#কুঁড়েঘর
#লেখিকা–মার্জিয়া রহমান হিমা
[ দ্বিতীয় পরিচ্ছদ ]
। পর্ব ৩৬।
ব্রেকের সময় হতেই রিধিশা বেরিয়ে যায় ক্লাস থেকে। যাওয়ার পথে নিশাদের গলা শুনে দেখে সামনে নিশাদ একা একা বিড়বিড় করতে করতে যাচ্ছে। রিধিশা একটু এগিয়েও নিশাদের কথা শুনতে পেলো না স্পষ্টভাবে। হাটার মাঝে নিশাদ দাঁড়িয়ে যায় আর রিধিশা সেটা বুঝতে না পেরে নিশাদের পিঠের সাথে ধাক্কা খায়। নিশাদ চট করে পেছনে ঘুরে। রিধিশা মুখে হাত দিয়ে সরে দাঁড়ায়। নিশাদ ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে
” কি? আমার পেছনে কি করছিলে?”
রিধিশা কেশে বললো
” আমি আপনার পেছনে কি করবো? আমি তো যাচ্ছিলাম এদিক দিয়ে আপনি দাঁড়িয়ে গেলেন তাই আপনার সাথে ধাক্কা খেয়েছি।” নিশাদ চোখ ছোট ছোট করে তাকায়। রিধিশা মুখ লটকিয়ে বললো
” কি এভাবে তাকান কেনো? চুরি করছি নাকি? সরুন।”
নিশাদ রিধিশার আরো সামনে গিয়ে বললো
” সরবো না কি করবে? যাওয়ার জন্য পথ কি কম আছে এখানে?” রিধিশা মুখ কুঁচকে বললো
” ঝগড়া করা রক্তে মিশে গেছে নাকি?”
নিশাদ হতাশার নিশ্বাস ফেলে বললো
” উফফ, মনে হয়।” নিশাদ কথায় রিধিশা মিটমিট করে হাসে। রিধিশা আশেপাশে তাকিয়ে বললো
” ঠিকাছে অন্যকাউকে খুঁজে ঝগড়া করুন আমি এখন ব্যস্ত।” নিশাদ ভ্রু কুঁচকে বললো
” কিসের এতো ব্যস্ততা তোমার?”
” আপনাকে বলবো কেনো শুনি?” রিধিশা চলে যায়। নিশাদ মুখ বাঁকায় রিধিশার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে।
“কালকে ঘুরে ফিরে রাতে ফিরেছি বাসায় তারজন্য একে তো স্যারের ক্লাস লেট করেছি আবার বকাও খেয়েছি। ধুর আজকের দিনটাই খারাপ। আজকে না আসলেই ভালো হতো।” নিশাদ বিড়বিড় করতে করতে আসলো।
ক্লাসে দুই মিনিট বসতেই সূর্য আর সাদি আসে। সূর্য নিশাদকে বললো
” এখানে কি মরার মতো বসে আছিস? ক্যান্টিনে চল খিধে পেয়েছে। সকালে তো খেতেও পারলাম না দৌঁড়ে চলে এসেছি।” নিশাদ জ্যাকেট টেনে বললো
” রেহান কোথায়?”
” ও তো সবার আগেই ক্যান্টিনে গিয়ে খাচ্ছে।” নিশাদরা ক্যান্টিনের উদ্দেশ্যে চলে গেলো।
.
রিধিশা জোয়ানের অপেক্ষায় বসে ছিলো। কিছুক্ষণের মধ্যে জোয়ান আসে। রিধিশা বললো
” তুমি হুট করে আসলে যে ভাইয়া? অফিসের কাজে এসেছো নাকি?” জোয়ান হেসে বললো
” হ্যা। অফিসের কাজে তো এখন মাঝে মাঝেই আসি তবে কম সময় হওয়ায় দেখা করতে পারি না তাই ভাবলাম এবার দেখা করেই যাই দুজনের সাথে।”
রিধিশা আলতো হেসে বললো
” ভালো করেছো। জোতি বললো আমার সাথে কি কথা বলবে তুমি?” জোয়ান গলা ঝেড়ে নেয়। নিচু স্বরে বললো
” বলতে পারিস কথাটা বলার জন্যই আসা তোর কাছে। অনেক সময় হয়েছে তাই এবার আর না বলে থাকা’টা আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।”
রিধিশা অবাক হয়ে বললো
” এমন কি কথা?”
” বলছি আগে বল আমাকে ভুল বুঝবি না।” রিধিশা কিছুক্ষণ চুপ সায় জানায় মাথা নেড়ে। জোয়ান রিধিশার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো
” আমি ভালোবাসি তোকে। কোনো মেয়ের প্রতি এতো মায়া, ভালোবাসা আগে কখনো অনুভব করিনি। রাতে ঘুমানোর আগে তোর কথা ভাবি ঘুম থেকে উঠার পরও তোর কথা ভাবিই। দিনে ২৪ ঘণ্টা তোর চিন্তায় বিভোর থাকি। তোর প্রতি ভালোবাসা’টা রোগের মতো দেখা দিচ্ছে। প্রথম প্রথম তোর প্রতি আমার একটা টান অনুভব হতো সেটা সাধারণ ভাবেই নিতাম কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সেটা ভালোবাসার মতো রোগে পরিণত হবে ভাবিনি।
তাও ধরে নিয়েছিলাম এসব কিছুই না দুদিন পর ভুলে যাবো। কিন্তু ভুলতে পারছি না কোনোভাবেই। প্রতিদিন দ্বিধায় ভুগেছি যে, আমি বলবো কিভাবে এসব কথা? আমি ভালো করেই জানি তুই আমাকে বড় ভাইয়ের চোখেই দেখিস তাই আমি নিজেকে আর নিজের অনুভূতি গুলো’কে বাধা দিয়ে এসেছি এতোদিন। এসব কথাও কখনো বলবো আমি ভাবিনি কিন্তু আমি নিরূপায় হয়ে গিয়েছি ভালোবাসার কাছে।
ভালোবাসা এভাবেও হয়ে যায় সেটা ভালো না বাসা পর্যন্ত বুঝতে পারিনি। আমি এই দ্বিধার সমাপ্তি করতেই তোর কাছে এসেছি। তোকে ভালোবাসি আমি আর বিয়ে করতে চাই।”
রিধিশা হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। জোয়ানের কাছে এসব কথা শুননে কখনো ভাবেনি। জোয়ান চুপচাপ রিধিশার দিকে তাকিয়ে আছে। নিজেকে অপরাধীর মতো মনে হচ্ছে রিধিশার চাহনি দেখে। দুই হাতে শক্ত ভাবে কফির মগ চেপে ধরে মাথা নিচু করে থাকে জোয়ান। রিধিশাকে স্তব্ধ ভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে জোয়ান তাকে ডাকলো
” রিধি! কিছু বল প্লিজ!” রিধিশা ধ্যান ভেঙ্গে বেরিয়ে আসে। অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে বললো
” আমি কি বলবো? বলার মতো কিছু রেখেছো?”
জোয়ান অসহায় দৃষ্টিতে তাকায়।
” এতোবড় ভুল কি করে করলে ভাইয়া? আমি সব সময় তোমাকে বড় ভাই এর মতো ভেবে এসেছি। আমার থেকে কি এক্সপেক্ট করছো তুমি?”
জোয়ান বলল
” ভালোবাসার মাঝে অনেক এক্সপেক্টেশন থাকে। আর আমার মনে হয় না আমার কোনো কমতি রয়েছে। তোকে যথেষ্ট সুখ দেওয়ার মতো ক্ষমতা আমার রয়েছে।”
রিধিশা নিশ্বাস ফেলে বললো
” এখানে কথা ক্ষমতা অক্ষমতার ব্যাপারে না।
তোমার মতো ছেলে চাইলেই পাওয়া যায় না। যে পাবে সেই ভাগ্যবতী। আমাকে ভালোবাসতে পারো মানছি। কিন্তু আমি তোমাকে ভাইয়ের চোখে দেখি। আমি কখনো এই সম্পর্ক নিয়ে ভাববো না। আমি তোমাকে বিয়েও করতে পারবো না।”
জোয়ান মলিন হেসে বললো
” জানতাম তুই বিয়ে করতে চাইবি না আমাকে। কিন্তু শেষ চেষ্টার জন্য মন ছটফট করছিলো রে।”
রিধিশা জোয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো
” আমাকে ভুলে যাও ভাইয়া। আমার থেকে ভালো কাউকে পাবে তুমি।” জোয়ান হেসে জড়ানো গলায় বললো
” শান্তনা দিচ্ছিস?” রিধিশা মাথা নেড়ে বললো
” নাহ, দেখবে সত্যি আমার থেকে ভালো কাউকে পাবে তুমি তারপর আর আমাকে মনেই থাকবে না তোমার।” জোয়ান তাচ্ছিল্য হাসে।
রিধিশা করুণ দৃষ্টিতে তাকায়। জোয়ান কফিতে চুমুক দিয়ে মুখ কুঁচকে বললো
” ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। চল জোতির সাথে দেখা করে চলে যাবো।” রিধিশা মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়ায়। জোয়ান রিধিশার সাথে বেরিয়ে যায়।
.
ঘাড় ঘুরিয়ে নিশাদ তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে রিধিশা আর জোয়ানের দিকে তাকায়। রিধিশার পেছনের টেবিলে বসে যে তাদের দুজনের কথোপকথন সব শুনেছে সেই ব্যাপারে সন্দেহ ণেই। সূর্য, সাদি, রেহান তিনজন নিশাদের পানে তাকিয়ে আছে। তিনজন খাওয়ায় এতো বিভোর ছিলো যে কি হয়েছে না হয়েছে সেদিকে খেয়াল নেই। সূর্য নিশাদকে উদ্দেশ্য করে বললো
” কিরে তুই খাচ্ছিস না কেনো? ঠান্ডা বরফ হয়ে গিয়েচ্ছে মনে হয়।”
নিশাদ বাঁকা হেসে টেবিলের উপর রাখা খাবারটা তুলে খেতে থাকে। সাদি ভ্রু কুঁচকে বললো
” হাসিস কেনো?” নিশাদ হাসতে হাসতে বললো
” সময় হলেই বলবো। তোরা তৈরি থাকিস।”
রেহান খেতে খেতে অস্পষ্ট ভাবে বললো
” কিসের জন্য তৈরি হবো? তোর বিয়ে জন্য নাকি?”
রেহানের কথা বুঝে উঠতে তিনজনের কিছুটা সময়।লেগে যায়। নিশাদ বোঝার পর উত্তরে হেসে বললো
” হয়তো! কখন কি হয় তার কি ঠিক আছে?”
তিনজন একে অপরের দিকে তাকিয়ে আবারও নিশাদের দিকে তাকালো। নিশাদ কি ভাবতে ভাবতে খেয়ে যাচ্ছে।
.
জোয়ান রিধিশার উদ্দেশ্যে বললো
” জোতি’কে এসব কিছু জানানোর প্রয়োজন নেই।” রিধিশা মাথা নেড়ে বললো
” জানাবো না কখনো।” জোয়ান মলিন হেসে বললো
” আজকের জন্য কিন্তু আমাকে ভুল বুঝে আবার ভুলে জাস না।”
” চাইলেও সবাইকে ভুলা যায় না। আর তোমাকে ভুলবো কেনো? তুমি তো আমার কাছে ভাইয়ের মতোই থাকবে।” জোয়ান আলতো হাসলো। জোতি আসতেই জোয়ান দুজনের থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলো।
জোতি আগ্রহ হয়ে জিজ্ঞেস করলো
” ভাইয়া কি কথা বলেছে’রে তোকে? আমার কথা কিছু বলিসনি তো!” রিধিশা ভ্রু কুঁচকে বললো
” তোর আমার প্রতি একটুও বিশ্বাস নেই না?” জোতি ইনোসেন্ট ফেস বানিয়ে বললো
” আছে তো!” রিধিশা রাগি দৃষ্টিতে তাকায়।
________________
রিধিশা ভার্সিটি শেষ করে বাসায় ফিরে আসে। ১টা বাজে অফিসে যাবে। তালা খুলতে খুলতেই হেনা ডাকলো তাকে। রিধিশা জিজ্ঞেস করে
” কি হয়েছে ভাবি?” হেনা মিটমিট হেসে বললো
” আরে তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে। এসো বাসায় এসো।” রিধিশা ভ্রু কুঁচকে ফেলে। তার জন্য আবার কি সারপ্রাইজ? হেনা রিধিশাকে তাদের ড্রইংরুমে নিয়ে আসে। নিশাদকে সোফায় বসে থাকতে দেখে রিধিশা চোখ কপালে তুলে ফেলে। রিধিশা ছুটে চলে যেতে চাইলে হেনা তাকে চেপে ধরে যেতে নিষেধ করলো।
নিশাদ কথা বলতে বলতে রিধিশার দিকে চোখ পড়তেই হেসে বললো
” আরে তুমি এখানে?” সাজেদা বেগম জিজ্ঞেস করলো
” রিধিশাকে চেনো নাকি নিশাদ?” নিশাদ হেসে বললো
” হ্যা, আন্টি খুব ভালো করে। ভার্সিটিতেও পড়ি আবার একই অফিসেও জব করি।”
” বাহ তাহলে তো আরো ভালো। রিধিশা এসে বসো। নিশাদ বাবা কতো দিন পর আসলো বাড়িতে।”
হেনা মিটমিট করে হেসে রিধিশার কাধে হালকা ধাক্কা দেয়। রিধিশা তাড়া দেখিয়ে বললো
” না আন্টি। ফ্রেশ হবো আবার অফিসে যেতে হবে। আমি যাই বরং।”
নিশাদ ঘড়ি দেখে বললো
” আরে আরো দেড় অনেক সময় বাকি। দুই মিনিট বসো! গুরুজনের কথা ফেলতে নেই।” রিধিশা দাঁতে দাঁত চেপে তাকায়। সাজেদা বেগম রিধিশাকে টেনে বসিয়ে দিলো। সাজেদা বেগম হেনা’কে বললো
” হেনা তুমি কথা বলো আমি আসছি এখনই।”
হেনা রিধিশার পাশে বসে নিশাদকে বললো
” তা নিশাদ ভাই দিনকাল কেমন চলছে?”
নিশাদ রিধিশার দিকে তাকিয়ে বললো
” হ্যা অনেক ভালো চলছে।”
হেনা আড়চোখে রিধিশার দিকে তাকিয়ে বললো
” তাই নাকি? তা এতোদিন খোঁজ খবরও তো নিলে না আমাদের। তোমার ভাই না বললে তো আজকেও আসতে না।” নিশাদ হেসে বললো
” কি যে বলো ভাবি। ব্যস্ত থাকায় আসিনি আজকে একবার বলতেই কিন্তু এসে পড়েছি। তাও যদি আফসোস না মিটে তাহলে একটু অপেক্ষা করো। দুইদিন পর বউ নিয়ে তোমার বাসায় দাওয়াত খেয়ে যাবো আর তোমাদেরও বউ এর রান্না খাওয়াবো।”
” বাব্বাহ! দুদিনে বিয়েও করে ফেলবে? বেশি ফাস্ট তাই না রিধিশা!” রিধিশা হেনার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। হেনা পাত্তা দিলো না।
” এখন এতো এতো বিয়ে দেখছি যে, ভয় পাচ্ছি যাকে বিয়ে করবো তার না আবার বিয়ে হয়ে যায়। তাই আমি তো দুদিনেই বিয়ে করছি ডিসিশন ফাইনাল।”
রিধিশার চোখে দৃষ্টি স্থির হয়ে যায় নিশাদের দিকে।
” তাহলে নিশাদ কি বিয়ে করলে মিলি’কে বিয়ে করবে?” রিধিশা ভাবতে ভাবতে শুকনো ঢোক গিললো। হেনা’কে কাজের কথা বলে নিজের বাসায় চলে আসলো।
চলবে……..
#কুঁড়েঘর
#লেখিকা–মার্জিয়া রহমান হিমা
[ দ্বিতীয় পরিচ্ছদ ]
। পর্ব ৩৭।
নিশাদ অফিসে যাওয়ার পথেই রিধিশাকে পিক করে নেয়। রিধিশা চুপচাপ বসে বসে চোখের পানি ফেলছে আর চোখ মুচছে। নিশাদ মিরর দিয়ে রিধিশাকে দেখার চেষ্টা করে কিন্তু রিধিশা মুখ এমনভাবে রেখেছে যে দেখা সম্ভব হচ্ছে না।
রিধিশা ঠোঁট চেপে ধরে কান্না আটকে রাখছে। নিশাদের সামনে কাঁদতে চায় না কিন্তু বেহায়ার মতো চোখের পানি পড়ছে। রিধিশার বুক ভারী হয়ে আসে।
তার অনুভূতি গুলোও অপূর্ণ থেকে যাবে এভাবে? রিধিশার বুকের ভেতর পুড়ে যাচ্ছে নিশাদের বিয়ের কথা ভাবতেই। নিশাদ সত্যিই যদি বিয়ে করে নেয়? নানান চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে রিধিশার।
নিশাদ ফাকা রাস্তায় বাইক থামিয়ে নেমে দাঁড়ায়। রিধিশাও নেমে আড়ালে চোখ মুছে নেয়। নিশাদ রিধিশার হাত চেপে কাছে এনে বললো
” কি? কাঁদছো কেনো? আজকে কি কিছু বলেছি? কিছুই তো বলিনি আমি তাহলে কাঁদছো কেনো? অন্যকেউ কিছি বলেছে?” রিধিশা নিশাদের থেকে চোখ সরিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো
” কোথায় কাঁদছি আমি? চোখে বেশি দেখছেন নাকি?”
নিশাস রাগি গলায় বললো
” আমাকে বয়রা মনে হয় তোমার? কান্নার আওয়াজ ঠিকই আমার কানে এসেছে। বলো কি হয়েছে?”
রিধিশা মুখ ঘুরিয়ে জোড়ানো গলায় বললো
” কিছু না অফিসে চলুন দেড়ি হয়ে যাচ্ছে।” নিশাদ রিধিশার হাত চেপে বললো
” এই যে দেখো, তুমি কি হয়েছে সেটা না বললে যাচ্ছি না এখান থেকে। চাকরি গেলে যাবে আজকে।”
রিধিশা হাত ছাড়িয়ে বললো
” চাকরি চলে গেলে দুদিন পর বিয়ে করে কি খাওয়াবেন বউ’কে?” নিশাদ ভ্রু কুঁচকে তাকায়। নিশাদ সন্দেহহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো
” তুমি বিয়ের কথা শুনে কাঁদছো?”
রিধিশার চোখ টলমল করে উঠে পানিতে। কান্না ভেজা গলায় অন্যদিকে ঘুরে বললো
” আপনার বিয়ের কথা শুনে আমি কেনো কাঁদবো? মিলি’কে করুন বা যাকে ইচ্ছে বিয়ে করুন আমার কিছু না।” রিধিশার পেছনে দাঁড়িয়ে নিশাদ ঠোঁট কামড়ে হাসলো। নিশাদ পেছন থেকে রিধিশার ওড়না টেনে বললো
” আচ্ছা চলো আমরাই বিয়ে করে ফেলি তারপর তুমি আর আমি সারাদিন ঝগড়া করবো।”
রিধিশা চোখ মুছে নাক টেনে বললো
” মজা করেন? ফালতু ছেলে একটা।”
” আরে আমি একদম সিরিয়াস। তুমি আর আমি বিয়ে করে ফেলবো সত্যি সত্যি। তুমি না করতে চাইলে জোড় করেই বিয়ে করবো বুঝেছো?” রিধিশা পাত্তা না দিয়ে বললো
” অফিসে দেড়ি হয়ে যাবে, চলুন।” নিশাদ বাইকে বসে স্টার্ট দিতে দিতে বললো
” আমি কিন্তু সিরিয়াস কথা বলছি মনে রেখো কিন্তু! নিশাদ উল্টো পাল্টা কথা বলে না, ওকে?”
রিধিশা বেখেয়ালি মাথায় নিশাদের কথা শুনলো না। অফিসে আসতেই দুজন কাজে লেগে পড়ে।
কয়েক ঘণ্টা পেড়িয়ে যায়। রিধিশা মলিন চেহারায় চুপচাপ কাজ করে যাচ্ছে। নিশাদ বারবার রিধিশার দিকে তাকাচ্ছে। রিধিশার চুপচাপ সহ্য হচ্ছে না তার।
মেয়েটা কথাও বলছে না কোনো। নিশাদ রিধিশার চেয়ার টান দিয়ে কিছুটা কাছে নিয়ে আসে। রিধিশা ভয়ে চমকে উঠে নিশাদের দিকে তাকায়।
নিশাদ শান্ত গলায় শুধালো
” রিধিশা বেশি মন খারাপ?” রিধিশা নিশাদের দিকে তাকালো। নিশাদের দৃষ্টি তার পানেই ছিলো। রিধিশা মাথা নিচু করে ঠোঁট কামড়ে ধরে। নিশাদের মোলায়েম কণ্ঠ শুনে নিশাদকে সব বলে দিতে ইচ্ছে করলো কিন্তু বললো না। ঢোক গিলে ভাঙ্গা গলায় উত্তর দেয়
” নাহ, মন খারাপ না আমার।” নিশাদ গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকালো। উঠেই রিধিশার হাত টেনে বললো
” চলো ব্রেক টাইম দিছে খেয়ে আসি।” রিধিশা হাত ছাড়িয়ে নিতে চেয়ে বলল্য
” খাবো না আমি। খিধে নেই আমার।” নিশাদ রাগি গলায় বললো
” কি সমস্যা তোমার? খাবে না আবার বলবেও না কি হয়েছে।”
রিধিশা রেগে বললো
” আমাকে একা থাকতে দিন! যান এখান থেকে প্লিজ!” নিশাদ শান্ত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চলে গেলো। নিশাদ যেতে যেতেই রিধিশা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। ফ্লোরে কেউ নেই এখন সবাই অফিসের ক্যান্টিনে চলে গিয়েছে। রিধিশা কিছুক্ষণ কাঁদার পর কান্না থেমে যায় ধীরে ধীরে। চোখ মুছে কাজ করতে থাকে। খুধা পেলেও যাবে না সে।
নিশাদ বার্গারের প্যাকেটে একটু আওয়াজ করে টেবিলের উপর রাখে। হাতে থাকা আরেকটা বার্গার খেতে খেতে বললো
” উমম, আজকের বার্গারের টেস্ট’টা অন্যরকম লাগছে একদম। একজনের জন্য এনেছিলাম। খুধা পেলে খেতে পারে।” রিধিশা কোণা চোখে তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নিলো।
নিশাদ বার্গার’টা রিধিশার দিকে ঠেলে দেয়। রিধিশা মুখ ফুলিয়ে নিয়ে খেতে থাকে চুপচাপ। নিশাদ হালকা হাসলো।
কিছুক্ষণ পর ব্রেক টাইম শেষ হতেই একে একে সবাই এসে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এক ঘণ্টা পর বিজয় স্যার আসে। ফ্যামিলি প্রবলেমের জন্য আজকে অফিসে আসতে পারেননি মাত্রই এসেছে। বিজয় স্যার এসেই নিশাদকে কেবিনে যেতে বললো। নিশাদ কয়েকটা ফাইল নিয়ে চলে যায়।
“মিস রিধিশা!” রিধিশা চোখ তুলে সামনে তাকিয়ে দেখে নিশাদের বয়সি একজন ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। রিধিশা দাঁড়িয়ে বললো
” জি, কে আপনি?” ছেলেটা উত্তরে ইতস্তত করে বললো
” আ আমি সাওন। একটু হেল্প করতে পারবেন? আমি আসলে আজকে নতুন। কাউকে বলতে পারছি না তাই আর কি।” রিধিশা মিহি হেসে বলল
” ইটস ওকে, বলুন কি সমস্যা?” সাওন খুশি হয়ে একটা ফাইল দেখিয়ে সমস্যা বের করে দেখায়। রিধিশা সাওনকে তার সমস্যা বুঝিয়ে বলতে থাকে।
এরমাঝে নিশাদ বিজয় স্যারের কেবিন থেকে বেরিয়ে আসে। নিজের কেবিনের কাছে এসে রিধিশা আর সাওনকে দেখে। রিধিশাকে হাসি মুখে কথা বলতে দেখে মাথার ভেতর আগুন জ্বলে উঠে।
“এতোক্ষণ ধরে এই মেয়ের সাথে কথা বললাম তখন কান্না ছাড়া কিছু করলো না আর এখন কথা বলার আগেই হাসি ফুটছে?” নিশাদ মনে মনে কথা গুলো ভেবে দাঁতে দাঁত চেপে দুজনের কাছে গেলো।
দুজনের সামনে দাঁড়িয়ে রিধিশার উদ্দেশ্যে বললো
” কি করছো এখানে?” রিধিশা সাওনের ফাইল দেখিয়ে বললো
” এখানে একটু সমস্যা হচ্ছিলো বুঝিয়ে দিচ্ছি।”
নিশাদ সাওনের দিকে তাকিয়ে জোরপূর্বক হেসে বললো
” বুঝেছো তো? নাকি আমি বুঝিয়ে দেবো?” সাওন মাথা নেড়ে বললো
” বুঝেছি। রিধিশা অনেক ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছে।” নিশাদ দাঁতে দাঁত চেপে হেসে রিধিশার দিকে একপলক তাকিয়ে আবার সাওনের দিকে তাকিয়ে বললো
” খুব ভালো। এরপর কোনো সমস্যা হলে আমাকে বলবে।” সাওন মাথা নেড়ে চলে গেলো।
নিশাদ রেগে রিধিশার টেনে এনে চেয়ারে বসিয়ে দিলো। রিধিশা রেগে বললো
” আরে! কি ধরনের অসভ্যতাম এটা?” নিশাদ রিধিশার দিকে ঝুকে রেগে বললো
” অসভ্যতাম কাকে বলে সেটা ভালো করে দেখিয়ে দেবো সুযোগ পেলে। এতো কিসের হেসে হেসে কথা বলছিলে ওই ছেলের সাথে? আমি এতোক্ষণ ধরে কথা বলার চেষ্টা করছি কথা তো দূড় কান্নাই বন্ধ করলে না। আবার নামও বলে দিয়েছে রিধিশা।”
রিধিশা নিশাদের হাতে কলমের গুঁতো দিয়ে বললো
” কোন পাগলা গারদের পাগল আপনি? কলিগের সাথে কি রেগে রেগে কথা বলবো নাকি? আর চোখ কি বাড়ির আলমারিতে গুছিয়ে রেখে এসেছেন? সবার গলার আইডি কার্ড চোখে পড়ে না আপনার? আমি কারো সাথে কথা বললে আপনার সমস্যা কি?একদম এসব নাটকীয় কাহিনী করবেন না!”
নিশাদ মুখ ফুলিয়ে রেখে বললো
” আমি ছাড়া তুমি কারো সাথে কথা বলবে না। ঝগড়া করলেও আমার সাথে করবে, মারামারি, হাসি-মজা কান্না করলেও আমার সাথেই করবে। অন্য কারো সাথে না বুঝেছো?” রিধিশা সরু দৃষ্টিতে তাকায়। নিশাদ গা ঝেড়ে গম্ভীর হয়ে বললো
” তাকিয়ে আছো কেনো? কাজ করো! আর সিনিয়র এর কথা শুনতে হয়। আমি সব জায়গায় তোমার সিনিয়র।” রিধিশা মুখ বাঁকিয়ে কাজে মন দেয়।
___________
টিউশনি পড়াতে এসে আজকে নিশাদকে দেখতে পেলো না কোথাও।
আজকে ভার্সিটিতে এসে ক্লাসে অপেক্ষা করছিলো। জোতি ক্লাসে এসেজ একটা ব্যাগ ধরিয়ে দিলো রিধিশার হাতে। রিধিশা ভ্রু কুঁচকে বললো
” কি এটা?” জোতি মেকি হেসে বললো
” তোর জন্য সারপ্রাইজ। বাসায় গিয়ে দেখবি কেমন?”
রিধিশা ব্যাগ এদিক ওদিক করে দেখে বললো
” সারপ্রাইজ কিসের? আর এতো ভারী কেনো ব্যগটা? আমার তো বার্থডেও না আজকে।”
” আরে বার্থডে ছাড়া কি গিফট সারপ্রাইজ দেওয়া যায় না নাকি?”
” আচ্ছা বাবা বুঝেছি।”
ছুটির পর লেকের পার এসে কৃষ্ণচূড়া ফুল কুড়িয়ে নিলো আজকে অনেক গুলো। রিধিশা বারবার চারপাশে তাকাচ্ছিল নিশাদের খোঁজে কিন্তু কোথাও দেখা নেই তার।
বাসায় এসে ফুলগুলো দিয়ে একটা ক্রাউন বানিয়ে মাথায় পড়লো। তারপর জোতির দেওয়া ব্যাগটা খুললো। ব্যাগ খুলতেই রিধিশা চোখ বিস্ময়ে ছেয়ে যায়। লাল টুকটুকে একটা ভারী কাতান শাড়ি। রিধিশা সাথে সাথে জোতি’কে ফোন করলো।
“কিরে এসব কি দিয়েছিস? লাল বেনারসি? আজকে কি আমার বিয়ে নাকি? এসব কেন দিয়েছিস?”
জোতি হেসে বললো
” আরে এমনি দিয়েছি। আমার অনেক ইচ্ছে হচ্ছিলো তোকে কিছু গিফট দেই তাই দিয়েছি। আজকে অফিসে পড়ে যাবি কিন্তু এটা!” রিধিশা চোখ বড় বড় করে বললো
” কি! এটা পড়ে অফিসে যাবো? আমাকে দেখলে সবাই বলবে বিয়ে করতে গিয়েছি অফিসে। তোকে মনে হচ্ছে ডক্টর দেখাতে হবে। এটা কেমন অদ্ভুত রকমের ইচ্ছা তোর? গিফট দেওয়ার ইচ্ছে হলে কাজের কিছু দিতি! আমার বিয়ে কোন কালে হবে সেটাও জানি না। এতোদিনে তো এই শাড়ি’টা ইঁদুরের পেটে চলে যাবে।”
” ধুর তুইও না বেশি বেশি ভাবিস। আসল কাজেই লাগবে তুই যা এখন অফিসে যা। যখন দরকার হবে তখন এমনি পড়বি তুই।”
জোতি কল কেটে দিলো। টু টু শব্দ শুনে রিধিশা মুখ লটকিয়ে রাখে।
ব্যাগ থেকে আরো জিনিস বের করলো। শাড়ির সাথে খুব সুন্দর কিছু অর্নামেন্স রয়েছে। রিধিশা সব গুছিয়ে রেখে বেরিয়ে গেলো অফিসের উদ্দেশ্যে।
চলবে……