কুন্দ ফুলের মালা পর্ব-২৩

0
15

#কুন্দ_ফুলের_মালা
#পর্ব-২৩
চৈতী আজ চিৎকার, চেঁচামেচি করছে না। সামান্য ব্যাপার কে রাবারের মতো টেনে লম্বা করা যার কাজ যে আজ স্তব্ধ, হতভম্ব। সভাপতি সাহেবের বাসায় ও’কে নিরাপদে রাখা হয়েছে। সঙ্গে আছে পাড়ার মেয়ে বউরা। চৈতীকে একা ছাড়তে বারণ করেছে আশরাফুলও। অল্প বয়সী মেয়ে, নতুন বিয়ে। স্বপ্ন ভাঙার এই যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে আত্মহননের পথ বেছে নিতে পারে।

বেশ কয়েকজন ঘিরে আছে চৈতীকে। এমন ঘটনা ওর সঙ্গে কেন ঘটলো! এলাকায় কেউ ওর দিকে বাজে নজরে দেখলেও বাপ, চাচারা মেরে তাকে গুষ্টির নাম বুলিয়ে দিতো। আর ওর বিয়ে এমন নোংরা আর বাজে মানুষের সঙ্গে।

বেশ কিছু কথা না চাইতেও চৈতীর কানে এলো। সুন্দর বউ, শ্বশুর বাড়ি সবকিছু থাকার পরও ওই মহিলার কাছে কেন যাইতে হলো! বউয়ের কাছে কী শান্তি পায় নাই!

চৈতী কান চেপে ধরলো। কী ছোটলোকি কথাবার্তা। ওর কোলের মধ্যে ফোন টা বাজছে। স্ক্রিনে ভেসে উঠলো মা নামে সেভ করা নাম্বার টা। তারা আসছে সবাই। কী অপমান সহ্য করতে হবে সবাইকে। চৈতীকে তো নিয়ে যাবে সাতক্ষীরা, কতো লোক ও’কে নিয়ে উপহাস করবে! যে বিয়ে, স্বামী নিয়ে ও গর্ব করেছিল সেই বিয়ে নিয়ে কটাক্ষ সহ্য করতে হবে, লোকে করুনার চোখে দেখবে।

চৈতী হঠাৎ ই পাগলের মতো কাঁদতে শুরু করলো। খানিকক্ষণ কেঁদে নিজের চুল টানতে শুরু করলো। কয়েকজন চেষ্টা করেও ও’কে সামলাতে পারছে না।

***
মিঠাপুকুর লেনের আজকের রাত টা কাল রাত্রির মতন। সবার মধ্যে সেকি উত্তেজনা। পাড়ার দোকানগুলো রমরমা। চা, পুরি, পিয়াজু, চপ রাত দশটার সময়ও বেঁচা হচ্ছে। পুলিশ আসছে যাচ্ছে।

এই তো গত জানুয়ারীতে প্রফেসর সাহেবের ছেলেটা নাইনে উঠলো। সায়েন্স নেবার সময় রাহেলা খুব হেসে হেসে বলছিলেন খালি সায়েন্স নিলে তো হবে না। পড়তেও হবে খুব, আমার বাবু যে কী পড়া পড়তো। এই পাড়ায় ছেলেমেয়েদের মা, বাবা তুলনা দেবার সময় আকাশের তুলনা দিতেন, আজ তারা লজ্জিত বোধ করছেন।

সভাপতি সাহেব নিজে পর্যন্ত অবাক না হয়ে পারলেন না। ইউনিভার্সিটিতে পড়াকালীন কী যেন রিসার্চ করে গোল্ড মেডেল পর্যন্ত পেল ছেলেটা। পাড়ার সবাই মিলে আয়োজন করে ফুল দেয়ার ব্যবস্থা করলো ক্লাবঘরে ডেকে। আজ সেই ছেলের বিচারসভা বসেছে, তাও এমন একটা বিষয় যেটা মনে করে লজ্জিত হবার পরিবর্তে খুব রাগ হয়।

“এই হৃদয় শুনে যাও। ”

সভাপতি সাহেব হৃদয়কে যেতে দেখে ডাকলেন। তিনি ঘড়িতে সময় দেখলেন। সাড়ে দশটার বেশী বাজে। পাড়ার ছেলেরা যারা মারামারি করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল তাদের কে শান্ত করা হয়েছে। সভাপতি সবাই কে আশ্বাস দিয়েছেন যে উনি সুষ্ঠু বিচার করবেন। কেউ কেউ ভীষণ উত্তেজিত, তারা সুষ্ঠু বিচার বুঝতে চান না, এদের পাড়া ছাড়া করা হোক। আকাশ কে ন্যাড়া করে, জুতার মালা পরিয়ে মিঠাপুকুর লেন থেকে বের করা হোক। সভাপতি ধৈর্য্য ধরে বুঝিয়ে সুঝিয়ে শান্ত করলেও সবাই পাহাড়া দিচ্ছে। আকাশের বাড়ির আশেপাশে জটলা আছে, কাউকে পালাতে দেয়া যাবে না।

“চাচা কিছু বলবেন? ”

“বাসায় যাচ্ছ?”

“হ্যাঁ চাচা। সারাদিন তো আজ বাইরেই কেটে গেল। এখন একটু যাওয়া দরকার। ”

“চলো আমিও যাব। ঝিলমিলের সঙ্গে একটু কথা বলা দরকার। ”

হৃদয় মেনে নিলো। বলল,

“চলুন। ”

***
ঝিলমিল আজ রান্না করেছে। মা, শাশুড়ী দুজনেই বাইরে আছে। রান্না, খাবার মতো হুশ কারোরই নেই। ঝিলমিলের ফুপু খবর শুনে ছুটে এসেছে। তিনি সব ঘটনার সাক্ষী হওয়া থেকে নিজেকে আটকানো পারলেন না। সকলের কথা চিন্তা করে ঝিলমিল চেষ্টা করলো নিজের মতো একটু রান্নাবান্না করার। হৃদয় অবশ্য কল করে জিজ্ঞেস করেছিল, বাইরে থেকে খাবার আনবে কী না। ঝিলমিল রাজি না হয়ে রান্নাবান্নার ঝামেলায় গেল।

“চাচা আপনি চায়ে চিনি খান?”

সভাপতি সাহেব ঝিলমিলের দিকে তাকালেন। মেয়েটাকে নিয়ে পাড়ায় গল্পের শেষ নেই। শান্ত মেয়েটাকে পাড়ার কতো মানুষ শয়তানের উপাধি দিয়েছে অথচ তার চোখে এই মেয়ে ধৈর্য্যশীল ও বুদ্ধিমতি।

“আবার চা করতে গেলে কেন? ”

“খান, ভালো লাগবে। ”

সভাপতি সাহেব চা নিলেন। হৃদয় ইশারায় ঝিলমিল কে বসতে বলল। ও বসলো। সভাপতি সাহেব বললেন,

“দেখো আজকের ঘটনায় বিচার যা হোক, তোমার কাছে ওরা তো কাল মাফ চাইবে….

ঝিলমিল কথা শেষ করতে না দিয়ে বলল,

“চাচা আমার কাছে মাফ চাইবার দরকার নেই। কারণ আমি ওদের মাফ করব না। যদি মাফ করার মতো সহানুভূতি ওদের জন্য আমার মনে থাকতো তবে এই বিষয় টা আমি সামনেই আনতাম না। ”

“তাহলে তুমি কী চাও?”

ঝিলমিল জবাব দেবার আগে হৃদয় বলল,

“চাচা ভবিষ্যতে ঝিলমিল আর ওর পরিবারের নামে ওদের মুখ থেকে আর একটাও খারাপ কথা না বের হয় সেই ব্যবস্থা করেন। আর ঝিলমিল যেহেতু চাচ্ছে না, আপনি ওর বাবা, মায়ের কাছে ক্ষমা চাইতে বলবেন। ”

“আচ্ছা তবে তাই হোক। ”

সভাপতি চলে গেলেন। ঝিলমিল হৃদয়কে খেতে দিয়ে নিজেও খেতে বসলো। অন্যান্য আর দশটা সাধারণ দিনের মতোই আজকের দিন টা ওর কাছে। হৃদয় হাসলো। ঝিলমিল খেয়াল করে প্রশ্ন করলো,

“হাসছ যে? ”

“একটা বিশেষ কারণে হাসলাম। ”

“কী বিশেষ কারণ? ”

“আমি ভেবেছিলাম আজ তুমি অনেক কান্নাকাটি করে বাড়িঘর ভাসিয়ে দিবে। কিন্তু সেটা করলে না, শর্তের কথা মনে রেখেছ তবে! থ্যাংক ইউ সো মাচ। ”

ঝিলমিল হেসে বলল,

“হ্যাঁ মনে রাখতে হলো। তোমার বলার ধরন এমন ছিলো যে শর্ত না মানলে ঘুষি মেরে নাক ফাটিয়ে দিবে। ”

হৃদয় নি:শব্দে হেসে খাওয়া শেষ করলো। উঠে যাবার সময় বলল,

“আমি তো অনেক শাস্তি ভেবে রেখেছিলেন, কিন্তু তুমিই তো ভুলটুল করছ না। আজকের রান্নাও দেখলাম ভালোই করলে। একটু ভুল করে দেখো না, শাস্তি কেমন হয়। ”

ঝিলমিল লজ্জা পেল খুব।

***
টানা দশবার অনিন্দিতাকে কল করে যখন পেল না সেই মুহুর্তে আকাশ ধরে নিলো যে ওর বাঁচার আশা, ভরসা শেষ। কিছু সময় তাকিয়ে রইলো সিলিং ফ্যানের দিকে। ওয়ারড্রব খুঁজলে বোধহয় শাড়ি পাওয়া যেতে পারে। ঝুলে পড়বে! এছাড়া আর মুক্তি কোথায়। চৈতীর পরিবার নিশ্চয়ই ও’কে ছেড়ে দিবে না। তারচেয়ে এই মুক্তিই সহজ। আকাশ সিলিং ফ্যানের দিকে অনেকক্ষন তাকিয়ে থাকার পর খেয়াল করলো যে ও কাঁপছে। কপাল বেয়ে টুপটুপ করে ঘাম ঝরছে। পরনের টিশার্ট টা ভিজে গেছে। মেঝেতে বসে দূর্বল কাঁপা হাতে আবারও কল করলো অনিন্দিতা কে। অনিন্দিতা তো আশ্বাস দিয়েছিল,

“আকাশ আমি আছি তো। সব সামলে নেব। ”

আজকে অনিন্দিতাই পারবে সবকিছু সামলাতে। আকাশ যে কতোবার কল করেছে, কতো টেক্সট করেছে। অনিন্দিতার তরফ থেকে সাড়া পায় নি, ওই তো অনিন্দিতা অনলাইনে আছে, টেক্সট সিন করে ফেলছে প্রতিটা। তবুও জবাব কেন দিচ্ছে না।

এরপর অনিন্দিতা কল রিসিভ করলো। শান্ত গলায় বলল,

“আজ আমাকে কেন মনে পড়লো আকাশ?”

আকাশ হড়বড় করে কতোগুলো কথা বলল। ঝিলমিলের কাছে নাকি প্রমাণ আছে। আকাশ বলতে গিয়ে কেঁদেও ফেলল। অনিন্দিতা খুব স্বাভাবিক ভাবে বলল,

“এখন আমি কী করব? আমার কী আসলেই কিছু করা উচিত? ”

আকাশ ভাঙা গলায় বলল,

“আমাকে বাঁচাও অনিন্দিতা। ”

“আমি তোমাকে কিভাবে বাঁচাব? তোমাকে কী আমি মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছি। তোমার এক্স গার্লফ্রেন্ড কে বলো বাঁচাতে। ”

“তুমি কিন্তু বলেছিলে সব সামলে নিবে। আজ তুমিও বেইমানি করেছ!””

অনিন্দিতা একটু সময় নিয়ে বলল,

“আকাশ তুমি সম্পর্কে স্পেস চেয়ে আমাকে সব জায়গায় ব্লক করে রেখেছিলে। তোমার ইমেইলে পর্যন্ত আমি যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলাম। তুমি নতুন বউ পেয়ে আমাকে ভুলে গেছ। বেইমান তুমি। প্রথমে ঝিলমিল, পরে আমাকে ছুড়ে ফেলে টাকার কাছে বিক্রি হয়েছ। ”

আকাশ বিস্ফোরিত হলো। অনিন্দিতা এসব কী সজ্ঞানে বলছে! অনিন্দিতার কথা মেনে ঝিলমিল কে ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ও। আকাশ কিছু বলতে যাবার আগে ফোনের ওপাশ থেকে ভেসে এলো একটা পুরুষ কন্ঠ।

“মিস্টার আকাশ, আমি আশরাফুল। আসছি কিছুক্ষনের মধ্যে মিঠাপুকুর লেনে। কথা হবে সামনাসামনি। ”

আকাশ খানিকক্ষণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে রইলো। দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে চৈতী। চৈতীকে ওর ভয় লাগছে এই মুহুর্তে। না, না দরজা খোলা যাবে। এরপর ইশিকার ডাক শুনতে পেল।

“ভাইয়া, ভাইয়া। দরজা খোলো। ”

আকাশ খুলবে না দরজা। এরপর ডাকলো বাবা।

“আকাশ বাইরে আসো। সব শা*লাদের দেখে নেব আমি। মরে যাই নাই। ”

আকাশ বেরিয়ে এলো। মা এসে গায়ে হাত মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। আকাশ দুহাত জোর করে শুধু একটা কথাই বলেছিল,

“সরি আম্মু, সরি… প্লিজ বাঁচাও আমাকে। ”

***
রাহেলা এখনো স্থির হয়ে বসে আছেন। তার মুখটা হা করা। কত কী বলে গেল একেকজন। তিনি কিছু শুনতে পাচ্ছেন না৷ তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে পুরোনো দিনগুলো। আকাশের জন্ম, প্রথম হাটা। স্কুলে ফার্স্ট হওয়া, প্রতি ক্লাসে স্কলারশিপ পাওয়া, ডিবেটে ফার্স্ট হওয়া, সাধারণ জ্ঞানের পরীক্ষা দিয়ে কম্পিউটার জিতে নেয়া। সমস্ত দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে চলছে পর পর। রাহেলা তার ভাবনায় এতো মগ্ন যে ঘন্টাখানিক আগে তালুকদার সাহেব কে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলেও তিনি বিন্দুমাত্র প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। আকাশ কে সরিয়ে নেয়া হয়েছে থানায়। এই মাত্র চৈতীর পরিবার এসে পৌছেছে। চৈতী বোধহয় কাঁদছে। আশ্চর্য হলেও সত্যি রাহেলার এই মুহুর্তে সবাইকে ছাপিয়ে প্রগাঢ় মায়া কেবল চৈতীর জন্য হলো। আহারে মেয়েটা!

***
চৈতীর মা মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে হাপুস নয়নে কাঁদলেন। বাবা স্থির হয়ে বসে আছেন চেয়ারে। চাচা, মামা, ভাইদের সামলানো মুশকিল হয়ে উঠেছে। তারা আকাশ কে পেলে শেষ করে ফেলবেন। চৈতীর চাচী, মামী অনেক অনুনয় করে ঘরে ঢুকেছেন। এই মহিলারা রাহেলার সঙ্গে কথা বলতে চান, তারা ভেতরে ঢুকেই দরজা লাগিয়ে দিলেন। ঘরে ইশিকার ফুপাতো ভাবী, বোন, আর মামী। চৈতীর চাচী বুক বরাবর একটা লাত্থি মারলেন রাহেলাকে। ইশিকা ও মাগো বলে চিৎকার করলে ও’কে কয়েকটা থাপ্পড় মারা হলো। মিনিট খানেকের মধ্যে পরিস্থিতি সামলানো গেল।

রাহেলা লাত্থি খেয়ে সম্বিৎ ফিরে পেলেন। বুকের ভেতর তীব্র ব্যথা অনুভব করেছেন তিনি। এই ব্যথা চৈতীর চাচীর দেয়া আঘাতে নয়, প্রচন্ড অহংকার ভেঙে গুড়িয়ে যাবার ব্যথা।

চলবে…..