কুঁড়েঘর পর্ব-৩৪+৩৫

0
420

#কুঁড়েঘর
#লেখিকা–মার্জিয়া রহমান হিমা
[ দ্বিতীয় পরিচ্ছদ ]
। পর্ব ৩৪ ।

নিশাদ কেবিনে আসলে রিধিশা ইতস্তত বোধ করে তার সামনে গিয়ে ধন্যবাদ বলে। নিশাদ এমনভাবে তাকায় যেনো খেয়ে ফেলবে তাকে। রিধিশা ভয় পেয়ে নিজের চেয়ারে বসে মাথা নিচু করে কাজ করতে থাকে।
অফিস ছুটি হতেই রিধিশা রিকশা ডেকে উঠে পড়ে। নিশাদ বাইক নিয়ে এসে ধমকে উঠে। রিধিশা রেগে যায়। নিশাদ রেগে বললো
” তোমাকে বলেছি না আমার সাথে যাবে প্রতিদিন? এখনই নামো রিকশা থেকে।” রিধিশা রেগেই ধুপধাপ করে নেমে গেলো।

রিকশাওয়ালা রিধিশাকে বললো
” কি আপা উঠবেন না তো আমরার সময় করেন কেন আপনারা? জামাই বউ ঝগড়া করবো আর সময় নষ্ট করবো আমার।” রিধিশা আর নিশাদ থমথমে চেহারায় একে অপরের দিকে তাকায়। রিধিশা কথার প্রতিবাদ করার আগেই রিকশা নিয়ে চলে গেলো।
নিশাদ শক্ত গলায় বললো
” উঠবে নাকি চলে যাবো আমি?” রিধিশা ছোট নিশ্বাস ফেলে উঠে বসে বাইকে। আজকে নিশাদ হাজারটা কথা শোনালেও রিধিশার মুখ থেকে শব্দ বের হবে না কারণ নিশাদের রাগের কারণটা একেবারে সঠিক।

কিছুক্ষণের পথে দুজন পুরোটাই চুপচাপ ছিলো। রিধিশা পেছন থেকে বাইকের মিররে নিশাদকে কতোবার দেখেছে কিন্তু নিশাদ সোজাই তাকিয়ে ছিলো। রিধিশার বাসার সামনে বাইক থামাতেই রিধিশা নেমে বলে উঠে
” আমি অনেকবার প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু কোনোভাবেই আমি পারিনি। পরে যদি কোনো ক্ষতি করে সেই ভয়ে আর লোক লজ্জার কারণে কিছু করতে পারিনি।”

নিশাদ শান্ত গলায় বললো
” লোক লজ্জার ভয়ে মিইয়ে থাকলে এভাবেই কাপুরুষদের কারণে মাটিতে মিশে যাবে একদিন। সমাজ তোমাকে খাইয়ে পরিয়ে বাঁচায় না তাই সমাজের লোক লজ্জার কারণে নিজেকে বিষর্রন দেওয়া বর্তমান নারীদের কাজ নয়। সামবে বিপদ হবে ভেবে ভয়ে গুটিয়ে না থেকে নারীবাদী হয় সেই বিপদের সাথে লড়াই করতে পারলেই পূর্ণ নারী হতে পারবে। বাসায় যাও।” নিশাদ কথা শেষ করেই টান দিয়ে বাইক নিয়ে চলে গেলো।
রিধিশা মিহি হেসে উপরে উঠে আসে।

____________

সময়ের পাল্লা বারতে থাকে। দিন পেড়িয়ে একেকটা রাত শেষ হওয়ার সাথে সাথে আমাদের প্রত্যেকের জীবন থেকে একটা করে দিন শুষে নিচ্ছে। আমাদের জীবনের সময় গুলোও কমে আসছে।
এক মাস ব্যস্ততায় পার করে দিয়েছে প্রত্যেকে।
শুক্রবার বন্ধের দিন। আজকের আকাশটা মেঘলা হয়ে আছে। আকাশে গুড়ি গুড়ি মেঘ জমেছে। সকালের সূর্যের আলো’টা আজকে ক্ষণিক্ষণের জন্যই উঠেছিলো। কেউ দেখা পেয়েছে আবার কেউ পায়নি।

রিধিশা ছাদের এক কোণায় মলিন দৃষ্টিতে দূড় আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। কেউ রিধিশার চোখ জোড়া দেখলে এখন অজান্তেই আবেগে অভিভূত হয়ে পড়বে। রিধিশার চিন্তার মাত্রা যেনো ছাড়িয়ে পড়েছে। গত এক মাসে ঝগড়া হাসি মজায় ভালোই কেটেছে সময় রিধিশা আর নিশাদের।
গত কয়েকদিন আগেই অফিসের একজন মেয়ে কলিগ রিধিশার সাথে কথা বলতে বলতে জিজ্ঞেস করেছিলো
” তোমার আর নিষাদের সম্পর্ক কেমন? মানে তুমি নিশাদের কে হও?” অনেক ভেবে উত্তরে রিধিশা উত্তর দিয়েছিলো
” বন্ধু।”

কিন্তু সেইদিন বাসায় আসার পর থেকে ভাবনার পর ভাবনাতেই ছিলো। রিধিশার মনে প্রশ্ন জাগে, আসলেই তো তার সাথে আমার সম্পর্ক কিসের?
রিধিশার নিজের মনেও আগে দু একবার প্রশ্নটা আসলেও সেইদিনের মতো সিরিয়াস হয়ে ভাবেনি।
রিধিশার মনে হলো দুজনের মাঝে কিছুটা দূরত্ব আনা প্রয়োজন তাহলেই হয়তো তাদের সম্পর্কের দৃষ্টিকোণ খুঁজে পেতো আর আসল সম্পর্কটা কি বুঝতে পারতো।

কয়েকদিনে রিধিশা নিশাদকে avoid করার চেষ্টা করেছে অনেক। নিশাদকে কথা বলার জন্য তীব্র ছটফট করতে দেখেছে। নিশাদ সুযোগ খুঁজেছে শুধু রিধিশার সাথে কথা বলার জন্য কিন্তু রিধিশা কয়েকদিনে নিশাদকে এড়িয়েই চলেছে কথা বলার কোনো সুযোগ দেয়নি।
নিশাদকে যেমন ছটফট করতে দেখেছে তেমনই নিজের অনুভূতিগুলোর সাথে সম্মুখীন হয়েছে। নিশাদের সাথে নিজেকে কতোটা গভীরভাবে জড়িয়ে ফেলেছে সেটা প্রতিটা পদক্ষেপে বুঝতে পারছে এখন।

নিশাদকে এড়িয়ে নিজেও শান্তি পাচ্ছে না। গলা কাটা মুরগির মতো ছটফট করে অশান্তির মাঝে ভুগছে।
নিশাদকে ছাড়া কতোটা নিসঙ্গ সে সেটাও বুঝতে পারছে। বারবার মনে হচ্ছে নিশাদকে ভালবেসে ফেলেছে কিন্তু রিধিশা সেটা মেনে নিতে পারছে না।
নিশাদকে সে ভালোবেসে বিশ্বাসই করতে পারছে না।
রিধিশা দ্বিধায় ভুগছে। কি করা উচিত তার বুঝতে পারছে না। এভাবে বেশিদিন নিশাদকে এড়িয়ে চলা সম্ভব না ভালো করেই জানে।

বৃষ্টির ছোট ছোটি ফোটা মুখের উপর পড়তেই রিধিশা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে। বৃষ্টি ভালো ভাবে শুরু হওয়ার আগেই রিধিশা ছাদ থেকে নেমে গেলো। শুক্রবার হলেও আজকে অফিসে যেতে হবে। পার্ট টাইম জব তাই শুক্রবারও অফিস রয়েছে যদিও প্রতিদিনের তুলনায় দুই ঘন্টা কম।

.
সূর্য, রেহান, সাদি ঘুরঘুরে নিশাদকে দেখছে। নিশাদের দৃষ্টি টিভিতে। সাদি ফিসফিস করে বললো
” নিশাদের কি হয়েছে জানিস রেহান? ওর ভাবসাব বোঝা মুশকিল এখন।” রেহান বিরক্ত গুলায় বললো
” জানলে কি তোদের সাথে দাঁড়িয়ে আমিও খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি নাকি?” সূর্য বললো
” আমার কি মনে হয় বলতো! রিধিশার সাথে নিশ্চই কোনো ঝামেলা হয়েছে তাই কয়েকদিন ধরে চুপচাপ হয়ে আছে।”

সাদি বললো
” এখন তো ঝগড়া হয়েছে বুঝলাম। কিন্তু আমার মতো তো মনে রিধিশা নিশাদের জীবনের এন্ট্রি নেওয়ার পর থেকেই নিশাদ বদলে গিয়েছে। মাঝে মাঝে আমাদের বাসার খাবারের টেস্টও আলাদা হয়ে যায়। আমার তো মনে হয় অন্যকেউ রেঁধে দেয়। বুয়া এতো মজা করে রান্না করে কখনো।”
রেহান সাদির মাথায় গাট্টা মেরে বললো
” তোর মাথাটা কি মিষ্টি দিয়ে ঠেসে রাখিস? এতোদিন হয়েছে এখনও বলছিস মনে হয়! রিধিশাই তো মাঝে মাঝে রেধে দিয়ে যায়। নিশাদ তো অফিসে যাওয়ার সময় রিধিশাকে সাথে করেও নিয়ে যেতো আমি দেখেছি। কিন্তু কয়েকদিন ধরে একাই যাচ্ছে।”

সূর্য নিশাদের দিকে তাকিয়ে বললো
” রিধিশার সাথে সেটিং হয়ে গেলে ভালোই হবে। নিশাদ তো মনে হয় রিধিশাকে ভালোওবাসে। যাই হোক দুজনের ভালো হলেই হয়।” রেহান আর সাদি সায় জানায়। রেহান চিন্তিত হয়ে বললো
” কিন্তু ব্রো! আমার আগে যদি নিশাদের বিয়ে হয়ে যায় থাহলে কিন্তু আমি মানতে পারবো না। আমি নিশাদের আগে থেকে প্রেম করছিলাম।”
” শোন যার ভাগ্যে বিয়ে লেখা থাকবে তারই তো হবে নাকি?”

সূর্য নিশাদের কাছে এসে বসে বললো
” কিরে নিশাদ অফিসে যাবি না!” নিশাদ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো
” হ্যা যাবো, কেনো?” সূর্য গলা ঝেড়ে বললো
” একটা কথা ছিলো আর কি।” নিশাদ টিভি অফ করে বললো
” হ্যা বল।”
” কালকে ঘুরতে যাবি? না কালকে তো অফিস আরো দেড়িতে ছুটি হবে আজকেই যাবি ঘুরতে? অনেকদিন ধরে তো চারজন ঘুরতে যাই না।”
নিশাদ মাথা নেড়ে বললো
” ঠিকাছে। অফিস থেকে এসে রাতে নাহয় যাবো।”
সূর্যরা খুশি হয়ে যায়।

.
রিধিশা তার কাজ করছে ঠিকই কিন্তু তার মন পুরোপুরি কাজের মধ্যে নেই। নিশাদ এখনও আসেনি তাই বারবার সেদিকে তাকাচ্ছে। রিধিশা চিন্তায় পড়ে যায়। নিশাদ দেড়ি করেনা কখনো।
কিছুক্ষণ পর নিশাদ আসলো অর্ধেক ভেজা অবস্থায়। রিধিশা তাকে দেখে হাফ ছাড়ে।
চেয়ারে বসতে বসতে প্রথমে রিধিশার দিকে তাকায় নিশাদ। নিশাদকে দেখে হাতের স্প্রিড বাড়িয়ে কম্পিউটারে কাজ করছে রিধিশা।

নিশাদ তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। রিধিশার এড়িয়ে চলার বিষয়টা বুকে ব্যাথা ধরিয়ে দিয়েছে তার। রিধিশাকে হাজার বার জিজ্ঞেস করেছে এড়িয়ে চলার কারণটা কিন্তু উত্তরেও এড়িয়ে চলেছে রিধিশা। আজকে তো একটা শলাপরামর্শ করেই ছাড়বে এটার আজকে ভেবেই এসেছে বাসা থেকে।
নিশাদ একটা ফাইল দিয়ে গম্ভীর গলায় বললো
” বিজয় স্যার বলেছে এটার আরেকটা ফাইলে কিছু ডিটেইলস রয়েছে যেটা স্টোর রুমে পাওয়া যাবে। স্টোর রুম থেকে নিয়ে এসো।”
রিধিশা কথা না বলে ফাইল নিয়ে উঠে গেলো।
দারোয়ানকে স্টোর রুম কোথায় জিজ্ঞেস করে সেদিকে গেলো।

.
রিধিশা স্টোর রুমে ঢুকে দেখে লাইব্রেরীর মতো একেবারে তাকে তাকে অনেক ফাইল রাখা। রিধিশা ফাইল খুঁজতে খুঁজতে ভ্রু কুঁচকে বললো
” এটা নাকি অফিসের নতুন শাখা! নতুন অফিসের স্টোর রুমের কি দশা বানিয়ে রেখেছে এরা! সব গুলো কাজচোর। এখানে এতো ফাইল রেখে দিয়েছে বারবার আসতে হবে সবাইকে। স্টোর রুমটা পরিষ্কার করতে পারে না একটু! আমাকে না পাঠিয়ে বিজয় নিজেই আসতো তাহলে এসব দেখে সবাইকে কয়েকটা লেকচার শুনিয়ে দিতো।”

রিধিশা খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত হয়ে যায়। এতো ফাইলের মাঝে খুঁজে বের করতে অনেক সময় লাগবে। রিধিশা হতাশার নিশ্বাস ফেলে ঘুরতেই নিশাদকে দেখতে পেয়ে ভয় পেয়ে চিৎকার করতে চায় কিন্তু তার আগেই নিশাদের এক হাত রিধিশার মুখ চেপে ধরে। রিধিশা চোখ বড় বড় করে তাকায়। ভয়ে তার বুক ধড়ফড় করছে এখনও।

রিধিশা নিশাদের হাত সরিয়ে রেগে বললো
” এভাবে ভুতের মতো কেউ আসে? আরেকটু হলে মরে যেতাম।” নিশাদ শান্ত চাহনি দিয়ে তাকায়। রিধিশা নিশাদকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলেই নিশাদ রিধিশার হাত টেনে ফাইলের তাকের সাথে চেপে ধরে। রিধিশা চোয়াল শক্ত করে বললো
” ছাড়ুন আমাকে নিশাদ! এসব কি ধরনের অসভ্যতাম?” নিশাদ শক্ত গলায় বললো
” আজকে আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে কোথাও যাবে না। তুমি আমাকে এড়িয়ে চলছো কেনো বলো!”

রিধিশা মুখ ঘুরিয়ে নেয়। নিশাদ রিধিশার বাহু চেপে বললো
” রিধিশা একদম চুপ করে থাকবে না। তোমার সাথে কথা বলার জন্য কতো চেষ্টা করছি চোখে পড়ে না তোমার এসব? সব দেখেও তুমি এড়িয়ে চলছো আমাকে! এসব কেনো করছো বুঝতে পারছি না আমি। আমি তো কোনো ভুলও করিনি তাহলে এভাবে শাস্তি দিচ্ছো কেনো?”

রিধিশা নিচু গলায় বললো
” শাস্তি দেওয়ার তো কিছু দেখছি না। আমাদের মধ্যে এমন কোনো সম্পর্ক নেই যার জন্য আমার এড়িয়ে চলাটা আপনার উপর ইফেক্ট করবে।”

চলবে……..

#কুঁড়েঘর
#লেখিকা–মার্জিয়া রহমান হিমা
[ দ্বিতীয় পরিচ্ছদ ]
। পর্ব ৩৫।

নিশাদ ভ্রু কুঁচকে বললো
” কি বলতে চাইছো তুমি?”
” বলেছি আমাদের মধ্যে এমন কোনো সম্পর্ক আছে বলে আমার মনে হচ্ছে না। যার জন্য আমার এড়িয়ে চলায় আপনি কষ্ট পাচ্ছেন।” নিশাদ তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো
” এতোদিন তোমার এই প্রশ্ন কোথায় ছিলো?”
রিধিশা আমতা আমতা করে বললো
” এতোদিন এই প্রশ্ন মনে হয়নি কখনো তাই কখনো ভাবিনি এসব।”

নিশাদ ঠান্ডা গলায় বললো
” তাহলে এখনও ভেবো না ভুলে যাও। এসব সম্পর্কের প্রশ্ন টেনে আমাদের মাঝে দেয়াল খাড়া করবে না। তুমি, আমি যেমন আছি তেমনই এর বেশি কিছু ভাবার প্রয়োজন নেই।” রিধিশা রাগি গলায় বললো
” প্রয়োজন নেই মানে কি? প্রত্যেক সম্পর্কের একটা নাম থাকে। কিন্তু আমাদের মধ্যে কোনো সম্পর্কও নেই আর সম্পর্কের নামও নেই। তাই বলছি আমার থেকে দূড়ে থাকবেন।”

নিশাদ রেগে কিছু বলার আগেই রিধিশা ফাইল রেখেই বেরিয়ে যায় স্টোর রুম থেকে। নিশাদ অতিরিক্ত রাগের মাথায় ফাইলের তাকে জোড়ে ঘুষি মেরে বসে। ব্যাথা পেয়ে মুখ কুঁচকে নেয়। হাত ঝাড়তে ঝাড়তে ফাইল নিয়ে বেরিয়ে পরে আর কোনো ফাইলেরই দরকার নেই তার।
চেয়ার টেনে বসে ঠাস করে ফাইলটা রাখে টেবিলের উপর। রিধিশা একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয়। নিশাদ কম্পিউটারে টাইপিং করতে থাকে।

কিছুক্ষণ পর বিজয় স্যার এসে নিশাদকে বললো
” নিশাদ ফাইল গুলো কিছুক্ষণের মধ্যে দিয়ে যাবেন। সব কিছু চেক করতে হবে আগামীকালকের মিটিং এর আগে।” নিশাদ একটা ফাইল এগিয়ে দিতে দিতে বললো
” বাকিগুলো কিছুক্ষণের মধ্যে দিচ্ছি স্যার।” বিজয় স্যার নিশাদের হাত দেখে চোখ কপালে তুলে বললো
” আপনার হাত এভাবে কাটলো কি করে? রক্তে হাত মেখে রয়েছে আর আপনি চুপ করে আছেন!”

রিধিশা তাৎক্ষণিক নিশাদের দিকে তাকায়। নিশাদের রক্ত মাখা হাত দেখে বুকের ভেতর লাফিয়ে উঠে।
নিশাদ শক্ত গলায় বললো
” আমার হাত ঠিকাছে কিছু হয়নি।” বিজয় রিধিশাকে উদ্দেশ্য করে বললো
” রিধিশা আমার কেবিনে গিয়ে দেখুন ফার্স্টএইড বক্স রয়েছে নিয়ে এসে নিশাদের হাতে ব্যান্ডেজ করে দিন।”
রিধিশা দ্রুত গতিতে উঠে চলে গেলো। বিজয় স্যারও চলে গেলো।

রিধিশা চেয়ার টেনে বসে নিশাদের হাত টেনে চিন্তিত গলায় বললো
” মিনিটের মধ্যেই হাত’টার কি অবস্থা করেছেন? ইশশ! আবার বোবা হয়ে বসে ছিলো।”
নিশাদ নিজের দিকে হাত টেনে নিয়ে গম্ভীর গলায় বললো
” কারো চিন্তা করতে হবে না। আমার থেকে দূড়ে থাকলেই তার ভালো।” রিধিশা মাথা নিচু করে আবার হাত টেনে ধরে।
নিশাদ আবার ছাড়িয়ে নিতে চাইলে রিধিশা শক্ত করে চেপে ধরে। নিশাদ ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠতেই রিধিশা দাঁতে দাঁত চেপে বললো
” আরেকবার হাত সরলে এখন হাতের ২৪টা বাজিয়ে দেবো।” নিশা হাত টানতে টানতে বললো
” হ্যা, তুমি তো তাই পারো। সব সময় মানুষকে ব্যাথায় দেয় কখনো ব্যাথা সারায় না। সাধে তো আর বেয়াদব বলি না।”

রিধিশা হাত ছেড়ে রাগি গলায় বললো
” চুপচাপ হাতটা ব্যান্ডেজ করতে দেবেন নাকি এখন স্যাভলন ঢেলে দেবো?”
” দেবো তবে শর্ত আছে।” রিধিশা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। নিশাদ গম্ভীর গলায় বললো
” এখন থেকে আবার আমার সাথে বাইকে যেতে আর আসতে হবে।” রিধিশা নিশাদ হাত টেনে তুলো দিয়ে রক্ত মুছতে মুছতে বললো
” আপনার সাথে দূরত্ব বাড়াতে চাইছি আর আপনি দূরত্ব ঘোচাতে চাইছেন, কেনো?”

নিশাদ রিধিশার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো
” জানি না তবে তোমার সাথে কথা না বলে এক মুহূর্তও থাকতে পারি না। আমার হাত ব্যান্ডেজ করছো মানে আমার সাথে যেতে হবে তোমাকে।”
রিধিশা কথা উত্তর দিলো না। যত্ন সহকারে নিশাদের হাতে ব্যান্ডেজ করে দিতে থাকে। নিশাদের চোখের আড়ালে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া চোখে পানি মুছে নিলো। আড়াল করতে চাইলেও তো আর পারে না। নিশাদ ঠিকই দেখে বুঝেছে।
রিধিশা ব্যান্ডেজ করে আবার কাজে মন দেয়।

বিজয় স্যার নিশাদকে কাজ করতে না করে দেয়। রিধিশা নিশাদের কাজ গুলো কমপ্লিট করতে থাকে। নিশাদ বসে বসে রিধিশার ওড়না নিয়ে দেখছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আবার মোবাইলে বসে গেইম খেলছে।
রিধিশা নিশাদের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখে নিশাদ তার দিকেই তাকিয়ে আছে। রিধিশা থতমত খেয়ে চোখ সরিয়ে নেয়। নিশাদ ঠোঁট চেপে হাসলো।
অফিসের কাজ শেষ করে দুজন বেরিয়ে পড়ে। নিশাদ বাইক নিয়ে আসলে রিধিশা চুপচাপ বসে পরে।

চলন্ত বাইকে নিশাদ বারবার রিধিশার দিকে তাকায় কিন্তু রিধিশার দৃষ্টি একদিকেই বরাদ্দ। নিশাদ একটা চায়ের টং দেখে বাইক থামায়। রিধিশা আশেপাশে পরখ করে বললো
” এখানে কেনো থামিয়েছেন?” নিশাদ বাইক থেকে নেমে বললো
” চা খাবো ওয়েট করো আসছি।”
রিধিশা বাইকের সাথে হেলান দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। দুপুরে বৃষ্টি হওয়ায় রাস্তায় পানি জমেছে। আকাশে মেঘ না থাকলেও বৃষ্টি বৃষ্টি ভাব’টা রয়েছে। ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় গায়ে লোম কাটা দিয়ে উঠছে।

মুখের সামনে গরম চা ধরে নিশাদ। রিধিশা চমকে তাকায়। মাটির মগের গরম চা হাতে নিয়ে ফু দিতে থাকে। রিধিশা নিশাদের দিকে তাকিয়ে বললো
” আপনি টং এর চা খান?” নিশাদ হতাশার স্বরে বললো
” কোনোদিন তো খাইনি কিন্তু আজকে না খেলেই নয়। আফসোসের ব্যাপার হলো মাহিন এর সাথে কতো বাত কফি শপে গিয়ে কফি খেলে, ডেট করলে অথচ আজ পর্যন্ত কখনো আমার সাথে এক কাপ কফি খেলে না তুমি। টং টা দেখে মনে হলো যদি একটু টং এর চা খাওয়ার সুযোগই পাই তাহলে মন্দ কি!”

রিধিশা হেসে নিশাদের দিকে তাকালো। চায়ে চুমুক দিয়ে বললো
” আপনি সব সময় অন্যের সাথে নিজের কম্পেয়ার করেন কেনো বুঝি না। সবার প্রতি সবার অনুভূতি যেমন এক না তেমনই সবার সাথে সব কিছু করা হয় না। আপনার সাথে কফি খাইনি কিন্তু বৃষ্টির দিনে টং এর চা ঠিকই খেয়েছি। বন্ধ কফিশপে কফি খাওয়ার থেকে খোলা আকাশের নিচে টং চা খাওয়াটা বেশি আনন্দের নয় কি?”
নিশাদ মাথা নেড়ে বললো
” হুম! একটা কথা বলো মাঝে মাঝে তুমি এতো যুক্তিসংগত কথা বলো কি করে? আমি তো জানতাম না বেয়াদব মেয়েরা শুধু ঝগড়া করতেই জানে।”
রিধিশা চোখ রাঙ্গিয়ে তাকাতেই নিশাদ নিঃশব্দে হাসলো। চা খাওয়া শেষে দুজন বাড়ির দিকে পথ দেয়।

নিশাদ রিধিশাকে বাসার সামনে নামিয়ে বললো
” এখন সব ঠিক হয়েছে আবার কোনো গণ্ডগোল করলে সত্যি সত্যি পানিতে ফেলে দেবো এবার মাথায় রেখো।” রিধিশা মুখ বাঁকিয়ে বললো
” আপনাকে ভয় পাই নাকি আমি? হুহ! উহহ, আপনার হাত’টা দেখিয়ে নেবেন ফার্মেসীতে গিয়ে।” নিশাদ চলে যেতে রিধিশা উপরে চলে আসে।
দরজার খুলতে খুলতে দেখলো হেনা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। রিধিশাও হেসে বললো
” এতো হাসছো কেনো ভাবি?”
হেনা হেসে বললো
” নাহ এমনি, আজকেও অফিস ছিলো নাকি তোমার।?”
” হ্যা, ভাবি। পার্ট টাইম জব তো তাই সপ্তায় ৭দিনই অফিস। তবে শুক্রবার একটু কম সময় অফিস।”

“ওওওও তা কার সাথে এসেছো গো!” রিধিশা হেনার দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করতে থাকে। হেনা হেসে বললো
” আরে ভয় পাচ্ছো কেনো? চলো তোমার রুমে চলো।”
রিধিশা দরজা খুলে হেনা’কে নিয়ে ভেতরে ঢোকে। ব্যাগ রাখতেই হেনা রিধিশাকে টেনে বসিয়ে বললো
” নিশাদ’কে আমরা চিনি বুঝলে? ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি তো বিয়ের পর থেকেই ওকে দেখছি। নিশাদ অনেক বছর ধরে এখানে থাকছে। নিশাদের সাথে তো আমাদেরও ভালো সম্পর্ক তবে নিশাদ এখন আর আসেনা বেশি। আরে আমাদেরও প্রেমের বিয়ে বুঝেছো! তাই ভয় পাওয়ার কিছু নেই।”
রিধিশা হেনা’কে থামিয়ে বললো
” না ভাবি তেমন কিছুই না। আমরা একই ভার্সিটিতে পড়ি আবার একই অফিসে চাকরি হয়েছে তাই আর কি নিশাদের সাথে মাঝে মাঝে আসা হয়।”

হেনা মিটমিট হেসে বললো
” সমস্যা নেই তেমন কিছু না থাকলেও ধীরেধীরে হয়ে যাবে অনেক কিছু। আমি তো কালই নিশাদকে দাওয়াত দিয়ে আসবো আমাদের বাড়িতে আসার জন্য।” রিধিশা মাথা চুলকাতে থাকে। হেনা কিছুক্ষণ কথা বলে চলে যায়।

.
টিউশনি পড়িয়ে রিধিশা ভার্সিটিতে এসে পড়েছে। ক্লাসে বসে আছে। স্যার এসে ক্লাস করাতে থাকে কিন্তু জোতির দেখা নেই। রিধিশা বসে বসে বিরক্ত হয়ে উঠে। জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে নিশাদ, রেহান, সূর্য, সাদি বাইক নিয়ে ঢুকেছে। বাইক পার্ক করেই উল্টোপাল্টা দৌঁড় দেয় নিজেদের ক্লাসে। রিধিশা ফিকফিক করে হেসে দেয়।
ক্লাসের স্যার হাসির উৎস খুঁজে গম্ভীর গলায় রিধিশাকে ডাকে।

রিধিশা চমকে দাঁড়িয়ে পরে। স্যার গম্ভীর গলায় বললো
” হাসাহাসি করার হলে বাইরে গিয়ে করবে আমার ক্লাসে নয়। আমার ক্লাসে ডিস্টার্ব পছন্দ করি না আমি ভালো করেই জানো।” রিধিশা মাথা নিচু করে বললো
” সরি, স্যার।” স্যার আবারও ক্লাস করাতে থাকে। রিধিশা মুখ ফুলিয়ে রাখে।

দ্বিতীয় ক্লাসের সময় জোতি ক্লাস আসে। রিধিশা জিজ্ঞেস করলো
” এতোক্ষণ কোথায় ছিলেন ম্যাডাম? এখন তোর আসার সময় হয়েছে?” জোতি হাপানো রোগীর মতো জোড়ে জোড়ে নিশ্বাস নিয়ে বললো
” তুই জানিস না কিভাবে দৌঁড়ে এসেছি আমি। ভাইয়া এসেছে, ভাইয়ার সাথেই ছিলাম। ব্রেক টাইমে আবার আসবে তবে তোর সাথে কি কথা বলতে চেয়েছে।”

রিধিশা ভ্রু কুঁচকে বললো
” আমার সাথে কিসের কথা?” জোতি ঠোঁট উল্টে বললো
” আমি কি জানি! আমাকে বললে তো বলেই দিতাম। কিন্তু প্লিজ, রিধি! আমার রিলেশনের কথা বলিস না প্লিজ!”
” ধুর চুপ থাক। তোর রিলেশন নিয়ে জিজ্ঞেস করার হলে ফোনেই জিজ্ঞেস করতো।”
” তাও ঠিক তবে এসব নিয়ে কিছু বললে তুই কিন্তু একদম মুখ খুলবি না।” রিধিশা বিরক্তিকর চাহনি দেয়।

চলবে…….