#কুন্দ_ফুলের_মালা
#পর্ব-১৯ ও ২০
রাত দুইটা বাজে। এখনো পর্যন্ত তালুকদার ম্যানশনের কেউ ঘুমায় নি। ইশিকা এগারোটার দিকে এসে পৌছেছে। আকাশের ইচ্ছে করছে মেরে মেরে চৈতীর কয়েকটা দাঁত ফেলে দিতে। রাহেলা আজকের ঘটনায় মর্মাহত হবার বদলে খুশি হলেন। তিনি এখন কোনোভাবেই চৈতীকে পছন্দ করতে পারছেন না। দুইয়ে দুইয়ে চারদিন হয় এসেছে আর এসেই আকাশকে তার থেকে আলাদা করার চেষ্টা করছেন। রাহেলা খুব কষ্ট পেয়েছেন। নীরবে কতো চোখের জল ফেলেছেন। মোনাজাতে আল্লাহ কে ডেকে বলেছেন কোনো একটা উপায়ে ছেলের যেন মত বদল হয়। আজ সন্ধ্যার ঘটনাটি হতে পারে ওদের আলাদা হবার উপলক্ষ্য। রাহেলা চৈতীর পক্ষ নিয়ে কিছু তো বলছেন ই না, আজ ঝিলমিলের বিপক্ষেও কিছু বলছেন না।
চৈতী আজ শান্ত আছে। আজকের ঘটনায় দোষ অনেকটা ওর। ওর এপ্রোচ টা সুইট হলেও মনে অন্যকিছু চলছিল। ও চেয়েছিল প্রাক্তন প্রেমিকযুগল মুখোমুখি হলে দুজনের প্রতিক্রিয়া কী হয়! আকাশের ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ খুঁজে একটা কিছু পায় নি, ও জানতে চায় এই দুজন ঠিক কতটুকু পানিতে নেমেছিলো । আরও একটা ব্যাপার চৈতীর মধ্যে আছে। নিজেকে সে বিশ্ব ব্রক্ষ্মান্ডের সবচেয়ে সুন্দরী ভাবে। বড়লোক বাপ, চাচার একমাত্র আদুরে মেয়ে। পুরোপুরি আত্মকেন্দ্রিক মানুষ হয়েও ঝিলমিল কে দেখে ঈর্ষা অনুভব করেছে। স্ট্যাটাস এর দিক থেকে ঝিলমিল ওর সঙ্গে পাল্লা দিতে না পারলেও একাডেমিক পড়াশোনা, রুপ দিয়ে ঠিকই পাল্লা দেবার মতন। তার উপর স্বামীর প্রাক্তন। এখনো কতটুকু তার হৃদয়ে জায়গা করে আছে কে জানে!
চৈতী মাজেদা খালার সঙ্গে যখন কথা বলেছিল তখন একটা ব্যাপার খেয়াল করেছে। মাজেদা খালা বারবার বলেছে, খুব ভালো মেয়ে। এমন শান্ত, ভদ্র, সুন্দর মেয়ে মিঠাপুকুর লেনে আর একটাও নেই। মেয়েলী জেলাসি আপনাআপনিই এসে গিয়েছিল চৈতীর অবচেতন মনে। তারপর ঝিলমিল কে সামনাসামনি দেখলো, ভালো করে কথা বললেও ঝিলমিলের প্রতি মুগ্ধ হতে পারলো না। মুগ্ধ হবার প্রশ্নও আসে না, কারণ স্বামীর প্রাক্তন। আজকে ঝিলমিল কে রাস্তায় দেখে ওর মাথায় মজা দেখার ভুত চাপলো। দুজনকে নাস্তানাবুদ করার সুযোগ হেলায় নষ্ট করতে চাইলো না। কিন্তু ওর হিসাবে ভুল হয়ে গেছে। সেদিন হৃদয়দের বাসায় শান্ত, নম্র, বিনয়ী ঝিলমিল কে দেখে কোনোভাবেই বুঝতে পারেনি ওর মধ্যে তেজ থাকতে পারে। বিনয়ে যারা নত থাকে, তাদেরকে হেনস্তা করা সহজ কারণ এরা নিজে অসম্মানিত হলেও অন্যকে অসম্মান করতে পারে না। এদের নীতিবোধ প্রখর হয়। কিন্তু চৈতীর সমস্ত প্রেডিকশন ভুল প্রমাণ হয়েছে। খুব সামান্য ঘটনায় এমন ধাক্কা খাবে সেটা ভাবা তো দূরে থাক, কোনোদিন কল্পনায়ও আসে না। ধাক্কা দেয়াটা ঝিলমিল বাড়াবাড়ি করলেও সবাই ওর দোষ টা দেখবে। ও কেন জোর করে হাত ধরেছিল!
“এই তোর বাড়ির লোককে এবার জানাস নি? তোর চৌদ্দ গুষ্টি কাল আসবে না মরতে?”
চৈতী আকাশের দিকে তাকালো। আকাশ ও’কে অনেকক্ষন ধরে তুই সম্বোধনে কথা বলছে। চৈতী রক্তচক্ষু নিয়ে একবার তাকালো। আকাশ তাতেও ক্ষেপে গেল। পারলে ও’কে যেন গলা টিপে মারে প্রথম দিকে অতো প্রতিক্রিয়া না দেখালেও যখন পাড়ার লোকজন কাল সকালে ক্লাবে থাকতে বলেছে। সভাপতি নাকি কথা বলবে। তখন থেকে আকাশের সমস্ত রাগ বেরোতে শুরু করেছে।
আকাশ ঠান্ডা গলায় বলল,
“কাল তুই বাপের বাড়ি যাবি। তোরে আমি তালাক দেব। সব টাকা গুনে গুনে দেব তোর বাপ, মায়ের মুখের উপর।”
চৈতী বাঘের ন্যায় গর্জন করে বলল,
“চুপ! চুপ!”
রাহেলা বিরক্ত গলায় বলল,
“ছি: বস্তিবাসীর মতো ঝগড়াঝাটি! ছি: ছি:।”
তালুকদার সাহেব অবশ্য পরিবেশ শান্ত করার চেষ্টা করলেন। তিনি আকাশ কে ধমক দিয়ে বললেন,
“যাও ঘরে। কাল সকালের মিটিংয়ে কী জবাব দিবা সেটা নিয়া ভাবো। নিজেদের ঝামেলা যেন বাইরের মানুষ না বুঝতে পারে। ”
রাহেলা গম্ভীর গলায় বললেন,
“জবাব আর কী দিবে। ও তো শুধু বেয়াদবি শিখছে, সেখানেও তাই করবে। ”
চৈতী কেঁদে ফেলল। এমন একটা ঘটনা যে বাসায় কল করেও বলতে পারবে না। তাছাড়া ভয়ও পাচ্ছে, আকাশ যদি রাগের মাথায় সত্যিই তালাক দিয়ে দেয়।
তালুকদার সাহেব চৈতীর উদ্দেশ্য শান্ত স্বরে বললেন,
“তুমি কালকে বুঝেশুনে কথা বলবা। সব জায়গায় বেয়াদবি মানায় না, তোমার পারিবারিক শিক্ষা নিয়াও প্রশ্ন উঠবে। তোমার আব্বা, আম্মা কী বেয়াদবী শিখাইছে তোমাকে? ”
চৈতী নি:শব্দে কাঁদছে। দৃশ্যটা ইশিকার কাছে খুব ভালো লাগছে। অনেক নাকানি চুবানি খাইয়েছে ওদের। কাল ক্লাবে যদি ও’কে নাকানি চুবানি খাওয়ায় তাহলে ভালোই হয়।
রাহেলা ব্যাঙ্গাত্মক স্বরে বললেন,
“তোমার শ্বশুর কী বলছে বুঝতে পারছ? আর যদি তোমার মনে হয় আবারও ত্যাড়া কাজকর্ম করবা তাইলে সকালের গাড়িতে সাতক্ষীরা চলে যেও। এতো নাচ আমাদের সইছে না আর। ”
আকাশ থম মেরে বসে আছে। বাবা, মায়ের কথাগুলো ঠিকঠাক কানে ঢুকছে না। চোখের সামনে ভেসে উঠছে সন্ধ্যের দৃশ্যটা৷ আর চৈতী ভাবছে কিভাবে এই সমস্যাটা উতরে যাওয়া যায়। একবার এটা সামলাতে পারলে সবগুলোকে দেখে নিবে। কনুই এর ছিলে যাওয়া অংশটার ব্যথাও ও মনে রাখবে।
***
জাহানারা ঝিলমিল কে বললেন,
“ভয় পাবা না। আমরা তো আছি সবাই। যা জিজ্ঞেস করবে তার সত্যি জবাব দিবা। ”
ঝিলমিল স্মিত হাসলো। হৃদয় গম্ভীর গলায় বলল,
“এটা না বলে ও’কে বলো যে স্পষ্ট করে যেন সেখানে কথা বলে। মিউ মিউ যেন না করে। ”
জাহানারা ছেলেকে খেয়াল করছেন কাল থেকে। অহেতুক রাগ দেখাচ্ছে বউয়ের উপর। আস্তেধীরে খাচ্ছে বলে ধমকের সুরে বলল,
“রুটিগুলো আরও আস্তে করে টুকরো করো। ওরা ভীষণ ব্যথা পাচ্ছে। ”
ঝিলমিল জবাবে কিছু বলে নি। ব্যটামানুষের এমন রাগ জাহানারা দেখতে পারেন না। ছেলে বলে কিছু বলছেন না। তবে মোল্লা সাহেব তার সঙ্গে এমন করলে তিনি দুই তিন ঘন্টা গজগজ করতেন। এই মেয়েটা এখনো নতুন তাই শান্ত আছে।
ঝিলমিল ঘরে ঢুকেই বলল,
“তুমি আমার উপর রেগে আছ কেন?”
হৃদয় শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে জবাব দিলো,
“আমি তোমার উপর রেগে নেই। জানোয়ারের বাচ্চার উপর রেগে আছি। ও’কে কয়েকটা লা*ত্থি মারতে পারছি না বলে নিজের উপরও রেগে আছি। ”
“তাহলে আমার উপর রাগ দেখাচ্ছ কেন?”
হৃদয় ঝিলমিলের দিকে গভীর চোখে তাকালো। শান্ত গলায় বলল,
“তাহলে কার উপর দেখাব?”
ঝিলমিল নীরব চোখে খানিকক্ষণ তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো। হৃদয় নিজে তৈরী হয়ে আগে বেরিয়ে গেল। ঝিলমিল যাবে মায়েদের সঙ্গে।
***
সকাল সাড়ে দশটা বাজে। মিঠাপুকুর লেন ক্লাবঘরে প্রায় চল্লিশ টা চেয়ার পেতে রাখা। সেই চেয়ার গুলো ভর্তি হয়েও আরও বিশ বাইশ জন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। আজ ছুটির দিন নয়, তবুও এতো মানুষ জমেছে। মানুষের এমন স্বভাব। অন্যের জীবন, অন্যের ঘর সংসার নিয়ে আগ্রহের শেষ নেই।
ঝিলমিলরা পৌছানোর আগেই আকাশ রা এসেছিল। জাহানারা রাহেলার দিকে তাকিয়ে ছিলেন অনেকক্ষন। রাহেলা বিমর্ষ মুখ করে অন্যদিকে তাকিয়ে ছিলেন। ভুল করেও জাহানারার দিকে তাকালেন না। হৃদয়ের সাথে ঝিলমিলের চোখাচোখি হতেই হৃদয় আশ্বস্ত করলো ইশারায়। ঝিলমিল স্মিত হাসলো। সকলের চোখ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ওর আর চৈতীর দিকে। তবে ঝিলমিল কে তেমন বিচলিত লাগছে না। রাতে ভালো করে ঘুম হয় নি বলে চেহারায় আলগা ক্লান্তিভাব ছাড়া তেমন কোনো সমস্যা নেই। ওদিকে চৈতীকে আজ প্রথম সবাই সাজ ছাড়া দেখলো। মাথা ওড়না দিয়ে ডেকে রাখায় চেহারায় ভদ্র একটা ছাপ এলেও খুব রুগ্ন লাগছে দেখতে। চোখ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ফর্সা চেহারা প্রানহীন লাগছে।
সভাপতি এলেন দশটা চল্লিশের দিকে। প্রাথমিক কথাটুকু বক্তৃতার মতো করে শেষ করে তিনি কাজের কথায় এলেন। প্রথমে ঝিলমিল কে প্রশ্ন করলেন,
“কাল কী ঘটনা ঘটেছে, সেটা সংক্ষেপে বলো। বেশী দেরি করবা না। ”
মিঠাপুকুর লেনের সভাপতি হলেন সেলিম খান। তার কথাবার্তায় মিষ্টতা খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। তিনি যেটা ভালো কথা বলেন সেটাও কেমন যেন ধমকের মতো শুনতে লাগে। উপস্থিত জনতাদের মধ্যে মহিলা সংখ্যায় বেশী। মাঝেমধ্যে তারা গুজগুজ করে আলাপ করার চেষ্টা করছিলেন কিন্তু সেলিম খান এসে হাকডাক দিতেই সব থেমে গেল।
ঝিলমিল কথা বলতে গিয়ে টের পেল গলা শুকিয়ে গেছে। একটু সময় নিয়ে শুরু করলো।
“আমি কাল হাকিম স্টোরের অপজিটে দাঁড়িয়ে পিঙ্কির সঙ্গে কথা বলছিলাম। তখন উনি (চৈতীকে ইঙ্গিত করে) গাড়ি থেকে নেমে আমার কাছে এসে কথা বলতে শুরু করলেন। ”
“কী কথা বলছে?”
“কেমন আছি, কোথায় যাব এসব। এরপর হাত ধরে টানতে শুরু করলেন গাড়িতে যাবার জন্য। আমি বেশকয়েকবার না বলার পরও জোর করলো, শেষমেস আমি ধাক্কা মারলাম। ”
“বুঝতে পারছি। হাত ধরে জোর করার বিষয় টা পছন্দ করো নি, তাই রাগ করে ধাক্কা মারছ? ইচ্ছে করে মারো নি?”
চৈতী মাথানিচু করে আছে। ওর এক পাশে ইশিকা অন্যপাশে রাহেলা। জীবনে এরকম পরিস্থিতিতে প্রথম। এর আগে এই ধরনের বিচার শালিসি ওদের বাসায় দেখেছে। ওর বাপের কাছে এমন লোক আসতো যাদের সংসারে ঝামেলা, বউ শাশুড়ীতে মারামারি। আজকে নিজেও এমন পরিস্থিতিতে পড়ে খুবই লজ্জিত বোধ করছে। চৈতী যখন কাউকে অপমান করে তখন ওর মাথায় একটা ব্যাপার কাজ করে যে ওর সঙ্গে কথায় কেউ পেরে উঠবে না, কথা শুনাতে শুনাতে ও এমন পর্যায়ে যাবে যে অপরপক্ষ আর অপমান হতে না চেয়ে পিছিয়ে যাবে। একমাত্র ঝিলমিল ই ও’কে সারপ্রইজিং মোমেন্ট উপহার দিয়েছে।
সভাপতি সাহেব চৈতীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“বৌমা তুমি কী কারণে তার হাত ধরে টানাটানি করছ? সে যখন বলছে যাবে না তখন কী দরকার তারে জোর করার?”
চৈতী মাথানিচু করে থাকলেও জবাব দিলো স্পষ্ট গলায়। এই সভায় হৃদয় যেমন কোনো কথা ঝিলমিলের পক্ষ নিয়ে বলছে না, তেমনি আকাশও কিছু বলছে না, চৈতীর হয়ে। আকাশ বলবেও না। বাবা, মা শিখিয়ে পড়িয়ে দিয়েছে যেন স্ত্রীর পক্ষ নিয়ে কথা বলে। নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি যা কিছু হোক, পাড়ার লোকের কাছে সেটা প্রকাশ করা যাবে না। কিন্তু আকাশ নিজের মন ঠিক করে নিয়েছে। কিছু বলবে না এখানে। চৈতী বলল,
“হাত ধরে টানাটানি করব কেন? আমি কী স্কুলে পড়ুয়া বাচ্চা। ওনার বাসায় আমি গিয়েছিলাম, সেখানে ভালো করে কথা বলেছি। রাস্তায় দেখা হয়েছে তাই তাকে লিফট অফার করেছি। যা কিছু বলেছি পোলাইটলি । অসভ্যতা উনি করেছেন। ধাক্কা না মেরেও রিজেক্ট করা যেত কিন্তু। ওনার সম্ভবত আক্রমণ করার ইচ্ছে ছিলো। ”
উপস্থিত মহিলা পুরুষরা তাজ্জব বনে গেল। কী সাহস মেয়ের! গলায় না আছে একটু অনুতাপ, না বিন্দুমাত্র অপরাধবোধ। স্বামীর প্রাক্তনের সঙ্গে মাখামাখি করতে গেছে আগ বাড়িয়ে আবার সেটা বড় গলায় বলছেও।
সভাপতি সাহেব নিজেও অবাক হলেন। তিনি চৈতীকে আপদামস্তক দেখলেন। উনি আশা করেন নি এমন গুছিয়ে জবাব পাওয়া যাবে। জাহানারা মাঝখানে কথা বলে উঠলেন,
“ভাইসাব ওরে জিগান যে ঝিলমিল তো না বলছিল কয়েকবার। তারপরও ও জোর করছে ক্যান ?”
হৃদয় মায়ের উদ্দেশ্যে বলল,
“আম্মা তুমি থামো। পরে বলবে যা বলার। ”
ঝিলমিল কে বিচলিত দেখানোর পরিবর্তে আরও কঠিন দেখাচ্ছে। রাহেলা আর ইশিকা আছে উভয় সংকটে। তারা একদিকে চৈতীকে হেনস্তা হতে দেখতে চায়। অন্যদিকে ঝিলমিলের কাছে হারতেও চান না।
সভাপতি সাহেব ঝিলমিলের উদ্দেশ্যে বললেন,
“ও যা বলছে তা কী সত্যি? ”
ঝিলমিল এবার স্বাভাবিক ও স্পষ্ট গলায় বলল,
“হ্যাঁ সত্যি। কিন্তু আমার একটা কথা আছে, আমি এই পাড়ায় অনেক বছর ধরে আছি। আমার বাবা, মা’কেও আপনারা চিনেন। অনেকে জানেন যে আকাশ তালুকদারের সঙ্গে আমার একটা সম্পর্কের গুঞ্জন আছে। হ্যাঁ অনেকেই জানে, অন্তত আকাশ তালুকদারের বিয়ের কার্ড পাড়ায় আসার পর যতজন মানুষ আমার বাবা, মা’কে প্রশ্ন করেছেন তাতে সংখ্যাটা অনেকই হবে। দুই, চার, পাঁচ জনের নাম তো আমি এখনই বলতে পারব। আমার কথা হলো এতোকিছুর পর আকাশ তালুকদার কেন তার মা, বোন, বউকে আমার শ্বশুর বাড়ি পাঠিয়েছে? আমি তো কোথাও একটা শব্দ তার এগেইনেস্টে বলিনি। কোথাও তার নাম ভাঙিয়ে কান্নাকাটি করে নিজের দু:খও দেখাই নি। তার বিয়েতে খুশি হয়ে নাচানাচিও করিনি কোথাও। ওনার ফ্যামিলি তাহলে আমাকে দেখতে গেল কেন! যেখানে ঠিক এক মাস আগে তার বোন ইশিকা আমার বাড়িতে গিয়ে আমাকে মা** বলে গালি দিয়ে এসেছিল? এই প্রশ্নটার উত্তর আপনি আমাকে পাইয়ে দিবেন। ”
আকাশ অবাক চোখে তাকালো। এই আসরে ওর নাম আসবে স্বাভাবিক কিন্তু এমনভাবে আসবে সেটা বুঝতে পারে নি। রাহেলা একটা ব্যঙ্গাত্মক হাসি দিয়ে বললেন,
“আমাদের অন্যদের ব্যাপারে আগ্রহ নাই। জাহানারা ভাবী আগে গেছেন আমাদের বাসায়। ”
জাহানারা সুযোগ পেয়ে বললেন,
“আমি বউ দেখতে গেছি, আপনি আসবেন। বউ নিয়া আইসা নাটক ক্যান করছেন? প্যাচ আপনের ভিত্রে, আমার ঝামেলা করার ইচ্ছা থাকলে আমিও তো বউ নিয়া যাইতাম। ”
রাহেলা সেই কথা পাত্তা না দিয়ে বললেন,
“আর ইশিকা কিছু বলে নাই। ওসব মিথ্যা কথা। ”
সভাপতি সাহেব ঝিলমিলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“প্রমাণ আছে তোমার কাছে? ”
ঝিলমিল দৃঢ় গলায় বলল
“হ্যাঁ আছে। ”
ঝিলমিলের বাবা হাত তুলে জানালেন তিনিও কিছু বলতে চান। তাকে বলার সুযোগ দিতেই সে জানালেন যে কিভাবে প্রতারণা করা হয়েছে তাদের সঙ্গে। বিয়ের মিথ্যে আশ্বাস, আংটি পরানো, আবার আংটি ফেরত নেয়া সবকিছু বললেন।
উপস্থিত অনেকেই রোমাঞ্চিত বোধ করছে। তারাও এই ধরনের ঘটনা, কথাবার্তা আশা করেছিলেন। সবার কথা শোনার পর সভাপতি সাহেব আকাশ কে প্রশ্ন করলেন,
“এতো ঘটনার পর তোমার বউ এতো কাহিনী কেন করছে? এটার ব্যখ্যা দাও। ”
আকাশ মাথানত করে ফেলল। এটার জবাবে ও কী বলবে! বউকে কন্ট্রোল করতে পারছে না এটা বললে হাসির পাত্র হবে। চৈতীও মাথানিচু করে ফেলল।
হৃদয়ের বাবা বললেন,
“তালুকদার সাবে বলুক কিছু, এইভাবে আমার ঘরের বউরে অপমান সহ্য করতে হবে ক্যান? ”
জাহানারা সঙ্গে যোগ করলেন,
“হ্যাঁ বলুক সে। উনি হাজী মানুষ কিন্তু ওনার ঘরের মেয়ে বউরা এতো পাজি ক্যান? ”
রাহেলার মুখটা ভোতা হয়ে গেল। ঝিলমিল বলল,
“চাচা আমাকে প্রশ্নগুলোর উত্তর পাইয়ে দেয়া আপনার দায়িত্ব। আমি খারাপ, আরও অনেক কিছু কিন্তু আমি তো ওনাদের সাতে, পাঁচে থাকি না। ওনারা কেন থাকেন? কী চায় আমার কাছে? আমার পরিবার কে পাড়াছাড়া করতে চায়?”
একজন মুরব্বি গোছের লোক বললেন,
“তালুকদার সাব এসব কী? আপনার টাকার গরমে এখন পাড়ায় মানুষ থাকতে পারবে না?”
তালুকদার সাহেব গলা খাকারি দিয়ে কথা শুরু করলেন,
তার কথার সারমর্ম হচ্ছে ঝিলমিলের পরিবার অত্যন্ত ধুরন্ধর, তারা ওই পরিবারের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে বিয়ে ভেঙে দিয়েছেন। এরপর হৃদয়কে বিয়ে করে ঝিলমিল হৃদয় কে উস্কানি দিচ্ছে। এখন তার পরিবার কে অপমান করা হচ্ছে।
হৃদয় বলল,
“চাচা আমি আবার কখন কী করলাম? ”
তালুকদার সাহেব ধমকের সুরে বললেন,
“তুমি চুপ থাকো, তুমি সবজায়গায় গুন্ডাগিরি দেখাতে আসবে না। মুরব্বিদের সঙ্গে ভালো করে কথা বলতে শিখো। ”
“আচ্ছা শিখব। কিন্তু কালকের ঘটনার কোনো ব্যখ্যা তো দেন নি আপনারা। ঘুরেফিরে পুরোনো কথায় যাচ্ছেন। ”
“ব্যখ্যা আবার কী? তোমার বউ ধাক্কা দিছে। সে মাফ চাইবে। ”
“তার হাত ধরে টানাটানি করতে আপনার ছেলে তার বউকে কেন পাঠাইছে সেটার ব্যখ্যা দিন। আমার বউ তো বলল ই যে সে আপনাদের সাতে, পাঁচে থাকে না। ”
ইশিকা মাঝখান থেকে বাপের পক্ষ নিয়ে বলল,
“আগে প্রমাণ দাও যে আমরা তোমার বউকে খারাপ কথা শুনাইছি। আর তুমি যে বাসায় গিয়ে ভাইয়াকে থ্রেট দিয়া আসছ সেটা তোমার বউ ভুলে গেছে। ”
সভাপতি সাহেব ধমকে শান্ত করলেন সবাইকে। ঝিলমিল প্রমাণ বের করে দিলো। সেদিন ইশিকার বলা সব কথা ফোনে রেকর্ড আছে। সভাপতি সাহেব শুনলেন, সঙ্গে শুনলো উপস্থিত সকলে।
এবার বলি রেকর্ড করার ব্যাপার টা। ঝিলমিল সেদিন বুদ্ধি করে সব কথা রেকর্ড করার কথা ভাবে নি। ইশিকা যখন ঘরে এসেছিল তখন টুটুল বসার ঘরে বসে পড়ছিল। পারিবারিক ঝামেলায় ওর পড়াশোনায় অনেক সমস্যা হচ্ছিলো। তাই শব্দ করে পড়ে সেগুলো রেকর্ড করে রাখতো। গাড়িতে যাবার সময়, ঘুমানোর সময় সেগুলো শুনতো। কোচিং এর ভাইয়ারা শর্টকাট এই পদ্ধতি শিখিয়েছিল ওদের। সেখানেই ইশিকার সব কথা রেকর্ড হয়। টুটুল সেটা পড়ে শুনেও ডিলিট করে নি।
রেকর্ডিং শুনে সভাপতি সাহেব রাহেলার উদ্দেশ্যে বললেন,
“এই বয়সে গলার রগ খাড়া করে এমন মিথ্যা বলেন লজ্জা লাগে না?”
রাহেলা ঘামছে রীতিমতো। ইশিকাও ফেসে গেছে এবার। পুরো পরিবার এই মুহুর্তে বাক্যহারা।
হৃদয় এগিয়ে এসে তালুকদার সাহেব কে বলল,
“চাচা কিছু বলেন এখন? আমি তো গুন্ডা। ইশিকা ভালো মেয়ে হয়ে আমার বউকে এতো গালি কেন দিলো? আর এগুলো শুনে চুপ করে থাকব ক্যান? এই পাড়ায় আপনার যেমন বাড়ি আছে তেমনি আমাদেরও বাড়ি আছে। ”
সভাপতি সাহেব চৈতীকে বললেন,
“তুমি যে বললা হৃদয়ের বউ তোমার উপর আক্রমণ করতে চাইছে আগে থেকে। কিন্তু সবজায়গায় তো গেছ তুমি। সে তো যায় নাই। তুমি গেছ ক্যান? তোমার স্বামীর সঙ্গে এতো কাহিনী জেনেও খাতির আলাপ জমাইতে গেছ কিসের জন্য? ”
চৈতী মাথানিচু করে চোখের পানি মুছলো।
“না না কান্দাকাটি করবা না। শয়তান তুমি, এতো পলিটিক্স কই শিখছ? তোমার শাশুড়ীর থেকে? ”
রাহেলা হাসার চেষ্টা করে বললেন,
“ভাইসাব এতো দলকানা কবে হইলেন? ঘুরেফিরে আমাদের দোষ দেখতেছেন। হ মানলাম কাল আমার বউয়ের দোষ। কিন্তু সে(ঝিলমিল) যে মহান তা তো না। তার দোষ আছে বলেই আমরা তারে রিজেক্ট করছিলাম। ”
সভাপতি সাহেব ধমকের সুরে বললেন,
“কী দোষ সেটাও বলেন। মিন মিন করছেন তো আপনারাই। ”
ঝিলমিলের মা এতক্ষণ চুপ থাকলেও এবার প্রশ্ন করলেন,
“কী দোষ বলেন। আমরাও তো জানিনা আমাদের মেয়ের কী দোষ। ”
রাহেলা বিশ্রী একটা হাসি দিয়ে বললেন,
“আপনি মা হয়ে না জানলে কেমনে হয়! আকাশের বিয়ের সময় আপনার মেয়ের বিয়ে হইছে। আর আপনি কিছু জানেন না। ”
ঝিলমিলের বাবা তেড়ে উঠে বললেন,
“মুখ সামলে কথা বলেন। ”
সভাপতি আবারও থামালেন। ঝিলমিল শান্ত গলায় রাহেলাকে প্রশ্ন করলো,
“আপনি জানেন আপনার ছেলে নিয়মিত একতা হাউজিং এ কেন যায়? এক হিন্দু মহিলার বাসায় তিনি যখন একা থাকে তখন গিয়ে কয়েক ঘন্টা সেখানে কী করে? তোয়ালে পেঁচিয়ে খালি গায়ে সোফায় বসে চা, কফি খায় সেটা জানেন তো?”
হৃদয় চকিতে ফিরে তাকালো ঝিলমিলের দিকে। ওর ঠোঁটে একটা আলগা হাসি। আকাশ স্তব্ধ চোখে তাকালো। অনেক গুলো চোখ আকাশের দিকে, রাহেলার দিকে, ইশিকার দিকে।
আসমা ঝিলমিলের কাঁধে হাত রাখলেন। সভাপতি সাহেব এবার বিস্মিত চোখে তাকালেন ঝিলমিলের দিকে।
চলবে….