কালিনী পর্ব-১৯

0
1

#কালিনী
#আরেব্বা_চৌধুরী
#পর্ব_সংখ্যা ১৯

রাত গভীর হচ্ছে, অথচ তুরিনের চোখে ঘুম নেই।
অন্ধকার ঘরটা তাকে আরও শূন্য করে তুলছে।
চোখ মেলে উপরের দিকে তাকিয়ে থাকে, মনে প্রশ্নের ঢেউ বারবার ধাক্কা দিচ্ছে।
কাল ভোরেই তো নতুন জীবনে পা বাড়াতে হবে, কিন্তু সেই পথ কতটা মসৃণ হবে, তা কে জানে?

একজন ডিভোর্সি মেয়ে হয়ে অন্যের ঘরে ঠাঁই পাওয়া কি এতোটাই সহজ?
সেখানে কি সত্যিই তাকে আপন করে নেবে সবাই?
নাকি ভেতরে ভেতরে তাকেই দোষারোপ করে আঙুল তুলবে, এই তো সেই ডিভোর্সি কালো মেয়ে।

তুরিনের বুক কেঁপে ওঠে এই ভেবে, বাহার কি কেবল মুহূর্তের আবেগে এই বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে?
আবেগ কেটে গেলে?
যদি একদিন তাকেও ছুড়ে ফেলে দেয় অবহেলার আঁধারে?

বাহার অনেকবার বলেছে, অনেক আশ্বাস দিয়েছে,
তবু তুরিনের হৃদয়ের ভেতর একটা অদৃশ্য ভয় আঁকড়ে বসে আছে।
সে বোঝে না, বাহারের মতো সম্মানিত, সুস্থির মনের একটা ছেলে কেন এমনভাবে তার জন্য পাগল।
সে নিজেকে কখনোই তেমন যোগ্য মনে করেনি।

শূন্য রাতের নিস্তব্ধতায় মনে মনে শুধু একটা প্রার্থনাই ঘুরপাক খাচ্ছে,
আল্লাহ, এ জীবনের নতুন অধ্যায়ে যেন আর কোনো ঝড় না আসে,
বাহারের হাতটা যেন সত্যিই তার শেষ আশ্রয় হয়ে থাকে।

সকালটা যেন অন্য সব দিনের চেয়ে আলাদা।
পাখির কিচিরমিচির, শিউলি ফুলের ঘ্রাণ সবকিছু মিলেমিশে এক অদ্ভুত আবেশ ছড়িয়ে দিয়েছে চারদিকে।
কিন্তু তার মাঝেই রমিস মিয়ার মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট।
ছোট পরিসরে বিয়ে হলেও, অতিথি আপ্যায়ন থেকে শুরু করে কাজি, মেহমান সবকিছু সামলাতে তিনি একেবারেই হিমশিম খাচ্ছেন।

আরেকদিকে, গ্রামের গুঞ্জন যেন থামতেই জানে না।
কারো মুখে করুণা, কারো কণ্ঠে বিদ্রূপ,
আবেগে বিয়ে করছে ছেলেটা, দু’দিন যেতেই আবার আগের মতো ভেঙে যাবে সংসার।
অন্যের সন্তানকে কে-ই বা বুক ভরে ভালোবাসতে পারে?
নতুন সংসারে মেয়েটা স্বামী নিয়েই মেতে থাকবে, আর ছেলেটা অবহেলায় বেড়ে উঠবে।

প্রতিটি শব্দ যেন ছুরি হয়ে আঘাত করছিল তুরিনের হৃদয়ে।
একসময় মনে হলো বুকের ভেতরকার সাহসটুকুও ভেঙে পড়ছে।
ভেবেছিল, অন্তত এ দিনে তো শান্তি পাবে, অথচ কটূক্তির আঁচল আবারও তাকে আঁকড়ে ধরলো।
চোখ নামিয়ে মনে মনে শুধু একটি প্রার্থনাই করলো,
“হে আল্লাহ, যদি ভাঙতে হয় আবার, তবে বাঁচিয়ে রেখো না আমায়, কারণ এবার আর ভাঙা আমিটাকে জোড়া লাগাতে পারবো না।”

অবশেষে এলো সেই মুহূর্ত।
বাহার কাজি ও ক’জন সঙ্গী নিয়ে পৌঁছলো উঠোনে।
চারপাশে কোলাহল, হাসি-আনন্দে ভরে উঠলো পরিবেশ।

দুজনকে পাশাপাশি বসানো হলো।
তুরিনের বুক কাঁপছে, অথচ বাহারের চোখে অদ্ভুত এক দীপ্তি।
সে আড়চোখে তুরিনের দিকে তাকায়, যেন চোখ দিয়ে ভরসা আর ভালোবাসা ঢেলে দিতে চাইছে।
তুরিন একবার তাকাতেই বাহার নিঃশব্দে হেসে ওঠে, চোখেমুখে এমন সরল খুশি যেন পৃথিবীর সব আনন্দ সেখানেই লুকিয়ে আছে।

সেই অকারণ হাসি দেখে অজান্তেই তুরিনের ঠোঁটেও ফুটলো একরাশ হাসি।
মুহূর্তের জন্য মনে হলো,
হয়তো, সত্যিই সে আবার বাঁচতে পারবে।
বাহারের চোখেমুখের সরলতা, সেই শিশুসুলভ হাসি তাকে ভুলিয়ে দিলো সব গুঞ্জন, সব ভয়।
তুরিনের মনে হলো, যেন সে কোনো কঠিন বাহু নয়, এক উজ্জ্বল সকালের আলোকে আশ্রয় হিসেবে বেছে নিচ্ছে।

বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলো, অতিথিরা তৃপ্ত মনে খাওয়া-দাওয়া সেরে বিদায়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
গৃহের উঠোনে সবার চোখে এখন বিয়ের শেষ মুহূর্ত কনের বিদায়।

রমিস মিয়া একটু অস্বস্তির সুরেই বললেন,
-বাচ্চা কোলে নিয়ে নতুন ঘরে প্রবেশটা কেমন দেখায় রে মা, মানুষ কী না কী বলবে। তারচেয়ে ফাওয়াদকে আপাতত এখানে রেখে যা, পরে আমি নিজে গিয়ে দিয়ে আসবো।

কিন্তু তুরিনের কিছু বলার আগেই বাহার দৃঢ় কণ্ঠে কথা কেটে দিলো,
-ফাওয়াদকে লুকিয়ে রাখার কোনো মানেই হয় না। তুরিনের বাচ্চা আছে, এ সত্য আমার পরিবারের কারোর অজানা নয়। আমি শুধু তুরিনকে নয়, তাদের দুজনকেই ভালোবেসে এ সংসার শুরু করছি। আজ থেকে তুরিন আমার স্ত্রী আর ফাওয়াদ আমার সন্তান। তাই তাদের আলাদা করে নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

চারপাশে মুহূর্তের জন্য নীরবতা নেমে এলো।
তুরিন নির্বাক হয়ে শুধু বাহারের দিকে তাকিয়ে রইলো।
এই মানুষটাকে যেন সে প্রতিবার নতুনভাবে আবিষ্কার করছে।
একেকটি আচরণ, একেকটি বাক্য যেন তাকে আরও গভীর মুগ্ধতায় ভাসিয়ে নিচ্ছে।

মনে হলো, বাহারের হৃদয়ের ভেতর যেন অশেষ গুণের ভাণ্ডার লুকিয়ে আছে,
ভালোবাসা, দায়িত্ববোধ, সাহস আর অদ্ভুত এক উদারতা।
তুরিনের চোখ ছলছল করে উঠলো,
নিঃশব্দে মনে মনে বললো,
-হয়তো এ জীবনটা আমাকে আবার নতুন করে বাঁচতে শেখাবে।

সকালবেলা ঘর থেকে বেরিয়েছিলো ফাহিম।
কোনো স্পষ্ট কারণ তার জানা নেই, তবুও বুকের ভেতর একটা অদ্ভুত টান তাকে গ্রামের পথে টেনে আনলো।
মনে মনে বারবার প্রশ্ন করছিলো,
-কিসের অধিকারে তাকে দেখতে চাইছি আমি? যদি সত্যিই সেই অধিকার এখনো থাকতো, তবে কি এতদিনে আমি তাকে ফেরাতে পারতাম না?

বিকেলের সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে, প্রায় চারটা বাজে।
ফাহিম পৌঁছালো গ্রামে, অথচ ততক্ষণে তুরিন বিয়ের লাল শাড়ি গায়ে জড়িয়ে পাড়ি জমিয়েছে শ্বশুরবাড়ি।
দূর থেকে, আড়ালে দাঁড়িয়ে সে চেষ্টা করলো একবার, শুধু একবার তুরিনকে দেখার, অন্তত নিঃশব্দে ক্ষমা চাওয়ার জন্য।

কিন্তু ভাগ্যও যেন তার প্রতি নিষ্ঠুর।
সেই দেখা আর হলো না।
অবশেষে গ্রামের এক ছোট্ট ছেলেকে জিজ্ঞেস করলো তুরিনের কথা।
ছেলেটা হেসে বললো,
-ও তো বিয়ে হয়ে গেছে, বাজারের বড় এক ব্যবসায়ীর সাথে।

ফাহিমের ঠোঁট বেয়ে এক তিক্ত হাসি বেরিয়ে এলো।
মনে মনে বললো,
-অযত্নে ফেলে রাখা ফুলও একদিন কোনো ভালোবাসার বাগানে জায়গা পায়। আমি যাকে একফোঁটা মর্যাদা দিতে পারিনি, সেই মেয়েটা আজ নতুন জীবন পেয়েছে, নতুন মর্যাদা পেয়েছে। ভালোই হলো, হয়তো এবার তার একটু শান্তি হবে। আর আমি? আমি তো নিজেরই বানানো অভিশাপের আগুনে ধুঁকে ধুঁকে মরছি।

আকাশে গোধূলির লাল আভা ছড়িয়ে পড়েছে।
ফাহিম নিঃশব্দে দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
তার পায়ের তলা যেন ভারী হয়ে উঠলো, অথচ সে এগিয়ে চললো নিজের ঘরের পথে।
পথটা দীর্ঘ হলেও মন বলছিলো,
-এটাই হয়তো নিয়তি, আমার জন্য শাস্তি, আর তার জন্য মুক্তি।

ফাওয়াদ খাটের এক কোণে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে, শিশুর মতো শান্ত, নির্ভার।
এই ফাঁকে বাহার আলতো করে তুরিনের হাত দুটো নিজের হাতে নিলো। তার চোখে ছিলো অটল দৃঢ়তা আর কণ্ঠে স্নিগ্ধ মমতা।

সে ধীরে বললো,
-ভালোবাসার সঠিক সংজ্ঞা হয়তো আমি জানি না, তবে আমি জানি, তোমাকে ভালো রাখাই হবে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সাধনা। আজ তোমার হাত ধরলাম, আর এই হাতে আমার প্রাণ ভরসা রেখে দিলাম। মৃত্যু ছাড়া এ পথ থেকে আমি আর কখনো সরে দাঁড়াবো না এই প্রতিজ্ঞাই করছি।

সংসারে কখনো সুখ আসবে, কখনো দুঃখও ভর করবে। কিন্তু সেই দুঃখকে ভয়ে নয়, একসাথে লড়ে জয় করতে চাই। আমি জানি তুমি বুদ্ধিমতী, তুমি সামলাতে পারবে, তবুও যদি কখনো হোঁচট খাও তবে মনে রেখো, আমি ছায়ার মতো সবসময় তোমার পাশে আছি।

একটু থেমে বাহার মৃদু হেসে তুরিনের চোখের গভীরে তাকিয়ে বললো,
-আমি বাহার, কথা দিলাম, সারাজীবন তুরিনের রূপের বাহার হয়ে তার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করবো। আমি তোমার জীবনকে রঙে রঙে ভরিয়ে রাখবো। তুমি তুরিন আমার কাছে বাহারের রূপকথা, বাহারের সৌন্দর্য, বাহারের অনন্ত প্রেরণা। তোমার হাসিই হবে আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।

তুরিনের চোখে অশ্রুর ঝিলিক ফুটলো।
এই মানুষটা তাকে শুধু গ্রহণই করেনি, বরং তার অস্তিত্বকেই নতুন করে সৌন্দর্যের ব্যাখ্যা দিলো।

তুরিন নিঃশব্দে বাহারের কাঁধে মাথা রাখলো।
মনে হলো এই মানুষ, এই শক্ত কাঁধ তার বহু চেনা, বহু দিনের আপন। যেনো ভাঙা ডালে নতুন কুঁড়ি গজিয়েছে, ঝড়ের পর শান্ত আকাশে রঙধনু ফুটেছে।

বাহার ধীরে ধীরে তুরিনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। সেই স্পর্শে তুরিনের বুকের গভীরের ভয়গুলো একে একে গলে যাচ্ছিলো। মনে হলো এ ঘর আর চারদেয়াল নয়, এ যেনো তার আশ্রয়, তার নিরাপদ ঠিকানা।

বাসর ঘরের পরিবেশটাও যেনো দুজনের হৃদয়ের মতোই শান্ত ও কোমল। চারদিকে মৃদু আলো, ফুলের ঘ্রাণে ভরপুর বাতাস, আর এক কোণে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকা ছোট্ট ফাওয়াদ সব মিলিয়ে এ রাত যেনো হয়ে উঠেছে এক পবিত্র আর নতুন জীবনের সূচনা।

বাহার আলতো করে ফিসফিস করে বললো,
-আজ থেকে এ ঘর হবে আমাদের ছোট্ট পৃথিবী। এখানে হাসি থাকবে, ভালোবাসা থাকবে, থাকবে অগণিত স্বপ্ন। আমি চাই, এই রাত শুধু আজকের নয়, আমাদের সারাজীবনের প্রতিজ্ঞার প্রতীক হয়ে থাকুক।

তুরিন চোখ বন্ধ করে মৃদু কণ্ঠে বললো,
-তাহলে আজ থেকে আমার বেঁচে থাকার কারণ বাহার।

নতুন জীবনের প্রথম রাত নিঃশব্দে তাদের দুজনের হৃদয়কে আরও গভীর বন্ধনে আবদ্ধ করলো।

ভোরের প্রথম আলোয় তুরিনের ঘুম ভাঙলো,
ঘর তখনও নীরব, বাহার আর ফাওয়াদ নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে।
সন্তানের কপালে মায়াভরা চুমু এঁকে দিলো তুরিন, তারপর চুপিসারে বাহারের কপালেও রাখলো একটি চুমু।
মুহূর্তেই তার ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠলো এক লাজুক হাসি।
এই ঘর, এই মানুষ দুজন, এ যেনো তার নতুন পৃথিবী।

রান্নাঘরে গিয়ে তুরিন ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
পরোটা, আলুর দম, সব একে একে সাজিয়ে রাখলো ছোট্ট টেবিলে।
কিন্তু যখন চা বানাতে যাবে ঠিক তখনই চোখে পড়লো, চায়ের চিনি নেই।
মনে হলো, মহাজনের ঘরে চায়ের চিনি না থাকা মানে যেনো অভাবের এক অদ্ভুত ছবি।

এক এক করে শ্বশুর-শাশুড়িকে ডেকে তুললো সে।
বাহারের মা টেবিলের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ নিঃশব্দে রইলেন,
নতুন বউয়ের এমন যত্নশীল আয়োজন দেখে তার চোখে বিস্ময়, হয়তো খানিকটা অচেনা স্নেহও খেলা করছিলো।

তুরিন এবার বাহারকে ডেকে বললো,
-বাজারের মহাজনের ঘরে যদি চা খাওয়ার চিনি না থাকে, তবে কেমন দেখায়?

বাহার মাথা চুলকে হেসে ফেললো, সেই হাসিতে ছিলো ছেলেমানুষি আর ভালোবাসার সরলতা।
-মা বোধহয় খেয়াল করেননি। ব্যাপার না, তুমি এসে গেছো তো, এবার থেকে এসবের খেয়াল রাখা তোমারই দায়িত্ব।

তুরিন বাহারের চোখে চোখ রাখলো।
মনে হলো, এ দায়িত্ব আসলে বোঝা নয়, বরং তার জীবনের নতুন মানে।
এ ঘরের প্রতিটি শূন্যতায় সে ভরিয়ে দেবে তার মমতা, আর প্রতিটি ভোর হয়ে উঠবে তাদের ভালোবাসার নতুন শুরু।

বাহারের মা একটু বিস্মিত গলায় বললেন,
-কি দরকার সকাল সকাল উঠে তুমি এসব করার? আমি ধীরে সুস্থেই করে নিতাম।

তুরিন মৃদু হেসে মাথা নিচু করলো,
-আপনার তো বয়স হয়েছে, শুনলাম শ্বাসকষ্টও বেড়েছে। আমি থাকতে কেনো আপনাকে এসব কষ্ট করতে হবে?

শাশুড়ি স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন তুরিনের দিকে।
মনে মনে ভাবলেন, লোকমুখে শোনা যায়, নতুন বউরা প্রথমে নয়গুণ ভালো দেখায়, পরে দিন গড়ালে দায়িত্ব থেকে সরে যায়। এই মেয়েটিও কি সময়ের স্রোতে বদলে যাবে? নাকি সত্যিই ব্যতিক্রম হবে?

তুরিন যেনো আজ থেকেই সংসারের সব দায়িত্ব বুকভরা আগ্রহে কাঁধে তুলে নিয়েছে।
শশুর-শাশুড়ির কাপড় ধুয়ে শুকোতে দিলো।
শাশুড়ি কপাল কুঁচকে বললেন,
-এসব আবার তুমি কেনো করবে?

তুরিন ভেজা হাত মুছে মৃদু গলায় উত্তর দিলো,
-আপনারা তো আমার মা-বাবার মতো। আমার তো আর মা নেই, তাই আপনাদেরই আমি মা-বাবা বলে মানি। বিনিময়ে শুধু চাই, আপনারাও যেনো আমায় মেয়ের মতোই ভালোবাসেন।

কথাগুলো বলেই তুরিনের গলা ধরে এলো, চোখে জল ভরে উঠলো।
চুপচাপ ঘরে চলে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়াল সে।
নিজেকেই বললো,
আমি সংসার চাই, আমি সুন্দর একটা জীবন চাই। সবার ভালোবাসা চাই। আমি চাই না আবার আমার সংসার ভেঙে যাক। যদি এই ঘর ভেঙে যায়, তবে হয়তো আমিই ভেঙে চুরমার হয়ে যাবো। আমি ভালোবেসে আগলে রাখবো এই সংসার, আর এই সংসারের প্রতিটি মানুষকে।

বাহার যখন বাইরে বেরোতে উদ্যত হলো, তুরিন কেমন যেনো কাচুমাচু করতে লাগলো।
মুখে বলতে চাইছে কিছু, অথচ সংকোচে গিলে ফেলছে।

বাহার থেমে দাঁড়াল, তার চোখে কৌতূহল ভরা স্নেহ।
-কিছু বলবে? কিছু বলার থাকলে বলে দাও। এত লুকোচুরি কেনো? আমরা তো আমাদেরই মানুষ।

তুরিন নিচু চোখে ক্ষীণ কণ্ঠে বললো,
-বেলা তো অনেক হয়ে গেলো, বাবা খেয়েছেন কিনা জানি না। যদি এখান থেকে একটু খাবার বাবাকে পাঠিয়ে দেই, আপনি কি কিছু মনে করবেন?

বাহার মুহূর্তেই চুপ করে তাকিয়ে রইলো তার স্ত্রীর দিকে।
তারপর ঠোঁটে ধীরে ধীরে এক আশ্বস্ত হাসি টেনে বললো,
-মনে করবো কেনো? তুমি তো আমার স্ত্রীই নও, এই সংসারের আলোও তুমি। তোমার ইচ্ছাই আমাদের ইচ্ছা হবে। আর উনি তো পর কেউ নন, একথাটা আমারই ভাবা উচিত ছিলো, ওবাড়ি কোনো মেয়ে মানুষ নেই চাচা খাবেন কিভাবে।
তুমি নিঃসংকোচে আমায় দাও, আমি ওবাড়ি দিয়ে আসবো।

তুরিন মৃদু হেসে মাথা নামালো।
কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা হারিয়ে ফেলেছে সে।

মা-মেয়ে বসে বসে শুধুই কানা-কানি।
এতে বেশ বিরক্ত হলো মেঘলা। ইফার কাছে এসে মৃদু হেসে ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো,
-এক মাস তো পেরিয়ে গেলো ননদিনী, আর কবে শশুরবাড়ি যাবে? সংসার বুঝে নিতে হয়, বছরের ছয় মাস যদি বাপের বাড়িই পড়ে থাকো তবে সংসার চলবে কেমন করে? এই দেখো না, আমি কয়দিনের জন্যই বা বাপের বাড়ি যাই? শশুর-শাশুড়ির সঙ্গে এখানেই থাকি। তোমার শাশুড়িও তো নেহাৎ ভালো মানুষ, আমার হলে এখনই বলতেন,
সংসারের কাজ আমার জন্য আটকে আছে।
তা বলছি, যাচ্ছো কবে?

মুহূর্তেই ইফা ও তার মা ক্ষেপে উঠলেন।
শাশুড়ি গলা চড়িয়ে বললেন,
-কত বড় সাহস! আমার একমাত্র মেয়েকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলিস?

মেঘলা ঝাঁঝালো হেসে বললো,
-যেতে বলতাম না যদি না সে আমার পেছনে কুটনামি করতো। ননদ-শাশুড়ি ভালো হলে সারাজীবন বসিয়ে খাওয়ানোতেও আমার আপত্তি থাকতো না।

মুহুর্তেই শাশুড়ির চোখ জ্বলে উঠলো।
-কি বললি? আমরা ভালো না?

মেঘলা তখনো থামলো না, তীব্র সুরে বললো,
-ভালো হলে কি আর এভাবে মা মেয়ে বসে বসে আমার নামে কানাঘুষা করতেন? মুখে মধু, পিঠে বিষ, তাই না? ননদিনী তো আজও নিজের সংসার বোঝেনি, অথচ আমায় দেখে দেখেই টিপ্পনী কাটতে ওস্তাদ!

শাশুড়ি হাত কাঁপিয়ে উঠলেন,

-ওরে ধৃষ্ট মেয়ে! সংসারের শান্তি কেড়ে নিচ্ছিস, আমার মেয়েকে নিয়ে তিরস্কার করছিস! তুই এ বাড়ির বউ হয়ে এ বাড়ির সম্মান হরণ করছিস।

মেঘলার রাগে চোখ লাল হয়ে উঠলো, সে দাঁত চেপে বললো,
-সম্মান তো আগেই শেষ হয়েছে মা-মেয়ের এমন বেহায়াপনা দেখে। ভেবেছো আমি চুপ থাকবো? তোমাদের মেয়ে তো দিন-রাত কাকের মতো আমার সংসারে ঝাঁপিয়ে পড়ে। শাশুড়ি হয়ে মেয়ে কোলে বসাও, বউকে শত্রু ভাবো?

এভাবেই চলতে থাকলো আঘাত-প্রতিঘাত।
চেল্লাচেল্লির শব্দে ঘুম ভাঙলো ফাহিমের। এটা আর নতুন নয়, বরং এখন রোজকার নিয়ম।

বাইরে থেকে হাক দিলেন শাশুড়ি,
-ফাহিম, দেখে যা তোর বউ কি বলছে! আমাদের এই বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতে চায়। আমরা নাকি এ সংসারের বোঝা!

একদিকে মায়ের কান্না, অন্যদিকে বউয়ের ঝাঁজালো কথার ঝড়।
ফাহিম প্রথমে স্থির করলো, এসবের মধ্যে সে আর যাবে না। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই মেঘলার চিৎকার শুনতে পেলো।

বাইরে বেরিয়ে দেখলো-মেঘলার মাথা থেকে টপটপ করে রক্ত পড়ছে। মা রাগের মাথায় ফুলদানি ছুঁড়ে মেরেছেন।

তবুও ফাহিম কিছু বললো না, নিশ্চুপে মেঘলার মাথায় ঔষধ লাগাতে চাইলো।
কিন্তু মেঘলা অভিমানে নিজেকে সরিয়ে নিলো।
চোখে আগুন ঝরিয়ে বললো,
-মায়ের আঁচলধরা ছেলেকে মায়ের আঁচলের চলাতেই মানায়, বউয়ের পাশে নয়। তুমি পুরুষ নও, কাপুরুষ! আজ তুমি আমার স্বামী নাহলে তোমার মুখে থুথু ছেটাতাম!

শাশুড়ি তৎক্ষণাৎ বলে উঠলেন,
-ওরে সর্বনাশী! স্বামীকে অভিশাপ দিস? তাইতো সংসারে অশান্তি লেগে আছে অলক্ষী।

মেঘলা হাত তুলে প্রতিবাদ করলো,
-অশান্তি তো আপনাদের আঁচলের ভাঁজেই লুকানো। মা-মেয়ে মিলে বউয়ের জীবন অন্ধকার করে দাও, তারপর আমার ওপরই দোষ চাপাও, ছেলের কাছে নালিশ করো।

শাশুড়ির গলা কাঁপলো ক্রোধে,
-তোকে বউ করে আনাই ছিলো আমাদের জীবনের অভিশাপ!

মেঘলা দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
-হ্যাঁ, আমি অভিশাপই বটে। তবে মনে রেখো, অভিশাপ যেমন সর্বনাশ ডেকে আনে, তেমনি অভিশাপই একদিন তোমাদের আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দেবে!

এবার কান্না, ঝগড়া, অভিযোগের স্রোতে চারপাশ ভারী হয়ে উঠলো।
ফাহিম নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলো, এক পাশে মা, অন্য পাশে স্ত্রী। অথচ কোনো দিকেই এগোনোর সাহস তার নেই।

ফাহিম বুঝতে পারলো এই ঘরের দ্বন্দ্ব কোনোদিন থামবে না।
ভেতরে ভেতরে সে যেনো নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি কান্না, প্রতিটি অভিযোগ, প্রতিটি চিৎকার তার বুকের ভেতর পাথরের মতো চাপ সৃষ্টি করছে।
এই যন্ত্রণা বোধহয় মৃত্যুর থেকেও ভয়ঙ্কর।

নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এলো, চোখের দৃষ্টি ঝাপসা।
নিঃশব্দে রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো ফাহিম।

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তাকালো নিজের দিকে।
একদিন এই চেহারাই ছিলো মা-বাবার অহংকার, বোনের গর্ব। অথচ আজ সেই মুখ একটুখানি হাসিও দিতে পারছে না কাউকে।
এ মুখই আজ হবে নির্জন কবরের মাটির সঙ্গী, মৃদু হাসলো ফাহিম, সাথে সাথে চোখ নামিয়ে নিলো।

তারপর কলম হাতে তুলে নিলো। কাগজ কাঁপতে লাগলো, অক্ষর ঝাপসা হয়ে গেলো অশ্রুর স্রোতে। লিখলো দুটো চিঠি, একটা মা-বাবা আর বোন ইফার জন্য, আরেকটা মেঘলার উদ্দেশ্যে।

প্রথম চিঠি :

প্রিয় মা, বাবা, আর আমার ছোট্ট ইফা,

আমি না হতে পেরেছি একজন ভালো সন্তান, না হতে পেরেছি একজন ভালো ভাই, আবার না হতে পেরেছি একজন দায়িত্বশীল স্বামী।
আমার ব্যর্থতার বোঝা এত ভারী হয়ে গেছে যে এ জীবনের যন্ত্রণা আমি আর সহ্য করতে পারছি না।
তোমাদের চোখের আলো হয়ে বাঁচতে চেয়েছিলাম, তোমাদের গর্ব হতে চেয়েছিলাম, অথচ আজ আমি কেবল বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছি।

মা, তোমার স্নেহের ভাত আমি শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত অনুভব করবো।
বাবা, তোমার কষ্টে গড়া ঘর আমারই অক্ষমতায় আজ অশান্তিতে জর্জরিত হলো।
ইফা, তোমার হাসিখুশি ভাইটা আর ফিরবে না, তবে বিশ্বাস করো তোমাদের প্রতি আমার ভালোবাসা মৃত্যুর পরেও অটুট থাকবে।

ক্ষমা করে দিও আমাকে।
তোমাদের কাঁধে বোঝা হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মাটির নিচে ঘুমিয়ে থাকাই হয়তো শান্তি।

-ফাহিম

দ্বিতীয় চিঠি :

প্রিয় মেঘলা,

শুরুতেই ক্ষমা চাইছি।
বিয়ের পর থেকে আমি তোমাকে শুধু অশান্তি দিয়েছি, সুখ দিতে পারিনি।
আমিও চাইতাম সুন্দর একটা জীবন, রঙিন সংসার, কিন্তু নিয়তি আমায় বাঁচতে দিলো না।
আমি জানি আমার ভীরুতা, আমার নীরবতা তোমাকে ধীরে ধীরে ভেঙে দিয়েছে।

হ্যাঁ, আমি কাপুরুষ।
তোমার প্রতি অন্যায় হতে দেখেও মায়ের প্রতি দুর্বলতায় আমি চুপ থেকেছি।
যে মা আজও আমাকে নিজের হাতে খাইয়ে দেন, যার প্রতিটি শাসনের ভেতরেও নিঃস্বার্থ ভালোবাসা লুকিয়ে আছে তার বিপরীতে দাঁড়ানোর শক্তি আমার হয়নি কখনো।

তবে এ সত্য অস্বীকার করতে পারবো না তুমি ছিলে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় আশ্রয়, আমার সবচেয়ে বড় স্বপ্ন।
আমার অক্ষমতার কারণে সেই স্বপ্নটাকেই আমি ভেঙে দিলাম।

মেঘলা, আমি তোমার জীবনটা নষ্ট করে দিলাম, জানি এই অপরাধের আমি কোনদিন ক্ষমা পাবো না।
কিন্তু তুমি বেঁচে থেকো, হাসো, নতুন করে জীবন সাজাও।
আমার অনুপস্থিতি যেনো তোমার ভবিষ্যৎকে কালো না করে।
ভালো থেকো তুমি, তোমার মতো করে।
আজ এক কাপুরুষের গল্প এখানেই শেষ হলো।

আমার মৃত্যুর দায় কারোর নয়, শুধু আমার।
ভালো থেকো, এ আমার শেষ কামনা।

-ফাহিম

চিঠি দুটো ভাঁজ করে টেবিলের ওপর রেখে, শেষবারের মতো ঘরটাকে একবার চারপাশে হেঁটে হেঁটে দেখে নিলো সে।

অতঃপর সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুলে পড়লো ফাহিম।
কোনো চিৎকার নেই, কোনো শব্দ নেই, শুধু নীরব মৃত্যু, যেনো অশান্ত সংসারের শেষ টানলো সে নিজের জীবন দিয়ে।

একটি সুন্দর জীবনের সমস্ত স্বপ্ন, সমস্ত সম্ভাবনা, সমস্ত ভালোবাসা শেষ হয়ে গেলো কয়েকটি কান্নার আঘাতে।
সংসারের কলহ শেষ করে দিলো একটি তরতাজা প্রাণ।

❝কেউ বলবেন না, আমি সুইসাইডকে প্রমোট করছি, আমি শুধু একটা কঠিন বাস্তবতা তুলে ধরেছি। আমাদের সমাজে অনেক পুরুষ আছে যারা মা আর স্ত্রীর মাঝখানে পড়ে দুই দিক সামলাতে না পেরে শেষমেশ নিজেকেই নিঃশেষ করে ফেলে।
তবে এমনটা মোটেও উচিত নয়, সুইসাইড কখনো কোনো সমস্যার সমাধান হতে পারে না।❞

চলবে,,,,,