#কুঁড়েঘর
#লেখিকা–মার্জিয়া রহমান হিমা
[ দ্বিতীয় পরিচ্ছদ ]
। পর্ব ১৮+১৯।
রিধিশা মুখ বাকিয়ে বললো
” আপনি তো ধোয়া তুলসী পাতা তাই না? আমি বজ্জাত হলে আমার কাছে এসেছেন কেনো?” নিশাদ গম্ভীর গলায় বললো
” হেয়ালি না করে সারাদিন কোথায় ছিলে সেটা বলো।” রিধিশা শান্ত গলায় বললো
” পারসোনাল কাজে গিয়েছিলাম তারপর টিউশনি ফিরেছি। কিন্তু আপনি এতো কিছু জিজ্ঞেস করছেন কেনো?” নিশাদ ভ্রু কুঁচকে বললো
” তোমার এমন কি পারসোনাল কাজ যে আমাকে ৩ঘন্টা অপেক্ষা করিয়ে রেখেছিলে তুমি?” রিধিশা অবাক হয়ে নিশাদের দিকে তাকিয়ে বললো
” ৩ঘন্টা! আপনাকে কখন অপেক্ষা করালাম আমি?আপনি আমার জন্য ৩ঘন্টা অপেক্ষা করেছিলেন কেনো?”
নিশাদ গম্ভীর গলায় বললো
” কাজ ছিলো তাই কিন্তু সেই ব্যাপারে কথা বলতে এখন আর ইন্টারেস্ট নই আমি। কিন্তু তোমার পারসোনাল কাজটা কি?”
” পারসোনাল অর্থ বোঝেন? পারসোনাল মানে একান্ত নিজের ব্যাপার। সেই ব্যাপারে আপনাক৩ বলবো কেনো আমি?” নিশাদ রিধিশার ঝুটি করা চুল গুলো হাতে পেঁচিয়ে টেনে ধরে ক্ষেপে বললো
” বলো বলছি নাহলে এখনই চুলগুলো ছিড়ে ফেলবো।” রিধিশা হা করে তাকিয়ে থাকে নিশাদের দিকে। নিশাদ রাগে ফুঁসছে। রিধিশা রেগে বললো
” বেয়াদব ছেলে একটা, আমার চুল ছাড়ুন বলছি! আমার থেকে দূড়ে থাকতে বলেছি না আপনাকে? রাস্তার মাঝে এসব দেখলে মানুষ কি বলবে ভেবেছেন?” নিশাদ রিধিশার চুল ছেড়ে দিয়ে বললো
” ছেড়ে দিলাম তবে ছাড় দেবো না বলে দিলাম। আমাকে ৩ঘন্টা অপেক্ষা করানোর জন্য তোমাকে শাস্তি দেবো আমি।”
রিধিশা ভেংচি দিয়ে এগিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়লো। নিশাদ মুখ ফুলিয়ে বাড়িতে ফিরে আসে।
রিধিশা পড়ায় মগ্ন হয়ে আছে। দিন দুনিয়া সব ভুলে বসে রয়েছে। খাওয়া শেষ করে একটু ঘুমাবে বলে ভেবেছিলো কিন্তু পড়া রেখে ঘুমের জন্য সায় দেয়নি।
পড়ার মাঝে ফোনের তীব্র রিংটোন কানে বাজতেই পড়ায় ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়। মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে মায়ের কল। রিধিশা রিসিভ করে কথা বললো। ভালো মন্দ কথা বলার কিছুক্ষণ পর তিনি বললেন
” ছেলের সাথে দেখা করেছিস? কেমন লাগলো?” রিধিশা নিসু স্বরে বললো
” তেমন খারাপ না। খারাপ লাগার মতো কিছু দেখতে পাইনি আপাতত।” লিমা বেগম অবাক গলায় বললো
” তাই নাকি? রিধিশার ছেলে পছন্দ হয়েছে? তোর বাবাকে খবরটা দিলে কতো খুশি হবে বলতো!” রিধিশা আলতো হাসলো। লিমা বেগম খুশি হয়ে বললো
” ঠিকাছে আমি জানাচ্ছি সবাইকে তারপর আবার কথা বলবো।” লিমা বেগম ফোন কেটে দিতেই রিধিশা দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়ল ফোনের দিকে তাকিয়ে।
বাবার এতোই যখন ইচ্ছে তখন আর না করতে চায় না রিধিশা। ছেলের মাঝেও এবার কোনো খুত পেলো না সে তাই না করার কথাটা মাথায় আসেনি। কাউকে ভালোবাসলে হয়তো কখনো বিয়েতে সম্মতি জানাতো না কিন্তু ব্যাপারটা তো তেমন নয়।
রিধিশা রাত ১২টা বাজে পড়া শেষ করে ঘুমিয়ে পড়লো।।
সকালটা নিত্য দিনের মতোই শুরু হয়। টিউশনি শেষ করে ভার্সিটিতে এসে ক্লাসে বসে থাকে রিধিশা। নিশাদকে আর তার বন্ধুদের কাউকে বটগাছের কাছে দেখেনি। হয়তো পরীক্ষা নেই আজকে। রিধিশার ভাবনার মাঝে জোতিও আসলো। জোতি এসেই রিধিশাকে চেপে ধরে জিজ্ঞেস করলো
” এই তুই কালকে কোথায় ছিলি বল! একটা কল তো দিয়েও খোঁজ নিলি না তুই।” রিধিশা হেসে বললো
” একেবারে চলে গিয়েছিলাম নাকি? কাজ ছিলো তাই
আর নেওয়া হয়নি। তোকে একটা কথা জানানোর ছিলো।”
” হ্যা বল। তোর কথা শোনার জন্যই তো অপেক্ষা করছিলাম। কি এমন মহান কাজ করেছেন আপনি কালকে?” রিধিশা আমতা আমতা করে বললো
” কালকে একজনের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম।
মানে বাবা একজনের সাথে বিয়ে ঠিক করেছে তাই দেখা করতে কফিশপে গিয়েছিলাম।” জোতি চোখ বড়বড় করে তাকালো। অতি বিস্ময়ের সাথে বললো
” তুই আমাকে না বলে ছেলের সাথে ডেটিং এ চলে গিয়েছিলি? ছি! ছি! ছি! তুই নাকি আবার আমার বেস্ট ফ্রেন্ড!” রিধিশা বিরক্ত গলায় বললো
” ধুর কিসের ডেটিং? পুরো কথা না শুনেই ঢং করছিস!” জোতি দাঁত কেলিয়ে বললো
” আচ্ছা বল বল।” রিধিশা কালকের কথা সব বললো।
জোতি সব শুনে বললো
” তার মানে তুই বিয়েতেও রাজি? আমাকে বললি না আগে?”
রিধিশা ইনোসেন্ট ফেস বানিয়ে বললো
” সরি, দোস্ত রাগ করিস না প্লিজ!” জোতি রেগে বললো
” একদিন তো বিয়ে করে বাচ্চা নিয়ে আমার সামনে এসে বলবি দোস্ত রাগ করিস না প্লিজ! সময়ের জন্য তোকে বলতে পারিনি। ছি! ছি! তুই তো বান্ধবী নামে কলঙ্ক।” রিধিশা জোতির রাগ ভাঙাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
____________
নিশাদ এদিকে ব্যাংকে একটা কাজ করছে। ব্যাংকে একটু ঝামেলা হয়েছে তাই সকালেই নিশাদের বাবার জরুরী ফোন এসেছে। পরীক্ষা নেই তাই তাড়াও ছিলো না।
” বাবা সব ঠিক করে এসেছে এবার আর কোনো সমস্যা হবে না।” নিশাদের বাবা হেসে বললো
” তা তো জানি। তুই কোনো কাজে হাত দিলে ঝামেলা তো থাকবেই না।” নিশাদ আলতো হাসলো। নিশাদের বাবা বললো
” তুই বাড়িতে কবে আসবি? এতো বছর হলো একবারও গ্রামে আসলি না। আমিই তোকে গিয়ে দেখে আসি বারবার।” নিশাদ হেসে বললো
” এবার আসবো বাবা নিশ্চিন্তে থাকো। তোমার ঔষধ গুলো ঠিক মতো খেয়ো।” নিশাদ কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন কেটে দেয়।
ফ্ল্যাটে এসে বিছানায় লম্বা হয়ে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লো।
কিছুক্ষণ শুয়ে থাকার পরই কানে হাসাহাসির শব্দ আসতেই নিশাদ চোখ খুলে পাশে তাকিয়ে দেখে তার গুনোধর তিন বন্ধু তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। নিশাদ উঠে বসে ভ্রু কুঁচকে বললো
” এতো দাঁত কেলানোর কারণ কি তোদের? কার বিয়ে লাগছে?” সাদি নিশাদের পাশে বসে বললো
” বন্ধু সত্যি বলছি। আমরা ভেবেছিলাম তুই রিধিশাকে
ভালোবাসিস তাই পেছনে লেগে থাকিস। তোর জ্বালানোটা কে আমরা অন্যভাবে নিতাম কিন্তু এখন থেকে আর নেবো না। এখন সব ক্লিয়ার হয়ে গিয়েছে।” নিশাদ বিরক্ত গলায় বললো
” কি ক্লিয়ার হয়েছে তোদের? আবার কি উল্টা পাল্টা শুনে ক্লিয়ার ক্লিয়ার বলছিস সেটা বল।”
সূর্য খুশি গলায় বললো
” আরে তেমন কিছু না। রিধিশার তো বিয়ে ঠিক করা তার মানে তো তোর আর রিধিশার মাঝে কিছু নেই সেটাই ক্লিয়ার হয়েছে আর কি! যদিও রিলেশন থাকলেও আমরা খুশি কিন্তু এখানে তো অন্য হিসাব তাই আর ভুল বোঝাবুঝির চান্স নেই।”
নিশাদ চমকে বললো
” তোদের এসব কে বলেছে?” রেহান নিজের কলার টেনে হেসে বললো
” আমি ব্রো! জোতির সঙ্গে কথা বলার সময় হঠাৎ বলছিলো আর কি তখন কনফার্ম হলাম।” নিশাদ চুপচাপ বসে রইলো। সূর্যরা নিশাদের এক্সপ্রেশন খেয়াল না করেই চলে গেলো।
নিশাদ নিজের চুল টানতে থাকে। বিরবির করে বললো
” রিধিশার বিয়ে ঠিক হয়েছে? কবে, কখন?এতোদিনে এসব কিছুই জানতে পারিনি আমি। ” নিশাদের ভেতরটা অজান্তেই অস্থির হয়ে উঠে। অস্থিরতার কারণ খোঁজার চেষ্টা করলো না নিশাদ।
অস্থিরতা নিয়ে দুপুর পর্যন্ত কেটে গেলো নিশাদের।
বিকেলের দিকে কালো মেঘের আনাগোনা দেখা যায় আকাশে। কিছু মুহূর্ত পর ঝিরঝির বৃষ্টি শুরু হয়। নিশার বাইরে বের হচ্ছিলো কিন্তু বৃষ্টি দেঝে বিল্ডিং এর নিচে দাঁড়িয়ে রইলো। এখানে বৃষ্টি পড়ছে না। সিগারেট জ্বালিয়ে ধোয়া ছাড়তে থাকে। দূর থেকে রিধিশার মতো কাউকে দেখতে পায়।
কিন্তু নিশাদের মাঝে ভাবান্তর এলো না। রিধিশা তো এখন আসে না বাসায় তাই ভাবলো অন্যকেউ হবে। কিন্তু ব্যাক্তিটা কাছাকাছি আসতেই বুঝতে পারলো এটা রিধিশাই। নিশাদ ধীর পায়ে বৃষ্টির মাঝেই রিধিশার দিকে এগিয়ে গেলো। রিধিশার পথ আগলে দাঁড়ায়। রিধিশার মাথার উপর ছাতা রয়েছে তাই রিধিশা ভিজছে না। রিধিশা শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো
” বৃষ্টিতে ভিজছেন যে?” নিশাদ আরো এক পা এগিয়ে গম্ভীর গলায় বললো
” আমার ইচ্ছে তোমার কি?”
” আমার কি হবে। আপনার যা ইচ্ছে করুন আপনি। আমার পথ ছাড়ুন তাহলেই হবে।”
নিশাদ সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো
” তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছে কার সাথে?” রিধিশা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় নিশাদের কথায়। সাথে কিছুটা অবাক গলায় বললো
” আপনি কি করে জানেন আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে?”
” সেটা জেনে তোমার কাজ কি? আমি যেই প্রশ্ন করেছি সেটার উত্তর দাও।” রিধিশা কিছুটা বিরক্তের সঙ্গে বললো
” যার সাথেই হোক আপনি কি পৃথিবীর সবাইকে চেনেন নাকি যে বললেই চিনতে পারবেন?” নিশাদ গম্ভীর গলায় বললো
” তোমার বিয়ে ঠিক করা আমাকে আগে কেনো বলোনি তুমি?”
রিধিশা তাচ্ছিল্য হেসে বললো
“এমন ভাবে বলছেন যেনো কতোকালের আপন মানুষ আপনি আমার! তাছাড়া ঠিকই তো হলো কাল। আর আমাদের মাঝে এমন কোনো সম্পর্ক নেই যে আপনাকে আমার পারসোনাল লাইফের সব কিছু বলবো।” নিশাদ কিড়মিড় করে তাকালো।
রিধিশা পাশ কাটিয়ে চলে আসতে গিয়েও আবার নিশাদের সামনে গিয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে বললো
” আচ্ছা আপনি এসব প্রশ্ন করছেন কেনো? আপনি কি কোনোভাবে…”
রিধিশার অর্ধেক কথাতেই থামিয়ে নিশাদ ক্ষিপ্ত গলায় বললো
” চুপ, বেয়াদব মেয়ে! আমার রুচি এতো খারাপ হয়নি যে তোমার মতো ঝগড়ুটে আর বজ্জাত মেয়েকে ভালোবাসতে যাবো আমি। এতোদিন ধরে ঝগড়া করছি, জানি না তাই জিজ্ঞেস করেছি। কারো উপকার করতে নেই, হুহ!” নিশাদ হনহন পায়ে বিল্ডিং এর ভেতর চলে গেলো।
রিধিশা বোকার মতো নিশাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। বিরবির করে বললো
” কি উপকার করলো এখন আমার? এমন ভাবে বললো যেনো ঝগড়া করাটা কোনো বন্ধুত্বের বা ভালো কাজের তালিকায় পড়ে।” রিধিশা বিরবির করতে করতে বাসায় চলে গেলো।
চলবে……..
#কুঁড়েঘর
#লেখিকা–মার্জিয়া রহমান হিমা
[ দ্বিতীয় পরিচ্ছদ ]
। পর্ব ১৯ ।
রাতের অন্ধকারে ব্যালকনিতে পা ছড়িয়ে বসে আছে নিশাদ। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট মাঝে মাঝে টানছে সেটা। ছয় তলা ব্যালকনি থেকে অপর পাশের বিল্ডিং
এর দু তলা ফ্ল্যাট টা ভালোই দেখা যাচ্ছে। নিশাদের চোখ জোড়া সেদিকেই রয়েছে। বন্ধ জানলা ছাড়া কিছুই দেখতে পারছে না। তবে ভেতরে লাইট জ্বলছে সেটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
সেই সকাল থেকে এখন পর্যন্ত অস্থিরতায় সময় কাটছে নিশাদের। কোনোভাবেই শান্তি পাচ্ছে না।
সন্ধ্যার পর থেকে ২প্যাকেট সিগারেট প্রায় শেষ করতে চলছে। এক বেলা না খেলে মাথা ঘুরে অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকে আর এখন যেনো খাওয়া হারাম হয়ে গিয়েছে। রাতের খাবার খায়নি দেখে সূর্যরা বারবার দরজা নক করে গিয়েছে কিন্তু নিশাদ দরজা খুলেনি একবারের জন্যও। দরজা খুললেই হাজারটা প্রশ্নের মুখোমুখি হবে।
নিশাদ বিরক্ত হয়ে উঠে রুমে এসে পড়লো। বিছানায় বসে ব্যালকনির দিকে তাকিয়ে থাকে
” রিধিশার বিয়ের কথা শোনার পর থেকে এমন লাগছে কেনো আমার? অসহ্য লাগছে সব কিছু। রিধিশার বিয়ে করার কি দরকার? কেনো বিয়ে করবে এই মেয়ে? বেশি বিয়ে করার শখ উঠেছে না! ওর বিয়েও আমি ভেঙ্গে ছাড়বো। ভালো লাগছে না কিছু।”
নিশাদ একা একা বিড়বিড় করতে করতে হঠাৎ চুপ করে যায়।
” আচ্ছা আমি কি সত্যি রিধিশাকে ভালোবেসে ফেলেছি? নাহ, কিভাবে সম্ভব? আমি তো জাস্ট একটু জ্বালাই ওকে, আর তো কিছু না। নাহ ওকে একদমই ভালোবাসি না আমি।” নিশাদ এসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে।
এতো রাতে সাজেদা বেগম আর হেনা দুজন মিলে রিধিশাকে ধরে বসিয়ে রেখেছে তাদের ড্রইংরুমের সোফায়। যেনো আটঘাট বেধে নেমেছে তাও এই রাতে। সাজেদা বেগমের বোনের ছেলের বিয়ে তাই পুরো পরিবার বিয়ে বাড়িতে যাবে। সেই জন্য শপিং করে এনেছে সবার জন্য। আর সেগুলোই এখন রিধিশাকে বসে বসে দেখাচ্ছে কারণ এরপর আর সময় পাবে না। দুজনের ভালোই ভাব জমেছে রিধিশার সঙ্গে। সব কিছু দেখাতে দেখাতে আরো সময় চলে যায়। রিধিশা রাত সাড়ে ১২টায় রুমে এসে শ্বাস ছাড়ে।
ঘুমানোর আগে মোবাইল চালু করে দেখে একটা নাম্বার থেকে অনেক গুলো মিসডকল এসেছে আরো আগে। রাত হওয়ায় রিধিশা এতো না ভেবে ঘুমিয়ে পড়লো।
.
সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিশাদ রুম থেকে বেরিয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতে থাকে
” বুয়া খিধে পেয়েছে নাস্তা দাও তাড়াতাড়ি।”
নিশাদের গলা শুনেই পাশের রুম থেকে রেহান বেরিয়ে এসে কোমড়ে হাত রেখে রাগি গলায় বললো
” এই তোর কালকে কি হয়েছিলো বল তো! ভূতে টূতে ধরছে? দরজা বন্ধ করে আর খুললি না আর না রাতে খেলি আর এই সকাল ৭টা বাজে তোর নাস্তা লাগবে?”
নিশাদ বিরক্তকর চেহারা বানিয়ে কিচেনে গিয়ে কফির জন্য দুধ বসিয়ে আসলো। এসে আবার ফ্রিজ খুলে দেখতে থাকে কিছু আছে কিনা। রেহান চেঁচাতে চেঁচাতে নিশাদের রুমে গিয়ে একবার চক্কর দিয়ে আসলো। এসে আরো চেঁচাতে থাকে
” তুই এত্তো গুলা সিগারেট খাইছিস? তোরে সত্যি ভূতে ধরছে। সূর্য! সূর্য, সাদি! তাড়াতাড়ি উঠ।”
নিশাদ রেগে ধমকে উঠলো
” চুপচাপ গিয়ে ঘুমা। সকাল না হতেই কানের মাথা খাচ্ছে। তোকে দেখে মনে হচ্ছে তুই ঘরের বউ হয়ে ছেলের চেঁচামেচি করছিস। পাগল যা গিয়ে ঘুমা।”
রেহান মুখ লটকিয়ে সূর্যকে ডাকতে গেলো।
নিশাদ ফ্রিজে আপেল আর পিৎজা দেখে বের করে। পিৎজা ওভেনে গরম করে নিয়ে এসে কফি, পিৎজা আর আপেল খেতে থাকে। আপাতত খিধে মেটাতে হবে।
এরমাঝে সূর্য আর সাদি ট্রেনের গতিতে রেহানের সাথে নিশাদের রুমে ঢুকে গেলো। নিশাদ বসে বসে ওদের দেখতে থাকে। সূর্য রুম থেকে বেরিয়ে এসে চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে থাকে। সাদি নিশাদকে পিৎজা খেতে দেখে বললো
” আরে এটা কালকের পিৎজা। তুই তো সকালে এসব খাস না। পিৎজা খাচ্ছিস কেনো? একটু পড়ে তো বুয়া আসবেই।”
নিশাদ কথা না বলে খেতে ব্যস্ত। সূর্য নিশাদের সামনে বসে অবাক গলায় বললো
” আচ্ছা তুই সত্যি সত্যি রিধিশাকে ভালোবাসিস তাই না? এই জন্যই কালকে থেকে এমন ছ্যাকা খোঁড়ের মতো বিহেভিয়ার করছিস?”
নিশাদ খাওয়া বাদ দিয়ে সূর্যর দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকায়। রেহান আমতা আমতা করে বললো
” আমারও তাই মনে হচ্ছে এখন। নিশাদ রিধিশার সাথে কথা বলবো?” নিশাদ খেতে খেতে গম্ভীর গলায় বললো
” নিজেদের কাজে মন দে। কতোবার বলবো এসব ভালোবাসা বাসি করি না আমি? আমারটা আমি দেখে নেবো যা।” সূর্য, সাদি, রেহান একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করে। এই ছেলে সহজে বুঝবেও না আর বুঝলেও স্বীকার করবে না ভালোবাসার কথা।
.
টিউশনি পড়িয়ে আবার বাসায় আসে রিধিশা। নাস্তা খাওয়া শেষ করতেই গতকালকের সেই নাম্বার থেকে ফোন আসলো। রিধিশা রিসিভ করে কানে ধরে
” আসসালাম ওয়ালাইকুম।” ছেলের গলা শুনে রিধিশা কিছুটা অবাক স্বরে বললো
” ওয়ালাইকুম আসসালাম। কে আপনি ?” ফোনের অপর পাশ থেকে হাসির আওয়াজ আসে। রিধিশা কিছু বলার আগেই বললো
” আমি মাহিন শেখ।”
রিধিশা কিছুক্ষণ তব্দা খেয়ে বসে থাকে।
” মানে আপনি? আ..আপনি আমার নাম্বার কোথায় পেলেন?”
” এখনও কি নাম্বার পাওয়া কঠিন ব্যাপার নাকি? কিন্তু আপনি কিন্তু আমায় হতাশ করলেন। আমি ভেবেছিলাম আমার গলা শুনেই চিনে ফেলবেন। এখন তো মনে হচ্ছে আমাকেই ভুলে গিয়েছেন।”
রিধিশা ঠোঁট কামড়ে ধরে।
মাহিনের কথা একদমই তার মাথায় ছিলো না। রিধিশা আমতা আমতা করে বললো
” না তেমন কিছু নয়। আপনি কল করবেন এরকম কিছু ভাবিনি তাই আর কি গেস করতে পারিনি। কেমন আছেন?”
” আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি কেমন আছেন? কালকে রাতে কয়েকবার কল করেছিলাম ধরেননি। আমি ভাবলাম ঘুমিয়ে পড়েছেন তাই আর পড়ে কল করিনি।” রিধিশা মাথা চুলকে কি বলবে ভাবতে থাকে।
” রাতের জন্য সরি। আসলে ফোন সাইলেন্ট ছিলো তাই দেখিনি।”
” ইটস ওকে। তো আপনার কাছে কি এই অদমের জন্য কিছুটা সময় পাওয়া যাবে? মানে হালকা দেখা সাক্ষাৎ করার জন্য।”
” এখন ভার্সিটিতে যাচ্ছি এরপর আর সময় নেই।”
” ভার্সিটির ব্রেক টাইম?” রিধিশা কপাল চাপড়ে জোড়পূর্বক হেসে বললো
” জি ব্রেক টাইমে ফ্রি থাকবো।” মাহিন হেসে বললো
” থ্যাংক ইউ ম্যাডাম। আপনার ভার্সিটির আশেপাশে কোনো রেস্টুরেন্ট বা কফিশপে অপেক্ষা করবো। আপনি চাইলে আপনার ফ্রেন্ডদের নিয়ে আসতে পারেন।” রিধিশা হেসে বললো
” অবশ্যই। আমার ফ্রেন্ড তো আপনার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে।”
” তাহলে তো দেখা করতেই হয়। ঠিকাছে আর সময় নষ্ট করবো না আপনার। সুস্থ থাকবেন রাখছি।”
ফোন কাটতেই রিধিশা হাফ ছাড়ল। তৈরি হয়ে ভার্সিটির জন্য বেরিয়ে পড়ে।
.
ভার্সিটির একদম ক্লাস শুরু সেই মুহূর্তে রিধিশা ভার্সিটিতে আসে। গিয়ে জোতির পাশে বসে পড়ে। জোতি ফিসফিস করে বললো
” এতো দেড়ি করলি কেনো?” রিধিশা বই বের করতে করতে বলে
” বাসায় গিয়েছিলাম আবার তাই দেড়ি হয়েছে।”
নিশাদ এর পরীক্ষা শেষ। আজকে থেকে আবার ক্লাস করছে। মিলি কয়েকদিন স্পেস রেখে থাকলেও আবার আগের মতো বিহেভ শুরু করেছে। আসতে যেতে নিশাদের গা ঘেঁষে চলা, নিশাদকে বেবি বলে ডাকা। নিশাদের ইচ্ছে করে কানে তুলো গুঁজে রাখতে কিন্তু পারে না। অনেক কষ্টে রাগ কন্ট্রোল করে রাখে।
ব্রেক টাইমে বট গাছের নিচে গিয়ে বসতেই মিলি নিশাদের বাইকে হেলান দিয়ে বসে বললো
” নিশু আজকে লং ড্রাইভে নিয়ে যাবে আমাকে?” নিশাদ মুখ কুঁচকে বললো
” কেনো? তুমি তো প্রতিদিনই যাও। আজকে আবার আমার সাথে কেনো?” মিলি লজ্জাবতীর মতো হাসি দিয়ে বললো
” তুমি আর বাকিরা কি এক নাকি? ফ্রেন্ডদের সাথে আর তোমার সাথে যাওয়া দুতো আলাদা ফিলিংস। আজকে রাতে আমি তৈরি থাকবো তুমি আসলে আমরা দুজন লং ড্রাইভে বেরিয়ে যাবো। কি বলো!”
নিশাদ শান্ত গলায় বললো
” আমি কি বলবো? সব তো তুমিই ঠিক করে দিচ্ছো।”
রেহান মিলির পাশে দাঁড়িয়ে বললো
” মিলি! বলছিলাম তাড়াতাড়ি বিয়েটা করে ফেলো। আজকে শুনেছিলাম তুমি নাকি ডক্টর দেখিয়েছো তোমার স্কিনের প্রবলেমের জন্য? বেশি দেড়ি করে বিয়ে করলে তো পড়ে এতো মেকাপ করো সে জন্য স্কিনটাই একদম ডেমেজ হয়ে যাবে তখন কেউ পছন্দ করবে না তোমাকে। তার চেয়ে ভালো এখনই বিয়ে করে ফেলো।” সাদি, সূর্য, নিশাদ মুখ টিপে হাসলো।
মিলি আমতা আমতা করে বললো
” না না তুমি শুনেছো স্কিন প্রবেলেমের জন্য যাইনি। every week স্কিন ডক্টর দেখাই। আমি তো স্কিন নিয়ে প্রচুর sensitive তাই আর কি। আমি স্কিনে কোনো প্রবলেম হয়নি।” সাদি বললো
” ওওও আচ্ছা!” মিলি হেসে বললো
” আচ্ছা আমি একটু আসছি।” মিলি দৌঁড়ে তার ফ্রেন্ডের কাছে চলে গেলো।
সূর্যরা জোড়ে হেসে উঠে।
.
হাসতে হাসতে রিধিশাদের দিকে চোখ যায় নিশাদের। দুজন কথা বলতে বলতে গেটের বাইরে বেরিয়ে গেলো। নিশাদ সূর্যদের কাছ থেকে সরে আসে। সূর্যকে একটু আসছি বলে দ্রুত এগিয়ে রিধিশাদের পেছন পেছন যেতে থাকে।
রিধিশারা ভার্সিটির কিছুটা সামনের কফিশপে ঢুকে পড়ে। নিশাদও মাস্ক পড়ে ঢুকলো।
রিধিশা মাহিনকে দেখে সেইদিকে এগিয়ে যায়। মাহিন দুজনকে দেখে উঠে দাঁড়ায়। জোতি মাহিনকে দেখে অবাক গলায় বললো
” কি করে রিধু? আংকেল এতো ভালো কি করে হয়ে গেলো? আগেরবার পঞ্চাশ বছরের বুড়োর সাথে ঠিক করেছিলো কিন্তু এই ছেলে তো একদম আগুন। তোর সাথে দারুণ মানাবে।” রিধিশা দাঁতে দাঁত চেপে বললো
” চুপ কর বদ মেয়ে। বাসায় গিয়ে কথা বলবি।”
জোতি আর রিধিশা গিয়ে বসে পড়ে। রিধিশা দুজনকে পরিচয় করিয়ে দেয়। মাহিন জোতির দিকে তাকিয়ে হেসে বললো
” আপনিও দেখি আপনার বান্ধবীর মতো সুন্দরী।”
” কেনো ভাইয়া আপনার কালো বউ চাই নাকি? নাকি আমাকে কালো ভেবেছিলেন?” মাহিন হেসে বললো
” আমি তো কিছুই ভাবিনি। বউ যেমনই হোক ভালো মনের মানুষ হলেই চলবে আমার। যেমন আপনার বান্ধবী!” রিধিশা মাথা নিচু করে আলতো হাসলো। মাহিন হেসে বললো
” এতো ব্যস্ততার মাঝে আমার সাথে দেখা করার জন্য ধন্যবাদ ম্যাডাম।” রিধিশা আলতো হেসে বললো
” আমার থেকে তো আপনি বেশি ব্যস্ত মানুষ বলে মনে হয় আমার।”
” তা তো অবশ্যই তবে আপন মানুষদের সাথে একটু সময় কাটানোর জন্য আমি সব কাজ ছেড়ে দিতে প্রস্তুত।”
জোতি খুশিতে গদগদ হয়ে বললো
” হায়! ভাইয়া আমার আপনাকে খুবই পছন্দ হয়েছে। আপনি একদম পারফেক্ট।” মাহিন ঠাট্টার সঙ্গে হেসে বললো
” আমি কিন্তু বউ ঠিক করে ফেলেছি এখন এসব বললে লাভ হবে না। তোমার বান্ধবীর আগে বললে
ভেবে দেখতাম।”
জোতি দাঁত কেলিয়ে বললো
” আমারও বয়ফ্রেন্ড আছে নাহলে আমি সত্যি সত্যি ট্রায় মারতাম একটা।” মাহিন জোতির কথায় হেসে দেয়।
তিনজনের এই হাসি মজা দেখছে নিশাদ। কোল্ড কফি খাচ্ছে আর গালে হাত দিয়ে দুজনকে বেশি পর্যবেক্ষণ করছে। কোল্ড কফি আপাতত মাথা ঠান্ডা রাখার জন্য। মাহিনকে খুব ভালো করে দেখছে। সত্যি দেখতে যথেষ্ট সুদর্শন একজন যুবক। নিশাদের থেকে কোনো দিক থেকে কম নয়। হাইটে এক দু ইঞ্চি কম হতে পারে এই আরকি। দূড়ে বসে আর কোনো কমতি
খুঁজে পেলো না নিশাদ।
জোতি আর মাহিন কথার ঝুড়ি খুলে বসেছে মাঝে মাঝে রিধিশা একটা দুটো কথা বলছে। দেখে বোঝা যাচ্ছে এখনও ফ্রি হতে পারেনি ছেলেটার সাথে।
চলেব………