কুন্দ ফুলের মালা পর্ব-২৪+২৫

0
15

#কুন্দ_ফুলের_মালা
#পর্ব-২৪ ও ২৫
“তোমার বাপের শরীর এখন কেমন? ”

“আগের থেকে ভালো আছে চাচা। ”

“একদম দেখি না তারে। ঘরের মধ্যে থাকে? বাইর হয় না?”

ইশিকা অপেক্ষা করছে বাজারের ব্যাগের। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো পাড়ার দোকান থেকেই নেয়। আজকাল বাইরে বেরোতে ওর সবচেয়ে কষ্ট হয়। কেমন যেন অস্থির লাগে, তবুও যেসব জিনিস লাগবে সেগুলো নিতে আসতেই হয়।

“তোমার ভাই কই আছে? বিদাশে পাঠায়ে দিবা শুনলাম? ”

ইশিকা এবার জবাব দেয়া বন্ধ করলো। লিস্ট মিলিয়ে বাজারগুলো দেখে টাকা বুঝিয়ে দিলো দোকানদার কে। দ্রুতযাবার তাড়া। সকাল, সন্ধ্যা দোকানে ভীড় থাকে বলে বিকেলে এসেছিল। এখনো মানুষজন এড়াতে পারে নি।

গেট দিয়ে যখন ঢুকবে তখন সেলিনা আন্টি ডাকলেন।

“ও ইশিকা কেমন আছ? কবে আসছ?”

ইশিকা মুখের উপর গেট বন্ধ করলো না। মৃদু স্বরে বলল,

“ভালো আছি আন্টি। ”

“শ্বশুর বাড়ি যাও না? জামাই আসে?”

ইশিকা চুপ করে আছে। সেলিনা আন্টি এরপর অপ্রিয় কথাটি তুললেন,

“যা শুনি তা তাহলে সত্য? ডিভোর্সের কাগজ পাঠাইছে?”

ইশিকা ইতস্তত করে বলল,

“অনেকক্ষন হয় আসছি আন্টি, ফোন নিয়া আসি নাই। আম্মু টেনশন করতেছে। এখন যাই। ”

সেলিনা আন্টি আরও কিছু বলতে চাইলেন, ইশিকা সুযোগ দিলো না। ঘরে ঢুকে বাজারের ব্যাগ টা সোফায় রেখে বসে পড়লো। রাহেলা আসরের নামাজ পড়ে রান্নাঘরে এসেছেন তালুকদার সাহেব কে মাল্টা কেটে দিবেন। ইশিকাকে ওভাবে বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন,

“কী হইছে? ওভাবে বসে আছিস কেন?”

ইশিকা রাগী গলায় বলল,

“আর কী হবে? আর কিছু হওয়া বাকী আছে? ”

রাহেলা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

“আস্তে। তোমার বাবায় জেগে আছেন। ”

ইশিকা হু হু করে কেঁদে ফেলল। ভাইয়ের স্ক্যান্ডালের কারণে ওর সংসারটাও শেষ হয়ে গেল। বিয়ের পর ইশিকা স্বামীর সঙ্গে সুখী ছিলো। শ্বশুর, শাশুড়ী দুই ননদ, দেবর কারোর সঙ্গে কোনো ঝামেলা নেই। ব্যস্ত স্বামী যতটুকু সম্ভব বউয়ের খেয়াল রাখেন। যা চায়, তারচেয়ে বেশি দিয়ে ভরিয়ে রাখে। আকাশের ঘটনার পর ইশিকা সেই বাড়িতে গিয়ে সকলের অন্যরুপ দেখতে পেল। এতো বড় একটা ঘটনা শুধু মিঠাপুকুর লেন অবধি তো রইলো না। পাড়ার ছেলেরা ফেসবুকে ব্যাপার টা ভাইরাল করে দিলো। ইশিকার শ্বশুর বাড়ি বনেদি পরিবার। শ্বশুর, শাশুড়ী দুজনেই শিক্ষিত ধর্মভীরু। তারা ছেলের জন্য পাত্রী নির্বাচনের সময় আধুনিক মেয়েকে গুরুত্ব দিলেও প্রাধান্য দিয়েছেন সুন্দরী, ভালো পরিবার কে। এখন পরিবারের এই রুপ দেখে স্বাভাবিক ভাবে ধরে নিয়েছেন যে তারা ভুল করেছেন এবং প্রতারিত হয়েছেন। ইশিকার স্বামী ব্যবসা করে নাম কামিয়েছিল ভালোই। তাকেও জনে জনে শ্বশুর বাড়ির কেচ্ছা কাহিনী সম্পর্কে বিস্তারিত বলতে হয়। এই নিয়ে ঝামেলা শুরু হলেও সেই ঝামেলা অবসান ঘটলো শ্বশুরের এক সিদ্ধান্তে। শ্বশুর ইশিকাকে বললেন,

“তুমি তোমার বাপ, মায়ের কাছে গিয়ে থাকো। আমরা সমাজ নিয়ে চলি, তোমার পরিবারের দুর্নামে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। ”

ইশিকা ওর স্বামীকে অনুরোধ করেছে, পায়ে ধরেছে কিন্তু সে তার সিদ্ধান্তে অবিচল। ইশিকার সঙ্গে আর সংসার করবে না। ইশিকা জানিয়েছিল যে ও আর বাপের বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে না, কিন্তু কেউ ওর কথা শুনেনি।

ইশিকাকে একরকম বের করে দেয়ার পর ডিভোর্স পেপারও পাঠিয়ে দিয়েছে চটজলদি। কাবিনের টাকা দিতেও তাদের আপত্তি নেই। ইশিকা কল করে কান্নাকাটি করারও সুযোগ পায় না, ওদের নাম্বারগুলো দেখলেই কল কেটে যায়। নতুন সিম কিনে কল করেও কথা বলার সুযোগ পায় না।

ইশিকার এখন দিন শুরু হয় মা’কে দোষারোপ করে, আর দিন শেষ হয় ভাইকে অভিশাপ দিয়ে। রাহেলা চুপচাপ থাকেন। আগে মেয়ে মা’কে ভয় পেত, আর এখন তিনি ভয় পান। সবসময় তটস্থ থাকেন মেয়ে আবার নিজের ক্ষতি না করে ফেলে।

সেই অন্ধকার সময় পেরিয়ে গেছে প্রায় মাস ছয়েক হলো। তালুকদার সাহেব অসুস্থ, তিনি এখনো পর্যন্ত ট্রমা কাটিয়ে উঠতে পারছেন না। বসে বসে ভাবেন কোন পাপে এতো বড় শাস্তি পাচ্ছেন।

রাহেলা কোর্ট কাছারি করে বড্ড ক্লান্ত। চৈতীর বাপ, মা মামলা করেছে। সেই মামলায় তারা নিষ্পত্তি পেলেও আকাশ কে জেল খাটতে হলো তিন মাস। এখন সাভারের দিকে একটা বাসা নিয়ে একা থাকছে। দেশের বাইরে যেতে পারবে না মামলা চলাকালীন। চৈতীর পরিবার কে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে দশকোটি টাকা।
রাহেলা টাকার পরিমাণ মনে করে অস্থির হন। এতো টাকা কোত্থেকে দিবেন তিনি। বাড়ি, জমি সব বিক্রি করেও এতো টাকা পাওয়া যাবে না। আর এরপর তারা কী করবেন।

আকাশের চাকরি তো গেছেই সেই সঙ্গে মান সম্মানও অবশিষ্ট নেই। রাহেলা ভাবেন এতো কিছুর পরও আকাশ বেঁচে আছে কেন! আশ্চর্য হয়ে যান নিজের ভাবনায়। এই সন্তান কে তিনি কতো যত্নে মানুষ করেছেন, রাত জেগে দুশ্চিন্তা করেছেন। সবকিছু বেস্ট দেবার চেষ্টা করেছেন, তবুও এই সন্তান তাদের ডুবিয়ে ছাড়লো।

আকাশ মিঠাপুকুর লেনে আসতে পারবে না আর। পাড়ার লোক তাদের একঘরে না করলেও তারা তেমন ই আছেন। ভাড়াটিয়ারা ঠিকঠাক ভাড়া দেয় না, গলা উঁচিয়ে কথা শোনার। পাড়ায় যার সঙ্গে দেখা হয় সে প্রশ্ন করে,

“আপনারা সত্যিই জানতেন না? তা কেমনে হয়। আপনারা জানতে পেরেই তো দূরে বিয়ে করালেন ছেলেকে। ”

যে যখন পারছে জ্ঞান দিয়ে যাচ্ছে। প্রফেসরের বউ আসে, সেও মুখ ঝামটা দিয়ে বলে যায়,

“আল্লাহর দুনিয়ায় কাউরে ছোট করতে হয় না, আবার বেশী অহংকারের ফলও অনেক খারাপ হয়। আল্লাহর কাছে মাফ চান। ”

রাহেলা মনের দিক থেকে এতো দূর্বল হয়েছে যে তিনি তার তেজ দেখাতে পারেনা। এই প্রফেসরের বউ তাকে একদিন এসে জিজ্ঞেস করেছিলেন,

“আকাশের অন্য জায়গায় বিয়ে দিতেছেন? ঝিলমিলের সাথে না হওয়ার কথা? ”

রাহেলা সেদিন ধমকের সুরে বলেছিলেন,

“এতো কথা বলেন ক্যান? আমার ছেলের কার সঙ্গে বিয়ে দেব, কার সঙ্গে দেব না সেটা আপনারে বলা লাগবে? আপনার এতো কী দরকার। অন্যের ঘরে কী হয় না হয় এই নিয়া পড়ে থাকেন। ”

এখন প্রফেসরের বউয়ের মুখের উপর কিছু বলেন না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সব শোনেন।

ছেলেকে তিনি ত্যাগ করতে পারেন নি। মাসে মাসে টাকা পাঠান। আকাশ তাকে কল করে, বাপের খোঁজ নেয়। রাহেলা একটা বাড়তি কথা বলেন না। আকাশ বারবার মাফ চায়। তিনি কিছু বলেন না।

****
আকাশ একা থাকে। বন্ধুরা কেউ কেউ ও’কে পুরোপুরি বর্জন করেছে। কেউ কেউ ও’কে এড়িয়ে চলছে। যারা এড়িয়ে চলছে তাদের ওর জীবনের নিষিদ্ধ সম্পর্ক টা নিয়ে আগ্রহের শেষ নেই। তাই তাদের কাছে দ্বিতীয়বার আর যেতে চায় না।

একা থাকা যে কতোটা যন্ত্রণার সেটা টের পেলেও ওর মরে যাবার সাহস নেই। মরে যাবার যার এতো ভয়, সে কীভাবে দিনের পর দিন এতো পাপ করলো।

ওর নামের সঙ্গে অনিন্দিতার নামটা জুড়ে যাওয়ায় সোশ্যাল মিডিয়ায় অনিন্দিতাকেও সবাই চিনে রাখলো। আকাশ ভাবে অনিন্দিতার আর কী হবে! ও সব ম্যানেজ করে ফেলবে, নিজেকে ঠিক বাঁচিয়ে নিবে। ও তো বোকা তাই নিজেকে বাঁচাতে পারে নি। যখন শুনেছে ঝিলমিলের কাছে কোনো প্রমাণ ছিলো না তখন ও নিজের মাথার চুল টেনে ছিড়েছে। আগে যদি ওরকম কিছু বুঝতে পারতো তবে নিজেকে বাঁচানোর একটা চেষ্টা করে ফেলতো। তবে কতটুকু বাঁচাতে পারতো সেটা ভাববার বিষয়। কারণ সত্যি সবসময় সহজ, আর মিথ্যে সবসময় কঠিন থেকে কঠিনতর।

চৈতীর মুখোমুখি ও’কে আর হতে হয় নি। হলে কী করতো চৈতী! মারতো ও’কে! আকাশ সবচেয়ে বেশী দু:খ পেয়েছে মায়ের সঙ্গে চৈতীর পরিবারের আচরণের কথা শুনে। সভাপতি সাহেব সাহায্য করেছিলেন বলে ও চৈতীর পরিবারের হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিল। নাহলে মেরে ফেলতো ও’কে। তবুও নিজে মার খেলেও সহ্য করে নিতো, কিন্তু মা’কে! এই একটা ব্যাপার আকাশ যতবার ভাবে, ততবারই ভেঙেচুরে শেষ হয়ে যায়। সেই সময়ে মনে হয় এর চেয়ে মরণ ভালো ছিলো ওর জন্য। কেন যে সাহস করে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে যেতে পারলো না।

অসময়ে ইশিকার নাম্বার থেকে কল আসায় আকাশ ভরকে গেল। বাবার হার্টের অসুখ আছে, অনেক দিন ধরে অসুখটা ভোগাচ্ছে। মায়ের কাছে শুনেছে, যত দিন যাচ্ছে বাবা নাকি নরম হয়ে গেছে। আকাশের খুব ভয় লাগে, একবার চোখের দেখা দেখতে ইচ্ছে করে। মা ফোনে কথা বললেও মুখোমুখি হতে চান না। আকাশ চেষ্টা করেছে তার সঙ্গে দেখা করার, তিনি জানিয়েছেন তার ইচ্ছে হয় না।

আকাশ কল রিসিভ করলো ভয়ে ভয়ে। কল রিসিভ করে যেন খারাপ কোনো খবর না শুনতে হয়, সেজন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে লাগলো।

“হ্যালো ইশিকা, বাবা ঠিক আছে? ”

“তোর খুব খারাপ মরণ হবে দেখিস, মরার সময় কেউ তোর সাথে থাকবে না, আমি অভিশাপ দিলাম তোকে। তুই স্বার্থপর, অসভ্য, জানোয়ার। তোর কারণে, শুধু তোর কারণে আমার সংসার টা ভেঙে গেছে। আমি সারাজীবন তোরে অভিশাপ দিয়ে যাব। ”

ইশিকা কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করে কথাগুলো বলল। আকাশ যে হাতে ফোন ধরে রেখেছে সেই হাতটা কাঁপছে অনবরত। ইদানীং প্যানিক অ্যাটাকের মতো হয়। ইশিকা আরও কতোকিছু বলল! সব কথার শেষে অভিশাপ জাতীয় কিছু কথাবার্তা থাকে। আকাশ সহ্য করতে পারলো না। কল টা কেটে দিলো।

নিজেকে সামলাতে সময় লাগছে আকাশের। হাতের নাগালে পানি থাকার পরও প্রচন্ড তৃষ্ণায় কাতর হয়ে বসে রইলো। এতো অসহায়, এতো একা একটা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে ও’কে!

***
ঝিলমিলের গ্রাজুয়েশন শেষ হয়েছে। হাতে অফুরন্ত সময়, রেজাল্টের অপেক্ষায় আছে। এই সময় টা বাড়িতে বসেই কাটছে। নতুন নতুন রেসিপি শিখে সেগুলো বানাচ্ছে। শাশুড়ী আগ্রহ করে ও’কে হাতের কাজও শিখাচ্ছেন।

শাশুড়ী ও’কে ভালোবাসেন, শ্বশুরও তেমন। আকাশের ওই ঘটনা জানার পর তাদের ভালোবাসা বেড়েছে। জাহানারা ঝিলমিল কে বলেছেন, ভালো হইছে তোমার বিয়ে পিশাচটার সাথে হয় নাই। আমার পোলা লেখাপড়ায় অতো উচুতে যায় নাই ঠিকই কিন্তু তার স্বভাব চরিত্র ভালো। আর তুমিও ভালো, ভাগ্য করে বউ পাইছে হৃদয়।

জাহানারা বিভিন্ন সময়ে আকাশের প্রসঙ্গ তুলে কথা বলে, এই বাড়িতে তিনি ছাড়া ওই প্রসঙ্গে আর কেউ কিছু বলে না। তবে তার মাথায় এখন রিহানের বিয়ে দেবার ভুত ঢুকেছে। তিনি ভয় পেয়েছেন অবশ্য, আকাশের মতো ছেলে পরিবারের সাথে থেকে যে কান্ড করলো! রিহান তো দূরে থাকে।

রিহান ছুটিতে বাসায় এসে ঝিলমিল কে বলল,

“ভাবী আম্মা তো সন্দেহবাতিক হয়ে গেছেন। সারাদিনে আট, দশবার করে কল করেন, আমার রুমমেট দের কাছেও কল করেন। ভাবো কী অবস্থা!”

ঝিলমিল হেসে বলে,

“আম্মা তোমার বিয়ে দিতে চান। ”

“আমার বিয়ে কেন?”

“দূরে থাকো তাই, আম্মার ভরসা হয় না। ”

রিহান অবাক গলায় বলে,

“এসবের কোনো মানে হয়?”

জাহানারা হৃদয়কেও এই কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন,

“বিয়েশাদি করে বউ নিয়া থাকুক, চরিত্র ঠিক থাকুক। আকাইশ্যা যদি তার মায়েরে এই জিনিস বলতো তাইলে তার মায়েও বিয়া দিয়া ঘরে আগেই বউ আনতো। ”

হৃদয় মা’কে গম্ভীর গলায় বলেছে,

“আম্মা অন্যের প্যাচাল বাদ দাও। আর রিহান কে জিজ্ঞেস করো, ও চাইলে বিয়ে করিয়ে দাও। ”

জাহানারা আকাশের প্রসঙ্গ ছাড়তে পারে না। তিনি সুযোগ পেলেই বলেন। ঝিলমিল কিছু বলে না, ওর সত্যিই কিছু যায় আসে না এখন। আকাশের পরিবার, আকাশ কী কী সমস্যা সামলাচ্ছে সেগুলো নিয়ে ওর মাথাব্যথা যেমন নেই তেমনি খারাপ লাগাও নেই। যে যেমন কর্ম করবে, তাকে তেমন ফল ই ভোগ করতে হবে। মানুষ ভুল করে, সেই ভুল থেকে শিক্ষা নেয়, শুধরে নেয়ার চেষ্টা করে। ঝিলমিলের কাছে ধরা পড়ার পর আকাশ চৈতীকে বিয়ে করেছে। ও ভুল শুধরাতে চাইলে বিয়ের পর অনিন্দিতার চ্যাপ্টার টা ক্লোজ করে দিতো, কিন্তু করেনি।

অনিন্দিতার কথা শোনা গেছে তাকে তাকে পরিবার থেকে আলাদা করে ফেলেছে। শ্বশুর, শাশুড়ী আত্মীয় স্বজনরা চাইছে না এমন মহিলার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে। একতা হাউজিং সোসাইটি থেকেও নাকি নোটিশ দিয়েছে। অনিন্দিতা চলে গেছে ওর দাদার কাছে। এখন কী অবস্থায় আছে, কেমন আছে কে জানে!

এই ঘটনাটা সোশ্যাল মিডিয়ায় খুব ভাইরাল হয়ে অনেকের জন্য শিক্ষা হয়েছে। তবে ঝিলমিলের একটু খারাপ লেগেছে চৈতীর জন্য। মেয়েটাকে বাপ, চাচা যখন নিয়ে গিয়েছিল তখন পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিল। নিশ্চয়ই এই মেয়েটা বিয়ের সময় স্বপ্ন দেখেছিল চমৎকার একজন পার্টনারের! বিনিময়ে কী পেল। ঝিলমিলের মনে হয় ও রাগ ক্রোধে অন্ধ হয়ে চৈতীর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছে। চৈতীর উদ্দেশ্য ও জানেনা তবে ওই একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করেই তো সবকিছু ওলট, পালট হয়ে গেল।

ঝিলমিল হৃদয়কে একদিন প্রশ্ন করেছিল,

“আচ্ছা আমার নেয়া একশনের জন্য চৈতীর জীবন টা শেষ হয়ে গেল! ওর দীর্ঘশ্বাসে কী আমার জন্য অভিশাপ থাকবে। ”

হৃদয় ও’কে সুন্দর করে বুঝিয়ে বলেছিল যে, না ও চৈতীর সঙ্গে খারাপ কিছু করে নি। চৈতীর সঙ্গে খারাপ তখনই হয়েছে, যখন ওর আকাশের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে। ঝিলমিলের পক্ষে সে সময় তো চৈতীকে বাঁচানো সম্ভব ছিলো না। হতে পারে এই ঘটনায় চৈতী বেঁচে গেছে। যদি আরও পরে জানতে পারতো, তখন হয়তো আর কিছু করার পথই থাকতো না।

হৃদয় বোঝানোর পর ও সব ভুলে যায়। শাশুড়ীর কাছ থেকে শুনতে পারে যে ওদের সঙ্গে কী কী হচ্ছে। চৈতীদের কাছ থেকে যা কিছু পেয়ে ওরা খুশি ছিলো তার থেকে দশগুন ওদের ফের‍ত দিতে হবে। জীবন যে কার কখন বদলে যায়! গত বর্ষায়ও এমন দিনে ওরা নিশ্চিন্তে দিন যাপন করেছিল। এবারের বর্ষায় ওদের জীবনে এমন বিপর্যয়।

রাহেলা ঝিলমিলের বাপ, মায়ের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। পাড়ার লোক ধরেছিল ওদেরও ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ঝিলমিলের বাবা, মা অস্বীকার করেছেন। তারা ক্ষতিপূরণ চায় না, মেয়ের অসম্মান, তাদের ঠকানো এসবের আসলে কোনো ক্ষতিপূরণ হয় না।

****
বিকেল থেকে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ঝিলমিল বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। হৃদয় বলেছে দশ মিনিটে পৌছে যাবে, তবুও ওর চিন্তা হয়। রিহান বারান্দায় ঝিলমিল কে দেখে বলল,

“ভাবী সামান্য বৃষ্টি তো। আর বজ্রপাতও নেই। এতো টেনশনের কী আছে? ”

“দশ মিনিট তো হয়ে গেছে এখনো আসছে না যে। ওদিকে কী পানি জমেছে?”

রিহান হেসে ফেলল।

হৃদয় কাকভেজা হয়ে ফিরলো। ঝিলমিল উচ্ছ্বসিত গলায় বলল,

“ওই তো দেখা যাচ্ছে। ”

কথাটা বলেই দৌড়ে গেল দরজার দিকে। হৃদয় ঘরে ঢুকে চুল মুছে নিলো। রেইনকোট পরা ছিলো বলে তেমন পানি লাগে নি। রিহান ভাইয়ের উদ্দেশ্য বলল,

“ভাইয়া মনে হচ্ছে আম্মার কথা শুনে বিয়েটা করে নেয়া ভালো। আমাকেও তখন এমন যত্ন করার কেউ থাকবে। ”

ঝিলমিল লজ্জা পেয়ে হাসলো। হৃদয় হাই তুলে বলল,

“জামাকাপড় পাল্টে এসে শুনব তোর বাকী কথা। ততক্ষন তুই জ্বলতে থাক। ”

হৃদয় চলে যেতেই রিহান ঝিলমিল কে বলল,

“এক কাপ চা আমার জন্যেও কোরো তো, তাহলে তোমাকে ভাইয়ার একটা গোপন কথা বলব। ”

“কী গোপন কথা?”

“ভাইয়া কী তোমাকে বলেছে যে সে তোমাকে তুলে আনার প্ল্যান করেছিল!”

ঝিলমিল চোখ কপালে তুলে বলল,

“কী?”

“হ্যাঁ। ওই যে মারামারি হলো সেইবার। ভাইয়া খুব রেগে গেছে। বাসায় আসার পর আম্মা, আমি, আব্বা সবাই তাকে শান্ত করছিলাম। আম্মা তো বলেছিলেন তিনি তোমার চেয়েও সুন্দর মেয়ে খুঁজে ভাইয়ার সঙ্গে বিয়ে দিবেন। এখন তো তুমি ঝগড়া করে তার প্রিয় হয়ে গেছো, আগে কিন্তু সে তোমাকে অতো পছন্দ করতো না। ”

ঝিলমিল লাজুক গলায় বলল,

“তুলে আনার কথা কী প্রসঙ্গে বলেছিল?’

রিহান মৃদু হেসে বলেছিল,

“ভাইয়ার তো রাগলে মাথার ঠিক থাকে না। আট, দশটা সিগারেট খেয়েও শান্ত হচ্ছিলো না সেদিন। আমি তার ঘরে যখন ঘুমাতে গেলাম তখন আমাকে বলল যে তুলে এনে হলেও ও তোমাকে বিয়ে করবে। ”

“আচ্ছা। ”

“ওর মাইন্ড পাওয়ার দেখো! তুলে আনার আগেই তুমি ধরা দিলে। ”

ঝিলমিল দ্রুত সেখান থেকে চলে গেল লজ্জা আড়াল করতে।

***
“রিহানের কাছে একটা ব্যাপার শুনলাম। ”

হৃদয় চায়ে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করলো

“কী?”

“তুমি নাকি আমাকে তুলে আনতে চেয়েছিলে?”

হৃদয় স্মিত হেসে চা’য়ে ফু দিলো। বলল,

“এরকম বলেছিলাম! মনে নেই তো। ”

“তোমার চিন্তাভাবনা তাহলে গুন্ডাদের মতোই ছিলো তাহলে। ”

হৃদয় ঝিলমিলের হাত ধরে কাছে টানলো। বলল,

“শোনো, আমি জানতাম যে তোমার বিয়ে তালুকদার বাড়িতে হবে না। চায়ের দোকানে বসে তালুকদার চাচা গল্প করতেন যে তার ছেলেকে জামাই করার জন্য কতো বড়লোক ব্যাটারা পাগল। হাতে, পায়ে ধরে আরও কত কী! শুধু জানতাম না যে তুমি এসে আমাকে বিয়ে করার জন্য পাগল হয়ে যাবে। ”

ঝিলমিল আজ আর রাগলো না। হৃদয় ও’কে ক্ষ্যাপানোর জন্য প্রায় ই এই প্রসঙ্গ আনে। ঝিলমিল ম্যুড অফ করে কিছু সময় কথাও বন্ধ করে দেয়। আজ আর সেসব করলো না। হৃদয় ওর চোখের দিকে তাকিয়ে হাসলো। ঝিলমিল আজ আবার বলল, হাসলে তোমাকে খুব মিষ্টি লাগে। অপেক্ষা করলো, হৃদয়ের জবাবের। এক্ষুনি কিছু একটা বলে অপ্রস্তুত করে রোমান্টিক ম্যুডের বারোটা বাজিয়ে দিবে। হৃদয় আরও সুন্দর করে হেসে ওর গালে হাত রেখে মুখটা কাছে টানলো। ঝিলমিলও এগিয়ে এসে দুহাত দিয়ে ওর গলা জড়িয়ে ধরলো।

চলবে…..