুধু অপেক্ষা,
একটি হ্যাঁ অথবা না শুনবার আকুল প্রতীক্ষা।

কিন্তু তুরিন কোনো উত্তর দিলো না।
চোখ নামিয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে।
পিছনে পড়ে রইলো বাহারের নিস্তব্ধ দৃষ্টি আর ভাঙা বুকের দীর্ঘশ্বাস।

বাধ্য হয়ে বাহার আবারও রমিস মিয়ার দিকে ফিরে তাকালো।
গভীর কণ্ঠে বললো,
-চাচা, আপনি তাকে বুঝান।
জীবন একা চলতে পারলেও মানুষ ভালোবাসা ছাড়া পূর্ণ হতে পারে না।
সে আজ একা, ভাঙাচোরা কিন্তু তারও তো অধিকার আছে আপনজন পাবার।
আপনি তাকে বলুন, সমাজের ভয় যেনো তাকে শৃঙ্খলিত না করে।
আপনি সাহায্য করুন যাতে তার দিকে আর কোনো দিন কেউ আঙুল তুলতে না পারে।
তার এই সংগ্রামী জীবনটা কলঙ্ক নয়,
বরং গৌরব হয়ে উঠুক।

এদিকে ফাহিম ধীরে ধীরে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছে।
ঘরে শান্তির বাতাস যেনো বহুদিন হলো উধাও।
মায়ের সাথে বউয়ের রোজকার অশান্তি এখন তার জীবনের নিত্যসঙ্গী।
বউয়ের পক্ষে কিছু বললেই মায়ের অঝোর কান্না,
এতো বছর লালন-পালন করে এই কষ্টটা দেখবার জন্যই কি রাখলাম তোরে?
আবার মায়ের পক্ষে কিছু বললেই বউয়ের মুখে ঝড়,
তুমি চিরকালই তোমার মায়ের আঁচল ধরা ছেলে, সংসার কি করে সামলাবে?

ফাহিমের বুকের ভেতর যেনো প্রতিদিনই এক নতুন যুদ্ধে ক্ষত তৈরি হচ্ছে।
অফিসে বসেও মন পড়ে থাকে ঘরের ভাঙাগড়ায়।
রাতে বিছানায় শোবার পরেও ঘুম আর আসে না,
কারণ মায়ের অভিযোগের পর বউয়ের অভিযোগের ভার তার কানে যেনো শিকল বেঁধে রাখে।

এমনকি সংসারের ভিড় সামলাতে একজন কাজের মেয়েকেও রাখা হয়েছিলো,
কিন্তু শাশুড়ি আর বউয়ের যুদ্ধের আগুনে সেও পালিয়ে গেছে।
এখন ফাহিমের কাছে সংসার মানেই যুদ্ধক্ষেত্র,
যেখানে সে প্রতিদিনই একা সৈনিক হয়ে হারে।

আজ প্রথমবারের মতো ফাহিম গভীরভাবে উপলব্ধি করছে,
তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা করেছে সৌন্দর্যের মোহে পড়ে।
যে সৌন্দর্যের খোঁজে সে তুরিনকে ছেড়ে দিয়েছিলো,
আজ সেই সৌন্দর্যের মাঝেই লুকিয়ে আছে তীব্র অশান্তি, অপরিসীম হাহাকার।

তার মনে ভেসে উঠলো তুরিনের মুখ,
সেই সাদাসিধে মেয়ে, যে একমুঠো ভালোবাসা পেলে সব অভাব-অভিযোগ ভুলে হেসে খেলে দিন কাটিয়ে দিতো।
সে সৌন্দর্যের মোহে পড়ে হারিয়েছে শান্তি,
এখন বুঝতে পারছে,
রূপ নয়, সুন্দর মনই আসল সম্পদ।
সৌন্দর্য ক্ষণস্থায়ী,
কিন্তু সুন্দর হৃদয়ই জীবনকে রাঙিয়ে দেয়।

রাতে তুরিনের ঘরে যেনো ভারি নীরবতা নেমে এসেছে।
চুপচাপ বসে ছিলেন রমিস মিয়া, তারপর ধীরে ধীরে মেয়ের পাশে এসে বসলেন।
অস্ফুট কণ্ঠে বললেন,

-তোকে নিয়ে আমি সারাজীবন শুধু দুশ্চিন্তাই করেছি মা। ভাবছি, আমি না থাকলে তোকে কে দেখবে? লোকের কথায় তোকে কতটা কষ্ট পেতে হয় আমি নিজের চোখেই দেখি। বাহারকে তুই এড়িয়ে চলতে চাইছিস, কিন্তু দেখ না, কোনো স্বার্থ ছাড়াই প্রতিটি মুহূর্তে তোকে আঁকড়ে ধরছে সে। এই যে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা, এ জিনিস কপাল করলে তবেই পাওয়া যায়।

রমিস মিয়ার হাতের স্নেহমাখা স্পর্শে চোখ ভিজে উঠলো তুরিনের।
তিনি আবারও বলতে লাগলেন,

-মানুষ তো সবসময়ই কিছু না কিছু বলবে রে মা। আমি আছি তাই এতটুকু আড়াল পাচ্ছিস, আমি মরে গেলে কে তোর হয়ে উত্তর দিবে? মিথ্যা অভিযোগ করবে তোর নামে, তোকে নিয়ে সালিশ বসবে। তোর কথা না ভাবলেও ফাওয়াদের কথা ভাব, ও যেনো সমাজের চোখে বাপহারা হয়ে না বড় হয়। অন্তত একটা পরিচয় পাক, বাবার স্নেহ পাক।

তুরিন নিরব হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলো।
চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রু মুছে নিলো আঙুলের কোণে।
অবশেষে খুব ধীর স্বরে বললো,

-তুমি যা ভালো মনে করো তাই করো বাবা। আমি তোমার কথায়ই ভরসা রাখি।

রমিস মিয়া যেনো অনেকটা হালকা হয়ে গেলেন, বুকের ভেতর জমে থাকা দীর্ঘশ্বাস বাইরে এসে মিলিয়ে গেলো।
মুখে একফোঁটা আশ্বস্তির হাসি ফুটে উঠলো, যেনো বহু দিনের ভার নেমে গেছে।

বাহার তার মা বাবার সাথে মুখোমুখি হয়ে ধীর গলায় বললো,
-আমি একজনকে পছন্দ করি। আপনারা যদি রাজি থাকেন, তবে তাকে বিয়ে করতে চাই।

বাবা হঠাৎ চমকে উঠলেন,
-কে?

বাহার সরল কণ্ঠে বললো,
-পাশের গ্রামের রমিস মিয়ার ছোট মেয়ে তুরিন, হয়তো চিনবেন?

বাবা প্রথমে কিছুটা দ্বিধা প্রকাশ করলেন, চোখে কৌতূহল মিশ্রিত হেসে বললেন,
-ওই কালো মেয়েটি? ওর তো বিয়ে হয়ে ডিভোর্সও হয়ে গেছে, তাই না?

বাহার নিশ্চয়তার সঙ্গে বললো,
-হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন, কিন্তু মেয়েটির মন-মানসিকতা অসাধারণ। শান্ত, নম্র, দায়িত্বশীল আপনারা দেখলেই বোঝবেন, এর মতো মেয়ে খুব কমই আছে। সে শুধু আদর জানায় না, সংসারে শান্তি ও সমঝোতার বাতাবরণও রচনা করে।

মা লাজুক হাসি মুখে বললেন,
-শেষে কিনা সত্যিই ওই মেয়েটিকে ঘরে তুলবি?

বাহার দৃঢ় কণ্ঠে উত্তর দিলো,
-মা, চেহারা সব নয়। মেয়েটা আমাদের পরিবারকে ভালোবাসা, আদর আর শান্তি দিতে পারবে। ওর মন-মানসিকতাই সংসারের মূল ভিত। যে সংসারে ভালোবাসা থাকে, সেখানে সুখের অভাব হয় না। আর আমি বিশ্বাস করি, তুরিন যদি আমাদের বাড়িতে আসে, সবাইকে ভালোবাসায় মুড়িয়ে রাখবে।

অবশেষে বাবা দৃঢ় কণ্ঠে বললেন,
-দেখো, আমরা আজ আছি, কাল নাও থাকতে পারি। সারাজীবন সংসার করবে তুমি। তাই যা করার ভেবেচিন্তে করো। তুমি প্রাপ্তবয়স্ক, নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়ার মতো বুদ্ধি ও ক্ষমতা রাখো। আশা করি যতটা সময় নিয়ে চিন্তা করবে, ততটাই নিঃসন্দেহে নিখুঁত সিদ্ধান্তে পৌঁছাবে।

মা আলতো করে বাহারের কাঁধে হাত রাখলেন,
-আমরা তোমার পাশে আছি। যা মনে হয়, সেই পথেই এগো। শুধু মনে রেখো, নিজের সুখের সঙ্গে অন্যের সুরক্ষা ও ভালোবাসাও থাকতে হবে।

বাহার গভীর নিঃশ্বাস ফেলে, মনে শান্তি ও সাহসের জোয়ারে ভেসে গেলো। জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের মুহূর্তে সে বুঝলো, ভালোবাসা, সম্মান আর পরিবারের আশীর্বাদ তার সঙ্গে আছে। এই সুরক্ষায় সে নিজের জীবন রঙিন করে তুলতে পারবে, এবং তুরিনকে জীবনের সঙ্গী হিসেবে বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে আর কোনো দ্বিধা থাকবে না।

পরের দিন সকালে বাহার সোজাসুজি তার সিদ্ধান্ত জানালো রমিস মিয়াকে।
-চাচা, আমি ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তুরিনকেই আমি আমার জীবনসঙ্গিনী করতে চাই।

রমিস মিয়া কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে বাহারের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর গভীর নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন,
-ঠিক আছে বাবা, তুমি যদি তোমার মন থেকে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকো তবে আমার আর কোনো আপত্তি নেই। ঝাকঝমক করে আয়োজনের দরকার নেই, সহজ-সরলভাবেই তোমাদের বিয়ে হবে। সংসারের আসল শক্তি তো আড়ম্বর নয়, বিশ্বাস আর ভালোবাসা।

বাহারের মুখে স্বস্তির ছায়া ফুটে উঠলো।
-চাচা, আমিও তাই ভেবেছি। আমার মা-বাবার বয়স হয়েছে, তারা এত আয়োজন সামলাতে পারবেন না। ঘরোয়া আয়োজনই যথেষ্ট, তাতেই আমাদের সুখ হবে।

এরপর খবরটা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়লো পুরো গ্রামে। প্রথমে যে গ্রাম তুরিনকে নিয়ে নানা গুঞ্জন তুলেছিলো, সেই গ্রামই এবার চুপ হয়ে গেলো।
তুরিন নিজের অবস্থান দিয়ে প্রমাণ করলো ডিভোর্স কোনো অভিশাপ নয়, বরং সেটা ভাগ্যের লিখন।

গ্রামের মেয়েরা, যারা ভয়ে নিজেদের কণ্ঠ কখনো প্রকাশ করেনি, তারাও যেন নতুন এক সাহস পেলো।
তুরিন সবার সামনে দৃঢ়ভাবে বললো,
-ডিভোর্স মানে জীবনের শেষ নয়। আমরা যারা ভেঙে যাওয়া সম্পর্ক থেকে ফিরে আসি, তারাও বাঁচতে জানি, নতুন করে দাঁড়াতে জানি।

তার চোখে ছিলো আত্মবিশ্বাসের ঝিলিক, ঠোঁটে দৃঢ় হাসি।
সে আশ্বাস দিলো,
-আমাদের কাজ, আমাদের পরিকল্পনা কোনোদিন থেমে থাকবে না। দোকান এগিয়ে যাবে, আমরাও এগিয়ে যাবো। সময়ের স্রোত আমাদের থামাতে পারবে না।

বাহার ভোর থেকে দু’জন কাজের লোক ডেকে এনে পুরো বাড়িটা ঝকঝকে করে তুলতে লাগলো।
বৃদ্ধ মা-বাবা তো বয়সের ভারে ন্যুব্জ, তাদের ওপর এত দায়িত্ব চাপানো যায় না। নতুন বউ ঘরে আসবে, তার চোখে যেনো কোথাও অগোছালো না লাগে এই ছিলো বাহারের একমাত্র চিন্তা।

সব কাজ সেরে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো সে। কিছুক্ষণ চুপচাপ নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে রইলো, তারপর যেনো আপন মনেই ফিসফিস করে উঠলো,

আমি রূপে অতোটাও সুন্দর নই, তবু বিশ্বাস করো, তোমার পাশে দাঁড়াতে আমার কোনো সংকোচ নেই। সুন্দর মুখ হয়তো চোখ ভরাতে পারে, কিন্তু সংসার ভরে রাখে মনের সৌন্দর্য।
তোমাকে পাওয়া সহজ ছিলো না,
ডিভোর্সি, কালো, এসব তির্যক কথায় সমাজের দেয়াল যেনো ক্রমেই উঁচু হয়ে উঠেছিলো। তবু সেই দেয়াল টপকে আসতে পেরেছি, শুধু এই বিশ্বাসে যে ভালোবাসার শক্তি সব প্রতিকূলতাকেও ম্লান করে দেয়।

আল্লাহ কত সহজ করে দিলেন কঠিনকে!
যে পথকে আমি পাথরে ভরা ভেবেছিলাম, সেই পথেই তিনি আলো ছড়িয়ে দিলেন। আর সেই আলোয় আজ আমি তোমার কাছে পৌঁছেছি।

বাহারের ঠোঁটে অজান্তেই একরাশ হাসি ফুটে উঠলো, মনে হলো যেনো আয়নার ভেতর থেকেও তুরিনের স্নিগ্ধ উপস্থিতি তাকে আশীর্বাদ করছে।

পরপর দু’বার ফাহিম মৃত্যুর পথ বেছে নিতে চেয়েছিলো, অথচ মৃত্যুর দরজায় গিয়েও ফিরে এসেছিলো সে।
হয়তো আল্লাহও চায়নি, তার জীবন এখানেই শেষ হয়ে যাক।
আসলে মরা কি এতো সহজ!
নিজেকে শেষ করতে গিয়েও হাত কাঁপে, বুক কেঁপে ওঠে।
কারণ ভিতরে ভিতরে সে বাঁচতে চায়, সুখের সংসার, শান্তির জীবন, একটুখানি ভালোবাসা, এগুলো তো সেও কামনা করে।
অকালমৃত্যুর আঁধার সে চায় না, সে চায় জীবনের আলো।

কিন্তু সেই আলো হঠাৎই নিভে গেলো এক রাতের বার্তায়।
মোবাইলের পর্দায় চোখ আটকে গেলো,
তুরিন লিখেছে, আগামীকাল তার বিয়ে।

খবরটা পড়ার সাথে সাথে বুকের ভেতরটা যেনো কেউ দুমড়ে-মুচড়ে দিলো।
শ্বাস নিতে কষ্ট হলো, চোখের সামনে সব ঝাপসা হয়ে গেলো।
এক মুহূর্তে মনে পড়লো, এমন সংবাদ তো সেও একদিন পাঠিয়েছিলো তুরিনকে।
তবে কি সেদিন তুরিনের বুকেও এমন দহন জ্বলে উঠেছিলো?
এমনই কি সে কেঁদেছিলো রাতভর, বুক চাপড়ে নিঃশব্দে হাহাকার করেছিলো?

আজ তার ভেতরে কেবল শূন্যতার হাহাকার।
বারবার মনে হচ্ছে দৌড়ে যাই, ঝাঁপিয়ে পড়ি, তুরিনকে বুকের ভেতর টেনে আনি।
কিন্তু কোন অধিকারে?
তার উপরে তো আর কোনো অধিকার নেই, সব সম্পর্ক, সব বন্ধন তো সে-ই একদিন নিজের হাতে ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিলো।

এখন কেবল নিজের ভুলের বোঝা নিয়ে একা একাই কাঁদতে হবে, একা একাই পুড়তে হবে।
আর বুকের ভেতর সেই চিরন্তন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে,
ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে কি কেউ বাঁচতে পারে? নাকি এ-ও এক ধরনের ধীরে ধীরে মরে যাওয়া?

চলবে,,,,,