কুঁড়েঘর পর্ব-৩২+৩৩

0
388

#কুঁড়েঘর
#লেখিকা–মার্জিয়া রহমান হিমা
[ দ্বিতীয় পরিচ্ছদ ]
। পর্ব ৩২।

রিধিশা স্নেহাকে পড়ানো শেষ করে বের হতেই দেখে নিশাদ নিজের ফ্ল্যাটের সামনেই কোমড়ে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে। দুটো ফ্ল্যাটে মুখোমুখি দরজায় রিধিশা লিফটে যেতে গেলেও নিশাদ ধতে ফেলবে। রিধিশা ঢোক গিলে এক পা দুই পা করে এগিয়ে যায়। নিশাদ গা জ্বালানো হাসি দিয়ে বললো
” আমাকে নাকি ভয় পাও না? তাহলে বিড়ালের মতো আসছো কেনো? যাও আমার সামনে দিয়ে যাও!” রিধিশার মুহূর্তেই নিজেকে মাছের মাথা আর নিশাদকে দানব বিড়াল মনে হলো। বিড়ালটা মাছের মাথাটা খেয়ে ফেলে এখনই। রিধিশা কেশে বললো
” এভাবে দাঁড়িয়ে আছেন কেনো? দারোয়ানের চাকরি করেন নাকি?”

নিশাদ দাঁত কেলিয়ে বললো
” নিজের ঘরের সামনে দারোয়ান হলেও সমস্যা নেই।” রিধিশা ধীরেধীরে কয়েক পা এগিয়ে আসতেই আসতে শুধু নিশাদের হাসিটার দিকে তাকিয়ে থাকে। রিধিশা হঠাৎ বললো
” আরে মিলি আপি আপনি এখানে?” নিশার চমকে নিজের পেছনে তাকায়। রিধিশা হেসে দৌঁড়ে চলে যায়। নিশাদ কপাল চাপড়ে বললো
” বোকা বানিয়ে দিলো মেয়েটা? আমার ঘরে মিলি কিভাবে আসবে? ধুর!” নিশাদ ফ্ল্যাটের দরজা ঠাস করে বন্ধ করে দিলো।

রিধিশা এড্রেস এর মাধমে ইন্টার্ভিউ এর উদ্দেশ্যে অফিস খুঁজছে। এদিকে অফিসের বিল্ডিং অনেক গুলো হওয়ায় বুঝতে পারছে না। একটা অফিসের গেট দিয়ে কয়েকজনকে ঢুকতে দেখে এগিয়ে এসে দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করলো
” এখানে কি ইন্টার্ভিউ নেওয়া হচ্ছে?” দারোয়ান সায় জানিয়ে বললো
” হ্যা পাঁচ তলার রাইট সাইডে ইন্টার্ভিউ হচ্ছে।” রিধিশা বিল্ডিং এর দিকে তাকালো। এতোবড় অফিসে কি তার ইন্টারের সার্টিফিকেটে চাকরি পাবে? ভাবতে ভাবতে রিধিশা নিশ্বাস ফেলে ঢুকে পড়লো ভেতরে। লিফটে ঢুকে পাঁচতলা বিল্ডিং এ চলে গেলো

রিধিশা অনেকক্ষণ বসে থাকার পর তার নাম ডাকা হয়। রিধিশা নার্ভাসনেস নিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে। ইন্টার্ভিউ শেষ হতেই একজন বললো
” আপনার চাকরিটা হয়েছে তবে বাকিটা আমাদের ম্যানেজারের সাথে কথা বলে বুঝে নিতে হবে আপনার।”

রিধিশা হাসিমুখে ম্যানেজারের সঙ্গে বেরিয়ে গেলো।
ম্যানেজার কেবিনে নিয়ে একটা কাগজ দিয়ে বললো
” আপনার পড়াশোনার অভিজ্ঞতা অনুযায়ী আপনার পোস্ট এই কোম্পানির নতুন শাখায় হয়েছে। এড্রেস দেওয়া হবে এবং পার্ট টাইম জব হওয়ায় বেতব ১২ হাজার। দুপুর ১টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত। আপনি চাইলে আগামীকাল থেকে জয়েন করতে পারবেন।”
রিধিশা আলতো হেসে বললো
“ধন্যবাদ আমি কালকেই জয়েন করতে চাই।” ম্যানেজার রিধিশাকে অফিসে এড্রেস দিয়ে দেয়।

রিধিশা খুশিতে নাচতে নাচতে বেরিয়ে যায় অফিস থেকে। রিধিশা হাটতে হাটতে বললো
” এখন টিউশনি গুলো না করে দিলেই হবে। তবে স্নেহা আর তারা’কে পড়িয়ে তারপর ভার্সিটি থেকে সেখানে চলে যাবো। উফফ যে কি ভালো লাগছে না! প্রথমবার ইন্টার্ভিউ দিতে দিতেই চাকরি হয়ে গেলো এখন আম্মুকে আর ভাইয়াকে জানাবো।”
রিধিশা টিউশনিতে পড়িয়ে তাদের চাকরির কথা বলে আর আসতে পারবে না বলে আসে।
রাতে বাসায় ফোন করে চাকরির কথা জানায়। হৃদকে জানানোর পর হৃদও খুশি হয় চাকরির কথা শুনে।

.
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে নামায শেষ করে স্নেহাকে পড়ানোর জন্য বেরিয়ে গেলো। বিল্ডিং এর ভেতর ঢুকতেই দেখলো নিশাদও তার সাথে ঢুকছে। রিধিশা থেমে নিশাদের দিকে তাকালো। নিশাদ মেকি হাসি দিয়ে বললো
” এখন তোমাকে কে বাঁচাবে রিধিশা ম্যাডাম?” রিধিশা ঢোক গিলে এদিক সেদিক তাকালো। নিশাদ হেসে বললো
” আজকে কোনো মিলি ফিলি নেই তোমাকে বাঁচাবে বলে।” রিধিশা শক্ত হয়ে পা চালিয়ে লিফটে ঢুকে গেলো। নিশাদও সাথে ঢুকে গেলো সাথে। রিধিশা এক কোণায় দাঁড়িয়ে বারবার নিশাদের দিকে কোণা চোখে তাকাচ্ছে। নিশাদ জ্যাকেট থেকে হাত দুটো বের করে রিধিশার দিকে এগিয়ে আসে। রিধিশা ভয় পেয়ে লিফটের সাথে লেগে যায়। নিশাদ দুই পাশে ঘাড় বাঁকিয়ে রিধিশার দিকে তাকায়।

লিফট খুলতেই রিধিশা ঢোক গিলে চেপে চেপে বেরিয়ে গেলো। নিশাদও ঠোঁট চেপে হেসে বেরিয়ে গেলো। রিধিশা দ্রুত পায়ে চলে যেতে নিলেই নিশাদ হাত ধরে আটকে দেয়। রিধিশা ভীতু গলায় বললো
” ছাড়ুন আমার হাত ছাড়ুন!” নিশাদ মুখ বাঁকিয়ে বললো
” কেনো এখন ছাড়বো কেনো? কালকে কি বলেছিলে আমায়?” রিধিশা কাঁদোকাঁদো গলায় বললো
” কি বলেছি? কিছু বলিনি সত্যি!”

নিশাদ চোখ রাঙ্গিয়ে বললো
” কি তারমানে তুমি বলতে চাইছো আমি ভুল শুনেছি? তুমি আমাকে বয়রা প্রমাণ করতে চাইছো!” রিধিশা হচকচিয়ে বললো
” না, না।”
” তারমানে তুমি আমাকে বলেছো বিষাদ বলেছো তাই তো!” রিধিশা করুণ দৃষ্টিতে তাকায়। নিশাদ মনে মনে হাসলো রিধিশার চেহারা দেখে। নিশাদ হাত ছেড়ে দিয়ে বললো
” যাও ছেড়ে দিলাম এখন। কিন্তু ভার্সিটিতে ছাড় পাবে না। দেখবে কি করি।” নিশাদ কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে চলে গেলো। রিধিশা সস্তির নিশ্বাস ফেলে স্নেহার বাসায় চলে গেলো।

.
ভার্সিটিতে এসে রিধিশা লুকিয়ে লুকিয়ে চলার চেষ্টা করছে। নিশাদের চোখে না পড়লেই বাঁচে সে। জোতি রেহানের সাথে কথা বলছে, একদম মোবাইলেই ঢুকে আছে। রিধিশা ইম্পরট্যান্ট ক্লাসগুলো করেই বেরিয়ে গেলো ভার্সিটি থেকে। নিশাদ আর তাকে পাবে না ভেবে খুশি হয়ে যায়। হাটার মাঝে হঠাৎ সামনে নিশাদ এসে দাঁড়ায়। রিধিশা ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে কয়েক পা পেছিয়ে যায়। নিশাদকে দেখে মুখ লটকিয়ে বললো
” আপনি এখানে কি করছেন?”

নিশাদ রাগি গলায় বললো
” তোমার জন্যই তো বসেছিলাম। কি ভেবেছো আমার হাত থেকে পালিয়ে যাবে? চলো আজকে তোমার একটা হাত না ভেঙ্গে ছাড়বো না।” নিশাদ রিধিশাকে টেনে লেকে নিয়ে গেলো। রিধিশা পারে না কেঁদে দিতে। নিশাদের হাতে লম্বা স্টিক দেখে মাথা ঘুরছে তার। নিশাদ রিধিশাকে দাঁড় করিয়ে স্টিকটা উঁচু করে বললো
” বলো কোন হাতটা ভাঙবো!”

রিধিশা কাঁদোকাঁদো গলায় বললো
” কোনো হাত না প্লিজ! আর বলবো না আপনাকে।”
” না বিশ্বাস করি না আমি। আজকে তোমাকে মারবোই দেখবে।” নিশাদ মারার জন্য হকি স্টিক উঠাতেই রিধিশা চোখ বন্ধ করে আম্মু বলে চেঁচিয়ে কেঁদে দিলো। নিশাদ মুখ চেপে হাসলো পরক্ষণেই ধমকে বললো
” এই মেয়ে তোমাকে মেরেছি আমি? চেঁচাচ্ছ কেনো?”
রিধিশা কাঁদতে কাঁদতে বললো
” মারবেন না আমাকে। সত্যি আর কোনো বিষাদ বলবো না আপনাকে দুই সত্যি। যা বলবেন তাই করবো।”

নিশাদ রাগি গলায় বললো
” দুই সত্যি মানে? আরেকটা সত্যি কোথায়? ঘুরতে গেছে নাকি? বলো তিন সত্যি! আর বলো নিশাদ অনেক ভালো ছেলে।” রিধিশা কাঁদতে কাঁদতে বলে
” নিশাদ বিষাদ নয়। নিশাদ অনেক ভালো ছেলে।” নিশাদ গম্ভীর গলায় বললো
” এবার তোমার অযথা কান্না বন্ধ করো আর যা বলবো তাই করবে।” রিধিশা চোখ মুছে নেয়।
” কালকে আমার বাসায় রান্না করে দিয়ে আসবে তুমি।”

রিধিশা ভ্রু কুঁচকে বললো
” কি! আপনার বাসায় গিয়ে রান্না করতে পারবো না আমি। আগেই বলেছি একদম আমাকে রান্নার কথা বলবেন না। আমি কি আপনার বুয়া নাকি? আর আপনার বুয়া তো এখন আছেই তাহলে আমি রাঁধবো কেনো?” নিশাদ হকি স্টিকটা উঠাতেই রিধিশা ঢোক গিলে পিছিয়ে যায়।
” একটু আগেই বললে আমি যা বলবো তাই করবে আর মিনিট না যেতেই কথার দাম ফুরিয়ে গেলো?”

” ফুরিয়ে গেলো মানে কি? এতো গুলো ছেলের বাসায় আমি রান্না করে দিয়ে আসবো? আমাকে পেয়েছেন কি আপনি?”
” আমি তোমার রান্না খাবো মানে খাবোই। দরকার পরলে তোমার বাসায় গিয়ে খেয়ে আসবো। নাহলে তুমি আমার বাসায় এসে রেঁধে দিয়ে যাবে।” রিধিশা চোখ বড় বড় করে বললো
” কি! একদম না আমার বাসায় আসা যাবে না। আমার মান-সম্মান চলে যাবে।” নিশাদ বুখ বাঁকিয়ে বললো
” এহ আসছে! এক বেলা খেলে ম্যাডামের মান-সম্মান চলে যাবে?”

রিধিশা শক্ত গলায় বললো
” আমি খাওয়ার কথা বলিনি। কমন সেন্স নেই আপনার? সাজেদা আন্টি দেখলে কি বলবে? আমি একা বাসায় থাকি এর মধ্যে একটা ছেলে বাসায় গেলে সবাই কটু দৃষ্টিতেই দেখবে।”
” ঠিকাছে বাবা যাচ্ছি না। তাহলে তুমি রান্না করেই দিয়ে যাবে কালকে। আর সকালে রেহানরা সবাই ঘুমিয়ে থাকে।”
” ঠিকাছে।” রিধিশা নাক ফুলিয়ে চলে গেলো। নিশাদ হাসতে হাসতে হকি স্টিকের দিকে তাকিয়ে বললো
” ভীতু মেয়ে! তোমাকে আমি মারতে যাবো কেনো?”

.
রিধিশাকে তার অফিসের দেওয়া এড্রেস খুঁজে রিধিশা ১টার আগেই অফিসে উপস্থিত হয়। অফিসের ম্যানেজার রিধিশাকে তার কেবিন দেখিয়ে দেয়। আর পাশের খালি কেবিন দেখিয়ে বললো
” যেকোনো সমস্যা হলে তুমি যার আন্ডারে কাজ করছো মানে আব্দুল্লাহ রয়েছে তাকে বলবে আর না হলে আমি রয়েছে।” রিধিশা মাথা নেড়ে। বিজয় স্যার হেসে চলে যায়। রিধিশা ফুরফুরে মুডে বসে কাজে লেগে পড়ে তার।

রিধিশা আগেই এসেছিলো তাই কয়েকজন রয়েছে। আর বাকিরা একে একে এখন আসছে মাত্র। হঠাৎ নিশাদের গলা শুনতে পেলো বলে মনে করে রিধিশা। কিন্তু অন্যকেউ ভেবে সেদিকে তাকায় না। রিধিশা কাজ করতে করতে পাশের কেবিনের দিকে চোখ যেতেই রিধিশা চমকে উঠে দাঁড়ায়। নিশাদও বোকার মতো তাকিয়ে আছে। বেচারা রিধিশাকে দেখে বুঝতে পারছে না রিধিশা কোথা থেকে এসেছে।
রিধিশা বিস্ময়ের সাথে বললো
” আপনি! আপনি এখানে কি করছেন?”

নিশাদ ভ্রু কুঁচকে বললো
” আমি কি করছি মানে কি? এক সপ্তাহ ধরে অফিসে কাজ করছি কখনো তোমাকে দেখলাম না। হঠাৎ তুমি এখানে কিভাবে উদয় হলে?” নিশার আর রিধিশার কথা শুনে বিজয় এগিয়ে এসে দুজনের উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করলো
” এনি প্রবলেম?” নিশাদ বিজয়কে জিজ্ঞেস করলো
” স্যার, ও এখানে কি করছে?” বিজয় হেসে উত্তর দেয় বললো
” নতুন জয়েন হয়েছে আজকে। আমাদের অফিসের আগের শাখা থেকে মিস. রিধিশার পোস্ট এখানে করা হয়েছে। আপনি কি চেনেন উনাকে?”

নিশাদ রিধিশার দিকে তাকিয়ে হেসে বললো
” জি স্যার খুব ভালো করে চিনি।”
” তাহলে তো ভালোই হলো। মিস. রিধিশা আপনার জুনিয়র। সমস্যা হলে তাকে হেল্প করবেন।” নিশাদ মাথা নেড়ে বললো
” হ্যা, হ্যা কেনো নয়!” বিজয় চলে যেতেই রিধিশা নাক মুখ ফুলিয়ে বসে পরে। আর নিশাদ বিশ্বজয়ের হাসি দিয়ে বললো
” আজকের দিনটা আমাকে জন্য খুব লাকি। রিধিশা ম্যাডাম দেখলেন তো! আমাদের ভাগ্য বারবার আমাদের এক জায়গায় নিয়ে আসে। উফফ! জুনিয়র বেবি কাজ করুন মন দিয়ে।”

রিধিশা ক্ষেপে বললো
” ওই কে বেবি? আমাকে দেখে বেবি মনে হয়? বজ্জাত ছেলে।” নিশাদ চোখ রাঙ্গিয়ে কাজে মন দেয়।

চলবে……….

#কুঁড়েঘর
#লেখিকা–মার্জিয়া রহমান হিমা
[ দ্বিতীয় পরিচ্ছদ ]
। পর্ব ৩৩ ।

নিশাদ কাজ করতে করতে রিধিশার দিকে তাকাচ্ছে বারবার। রিধিশাও আড়চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। কাজের মধ্যেই দুজন আজকের অফিস টাইম শেষ করে নেয়। অফিস ছুটি হতেই দুজন বেরিয়ে যায়। নিশাদ বাইক স্টার্ট দিতে দিতে রিধিশার দিকে তাকায়।
রিধিশা রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু খালি রিকশা রিধিশার চোখেই পরছে না। নিশাদ বাইক নিয়ে রিধিশার সামনে যায়। রিধিশা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। নিশাদ চোখে ইশারায় পেছন দেখিয়ে বলে উঠলো
” পেছনে বসো। এক জায়গায়ই তো যাবো চলো আমার সাথে। রিকশার জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা দাড়িয়ে থাকবে নাকি?”

রিধিশা শক্ত গলায় বললো
” থাকবো আপনার কি? আপনি আপনার মতো যান আমি আমার মতো যাবো। আপনার সাথে যাওয়া কোনো interest নেই আমার।”
নিশাদ গম্ভীর গলায় বললো
” তোমার সাথে যাওয়ার জন্য যেনো মরে যাচ্ছি আমি? এক জায়গায় যাচ্ছি তাই বলেছি নাহলে আমারও যার তার সাথে যাওয়ার কোনো Interest নেই, ওকে? এখন চুপচাপ উঠবে নাকি দুপুরের কাজটা আরেকবার রিপিট করত্র হবে?”

রিধিশা শুকনো ঢোক গিলে রাগি গলায় বললো
” ভয় দেখাচ্ছেন আমাকে আপনি?” নিশাদ হেসে বললো
” না একদমই না। সাবধান করছি সব দিক থেকে। রিকশা না পেয়ে গেলে বাসায় যাওয়ার পথে আবার কোনো বাজে ছেলের খপ্পরে পড়লে বুঝবে তোমার এতো জেদ ধরার মজা।”
রিধিশা চোখ মুখ কালো করে ফেলে। নিশাদ স্টার্ট দিতে দিতে আবারও বললো
” লাস্ট বার বলছি উঠবে নাকি চলে যাবো?”

রিধিশা নিশাদের বাইকে উঠে বসে। নিশাদ বাইক রাইড করতে করতে রিধিশাকে বললো
” ভালো করে ধরো আমাকে নাহলে রাস্তায় পড়লে মৃত্যু নিশ্চিত।” রিধিশা নিশাদকে না ধরে তার পেছনে বাইকের উঁচু জায়গাটা শক্তভাবে আকড়ে ধরে।
উঁচু নিচু রাস্তায় আসতেই রিধিশার পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। রিধিশা শক্ত করে বসে থাকতে চাইলেও পারছে না। ঢোক গিলে নিশাদের কাধ শক্ত করে ধরে
বসে। রিধিশা মনে মনে সরকারকে গালমন্দ করলো। রাস্তায় বেহাল দশা করে রেখেছে। কখন এক্সিডেন্ট হয়ে যায় ঠিক নেই।

বাসার সামনে বাইক থামাতেই নামতে নামতে দম ছেড়ে রিধিশা বললো
” আল্লাহ! এই রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন কি করে আসবো?”
” আজকে যেভাবে আসলে সেভাবেই আসতে হবে ম্যাডাম। সকালে রান্না করে দিতে হবে মনে রেখো কিন্তু!” রিধিশা থমথমে চেহারা বানিয়ে বললো
” পারবো না। রান্না করে দেওয়ার সময় নেই। ভার্সিটি আছে জানেন না?”

নিশাদ চোখ মুখ শক্ত করে বললো
” একদিন ভার্সিটিতে দেড়ি হলে কেউ খেয়ে ফেলবে না তোমাকে। তোমার ওই না হওয়া জামাইয়ের সঙ্গে যখম ভার্সিটি বন্ধ করে দেখা করতে চলে যেতে তখন ভার্সিটির চিন্তা কোথায় থাকতো? আমার সাথে চালাকি করতে আসবে না। যা বলছি তাই শুনবে।”
শব্দ করে বাইক চালিয়ে নিজেদের বিল্ডিং এ চলে যায় নিশাদ। রিধিশা হা করে তাকিয়ে বললো
” রাগার মতো কি বললাম আমি? উদ্ভট বজ্জাত ছেলে।” রিধিশা মুখ ফুলিয়ে বাসায় চলে আসে।

.
রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমানোতে রিধিশার আজকে অনেক আগেই ঘুম ভেঙ্গে যায়। এখনও আযান পড়েনি ফযরের তাই রিধিশা চা নাস্তা করে নেয়। আযানের জন্য কিছুক্ষণ বসে থাকার পর আযান পড়লেই নামায শেষ করে নেয়। তারপর স্নেহার বাসায় চলে আসে। স্নেহার বাসায় নক করতেই স্নেহার আম্মু দরজা খুলে দেয়। রিধিশা সালাম দিয়ে ভেতরর ঢুকতে নিলেই স্নেহার আম্মু বললো
” আরে রিধিশা স্নেহা তো নিশাদের বাসায়। তুমি নাকি নিশাদের থেকে কিসের নোটস কালেক্ট করবে! তাই স্নেহাকে নিয়ে গিয়েছে। স্নেহাকে পড়াতে পড়াতে তোমার কাজ সেরে নাও।”

রিধিশা জোড়পূর্বক হেসে বললো
” ওহহ ভুলেই গিয়েছিলাম আমি নোটস এর কথা। আচ্ছা আন্টি আমি যাচ্ছি।” স্নেহার আম্মু হেসে মাথা নাড়ায়। রিধিশা নিশাদের ফ্ল্যাটের কলিং বেল বাজায়। মুহূর্তেই দরজা খুলে দেয় নিশাদ। রিধিশা অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে নিশাদের উপর। নিশাদ হেসে বললো
” আরে আসো আসো রিধিশা। তোমার জন্যই আমরা বসে ছিলাম।” রিধিশা ঠাস করে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়।

দাঁত কিড়মিড় করে বললো
” আপনি জানেন আপনি কতো খারাপ? এসব করার মানে কি?” নিশাদ চোখ রাঙ্গিয়ে বললো
” একদম রাগ দেখাবে না কালকের কথা ভুলে গেলে এখনি? আমি ভালো করেই জানি তুমি অজুহাত দেবে তাই সেই উপায় রাখছি না আমি। চলো ভেতরে চলো।” রিধিশা নাক ফুলিয়ে নিশাদের সাথে যায়।
গিয়ে দেখে স্নেহা সোফায় বসে আছে তার বই নিয়ে। রিধিশাকে দেখে এক গাল হেসে বললো
” ম্যাডাম তোমার জন্য কখন থেকে বসে আছি। এতো দেড়ি করো কেনো?” রিধিশা হেসে বললো
” সরি, আর দেড়ি করবো না।” রিধিশা স্নেহাকে পড়া দিয়ে রান্না ঘরে চলে যায়।

প্রথমে নাস্তা তৈরি করে দেয় নিশাদকে তারপর দুপুরের জন্য রান্না করতে থাকে। নিশাদ কফি খেতে খেতে পকেটে এক হাত গুঁজে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রিধিশার কাজ দেখছে। রিধিশা এক মনে রান্নার কাজে ব্যস্ত হয়ে আছে। দেড় ঘন্টার মধ্যে কয়েক পদ রেঁধে রান্নার কাজ শেষ করে। নিশাদের কাছে গিয়ে বললো
” সব রান্না শেষ করে দিয়েছি। এবার আমি যাচ্ছি আমার লেট হয়ে যাচ্ছে।”
” এক মিনিট দাঁড়াও।” নিশাদ নিজের রুমে চলে যায়। রিধিশা স্নেহার বই গুছিয়ে দেয়। এর মধ্যে নিশাদ এসে রিধিশার হাতে একটা গিফট দিয়ে চোখ মেরে বললো
” ধরো এটা তোমার জন্য। তোমার নো….টস”

রিধিশা ভ্রু কুঁচকে নিশাদের দেওয়া গিফটের দিকে তাকিয়ে এগিয়ে দিয়ে বললো
” কিসের গিফট এটা? আমি নেবো না।” নিশাদ শান্ত গলায় বললো
” না নিলে আমার খারাপ লাগবে। তোমার জন্য ছোট্ট একটা উপহার।” রিধিশা অস্বস্তি নিয়ে গিফটা নিলো। স্নেহাকে নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগে নিশাদ ডেকে বললো
” অফিসে একসাথে যাবো আগে যাবে না কিন্তু!”
রিধিশা উত্তর না দিয়ে বেরিয়ে পরে। স্নেহা তার ফ্ল্যাটে চলে যায়। নিশাদের দেওয়া গিফট’টা ব্যাগে রেখে দেয় রাতে দেখবে এখন সময় নেই আরেকটা টিউশনিতে যাবে।

.
অফিস শেষে রিধিশাকে নিশাদের সাথেই ফিরতে হয়। রিধিশা ফ্রেশ হয়ে রান্না বসায়। নিশাদের গিফটের কথা হঠাৎ মনে পড়তেই রিধিশা ব্যাগ থেকে বের করে। র‍্যাপিং পেপার খুলে দেখে একটা উপন্যাস বই। রিধিশা মুচকি হাসলো বইটা দেখে। বইটা খুলতেই প্রথমে কালো কাগজে হোয়াইট পেন দিয়ে লিখা ছোট একটা চিরকুট দেখতে পায় রিধিশা।

” নিশাদ শাহ’কে খুশি করা কিন্তু এতো সহজ না। বুঝলে? আজকে রান্না করে আমার খুশি করেছো তারজন্য ওই ছোট একটা গিফট। তোমার রান্নায় আমার মায়ের রান্নার স্বাদ পাই তাই কয়েকবার তোমাকে রান্না করে দিতে বলেছি।
আমাকে না করার সাধ্য কারো নেই তাই জোড় করে হলেও তোমাকে দিয়ে রাধাবো।”
রিধিশা মনে মনে চিরকুট’টা পোরে হাসলো।

__________

নিশাদ অফিসে আসার পর থেকে রিধিশার সাথে এখনও তার ঝগড়া বা কোনো কথা হয়নি তাই নিশাদ ভাবছে কি করে কথা বলা যায়। রিধিশা কম্পিউটারে মনোযোগ সহকারে কাজ করছে। নিশাদ রিধিশার টেবিল থেকে আইডি কার্ড সরিয়ে ফেললো কিন্তু রিধিশার খেয়াল নেই। নিশাদ রিধিশার ওড়না টেনে ওড়নার পমপম গুলো দেখতে থাকে। রিধিশার কাধে হালকা টান লাগতেই রিধিশা সেদিকে নজর দেয়।
নিশাদকে ওড়না নিয়ে খেলতে দেখে রিধিশা টান দিয়ে ওড়নার অংশ কোলে রেখে ভ্রু কুঁচকে বললো
” কাজ করতে এসেছেন নাকি খেলতে এসেছেন? স্যার দেখলে আপনার চাকরি না খেয়ে নেয়!”

নিশাদ ঘাড় বাকিয়ে ভ্রু নাঁচিয়ে বললো
” বাব্বাহ! আমার চাকরি নিয়ে তোমার এতো চিন্তা? নাকি আমাকে নিয়ে চিন্তা?” রিধিশা আমতা আমতা করে বললো
” আমার কেনো চিন্তা হবে? আমি তো বলছিলাম মনোযোগী হয়ে কাজ করুন।” নিশাদ হেসে বললো
” আমার কাজ শেষ ওকে? এখন নতুন কাজ আনবো।”

রিধিশা অবাক হয়ে বললো
” এতো দ্রুত আপনার কাজ শেষ? আপনি একাই করেন নাকি পিএ আছে?” নিশাদ কোণা চোখে তাকায়
” এসব কিছু নেই ঠিকাছে?” রিধিশা ঠোঁট উল্টে কপাল কুঁচকায়।
এর মাঝে রিধিশার বস আব্দুল্লাহ স্যার এর ডাক পড়ে। তিনি ডাকছে রিধিশাকে। নিশাদ উঠে বিজয় স্যারের রুমে চলে যায় ফাইল নিয়ে।

রিধিশা শক্ত হয়ে বসে আছে যেনো আব্দুল্লাহ স্যারের ডেকেছে শুনেইনি। হাত চালিয়ে কাজ করে যাচ্ছে শুধু।
নিশাদ আবারও কয়েকটা ফাইল নিয়ে বসে মুখ ফুলিয়ে বললো
” ভাবলাম কাজ শেষ করলে ছুটি দেবে কিন্তু আরো কাজ দিয়ে দিলো।” রিধিশা ঠোঁট চেপে হাসে।
আব্দুল্লাহ স্যারের রুম থেকে আবারও রিধিশার ডাক পড়ে। নিশাদ রিধিশাকে বললো
” যাচ্ছো না কেনো? স্যার পড়ে রেগে যাবে।”

রিধিশা কাজ বন্ধ করে অস্বস্তি নিয়ে দুটো ফাইল তুলে কেবিনে গেলো। রিধিশার চেহারা দেখে নিশাদ কপাল কুঁচকে যায় আপনা আপনি। রিধিশা কাজ শেষ করতে পারেনি তাই ভয় পাচ্ছে চাবে নিশাদ আবার ভাবলো অন্যকিছুও হতে পারে। নিশাদ উঠে আব্দুল্লাহ স্যার এর কেবিনে গেলো।

রিধিশা ফাইল দিতেই আব্দুল্লাহ স্যার তার দিকে কেমন করে তাকালো। রিধিশা চোখ মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে থাকে। আব্দুল্লাহ স্যার আরো দুটো ফাইল দিলে রিধিশা সেগুলো নেওয়ার সময় সে কথা বলতে বলতে রিধিশার হাত ছুঁয়ে দেয়। রিধিশা অস্বস্তি আর রাগে চোয়াল শক্ত করে হাত ছাড়িয়ে ফাইল নিয়ে বেরিয়ে আসে।
সব কিছু দেখে নিশাদের চোখ জোড়া লাল হয়ে যায়।
নিশাদ রাগে হাত মুঠো করে একবার স্যারের দিকে তাকিয়ে আবার রিধিশার দিকে তাকায়।

নিশাদ হনহন পায়ে রিধিশার কাছে গিয়ে চেয়ার টেনে রিধিশার দিকে ঝুঁকে যায়। রিধিশা চমকে নিশাদকে বললো
” কি হয়েছে?” নিশাদ দাঁতে দাঁত চেপে বললো
” এতো রাগ তোমার মধ্যে তাহলে ভেতরে চুপ করে ছিলে কেনো? তখন রাগ হয়নি তোমার? বোবার মতো চুপ করে আছো কেনো এখনও? নাকি আমাকেই শুধু রাগ দেখানোর সাহস রাখো আর বাইরের দুনিয়ায় সেই রাগ দেখানোর কোনো সাহস নেই তোমার।”
রিধিশা মাথা নিচু করে নেয়। নিশাদ রিধিশার চেয়ার ছেড়ে সোজা হয়ে শক্ত গলায় বললো
” আমি ব্যবস্থা করছি।”

নিশাদ হনহন করে বিজিয় স্যারের কেবিনে ঢুকে গেলো। বিজয় স্যার নিশাদকে দেখে ভ্রু কুঁচকে বললো
” নিশাদ একটু আগেও নক করে এসেছিলেন আর এখনই হুট করে ঢুকে পড়লেন?” নিশাদ শান্ত গলায় বললো
” সরি, স্যার। ইম্পরট্যান্ট কথা বলার বলবো আপনি অনুমতি দিলে।” বিজয় স্যার ইশারায় বলতে বললো।
নিশাদ নিজের রাগ কন্ট্রোল করে বললো
” স্যার আমি চাইছি মিস. রিধিশা আমার আন্ডারে কাজ করুক।”

বিজয় স্যার ভ্রু কুঁচকে বললো
” নিশাদ কি বলতে চাইছেন? আপনার ইচ্ছে মতো তো হবে না এসব।”
নিশাদ শক্ত গলায় বললো
” সরি, স্যার আমি চাই না রিধিশা আব্দুল্লাহ স্যারের আন্ডারে কাজ করুক। কিছু মানুষ রয়েছে যারা কিছু কাপুরুষদের নজরে নিরাপদ নয়। এখানে রিধিশা আমার সব চেয়ে আপন মানুষ। তাহলে নিশ্চই আমি সব কিছুর আগে তার নিরাপদ চাইবো। তাই আমি চাই রিধিশা আমার সাথে বা আমার আন্ডারে কাজ করবে।”

বিয়জ স্যারের তীক্ষ্ম বুদ্ধির মাথা নিশাদের কথার ভাজে থাকা কথাগুলোও নিমিষেই বুঝে নিলো। বিজয় স্যার রিধিশাকে ডেকে পাঠায় আর নিশাদকে বললো
” বসুন আপনি আমি দেখছি।” নিশাদ শার্টের হাতা কনুই পর্যন্ত উঠিয়ে চেয়ারে টেনে বসে পড়লো। রাগে মাথা ভনভন করছে নিশাদের। কিছুক্ষণের মধ্যে রিধিশা নক করতেই বিজয় স্যার ভেতরে আসতে বসে। রিধিশা ঢোক গিলে একবার নিশাদের দিকে তাকিয়ে আবার স্যারের দিকে তাকায়।
নিশাদকে দেখেই গায়ে কাটা দিচ্ছে রিধিশার।

বিজয় স্যার রিধিশাকে বসতে বলে। রিধিশা বসতেই জিজ্ঞেস করে
” এখন থেকে তুমি নিশাদের আন্ডারে কাজ করবে। আব্দুল্লাহ স্যারের সাথে তোমার আর কোনো কাজের লেনাদেনা নেই। তোমার কাজ এখন নিশাদের আন্ডারেই চলবে। তোমার সমস্যা নেই তো!”
রিধিশা ফ্যালফ্যাল করে বসে থাকে। নিশাদ হমকি শরূপ ঠাণ্ডা গলায় বললো
” উত্তর দিচ্ছো না কেনো?”

নিশাদের হার কাঁপানো গলা শুনে বললো
” ন…না স্যার। কোনো সমস্যা নেই আমার।” বিজয় স্যার আলত হেসে বললো
” ঠিকাছে কাজ করতে থাকো।” রিধিশার সাথে নিশাদ চলে যেতেই বিজয় ডেকে বললো
” শার্টের হাতা নামিয়ে সুন্দর এমপ্লয়ির মতো থাকুন এখন আপনার ‘সব চেয়ে আপন মানুষটা’ সুরক্ষিত।”
বিজয়ের টানা সুরের কথা শুনে নিশাদ শার্টের হাতা নামাতে নামাতে লজ্জা পেয়ে বেরিয়ে আসে।

চলবে……..