#কুড়িয়ে_পাওয়া_ধন
#পার্ট_৩০
জাওয়াদ জামী
কান্তা ফোনে আরমানের ছোট মামাকে সবটা জানিয়েছে। সে খবরটা শোনামাত্রই আরমানের গ্রামে হাজির হয়েছে। তার সাথে আছে তার মেজো ভাই। একে একে তার ভাই-বোনেরা সকলেই পৌঁছে আরমানের গ্রামে।
আরমানের কান্না কিছুতেই থামছেনা। ওর দুই মামা অনেক চেষ্টা করেও ওকে থামাতে পারেনি।
আইরিনের ভাই-বোন এসে কেঁদেই চলেছে। তারা কল্পনাই করতে পারেনি, তাদের বোনের সাথে এত খারাপ ঘটনা ঘটেছে।
আরমান একসময় শান্ত হয়। সে পুলিশের সাথে থানায় গেছে। সাথে ওর তিন মামাও আছে।
শহিদ আহমেদকে ঘুমের ঔষধ দিয়ে ঘুমিয়ে রাখা হয়েছে। তার শারিরীক অবস্থা খুব একটা ভালো নেই।
স্বামীর পাশে বসে আকলিমা খানম আকাশপাতাল চিন্তা করছে। সে কখনও ভাবতেই পারেনি, যাকে নিজের ভাইয়ের আসনে বসিয়েছিল সে-ই তার নিজের ভাইকে খু’ন করেছে! কেন এমনটা হল, সে ভেবেই পায়না।
এত বছর কারনে-অকারনেই স্বামীর কাছে আরমানের মা’য়ের সম্পর্কে নানান কথা বলে উস্কে দিয়েছে। তার মনে আইরিনের জন্য ঘৃণা সৃষ্টি করিয়েছে । এভাবেই হাতে রেখেছিল তার স্বামীকে। সে ভাল করেই জানত আইরিনকে তার স্বামীর মন থেকে না সরালে সে কিছুতেই স্বামীর ভালোবাসা পাবেনা। অবশ্য সে সফলও হয়েছিল। কিন্তু আজ কি থেকে কি হয়ে গেল! তার স্বামীর মনে আইরিনের জন্য জমে থাকা ঘৃ’ণা এক লহমায় মুছে গেছে। মানুষটা আবার আইরিন আইরিন করছে। যেমনটা করত আইরিন হারিয়ে যাবার পর।
কাল থেকে কিভাবে স্বামীর সামনে দাঁড়াবে সেই চিন্তা তার মাথা থেকে যাচ্ছেনা।
রাজিয়া খানম স্তব্ধ হয়ে বিছানায় বসে আছে। আজ কিছুতেই তার চোখে ঘুম নামছেনা। সে ভাবতেই পারেনি তার সংসারে এমন ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছে। অথচ কত অপমানজনক কথাই না সে বলেছে ঐ মৃ’ত মেয়েটার সম্পর্কে। সে আইরিনকে পছন্দ করতনা এটা ঠিক আছে। কিন্তু তাই বলে সে কখনোই আইরিনের মৃ’ত্যু চায়নি। তার সকল আয়োজন ছিল আকলিমাকে ঘিরে। সে অনেক আগে থেকেই মনেপ্রাণে আকলিমাকে ছেলের বউ রূপে দেখতে চেয়েছিল। তাই আইরিনকে ছেলের বউ হিসেবে মানতে পারেনি। তাইতো আইরিন হারিয়ে যাবার পর, তার ছেলে যখন পাগলের মত হয়ে গিয়েছিল, তখন ছেলের কানে আইরিনের সম্পর্কে বিষ ঢেলে ছেলেকে নিজের কবজায় করে নিয়েছিল। এবং ধীরে ধীরে আরমানকেও তার ছেলের জীবন থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল। এবং আকলিমাকে ছেলের বউ করে নিয়ে এসে তার দুরভিসন্ধিকে সফল করেছিল। কিন্তু হায় আজ তার এত বছরের পরিশ্রম বৃথা হল। তার ছেলে এত বছর পরও আইরিনের জন্যই পাগলামি করছে।
কাল যদি তার ছেলে সবকিছুর জন্য জবাবদিহিতা করে, তখন সে কি উত্তর দিবে!
কান্তা ওর খালা শ্বাশুড়ির সাথে ঘরে বসে আছে। তারা আরমানদের জন্য অপেক্ষা করছে। আরমানের খালারা বোনের জন্য থেকে থেকেই কেঁদে উঠছেন। বারবার বলছেন, এমনটা না হলেও পারত।
কান্তা চিন্তাকরছে আরমানের জন্য। মানুষটাকে ও কিভাবে সামলাবে, তা ওর জানা নেই।
শ্রীজাও আছে কান্তার সাথে। ওর চিন্তা হচ্ছে ভাইয়ের জন্য। এতদিন সবাই ওর ভাইকে কতইনা কথা শুনিয়েছে। একজন ছেলের সামনে যখন তার মা’কে নিয়ে আজেবাজে কথা বলা হয়, তখন সেই ছেলের কষ্ট কি কেউ আঁচ করতে পারে? তার ভাই দিনের পর দিন নিজের মা’কে নিয়ে আজেবাজে কথা শুনেছে। হয়তো সে-ও আশায় ছিল, তার মা একদিন ফিরে আসবে। তখন সে সবার কটুকথার জবাব দিবে। কিন্তু একি হয়ে গেল! তার ভাইয়ের জবাব দেয়ার রাস্তা ঠিকই হয়েছে, কিন্তু তার মা আর ফিরে আসবেনা।
সবাই নানান চিন্তায় অস্থির থাকলেও শুভর মধ্যে কোন অস্থিরতা নেই। এসবে তার কিছুই যায় আসেনা। সে-তো ব্যস্ত নিজেকে নিয়ে। বাবার হঠাৎ করেই অসুস্থ হওয়াকে ওর আদিখ্যেতা মনে হচ্ছে। আবার শ্রীজার বড় ভাইয়ের জন্য এত দরদ দেখেও রা’গ হচ্ছে। এত হাইপার হওয়ার কি আছে! যার যেটা ভাগ্যে আছে সেটা হবেই। ও সিদ্ধান্ত নেয় সকাল হলেই ঢাকার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যাবে।
পরদিন দুপুরে ওরা ফিরে আসে। সবার মুখ থমথমে।
কান্তারা আরমানের চাচার বাড়িতেই আছে। আরমান সেখানে ঢুকতে চাইলে ওর ছোট মামা ওর হাত ধরে নিয়ে যায় শহিদ আহমেদের বাড়িতে। ওরা বাড়িতে ঢুকতেই রাজিয়া খানমকে দেখতে পায়। রাজিয়া খানম বারান্দায় বসে ছিল।
আরমানের মামা আতিক সোজা যেয়ে দাঁড়ায় রাজিয়া খানমের সামনে।
” আপনি আজ পর্যন্ত আমার আপাকে যা যা বলেছেন, তার সবটাই আমার মনে আছে। আমি সবসময়ই আপনার অপমান সহ্য করে বাড়িতে ফিরেছ। কিন্তু আজ সেসব অপমানের জবাব দেয়ার সময় এসেছে। আমার আপা চরিত্রহীনা ছিলনা সেই প্রমান নিশ্চয়ই পেয়েছেন? এতকিছুর পরও আপনি বেঁচে আছেন কিভাবে! আপনার লজ্জা করছেনা নিজের মুখ সবাইকে দেখাতে? নিজের বলা কথাগুলোর জন্য অনুশোচনা হচ্ছেনা? ধিক জানাই আপনার মত মহিলাদের যারা সংসারে নিজের স্বার্থ ছাড়া কিছুই বোঝেনা। ”
” মামা, কাকে কি বলছেন আপনি! এই ভদ্রমহিলার মনুষ্যত্ব আছে বলে আপনার মনে হয়! এই মহিলা নারীজাতির ক’ল’ঙ্ক। যে মহিলা এতদিন শুধু নিজের স্বার্থই দেখেছে, তার কাছে এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার আশা করা বৃথা। আজতো তার সাথে আমার মা’কে নিয়ে কথা বলারই রুচি হচ্ছেনা। ইভেন আজকের পর থেকে কোনদিও আমার মা’য়ের বিষয়ে এই মহিলার সাথে কথা বলবনা। এদের মুখ দেখতেও আমার ঘৃ’ণা হয়। এরা যদি বুঝত, আমার মা’য়ের নাম মুখে নেয়ার মত যোগ্যতা এদের নেই। তবে কখনোই সেসব কথা বলতনা। এখান থেকে চলুন মামা। এদের পাপের শাস্তি দেয়ার জন্য সৃষ্টিকর্তা আছে। আর আমার তরফ থেকে এদের জন্য শাস্তি বলতে শুধু ঘৃ’ণা’ই আছে। আর আমার ঘৃ’ণা যে কত ভয়ংকর এরা এবার তা দেখবে। ” আরমান একটিবারও রাজিয়া খানমের দিকে তাকায়না। সোজা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।
রাজিয়া খানম এই অপমানে কাঁপতে থাকে। এই বয়সে এত অপমানও তার ভাগ্যে ছিল। তবে সে ভয় পাচ্ছে ছেলের কথা ভেবে। তার ছেলে সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলে কি উত্তর দেবে?
সেইদিন বিকেলে আরমানরা গ্রাম ছাড়ে। আরমান কান্তাকে নিয়ে ওর কর্মস্থলে ফিরে। তবে শ্রীজার জোড়াজুড়িতে ওকেও সাথে নেয়।
পনের দিন কেটে গেলেও আরমান স্বাভাবিক হতে পারেনা। এখনও ওর মায়ের ডিএনএ রিপোর্ট আসতে অনেক দেরি। রিপোর্ট আসলেই ও রশিদ বেগের বিরুদ্ধে একে একে মামলা সাজাবে। ওর কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারবে।
আজ সকালে শ্রীজা ঢাকায় ফিরে গেছে। এই কয়টা দিন মেয়েটা ভাইয়ের পাশে ছায়ার মত থেকেছে। ভাইকে সাহস দিয়েছে, শান্তনা দিয়েছে। যাওয়ার সময় মেয়েটা ভাইকে জড়িয়ে ধরে ভিষণ কাঁদছিল।
রাতে ডিউটি থেকে ফিরে আরমান না খেয়েই শুয়ে পরে। কান্তা ওর জন্য খাবার নিয়ে এসে দেখল আরমান কপালে হাত রেখে টানটান হয়ে শুয়ে আছে।
” উঠুন, একটু খেয়ে নিন। এভাবে না খেয়ে থাকলে আপনার শরীর খারাপ হয়ে যাবে। ” কান্তা আলতোভাবে আঙুল চালায় আরমানের চুলে। ওর কন্ঠে কোমলতা খেলা করছে৷
” আমার ক্ষুধা নেই। তুমি খেয়ে নাও। ”
কান্তা বেশ বুঝতে পারছে আরমান আজও খাবেনা। ও একটু নড়েচড়ে বসে। আজ সময় এসেছে সেই কথাগুলো বলার।
” জানেনতো, আমি কোনদিন স্বপ্নেও ভাবিনি, আমার এত সুখের একটা সংসার হবে, দ্বায়িত্ববান স্বামী পাব। আমি সব সময়ই ভেবেছিলাম, আমার ভাই-ভাবী কোন একটা ছেলের সাথে ধরে বেঁধে বিয়ে দিবে। সেখানে আমাকে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর পঁচে ম’র’তে হবে। কেমন আছি এই খোঁজটা নেয়ার কেউ থাকবেনা। আবার হয়তোবা যার সাথে বিয়ে হবে সে-ও ভাইদের মত অবহেলা করবে, দূরদূর করবে। কিন্তু আপনাকে দেখেই আমার সেই ধারনা পাল্টে গেল। আমি ভাবতে শুরু করলাম আপনি আমার #কুড়িয়ে_পাওয়া_ধন। যে ধন আমি অনেক ভাগ্য করে পেয়েছি। আমার মত এতিম মেয়ের যেখানে আরেকটা সংসারে পঁচে ম’রা’র কথা ছিল, সেখানে আপনি আমাকে মাথায় তুলে রেখেছেন। হঠাৎ করেই আপনি আমার জীবনে আসলেন। আমার জীবনটাকে ভালোবাসার চাদরে ঢেকে দিলেন। আমি জানি আমার বাবা-মা কেউ বেঁচে নেই। তাই নিজেকে শক্ত করতে পেরেছি। কিন্তু আপনার ক্ষেত্রে এটা পুরোটাই ব্যাতিক্রম। এত বছর পরও আপনি মা’কে দেখার আশায় ছিলেন। আপনার এই কষ্ট আমি উপলব্ধি করতে পারছি। এবং আপনার অংশীদারও আমি হতে চাই। কিন্তু আপনি আমাকে তা হতে দিচ্ছেননা। এভাবে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখলে আপনি কখনোই সবকিছু সামাল দিতে পারবেননা। কেন আমাকে আপনার দুঃখের সাথী করছেননা! আপনার দুঃখবিলাসের সাথী হয়ে আমি আজন্ম থাকতে চাই। আজ আপনি একা নন। অনেকেই আপনার পাশে আছে। আমি আছি। আরেকজন আসছে। যে আপনার সকল দুঃখ বিনাশ করবে। যে আপনারই অংশ। সে যখন বড় হয়ে সবকিছু জানবে, তখন যদি বলে তার বাবার দুঃখের সাথী হইনি কেন? তখন আমি কি জবাব দিব? আমিতো তাকে বলতে পারবনা, তোমার বাবা আমাকে তার পাশে রাখেনি। সে নিজে পু’ড়ে আমাকে জ্বা’লি’য়ে’ছে। একাকিত্বতেই তার দুঃখ ধুয়েছে। ”
কান্তা আর কিছু বলার আগেই এক ঝটকায় উঠে বসে আরমান।
” কি বললে তুমি! কে আসছে! আমি কি ঠিক শুনেছি? ”
” আপনি ঠিকই শুনেছেন। আমি চাই সে আপনার মা হয়ে আসুক। যে অনেক বছর আগে হারিয়ে গিয়েছিল। সে এবার নতুন পরিচয়ে আসুক। ”
আরমান কান্তাকে জড়িয়ে ধরে। ওর সমস্ত মুখে চুমু দেয়।
” আগে বলনি কেন? আমি তোমাকে মোটেও দূরে সরিয়ে রাখিনি। আমি চাইনি তুমি আমার জন্য কষ্ট পাও। বাবার বাড়িতে অনেক কষ্ট করেছ। আমি চেয়েছি আমার কাছে তুমি শুধুই সুখে থাক। কোন কষ্ট তোমাকে যেন না ছুঁতে পারে। ব্যস এজন্যই তোমাকে এসবে জড়াইনি। আচ্ছা, তুমি কবে জেনেছ, সে আসছে? ”
” দশদিন আগে। কিন্তু এবার আমার কাছে প্রমিজ করুন, আপনি এভাবে মনমরা হয়ে থাকবেননা? নিয়মিত খাওয়াদাওয়া করবেন? এই কয়েকদিন না খেয়ে থেকে আমার ভিষণ কষ্ট হয়েছে। আপনি না খেয়ে থাকলে, আমিও খেতে পারিনা। ”
” আচ্ছা, আর না খেয়ে থাকবনা। এবার খাবারগুলো দাও। আজ তোমাকে আমি খাইয়ে দিব। ” আরমান বিছানা থেকে নেমে ওয়াশরুম থেকে চোখমুখে পানি দিয়ে এসে কান্তাকে খাইয়ে দিয়ে নিজেও খেয়ে নেয়।
এরপর নিজে খাবারের প্লেটসহ সবকিছু রান্নাঘরে রেখে আসে।
কান্তা ততক্ষণে বিছানা ঠিক করে শোয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
আরমান রুমে এসে কান্তাকে নিয়ে শুয়ে পরে। আজ ওর কান্তার সাথে অনেক গল্প করার আছে।
চলবে…
#কুড়িয়ে_পাওয়া_ধন
#পার্ট_৩১
জাওয়াদ জামী
” তোমার মনে কখনও প্রশ্ন জাগেনি, আমি তোমাকে কেন বিয়ে করেছি? ” আরমানের কথা শুনে একটু চমকায় কান্তা। ও আরমানের বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে। আর আরমান ওর চুলে বিলি কাটছে।
” অনেকবারই মনে প্রশ্ন জেগেছে। একবার তো আপনাকে জিজ্ঞেসও করেছিলাম। কিন্তু আপনি চোখ পাকিয়ে আমাকে চুপ করিয়ে দিয়েছিলেন। বারবার মনে প্রশ্ন জেগেছে, আমার মত সাধারণ একটা মেয়েকে আপনি না দেখেই কেন বিয়ে করলেন? আর না কোন খোঁজ খবর নিলেন। যেখানে কোন সম্মান পাওয়ার আশা নেই সেই বাড়ির মেয়ের সাথে কেনইবা কোন বাবা-মা ছেলের বিয়ে করাবে? ”
” কে বলেছে, তোমাকে না দেখে বিয়ে করেছি? তোমার সম্পর্কে খোঁজ না নিয়েই বিয়ে করেছি এমনটা তোমার কেন মনে হল? তোমার আদ্যোপান্ত জেনেই তবে তোমাকে বিয়ে করেছি। খোঁজ না নিয়ে অচেনা কাউকে বিয়ে করার মত বোকা আমাকে তোমার মনে হয়? সারাজীবন যার সাথে কাটাব, তাকে একটু বাজিয়ে না দেখেই বিয়ে করার কথা স্বপ্নেও ভাবিনি আমি। ”
আরমানের কথা শুনে কান্তা উঠে বসে ওর সামনে শুয়ে থাকা ব্যাক্তির দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে।
” আপনি আমাকে বিয়ের আগে দেখেছিলেন! আমার সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছিলেন? কিন্তু কবে? আমি বা আমরা এ সম্পর্কেতো কিছুই জানিনা! কই আমিতো আপনাকে আগে কখনোই দেখিনি! ”
” তুমি নিজেকে যতটা চালাক ভাব আদতে ততটা চালাক তুমি নও। তুমি একটাবারও ভেবে দেখেছিলে, কোন আগন্তুক হঠাৎই তোমার সামনে এসে এক হাজার টাকার নোট খুচরা করতে চাইল কেন? যেখানে আশেপাশে অনেকগুলো দোকান আছে। সে ইচ্ছে করলে দোকান থেকেই টাকা খুচরা করতে পারত। আবার সেই আগন্তুক যখন বলল, তার দশ টাকা প্রয়োজন রিক্সা ভাড়ার জন্য। তুমি কোন প্রশ্ন না করেই দিয়ে দিলে। একবারও চিন্তা করলেনা, যে তোমার কাছে এক হাজার টাকার নোট খুচরা চাইল, সে কেন দশ টাকা তোমার কাছ থেকে চাইছে? এক হাজার টাকা খুচরা করেই সে-তো দশ টাকা রিক্সা ভাড়া দিতে পারত। ”
আরমানের কথা শুনে কান্তার মাথা ঘুরতে শুরু করে। সেদিনের সেই ব্যক্তি তাহলে আরমান ছিল! কান্তার চোখের সামনে ভেসে উঠে সেদিনের ঘটনা।
সেদিন কান্তা কলেজ থেকে বাড়িতে যাওয়ার জন্য অটোরিকশার জন্য দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎই একজন মানুষ তার পাশে এসে দাঁড়ায়। নিজের কাছে কারও উপস্থিতি টের পেয়ে ভরকে যায় কান্তা। সেখান থেকে সরে আসতে চাইলে মুখ খোলে আগন্তুক।
” এক্সকিউজ মি, ম্যাম। আপনার কাছে এক হাজার টাকার নোট খুচরা হবে? ”
” আমার কাছে এত টাকা নেই। ” বলেই কান্তা সরে আসতে চাইলে, আবারও কথা বলে সেই ব্যক্তি।
” দশ টাকা দিতে পারবেন আমাকে? রিক্সা ভাড়া দিতে পারছিনা। দশ টাকা আছেতো আপনার কাছে? ”
কান্তা আগন্তুকের কথার উত্তর না দিয়ে ব্যাগ হাতড়ে দশ টাকার একটা নোট বাড়িয়ে দেয় সামনে। আগন্তুক হাত বাড়িয়ে টাকা নিয়ে কান্তাকে ধন্যবাদ জানায়।
কান্তা এবারও তার ধন্যবাদের জবাবে কিছুই বলেনা। সামনে একটা অটো আসতে দেখে সেদিকে এগিয়ে যায়। পুরোটা সময় কান্তা একবারও আগন্তুকের দিকে তাকায়নি।
অতীত থেকে বেরিয়ে আসে কান্তা। ওর বিস্ময়ভাব এখনও কাটেনি। হঠাৎ করেই যেন অসার হয়ে আসছে শরীরটা। যেই মানুষটাকে চিনতে তার অনেকদিন সময় লেগেছে। সেই মানুষটাই তাকে আগে থেকে চিনে রেখেছে! জেনে নিয়েছে কান্তার আদ্যোপান্ত! শুরু থেকেই সবটাই তার নিয়ন্ত্রনে ছিল! হঠাৎই কান্তার ভেতরটা ভালো লাগায় ছেয়ে যায়। যেন চারপাশে হাজারও ফুলের সৌরভ ম ম করছে। রংবেরঙের প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে বুকের আকাশ জুড়ে।
” সেদিন সেই মানুষটা আপনি ছিলেন! আপনি কেমন করে জানলেন, আমি সেদিন কলেজে গিয়েছিলাম! প্লিজ, পুরোটা বলুননা। এভাবে অর্ধেকটা বলে আমাকে অপূর্ণতায় রাখবেননা। ” কান্তার অনুনয় দেখে আরমানের ঠোঁট হালকা প্রসারিত হয়। তা দেখে কান্তার চোখে পানি আসে। মানুষটাকে কতদিন পর হাসতে দেখল। হোকনা সে হাসি যৎসামান্য। তবুও তো হেসেছে।
” শোন তবে। অনেকদিন আগে থেকেই আকলিমা খানম আমার বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল। সে অনুযায়ী পাত্রীও দেখছিল। আমি প্রতিবারই তাদের সব প্রস্তাব না করে দিই। আমি চাচ্ছিলাম নিজের পছন্দমত মেয়েকে বিয়ে করতে। আকলিমা খানমের ইচ্ছে ছিল, তার পরিচিত কিংবা আত্মীয় কাউকে আমার সাথে বিয়ে দিয়ে আমাকে কোনঠাসা করে রাখার। তার ইচ্ছেতেই সবকিছু হোক এটা তার মনে ছিল। কিন্তু আমি রাজি হইনি। শেষ পর্যন্ত আমার সাথে পেরে না উঠে, শুরু করে গরীব ঘরের মেয়ে দেখতে। যাতে সে নিজের মত করে মেয়েটাকে পরিচালনা করতে পারে। এক কথায় সে একজন কাজের মেয়ে চাইছিল। এভাবে একদিন সে তোমার খোঁজ পায়। যখন জানল তোমার বাবা-মা নেই। তখন তাকে আর পায় কে। বরাবরের মত আমি এবারও তাদের প্রস্তাব না করে দিয়ে সেখান থেকে সরে আসতেই কানে গেল, মেয়েটা এতিম।আমার পুরো দুনিয়া টলে উঠল। যেখানে আমি ছোটবেলা থেকেই এতিমের মত জীবন কাটিয়েছি, সেখানে আরেকটা এতিমের সাথে আমার বিয়ের কথা চলছে! সিদ্ধান্ত নিলাম তোমার সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিব। কারন এতিম হওয়ার কষ্ট আর কেউ না বুঝলেও আমি বুঝি। তাই শ্রীজার কাছ থেকে তোমার বাড়ির ঠিকানা নিলাম। এরপর ভার্সিটি থেকে ছুটি নিয়ে তোমার গ্রামে গেলাম। সেখানে চারদিন কাটালাম তোমার সম্পর্কে খোঁজ নিতে। যে আন্টি তোমার খোঁজ আকলিমা খানমকে দিয়েছিল, সেই আন্টির বোনের সাথে যোগাযোগ করে তোমার বাড়ি চিনে নিলাম। এরপর দেখলাম তোমাকে। বাইরের উঠানে সারাদিন ধরে কাজ করতে দেখলাম একটা মেয়েকে। কাজ করতে যার কোন ক্লান্তি নেই, নেই কোন অভিযোগ। আশেপাশের অনেকের কাছ থেকে শুনলাম মেয়েটার দূর্দশার কথা। একদিন বাজারে টং দোকানে বসে চা পান করছিলাম, তখন দেখলাম তুমি কোথাও যাচ্ছ। ব্যাস, তোমার পিছু নিলাম। তোমার অটোতে না উঠে অন্য অটোতে উঠে চললাম তোমার পিছুপিছু। তুমি কলেজে গেলে। আমি বসে রইলাম সামনের দোকানে। এরপর শুধুই অপেক্ষা। একসময় তোমার ক্লাস শেষ হল। তুমি অটোর জন্য অপেক্ষা করছিলে। আর তখনই আমার টাকা খুচরো করার দরকার পরল। এরপর ঢাকা যেয়ে শহিদ আহমেদকে জানালাম, তোমাকে বিয়ে করব। এতটুকুই গল্প। ”
কান্তার বলার মত আর কিছুই নেই। ও চুপচাপ আবারও আরমানের বুকে মাথা রেখে শুয়ে পরে। মানুষটা সব জেনেই ওকে বিয়ে করেছে! এজন্যই কখনও ওর বাবার বাড়ি নিয়ে কোন কথাই তোলেনি! উল্টো সেখানে যেতে নিষেধ করেছে! মানুষটার ওপর কৃতজ্ঞতায় ছেয়ে যায় কান্তার মন। আড়াল থেকে মানুষটা ওকে কতভাবে সাপোর্ট দিয়েছে, অথচ একটাবারও টের পেতে দেয়নি!
” চুপ হয়ে গেলে যে? আর কিছু জানতে চাওনা? তোমার কষ্টের জীবন সম্পর্কে জেনেছিলাম জন্যই, আমি তোমাকে নতুন করে কোন কষ্ট দিতে চাইনি। আমার এই দুঃসময়েও তোমাকে আমার সাথে জড়াতে চাইনি। আমি চেয়েছি সব কষ্টই আমার হোক, বিনিময়ে তুমি সুখের হাসি হাসো। একজীবনে অনেক কষ্ট সয়েছ। তোমার সেই কষ্টেই এখনও আমি প্রলেপ লাগাতে পারিনি। তাই নতুন করে আবার তোমাকে কষ্টে জড়াতে ইচ্ছে করলনা। কিন্তু তুমি সেটা না বুঝে, বুকে অভিমানের পাহাড় জমালে। মেয়ে, তুমি কি জানো, তোমার সকল অভিমানও জমা হয় আমার বুকের খাতায়? যেমন করে তোমার সকল ভালোবাসা জমা হয় আমার হৃদয় গহীনে। তোমার অভিমান বুঝতে না পারার মত বোকা আমি নই। এই পনেরদিন একটু দূরে দূরে থেকেছি বলেই ভেবে নিয়েছ, আমি তোমাকে দুঃখের সাথী করিনি? আমিতো শুধু নিজেকে সামলানোর জন্য সময় নিচ্ছিলাম। যেদিন থেকে তুমি আমার জীবনে এসেছ, সেদিন থেকে তুমিই আমার সুখ-দুঃখের সাথী হয়েছ। ”
কান্তার আজ অবাক হবার পালা। মানুষটা ওকে কিভাবে চমকে দিচ্ছে! কান্তার অভিমান হয়েছিল, সে এটাও জেনে গেছে!
” আপনি এত কিছু জানেন কিভাবে? কই আমিতো এভাবে জানতে পারিনা, এভাবে বুঝতে পারিনা! ”
” আমার মত করে ভালোবেসে দেখ। তুমিও সব জানবে, সব বুঝবে। ভালোবাসার মাঝে কখনও জড়তা, সংকোচ, সন্দেহ এসব আনতে নেই। এসব যখন কারও ভালোবাসার মধ্যে থাকবেনা, তখন সেই ভালোবাসা হয়ে ওঠে পরিশুদ্ধ। আমার ভালোবাসাও তেমনি পরিশুদ্ধ। তোমার ভালোবাসার মধ্যে থেকে শুধু জড়তা আর সংকোচকে ছুঁড়ে ফেলে দাও, দেখবে তুমিও আমার মত করে ভালোবাসতে শিখে যাবে। তখন তোমার সকল প্রশ্নের উত্তর তুমি নিজেই পেয়ে যাবে? ”
কান্তার আর কিছু বলতে ইচ্ছে করছেনা। আজ শুধু ইচ্ছে করছে মানুষটাকে অনুভব করতে। মানুষটার ভালোবাসার গভীরতা আজও তার জানা হয়ে উঠলনা। ও পরম আবেশে ঠোঁট ছোঁয়ায় মানুষটার লোমশ বুকে। এই বুকে মানুষটা কান্তার জন্য এত ভালোবাসা জমা রেখেছে! আবেগে ভিজে যায় কান্তার চোখ। এত ভালোবাসাও ওর ভাগ্যে ছিল!
” শুধু তিনটা চুমুর জন্য এত গল্প শোনালাম! ভালোবাসায় এত কিপ্টামো করলে হয়না, বুঝলে? আজ থেকে তোমার সব কিপ্টামো বাদ। শেষে দেখা যাবে আমার মেয়েটাও তোমার মত কিপ্টে হয়েছে। তখন বেচারা জামাই বাবাজিকে আমার মত ভালোবাসাহীনতায় থাকতে হবে। ভালোবাসতে হয় প্রানখুলে। বুঝলে আমার বোকা, বউ? ”
আরমানের কথা শুনে কান্তা মুখে হাত চাপা দেয়। ওর দুইটা রসগোল্লার আকার ধারণ করেছে৷
এই বেহায়া লোক বলে কি!
” ছিহ্ আপনার একটুও লজ্জা নেই! মেয়ের দুনিয়ায় আসতে এখনও কত মাস বাকি আছে। আর আপনি কিনা এখন থেকেই এসব আজেবাজে কথা ভাবছেন? মেয়ে জন্মাবে, বড় হবে, পড়াশোনা শিখবে তারপর বিয়ের কথা চিন্তা করব। হিসেব করলে দেখা যাবে পঁচিশ বছরের আগে হবেইনা। আর আপনি বাবা হয়ে এখনই এসব ভাবছেন! লজ্জাহীন লোক একটা। ”
” তোমার জন্যই তো এসব বলতে হচ্ছে। ভালোবাসায় একটু উদারতা দেখালে কি হয়? কতদিন তোমাকে কাছে পাইনি সেই হিসেব তোমার আছে? এতদিন পর একটু চুমু দিলে, তাও আবার তিনটা। কেন, একসাথে আনলিমিটেড চুমু দিলে ঠোঁট কি ক্ষয়ে যাবে? ” কান্তা আরমানের মুখে হাত দিয়ে ওকে থামায়। ও জানে মানুষটাকে কথা বলার সুযোগ দিলে এখন ননস্টপ উল্টাপাল্টা কথা শুনিয়েই যাবে।
আরমানও হাঁফ ছাড়ে। যাক, অবশেষে তার বউয়ের মন ভালো করতে পেরেছে। কয়দিন থেকেই মেয়েটা মনমরা হয়ে ছিল। ওকে মনমরা দেখতে আরমানেরও ভালো লাগছিলনা।
আরমানের বুকে মাথা রেখে কান্তা ভাবছে, ও মানুষটার মন একটু হলেও ভালো করতে পেরেছে। কয়েকটাদিন তার মুখের দিকে তাকাতে পারছিলনা কান্তা। অবশেষে, তার মুখে আজ হাসি ফোটাতে পেরেছে কান্তা।
শহিদ আহমেদের শরীর ভালো নেই। তিনি স্ত্রী ও মায়ের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছেন। নাওয়াখাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। তার নিজেকে নিজের কাছেই অপরাধী মনে হচ্ছে। এত বছর পর তার মনে হচ্ছে, সেদিন মা’য়ের কথাগুলো মেনে নেয়া তার জন্য ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। কেন মা’য়ের কথায় প্রভাবিত হয়ে, আইরিনকে খোঁজার চেষ্টা করলনা? কেন সহজেই মেনে নিল, আইরিন অন্যের সাথে পালিয়ে গেছে? কেন, মায়ের কথায় আকলিমাকে বিয়ে করল? আর কেনইবা নিজের সন্তানকে দিনের পর দিন কষ্ট দিয়ে গেল? এসব প্রশ্ন তার ভেতরে আসতেই অপরাধবোধে কুঁকড়ে যাচ্ছেন তিনি। তার জন্যই আজ তার ছেলেটার জীবন অন্যরকম। তার ছেলেটা সবার থেকে দূরে চলে গেছে। কিভাবে নিজেকে ক্ষমা করবেন তিনি? আর কিভাবেই বা ছেলের কাছে ক্ষমা চাইবেন।
বিছানায় শুয়ে তড়পাতে থাকেন শহিদ আহমেদ। এখন তার মাঝেমধ্যেই মনে হয়, তার পুরোটা জীবন ভুলে ভরা।
চলবে…