#কাশফুলের_মেলা
#পর্ব_১১
#Writer_Nusrat_Jahan_Sara
অনু রেগে ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। এই প্রথম ওর মা ওকে এড়িয়ে যাচ্ছেন তাও একটা ডায়েরির জন্য।অনু আবারো বেশ ঠান্ডা গলায়ই বলল,
“মা বলো এই ডায়েরি তোমার কাছে কী করে এলো?
“বললাম তো তোমার এতো কিছু না জানলেও চলবে। আর এই ডায়েরি কী করে এলো সেটা সত্যিই জানিনা আমি।
“তুমি মিথ্যা বলছো মা।তুমি জানো।যদি তুমি না-ই জানো তাহলে ডায়েরিটা কী করে এলো বলোতো?
অনুর মা কিছুক্ষন চুপ থেকে বললেন,
“আগে বলো তুমি অস্বাভাবিক কোনো আচরন করবে না?।
“মানে?
“বলো
“না করবনা।
“এই ডায়েরি পড়ে তুমি যাদের সম্বন্ধে জেনেছো উনারা হচ্ছেন তোমার বাবা মা।
অনু যেন নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে চাইছেনা।কানের চারিপাশে শু শু শব্দ করছে।এমনও একদিন আসবে যে নিজের মা তার সন্তানকে অন্যের সন্তান বলবে এটা কোনোদিনও ভাবেনি অনু। কী বলছেন কী উনি?অনু বিস্ময়কর দৃষ্টিতে ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
“এসব কী বলছো তুমি মা? আমি শুধু তোমারই মেয়ে আর তুমি আমারই মা।
অনুর মা একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,
“হ্যাঁ আমি তোমার মা।আমি তোমাকে গর্ভে ধরিনি তাতে কী হয়েছে তোমাকে ছোট থেকে লালন পালন করে বড় তো করেছি।আজ থেকে বিশ বছর আগে,
বাইরে উতালপাতাল ঝড় বইছে।রান্নাঘর থেকে ছুটে গেলাম সামনের দরজা বন্ধ করার জন্যে।হঠাৎ দুজন মানুষকে আমাদের ঘরের দিকে আসতে দেখে বেশ অবাক হলাম।ভদ্র লোকটির হাতে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছিলো।আর মহিলাটি সেসময় তোমাকে আর এই ডায়েরিটা আমার হাতে তুলে দিয়ে শুধু এটুকুই বলেছিলো”আমার মেয়েকে আমি আপনার হাতে শপে দিলাম।আমি জানিনা বোন আপনি কে?তারপরও নিজের বোন ভেবে বলছি আমার মেয়েটাকে আপনি দেখে রাখবেন। আর ওর গলায় যে লকেটটি দেখছেন ওটাতে ওর নাম লিখা আছে। আর এই ডায়েরিতে আমারদের ব্যাপারে লিখা আছে। ও যখন বড় হবে তখন ওকে সব জানতে হবে।”
কথাটি বলে উনারা আর এক সেকেন্ডও দাঁড়ালেন না চলে গেলেন।আমি পিছনে ডেকেছিলাম কিন্তু উনারা শোনেননি।
“কিন্তু কেন কী এমন হয়েছিলো?
“সেটাতো জানিনা।কিন্তু আমার মনে হয় উনাদের উপরে প্রাণঘাতী আক্রমন হয়েছিলো।কারন উনারা চলে যাওয়ার পরই কয়টা সন্ত্রাস দেখতে ছেলে কাউকে খুঁজ করার জন্য আমার ঘরে ঢুকেছিলো ভাগ্যিস তখন তোমাকে রান্নাঘরের এক কোনে লুকিয়ে রেখেছিলাম।
অনুর মা সেই লকেটটি এনে অনুর হাতে তুলে দিলেন। স্বর্নের লকেট তাতে খোদাই করে অনুর নাম লিখা।উনি এবার একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
“দামী লকেট।বুঝতেই পারছিস আমার মতো গরীব আর মূর্খ মানুষ এইরকম লকেট বানাতে পারবেনা। হয়তো এটা তোর মা বাবা তোর জন্য খুব যত্নসহকারে বানিয়ে ছিলো। কারও দৃষ্টি যাতে তোর লকেটের উপরে না পরে সেই জন্যে খুলে রেখে দিয়েছিলাম।এখন এটা তোর কাছে রাখ কাজে দিবে।
অনুর চোখ থেকে টপটপ করে পানি পরছে।এতো ঝটকা তাও একসাথে মেনে নিতে পারছেনা সে। কোনো রকমে চোখটা মুছে বলল,
“উনারা বেচে আছেন তো?
“জানিনা রে মা।
“মা আমি উনাদের খুঁজ করার জন্য শহরে যেতে চাই।
“বেশ তাই হবে।
“তাহলে আমি রওনা দেই?।
“না এখন না সোহেল ওই হিজল গাছটার নিচে বসে আছে যদি একবার জানতে পারে তুই কোথাও চলে যাচ্ছিস তাহলে তোকে মেরে ফেলবে রে।তুই তো জানিস ছেলেটা কী পরিমানের গুন্ডা।
“ওকে ফাকি দিয়ে যেতে হলে রাতের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
সন্ধ্যা ছয়টা বাজে অনু অপেক্ষায় আছে কখন চারিদিক একেবারে বিদঘুটে অন্ধকার হয়ে যাবে।
আসল মা বাবার কথা শুনে তাদেরকে দেখার জন্য আর তর সইছে না। যদিও জানে ওদেরকে ফিরে পেতে হলে অনেক কষ্ট পোহাতে হবে।চারিদিকে অন্ধকার হওয়ার সাথেসাথেই অনু বেড়িয়ে গেলো ওর মা বাবাকে খুজার উদ্দেশ্যে।সে আদৌ জানেনা তার মা বাবাকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব কী না। বর্ষাকাল। বৃষ্টি না হলে যেন না-ই। অনু এই অন্ধকারেই একা একা হেঁটে যাচ্ছে।ল্যাম্পপোস্টের আলোতে যতটুকুই দেখা যাচ্ছে ততটুকুই অনুসরন করে সে হেঁটে যাচ্ছে। তীব্র বাতাসে ওর জামা বারবার উল্টে যাচ্ছে। আর সব চুলগুলোও বিরক্ত করার জন্য সামনে আসছে।
আকাশে বিজলির রেখা দেখা যাচ্ছে সাথে হার কাঁপানো বজ্রপাত। অনুও আরশির মতোই বজ্রপাত অনেক ভয় পায়।সে কানে দুই হাত দিয়ে চেপে ধরে হাঁটছে। নিজেকে এখন বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে। জানিনা এই সোহেলটা আমি নেই সেটা জানলে মায়ের সাথে কী করে।জানিনা আমি আদৌ মা বাবাকে পাবো কী না? নাকি শুধুই নিজের আবেগের বশিভূত হয়ে ছোটে চলেছি ওদের খুঁজে। ঝোম ধারায় বৃষ্টি পরছে।মুষলধারে বৃষ্টি।একেকটা বৃষ্টির ফোটা মনে হচ্ছে শরীর থেকে এক টুকরো মাংস তুলে নিতে যথেষ্ট। বাতাস আর বৃষ্টির মিশ্রণে একটা ঠান্ডা পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।অনু দুইহাত দিয়ে শরীর ডেকে হাঁটছে।মাঝেমধ্যে হিচকিও উঠছে।ভাঙা যে ছাতাটা সাথে করে নিয়ে এসেছিলো বাতাসে সেই ভাঙা ছাতাটি আরও ভেঙে গেছে।অনু রেগে কখনই ছাতাটা বটতলায় ফেলে এসেছে।ভাঙা ছাতাটাই যদি থাকতো তাহলে হয়তো বৃষ্টির প্রকোপ ওর শরীরের উপর পরা থেকে একটা রক্ষা করতো।অনু এসব ভাবছে আর এগিয়ে যাচ্ছে। শহরে পৌঁছাতে হলে আরও এক ঘন্টা হাঁটতে হবে।অনু এবার হাঁটার বেগ বাড়িয়ে দিলো। কিছুটা দূরে একটা ছাওনি দেখে অনুর মুখে হাসি ফুটে উঠলো।সে দ্রুত হেঁটে ছাওনির কাছে গিয়ে দাঁড়াল সাথেসাথেই মুখে যে হাসিটা ছিলো সেটাও নিমিষেই মিলিয়ে গেলো।কয়েকটা ছেলে ছাওনির ভিতরে খরের উপরে বসে আছে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে ছেলেগুলো বখাটে একদম সোহেলের মতো।অনুর মনে ভয় বেড়ে গেলো। সে দ্রুতপদে হেঁটে যেতে লাগল।পিছনে একবার তাকিয়ে দেখলো ছেলেগুলো আসছে কী না।হ্যাঁ ছেলেরা আসছে।চারটে ছেলে দুটি ছাতা নিয়ে ওর পিছন পিছন আসছে।অনুর মনে ডিপডিপ করে দ্রতবেগে হৃদপিণ্ড পরিচলন হচ্ছে।অজানা এক আশংকায় মন বারবার কেঁপে উঠছে। পেছন থেকে একটা ছেলে উচ্চস্বরে বলে উঠলো,
“কী হে সুন্দরী ছাতা লাগবে নাকি তোমার?
অনুর এবার কেঁদে দেওয়ার পালা। সে কিছু না বলে নিজের মতো হাঁটতে লাগল। একটা ছেলে হুট করেই ওর হাত এসে খপ করে ধরে ফেলল,
“এত দেমাগ কিসের তোর? চল আজ আমাদের সাথে। তোর দেমাগ আজ বেড় করছি অসভ্য মেয়ে।
ছেলেটি এমন ভাবে হাত চেপে ধরেছে মনে হচ্ছে হাতের হাড় একেবারে ভেঙে গুড়ো হয়ে যাচ্ছে।অনু এবার ফুপিয়ে কেঁদে দিলো।ওর কাঁদা দেখে ছেলেরা অট্টহাসিতে ফেটে পরলো।অনু ওকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য অনেক আকুতি মিনতি করছে কিন্তু ছেলেরা ওর কথা এক কান দিয়ে শুনছে আরেক কান দিয়ে বেড় করছে।আরেকটা ছেলে ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগল। হঠাৎ ওদের সামনে একটা কার এসে থামাতে ছেলেগুলো একটু হকচকিয়ে গেলো। কিন্তু অনুকে ছাড়লো না। অনুর সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। সে তো কাঁদতে ব্যস্ত।কার থেকে ছাতা মাথায় দিয়ে একটা ছেলে নামলো। পরনে সাদা শার্ট কালো জিন্স।কিছু চুল কপালে এসে পরেছে। ছেলেগুলো হা করে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে আছে।আরেকটা ছেলে অস্ফুট স্বরে উচ্চারন করলো,, “””আবির রায়হান চৌধুরী””
ছেলেগুলো এবার অনুকে ছেড়ে দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেলো। নিজের দুহাত মুক্তি পেয়ে অনু আশেপাশে একবার তাকিয়ে দেখলো ছেলেগুলো চলে গেছে।কিন্তু সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটিকে দেখে সে একদমি খুশি হয়নি। আবির অনুর দিকে দুকদম এগিয়ে এসে বলল,
“কেমন মেয়ে আপনি যে এই ঝড় আর বৃষ্টির সময় বাইরে বেড়িয়েছেন তাও রাতের বেলা। আপনার বাড়ির মানুষই বা কেমন দায়িত্বশীল যে একা একটা মেয়েকে এই রাতের বেলা ছেড়ে দিয়েছে। কোনো অঘটন যদি আজ ঘটে যেতো তাহলে সমাজে মুখ দেখাতে কী করে? ইডিয়ট!!!
অনু কিছু বলল না।মাথা নিচু করে রেখেছে কীই বা বলবে আবিরকে। আবির আবারো কর্কশ কন্ঠে বলল,,
“কী হলো বলছেন না কেন?
“আসলে আমার বাড়ি নেই
“কীহ!!!!
“হুম আমার বাড়ি নেই তাই শহুরে যাচ্ছিলাম নিজের মা বাবাকে খুজতে।
অনু কী বলছে কিছুই মাথায় ঢুকছেনা আবিরের। তাতে তার কী?তবুও কর্তব্যের খাতিরে একবার বলল,
“আপনি যদি চান তাহলে আমি আপনাকে শহরে পৌছে দিতে পারি।
#চলবে,