কুন্দ ফুলের মালা পর্ব-০৩

0
15

#কুন্দ_ফুলের_মালা
#পর্ব-৩
কিছু মানুষকে প্রথম দেখায় ভালো লাগে না, কিন্তু দেখতে দেখতে ভালো লেগে যায়। ঝিলমিলের ক্ষেত্রে হৃদয়ের অনুভূতি ঠিক তেমন। মিঠাপুকুরলেনে ঝিলমিল রা যখন এসেছিল তখন ও’কে বিশেষ কিছু লাগে নি। আর দশটা সাধারণ মেয়ের মতোই নম্র, বিনয়ী, ভদ্র। লম্বা বিনুনি আর নীল সাদা স্কুল ড্রেসে দেখতে দেখতে কেমন অভ্যস্ত হয়ে গেল। মেয়েটা একটু বেশী ভদ্র ধরনের। স্কুল, কোচিং ছাড়া খুব একটা বের হয় না। মাঝেমধ্যে ইশিকার সঙ্গে এখানে সেখানে যায়। ইশিকার সঙ্গে যখন থাকে তখন খলবল করে হাসে। প্রায় তিন, চার বছর এভাবে কেটে যায়, হৃদয় একটু একটু করে ঝিলমিল কে আবিষ্কার করে। পাড়ার ছোট বাচ্চাদের খুব পছন্দের। একমাত্র ভাই টুটুলকেও খুব ভালোবাসে। এদিকে টুটুল কে পেলে হৃদয়ের দলবল একটু মজা করে। মাঝেমধ্যে সেই মজা মাত্রাতিরিক্ত হয়ে যায়। এরকমই একদিন বৃষ্টির দিনে টুটুল স্কুল থেকে ফেরার সময় শাকিল, রাজুসহ বন্ধুরা ওর সঙ্গে মজা করেছিল। এক পর্যায়ে বৃষ্টিতে ভেজা টুটুলের গায়ে আনাস ভাইয়ের দোকানে কাপ, প্লেট ধোঁয়া ময়লা পানি ছুড়ে মারলো। হৃদয় যখন খেয়াল করলো ব্যাপার টা বাড়াবাড়ি হচ্ছে তখন সবাইকে খুব বকেছিল।

ঝিলমিল এলো বিকেলের দিকে। তার আগেও নাকি দুইবার এসে ফিরে গেছে। যখন হৃদয়ের মুখোমুখি হলো তখন এক অন্যরকম ঝিলমিল কে দেখলো ও। আশ্চর্য মেয়েটা রেগে গেলে এমন ভয়ংকর হয়ে যায়! ঝিলমিল রাগী গলায় বলল,

“আমার ভাই কী আপনার সাথে বেয়াদবি করেছে?”

হৃদয় তার সাগরেদ দের দিকে একবার তাকালো। পাশে দাঁড়ানো টুটুলকেও দেখলো। বেচারা ভীত চোখে তাকাচ্ছে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে বোনের চাপে এখানে এসেছে। হৃদয় গম্ভীর গলায় বলল,

“ওরা একটু মজা করছিল। তেমন কিছু না আর। ”

“ওটাকে মজা বলে না। অসভ্যতা বলে। আপনারা অসভ্য এই ব্যাপারে তো কোনো সন্দেহ নেই। অন্তত বাচ্চাদের সঙ্গে একটু রয়েসয়ে বিহাভ করতে শিখুন। ”

ঝিলমিল টুটুলের হাত ধরে চলে গেল। হৃদয় হতভম্ব ভাব কাটিয়ে আনাস ভাইকে জিজ্ঞেস করলো,

“আমাকে অসভ্য কেন বলল? আমি কী অসভ্যতা করেছি?”

এই ব্যাপার টা নিয়ে হৃদয়ের দলবল খুব আপসেট হলো। এরা চায়ের দোকানে আড্ডা দেয়, সিগারেট খায়, ঘোরাঘুরি করে, খুব বেশী এন্টারটেইনমেন্ট এর জন্য মাঝেমধ্যে মদও খায়। তবে খুব সতর্কতার সাথে ও গোপনে। পাড়ার কারোর সঙ্গে তো অসভ্যতা করে না, এমনকি মিঠাপুকুর লেনের কোনো মেয়ের দিকে কুনজরে দেখেও নি। তবুও অসভ্য তকমা!

আনাস ভাই ব্যাপার টা জানালেন ঝিলমিল এর বাবা জাহাঙ্গীর আলীকে। তিনি শুনে হৃদয়ের সঙ্গে কথা বলতে এলেন। মেয়েটা রাগের মাথায় কী না কী বলে ফেলেছে সেটা যেন ধরে না রাখে। হৃদয় ব্যাপার টা মেনে নিলো। সবাই কে বলল ঝিলমিল আর ওর ভাইকে যেন এরপর আর কেউ কিছু না বলে।

সেই ঘটনার পর থেকে হৃদয় ঝিলমিল কে ভালো করে খেয়াল করতে লাগলো। ঝিলমিল স্কুল শেষ করে কলেজে যায়। কিশোরী খোলস ছেড়ে যুবতী বয়সে পদার্পণ করে! হৃদয় একদিন আবিষ্কার করলো যে ঝিলমিল কে ওর ভালো লাগে। ওর কলেজ যাবার সময়টাতে ইচ্ছে করেই চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে থাকে। না থাকলে ওর ভীষণ অসুবিধে হয়। বদ্ধ ঘরে গরমে নি:শ্বাস নিতে না পারলে যেমন কষ্ট হয় তেমন কষ্ট ফিল করে। ঝিলমিল অবশ্য স্বাভাবিক ভাবে দেখে। ওর ভাবনায় হৃদয়ের জন্য ইতিবাচক, নেতিবাচক কিছুই থাকে না। ওর এতো খেয়াল করারও সময় হয় না। কারণ অন্য আরেকজন ভাবনায় বিচরন করে সারাক্ষণ। তবুও মুখোমুখি দেখা হয়ে গেলে ঝিলমিল চোখ নামিয়ে হেটে চলে যায়।

একদিন বড় রাস্তায় ব্রিজের নীচে দেখা হলো। সঙ্গে তখন ইশিকা নেই, হৃদয় বাইক নিয়ে সামনে এলো। ঝিলমিল আচমকা দেখে ভীত সন্ত্রস্ত চোখে তাকালো। হৃদয়কে এমনিতে তো ভয় পাবার কোনো কারণ নেই, কিন্তু সেদিন একা বলেই বোধহয় ভয় পেল। হৃদয়ের সঙ্গে তর্ক বিতর্কের ঘটনাও অনেক দিন হয়ে গেছিলো, তবুও কেন ওর সামনে এলো সেটা ভেবেই বিচলিত হলো যেন। হৃদয় জিজ্ঞেস করলো,

“তুমি আমাকে সেদিন অসভ্য বলেছিলে? আমি কারও সঙ্গে অসভ্যতা করেছি এমন কিছু শুনেছ তুমি? ”

ঝিলমিল মাথা নেড়ে না বলল। পাড়ার মধ্যে হৃদয়ের সঙ্গে বড় গলায় কথা বলতে ওর তেমন ভয় লাগে নি। ব্যস্ত পাড়ায় হৃদয় যদি অভদ্র আচরণ করেও দশজন ছুটে আসবে ওর হয়ে কথা বলতে। কিন্তু আজ যে ও একা। হৃদয় স্বাভাবিক গলায় বলল,

“জেরা করছি না। শুধু জানতে চাইছি। যদি এরকম কিছু সত্যিই করে থাকি তবে শুধরে নেয়া দরকার। পাড়ার মানুষ সবসময় নিজেদের মানুষ ই হয়। তাদের জন্য আচরণ একটু শুধরে নেয়াই যায়। ”

ঝিলমিল শান্ত অথচ কাঁপা গলায় বলল,

“সরি। রাগের মাথায় বলে ফেলেছি। আপনার বন্ধুরা টুটুল কে সবসময় বিরক্ত করে। ও তো ছোট মানুষ, খারাপ লাগে এজন্য। ”

হৃদয় নরম গলায় বলে,

“আর কখনো করবে না এমন। ”

ঝিলমিল এক পলক দেখেই চোখ নামিয়ে নিলো। হৃদয় রিকশা ডেকে দিলো। ঝিলমিল বলল,

“রিকশা লাগবে না। বাসে যাব আমি। ”

“রিকশায় যাও।”

খানিকটা অর্ডারের সুরে কথাটা বলল হৃদয়। ঝিলমিল উঠলো, ওর পার্সে যাওয়া আসার বাস ভাড়া ছাড়া বাড়তি টাকা নেই। হৃদয় রিকশাওয়ালাকে বলল,

“ওর কাছ থেকে ভাড়া নিও না আবার। ”

তারপর ঝিলমিলের উদ্দেশ্যে বলল,

“আমার বন্ধুরাও কেউ অসভ্য না, উচ্ছৃঙ্খল তবে অসভ্যতা করে না কখনো। আর নিশ্চিন্তে থাকো এরপর আর কেউ বিরক্ত করবে না।”

ঝিলমিল শুকনো ঢোক গিলল। কোনো জবাব দিলো না।

এরপর ঝিলমিল সতর্ক হয়। চেষ্টা করে হৃদয়ের সামনে না পরার। দেখা হলেও এড়িয়ে যায়। হৃদয়ও আর সরাসরি ঝিলমিল কে কিছু বলে না।

হৃদয় তখনও জানেনা আকাশের সঙ্গে ঝিলমিলের মন দেয়া, নেয়ার ব্যাপার টা আগেই ঘটে গেছে। আকাশ ক্যারিয়ার ওরিয়েন্টেড, পড়াশোনা করা ছেলে। তার বন্ধু বান্ধব তার মেন্টালিটিরই। হৃদয়ের সঙ্গে কালেভদ্রে দেখা হলে কথা হয়, খুব বেশী হলে দুজন বসে একসঙ্গে চা খায়। এর বাইরে মাখামাখি ধরনের সম্পর্ক নেই। শত্রুতাও নেই। দুজন দুই মানসিকতার মানুষ বলে তাদের জীবনযাত্রার ধরনও আলাদা। ছোটবেলার সখ্যতা বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যায় তাই।

হৃদয় ঝিলমিল কে পছন্দ করে সেই ব্যাপার টা ওর সার্কেলে সবাই বুঝে ফেলে। তৃষিত নয়নে ঝিলমিল কে দেখা, অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে দেখা হয়ে গেলে মুখের অভিব্যক্তি বদলে যাওয়া এসব কারণে ব্যাপার টা নজরে এসেছে। সকলের পরামর্শে হৃদয় সিদ্ধান্ত নিলো ঝিলমিল কে ব্যাপার টা বলবে। না বলার সম্ভাবনা প্রবল। তবে হৃদয় ভেবে রেখেছে ঝিলমিল না বললেও সহজে হাল ছাড়বে না।

একদিন কলেজ থেকে ফেরার পথে ঝিলমিলের পথ আটকালো। সঙ্গে ইশিকাও আছে। হৃদয় ইশিকাকে বলল,

“তুই একটু এগিয়ে যা। ওর সঙ্গে আমার দুই মিনিট কথা আছে। ”

ইশিকা সন্দিহান চোখে ঝিলমিলের দিকে তাকায়। ঝিলমিল ইশিকার হাত চেপে ধরে। তবুও ও সামনে হেটে যায়। হৃদয় একটু সময় নিয়ে বলে,

“আমার তোমাকে ভালো লাগে ঝিলমিল। ”

ঝিলমিল দাঁড়িয়ে থাকে নি:শ্বাস বন্ধ করে। এরকম একটা ব্যাপার ও আঁচ করতে পেরেছিল। ও’কে চুপ থাকতে দেখে হৃদয় বলে,

“তুমি সময় নিয়ে জানিও। আমি অপেক্ষায় থাকব। ”

বাইক নিয়ে হৃদয় চলে যায়। ইশিকা পিছু ফিরে এসে জিজ্ঞেস করে,

“কী বললো তোকে?”

হৃদয় বাইক ঘুরিয়ে আবারও সামনে আসে। বলে,

“ঝিলমিল সবসময় তো আমি এরকম থাকব না। ভদ্র হবার চেষ্টা করব। তুমি তোমার সিদ্ধান্ত আমাকে জানিও।”

ইশিকাকে আর কিছু বলার দরকার হয় না। ও বুঝে গেল যা বোঝার। আকাশের কানে চলে গেল ব্যাপার টা। আকাশ নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে পারলো না। সেদিন ঝিলমিল দের বাসায় এসে সরাসরি জিজ্ঞেস করলো,

“হৃদয় তোমাকে কী বলেছে?”

ঝিলমিল আমতা আমতা করলেও শেষ পর্যন্ত কথাটা বলে দিলো। আসমাও সেদিন ই প্রথম জানলেন যে আকাশ আর ঝিলমিলের মধ্যে একটা কিছু চলছে।

সেদিন বিকেলে আকাশ আর হৃদয়ের মারামারি হয়ে গেল। পাড়ার লোকজন এসে দুজন কে ছাড়ালো। আকাশ একটু বেশী মার খেল। মারামারি করার অনভ্যাস এর কারণে সে হৃদয়কে তেমন আহত করতে পারলো না। আকাশ আহত হয়ে বাসায় ফিরলে ব্যাপার টা তার পরিবারের সামনেও এলো। পুরো পাড়া জেনে গেল ব্যাপার টা। ঝিলমিলের বাবা মেয়েকে কিছু বললেন না, তবে মা খুব রাগারাগি করলেন। তার কাছে ব্যাপার টা ভালো লাগলো না। আকাশদের পরিবার অবস্থাপন্ন, আকাশের মায়ের ছেলেকে নিয়ে অবসেশনও আছে। যদি তারা অপমান করতে আসে। কিন্তু আকাশের মা এসে ব্যাপার টার সুন্দর সমাধান করলেন। তিনি মেনে নিলেন। ওটাকে আসলে মেনে নেয়া না বলে মেনে নেয়ার ভান করলেন বলা চলে। ঝিলমিল আর আকাশের জন্য ব্যাপার টা সাপেবর হলো বটে। কারণ দেখা সাক্ষাৎ এখন আর লুকিয়ে চুরিয়ে করতে হবে না।

তবে এই ঘটনায় হৃদয় নিজেকে খুব অপমানিত বোধ করলো। ও ব্যাপার টা জানলে কখনো ঝিলমিল কে ভালোলাগার বিষয় টা জানাতো না। পাড়ার বড়রা মিলে আকাশ আর হৃদয়কে নিজেদের মধ্যে সমঝোতা করে নিতে বললে ওরা সেটা মেনে নিলো। কিন্তু আড়াল হতেই আকাশ হৃদয়কে হুমকির স্বরে বলল,

“ঝিলমিলের থেকে একদম দূরে থাকবি। নাহলে খুন করে ফেলব। ”

হৃদয় বাঁকা হাসি দিয়ে বলল,

“হুমকি দিচ্ছিস! বেশ তো, তাহলে আমিও হাল ছাড়ছি না।”

“আচ্ছা! ঝিলমিল তো আমাকে ভালোবাসে। ”

“শেষ অবধি বাসবে তো?”

আকাশ ভ্রু কুঁচকে তাকায়। হৃদয় স্মিত হেসে বলে,

“যাহ! তোর মতো চামচিকার সঙ্গে লড়াই করব না। তবে দ্বিতীয়বার আমার সঙ্গে আগ বাড়িয়ে কিছু করতে এলেও চুপ করে থাকব না।”

এরপর ব্যাপার টা থেমে যায়। সবাই সবার মতো, তবে একই পাড়ায় থাকার সুবাদে ঝিলমিল, হৃদয় দুজনেই মুখোমুখি হয়েছে। তবে কথাবার্তা হয় নি আর। পোস্ট গ্রাজুয়েশন এর জন্য আকাশকে যেতে হলো সিডনি। যাবার আগে ঘরোয়া অনুষ্ঠান করে আংটিবদল হলো। ব্যাপার টা গোপন রাখতে চাইলেও, পারলো না। অনেকেই জেনে গেল। ঝিলমিল ইউনিভার্সিটিতে ঢুকেছে, টিউশন পড়াচ্ছে। আকাশ চলে যাবার পর ঝিলমিল খানিকটা জোর করে ব্যস্ত হয়ে গেল নিজের জীবনে। হঠাত একদিন ওর ইউনিভার্সিটির সামনে হৃদয় গেল। দেখা হতেই বলল,

“একটা কথা বলতে এসেছি। ওয়েল উইশার হিসেবে বলা, বিয়ের আগে একটু আকাশ সম্পর্কে জেনে নিও ভালো করে। যা দেখছ বা যা দেখা যায় সেটা তো আসল নাও হতে পারে। ”

ঝিলমিলের রাগ হলো খুব। আকাশ সম্পর্কে নেতিবাচক কথা শুনতে রাজি নয় মোটেও। ও বলল,

“আপনি আর কখনো কোনো বাহানায় আমার সঙ্গে কথা বলতে আসবেন না।”

হৃদয় স্মিত হেসে বলেছিল,

“আচ্ছা।”

চলবে….