কুন্দ ফুলের মালা পর্ব-২৬ এবং শেষ পর্ব

0
16

#কুন্দ_ফুলের_মালা
#শেষ পর্ব
চৈতী বাবা, মায়ের অতি আদরের মেয়ে। যাকে কেউ কটু কথার বলার সাহস পেতো না, অথচ পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে এখন অনেকের উপহাসের পাত্র হয়েছে। কেউ আড়ালে, কেউবা হাসির ছলে ওর সামনেই উপহাস করে। চরিত্রবান স্বামী, সুন্দর সংসার সব মেয়েদের ই আরাধ্য থাকে, চৈতী কখনোই কল্পনা করে নি, আকাশের চরিত্রের এমন একটা গল্প থাকতে পারে। বাবা, পরিবারের অন্য সদস্যরা আকাশ ও তার পরিবার কে শাস্তি দিতে মরিয়া হলেও মায়ের আচরণ টা ভিন্ন। তিনি মেয়ের কপালের দোষ দিচ্ছেন, সেই সঙ্গে দোষারোপ করছেন চৈতীকেও।

চাচী বলেন, চৈতী খুব বাড়াবাড়ি করেছে। স্বামী, সংসার নিয়ে ওর বাড়াবাড়ি ভালো রকম ছিলো। কী দরকার ছিলো ঝিলমিলের টপিকে এতো নাক গলানোর। গর্তে ইঁদুর খুঁজতে গিয়ে সাপ বেরিয়ে এলো, এটা কী ভালো কিছু! এরচেয়ে যদি আকাশের চরিত্রটা আস্তেধীরে ওর কাছে প্রকাশ পেত তবে জটিলতা আরেকটু কম হতো। মানুষের এতো মিথ্যে দীর্ঘশ্বাস গুনতে হতো না। বিষয় টা গোপন থেকে ছাড়াছাড়ি হলে ভালো হতো, জামাইয়ের চরিত্র খারাপ কথাটা শোনার পর একদল শুনিয়ে যায়, এমন সুন্দর বউ, শ্বশুরবাড়ির আন্তরিকতার পরও সংসার টিকলো না! অথচ সংসার না হওয়ার পিছনের গল্পটা কতো করুণ ছিলো সেটা ভাববে না কেউ।

চৈতী এই জীবনে আরও একবার আকাশের মুখোমুখি হতে চায়। একবার চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করতে চায়। আর ঝিলমিল! ঝিলমিল ও’কে প্রথম অপমানের স্বাদ বুঝিয়েছে, ঝিলমিল কে তো কখনো ভুলতে পারবে না।

মানুষ সবসময় নিজের দু:খ, কষ্টের জন্য অন্যকে দোষারোপ করতে পছন্দ করে। অন্যকে দোষারোপ করে নিজে হালকা হয়। আকাশের জীবনের গল্পে চৈতীর জায়গায় ঝিলমিল, আর ঝিলমিলের জায়গায় চৈতী থাকলে গল্পটা নি:সন্দেহে ব্যতিক্রম হতো, কিন্তু চৈতী কী ঝিলমিলের চেয়ে বেশী হিংস্র হতো না!

****
ঝিলমিল আজ নিজেদের বাসায় এলো। অনেক দিন পর আসা হলো। এতো কাছে বাপের বাড়ি হলেও ওর আসা হয় খুব কম। নিজেরই আসতে ইচ্ছে করে না, অথচ ঘরে ওর তেমন কাজও নেই। এক জায়গায় থিতু হয়ে গেলে আপনাআপনি সেই জায়গার প্রতি মায়া জন্মে যায়। হৃদয় আর ওর ঘরটা এখন ওর সবচেয়ে ভালোলাগার জায়গা। দক্ষিণমুখী বারান্দাটা ওর অবসর কাটানোর স্থান।

আসমা মেয়েকে দেখে ভারী খুশি হলেন। আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেছে, বৃষ্টি নামবার পালা। আসমা বড় ইলিশ নামিয়ে রেখেছেন। চাল, ডাল ধুয়ে খিচুড়ি বসিয়ে দিয়েছেন। নারকেল, খই, খেজুরের গুড়ে মাখিয়ে মেয়েকে দিতে দিতে বললেন,

“আমার মাঝেমধ্যে মনে হয় তোকে ভিনদেশে বিয়ে দিয়েছি। এতো কম আসিস, আমি এতো বলি তাও শুনিস না। ”

“বারান্দার গোলাপ গাছ টায় ফুল ধরেছে মা?”

“হ্যাঁ। তোকে বলতে ভুলে গেছি। ”

ঝিলমিল এই গোলাপ গাছ টা দুই বছর আগে পুতেছিল একটা ভাঙা টবে। গাছটায় ফুল ধরে নি, এই তো কয়েক মাস আগে নতুন টবে, নতুন মাটিতে পুতে দিলো। এখন কী সুন্দর ফুল ধরেছে। গোলাপি রঙের ফুলগুলো যেন ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে। ভাঙা টবে গাছ ফুল ফোঁটায় নি, গাছেরও অভিমান হয় বুঝি! যত্ন, ভালোবাসা পেয়ে এখন কী সুন্দর ফুল দিয়েছে।

ঝিলমিল গভীর চোখে তাকিয়ে আছে ফুলগুলোর দিকে। আসমা বললেন,

“এই শোন, টুটুল তোর নামে অভিযোগ করেছে কিন্তু। তুই ও’কে কখনো কল করিস না, টেক্সট পাঠাস না। ”

ঝিলমিল হাসলো। বলল,

“আমি তো ওর সঙ্গে কথা বলি। ”

আসমা মেয়ের হাত ধরে বললেন,

“আমি দেখেছি ঝিলমিল। যতটুকু প্রয়োজন, ততটুকু বলিস। আগে ভাই তোর প্রাণ ছিলো। সেই ছোট্ট থেকে আগলে রেখেছিস। একটা লজেন্স যে দুই ভাগ করে খেতে হয় সেটা আমি তোকে দেখে শিখেছি। ”

“এখন তো বয়স বেড়ে গেছে মা। টুটুলের আর ওরকম আদরের দরকার নেই। আমারও বিয়ে হয়ে গেছে, পর হয়ে গেছি। ”

“একি কথা! বিয়ে হলে পর হয়? বড় হলে ভাই বোনের সম্পর্ক বদলে যায়?”

ঝিলমিল জবাব দিলো না। আসমা বললেন,

“ও তো ছেলেমানুষ, কবে কী বলেছে সেটা মনে রাখিস না। ”

ঝিলমিল হাত টা মুছে নিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,

“কবে, কোনসময় কী বলেছে সেটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার মা। আর ছেলেমানুষ এই কথাটা তোমার একচোখা হয়ে গেল। আকাশ আমার সঙ্গে কী করেছিল সেটা চাইলেও আমি যেমন ভুলতে পারব না, তেমনি তোমাদের আচরণ টাও ভুলতে পারব না। ”

আসমা আলগোছে মেয়ের হাত ধরলেন। তার চোখে অপরাধবোধ। মেয়েটা চাপা স্বভাবের, কষ্ট পেলেও বলে না।

ঝিলমিল বলল,

“আমি আল্লাহর কাছে চাইবো আমারও যেন তোমার মতো একটা মেয়ে আর ছেলে হয়। মেয়েটি যেন বড় হয়, সে যখন ভুল করবে, কিংবা মানুষ তাকে প্রতারিত করবে তখন আমি মেয়ের জন্য কাঁদব। মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে কাঁদব। তাকে বলব যে তোর দু:খ মানেই আমার দু:খ। তার ভাইকে বলব আপুর ভালো সময়ে যখন হি হি করে হেসেছিস, খারাপ সময়ে এখন কান্নাকাটি কর। কিন্তু ভুলেও তাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাবি না। মেয়ের বাবাকে বলব পাড়ার দোকানে চা খেতে যেতে হবে না, সে যেন মেয়েকে বলে, মা আমার জন্য এক কাপ চা নিয়ে আয় আজ আমার তোর হাতের চা খেতে ইচ্ছে করছে। ”

আসমার চোখ ভিজে উঠেছে। ঝিলমিল মায়ের হাতটা শক্ত করে ধরে বলল,

“আমার কোনো রাগ নেই মা, অভিযোগও নেই। তবে ভীষণ দু:খ আছে। তুমি আমার পোড়া কপাল ভেবে তুমি কেঁদেছ, নিজেদের মান, সম্মানের জন্য ভেবেছ। এখানেই আমার দু:খ। আমার মেয়েকে যদি ভালোবাসার মানুষ ছেড়ে যায় তবে তার পোড়া কপালের জন্য কাঁদব না, আমি ওই সময়ে আমার মেয়ের দু:খ কে অনুভব করে কাঁদব। তারপর তাকে বুঝিয়ে বলব যে কেউ ছেড়ে গেলে, বিয়ে ভেঙে গেলে কিছু হয় না। তোমাকে যে ছেড়ে গেছে সে তার মতো একজন কে পাবে। আর তুমি পাবে তোমার মতো একজন কে।

আসমা ঠোঁট চেপে কান্না থামানোর ব্যর্থ চেষ্টা করলেন। মেয়ের কথাগুলো তো মিথ্যে নয়, তিনি মানুষের কথা শুনে ত্যক্ত, বিরক্ত হয়েছেন। টুটুল, ওর বাবা বাইরের মানুষের কথায় ওর সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছেন। অথচ সেই সময়ে মেয়েটা একদম একা নিজেকে সামলেছে।

“আমি আবারও বলছি মা, আমার তোমাদের উপর রাগ নেই। টুটুল আমার একমাত্র ভাই, আমি সবসময় যেমন চেয়েছি ও ভালো থাকুক, এখনো তেমন চাই। কিন্তু আরও একটা ব্যাপার চাই যে সেদিনের সেই বেয়াদবির পুনরাবৃত্তি না হোক। ও’কে বুঝতে হবে আমি ওর বড়বোন। আমার জীবনের যেকোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নেই। তাই এই মুহুর্তে ওর সঙ্গে আমার যেমন সম্পর্ক আছে আমি সবসময় তেমন ই থাকতে চাই। সময়, পরিস্থিতি যেমন মানুষ কে বদলে দেয়, তেমনি সম্পর্কও বদলে দেয়। আমিও আমার ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক বদলেছি। ওর ভালো, খারাপে নিশ্চয়ই থাকব কিন্তু আগের মতো হতে পারব না। সবটা উজাড় করে যাকে ভালোবাসা হয়, তার কাছে অনেক চাহিদা থাকে। আমারও তেমন ছিলো। ”

আসমা আর কিছু বলতে দিলেন না মেয়েকে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন। ঝিলমিল মা’কে জড়িয়ে ধরে রাখলো। আসমা মেয়ের অভিযোগের বিরুদ্ধে কিছু বললেন না। করুক অভিযোগ, বাপ মায়ের কাছে তো এটুকু করবেই।

****
ঝিলমিল বিছানার চাদরে হাত বুলালো। পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন করছিলো। ওই যে সেই মুহুর্ত টা! ভেঙেচুরে যখন কাঁদছিলো হৃদয় আদুরে বিড়ালের মতো ও’কে জড়িয়ে রেখেছিল।

বারান্দার গাছ থেকে গোলাপগুলো তুলে আনতে কষ্ট হলো ভীষণ। তবুও একটা ইচ্ছেপূরণ এর লোভ সামলাতে পারলো না। বিছানাময় ছড়িয়ে দিলো গোলাপের পাপড়িগুলো। ফোন টা হাতে নিয়ে হৃদয়কে ফোন করবে। কখন আসবে ও!

***
বাতাস টা শো শো শব্দ করছে। এক্ষুনি বোধহয় ঝাপিয়ে বৃষ্টি নামবে। রাস্তার ধারের মানুষজনের ব্যস্ততা। ভ্যানের সবজি বিক্রেতা সব গুছিয়ে নিরাপদ আশ্র‍য়ে চলে যাবার তাড়া, কলেজ পড়ুয়া কিশোর, কিশোরীরা বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতে দ্রুত পায়ে এগিয়ে চলছে। একটা দৃশ্য দেখে হৃদয় থমকে গেল। একটা ছেলে আর মেয়ে। হতে পারে দুজন বন্ধু, কিংবা প্রেমিকযুগল। মেয়েটা ওড়নার আঁচল দিয়ে মাথা ঢেকে নিলো। ছেলেটা তাকিয়ে আছে মুগ্ধ চোখে। দুজনের চোখাচোখি হলো, কিছু একটা বলল ছেলেটা মেয়েটা লাজুক হেসে মুখ আড়াল করলো।

হৃদয়ের জীবনে ঝিলমিল কে যেমন ভাবে চেয়েছিল ঠিক তেমন ভাবেই পেয়েছে। মন দিয়ে চাইলে সত্যিই যে পাওয়া যায় সেটা ও নিজেকে দেখে শিখলো। এই ব্যাপার ভেবে গর্বও হয় খুব। পাওয়ার আগে, পরে অনেক গল্প আছে। থাকুক সেসব তবুও দিনশেষে প্রাপ্তির খাতাটা পরিপূর্ণ। এটাই সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ।

মিঠাপুকুর লেনে আসার পর হৃদয় ঝিলমিল কে কল করলো। ঝিলমিল বারান্দায় দাঁড়িয়েই বলল,

“উপরে এসো তাড়াতাড়ি। বৃষ্টি নামবে তো। ”

হৃদয় চিৎকার করে বলল,

“না তুমি নিচে নেমে এসো। ”

ঝিলমিল কিছু ভাবলো না, নিচে নেমে এলো। জিজ্ঞেস করলো,

“কী হলো? ”

“বাইকে ওঠো। ”

“এখন কোথায় যাবে? ”

“তুমি অনেক প্রশ্ন করো মাঝেমধ্যে। ”

ঝিলমিল আজ শাড়ি পরেছিল। শাশুড়ী আজ শাড়ি পরতে বলেছিল। ও আঁচল টা সামলে হৃদয়ের কাঁধে ভর করে বাইকে উঠলো। হৃদয় বলল,

“ভালো করে ধরে বসো। ”

প্রতিবার ও এই কথা বলে। ঝিলমিলও ও’কে শক্ত করে ধরে।

বাইক চলছে ধীর গতিতে। মিঠাপুকুর লেন ছাড়িয়ে বাইক চলে এলো বড় রাস্তায়। ঝিলমিল আবারও প্রশ্ন করলো,

“কোথায় যাচ্ছি আমরা?”

“কোথাও না। ”

“মানে কী?”

“আমাদের তো সেভাবে আয়োজন করে প্রেম করা হয় নি, তাই আজ প্রেম করব আয়োজন করে। বৃষ্টিতে ভিজব, পলাশীর মোড়ে চা, শিঙ্গাড়া খাব। ”

ঝিলমিল হাসলো। বৃষ্টি শুরু হচ্ছে, সেই সঙ্গে ঝোড়ো বাতাস। ঝিলমিল চোখ বন্ধ করে ফেলল। আয়োজন বিহীন প্রেম তো ওদের জীবনে আছে। সেটাও কী কম সুন্দর!

ভিজতে ভিজতেই ঝিলমিলের মনে পড়ে গেল যে গোলাপের পাপড়িগুলো ও বিছানায় ছড়িয়ে রেখে এসেছে। মা যদি দেখে ফেলে! ইশ কী লজ্জা!

……সমাপ্ত….