কুড়িয়ে পাওয়া ধন পর্ব-২৮+২৯

0
280

#কুড়িয়ে_পাওয়া_ধন
#পার্ট_২৮
জাওয়াদ জামী

সারারাত কান্তা দুচোখের পাতা এক করতে পারেনা। অপরপাশে শোয়া মানুষটার চোখমুখ দেখে ওর কিছুতেই ঘুম আসছেনা। মানুষটা ওকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে আছে ঠিকই কিন্তু তার ভেতরে ভেতরে কিছু একটা হচ্ছে। যা সে মুখে প্রকাশ করছেনা।

” কান্তা, তুমি এখনও জেগে আছ। রাত গভীর হয়েছে। এখন একটু ঘুমাও। আমাদের খুব সকালেই বের হতে হবে। ” ম্লান গলায় বলল আরমান।

” আপনাকে এভাবে জাগতে দেখে, আমি কি করে ঘুমাব। আগে আপনি ঘুমান, পরে আমি ঘুমাচ্ছি। আর তা যদি না করেন, তবে আজ নাহয় দুজন একসাথে জেগে রইলাম। ”

” আমার চোখে আজ ঘুম আসছেনা। তুমি এমন পাগলামি না করে ঘুমাও। গ্রামে গিয়ে ঘুমানোর সুযোগ পাবেনা। ”

” আপনি কি আমাকে খুব স্বার্থপর মানুষ ভাবেন! যেখানে আপনার চোখে ঘুম নেই। সেখানে আমি কিভাবে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারি! একটা রাত জাগলে আমার কিছুই হবেনা। আচ্ছা, আমি আপনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে আপনার ঘুম আসবেনা? দেখি ভালো ছেলের মত এবার চোখ বন্ধ করুনতো। আমি আপনার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছি। দেখবেন আপনার ভালো লাগবে। ” কান্তা আরমানকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে, বিছানা থেকে নেমে ড্রেসিং টেবিল থেকে নারকেল তেলের বোতল এনে ওর মাথায় হালকা করে তেল দিয়ে ম্যাসাজ করতে থাকে।
আরমান অনেকবার নিষেধ করলেও শোনেনা। এভাবে অনেকক্ষণ যাবৎ মাথায় হাত বুলায় কান্তা। এক সময় লক্ষ্য করল আরমান ঘুমিয়ে পরেছে। আরও কয়েক মিনিট আরমানের চুলে বিলি কাটে কান্তা। এরপর নিজেও শুয়ে পরে। আস্তে আস্তে পাড়ি দেয় ঘুমের দেশে।

ভোর হতেই কান্তা হুড়মুড়িয়ে উঠে বসে। আজ ওদের গ্রামে যেতে হবে।
বিছানা থেকে নেমে সোজা ওয়াশরুমে ঢোকে। কিছুক্ষণ পর অজু করে বেরিয়ে আসে।
মেঝেতে জায়নামাজ বিছিয়ে দাঁড়িয়ে যায় সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্য লাভের আশায়।

নামাজ শেষ করে দেখল আরমানও উঠে গেছে। সে-ও অজু করে এসে কান্তার পাশে নামাযে দাঁড়িয়েছে।

খালা ও উঠেছে। সবাই রাতেই গোছগাছ করে রেখেছিল। তাই বের হতে সময় লাগেনা। কান্তা নামাজ পড়ে রান্নাঘরে এসে চায়ের পানি বসায়। এরপর সবার জন্য স্যান্ডউইচ বানায়। যদিও এত সকালে ওরা কেউই খেতে পারেনা। তারপরও স্যান্ডউইচ বানায়। গ্রামে যেতে সময় লাগবে। তাই কিছু খেয়ে বের হওয়াই উত্তম।

ওরা যথাসময়ে গ্রামে পৌঁছায়। সেখানে আরমানের চাচা ওদেরকে আপ্যায়ন করেন। যিনি সম্পর্কে শহিদ আহমেদের চাচাত ভাই। আরমানের চাচা-চাচি ওদেরকে দেখে ভিষন খুশি হয়।
চাচি নানানরকম খাবার রান্না করেছে। ওদেরকে নিজের পাশে বসিয়ে খাইয়েছে। কান্তা অনেকদিন এমন সমাদর কারও কাছ থেকে পায়নি। শুধু ফুপুই ওকে যেটুকু আদর করত, তাতেই ও সন্তুষ্ট থাকত।

খাবার পর রুমে শুয়ে শুয়ে কান্তা ভাবছে, হঠাৎ করে আরমান ওদের নিয়ে গ্রামে আসল কেন? আবার নিজের বাড়িতে না উঠে চাচার বাড়িতে উঠেছে। কি চলছে তার মনে?

ওর কেবলই তন্দ্রাভাব হয়েছে, তখন পাশের বাড়ি থেকে কারও কথার আওয়াজ কানে আসে। পাশের বাড়িটা আরমানদের। সেখানে কেউই থাকেনা। শুধু দেখাশোনার জন্য একজন থাকে, যার জন্য বাড়ির মেইন গেটের পাশে আলাদা রুম আছে।
কান্তা কৌতুহলবশত এক পা দু পা করে রুমের বাইরে আসে। ঐ বাড়িতে কে এসেছে! একবার মনে হল দাদিমার শুনেছে।
পাশাপাশি বাড়ি হওয়ায় দুই বাড়িতে কথা বললেই সবাই শুনতে পায়। দুই বাড়ির সীমানা প্রাচীর একটাই। উত্তর-দক্ষিণ লম্বা বাড়ির দক্ষিণ দিকে মেইন গেট। গেইট পার হলেই বাহিরের উঠান। প্রায় এক বিঘা জায়গা নিয়ে দুই বাড়ির উঠান।
সেখানে আবার অংশীদারও কয়েকজন। আরমানের বাবা একটাই ছেলে হওয়ায় তার ভাগের অংশ বেশি। আর আরমানের সেই চাচার আরও দুইটা ভাই আছে। তারা চাকরির জন্য পরিবার নিয়ে বাইরে থাকে। তারা তিন ভাই এক বাড়িতেই থাকে।
উঠানের কিছু অংশ ফাঁকা রাখা হয়েছে। বাকি জায়গায় আম, লিচু, কাঁঠাল, নারকেল, সুপারি আর সফেদা গাছ শোভা ছড়াচ্ছে। গাছগুলো দেখেই বোঝা যায় এগুলোর নিয়মিত যত্ন নেয়া হয়। উঠানের সীমানা ঘেঁষে কাঁটাতারের বেড়া দেয়া। এরপর শুরু হয়েছে রাস্তা। সেই রাস্তা উত্তর-দক্ষিণ বরাবর চলে গেছে অন্য দিকে।

কান্তা রুমের বাইরে এসে দেখল বাসায় চাচি নেই। তাদের একটা ছেলে ঢাকায় জব করে, মেয়েটা ভার্সিটিতে পড়ে। তাই চাচা-চাচি বাড়িতে একাই থাকেন।
কান্তা এদিকওদিক তাকিয়ে কাউকে না পেয়ে ধীরে ধীরে পা চালায়। ওর একটু ভয় ভয় করছে।ওকে বাইরে যেতে দেখে আরমান যদি কিছু বলে।

ধীরে ধীরে মেইন গেট খুলে বাইরে উঁকি দেয় কান্তা। এই বাড়ির মেইন গেট থেকে আরমানদের বাড়ির মেইন গেটের দূরত্ব কয়েক ফুট হবে। কান্তা বাইরে এসে ওদের বাড়ির মেইন গেটে তাকায়। পরক্ষণেই ওকে নিরাশ হতে হয়। গেট ভেতর থেকে বন্ধ।
ও আবার ভেতরে ঢুকে যায়। এরপর পুরো বাড়ির দিকে নজর দেয়। বাড়ির বাইরে যেমন বড় উঠান, তেমনি বাড়ির ভেতরটাও বিশাল। চারপাশে ঘুরানো বেশ কয়েকটা রুম। কান্তা গুনে দেখল চারপাশ মিলে পনেরটা রুম। উত্তরদিকের একপাশে রান্নাঘর, টিউবওয়েল, গোসলখানা, টয়লেট। খুব সুন্দরভাবে সাজানো বাড়িটা। উত্তর দিকে একটু করিডোর মত আছে। করিডোরের শেষ মাথায় লোহার দরজা লাগানো। কান্তা হাঁটতে হাঁটতে করিডোরের শেষ মাথায় যেয়ে দরজা খুলে বাইরে তাকায়।
সেখানে পশ্চিমদিকে একটা বিশাল পুকুর, পুকুরের চারদিকে কলার বাগান, পূর্বদিকে উত্তর-দক্ষিণ লম্বা আম বাগান, সেখানে কয়েকটা পেয়ারা গাছ, বড়ই গাছ, লেবু গাছও দেখল। বাগানের সীমানা শেষে কাঁটাতারের বেড়া।
পুকুরের পশ্চিম দিকে তাকালে দেখতে পায় বাঁশঝাড়। আরেকটু ভালোভাবে লক্ষ্য করতেই দেখল সেখানে গোরস্থানও আছে।
এখানের চারপাশের পরিবেশ কান্তার ভিষণ ভালো লাগে।
ওর এখন বাগানে যেতে ইচ্ছে করছে। তাই ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিয়ে বাগানে যেয়ে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে, বাড়ির দিকে আসে।
আরমানদের বাড়ির দিকে নজর পড়তেই দেখল, ঐ বাড়ি থেকেও বাগানে আসার রাস্তা আছে।
কান্তা বুঝতে পারে, এই বাগান, পুকুরের মালিক যৌথভাবে ওর শ্বশুর আর চাচা শ্বশুরেরা।

আরমান বাড়িতে নেই। সে খাবার পর কোথায় যেন বেরিয়েছে। এদিকে চাচা-চাচিও নেই। একা একা ওর কিছুই ভালো লাগছেনা।

প্রায় ঘন্টাখানেক পর চাচি বাড়িতে আসলে কান্তা জানতে পারে, ওর শ্বশুর বাড়ির সবাই এসেছে। এবার কান্তার অবাক হওয়ার পালা। চাচি জানালেন, তিনিই তাদের খাবারের ব্যবস্থা করেছেন।

আরমান সন্ধ্যায় বাড়িতে আসে। তার সাথে পাঁচজন মানুষ এসেছে। তারা আরও তিনজনকে ধরে রেখেছে।
এদিকে ঐ বাড়ি থেকে শহিদ আহমেদের গলা শোনা যাচ্ছে। তিনি কারও সাথে কথা বলছেন।

আরমান সেই পাঁচজনকে কিছু বলে, কান্তাকে নিয়ে বাইরে আসে। সাথে চাচিও আছে।

কান্তা অবাক হয়ে আরমানের দিকে তাকায়। সে কান্তার হাত ধরে ওদের বাড়ির দিকে যাচ্ছে।
কান্তার বুক দুরুদুরু করছে। কতদিন পর আবার সবার সাথে দেখা হবে।

ওরা গেইটে ঢুকতেই শহিদ আহমেদের গলা শুনতে পায়।

” ওয়াহাব, তুই আমাদের বললি, তোর মেয়ে ত্বন্বীর বিয়ে আজকে। তাই আমাদের সবাইকে আসতে হবে। আমরাও আসলাম। কিন্তু বিয়ের কোন আয়োজন চোখে পরছেনা। এমনকি তোর মেয়েও নেই। আমরা সেই দুপুরে এসেছি। কিন্তু তোদের বাড়িতে যে বিয়ে, তেমনটা তো মনে হচ্ছেনা! এভাবে আমাদের কেন ডাকলি? জানিসই তো আমি কত ব্যস্ত থাকি। এরপরও তুই এটা কেন করলি? ” শহিদ আহমেদ জানতে চান তার চাচাত ভাইয়ের কাছ থেকে।

কিন্তু তার ভাই কোন জবাব দিতে পারছেনা। তার চোখেমুখে অপরাধবোধ।

” আমি আপনাদের এখানে ডেকেছি। আমিই চাচাকে বলেছি, আপনাদের মিথ্যা বলে ডাকতে। চাচাকে এই বিষয়ে কোন প্রশ্ন না করে আমাকে করুন। ” আরমানের গলা শুনে সবাই মেইন গেইটের দিকে তাকায়।

শহিদ আহমেদ এতদিন পরে ছেলেকে দেখে বাকহারা হয়ে গেছেন। আরমানকে দেখে রাজিয়া খানম ও আকলিমা খানমের মুখ হা হয়ে গেছে।
শ্রীজা দৌড়ে এসে আরমানকে জড়িয়ে ধরে।
রশিদ বেগ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। বিরক্তিতে শুভর ঠোঁট বেঁকে গেছে।

শহিদ আহমেদ ছেলের কাছে এগিয়ে আসেন।
আবেগে ছেলেকে জড়িয়ে ধরেন। কতদিন পর ছেলেকে দেখছেন তিনি। আনন্দে তার দুচোখে পানি জমেছে।

” আরমান, তুমি এসেছ। কেমন আছো তুমি? হঠাৎই বা আমাদের এখানে ডেকেছ কেন! তুমি নিজে কেন ডাকলেনা! ”

” আমি ডাকলে আপনার পরিবারের সবাইকে এখানে পেতামনা। আপনাদের সবাইকে এখানে আমার দরকার ছিল, তাই চাচাকে মিথ্যা বলতে আমিই বলেছি। ”

” তোমার কি এমন দরকার যে, এভাবে আমাদের ডাকতে হল! সবকিছু ঠিকঠাক আছেতো, বাবা? ” বাবার মুখে এভাবে বাবা সম্ভাষণ শুনে আরমানের বুকের ভিতর হুহু করে উঠে। শেষ কবে বাবা ওকে এভাবে ডেকেছিল, তা আরমানের মনে পরেনা।

” আরমান, বাপ তুমি হঠাৎ এমন করে সবাইকে ডাকলে, কি হয়েছে? প্রয়োজন থাকলে তুমি ঢাকায় যেতে। সেখানে তোমার বাবার বাড়িতে কথা বলতে। ” রশিদ বেগ এগিয়ে এসে আরমানকে বলে।

” ঢাকার বাড়ির মালকিন আপনার বোন আর ফুপু। সেই বাড়িতে পা রাখতে আমার ঘৃণা হয়। এটা আমার দাদুর বাড়ি। তিনি তার পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে এই বিষয়সম্পত্তি পেয়েছিলেন। এসবে আপনার বোন অথবা ফুপুর কোন ক্রেডিট নেই। তাই আমি সবাইকে এখানে ডেকেছি। ”

” এই ছেলে আমাদের হয়রানি করতে যতসব ঢং শুরু করেছেন। এর মা যেমন অভিনেত্রী ছিল, এ-ও তাই হয়েছে। আর আমার ছেলেকে দেখ, অপয়ার এই ছেলেকে দেখে আল্লাদে গদগদ হয়ে যাচ্ছে। ” রাজিয়া খানম স্বভাবসুলভভাবে খেঁকিয়ে উঠে।

” আপনি যদি আজ মুখ বন্ধ না রাখেন, তবে খুব খারাপ কিছু ঘটবে। আজ থেকে আমার মায়ের নামে কোনও কথা মুখে আনবেননা আপনি। আপনার ঐ দুষিত মুখে আমার মায়ের কথা শোভা পায়না।” আরমান রাজিয়া খানমকে ধমকে চুপ করায়।

আরমানের এমন রূপ দেখে রাজিয়া খানম ভয় পায়। আজ পর্যন্ত আরমান তাকে এভাবে হুমকি দেয়নি।

” আরমান, বাবা তুমি বল। কেন আমাদের ডেকেছ? তোমার কথা শেষ না হওয়া পর্যন্ত কেউ কোন কথা বলবেনা, তার গ্যারান্টি আমি দিচ্ছি। ”
শহিদ আহমেদ ছেলের পক্ষ নিয়ে কথা বললেন।

” আমার জীবনের কয়েকটা ভুল নিয়ে কথা বলতে এখানে আপনাদের ডেকেছি। যে ভুলগুলো আমাকে অনেক পিছিয়ে দিয়েছে। প্রথমত, আমি মানুষ চিনতে ভুল করেছি। দ্বিতীয়ত, শত্রুকে বন্ধু ভেবেছি। আর সেই বন্ধুরূপী শত্রুর মুখোশ খুলতে চাচ্ছি আজ। এছাড়া আরও কিছু ভুল আমি করেছি, যেগুলো নিয়ে ধীরে ধীরে আলোচনা করব। ”

” হেয়ালি না করে ঠিকঠাক বল, আরমান। আমি তোমার কথা বুঝতে পারছিনা। কে তোমার শত্রু? ” শহিদ আহমেদ আবার কথা বললেন।

আরমান এতক্ষণ কান্তার হাত ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। এবার সে কান্তার হাত ছেড়ে দিয়ে সামনে এগিয়ে আসে। সেখানে শহিদ আহমেদ ছাড়া আর সবাই দাঁড়িয়ে আছে।
আরমান সোজা এসে রশিদ বেগের মুখোমুখি হয়। তাকে সপাটে প্রশ্ন ছুঁড়ে।

” আমার মা কোথায়? ”
আরমানের এই কথায় সাড়া বাড়িতে যেন থ হয়ে যায়। সবাই একসাথে তাকায় আরমানের দিকে। এসব কি বলছে সে?

” ক..ক..কি বলছ তুমি, আরমান? আ..আমি কিভাবে জানব, তোমার মা কোথায়! ”

” আমি সব জেনে গেছি। তাই আমার কাছে কিছু না লুকানোই বোধহয় আপনার জন্য মঙ্গল। আমার মা কোথায়? ”

” আরমান, এতক্ষণ তোমার অনেক বেয়াদবি সহ্য করেছি। তুমি কোন সাহসে আমার ভাইকে অপমান করছ? যে মানুষটা সব সময় তোমার পক্ষ নিয়ে কথা বলে, আজ তুমি তার দিকে আঙুল তুলছ? ” এবার আকলিমা খানম ফুঁসে ওঠে।
আরমান তার কথার উত্তর না দিয়ে শহিদ আহমেদের দিকে তাকায়।

” আপনি বলেছিলেন, আমার কথার মাঝে কেউ কোন কথা বলবেনা। কিন্তু আপনি ভুল। এখানে ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়ার মানুষের অভাব দেখছিনা। ”

” আকলিমা, আজ যদি তুমি একটা কথাও বলেছ, তবে আমার বাড়িতে তোমার কোন জায়গা হবেনা। এবং এটাই আমার ফাইনাল কথা। ” শহিদ আহমেদের এতটুকু কথাই যথেষ্ট ছিল আকলিমাকে চুপ করাতে।

আরমান মৃদু হেসে আবার রশিদ বেগের মুখোমুখি হয়।

” আমি এইচএসসি পরীক্ষার পর যখন নানার বাড়িতে যাই, সেদিন আমার পেছনে লোক লাগিয়েছিলেন কেন? যে আমাকে বলেছিল, সে শ্রীখন্ডি গ্রামের অধিবাসী । কিন্তু আদতে তা সে ছিলইনা। সে আমাকে জানায়, আমার মামারা কেউই গ্রামে থাকেনা। গ্রামের কারও সাথে তাদের যোগাযোগ নেই। কিন্তু সেটা সম্পূর্ণ ভুল ছিল। আবার পরেরবার যখন সেখানে গেলাম তখনও একই ঘটনা ঘটল। সৌভাগ্যক্রমে বাসস্ট্যান্ড থেকে যে ভ্যানগাড়িতে গিয়েছি সেখানে চালক একই ব্যাক্তি ছিল। পরপর দুইবার দুইজন মানুষ আমাকে বোকা বানাল। অবশ্য এতদিন এসব নিয়ে আমার সন্দেহের অবকাশ ছিলনা। আমি সেই দুইজন অচেনা ব্যাক্তির কথাই সত্যি ভেবেছিলাম। কিন্তু কয়েকমাস আগে যখন ছোট মামার সাথে দেখা হয়, তার সাথে কথা বলে সেই ধারনা ভুল মনে হয়। মামা জানায়, গ্রামে তাদের নিয়মিত যাতায়াত আছে। এবং প্রায় সবার কাছে তাদের ফোন নম্বর আছে। তখনই আমার প্রথম খটকা লাগে। আমি ভাবতে শুরু করলাম। তখনই মনে হল, নানার বাড়িতে যাওয়ার আগে আমি আপনার সাথে সে বিষয়ে আলোচনা করেছি। এরপর ধীরে ধীরে খোঁজ নিতে শুরু করলাম। অনেক দিনের চেষ্টায় খুঁজে পেলাম সেই দুই অচেনা ব্যাক্তি আর ঐ ভ্যানওয়ালাকে। এবার বলুন, কি বলবেন? ”

” আমার নামে এভাবে মিথ্যা অপবাদ দিওনা, আরমান। আমি তোমাকে নিজের সন্তানের মত ভালোবাসি। তোমাকে.. ” রশিদ বেগ কথা শেষ করতে পারেনা।

” ঠিক যেমন ভালোবাসতেন আমার মা’কে? তার পেছনে আঠার মত লেগে ছিলেন সময়ে-অসময়ে তাকে বিরক্ত করতেন। এবার আপনি কি নিজ থেকে সবটা বলবেন, নাকি আমি বলাব? অবশ্য সেটা আপনার জন্য কোন শুভ কিছু হবেনা। আপনি যে শ্রীজার মামাকে মে’রে’ছে’ন সেটাও জেনেছি। সেসব কথা আজ থাক। আপনি বলুন, আমার মা কোথায়? ”

” আমি জানিনা। তুমি এএসপি হয়েছ বলেই আমাকে ফাঁসাবে মনে করলে ভুল করবে। আমি তোমার বিরুদ্ধে উপরমহলে যাব। ” এবার রশিদ বেগের গলার স্বর পাল্টেছে।

” তাহলে আমাকেই সবটা বলতে হবে? আচ্ছা শুনুন, আমি সেই দুই ব্যাক্তির খোঁজে নানার বাড়ির পুরো এলাকা চষে বেড়াই। অবশ্য এজন্য আমাকে এক বন্ধু যে একটা এনজিওর মালিক। তার সাহায্য নিতে হয়। শ্রীখন্ডিসহ আশেপাশের সব গ্রামে জরিপ চালানোর নামে সেই দুই ব্যাক্তির খোঁজ চালাই। এখানে আমাকে সাহায্য করেছে আমার সোর্স। এখানে আপনার দুর্ভাগ্য বলতে হবে, যে ঐ দুই ব্যাক্তির চেহারা আমার তেমন মনে ছিলনা, কিন্তু তারা তাদের নাম বলেছিল। যে নামে শ্রীখন্ডিতে একজন ছিল। কিন্তু সে ঐ ব্যাক্তি ছিলনা। তারা তাদের নাম বলেছিল, জমির মৃধা আর বিল্লাল শেখ। আমি তাদের নামের সূত্র ধরেই তাদের খোঁজ চালাই এতদিন ধরে। এবং অবশেষে একমাস আগে তাদের পেয়েও যাই। তারাও আপনাকে চিনে। তাদের একজনের বাড়ি শ্রীপুর। যেখানে আপনার পৈতৃক নিবাস। যেখান থেকে আপনার মা আপনাকে নিয়ে এসে শ্রীজার নানার সংসার করেছিল। এরপর আপনার সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হলাম। খোঁজ নিতে থাকলাম আপনার সম্পর্কে। ও হ্যাঁ, ভুলেই গেছি। সেই ভ্যানওয়ালাকেও খুঁজে পেয়েছি। সে এখন বৃদ্ধ। আর বাকি দুইজনও তাই। ভ্যানওয়ালাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম আপনিই তাকে বাসস্ট্যান্ডে আপনার ঠিক করা যাত্রীকে নিয়ে অপেক্ষা করতে বলেছিলেন। আমার ছবি দেখিয়েছিলেন। যাতে সে-ই আমাকে নিয়ে যায় শ্রীখন্ডি গ্রামে। তবে আপনার সাথে চুক্তি ছিল ১৫ কিলোমিটারের রাস্তার মধ্যেই আমাকে ভুল সংবাদ দিয়ে গ্রামে যেতে না দেয়া। এবং তারা সফলও হয়েছিল। আমি বুঝতেই পারিনি, আমার পেছনে এতবড় ষড়যন্ত্র হয়েছে। যাইহোক, আপনার সম্পর্কে খোঁজ নিতে যেয়ে অনেক গোপন তথ্য জানতে পারলাম। এরপর ছোট মামার কাছ থেকে আমার মায়ের স্কুল, কলেজের ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর ঠিকানা সংগ্রহ করলাম। দেখা করলাম শাহানা আন্টির সাথে। তার কাছ থেকেই জানতে পারলাম, আপনি মায়ের পেছনে সব সময়ই ঘুরঘুর করতেন। একদিন যখন জানলেন শ্রীজার বাবার সাথে আমার মায়ের একটা সম্পর্ক আছে, তখন মা’কে নানানভাবে বুঝাতে চাইলেন, শ্রীজার বাবা ভালো মানুষ নয়। কিন্তু মা সেকথা শুনলনা। তার ভালোবাসার মানুষকেই বিয়ে করল। আমি প্রায় সবটুকুই বলেছি। এবার আপনি বাকিটুকু বলুন। ”

” তোমার কাছে কোন প্রমান আছে? আমাকে মিথ্যা দোষারোপ করার জন্য তোমাকে ভুগতে হবে বলে দিলাম। এর শেষ আমি দেখেই ছাড়ব। ” রশিদ বেগের চোখ দিয়ে যেন আগুনের ফুলকি বেরিয়ে আসতে চাইছে।

” প্রমান চান? ” কথাটা বলেই আরমান কাউকে ফোন করল।

কিছুক্ষণ পর সেই পাঁচজন ব্যাক্তি ধরে রাখা তিনজনকে নিয়ে বাড়িতে ঢোকে। তাদের দেখে রশিদ বেগ থমকে যায়।

সেই তিনজন একে একে তাদের সব অপরাধ স্বীকার করে।

শহিদ আহমেদসহ উপস্থিত সকলে স্তব্ধ হয়ে গেছে সবকিছু শুনে। যে রশিদ বেগকে সবাই শান্ত, নিরীহ বলে জেনে এসেছে, তার নামে এসব কি শুনছে তারা!
শহিদ আহমেদ ধপ করে বসে পরেন। যাকে তিনি নিজের ব্যবসার সকল দ্বায়িত্ব দিয়েছেন, বিশ্বাস করেছেন, তার এ কি রূপ আজ দেখছেন!

” এভাবে বসে পরছেন কেন! আরও কিছু শুনবেননা? আপনার ব্যাবসার অর্ধেক শেয়ার নিজের অজান্তেই তার নামে করে দিয়েছেন। বনানীর ফ্ল্যাটও তাকে দিয়েছেন। এছাড়াও গাজীপুরে যে জমি কিনেছিলেন সেটাও তাকেই দিয়েছেন। এসব কি জানেন আপনি? পারলে কালই সব জেনে নিয়েন। ” আরমান শহিদ আহমেদকে উদ্দেশ্য করে বলে।

” এসব মিথ্যে। সব আরমানের সাজানো। আমাকে এখানে থেকে যেতে দাও। তোমাদের সাথে কোনরূপ সম্পর্ক আমি রাখতে চাইনা। ” রশিদ বেগ এবার ফুঁসে ওঠে।

” আপনি যেখানে খুশি যাবেন। তার আগে বলুন, আমার মা কোথায়? আর বারবার জানিনা জানিনা বলে সাধু সাজতে চাইবেননা। কারন মা সেদিন যখন এই বাড়িতে এসেছিল, সেইদিন সন্ধ্যায় আপনাকে গ্রামের বাজারে দেখেছিল আমাদের গ্রামের রহমতুল্লাহ দাদু। তিনি এখনও বেঁচে আছেন। তার ছেলেই এখন এই বাড়ি, সম্পত্তি সব দেখাশোনা করে। এবার বলুন, আপনাকে সেদিন গ্রামে দেখা গিয়েছিল সেটাও কাকতালীয়? আমি এবার সোজা কথায় উত্তর চাই। একটুও যদি ভণিতা করেছেন, তবে এরা আপনাকে মাটিতে মিশিয়ে ফেলবে। কারন এরা পাঁচজনই পুলিশের লোক। ” আরমান ইশারায় পাঁচজনকে দেখায়।

” আমি কিছুই জানিনা। একশোবার বলব, এক হাজারবার বলব। আমি কিছুই জানিনা। ”

” ঠিক আছে, মানলাম তুই স্যারের মায়ের বিষয়ে কিছুই জানিসনা। কিন্তু তুই এটা বল বজলুর খানের ছেলে, শাহিন খানকে কেন মে’রে’ছি’লি? তুই যে তাকে মে’রে’ছি’স তার প্রমান আমাদের কাছে আছে। এবার অস্বীকার করলে আমরা ভুলে যাব তুই কে৷ প্রথমে তোকে ক্যালাব। পরে কোন জবাবদিহি করতে হলে বলব, তুই প্রথমে আমাদের উপর হামলা করেছিলি। আমাদের ধৈর্যের পরীক্ষা আর নিসনা। ” সেই পাঁচজনের থেকে একজন এগিয়ে এসে বলে। সে সদর থানার ওসি।

তখনও রশিদ বেগ সবকিছু অস্বীকার করছিল। ঠিক তখন দুইজন পুলিশ মিলে রশিদ বেগকে
আচ্ছামত ধোলাই দিতে শুরু করে।
মারের এক পর্যায়ে রশিদ বেগ মুখ খুলতে রাজি হয়।

” আমি সব বলছি। আমাকে আর মারবেননা। সব বলছি আমি। ”

” তাহলে শুরু কর। ” ওসি বলল।

” আমি সবকিছু স্বীকার করছি। যেসব অপরাধের কথা আপনারা বলছেন, সব আমিই করেছি। ”

এবার আরমান কথা বলে।

” আমার মায়ের কথা বলুন। সে কোথায়? ” আরমানের বুক দুরুদুরু করছে। এবার ওর মায়ের সন্ধান পাবে।

” আমি, আ…ম আমি আইরিনকে সেদিন রাতে মে..মে’রে ফেলেছিলাম। সে কিছুতেই আমার সাথে স..সংসার করতে রাজি হচ্ছিলনা। তাই রাগে তাকে খু’ন করে দিলাম। ”
রশিদ বেগের কথা শুনে শহিদ আহমেদ মাথায় হাত দিয়ে উঠানে বসে পরেন।

আরমান চমকে উঠে তাকায় রশিদ বেগের দিকে। ওর পা টলছে। যে কোন মুহুর্তে ও পরে যাবে। শ্রীজা দৌড়ে ভাইয়ের কাছে আসে। ভাইয়ের হাত শক্ত করে ধরে।

আকলিমা খানম ও রাজিয়া খানম এখনও নিজেদের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেনা। যাকে তারা নিজের আপনজন ভেবেছে, আজ সে-ই তাদের সংসারে ভাঙ্গন ধরিয়েছে!
শুভও হতবাক! এমনটাও হওয়ার ছিল!

কান্তার দুনিয়াদারী আজ অন্ধকারে ছেয়ে গেছে। সামনের অপরাধী মানুষটা তাকে কত সুন্দর করে মা বলে ডাকত! আজ তার এ কোন রূপ দেখল ও!

চলবে…

#কুড়িয়ে_পাওয়া_ধন
#পার্ট_২৯
জাওয়াদ জামী

কান্তা টালমাটাল পায়ে এসে দাঁড়ায় আরমানের কাছে। শক্ত ধরে সামনে দাঁড়ানো বিধ্বস্ত মানুষটার হাত। কিভাবে তাকে শান্তনা দিবে সেই ভাষা কান্তার জানা নেই। ও ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে থাকে তার একান্ত আপনজন পুরুষের থমকে যাওয়া মুখের দিকে।

শহিদ আহমেদ নিজেকে ধাতস্থ করে এগিয়ে আসে রশিদ বেগের দিকে।

” তুমি যা বলছ সত্যি বলছ রশিদ! তোমাকে বিশ্বাস করে, আমার বাড়িতে ঠাঁই দিয়ে আমি কি বড় ভুল করে ফেলেছি? কেন করলে এমন? কি দোষ করেছিল আইরিন? অথচ দেখ বছরের পর বছর ধরে সেই মানুষটাকে আমি অবিশ্বাস করেছি। তার জন্য বুকের ভেতর রা’গ পুষে রেখেছি। কিন্তু আজ এতবছর পর জানলাম, আমার সব রাগ, অবিশ্বাস সবই বৃথা। সে আজ আমার ধরাছোঁয়ার বাইরে। আমার রা’গে , অবিশ্বাসে তার কিছুই যায় আসেনা। মিছেই আমার এত আয়োজন। ” শহিদ আহমেদ বাচ্চাদের মত হাউমাউ করে কাঁদছেন।

কান্তা আরমানের মুখের দিকে তাকিয়েই থাকে। আরমানের দৃষ্টিতে অবিশ্বাস, বিষাদের মেঘ জমেছে।

” আপনি এভাবে চুপচাপ আছেন কেন। একটিবার কথা বলুন। আপনার এই নিরবতা আমাকে ভিষণ পোড়াচ্ছে। ” কান্তা মলিন গলায় বলল।

” কান্তা, তুমি ঐ ভদ্রলোককে আমার মা সম্পর্কে কিছু বলতে নিষেধ কর। তার মুখে আমার মায়ের নাম শোভা পায়না। সে এত বছর আমার মা’কে মিথ্যা দোষারোপ করেছে। হঠাৎ আজ তার আমার মা’য়ের ওপর এত দরদ উথলায় কেন! তুমি তাকে নিষেধ করে দাও, কান্তা। ” আরমান ওর বাবার দিকে ইশারা করে কান্তাকে বলে। হঠাৎই ও অসহিষ্ণু হয়ে পরেছে।
এরপর কান্তার হাত ছাড়িয়ে, শ্রীজাকে সরিয়ে দিয়ে রশিদ বেগের সামনে এসে দাঁড়ায়।

” এবার তুই আমাকে বল, আমার মা’য়ের সাথে তুই কি করেছিস? আমি পুরোটাই শুনতে চাই। তুই কোন আঁইগুই না করে সবটা বলবি। তার আগে তুই এটা বল, তোর বুক কাঁপেনি আমার মা’য়ের শরীরে হাত দিতে? তোর মনে হয়নি, তুই ধরা পরলে কি হতে পারে? ” আরমানের সম্মোধন সোজা তুইতে নেমে গেছে। সে রশিদ বেগের শার্টের কলার ধরে তাকে পরপর কয়েকটা থাপ্পড় মা’রে। মা’রে’র চোটে রশিদ বেগের ঠোঁট কে’টে গেছে। চোখের কোনে কালশিটে পরেছে।
কান্তা দৌড়ে এসে আরমানকে বাঁধা দেয়।

” আপনি এভাবে তাকে মারছেন কেন! তাকে এভাবে না মে’রে আইনের মাধ্যমে শাস্তি দিন। যাতে কেউ বলতে না পারে, আপনি আইনের রক্ষক হয়েই, আইন নিয়ে স্বেচ্ছাচারিতা করেছেন। তার আগে উনি মা’য়ের সাথে কি করেছে সেটা শুনে নিন। সে মা’কে কোথায় রেখেছে এটাও জেনে নিন। ” কান্তার কথা শুনে আরমান থেমে যায়। তার বুকের ভিতর ধুকপুক করছে। আবারও ফিরে এসেছে মা’কে চিরতরে হারিয়ে ফেলার ভয়।

” বল শা’লা , স্যারের মায়ের সাথে কি করেছিস তুই? এবার পুরো ঘটনা বল। তারপর তোর একটা ব্যবস্থা করব। ” সেই ওসি এসে রশিদ বেগের ঘাড় চেপে ধরে বলে।

” আমি একদিন স্কুলে যাওয়ার পথে আইরিনকে দেখি। তখন আমি ক্লাস নাইনে পড়ি। আর আইরিন তখন সেভেনে পড়ে। তখনকার দিনে কয়েকটা গ্রাম মিলে একটা হাইস্কুল থাকত। আমি তখন থাকতাম মায়ের সাথে তার দ্বিতীয় স্বামীর বাড়িতে। সেখানে কোন হাইস্কুল না থাকায় আমরা শ্রীখন্ডি হাইস্কুলে পড়তাম। সেখানেই আইরিনকে প্রথম দেখি। তখন থেকেই ওকে ভালো লাগতে শুরু করে। এরপর আমি এসএসসি পাশ করে উপজেলার কলেজে ভর্তি হলাম। আকলিমার বাবা আমাকে খুব ভালোবাসত। একদম নিজের ছেলের মত। তিনি চাইতেন আমি লেখাপড়া শিখি। আমিও তার ইচ্ছে পূরণ করতেই মনযোগ দিয়ে পড়াশোনা করি। কিন্তু কলেজে ভর্তি হলেও আইরিনের প্রতি টান আমার একটুও কমেনা বরং দিনকে দিন বাড়তে থাকে। মাঝেমধ্যে ক্লাস শেষে আইরিনের স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতাম। একদিন সাহস করে ওকে বলে দিলাম আমার মনের কথা। কিন্তু আইরিন রাজি হলোনা। এভাবেই কাটতে থাকে দিন। আমি প্রতিদিন আইরিনের স্কুলের সামনে যাওয়া শুরু করলাম। আইরিনকে বোঝাতে চাইলাম। কিন্তু ও কিছুতেই বুঝতে চায়না। এরইমধ্যে দুই বছর পেরিয়ে গেছে। আমি এইচএসসি পাশ করে জেলা শহরের কলেজে বিএ ভর্তি হলাম। আরেকটা কথা আমি রহমতুল্লাহ খানের বাড়িতে যাওয়ার পর থেকেই সেখানকার সবাই আমাকে ভালোবাসত। রহমতুল্লাহ খানের বোন রাজিয়া খানম আমাকে নিজের ভাইয়ের ছেলের মতই আদর করতেন। তার ছেলে শহিদ ভাইও আমাকে খুব ভালোবাসত। শহিদ ভাইয়ের সাথে আমার খুব জমত। সে তখন ভার্সিটির ছাত্র। অনেকদিন পর একদিন জানলাম শহিদ ভাই একজনকে পছন্দ করে। কিন্তু মেয়েটার নাম তখন ভাই আমাকে জানায়নি। কয়েক বছর কেটে যায়। এরমধ্যে আইরিন এইচএসসি পাশ করে কলেজে ভর্তি হয়। আমিও বিএ পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছি। শহিদ ভাই অনার্স শেষ করে মাস্টার্সে পড়ছে।
একদিন খবর পেলাম শহিদ ভাই বিয়ে করেছে। এই নিয়ে খান পরিবারে ভিষণ অশান্তি শুরু হয়। কারন রাজিয়া খানমের ইচ্ছে ছিল আকলিমাকে ছেলের বউ বানাবে। যদিও আকলিমা শহিদ ভাইয়ের থেকে বেশ ছোট। তবুও দুই পরিবারে কথাবার্তা ঠিক করা ছিল। হঠাৎ করে শহিদ ভাইয়ের বিয়ের খবর শুনে সবাই রে’গে যায়। আমার মা গোপনে আমাকে শহিদ ভাইয়ের বাড়িতে পাঠায় রাজিয়া ফুপুকে একটা সংবাদ দিতে। এখানে বলে রাখি, শহিদ ভাইরা অনেক আগে থেকেই শহরে থাকত। প্রয়োজন ছাড়া গ্রামে যেতনা। সেখানে গিয়েই আমি চমকে যাই শহিদ ভাইয়ের বউ রূপে আইরিনকে দেখে। ফুপুকে মায়ের পাঠানো সংবাদ শুনিয়ে আমি সেখান থেকে বেরিয়ে আসি। এরপর থেকে মাঝেমধ্যেই সেখানে যাওয়া শুরু করি। আইরিন এসব নিয়ে ভিষণ বিরক্ত ছিল। কিন্তু শ্বাশুড়ির কটুকথা শোনার ভয়ে কাউকে কিছু বলতনা এটা বেশ বুঝতে পারতাম। এভাবেই চলছিল সবকিছু। একসময় আরমানের জন্ম হয়। আর আমার সাথে শহিদ ভাইয়ের ঘনিষ্ঠতা আরও বাড়ে। আসলে আমি চাইছিলাম সবাইকে নিজের হাতের মুঠোয় আনতে। তাই রাজিয়া ফুপুর কাছে আইরিনের বিরুদ্ধে নানান কথা বলতাম। ত্কে উস্কে দিতাম। এরপর একদিন এলো সেই মহা সুযোগের দিন। আমি শহিদ ভাইয়ের সাথে দেখা করতে যেয়ে শুনলাম আইরিন ছেলেকে নিয়ে বাপের বাড়ি গেছে। কিছুক্ষণ পর আমিও সেখান থেকে বেরিয়ে সোজা চলে গেলাম শ্রীখন্ডি। খোঁজ নিয়ে জানলাম আইরিন সেখানেই আছে। সেখানে বাজারে বসে কাটিয়ে দিলাম সারাদিন। সন্ধ্যায় গ্রামে ফিরে গেলাম। পরদিন সকালে আবার শ্রীখন্ডি গেলাম। দুপুরে দেখলাম আইরিন ছেলেকে নিয়ে ওর ছোট ভাইয়ের সাথে কোথাও যাচ্ছে। আমিও ওদের পিছু নিলাম। কিছুক্ষণ পর বুঝলাম ওরা শহিদ ভাইয়ের গ্রামে যাচ্ছে। আতিক ওর বোনকে শহিদ ভাইয়ের বাড়িতে রেখে সন্ধ্যায় নিজের বাড়িতে চলে যায়। আমি অপেক্ষায় থাকি। রাতে বাড়ির দেয়াল টপকিয়ে ঢুকে পরি বাড়ির ভেতর। সেখানে শুধু আইরিন আর একটা কাজের মেয়ে ছিল। বাইরের ঘরে ওদের বাড়ির পাহারাদার ছিল। আইরিনের ঘরের দরজা খোলা দেখে আমি তরে ঢুকে পরি। আমাকে দেখে আইরিন চমকে যায়। কিন্তু সম্মানের কথা চিন্তা করে কোন চেঁচামেচি করেনা। আমি ওকে অনেকবার করে বোঝানোর চেষ্টা করি, শহিদ ভাইকে ছেড়ে দিতে। কিন্তু ও আমার কথা শুনতেই চাইছিলনা। এ নিয়ে অনেক কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে আমি রে’গে গিয়ে আইরিনের গলা টিপে ধরি। রা’গ যখন কমে গেল, তখন দেখলাম আইরিন নিস্তেজ হয়ে গেছে। গলা থেকে হাত সরাতেই ও ধপ করে মেঝেতে পরে যায়। আমি তৎক্ষনাৎ ওকে উঠাতে গিয়ে আবিষ্কার করি ও মা’রা গেছে। আমি ভয় পেয়ে যাই। শহিদ ভাই শুনলে আমাকে খু’ন করে ফেলবে। তার আগেই আইরিনের ব্যবস্থা করতে হবে। আমি সেই ব্যবস্থাও করলাম। ”

এতক্ষণ যেন উঠানে উপস্থিত সকলেই ঘোরের মধ্যে ছিল। কত সহজেই একটা মানুষ তার কুকীর্তির কথা সবাইকে জানিয়ে দিল! একটুও গলা কাঁপলনা তার!

সব শুনে শহিদ আহমেদের হাত-পা কাঁপছে। শেষ সময়ে মেয়েটা কতইনা কষ্ট পেয়েছে!

আরমানের হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে গেছে রশিদ বেগের কথা শুনে। ওর ইচ্ছে করছে এখনই শয়তানটাকে দু-চার ঘা লাগাতে। কিন্তু কান্তার কারনে তা সম্ভব হয়না। কান্তা ওকে শক্ত করে ধরে রেখেছে। রাগ হলেও আরমানের ভিষণ ভয় করছে। একটু আগ পর্যন্তও ওর আশা ছিল মা’কে খুঁজে পাবে। কিন্তু এই লোকটা ওর সমস্ত আশা চূর্ণ করে দিয়েছে। এখন ঐ শয়তানটাকে শেষ প্রশ্ন করার সাহস পাচ্ছেনা আরমান। কিভাবে করবে সেই প্রশ্ন! শেষ প্রশ্নের উত্তর শোনার ক্ষমতাযে নেই ওর।

” কু’ত্তা’র বা’চ্চা, এমনভাবে বলছিস যেন কোন সিনেমার গল্প। স্যারের মা’য়ের সাথে এরপর কি করেছিলি? কোথায় রেখেছিস তার ডে’ড বডি? ” ওসি এবার রশিদ বেগের চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকিয়ে দেয়।

” আমি বলছি স্যার। সব বলছি। ” ব্যথায় কঁকিয়ে ওঠে রশিদ বেগ।
ওসি চুল ছেড়ে দিলে পুনরায় কথা বলে।

” আমি আইরিনকে ধরে মেঝেতে কিছুক্ষণ বসে থাকি। আরমান তখন ঘুমাচ্ছিল। অনেক ভেবে একটা উপায় বের করলাম। দেখলাম আইরিনের ব্যাগ গোছানোই আছে। আইরিনকে কাঁধে তুলে নিলাম। আর এক হাতে নিলাম ওর ব্যাগ। আস্তে করে ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম উঠানে। মেইন গেইট খুললাম কোন শব্দ না করে। এরপর ওকে বয়ে নিয়ে গেলাম গোরস্তানের দিকে। শহিদ ভাইদের পারিবারিক গোরস্থান। সেখানে নিয়ে রাখলাম আইরিনকে। চারদিকে চোখ বুলালাম। পছন্দ হল গোরস্তানের ভেতরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোন। সেখানে কেউই যায়না। জায়গাটা প্রায় পরিত্যক্ত। হঠাৎ মনে হল, মাটি খোঁড়ার কিছু আনিনি। আবার ফিরে এলাম শহিদ ভাইয়ের বাড়িতে। আগে থেকেই জানতাম কোথায় কি থাকে। একটা কোদাল নিয়ে বেরিয়ে এলাম। কেউই জানতে পারলনা কিছুক্ষণ আগে কি ঘটেছে। গোরস্থানে এসে মাটি খুঁড়ে পুঁ’তে দিলাম আইরিনের দেহ এবং ব্যাগ। এরপর মাটির উপর বিছিয়ে দিলাম কিছু ডালপালা, ঘাস। এরপর কোদাল নিয়ে বেরিয়ে এলাম। আমি জানতাম শহিদ ভাইদের বাড়ির কেউ মা’রা না গেলে গোরস্থানে কেউ আসবেনা। আর কেউ মা’রা গেলেও ঐ কোনার দিকে কেউ যাবেনা। তাই নির্ভয়ে কাজটা করেছি। এরপর পাশের গ্রামের ঝোপের ভেতর কোদালটা ফেলে দিয়ে আমি শহরে ফিরে যাই। এরপরের ঘটনা সবারই জানা। ”

রশিদ বেগের কথা শেষ হওয়া মাত্রই আরমান ছুটে যেতে চায় গোরস্তানের দিকে। কিন্তু কান্তা আর ওসি মিলে ওকে আটকায়। এদিকে আরমান পাগলামি শুরু করেছে।

” স্যার, ওর নামে এ্যারেষ্ট ওয়ারেন্ট আছে। আগে ওকে থানায় নিয়ে যাই। অফিসিয়ালি ফর্মালিটি পালন করেই আমরা গোরস্থানে যাব। আপনি একটু ধৈর্য্য ধরুন। আমরা কাজটা এমনভাবে করব, যাতে এই হা’রা’মি আইনের ফাঁক গলে বের হতে না পারে। ওর কথামত এখন যদি আমরা গোরস্থানে যেয়ে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করি তবে এটা আমাদের জন্য ভুল হবে। আগে আমরা থানায় এর জবানবন্দি নিই। এরপর অফিসিয়ালি কাজ করলে আমাদের জন্য ভালো হবে। ”

আরমান চিন্তা করে দেখল ওসি ঠিক কথাই বলেছে। ও রশিদ বেগের শার্টের কলার ধরে টানতে টানতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। ওর সাথে আসে বাকি পুলিশেরা।

অফিসিয়ালি অর্ডার নিয়ে আরমান আবার আসে গ্রামে। এবার সরাসরি গোরস্থানে যায়। ওদের বাড়ির পশ্চিম পাশ দিয়ে পায়ে হাঁটার রাস্তার মাথায়ই গোরস্থান।

রশিদ বেগের দেখানো স্থানে মাটি খোঁড়া শুরু হয়। কিছুক্ষণ পর মাটির নিচ থেকে পাওয়া যায় একটা ক’ঙ্কা’ল। এত বছর পর সেখানে ব্যাগের কোন অস্তিত্ব পাওয়া যায়না। ক’ঙ্কা’লও আস্ত নেই। অতি সাবধানে মাটি সরাচ্ছে থানা থেকে আসা লোকজন। হঠাৎ একজন মাটি সরাতে যেয়ে একটা গলার চেইন পায়। চেইনের সাথে একটা বড় লকেট ঝুলছে। সে ওসির হাতে চেইনটা দেয়। মাটির নিচে এত বছর থাকার পর চেইনের কোন সৌন্দর্য চোখে পরেনা। দেখে বোঝাই দায় এটা সোনার চেইন। কিন্তু শহিদ আহমেদ ঠিকই চিনতে পেরেছে। সে এক ছোঁ মেরে চেইনটা ওসির হাত থেকে নেয়।

” এটা আমার আইরিনের চেইন। আমাদের প্রথম বিবাহ বার্ষিকীতে ওকে আমি এটা উপহার দিয়েছিলাম। সেদিনের পর থেকে ও চেইনটা গলা থেকে খুলতনা। অনেক বলেও ওকে গলা থেকে চেইনটা খোলাতে পারিনি। ” শহিদ আহমেদ সবার সামনেই কেঁদে ফেলেন। চেইনটা তিনি বুকে চেপে ধরে রেখেছেন।

চোখের সামনে মা’য়ের শরীরের অবশিষ্টাংশ দেখে আরমান আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেনা। মায়ের ক’ঙ্কা’লে’র পাশে বসেই আহাজারি করে কাঁদতে থাকে। কেউই ওকে সামলাতে পারছেনা।

চলবে…