#কুন্দ_ফুলের_মালা
#পর্ব-৭
আকাশ বউভাত, শ্বশুর বাড়িতে ব্যস্ত সময় কাটাতে গিয়ে ঝিলমিলের ব্যাপার টা প্রায় ভুলে গেল। চৈতীকে নতুন অবস্থায় আবিষ্কার করা, শ্বশুর বাড়ির প্যাম্পার সব মিলিয়ে ভালোই কাটছে ওর দিন। দিনে চৈতী ও তার কাজিন দের নিয়ে ঘোরাঘুরি করে আর মধ্যরাত অবধি চৈতীর ভালোবাসায় ডুবে থাকে। প্রায় দুই সপ্তাহ পর মিঠাপুকুর লেনে ফিরলো চৈতীকে নিয়ে। ওদের হানিমুনে যাওয়া বাকী এখনো। হানিমুনের সময় টা পিছিয়ে দিয়েছে। হৃদয় ও ঝিলমিলের বিয়ের সময় টা হয়তো দেশে থাকবে না। থাইল্যান্ডে হানিমুনের স্পন্সর করেছে চৈতীর ছোট চাচ্চু।
মিঠাপুকুর লেনে যেদিন ফিরলো সেদিন ই ওদের বাসায় হৃদয়ের মা এলেন। খালি হাতে আসেন নি, বিয়ের কার্ড নিয়ে এসেছেন। না চাইতেও রাহেলাকে আপ্যায়ন করতে হলো। জাহানারা ইশিকাকে বললেন,
“তোমার তো একটা কার্ড পাওয়ার কথা আলাদা করে। ঝিলমিল তোমার বান্ধবী না?”
ইশিকার গা জ্বলে গেল। ভদ্রমহিলাকে ওর পছন্দ না। ওনার কথাবার্তার ধরন চামারের মতো। একবার একুশে ফেব্রুয়ারির দিন গাঁদাফুল আনতে গিয়েছিল। মুখের উপর বলে দিলেন, ফুল চাইতে আসছ ক্যান? তোমাদের জন্য লাগাইছি গাছ!
সেই থেকে ইশিকার ওনাকে পছন্দ না। তারপরও রাস্তাঘাটে দেখা হলে জিজ্ঞেস করতেন, এই ইশিকা কেমন আছ? জামাটা কই থেকে নিছো! ভালোই লাগতেছে জামাটা।
ইশিকা হেসে বলল,
“না কাকী আমি কার্ড পাই নি। আর আমি এমনিতেও যাব না তো, এজন্য কার্ড আসে নি। ”
“যাবা না ক্যান? পরানের বান্ধবী তোমার। খাতির নাই এখন?”
রাহেলা ইশিকাকে থামতে বললেন। ও চুপ করলো। ভদ্রমহিলা ইচ্ছে করে খোঁচাচ্ছে। জাহানারা এরপর আকাশের বউ দেখতে চাইলেন। রাহেলা মেকি হাসি দিয়ে বললেন,
“বউ ঘুমায়। সাতক্ষীরা থেকে জার্নি করে আসছে তো। তাছাড়া নতুন বিয়ে…
জাহানারা কে মনে হলো নাছোড়বান্দা। বউ না দেখে উঠবেন না। তিনি বললেন,
“সমস্যা নাই। মাগরিবের নামাজের সময় তো উঠবে। নামাজ পড়ে না বউ?”
রাহেলা থতমত খেলেন। এবার না চাইতেও এড়াতে পারবেন না। জাহানারা চা খেলেন। জর্দা দিয়ে বানিয়ে পান খেলেন। ইশিকাকে ওর শ্বশুর বাড়ি নিয়ে প্রশ্ন করে বিরক্ত করলেন। ইশিকা সুযোগ বুঝে একটা প্রশ্ন করলো,
“কাকী হৃদয় ভাইয়ার জন্য ঝিলমিল কে পছন্দ করলেন? আরেকটু বুঝেশুনে ভালো ঘরের মেয়ে আনতেন। বিয়েশাদিতে ঘরটাই আসল।
“ক্যান জাহাঙ্গীর সাব খারাপ কিসে? কতো বছর ধরে আছে পাড়ায়। ভালো মানুষ তো। পোলাপান দুইটাও তো ভালো হইছে। ”
ইশিকা আগুনে আরেকটু ঘি ঢালার প্রয়াস চালালো।
“ভালো মন্দ ছাড়াও আরও ব্যাপার আছে তো কাকী! আমি তো জানি কী আছে না আছে। গ্রামে দশ বিঘা জমি ছাড়া আর কিচ্ছু নাই। ”
জাহানারা ইশিকার দিকে তাকালেন। দুদিন আগেও দেখেছেন এই মেয়েকে পিঠে ব্যাগ ঝুলিয়ে স্কুলে যেতে। আর এখন কী সুন্দর বৈষয়িক কথাবার্তা বলছে। তিনি বললেন,
“এতো টাকা পয়সা দিয়া কী হবে। আল্লায় মোল্লা সাব রে টাকা কী কম দিছেন? তার ভাই, বোন কারোরে অমন ব্যবসা ভাগ্য দেন নাই। তিনি যেখানে যে ব্যবসায় হাত দিছেন সোনা ফলছে। দুইটা মাত্র পোলা, এতো লোভ করে কী হইবে! ”
ইশিকার মুখে শব্দ নেই আর। পরোক্ষ ভাবে বুঝিয়ে দেয়া যে আকাশের সঙ্গে ঝিলমিলের বিয়ে হয় নি কারণ ওদের টাকার লোভ আছে।
চৈতী এলো সেজেগুজে। জাহানারা লোকমুখে শুনেছেন বউয়ের গুনগান। তাই নিজের চোখে দেখার ইচ্ছে প্রকাশ করলেন। চৈতীকে তার বিশেষ পছন্দ হলো না। গায়ের রঙ টা ফর্সা আছে তবুও এতো লাল করার কী দরকার মুখ দুটো। তিনি পার্স খুলে একটা সোনার আংটি পরিয়ে দিলেন। আসার সময় ইশিকাকে বলে আসলেন,
“চেহারাটা কী এমন ভোতা ভোতা ধরনেরই? নাকি বেশী সাজগোজের কারণে এমন লাগে। ঘরে বসেও এতো সাজা লাগা।”
ইশিকা দাঁত বের করে হেসে বলল,
“বড়লোকের মেয়ে তো, তাই সেজেগুজে টিপটপ হয়ে বসে থাকে। ”
জাহানারা পাড়ার আরও কয়েকজনের সঙ্গে আকাশের বউ নিয়ে আলোচনা করলেন। আলোচনার মূল বিষয় হচ্ছে আকাশের পরিবার অত্যন্ত ছোটলোক। টাকার কাছে বিক্রি হয়ে গেছে। বউটা ফর্সা হলেও গুন নাই। পড়াশোনায়ও নাকি বেশী ভালো না। সাতক্ষীরা কলেজে পড়ে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার মেয়েরা নাকি ঘুরে আকাশের পেছনে। কই তারা!
জাহানারার আসল উদ্দেশ্য ছিলো অন্য। তিনি পরখ করতে গিয়েছিলেন ঝিলমিল বেশী সুন্দর নাকি আকাশের বউ। কিন্তু সেটা প্রকাশ করেন নি কারোর কাছে। চৈতীকে দেখার পর মনে হলো ঝিলমিলের সামনে ওই মেয়ে কিছুই না। এতো ফেস পাউডার লাগিয়েছে যে চেহারায় মায়া আছে কী না সেটা বোঝাই গেল না।
***
ঝিলমিল সন্ধ্যেবেলা বেরিয়েছে। আনাসের দোকানের সামনে থেকে যাবার সময় হৃদয় ডাকলো।
“এই সময়ে কোথায় যাচ্ছ?”
“নবনীদের বাসায় যাচ্ছি একটু। ”
“টিউশন গুলো ছেড়ে দাও নি?”
“না। এখন ছাড়লে সমস্যা হবে। পরীক্ষা পর্যন্ত পড়াব। ”
“চলো আমি পৌঁছে দেই। ”
ঝিলমিল বারণ করলো না। হৃদয় বাইক আনলো। ঝিলমিল বাইকে উঠে হৃদয়কে ধরলো। জীবনে প্রথম বাইকে উঠেছে। পড়ে যাবার ভয় হচ্ছে। বাইক চলতে শুরু করলে যদি পেছন থেকে ও ছিটকে পড়ে যায়!
বাইক চলতে শুরু করলো মাঝারি গতিতে। হৃদয় জিজ্ঞেস করলো,
“তুমি কী ভয় পাচ্ছ?”
ঝিলমিল না বলল। হৃদয় বুঝতে পারলো যে ও ভয় পাচ্ছে। ও বলল,
“ভালো করে ধরে বসো, ভয় নেই তুমি পড়ে যাবে না। ”
ঝিলমিল একপ্রকার জড়িয়েই ধরলো হৃদয়কে। হৃদয় নি:শব্দে হাসলো।
নবনীদের বাসা থেকে বেরিয়ে ওরা রেস্টুরেন্টে গেল। দুজনে ডিনার করে ফিরলো রাতের দিকে। ঝিলমিল কে ওদের বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে হৃদয় নিজের বাসায় গেল। ফ্রেশ হয়ে ফোন হাতে নিতেই দেখলো ঝিলমিলের অনেকগুলো মিসড কল। কলব্যাক করতেই ঝিলমিল অস্থির গলায় বলল,
“ইশিকা এসেছিল বাসায়। ”
“কখন? কী বলল?”
“একটু আগে। আপনার মা’কে নাকি ওদের বাসায় পাঠিয়েছি অপমান করার জন্য। ”
“আমি দেখছি। ”
হৃদয় মায়ের কাছে পুরো ব্যাপার টা শুনে তখনই বেরিয়ে গেল। রাত তখনও তেমন বেশী হয় নি, তবুও কারোর বাসায় যাওয়ার মতো সময় না। হৃদয়কে দেখে আকাশদের দারোয়ান গেট খুলে দিলো বিনাবাক্য ব্যয়ে। হৃদয় চলে গেল দোতলায়। আকাশের বাবা দরজা খুললেন। হৃদয় ঠান্ডা গলায় বলল,
“চাচা আকাশ কে একটু ডাকেন কথা আছে?”
আকাশের বাবা বিরক্ত হলেন খুব। বললেন,
“এতো রাতে কী কথা বলবা? কাল দিনে আসো। ”
“না আপনি এখনই আকাশ কে ডাকুন। ”
রাহেলা বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন,
“আকাশের কাছে কী কাজ?”
হৃদয় স্মিত হেসে বলল,
“কোনো কাজ নেই। একটা কথা বলব ও’কে। আপনার সামনেই বলব সমস্যা নেই।”
আকাশ এলো বাপ, মায়ের চেয়েও দ্বিগুণ বিরক্তিকর চেহারা নিয়ে। তবে তাকে কিছু বলার সুযোগ দিলো না হৃদয়। বলল,
“কিছুক্ষন আগে ইশিকা আমার বউকে অপমান করে এসেছে শুনলাম। এতো বড় স্পর্ধা ওর দেখানো ঠিক হয় নি সেটা তুই ও’কে বুঝিয়ে দিস। নাহলে আমাকে কিন্তু অপূর্বদের ঘটনা খুলে বলতে হবে সবাইকে। আমি অভদ্র সেটা নতুন কিছু না, তবে কেউ যদি আমার বউকে অপমান করে তবে অভদ্রতার পাশাপাশি গুন্ডামী করতেও দুই সেকেন্ড ভাবব না। একটু মনে রাখিস ব্যাপার টা। ”
হৃদয় দুই পা হেটে ফিরে এসে বলল,
“আমার কথাগুলো থ্রেট ভেবে ভুল করে উড়িয়ে দিস না, মনে ভয়ও রাখিস।”
আকাশ স্থির চোখে তাকিয়ে আছে। হৃদয়ের ঠোঁটের কোনে শয়তানি হাসি। হৃদয় চলে যেতেই আকাশের বাবা গমগমে গলায় বললেন,
“রাত বিরাতে এসব কী! ইশিকাকে ফাজলামি করতে কে বলছে! আর এই অপূর্ব কে আকাশ!”
আকাশের চেহারাটা ফ্যাকাসে লাগছে। শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে নিলো। রাহেলা মধুর গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
“অপূর্ব কে আব্বু? তার সাথে তোমার কী ঝামেলা? ”
আকাশ কিছু বলতে যাবে তার আগেই চোখ গেল ডাইনিং স্পেসে। চৈতী দাঁড়িয়ে আছে কপাল কুঁচকে। ও কী আকাশকে হেনস্তা হতে দেখে ফেলল!
****
হৃদয় আকাশদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে ঝিলমিল কে কল করলো। ঝিলমিল কল রিসিভ করতেই বলল,
“দরজা খোলো, আমি আসছি। ”
ঝিলমিল দরজা খুলতেই হৃদয় খেয়াল করলো যে ও এখনো বাইরের পোশাক পরে আছে। হৃদয় প্রশ্ন করলো,
“তুমি কাঁদছিলে নাকি? শর্তের কথা ভুলে গেছ মনে হচ্ছে? ”
“আপনি ওদের বাড়িতে গিয়েছিলেন?”
“হ্যাঁ। ওই একটু ভয় দেখাতে যেতে হলো। ”
হৃদয়ের কথা বলার ধরন শুনে ঝিলমিল হেসে ফেলল। হৃদয়ও হাসলো।
চলবে…..