#কুড়িয়ে_পাওয়া_ধন
#পার্ট_৩২
জাওয়াদ জামী
রাত পেরিয়ে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে ধরিত্রীর বুকে। শহিদ আহমেদ বাগানে পায়চারী করছেন। আজ রাতেও তিনি ঘুমাননি। সেদিন আইরিনের শেষ পরিনতি জানার পর থেকেই তার চোখের ঘুম উবে গেছে। নিজেকে বারংবার দোষী ভাবছে মন। বারবার মনে হচ্ছে সে পাপী। তার এই মহাপাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে না পারলে ম’রেও শান্তি পাবেননা তিনি।
চারপাশে ফজরের আজানের সুমধুর ধ্বনি বাজতেই ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসলেন শহিদ আহমেদ। সামনে তাকাতেই লক্ষ্য করলেন দারোয়ান মেইন গেইটের দিকে যাচ্ছে।
” এই ভোরে দারোয়ান কোথায় যাচ্ছে? মাত্রই তো আজান দিচ্ছে! ” নিজের সাথে কথা বলেই শহিদ আহমেদ দারোয়ানের দিকে প বাড়ান।
ততক্ষণে দারোয়ান গেইট খুলে দিয়েছে। আর ভেতরে ঢুকছে তার ছোট ছেলের গাড়ি। শহিদ আহমেদ কপাল কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন গাড়ির দিকে। শুভ গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসলে ওর সমানে যেয়ে দাঁড়ায় শহিদ আহমেদ।
” এত ভোরে তুমি কোথায় থেকে আসলে? কোথায় ছিলে সারারাত? ”
” উফ্ বাবা, বাসায় আসতে না আসতেই তুমি শুরু করে দিয়েছ? তোমার ঘ্যানঘ্যানানিতে বাসায় এসেও শান্তি নেই। জাষ্ট অসহ্য লাগে তোমার এমন গোয়েন্দাগিরি। সব সময় বাবা গিরি ফলিয়ে কি এমন শান্তি পাও? ” শুভ টলছে। ও দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেনা।
শহিদ আহমেদের বুঝতে বাকি থাকেনা, তার ছেলে নেশায় বুঁদ হয়ে আছে। ছেলেকে এই অবস্থায় দেখে শহিদ আহমেদ কথা বলার ভাষা হারিয়েছেন। তার ছেলের এতটা অধঃপতন হয়েছে ভাবতেই তার দমবন্ধ হয়ে আসছে। সেই সাথে রা’গও তরতর করে বাড়ছে। তিনি ছেলেকে টানতে টানতে ভেতরে নিয়ে আসলেন। ভেতরে এসেই স্ত্রীকে চিৎকার দিয়ে ডাকতে থাকেন।
স্বামীর ডাক শুনে আকলিমা খানম রুম থেকে বেরিয়ে আসে। ড্রয়িংরুমে এসে স্বামীর সাথে ছেলেকে দেখে তার কলিজা শুকিয়ে যায়। শহিদ আহমেদ শুভকে ধরে রেখেছেন আর শুভ টলছে।
” তোমার ছেলের যে এত অধঃপতন হয়েছে, তা কি তুমি জান? এই ভোরে সে নেশা করে বাসায় এসেছে। কবে থেকে চলছে এইসব? ”
শহিদ আহমেদের প্রশ্নের জবাব দিবে আকলিমা। সে কোন উত্তর খুঁজে পায়না।
” উত্তর দিচ্ছনা কেন? নিজের সন্তানকে মানুষ করতে পেরেছ? খুব তো চেয়েছিলে, তোমার ছেলে যেন আরমানকে ছাড়িয়ে যায়। আজ তোমার কি মনে হচ্ছে? তোমার ছেলে আরমানকে ছাড়িয়ে যেতে পেরেছে? ছেলেটাকে তো কম জ্বালাওনি। কি পেলে এতসব করে? ”
” জাষ্ট স্যাট আপ, বাবা। তুমি মায়ের সাথে এভাবে কথা বলছ কেন? নিজেকে কি মনে কর? দুইটা পয়সার মালিক হয়েছ বলেই এভাবে কথা বলবে? তোমার এত সম্পদ খাবে কে? আমরাই মালিক এসবের। এখন যে এত ফুটানি দেখাচ্ছ, শেষ বয়সে তোমাকে দেখবে কে? আমি যদি লাথি দিয়ে বের করে দিই, তখন কোথায় যাবে? আমাকে শাসন করতে আসছে! বড় ছেলের সাথে আমার তুলনা দেয়! এখনতো আবার একটা বাহানা পেয়েছে, তার বড় বউ ম’রে গেছে। বউয়ের শোকে দেবদাস হয়েছে। এই বাহানায় এখন বড় ছেলেও ভালো হয়েছে। আর আমরা হয়েছি নিকৃষ্ট। আমার মা এখন খারাপ হয়েছে। স্বার্থপর মানুষ বুঝি একেই বলে। ”
শুভর কথা শুনে শহিদ আহমেদ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। এসব কি বলছে তার ছেলে! এতবড় অপমান তাকে করল শুভ! ছেলে হয়ে বাবাকে লাথি মা’র’তে চাইল! ধপ করে মেঝেতে বসে পরলেন শহিদ আহমেদ। তার সমস্ত শরীর ঘেমে-নেয়ে একাকার। এসব তারই কর্মফল।
” শুভ, তুই আমার ছেলেকে এসব কি বলছিস? নিজের হিতাহিত জ্ঞান হারিয়েছিস? তোর এত অধঃপতন হয়েছে? ভালোবাসা বেশি পেয়েছিস জন্যই এতটা বেড়েছিস। নিজের বাবাকে সম্মান দিতে পারছিসনা। ছিহ্, এতটা বেয়াদব হয়েছিস? ”
” ওহ দাদিমা, তুমিও শুরু করেছ? আজ হঠাৎ ছেলের পক্ষ নিচ্ছ? নাকি তুমিও ছেলের বউয়ের শোকে উল্টাপাল্টা বকছ? বুড়ো বয়সে তোমাকেও দেখছি ভীমরতিতে পেয়েছে! শোন একটা পরামর্শ দিই, আজ বাদে কাল ম’র’বে, তাই এই কয়দিন বেশি বেশি করে আল্লাহর নাম নাও। সুযোগ পেলেই সবাই নিজের জ্ঞান জাহির করতে পিছপা হয়না। আমাকে কি তোমরা আরমান পেয়েছ? যখন খুশি তখনই কথা শোনাবে? শুনে রাখ, আমি আরমান নই আমি শুভ। আমাকে জ্ঞান দিতে আসলে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ডাষ্টবিনে ফেলে আসব। যত্তসব, ফালতু মানুষজন, আস্তাকুঁড়ের আবর্জনা । ” শুভ কথাগুলো বলেই টালমাটাল পায়ে উপরে যায়।
রাজিয়া খানমের নাতির এরূপ অপমান হজম করতে কষ্ট হয়। আজ কেন যেন আরমানকে ভিষণ মনে পরছে। আরমান সবার হাজারও কটুকথা শুনে নীরবে হজম করত। কতইনা কষ্ট ছেলেটাকে তারা দিয়েছে। তবুও সে কখনও এভাবে বলেনি। ছেলের পাশে বসে তার কাঁধের উপর হাত রেখে কাঁদতে থাকে রাজিয়া খানম।
ছেলের এহেন মুখের ভাষা শুনে আকলিমা খানমেরও চোখে পানি আসে। এটাও হওয়ার ছিল!
চিৎকার-চেঁচামেচির শব্দ শুনে শ্রীজা রুম থেকে বেরিয়ে নিচে আসতেই, শুভর কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়। তবে ওর একটুও খারাপ লাগছেনা। আজ যেন একটু শান্তি শান্তি লাগছে। একেই বুঝি বলে, প্রকৃতির প্রতিশোধ। আসলেই প্রকৃতি কখনোই কারও ঋণ রাখেনা। একদিন না একদিন, সুদে আসলে ফিরিয়ে দেয়। হাঁই তুলে আবারও রুমের দিকে পা বাড়ায় শ্রীজা।
সেদিন সকালে অফিসে গিয়ে প্রথমেই শহিদ আহমেদ তার ল ইয়্যারকে ডাকেন। তার সাথে কিছু জরুরী কাজ আছে।
রাজিয়া খানম সেদিনের পর থেকে অসুস্থ হয়ে পরেছে। কিছুই খেতে পারছেনা সে। সব সময়ই অনুশোচনা এসে হানা দিচ্ছে তার মনে। বিবেক বলছে, তুই বড্ড ভুল করেছিস, পাপ করেছিস। তোর কর্মফল তোকেই ভোগ করতে হবে।
ধীরে ধীরে বিছানা থেকে নেমে আলমিরার কাছে এসে দাঁড়ায় রাজিয়া খানম। আলমিরার পাল্লা খুলে বের করে আনে একটা বাক্স। এটা তাকে তার শ্বাশুড়ি দিয়েছিলেন বিয়ের দিন। বলেছিলেন, এখানে আছে এই পরিবারের ঐতিহ্য। এরপর বাক্সের ডালা খুলে বের করেন একটা সাতনরি হার। পরিয়ে দেন পুত্রবধূর গলায়। এটাই নাকি তাদের ঐতিহ্য। বংশের বড় ছেলের বউ পায় এই হার। এটাই হয়ে আসছে বংশপরম্পরায়। তবে স্বামীর বংশের ঐতিহ্যকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে রাজিয়া খানম এটা আইরিনকে দিতে অস্বীকার করে। আইরিন হারিয়ে যাবার পর, তার ভাইয়ের মেয়েকে পুত্রবধূ করে এনে এটা সে আকলিমাকে দিয়েছিল। এতদিন এই হারটা আকলিমার কাছেই ছিল। আজ দুপুরে সে আকলিমার কাছ থেকে এটা চেয়ে নেয়। আকলিমাও বিনাবাক্যে ফুপুকে বাক্সটা দিয়ে দেয়।
ফজরের আজান দিতে আরও কিছুটা সময় বাকি। আরমান কান্তাকে তার বুকে জরিয়ে নিয়ে ঘুমাচ্ছে। চারদিকে নিস্তব্ধতার চাদর বিছিয়ে দিয়েছে ধরনী। শুধু মাথার ওপর শাঁ শাঁ আওয়াজে ফ্যান চলছে। হঠাৎই নিস্তব্ধতাকে গ্রাস করে বেজে ওঠে আরমানের মোবাইল। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকায় দুজনের কেউই শুনতে পায়না। তবে বিরতিহীনভাবে বাজতে থাকায় একসময় দুজনেরই ঘুম ভেঙে যায়। কান্তার মাথা বালিশের ওপর রেখে, আরমান বিছানা হাতড়ে ফোন হাতে নেয়। এই অসময়ে কে ফোন দিয়েছে! মুখের সামনে নিতেই দেখল আননোন নম্বর। কয়েক সেকেন্ড ভেবে রিসিভ করে ফোন।
” আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন? ” ঘুম জড়ানো গলায় বলে আরমান।
” আরমান, তুমি কি ঢাকায় আসতে পারবে, কান্তাকে নিয়ে? আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। ”
গলার স্বর চিনতে আরমানের কয়েক সেকেন্ড সময় লাগে। এবার আরমানের অবাক হওয়ার পালা।
” এতরাতে এই কথা জানাতে ফোন দিয়েছেন! আমি আপাতত ঢাকায় যাচ্ছিনা। দুঃখিত আপনার কথা না রাখতে পারার জন্য। ”
” এখন ভোর। একটু পরেই ফজরের আজান দিবে। আমিও দুঃখিত তোমার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটানোর জন্য। তবে যদি পার একটিবার এসে আমার সাথে দেখা করে যেও। আর কোনদিনও তোমাকে বিরক্ত করবনা। এটা এক বৃদ্ধার শেষ আকুতি ধরে নাও। রাখছি। তোমরা ভালো থেক। ”
ফোন কেটে গেছে। আরমান অবাক হয়ে ফোনের স্ক্রীনে তাকিয়ে আছে। ওর এত বছরের জীবনে আজ এমন আজব অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছে।
” কে ফোন করেছিল? আপনি এভাবে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছেন কেন? ” কান্তা উঠে বসে আনমানকে জিজ্ঞেস করে।
” রাজিয়া খানম ফোন করেছিল। সে আমাকে ঢাকা যেতে বলে তোমাকে সহ। ”
” আর আপনি যেতে চাইলেননা, তাইতো? ”
” হুম। ”
” ভুল করবেন না গেলে। অফিস থেকে ছুটি নিয়ে চলুন ঢাকা যাই। উনি হঠাৎ কেন আমাদের ডাকলেন তা জানা দরকার। ”
” আমার যাওয়ার মোটেও ইচ্ছে নেই। আর ঐ বাড়িতে তো অবশ্যই নয়। এখন শুয়ে পর। ”
” প্লিজ, বয়স্ক মানুষ হঠাৎ করেই ফোন করেছে, নিশ্চয়ই এর কোন কারন আছে। আমরা নাহয় ঐ বাড়িতে না-ই গেলাম। শ্রীজাপুর সাথে দাদিমাই আসলো আমাদের সাথে দেখা করতে।”
” সেটা পরে ভাবলেও চলবে। এবার তুমি ঘুমাও। ”
কান্তা আর কথা না বাড়িয়ে শুয়ে পরে। তবে ওর চোখে আর ঘুম আসলনা। আরমানেরও তাই।
একটু পর ফজরের আজান দিতেই দুজনেই উঠে পরে।
সকালে শ্রীজার ফোন পেয়ে স্তব্ধ হয়ে যায় আরমান। শ্রীজা ওকে জানাল, দাদিমা হঠাৎ করেই ফজরের নামাজের পর অসুস্থ হয়ে পরেছে। তাকে হসপিটালাইজড করা হয়েছে। ডক্টর জানিয়েছেন তার ব্রেইন স্ট্রোক হয়েছে।
সংবাদ পাওয়া মাত্রই আরমান দেরি না করে কান্তাকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
চলবে….
#কুড়িয়ে_পাওয়া_ধন
#পার্ট_৩৩
জাওয়াদ জামী
ওরা ঢাকায় পৌঁছেই হসপিটালে যায়। দীর্ঘ ভ্রমনে কান্তা অসুস্থ হয়ে গেছে। এমনিতেই প্রেগ্রেন্সিতে ওর নানারূপ অসুবিধা দেখা দিয়েছে। বমি তো নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। রাস্তায় আসার পথেই কয়েকবার বমি করে নেতিয়ে পরেছে মেয়েটা। আরমান একটু ভয়ই পেয়ে যায় ওর অবস্থা দেখে। তবে খালা বারবার ওকে সাহস দিয়েছে। বলেছে, এই অবস্থায় এগুলো মেয়েদের জন্য সাধারণ বিষয়।
আরমান হসপিটালে পৌঁছে প্রথমেই একটা কেবিন বুক করে। সেখানে কান্তাকে রেখে ডক্টরের কাছে যায়। একজন গাইনী ডক্টরের কাছে সিরিয়াল দিয়ে তবেই একটু শান্ত হয়।
আকলিমা খানম দুর থেকে কপাল কুঁচকে আরমানের কর্মকান্ড দেখছিল। আরমানের উদ্বিগ্ন ভাব দেখেই সে ধরে নিয়েছে ঘটনা কি।
শহিদ আহমেদ ছেলের সাথে কথা বলার চেষ্টা করছেন। কিন্তু আরমান তাকে পাত্তা না দিয়ে শ্রীজার সাথে কথা বলায় ব্যস্ত থাকে।
রাজিয়া খানমকে আইসিইউতে রাখা হয়েছে। তার অবস্থা খুব একটা ভালো নয়।
ওরা সারাদিন ধরে অপেক্ষা করে রাজিয়া খানমের সুস্থ হওয়ার আশায়।
কান্তার চেক-আপ করা হয়েছে। ডক্টর জানিয়েছে ওর শরীরটা একটু দুর্বল। তাছাড়া সব ঠিকঠাক আছে।
শহিদ আহমেদ তার ছেলেকে অনেকবার বলেছেন, কান্তাকে নিয়ে বাসায় যেতে। কিন্তু আরমান বাবার কথা কানে তোলেনি। ও কেবিনেই কান্তা ও খালার জন্য খাবার নিয়ে আসে।
শ্রীজা বাসা থেকে খাবার এনেছে কিন্তু আরমান সেই খাবার নিজেও ছুঁয়ে দেখেনি আবার কান্তাকেও ছুঁতে দেয়নি।
” তুমি আসার পর থেকেই এভাবে শুয়ে-বসে কাটাচ্ছ কেন? তুমি কি অসুস্থ? ” আকলিমা খানম হসপিটালের কেবিনে এসে কান্তাকে জিজ্ঞেস করে।
কান্তা আকলিমা খানমকে দেখে উঠে বসে। একটু হেসে জবাব দেয়,
” অসুস্থ নই, একটু ক্লান্ত। রাস্তায় আসার পথে বেশ কয়েকবার বমি করেছি। তাই শরীরটা একটু দুর্বল লাগছে। ”
” হঠাৎ বমি করেছে কেন? কোন খবর আছে নাকি? ”
কান্তা আকলিমা খানমের প্রশ্ন বুঝতে পারে। ও আবারও হেসে বলে,
” জ্বি। ”
” আমরাও তো সন্তান পেটে ধরেছি, জন্ম দিয়েছি। একটুআধটু শরীর খারাপ আমারও করেছে। তাই বলে এমন শুয়ে-বসে দিন কাটাইনি। এখনকার বউরাও হয়েছে এক নম্বরের ফাঁকিবাজ। কতদিন পর এসেছে, সবার সাথে কথা বলবে কিনা, তা না করে অসুস্থতার অযুহাতে হসপিটালের বেডে শুয়ে আছে। ”
আকলিমা খানমের কথা শুনে কান্তা ছ্যাঁত করে উঠে। রাগে রি রি করতে থাকে শরীরের শিরা-উপশিরা।
” এখানেই মা, সৎমা আর শ্বাশুড়ি, সৎ শ্বাশুড়ির পার্থক্য। আপনি যদি আমার নিজের শ্বাশুড়ি হতেন তবে এভাবে বলতে পারতেন? আরমান যদি আপনার নিজের ছেলে হত, তবে কি আপনি আমার সাথে এমন আচরন করতে পারতেন? একবার আমার জায়গায় নিজের মেয়েকে রেখে দেখুনতো। তখনও কি আপনার মনে হবে আপনার মেয়ে ফাঁকিবাজ? আসলে আপনার মত মানুষরা কখনোই বদলাননা। ধিক্ আপনার মত নারীদের ধিক্। নারী যদি নিজের সংসারকে সুখের বাগানে রূপান্তরিত করতে না-ই পারে, তবে তার নারীত্বের গর্ব কোথায়? শুধু সন্তান জন্ম দিলেই তার নারীত্ব প্রকাশ পায়না। দয়া , মায়া-মমতা, দ্বায়িত্ব-কর্তব্য, ত্যাগ-তিতিক্ষা, কোমল-কঠিনেই একজন নারী হয় পরিপূর্ণ। যার কোনটাই আপনার কাছে নেই। আপনি শুধু নিজেরটাই বুঝেন। ” কান্তা একনাগাড়ে
কথাগুলো বলে আকলিমা খানমের দিকে পিঠ দিয়ে শুয়ে পরে।
আকলিমা খানম কান্তাকে কিছু না বলে মুখ কালো করে কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়।
সেইদিনও রাজিয়া খানমের জ্ঞান ফিরেনা। আরমান কান্তাকে নিয়ে হসপিটালেই অবস্থান করছে। খালা বাসায় গেছে। শ্রীজা রাতে কান্তার সাথেই থাকে। আকলিমা খানম ও শহিদ আহমেদ দুজনকেই বাসায় পাঠিয়ে দেয় শ্রীজা।
পরদিন দুপুরে রাজিয়া খানমের জ্ঞান ফিরে। তাকে আইসিইউ থেকে বের কেবিনে শিফট করা হয় সন্ধ্যায়।
জ্ঞান ফিরলেও রাজিয়া খানম কথা বলতে পারছেনা। শুধু ফ্যালফেলিয়ে সবার দিকে তাকিয়ে আছে। সেই সাথে চোখ দিয়ে অনর্গল পানি ঝরছে। সে আরমানে দিকে বারবার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। উপায় না দেখে আরমান তার হাত ধরে বসে থাকে।
সারারাত আরমান ও শ্রীজা রাজিয়া খানমের কেবিনে বসে থাকে। কান্তাও ওদের সাথে ছিল। তবে মাঝরাতের দিকে আরমান কান্তাকে জোর করে ওর জন্য রাখা কেবিনে পাঠিয়ে দেয়। এরপর শ্রীজা ও আরমান মিলে গল্প করে বাকি রাত কাটায়।
সকালে আরমান শ্রীজাকে কেবিনে রাজিয়া খানমের কাছে রেখে কান্তার কাছে যায়। ওর সাথে কিছুক্ষন কথা বলে বাইরে যায় খাবার কিনতে।
শ্রীজা দাদিমার মাথার কাছে বসে আছে। সারারাত ঘুম না হওয়ার দরুন ও ঘুমে ঢুলছে। এমন সময় ওকে অবাক করে দিয়ে চোখ মেলে চায় রাজিয়া খানম। মুখ খোলে কথা বলার জন্য।
শ্রীজাও দাদিমার আরও কাছে এগিয়ে যেয়ে মনযোগ দিয়ে তার কথা শুনতে থাকে।
দাদিমা অনেক কষ্টে শ্রীজাকে কিছু কথা বলে আবারও ঘুমিয়ে পরে।
এরইমধ্যে আরমান খাবার নিয়ে এসেছে। কান্তাও এসেছে দাদিমার কাছে। কান্তা ও আরমানকে কেবিনে দেখে শ্রীজা সেখান থেকে বেরিয়ে আসে।
আরমান কান্তাকে ধমকে নাস্তা করায়। কান্তা কিছুতেই খেতে চাচ্ছিলনা। দাদিমার দিকে তাকালেই ওর শুধু কান্না পাচ্ছে। কিন্তু ডাক্তার ওকে বারবার বলে দিয়েছে কিছুক্ষণ পরপর খেতে। তাই আরমানও নাছোড়বান্দার মতো কান্তাকে জোড়াজুড়ি করে খাওয়ার জন্য।
প্রায় দেড় ঘন্টা পর শ্রীজা হসপিটালে এসে দেখল দাদিমা এখনও ঘুমাচ্ছে।
দাদিমার ঘুম ভাঙ্গলো শেষ বিকেলে। তখনও আরমান তার পাশে ঠাঁয় বসা। সেখানে অবশ্য শুভ ছাড়া ঐ পরিবারের সবাই আছে।
রাজিয়া খানমের ঘুম ভাঙ্গলে পাশে আরমানকে দেখে তার ঠোঁটে খেলে যায় এক চিলতে সরু হাসির রেখা।
রাজিয়া খানম ধীরে আরমানের নাম ধরে ডাক দেয়।
” আরমান। ”
” বলুন। আপনার সব কথা আজ আমি শুনব। ”
” কান্তাকেও ডাক। ”
আরমান কান্তাকে ডাকলে কান্তা সেখানে আসে।
রাজিয়া খানম শ্রীজাকে ইশারা করলে শ্রীজা এসে তার বালিশের পাশ থেকে একটা বাক্স বের করে আনে। বাক্সটা আরেকটা বালিশ দিয়ে চাপা দেয়া ছিল। শ্রীজা বাক্সটা রাজিয়া খানমের হাতে দেয়। রাজিয়া খানম শোয়া অবস্থায়ই বাক্সের ডালা খুলে বের করে আনে একটা সাতনরি হার। সেটা বাড়িয়ে দেয় কান্তার দিকে।
” এটা আমার বংশের ঐতিহ্য। যেটা পাওয়ার অধিকার ছিল আইরিনের। কিন্তু একদিন তার অধিকার আমি হরন করেছিলাম। হিসেব মত এটার মালিক এখন তুমি। আজ এটা তোমার কাছে দিয়ে আমি পাপ থেকে একটু মুক্তি পেতে চাই। শ্রীজা আমার বড় নাতবউকে হারটা পরিয়ে দে। আমি একটু দেখি হারটায় ওকে কেমন দেখতে লাগছে। ”
রাজিয়া খানমের মুখে নাতবউ ডাক শুনে কান্তার বুকের ভিতর ছলকে উঠছে আবেগের দল। চোখের কোনে পানি জমেছে। অতি সন্তর্পনে চোখের কোন মুছে মুখ খোলে কান্তা।
” দাদিমা, এসব আমার লাগবেনা। আপনি শুধু আমাদের জন্য দোয়া করবেন। আর তারাতারি সুস্থ হয়ে উঠুনতো। আপনাকে এই অবস্থায় দেখতে আমাদের মোটেও ভালো লাগছেনা। একটা কথা জানেন, বাঘিনীকে বিড়াল রূপে মানায়না। ”
কান্তার কথা শুনে মৃদৃ হাসে রাজিয়া খানম।
” এটা যে তোমাকে নিতেই হবে। যার হাতে ধরে এই নিয়ম প্রচলিত হয়েছে, তার সম্মান রক্ষার্থে এটা তোমাকে নিতেই হবে। এটার মালিক এখন আমি নই। যতদিন শহিদের বংশে কোন পুত্রবধূ না আসছে, ততদিনই এটার মালিক শুধু তুমি। শ্রীজা দেরি না করে পরিয়ে দে। ”
আরমান আজ কোন কথা বলতে পারছেনা। ওর ইচ্ছে নেই কান্তা এটা নিক৷ কিন্তু বংশের নিয়ম অগ্রাহ্য করতে পারছেনা। হাজার হোক সে এই বংশেরই একজন।
শ্রীজা কান্তার গলায় সাতনরি হার পরিয়ে দিলে, রাজিয়া খানম হাসিমুখে চেয়ে থাকে ওর দিকে৷
এদিকে এসব দেখে আকলিমা খানমের মুখ কালো হয়ে গেছে। সে আশা করেছিল এই হার সে শুভর বউকে দিবে। কিন্তু আজ তার ফুপু সেটা হতে দিলনা।
” বেঁচে থাক। দোয়া করি এমনিভাবে জীবনে অনেকদূর এগিয়ে যাও। পারলে তোমরা আমাকে মাফ করে দিও। কম কষ্টতো তোমাদের দিইনি। শুনলাম এই বংশে আরেকজন নতুন অতিথি আসতে চলেছে? খবরটা শোনার পর থেকেই খুব ইচ্ছে করছে, আরও কিছুদিন বাঁচতে। তাকে ছুঁয়ে দেখার, কোলে নেয়ার তীব্র বাসনা আমাকে পেয়ে বসেছে। কিন্তু জানি তা কখনোই হবার নয়। ” কথা বলতে বলতে হাঁপিয়ে ওঠে রাজিয়া খানম। সে জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে।
” আপনি এত কথা বলবেননা। এবার একটু ঘুমানোর চেষ্টা করুন। আমরা আজ রাতটুকুই এখানে আছি। কাল দুপুরেই রওনা দিব। তার আগে আপনাকে সুস্থ হয়ে উঠতে হবে। আপনাকে বাসায় পাঠিয়ে না দিয়ে আমরা যেতে পারছিনা। ” আরমানের কেন যেন ভিষন খারাপ লাগছে। আজ ওর বছরের জীবনে দাদিমা কোনদিন এভাবে কথা বলেনি। যে মানুষটা সব সময়ই নাক উঁচু করে থেকেছে, আজ সে হঠাৎ করেই কেমন নিভে গেছে।
” তোমাদেরকে আর কষ্ট দিবনা। হয়তো আর কখনোই আমার বাসায় যাওয়া হবেনা। তোমার দাদুর পাশে আমাকে রেখ। তোমাকে তো কম আঘাত দিইনি।তোমার কাছে ক্ষমা চাওয়ার মত মুখ আমার নেই। তবুও বলছি, পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও। তুমি ক্ষমা না করলে আমি কবরে শান্তিতে থাকতে পারবনা। দোয়া করি, তোমার যেন একটা মেয়ে হয়। সারাজীবন মায়ের ভালোবাসা পাওয়ার জন্য তোমাকে ছটফট করতে দেখেছি। একটা মেয়ে এসে যেন তোমার সেই অপূর্ণতা ঘুচিয়ে দেয়। তুমি যেন সকলের থেকেও বেশি সুখি হও। আর পারলে আমার ছেলেটাকেও ক্ষমা করে দিও। তার কোন দোষ ছিলনা। সবকিছুর মূলে আমিই ছিলাম। পরিবারের ছেলে হিসেবে বাবা-মা’কে দেখে রাখার দ্বায়িত্ব তোমারও আছে। শ্রীজাকে ভালো একটা পরিবার দেখে বিয়ে দিও। পারলে শুভকে সঠিক পথে ফিরিয়ে এন। আমাকে একটিবার দাদিমা বলে ডাকবে, আরমান? কতবছর তোমার মুখে দাদিমা ডাক শুনিনি। ” রাজিয়া খানম আরমানের হাত ধরে ডুকরে কেঁদে উঠে।
আরমানও দাদিমার এরূপ আবদারে অবাক হয়ে গেছে। এসব কি বলছে সে!
” দাদিমা, এভাবে বলবেননা। দেখবেন আপনি সুস্থ হয়ে যাবেন। আপনি আমার কাছে ক্ষমা চেয়ে আমাকে আর দোষী করবেননা। আমি সবাইকে ক্ষমা করেছি। ” আবেগে ভিজে আসে আরমানের গলা।
” তোমার মেয়ে হলে তার নাম আইরিন বিনতে আরমান রেখ। দেখবে তোমার মনে হবে মা তোমার পাশেই আছে। ডাকনাম তোমাদের পছন্দমত একটা দিও। আর তাকে এই কানের দুল জোড়া দিও। খুব সাধ ছিল তাকে দেখার। ”
” ঠিক আছে আপনার দেয়া নামই রাখব। এখন আপনি একটু ঘুমাতে চেষ্টা করেন। ”
এরপর রাজিয়া খানম তার ছেলেকে এবং আকলিমাকে কাছে ডেকে কিছু কথা বলেই ঘুমিয়ে যায়।
পরদিন ভোরে আবারও রাজিয়া খানমের শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। ডক্টরকে আসার সুযোগ না দিয়েই আরমানের হাতের ওপর মৃ’ত্যু’র কোলে ঢলে পরে বৃদ্ধা।
সে বারবার আরমানের হাত শক্ত করে ধরছিল। আর বারবার আরমানের কাছে ক্ষমা চাচ্ছিল।
আরমানের হঠাৎই ভিষন কান্না পায়। এই প্রথম এত কাছে থেকে কারও মৃ’ত্যু দেখল। এই প্রথমবার দাদিমার জন্য ওর সত্যি কষ্ট হচ্ছে। মানুষটা শেষ সময়ে ওকে সত্যিই কষ্টের সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে গেছে।
চলবে…