কুন্দ ফুলের মালা পর্ব-০২

0
15

#কুন্দ_ফুলের_মালা
#পর্ব-২
বিশাল আয়োজন করে সাতক্ষীরার উদ্দেশ্যে বরযাত্রী যাচ্ছে। একদিন আগে সবাই রওনা হচ্ছে। বিয়ে পরদিন দুপুর নাগাদ হবে। চারটা বড় সাইজের বাস, চারটা মাইক্রো বাস নিয়ে সবাই আকাশ তালুকদারের বিয়েতে যাচ্ছে। আকাশ তালুকদার আজমল তালুকদারের একমাত্র ছেলে। তার বিয়েতে আয়োজনের কমতি থাকা চলবে না। গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানেও কম করে পাঁচশ মানুষ খেয়ে গেছে।

আকাশ কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। পোস্ট গ্রাজুয়েশন করেছে সিডনির এক ইউনিভার্সিটি থেকে। বাবা, মা দুজনেরই আদরের ছেলে। ভালো ছেলের বিশেষন টুকু খাপে খাপ মিলে যায় তার সঙ্গে। আকাশের ছোট বোন ইশিকা। ইশিকার বিয়ে হলো গতবছর। হাজবেন্ড ব্যবসায়ী। ধানমন্ডিতে নিজেদের রেস্টুরেন্ট আছে। ইশিকা এককালে ঝিলমিলের বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলো। ক্লাশমেট থেকে বন্ধু, বন্ধু থেকে প্রাণের সখী। এরপর সম্পর্কের সুতাটি আলগা হয়েছে ক্রমশই। সামনের দিনগুলোতে সুতাটি ছিড়ে যাবার সম্ভাবনা প্রবল।

ভাইয়ের সঙ্গে বেস্ট ফ্রেন্ডের সম্পর্ক নিয়ে ইশিকার তেমন নেতিবাচক ভাবনা ছিলো না। ওই বয়সে স্ট্যাটাস, বংশ এগুলো মাথায়ই আসে নি। প্রিয় বন্ধু যদি ভাবী হয় তবে আনন্দের পাল্লা ভারীই হবে। নতুন একজন উড়ে এসে জুড়ে বসলে তাকে কম্পিটিটর ভাববার চান্স বেশী থাকে। ইশিকা দুজনের সম্পর্ক নিয়ে খুশিই ছিলো। সাহায্যও করেছে খুব। ফুল, গিফট, টফি গুলো পৌছে দেবার পাশাপাশি সেগুলোয় ভাগও বসিয়েছে।

বাড়িতে আসা আত্মীয়দের মধ্যে একটা চাপা গুঞ্জন আছে। পাশের বাড়ির মেয়েটার সঙ্গে সম্পর্ক ছিলো না! কী হলো তারপর! আংটিও তো পরিয়েছিল বোধহয়। কিন্তু আলোচনা জমে ওঠে না। আকাশের মা জাদরেল মহিলা। তিনি এই ধরনের আলোচনা শুনলে এক গাল মন্দ কথা শুনিয়ে দিবেন।

আকাশের ফুপাতো ভাইয়ের বউ হঠাৎ সুযোগ পেতেই বলল,

“এই ইশিকা, ঝিলমিল না তোর বন্ধু? ও’কে দেখলাম না যে?”

ইশিকা মুখে একটা ফেস মাস্ক লাগিয়েছে। পার্লার থেকে সাজেস্ট করেছে ফেস মাস্ক টা। ভারী মেকাপের আগে লাগালে ভালো হবে। দুপুর নাগাদ বাস ছাড়বে সাতক্ষীরার উদ্দেশ্যে। এখন সবারই তৈরী হয়ে নেয়ার ব্যস্ততা।

ইশিকা নির্লিপ্ত গলায় বলল,

“জানিনা। এতো খবর নেয়ার সময় কই?”

“ওর সঙ্গে না আকাশের বিয়ে হবার কথা ছিলো। ”

ইশিকা বুঝতে পারে কথার খেলা। উদ্দেশ্যপ্রনোদিত ঝিলমিলের প্রসঙ্গ কেন আনা হলো। ওর রাখঢাক নেই, সবাই তো জানেই ব্যাপার টা। সম্পর্ক টা গোপন থাকেনি হৃদয়ের কারণে। ইশিকা বলল,

“হু ছিলো তো। ছিলো মানে ভাইয়া পছন্দ করেছিল। সহজ, সরল ভেবেছিল। আমাদের বাসায় ছুতোনাতায় আসতো ভাইয়ার মনোযোগ আকর্ষনের জন্য। ভাইয়ারও ভালো লেগে গেছিল। ও তো আর এতো প্যাচগোছ বুঝতে পারে না। ”

“একটু পরিস্কার করে বল তো। ঝিলমিলের মধ্যে প্যাচ ছিলো? ”

“সেরকমই শুনেছিলাম। ঝিলমিল নাকি ভাইয়ার বিশ্বাস ভাঙছে। আরও সব ঝামেলা। ওদের ভেতর ঝামেলার কথা তেমন জানিনা আমি, যেটুকু কানে এসেছে।”

ইশিকা একটা মিথ্যে কথা বলল। না ঝিলমিলের কোনো দোষ ছিলো না। একেবারে দোষ ছিলো না সেটাও অবশ্য বলা যায় না। ভাইয়াকে প্রেমের ঝালে ফাঁসানোর ব্যাপার টা দোষের। নিজের লেভেল ভুলে গিয়েছিল। কোনো যোগ্যতা আছে ওর আকাশের বউ হবার। যা একটু মুখশ্রী টা সুন্দর আছে। এছাড়া আর কী ই বা এমন যোগ্যতা। ফ্যামিলির অবস্থাও তো যেমন তেমন। মাসের শেষ কটা দিন তেলাপিয়া মাছ আর ডিমের তরকারি ছাড়া খেতে পারে না। ইশিকা ইনডাইরেক্টলি বুঝালো ঝিলমিলের মধ্যে ঘাপলা আছে। এখন যদি এরজন্য কেউ ঝিলমিলকে চরিত্রহীন ভাবে তো ভাবুক। এতে ওর কী বা আসে যায়।

ইশিকার ফুপাতো ভাইয়ের বউ কথাটা ঠিক বিশ্বাস করতে পারলো না। এদের টাকার অহংকার আছে। মধ্যবিত্ত পরিবারের ঝিলমিল কে মেনে না নেবার একটাই কারণ হতে পারে, ঝিলমিলদের অঢেল টাকা না থাকা। এখন যেখানে বিয়ে হচ্ছে তারা নাকি টাকার কুমির। কতো টাকা থাকলে টাকার কুমির বলা হয় কাউকে সেই ব্যাপারে ধারণা নেই অবশ্য।

***
“চৈতীর সাথে কথা হইছে আব্বু?”

আকাশ ফোন দেখতে ব্যস্ত। জবাব দিলো,

“হ্যাঁ আম্মু। ”

“ওদের ওখানে আজ গায়ে হলুদ না?”

“হ্যাঁ। ”

“ছবি পাঠালে, আমার ফোনেও দিও সেগুলো। তোমার মামী, খালামনিরা দেখতে চাইছেন। ”

“আচ্ছা। ”

রাহেলা নিশ্চিন্ত বোধ করছেন। আরেকটু পর বেরিয়ে পড়বে সবাই। চৈতী তার নিজের পছন্দ করা, তারপর আকাশ পছন্দ করেছে। পছন্দ হবে না কেন? কী সুন্দর মেয়ে! দেখলেই তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে, বয়সও একটু কম। আকাশের পাশে খুব সুন্দর মানায়। খুব কষ্ট করতে হয়েছে তাকে ঝিলমিলের কবল থেকে আকাশ কে মুক্ত করতে। খুব সতর্কতার সাথে কাজটা করেছিলেন। প্রথমে যখন জানলেন তখন মাথা গরম করলেন না, স্বামীকেও বারন করলেন প্রতিক্রিয়া যেন না দেখায়। খুব আদুরে গলায় বলেছিলেন,

“আচ্ছা আব্বু, তুমি যা চাইবে তাই হবে। আগে সুন্দরমতো পড়া শেষ করো। ”

আকাশের মুখে হাসি ফুটে উঠেছিল সেই সময়ে। তিনি তার মনের ক্ষোভ, তিক্ততা কাউকে বুঝতে দেন নি। দাঁতে দাঁত চেপে থেকেছেন যেন ছেলের পড়াশোনাটা ঠিকঠাক মতো হয়। শাসন, বারনে যদি উল্টাপালটা কিছু করে ফেলে। বয়স কম, রক্ত টগবগ করে ফুটছে। দুজন পালিয়ে গিয়ে বিয়েটিয়ে করে ফেললে সবকিছু হাত থেকে বেরিয়ে যাবে। দিনের পর দিন নাটক করে গেছে। বেহায়া মেয়েটাকে যতবার দেখতো ইচ্ছে করতো জুতা দিয়ে গালে কয়েকটা দিতে। ছোটলোকের বাচ্চা। বাপ করে কেরানির চাকরি আর সে এসেছে তালুকদার বাড়ির বউ হতে।

চৈতীই আকাশের বউ হবার যোগ্য। বড় বাড়ির মেয়ে। বাপ, চাচাদের সম্পত্তি অনেক। সাতক্ষীরা শহরে প্রচুর জমিজমার মালিক। মেয়ের বিয়েও দিচ্ছেন খুব খরচ করে। রাহেলা আর আজমল সাহেব বলেছিলেন তাদের কোনো দাবি নেই, কিন্তু চৈতীর বাবা শুনলেন না। মেয়ের সংসার সাজাতে সব করছেন। এমনকি হানিমুনে গিয়ে খরচের জন্যও আকাশকে টাকা দিলো। সেই টাকার পরিমাণও কম নয়। দশজনের কাছে হাসিমুখে গল্পও করতে পারছেন। আর ঝিলমিলের সঙ্গে বিয়ে হলে! উল্টো হাত পেতে থাকতো ভিখিরির বাচ্চাগুলান। শেষ অবধি নিজের চাল টা ঠিকঠাক চালতে পেরেছিলেন নাহলে আজকের দিনটা দেখতে হতো না।

***
ঝিলমিল আজ সময় নিয়ে গোসল করলো। বাবা আজ ঘরে আছেন। টুটুল পড়ছে ঘরে বসে। ভর্তি পরীক্ষার জন্য সারাদিন পড়ে। বিকেলে এক ঘন্টার জন্য কেরাম খেলতে যেত। এখন সেটাও বন্ধ।

ঝিলমিল রান্নাঘরে গেল। মা ডালে বাগার দিচ্ছেন। ঝিলমিল কে দেখে বললেন,

“কিছু বলবি?”

“রান্না হতে কতো বাকী মা?”

মা ঝিলমিলের দিকে তাকালেন। নরম গলায় বললেন,

“মাছ টা হয়ে গেলেই শেষ। ভাজা মুড়ি আছে, একটু নারকেল দিয়ে মেখে দেব?”

“না। ভাতই খাব।

“আচ্ছা। ঘরে গিয়ে বোস, রান্নাঘরে গরম তো। ”

ঝিলমিল ঘরে যেতে গেলে মা ডাকলেন,

“ঝিলমিল!”

“হ্যাঁ। ”

“কাল রাগের মাথায় তোকে মেরেছি। আমাকে ক্ষমা করে দিস মা। ”

ঝিলমিল স্মিত হাসলো।

মেয়ে চলে গেলেও আসমা স্বাভাবিক হতে পারেন নি। রাতে এক ফোঁটা ঘুমাতে পারেন নি। আহারে মেয়েটাকে এই সময়ে মারলো! এমনিতেই দু:খের শেষ নেই। আসমা আঁচলে চোখের পানি মুছে নেন। বাসা খুঁজে পেলেই এই পাড়া ছেড়ে দিবেন। দূরে গেলে যদি মেয়েটা একটু শান্তি পায়।

ঝিলমিল আজ অনেকদিন পর ভালো করে খেল। বিকেলে মা’কে বলল,

“আমি একটু বাইরে যাব মা।”

আসমা বারন করলেন না। জিজ্ঞেস করলেন,

“কোথায় যাবি?”

“একটু মার্কেটে যাব। একটা ওড়না কিনতে হবে। ”

“আচ্ছা।”

মেয়েটা স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করছে হয়তো। করুক, একটা জানোয়ারের জন্য কষ্ট পাবার মানে হয় না। কী ছোটলোক, গোপনে বিয়ে ঠিক করে তারপর ঝিলমিলের কাছে আংটি ফেরত চাইলো! পয়সা থাকলেই মানুষ বড়লোক হয় না। ছোট মনের মানুষ সবসময় ছোটলোকই থাকে।

***
ঝিলমিল এসেছে এলাকা থেকে দূরের একটা কফিশপে। ওর সামনে হৃদয়। ঝিলমিল জিজ্ঞেস করলো,

“আপনার সিদ্ধান্ত বলুন। ”

হৃদয় আঙুল ঘোরাতে ব্যস্ত। ঝিলমিলের দিকে না তাকিয়েই বলল,

“তুমি নিজের ক্ষতি করতে চাইছ ঝিলমিল। আমাকে বিয়ে করলে তোমাকে আরও বেশী কথা শুনতে হবে। ”

“এতে আপনার ক্ষতি হবে কী কোনো? ”

“আমি নিজের পরোয়া করি না।”

“সেটা জানি বলেই এই প্রস্তাব আপনাকে দিচ্ছি।”

হৃদয় ঝিলমিলের চোখের দিকে তাকালো। বেশীক্ষন তাকিয়ে থাকতে পারে না, চোখ নামিয়ে বলল,

“আকাশ কে তুমি সুযোগ দিচ্ছো একটা জঘন্য নাটক তৈরী করার। এরপর পাড়ার সবাইকে বলে বেড়াবে তোমার আমার গোপন সম্পর্ক ছিলো। সেটা জানতে পেরেই ও বিয়ে ভেঙেছে। ”

ঝিলমিল মৃদু হেসে বলল,

“আপনার যুক্তি শুনলাম। সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধাবোধ করছেন? আমি আপনাকে জোর করব না। ”

ঝিলমিল উঠে দাঁড়ালো। পার্স টা হাতে নেয়ার সময় বলল,

“আসি। আর হ্যাঁ, সরি আপনাকে বিব্রত করার জন্য। ”

হৃদয় শান্ত ও নির্লিপ্ত গলায় বলল,

“একটু বসো ঝিলমিল। ”

ঝিলমিল গম্ভীর স্বরে বলল,

“সময় নেই আমার। ”

“আমি রাজি। বলো কী করতে হবে। ”

কথাটা বলেই ঝিলমিলের দিকে তাকালো।

চলবে…..