কুঁড়েঘর পর্ব-৪১

0
471

#কুঁড়েঘর
#লেখিকা–মার্জিয়া রহমান হিমা
[ দ্বিতীয় পরিচ্ছদ ]
। পর্ব ৪১।

অনেক ভাবনা চিন্তার পর দুই পরিবার রিধিশা আর নিশাদের বিয়ে’টা মেনে নেয়। হৃদ মানতে না চাইলেও জোড় করেই মানানো হয়েছে তাকে। নিশাদের মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ হলেই দুজনের অনুষ্ঠানিক ভাবে বিয়ে দেওয়া হবে আবার।

নিশাদ রিধিশার পাশে বসে পাবজি খেলছিলো। রিধিশা বারবার নিশাদের দিকে তাকাচ্ছে কিন্তু নিশাদের খেয়াল নেই। রিধিশা এবার বিরক্ত গলায় বললো
” অফিস নেই আপনার? এখানে বসে গেইম না খেলে অফিসে যান না!” নিশাদ মুখ তুলে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো
” তোমার সমস্যা কি? আমার যা ইচ্ছে তাই করবো আমি। গতকাল মাত্র বিয়ে করলাম আজই অফিসে চলে যাবো?”

রিধিশা রেগে বললো
” তো কি করবেন আপনি? এখানে কি বিয়ের অনুষ্ঠান হচ্ছে নাকি যে অফিসের কাজকর্ম রেখে বসে থাকবেন?”
” তো চলে যাওয়ার মতোও পরিস্থিতি না এখন, ওকে?
একে তো তুমি অসুস্থ তার উপর ভেতরে যে গবেষণায় বসেছে কতোক্ষণ হলো কোনো খবর নেই! এখন যদি ভেতরে তোমার ভাই বিয়ে না মানার বদলে খুনাখুনি করে বসে তখন কে দেখবে?”

রিধিশা চোখ বড় বড় করে রাগি গলায় বললো
“এই আপনার সমস্যা কি? আমার ভাইয়া আসার পর থেকে আপনি ওর পেছনে পড়ে আছেন কেনো? আমার ভাইয়া খুনাখুনি করবে কোন দোষে?”
নিশাদ হাই তুলে বললো
” করতেই পারে। আমার সাথে তো দু দণ্ড ভালো করে কথা বললো না।” রিধিশা ভেংচি কাটে। ঠুসঠাস করে দরজা খুলে জোতি, রেহান, সূর্য, সাদি ঢুকে গেলো।

জোতি খুশিতে আত্মহারা হয়ে বললো
” রিধি! তোমাদের বিয়ে সবাই মেনে নিয়েছে। আর তোদের বিয়ে হবে আবার।” রিধিশা চমকে যায়
” আবার বিয়ে মানে?” রেহান হেসে বললো
” নিশাদের মাস্টার্স শেষ হলে তোমাদের বিয়ের প্রোগ্রাম করবে।” রিধিশা নিশাদের দিকে তাকিয়ে বললো
” প্রোগ্রামের কি দরকার? বিয়ে তো হয়েই গিয়েছে।”

জোতি চোখ বড় বড় করে বললো
” প্রোগ্রামের দরকার নেই মানে? তোর বিয়েতে নাচ,গান করবো না? বরযাত্রী যাবো না নাকি? আমার বোন+বান্ধুবির বিয়ে আনন্দ করবো না?”
সাদি সায় দিয়ে বললো
” হ্যা! আমরাও তো অধীর আগ্রহে বসে আছি। আমাদের বিষাদ ভাইয়ের বিয়ের জন্য। প্রোগ্রাম তো হতেই হবে নাকি ভাবি ডাকবো না।” সূর্য হাসতে হাসতে বললো
” তোর ভাবি ডাক শোনার জন্য কেউ বসে নেই। আমরা আছি ভাবি ডাকার জন্য। কিন্তু বিয়ের প্রোগ্রাম হবেই।”

নিশাদ কলার ঠিক করতে করতে গলা ঝেড়ে বললো
” সব আমার বাবার জন্য বুঝলি! কতো সহজে বিষয়টা হেন্ডেল করে নিয়েছে।” জোতি দাঁত কেলিয়ে বললো
” রিধির বাবারও রয়েছে! আংকেল এর বন্ধুর বড় ভাই আপনার বাবা।” নিশাদ অবাক হয়ে যায়। মুখ ভোতা করে নেয়। রিধিশা ঠোঁট চেপে হাসে।

.
সাজেদা বেগম নিজের পরিবারের মতো দেখা শোনা করছে দুই পরিবারের। রিধিশাকে বেশিই আপন করে নিয়েছিলো সাজেদা আন্টি। দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পর্ব তাদের বাড়িতেই শেষ করে।
হৃদ নিশাদদের সাথে বাইরে থেকে হেটে এসে বোনের
কাছে বসে। রিধিশা প্রায় ঘুমিয়ে পড়ছিল বসে বসে থাকতে থাকতে। হৃদকে দেখে সোজা হয়ে বসে বিরক্ত হয়ে বললো
” উফফ ভাইয়া, আমার বসে থাকতে ভালো লাগছে না। বারবার ঘুম পাচ্ছে।”

হৃদ হেসে বললো
” আর কি করবি? হাটারও তো উপায় নেই। একটু পর বড় আম্মু আর আম্মু এসে তোর ব্যাগ গুছিয়ে দেবে। তুই আমাদের সাথে যাচ্ছিস। আমি ঢাকা ব্যাবসার জন্য থাকি তাই ফ্ল্যাট নিয়েছিলাম। সুস্থ হওয়া পর্যন্ত তুই আম্মু আর আমার সাথে থাকবি। আব্বু আর
আম্মু’কে বাড়িতে পাঠিয়ে দেবো।” রিধিশা আমতা আমতা করে বললো
” এখানেই থাকি না ভাইয়া! ছোট আম্মু নাহয় আমার সাথে থাকবে।”

হৃদ ভ্রু কুঁচকে বললো
” কেনো আমার সাথে গেলে কি সমস্যা?” রিধিশা হচকচিয়ে বললো
” না না তোমার সাথে যেতে সমস্যা হবে কেনো? আমার বলছিলাম কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না তাই আরকি।” হৃদ গম্ভীর গলায় বললো
” ইচ্ছে না করলেও যেতে হবে। রেস্ট কর আমি আসছি।” হৃদ রুম থেকে চলে যেতেই রিধিশা বিড়বিড় করে বললো
” কোন ঝামেলায় পড়বো আবার কে জানে! নিশাদ যদি যেতে না দেয় তাহলে ভাইয়া রাগ করে বসবে। আর ভাইয়া নিয়ে গেলে নিশাদ কি করবে কে জানে?”

কিছুক্ষণ পর নিশাদ আর তার বাবা আসে। রিধিশা তাকে দেখেই উঠে বসে চট করে। মৃণাল সাহেব বললো
” আরে মা উঠছো কেনো? তুমি শুয়ে থাকো। অসুস্থতার সময় কতো বার উঠবে না বসবে!” রিধিশা মাথা নিচু করে থাকে লজ্জায়। মৃণাল সাহেব হেসে বললো
” ছেলের বউ কে দেখা হয়ে গেলো এবার আমাকে চলে যেতে হবে।” রিধিশা মাথা তুলে বললো
” আজই চলে যাবেন? কয়েকদিন থাকুন!”

“না মা অনেক ব্যস্ততার মাঝে সময় করে এসেছি শুধু ছেলের জন্য। ছেলে যে পাগলামো করে বসে মাঝে মাঝে আমাকেই সামলাতে হয় নাহলে আর কে সামলাবে! আজকে চলে যাবো ব্যস্ততা কাটিয়ে উঠলে আবার আসবো নাহয় তোমার শাশুড়িকে নিয়ে।”
রিধিশা মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো। নিশাদ মৃণাল সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললো
” তোমাকে বলেছিলাম নিহান’কে নিয়ে আসতে।”

” আরে তোর ভাই কি বাড়িতে নাকি? হোস্টেল থেকে কিভাবে নিয়ে আসবো? তাও আবার রাতে সব জানতে পেরে ভোর রাতে রওনা দিয়েছিলাম আমি। আনার কোনো সুযোগই ছিলো না।”
মৃণাক সাহেব উঠে বললো
” চল বেরিয়ে যেতে হবে এখনই। রিধিশা মা, খেয়াল রাখবে নিজের। তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাও পরের বার যেকোনো সময়ে আসলে যেনো তোমার হাতের রান্না খেতে পারি।” রিধিশা মিষ্টি হেসে সায় জানায়।
নিশাদ মৃণাল সাহেবকে নিয়ে বেরিয়ে যায়।

.
নিশাদ রেগে বসে আছে কারণ রিধিশাকে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছে। হৃদ নাছোড় বান্দা বোনকে নিয়ে যাবে। তার কথা হলো একা এখানে তার বোনকে কে দেখবে? নিশাদ মুখের উপর না করে দিয়ে বসে আছে। রিধিশার বাবা, মা’রাও নিয়ে যেতে চাইছে। অনেক বোঝানোর পরেও নিশাদ রাজি হচ্ছে না। নিশাদ রিধিশাকে তার চোখের আড়াল হতে দেবে না আর যাই হোক।
নিশাদ গমগম স্বরে বললো
” রিধিশা কোথাও যাবে না। বিয়ে যখন করেছি বউ এর সেবাও একা করতে পারবো। তাও সমস্যা হলে মা’কে রেখে যেতে পারেন কিন্তু রিধিশাকে কোথাও যেতে দেবো না।” বলেই উঠে ধুপধাপ পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।

হৃদ বাবার উদ্দেশ্যে বললো
” দেখেছো কেমন নাছোড়বান্দা ছেলে? বড়দের কোথাও শুনছে না।” শফিক উদ্দিন গা ছাড়া ভাবে বললো
” নিশাদ কেমন ছেলে সব খবর নিয়েছি। বউকে একা ছাড়বে না এটাই আসল কথা। তুমিও বিয়ে করলে এমন করবে সমস্যা নেই। ছেলে জাতি’টাই নারীর টানে চলে। বউ প্রতি টান ভালোবাসা থাকলে স্বাভাবিক এসব।” হৃদ আড়চোখে বাবার দিকে তাকালো।
রিধিশার চিন্তায় চুপটি মেরে বসে ছিলো। বাবার কথা শুনে হাসি পায়।
লিমা বেগম আর সাদিয়া বেগমের শফিক উদ্দিনের উদ্দেশ্যে তাকানো দেখেই তিনি চুপ করে গেছেন।

শেষ পর্যন্ত ডিসিশন হয় লিমা বেগম রিধিশার সাথে থাকবে রিধিশা সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত। আর বাকিরা চলে যাবে। নিশাদ আবার আসতেই তাকে জানানো হয়। নিশাদ সস্তির নিশ্বাস ফেলে।

______________

ব্যস্ততার মাঝে দিনগুলো চোখে পলকে মিলিয়ে যায়। ১৫ দিন পেড়িয়ে গিয়েছে এর মাঝেই। রিধিশার এতোদিনে সুস্থ পুরোপুরি। পা কয়েকদিনেই ঠিক হয়ে গিয়েছিলো। ভাঙ্গা হাত ঠিক হতে অনেক দিন লেগেছে। নিশাদ রিধিশার ছুটি নিয়েছিলো অফিস থেকে। ১০ দিন পর থেকে রিধিশা অফিসে গিয়েছে। এক হাত দিয়েই কাজ করার চেষ্টা করেছে আগে কিন্তু এখন হাত ঠিক হয়ে গিয়েছে।
হৃদ দুদিন পর পর এসে দেখে যেতো রিধিশাকে। নিশাদের সাথে সম্পর্কটাও কিছুটা ভালো হয়েছে।
লিমা বেগমের সাথেও নিশাদ আর সূর্যদের সম্পর্ক গাড় হয়েছে। লিমা বেগম আর নিশাদ এখন মা ছেলের মতোই।

আজকে লিমা বেগম চলে যাচ্ছে। তৈরিও হয়ে বসে আছেন রিধিশা তাকে আটকে রেখেছে। যদিও হৃদ আসছে তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
লিমা বেগম রিধিশার মাথা হাত বুলিয়ে বললো
” নিশাদের সাথে ঝগড়া করবি না এতো। তোরা বেশিই ঝগড়া করিস। মিষ্টি মিষ্টি করে ভালোভাবে কথা বলবি। কিছু খেতে চাইলে রেঁধে দিবি। দুটো যেভাবে ঝগড়া করিস মাঝে মাঝে আমি ভয় পেয়ে যাই।”

রিধিশা ফিক করে হেসে দেয়। লিমা বেগম কড়া গলায় বললো
” হাসিস না, সত্যিই বলছি। তবে ছেলেটা কতো ভালো দেখেছিস! তোর সাথে ঝগড়া করে চলে যায় আবার একটু পর এসেই তোর খবর নেই। ঔষধ, খাবার খেয়েছিস কিনা। কতো যত্ন করে।”
” তুমি দেখি নিশাদের গল্পের ঝুড়ি নিয়ে বসেছো। এক কাজ করো নিশাদকে নিয়ে চলে যাও।”
“পারলে তো নিয়ে চলেই যেতাম।” দুজনের কথার মাঝে নিশাদ আর হৃদ আসে। হৃদ ঢুকেই বললো
” মা চলো!” রিধিশা অবাক হয়ে বললো
” চলো মানে কি? ভালো করে তো রুমেও ঢুকলে না। এখনই চলো বলছো!” হৃদ ব্যস্তার সাথে বললো
” বসার সময় নেই। একটু পর আবার আমার মিটিং রয়েছে একটা। সময়ের মধ্যে পৌঁছতে হবে।”

রিধিশা রেগে বললো
” তাহলে আজকে আসার দরকার কি ছিলো? কালকে আসলেই পারতে। এতোদূড় থেকে এসে একটু বসছোও না!” হৃদ এগিয়ে এসে রিধিশাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে বললো
” রাগ করিস না। মিটিং টা কালকে ছিলো কিন্তু ক্লাইন্ট এর একটু সমস্যা হওয়ায় সকালে জানিয়েছে আজকেই হচ্ছে সেটা তাই এতো তাড়া। আমি তো আবার আসবোই। তুই বললেই চলে আসবো। ” হৃদ আর লিমা বেগম বিদায় নিয়ে বেরিয়ে যেতেই রিধিশা নাক ফুলিয়ে কেঁদে দেয়।

নিশাদ রিধিশাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে। রিধিশা নিশাদের বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে থাকে। নিশাদ রিধিশাকে কান্না থামানোর জন্য সান্তনা দিতে থাকে। নিশাদের নিজেরও মন খারাপ লিমা বেগম চলে যাওয়ায়। রিধিশার কান্না কমার নাম গন্ধ দেখলো না। কাঁদতে কাঁদতে হিচকি উঠিয়ে ফেলেছে। নিশাদ এবার মুখ কুঁচকে বললো
” ইশশ! কি করলে বলো তো! কাঁদতে না করলাম না আমি? অফিসে যাবো একটু পর আর তুমি আমার শার্টটা নষ্ট করে দিলে?”

রিধিশা মুখ তুলে তাকায়। নিশাদের দিকে তাকিয়ে মুখ ফুলিয়ে ধাক্কা দিয়ে দূড়ে সরে গেলো। কান্না ভেজা চোখে রেগে বললো
” আমি কষ্টে কাদছি আর আপনি শার্ট নিয়ে পড়েছেন?” নিশাদ দাঁত কেলিয়ে বললো
” জি ম্যাডাম। আপনার কান্না থামানোর জন্যই।” রিধিশা মুখ ফুলিয়ে নাক টেনে চোখ মুছতে থাকে। নিশাদ কোমড়ে হাত রেখে রাগ দেখিয়ে বললো
” এখন! আমার শার্ট ভিজিয়ে দিয়েছো তোমার চোখের পানিতে। ভেজা শার্ট পড়ে যাবো?’

রিধিশা মুখ বাঁকিয়ে বললো
” কেনো আপনার জ্যাকেট কোথায়? জ্যাকেট পড়েন।” নিশাদ রাগি চোখে তাকিয়ে
” অফিসে জ্যাকেট পড়ে যাবো? বুদ্ধির দরজা বন্ধ করে রেখেছো? স্যার দেখলে বকবে জানো?” রিধিশা বিরক্ত গলায় বললো
” উফফ মহা জ্বালা তো! একদিন জ্যাকেট পড়লে আপনার চাকরি তো আর খেয়ে ফেলবে না! বলবেন আপনার জ্বর উঠেছে, ঠিকাছে।” নিশাদ গলা ঝেড়ে বেরিয়ে গেলো। রিধিশাও রুম লক করে অফিসের জন্য বেরিয়ে গেলো।

চলবে…….