কুঞ্জলতার মায়ায় পর্ব-০৩

0
252

#কুঞ্জলতার_মায়ায়
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
#পর্বঃ০৩

শুভ্রতার পাশে কাব‍্য এসে দাড়ালো। শুভ্রতা সেইদিকে পাত্তা না দিয়ে তাকিয়ে রইলো আকাশের দিকে। কাব‍্য গলা পরিষ্কার করে বলল
-“তোমার বাবা এখন কেমন আছেন?”

শুভ্রতা কাব‍্যের দিকে না তাকিয়েই বলল
-“আগের থেকে একটু ভালো আছে।”

কাব‍্য আকাশের দিকে বলতে লাগলো
-“দেখো শুভ্রতা আমি সবসময় পরিষ্কার করে সব বলতে পছন্দ করি। তুমি জানো আমি ইশিতাকে ভালোবাসি। তারপর তোমাকে কেন বিয়ে করলাম জানতে চাইবে না।”

শুভ্রতা ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটিয়ে বলে উঠলো
-“আমি আর কি জানতে চাইবো বলুন। আমার কথার আবার কোনো গুরুত্ব আছে নাকি। যে যেইদিকে যেতে বলবে আমার তো সেইদিকেই যেতে হবে।”

কাব‍্য এক পলক শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে আবার আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো
-“তোমার বাবা আমাদের অনেক বড় সহযোগিতা করেছে। আমাদের বিজনেসে যখন অবস্থা খুব খারাপ ছিল। তখন ওনিই আমাদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। কাল যখন তোমার বাবা অসুস্থ হয়ে যায় তোমার মায়ের অবস্থাও খারাপ হয়ে যায় তখন আমার মা আমাকে তোমাকে বিয়ে করতে বলে। আমি ইশিতাকে ভালোবাসি বলেই রাজি ছিলাম না। পরে আম্মু বলে আমি যদি তোমাকে এখন বিয়ে না করি তাহলে আম্মুর মরা মুখ দেখবো। এই কথা শোনার পর আমি কিছুই করতে পারিনি। আমার বিয়ের কথা শুনে রাতে ইশিতা এক্সিডেন্ট করে। রাতে হাসপাতালেই ছিলাম। আম্মু তোমার সঙ্গে খারাপ ব‍্যবহার করতে নিষেধ করে। তোমাকে কিছু বলারও সুযোগও পাই নি।”

শুভ্রতা কাব‍্যের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো
-“তো কি ডিভোর্স চাইছেন নাকি। বলে দিতে পারেন আমি কিছু মনে করবোনা।”

কাব‍্য ফুস করে একটা নিশ্বাস ছেড়ে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল
-“না আমি এমন কিছুই করবোনা। কারণ আমি ইশিতাকে ভালোবাসি। ইশিতা না ওর তো আরো ভালোবাসার মানুষও আছে। শুধুমাত্র টাকার জন‍্য ও আমার সঙ্গে ছিল ভাবতেই নিজের উপর হাসি আসে আমার। আমি কতটা বলদ। এতোদিন বোকা বানিয়ে গেছে আমাকে ওরা। আর আমি বুঝতেও পারিনি।”

কবিতা বেগমের ডাকে দুইজনই পিছনে ফিরে তাকালো। কবিতা ‍বেগম ওদের কাছে এগিয়ে এসে দুইজনের কাধে হাত রেখে হাসিমুখে বললেন
-“দেখ আল্লাহ উত্তম পরিকল্পনাকারী। উনি যা করেন ভালোর জন‍্যই করেন। দেখ শুভ্রতা তোর জন‍্য শিশির ঠিক ছিল না। আর কাব‍্য তোর জন‍্য ইশিতা ঠিক ছিল না। সেইজন‍্যই তো ভাগ‍্য তোদের এক করে দিয়েছে। এতদিন তো নিজের মন মতো জীবন চালিয়েছিলি। এবার জীবনকে জীবনের মতো চলতে দে। দেখ না কি হয়।”

বলেই হেসে চলে গেলেন কবিতা বেগম। কাব‍্য শুভ্রতা দুইজন দুইজন‍ের দিকে তাকালো।

হাওয়ার বেগ বাড়ার সাথে সাথে শুভ্রতার চুলও উড়ছে সেই বেগে। কাব‍্য তাকিয়ে আছে শুভ্রতার দিকে। সে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল
-“সরি,শুভ্রতা। সকালের কথায় তুমি কষ্ট পেয়েছো। কথাগুলো বলার আগে আমার ভাবা উচিত ছিল।”
শুভ্রতা কিছু বলল না। মেঘ ডাকতেই কাব‍্য শুভ্রতার হাত ধরে বলল
-“চলো এখন নিচে যাই বৃষ্টি আসবে।”

বলতে বলতেই বৃষ্টি চলে আসলো। শুভ্রতা কাব‍্যের দিকে তাকিয়ে বলল
-“ভিজে তো গিয়েছেই। একটু ভিজিই না হয় আজ।”

কাব‍্য শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে আর না করতে পারলো না। হাত ছেড়ে দিলো শুভ্রতার। কাব‍্য দাঁড়িয়ে রইলো বুকে হাত গুজে।

শুভ্রতা খুশি হলো কাব‍্যের হাত ছেড়ে দেওয়ায়। শুভ্রতা নিজের দুই হাত দুইপাশে প্রসারিত করে মুখ‍টা আকাশের দিকে মেলে দিয়ে চোখ বুজে নিলো। অনুভব করতে লাগলো বৃষ্টির প্রতিটা পবিত্র স্পর্শ।

কাব‍্য মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে শুভ্রতার দিকে। কোথায় আগে তো এতো সৌন্দর্য সে দেখেনি শুভ্রতার। তবে আজ কেন এমন অনুভব হচ্ছে তার।

শুভ্রতা হাঁচি দিতেই কাব‍্যের ভাবনায় ছেদ ঘটলো। কাব‍্য এগিয়ে গিয়ে শুভ্রতার হাত ধরলো। হাত ঠান্ডা দেখে কাব‍্য রাগান্বিত কন্ঠে বলল
-“বৃ‍ষ্টিতে ভিজতে দিছে বলে এতো কেন ভিজতে হবে। এখন যদি জ্বর আসে তখন কি হবে। হাত কতো ঠান্ডা হয়ে গেছে দেখছো। চলো এখন।”

শুভ্রতা কিছু বলতে নিবে তার আগেই কাব‍্য ওকে থামিয়ে দিয়ে ‍বলল
-“আর কোনো কথা শুনতে চাই না। চলো এখন পরে জ্বর আসলে আম্মু তো আমাকে দোষ দিবে।”

কাব‍্য হাত ধরে নিয়ে যেতে লাগলো শুভ্রতাকে। শুভ্রতা চুপচাপ মাথা নিচু করে যেতে লাগলো।

বাসায় আসতেই দেখতে পেলো কবিতা বেগম কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। কাব‍্য আর শুভ্রতা দুইজনই অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে আছে মাথা নিচু করে।

কবিতা বেগম রাগান্বিত কন্ঠে বলল
-“তোরা কি এখনো ছোট আছিস। বৃষ্টিতে এতো সময় ভিজছিস যে জ্বর আসলে কি হবে।”

বলতে দেড়ি কিন্তু দুইজনের হাঁচি দিতে দেড়ি হলোনা। কাব‍্য আর শুভ্রতা দুইজন দুইজনের দিকে তাকালো। কবিতা বেগম ধমক দিয়ে বলল
-“যা তোরা ফ্রেশ হয়ে আয় তাড়াতাড়ি। আমি কফি বানাচ্ছি দুইজন খাবি।”

দুইজনই রুমে চলে গেল। কাব‍্য কাপড় নিয়ে শুভ্রতাকে বলল
-“এই রুমের ওয়াশরুমে তুমি ফ্রেস হয়ে নেও। আমি ‍পাশের রুম থেকে ফ্রেশ হয়ে আসছি।”

শুভ্রতাও কাব‍্যের কথায় সম্মতি দিয়ে চলে গেল ওয়াশরুমে।

————————

রাত হয়ে গেছে। শুভ্রতার জ্বর এসেছে। কাব‍্যের একটু সর্দি লেগেছে। কবিতা বেগম দুইজনকেই খাইয়ে দিয়ে ঔষধ খাইয়ে দিলো। কবিতা বেগম কাব‍্যকে শুভ্রতার খেয়াল রাখতে বলে চলে গেলেন। আর কোনো সমস্যা হলে তাকে ডাকতে বলে গেছেন।

কাব‍্য বারান্দায় গিয়ে দাড়ালো। বৃষ্টির পানিতে বারান্দায় থাকা বেলিফুলের আর কুঞ্জলতার গাছ‍টা ভিজে এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশ তৈরি করেছে। শিশির বিন্দুর ন‍্যায় ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির পানি গাছগুলোর পাতা বেয়ে চুয়ে চুয়ে পড়ছে। কাব‍্য খেয়াল করলো আজ অন‍্যদিনের চেয়ে বেলি ফুল অনেকটা বেশিই ফুটেছে। কাব‍্য অনেকক্ষণ যাবত এই মনোমুগ্ধকর পরি‍বেশ উপভোগ করলো। এখন চোখটা লেগে এসেছে তার।

কাব‍্য বারান্দা থেকে রুমে আসতেই দেখলো শুভ্রতা ঠান্ডায় কাঁপছে। কাব‍্য কার্বাট থেকে একটা কম্বল বের করে শুভ্রতার গায়ে দিয়ে দিলো। শুভ্রতা কম্বলটা টেনে আরামে ঘুম দিলো। কাব‍্য ওর কপাল চেক করে দেখলো এখন শুভ্রতার জ্বর অনেকটাই কম। কাব‍্য সস্থির নিশ্বাস ছেড়ে নিজের কম্বল নিয়ে সোফায় গিয়ে শুয়ে পরলো।

————————–

সকাল থেকে টেনশনে শুভ্রতা খানাপিনা বাদ দিয়ে বসে আছে। কবিতা বেগম অনেকবার চেষ্টা করেছে শুভ্রতাকে খাওয়ানোর কিন্তু শুভ্রতা কিছুতেই খাচ্ছেনা। অন‍্যদিকে কাব‍্য বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। যতো সময় যাচ্ছে শুভ্রতার কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে গেছে। এইদিকে কাব‍্যের ফুপু মুখ বাঁকিয়ে সবার সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছে।

কবিতা বেগমের ফোন বেজে উঠতেই দেখলো শুভ্রতার মা বাবা ভিডিও কল দিয়েছে। ওনি রিসিভ করে কথা বললেন। শুভ্রতাকে কথা বলতে দিলেই শুভ্রতা টেনশনে কান্না করে দেয়। শুভ্রতা এমন অবস্থা দেখে সবাই থতমত খেয়ে যায়।

শুভ্রতার এমন অবস্থা দেখে কাব‍্যের ছোট ভাই কিরণের এখন টেনশন ধরে গেছে। সামনের বার ওর পরীক্ষা তা যেন ভুলেই গেছে। মনে হচ্ছে ওর রেজাল্ট দিবে।

কবিতা বেগম শুভ্রতাকে সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছে। এমন সময় কাব‍্য হাম পারতে পারতে উঠে এসে এই পরিস্থিতি দেখে থতমত খেয়ে যায়। পরক্ষণেই বিষয়টা বুঝতে ‍পেরে কাব‍্য গিয়ে শুভ্রতার পাশে বসে। শুভ্রার ডান হাত নিজের দুই হাতের মধ্যে আবদ্ধ করে ধীর কন্ঠে বলল
-“শান্ত হও শুভ্রতা। আমি জানি এখন তোমার এক অন‍্যরকম অনুভূতি হচ্ছে। কিন্তু দেখো তুমি যদি এখন আশা অনুরূপ ফল না পেয়ে ভেঙে পড়ো। তাহলে আল্লাহ নারাজ হবে তোমার প্রতি। তিনি জানেন তোমার জন‍্য কোনটা ভালো। আর আমি বিশ্বাস করি তোমার রেজাল্ট ভালো হবে। কারণ তুমি ভালো স্টুডেন্ট। আর আল্লাহ তোমাকে নিরাশ করবেনা দেখে নিও।”

কাব‍্যের কথাগুলো শুনে কিছুটা ভরসা পেলো শুভ্রতা। চোখ বন্ধ করে চুপ করে রইলো সে।

কাব‍্য দীর্ঘশ্বাস নিয়ে শুভ্রতার রেজাল্ট দেখার ল‍্যাপটপটা নিয়ে এলো।

কাব‍্য একবার মায়ের দিকে তাকিয়ে শুভ্রতার দিকে তাকালো। একদিনের জ্বরে আর রেজাল্টের টেনশন মেয়েটার দিকে তাকানো যাচ্ছেনা।

অনেকক্ষণ কারো কোনো শব্দ না পেয়ে শুভ্রতা পিটপিট করে চোখ খুলল। সামনে তাকাতেই দেখলো সবাই ওর দিকে তাকিয়ে আছে। শুভ্রতার হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে চলছে। সে এক করুন দৃষ্টি কাব‍্যের দিকে রাখতেই কা‍ব‍্য হেসে দিলো।

কাব‍্যের হাসি দেখে শুভ্রতার যাই যাই অবস্থা। কাব‍্য এবার জোরেই হেসে দিলো আর বলল
-“আরে পাগলি এবার টেনশন করা বন্ধ করে দেও। তুমি GPA 5 পেয়েছো।”

শুভ্রতা যেন নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছেনা। সবাই একসঙ্গে আলহামদুলিল্লাহ্ ‍বলে উঠলো। শুভ্রতার বাবা মা দুইজনই ভিডিও কলে ছিলো দুইজনের মুখেই হাসি।

শুভ্রতা খুশিতে আলহামদুলিল্লাহ্ বলে কান্না করে দিলো। কাব‍্য শুভ্রতাকে বলল
-“বলে ছিলাম না ভালো করবে। এখন যাও কিছু খেয়ে নেও। চোখমুখের কি অবস্থা করেছো। খাওয়া শেষে আল্লাহর কাছে শুকিয়ে আদায়ের জন‍্য দুই রাকাত নফল নামাজ পড়বে।”

কাব‍্যের ফুপু রেগেমেগে উঠে গেল। ওনার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে সবাই হেসে দিলো।

#চলবে