কৃষ্ণচূড়ার এক সন্ধ্যা পর্ব-২০+২১

0
436

#কৃষ্ণচূড়ার_এক_সন্ধ্যা – [২০]
লাবিবা ওয়াহিদ

——————————-
–“আচ্ছা, রায়ার এরকম অস্বাভাবিক আচরণের কারণ কী?”

রায়িন কফিতে চুমুক দিতে দিতে নিথির পানে কোণা দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। নিথি তখক্ন উৎসুক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছে রায়িনের দিকে। রায়িন চোখের সামনে থেকে ফাইলটা সরিয়ে কফিটা কোলে রাখলো। কফির মগটা মৃদু উষ্ণতা ছড়াচ্ছে। রায়িন কফিটার দিকে তাকিয়ে নরম স্বরে শুধায়,
–“তুমি বানিয়েছো?”

নিথি কাচুমাচু ভঙ্গিতে আওড়ায়, “হু!”
রায়িন নিরব থাকলো। নিথি তার কৌতুহল দমাতে না পেরে পুণরায় বললো,
–“বলুন না স্যার!”
সূক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো রায়িন। বেশ সময় নিয়ে বললো,
–“রায়ার মানসিক প্রব্লেমটা হয়েছে ক্লাস টেনে থাকতে। ওকে একটা ছেলে রোজ ডিস্টার্ব করতো, আজেবাজে কথা বলতো। রায়া আবার ছিলো ভীতু স্বভাবের। তাই সবসময়ই ছেলেটাকে এড়িয়ে চলতো এবং ভয়ে ভয়ে থাকত। একদিন ছেলেটা সুযোগের অসৎ ব্যবহার করলো। রায়াকে টেনে-হিঁচড়ে…”

চোখ বুজে এলো রায়িনের। গলা ধরে আসছে তার। চাপা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার আওড়ায়,
–“এক নিরব গলির মাঝে আমার বোনকে রে’প করতে চেয়েছিলো। কিন্তু সৌভাগ্যবশত সময়মতো আমি চলে গেছিলাম। আরেকটু দেরী করে ফেললে হয়তো আমি আমার প্রাণপ্রিয় বোনটাকে হারিয়ে ফেলতাম। কিন্তু সেদিন আল্লাহ’র রহমত ছিলো৷ পরবর্তীতে ওই রা’বিশকে শাস্তি দেয়া হয় কিন্তু রায়া সেদিনের যন্ত্রণা ভুলতে পারেনি। তাকে প্রতিনিয়ত সেই দিনটা কুড়ে কুড়ে খেত, একটা মেয়ের জন্যে ওটা খুবই বাজে সিচুয়েশন। ডিপ্রেশনে থাকতে থাকতে মানসিক রোগীতে পরিণত হয়। তোমার সাথে ঘটে যাওয়া সময়টাতেও আমার বোনের কথা মনে পরেছিলো। সিচুয়েশনটা তুমি সামলে উঠতে পারলেও আমার বোনটা পারেনি। ও ছিলো তখন টিনএজ! ওর জন্য সহজ ছিলো না। এছাটা ম্যাচিউরিটিও তার মধ্যে তখন আসেনি।”

নিথি নিরবে সবটা শুনে নিলো। চোখে মুখে অধিক বিষ্ময়। মেয়েটার সাথে এতকিছু ঘটেছে? রায়িন আবারও বললো,
–“রায়া অচেনা কারো সাথে মিশে না, অচেনা দেখলেই ভয় পায়! সেখানে তোমার সাথে এতটা মিশেছে আমার ভাবনার বাইরে। তুমি কী ম্যাজিক জানো নিথি? ইউ নো হোয়াট, তোমার সঙ্গ পাওয়ার পর থেকে আমার বোনটা স্বাভাবিক হয়ে উঠছে?”

নিথি চমকে রায়িনের দিকে তাকালো। তার জন্যে মানে? নিথি আটকে গলায় বলে,
–“আমার জন্যে?”
–“হুম। রায়ার সাথে এভাবে বন্ধুসুলভ ভাবে কেউ মিশতে পারেনি। এছাড়া তুমি অচেনা হয়েও তোমায় সেদিন রায়া ভয় পায়নি। এরপরের ঘটনা গুলোও ছিলো অপ্রত্যাশিত!”

নিথি চুপসে যায়। মনগহ্বরে কোথাও এক জায়গায় শান্তির ঘন্টা বাজছে। নিজের জন্যে একজন মানুষ যদি স্বাভাবিক জীবন ফিরে পায়, তাহলে এর চেয়ে প্রাপ্তির আর কী থাকতে পারে?
রায়িন কফিটা শেষ করে শূন্য মগটি নিথির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
–“আরেক কাপ কফি হবে?”

নিথি লাজুক হাসলো। দৃষ্টি নত করে মগটা হাতে নিয়ে বলে,
–“আনছি!”

নিথি চলে গেলো। রায়িন নিথির যাওয়ার পানে তাকিয়ে ফিচেল হাসলো। মেয়েটা অনেক সরল মনের। রায়িন ভেবে পায় না, এতটা সহজ-সরল কেন এই মেয়ে? কই, আগে তো এতটা সরল ছিলো না। তখন তো মনে হতো নিথি চঞ্চল প্রকৃতির! বিয়ের পর বুঝি মেয়েরা এভাবে বদলে যায়? এছাড়া নিথি তো রায়িনকে ভালোবাসে। রায়িন ভাবনায় বুদ হলেও বাস্তবে ফিরে এসে নিজের কাজে ধ্যান দেয়। নিথি আরেক মগ কফি আনতেই রায়িন কাজ করতে করতে বললো,
–“কাল থেকে ভার্সিটি যাচ্ছো তুমি। আমি দিয়ে আসবো আর ড্রাইভার চাচা নিয়ে আসবে। আমি চাই না বিয়ের কারণে তোমার লেখাপড়ায় কোনোরকম ইফেক্ট পরুক!”

—————————-
নিথি এবং রায়িনের দিনগুলো বেশ ভালো যাচ্ছে। নিথি এখন রেগুলার ভার্সিটি যেতে শুরু করেছে। রোজ রায়িন তাকে দিয়ে আসে আর আসার সময় বাড়ির ড্রাইভার তাকে নিয়ে আসে। মাঝেমধ্যে রায়িন-ই যায় নিথিকে নিতে। রায়িন যখন তাকে চমকে দেয় তখন নিথির বক্ষঃস্থলে খুশির জোয়ার ওঠে। সে যথেষ্ট চেষ্টা করছে, রায়িনকে তার সাথে সহজ করতে। রায়িন তাকে ভালো না বাসুক, রায়িন তো তারই স্বামী। আজ হোক বা কাল, একদিন ঠিকই রায়িনের মনে ভালোবাসা জাগবে। সেটা নিথি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে। এতগুলা দিন যেহেতু রায়িনের জন্যে অপেক্ষা করেছে আরও কিছুটা দিন নাহয় অপেক্ষা করলো। অপেক্ষায় ক্ষতি কী? একদিন হয়তো দেখা গেলো এই অপেক্ষা তাকে সুফল দিলো। অপেক্ষার শেষেই আসবে প্রাপ্তি!

–“কী রে নিথু, আজ বেশি খুশি খুশি লাগছে তোকে?”
নিথি থতমত খেয়ে নয়নার দিকে তাকালো। নয়নার অধরে দুষ্টু হাসি। নিথি লাজুক বনে নয়নার পিঠে এক চা’পড় মারলো। মিনমিন করে বললো,
–“অ’সভ্য! প্রতিদিন এভাবে নানান কথা বলে জ্বা’লাস কেন?”
–“কী বলবো বল! যবে থেকে বিয়ে হয়ে ভার্সিটিতে আসা শুরু করেছিস তবে থেকে তোর মুখে হাসি লেগেই থাকে। সাথে ননস্টপ ভাবনা তো আছেই। না জানি রায়িন ভাইকে নিয়ে কত আকাশ পাতাল ভাবিস!”
–“আমি ভাবলে তোর কী? আমি সারাদিন, সারারাত ভেবে যাবো!”
–“হায়রে আমার রোমান্টিক বান্ধুবীরে! তা ভাইয়া এতদিনে কয়টা পা*** দিলো?”

এবার নিথির ধৈর্য ধরে নয়নার সামনে বসে থাকা হলো না। মেয়েটার মুখ পুরোই লাগামহীন! সরাসরি এমন এমন প্রশ্ন করে বসে যে নিথি নিজেই গুটিয়ে যায় লজ্জায়। নিথি যেতে নিলে নয়না শরীর কাঁপিয়ে হেসে নিথিকে টান দিয়ে চেয়ারে বসালো!
–“আরে কই যাস!? আমি তো মজা করছিলাম। আমি তো চাই তুই সারাজীবন এমন হাসি-খুশি থাক। তোর রায়িন স্যারকে পাইছিস তুই! কতটা লাকি তুই, ভাবতে পারছিস?”

কথাগুলো বলতে বলতেই নয়না নিথিকে পাশ দিয়ে জড়িয়ে ধরলো। নিথি নিজেও ভাবছে, সত্যি-ই তো! কতকিছু-ই না করেছে একমাত্র রায়িনের জন্যে। সব পাগলামি, আবেগ ঢেলেছে রায়িনের পায়ের কাছে। কত ডেকেছে উপরওয়ালাকে, একমাত্র রায়িনকে পাওয়ার জন্যে। রায়িনকে স্বামী হিসেবে পাওয়াটা এতটাও সহজ ছিলো না। তার কাছে প্রতিটা মাস বছরের ন্যায় লেগেছিলো।

আজ রায়িন আসবে তাকে পিক করতে। নিথি খুশিতে কী করবে জানা নেই। নয়নাও মুচকি মুচকি হাসছে বান্ধুবীর চঞ্চলতায়। নিথির দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে নয়না আপনমনে বলে ওঠে,
–“খুব ভালো থাক তুই নিথি!”

——————————-
–“একটা কথা বলবো?” বেশ ইতস্তত নিয়ে বললো নিথি। রায়িন ড্রাইভিং এ মনোযোগ দিয়ে বললো,
–“হুম!”
–“ফুচকা খেতে ইচ্ছে হচ্ছে!”

রায়িন কোণা চোখে তাকিয়ে পুণরায় ড্রাইভিং এ মনোযোগ দিলো। এদিকে নিথি অস্বস্তিতে জমে দই হয়ে যাচ্ছে। আবদারটাকে কী রায়িন খারাপ ভাবে নিবে? নিথি পিটপিট করে সামনে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। কয়েকটা ফুচকার স্টল পেছনে ছুটছে। মন খারাপ হয়ে গেলো নিথির৷ দৃষ্টি নত করে চুপচাপ হাতের ফোনের দিকে তাকিয়ে রইলো। মিনিট পাঁচেক পরে হঠাৎ গাড়ি থেমে যায়। নিথি মাথা তুলে তাকায়। এত দ্রুত বাড়ি চলে আসার তো কথা না। আশেপাশে তাকিয়ে দেখে এখনো রাস্তাতে। পাশ ফিরে রায়িনের দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো রায়িন সিটবেল্ট খুলছে। রায়িন সিটবেল্ট খুলে বলে,
–“নামো!”

নিথি হতবুদ্ধি হারিয়ে নেমে পরলো। যেন সে রায়িনের বাধ্য বউ! নামতেই পাশে দেখলো ফুচকার স্টল। ভীড়-ভাট্টা নেই এখানে। নিথি অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়।
–“এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে? খাবে না!”

নিথি চমকে রায়িনের দিকে তাকালো। এর মানে রায়িন তাকে ফুচকা খাওয়াবে। মন নেচে উঠলো নিথির।

———-
রাতে রায়িন ল্যাপটপ চাপছিলো। নিথি তার মুখোমুখি বসে পড়ছে। নিথি থেমে থেমে রায়িনের দিকে তাকাচ্ছে। এর মাঝে খাবারের ডাক পরলো। নিথি কিছু না ভেবে এক অপ্রত্যাশিত কান্ড ঘটিয়ে ফেললো। নিজের লাজ-লজ্জা ভুলে রায়িনের গালে চুমু দিয়ে বলে,
–“আপনি জানেন খুব ভালো। আপনি আমাকে ফুচকা খাইয়েছেন, আমার কত কেয়ার করেন। ভালোবাসি আপনাকে স্যার!”

বলেই এক মুহূর্তও সেখানে না দাঁড়িয়ে এক ছুটে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। বুকের ওঠা-নামার শব্দ খুব তীব্র। বুক ধরেই দৌড় দিয়েছে নিথি। নিঃশ্বাসও যেন গলায় দলা পাকিয়ে আছে। একবুক সাহস নিয়ে এসব বলেছে সে। এছাড়া রায়িনকে লাইনে আনার কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছিলো না। এদিকে রায়িন রোবটের মতো বসে আছে। গালে তার হাত আলতো স্পর্শ করে আছে। সবটা কেমন মাথার উপর দিয়ে গেলো তার। কী হলো ব্যাপারটা?

~চলবে, ইনশাল্লাহ।
ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন।

#কৃষ্ণচূড়ার_এক_সন্ধ্যা – [২১]
লাবিবা ওয়াহিদ

—————————–
ঘুটঘুটে অন্ধকার রাত। ইলেট্রিসিটি নেই। জড়ো হাওয়া। শোঁ শোঁ শব্দে সেই হাওয়া ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। সামনে ফাঁকা বাগান। রাস্তার ল্যাম্পপোস্ট জ্বলছে তো নিভছে৷ আকাশে কুঞ্জ কুঞ্জ মেঘ জমেছে৷ ঘুটঘুটে কালো মেঘ৷ মাঝেমধ্যে মেঘেদের ফাঁক দিয়ে তীরের ন্যায় ঝলকানি দিচ্ছে। বিজলিপাতের শুভ্র তীক্ষ্ম আলো। বাতাসের তীব্রতাও বাড়ছে ভিষণ। আবারও বিজলিপাত হলো, অদূরে গর্জন দিয়ে উঠলো মেঘ। রায়িন সঙ্গে সঙ্গে চোখ বুজে ফেললো। এই তীক্ষ্ণ কিরণ নজরে নেয়া সম্ভব না। রায়িন বেলকনি থেকে ফিরে রুমে প্রবেশ করলো। নিথির এখনো পাত্তা নেই। আসেনি রুমে। এমনিতেই তো এত বড়ো কান্ড ঘটালো এখন নিজেই নিখোঁজ হয়ে গেলো? আশ্চর্য! টেবিল হাতড়ে ফোন খুঁজতে লাগলো রায়িন। সচরাচর ইলিক্ট্রিসিটি এদিকে যায় না। আজ কী হলো কে জানে! সেদিনও তো কামাল চাচা ইলেকট্রিসিটির বিল পে করে আসলো। আশেপাশের বাড়িগুলোতেও রায়িন আলো জ্বলতে দেখেনি। ল্যাম্পপোস্ট গুলোতেও ভোল্টেজ কম। এখন তো সেগুলাও নিভে গেছে। রায়িন ফোন হাতে নিয়ে যেই ফ্ল্যাশলাইট জ্বালালো ওমনি এক চিৎকারের শব্দ শুনতে পেলো সে!

রায়িন চমকে দরজার দিকে তাকালো। ফোনের স্ক্রিনে বারোটা বেজে দশ। বাবা-মা নিশ্চয়ই ঘুমাতে চলে গেছেন। রায়াও তো এতক্ষণে ঘুম। আচ্ছা, নিথির কিছু হলো না তো? গলাটা শুকিয়ে আসলো রায়িনের। দ্রুত ফোনে হাতে ছুট দেয় রায়িন। সিঁড়ির সামনে আসতেই দেখলো একদম প্রথম সিঁড়িতে একটা অবয়ব সিঁড়ির রেলিং ঘেঁষে বসে। টুকটাক আর্তনাদও শ্রবণ হচ্ছে। রায়িন দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলো। বুঝতে দ্বিধা নেই, ওটা নিথি। সিঁড়ি বেয়ে নামার ঘুটঘুট শব্দ শুনে নিথির হৃদয় শুকিয়ে খরায় পরিণত হলো। কম্পিত ভঙ্গিতে ঘাড় কাত করে উপরের দিকে তাকালো। একটি ক্ষুদ্র আলো তার দিকে এগিয়ে আসছে। নিথি আতঙ্কে ঢোঁক গিললো। মিনমিন করে দোয়া পড়তে লাগলো। চারিপাশ যেই পরিমাণে অন্ধকার, ভয়ে দম আটকে যাবার মতোন। এবার যেন ভয়ে হুঁশ হারিয়ে ফেলবে সে। এত বড়ো বাড়ির কী প্রয়োজন? থাকেই কয়েকজন মানুষ, এছাড়া এই বাড়ি পুরোই ভুতুড়ে, পরিত্যক্ত। নিথির মনে হচ্ছে এই সৌখিন বাড়ির চাইতে ছোট কুড়েঘর-ই ভালো, ভীষণ ভালো। অন্তত ভূতের ভয় তো আর থাকবে না৷

রায়িনের ব্যস্ত কন্ঠস্বর নিথির গভীর ভাবনায় ফোড়ন কাটে। নিথি সম্বিৎ ফিরে পেয়ে পুণরায় মাথা তুলে তাকালো। ওইতো, রায়িনের অস্পষ্ট চেহারা দেখা যাচ্ছে। স্বস্তি পেলো নিথি। পরবর্তীতে খেয়ালে এলো দু’ঘন্টা আগের ঘটনা। জ্বলে উঠলো যেন নিথির সর্বাঙ্গ। হাত-পা নিমিষেই অবশ হতে লাগলো। কী এক লজ্জাজনক ঘটনা ঘটিয়েছিলো সে, একজন মেয়ে হয়ে? ভাবতেই নিথির ইচ্ছে করছে মাটি ফাঁক করে দুই ফুট নিচে গিয়ে পলাতে। কী দরকার ছিলো ওরকম উদ্ভট ঘটনা ঘটিয়ে পুণরায় রায়িনকে প্রপোজ করার? নিথি নিজের প্রতি যেমন বিরক্ত তেমনই তার কর্মে লজ্জিত। ফলাফলস্বরূপ এখন রায়িনের সামনে দাঁড়াতে পারবে না। কীভাবে এই বেহায়া মুখ রায়িনকে দেখাবে সে? জানা নেই নিথির। এজন্যই কবি বলে,
“ভাবিয়া করিও কাজ,
করিয়া ভাবিও না!”

লজ্জায় লাল হয়ে নিথি সেখানেই মূর্তির ন্যায় বসে রইলো। পায়ের মচকানিটার কথা মাথা থেকেই বেরিয়ে গেছে যেমন। রায়িন নিথির সামনে এসে বসতেই নিথি পলকের মাঝে মুখে ওড়না পেঁচিয়ে নেয়। হতভম্ব রায়িন বোকাসুলভ চাহনি দিয়ে রয় নিথির পানে। নিথি লজ্জায় দৃষ্টি তুলে রায়িনের দিকে তাকাতে পারছে না।
–“কী হলো? নতুন বউয়ের মতো এভাবে মুখ ঢাকলে কেন? গলায় প্যাঁচ দিয়ে তো ম’রে যাবা!”
–“বিয়ের এক মাস চলছে। এখনো পুরানো হইনি আমি হু্হ!” কথাটি অভ্যন্তরেই আওড়ালো নিথি, সম্মুখে বলার মতো সাহস আপাতত নেই।
–“কী হলো? জবান হারিয়েছো?”

নিথির জবাব এবারও এলো না। সে পায়ে হাত বুলাতে বুলাতে সেভাবেই বসে রয়। বিষয়টি রায়িনের খেয়ালে আসতেই ফ্ল্যাশ সেদিকে দিলো, চমকেও উঠলো বেশ। পায়ের গোরালি কেমন ফুলে লালচে বর্ণ ধারণ করেছে! রায়িন চট করে নিথির হাতে ফোনটি দিয়ে নিজে নিথির পা ছুঁলো। রায়িনের স্পর্শে নিথির সর্বাঙ্গ শিথিল হলো। হার্টবিটের তীব্রতা বাড়ছে অবিরাম। নিথি পিটপিট করে তাকালো রায়িনের পানে। নিঃশ্বাস তার ঘন। রায়িন তখন নিথির পা দেখতে ব্যস্ত। গোরালিতে হালকা চাপ পরতেই নিথি চোখ-মুখ কুচকে কুঁকড়ে ওঠে ব্যথায়। অসম্ভব ব্যথা।
–“এত কেয়ারলেস কেন তুমি? দেখে চলতে পারো না?”

নিথি মৃদু কম্পিত স্বরে বলে,
–“চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। সো..সোফা থেকে কোনরকমে হাঁতড়ে হাঁতড়ে এই অবধি এসেছি। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে নিতেই পা পিছলে পরার পূর্বেই পা মচকে যায়। আমার দোষ?”
–“দোষ তো তোমার-ই! কী করছে সোফায় বসে বসে? অন্ধকারে খুব ভাল্লাগছিলো? টিভিতে সিনেমা চলছিলো বুঝি?”

রায়িনের গম্ভীরমুখো কথাবার্তা শুনে নিথির মুখ ঘুচে এলো। এই মানুষটা যেমন রাগী তেমনই গম্ভীর! এখন কেমনে ভালো হবে, কেমনে হেঁটে রুম অবধি যাবে তা না ব্যবস্থা করে তিনি ভাষণ দিচ্ছেন। ফ্রী ভাষণ নিথির মোটেও পছন্দ নয়। তাও রায়িন বলে সহ্য করে যাচ্ছে। যা অকাজ ঘটিয়েছে তাতে রুমে যাওয়ার সাহস হয়নি নিথির। সোফায় বসে কিছুক্ষণের জন্যে চোখ লেগে এসেছিলো তার। ঘুম ভাঙতেই দেখে সবকিছু অন্ধকার, কারো কোনো সাড়াশব্দ নেই। ভয়ে সেখানে বসে থাকার মতো সাধ্যি নিথির ছিলো না। তাইতো বসে না থেকে উপরে আসতে চেয়েছিলো সে। এক রুমে থেকে রায়িনের থেকে দূরে থাকলেও অন্তত এই একা থাকার ভয়টা আসতো না। নিথি মুখ বাঁকিয়ে বসে রইলো। নিথির ভাবনার মাঝে-ই রায়িন উল্টোদিকে পা মচকিয়ে দিলো। নিথি দিক-নির্দেশনা ব্যতীত জোরে আর্তনাদ করে ওঠে। ব্যথায় শিড়শিড় করছে পা। চোখের কোণও ভিঁজেছে। রায়িন নিথির দিকে তাকিয়ে বলে,
–“হাঁটতে পারবে?”

নেতিবাচক মাথা নাড়ায় নিথি। ব্যথার ভিষণ কান্না পাচ্ছে নিথির। গলায় কান্না’রা দলা পাকিয়ে আছে তার। কথা বলতে গেলেই যেন ঝড়ঝড় করে সব চোখ বেয়ে গড়াবে। রায়িন হঠাৎ বিনা-বাক্যে নিথিকে কোলে তুলে নিলো। নিথি কিছুটা নয়, অনেকটা চমকে অস্ফুট স্বরে মৃদু চিৎকার দিলো। রায়িনের কপালে বিরক্তির ভাঁজ পরলো!
–“চুপ করবা? কথায় কথায় এত চিল্লাও কেন? স্টু’পিড একটা!”

নিথি চোখে বিষ্ময় নিয়ে রায়িনের দিকে তাকিয়ে রয়। রায়িন তাকে কোলে নিলো? স্বপ্ন দেখছে? নাকি সত্যি? বাস্তবে আদৌ রায়িনে কোলে ওঠার ভাগ্য ছিলো? অদ্ভুতভাবে অশ্রু’রা এখন পালিয়েছে। নিথি মনে মনে শুধায়,
–“নাহ! আজই “নিরামিষ” ট্যাগলাইন ক্যান্সেল করতে হবে!”

————————-
–“কিররে মাম্মা! বিয়া করে আমাদের ভুলে গেলি?”
–“আরে ভুলবে না? সুন্দরী বউ পাইসে আর কী লাগে?”

রাব্বির দিকে কিড়মিড় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রায়িন। রায়িনের মুখ-ভঙ্গি দেখেই বুঝে গেলো বেচারা সিরিয়াস মুডে আছে! তিন বন্ধু নিজেদের দিকে চাওয়া-চাওয়ি করলো। পরিস্থিতি অনুকূল আনতে রাব্বির গলা খাঁকারি দিলো। অতঃপর বললো,
–“কী হয়েছে? এমন লাগছে কেন তোকে?”

রায়িন তখনো শক্ত হয়ে বসে রয়। চোখ-মুখে একরাশ গাম্ভীর্য বিরাজ করছে। রাব্বি পুণরায় একই প্রশ্ন করলো! রায়িন এবার কাঠ কাঠ গলায় বলে,
–“ওই জা/ নো/য়ারের কথা আমার মাথা থেকেই বেরিয়ে গেছিলো। কেমনে ভুললাম ওই রা’বিশটার কথা? শিট! শিট! শিট!”

মাথা নিচু করে সামনের একগুচ্ছ চুল মুঠোতে আবদ্ধ করলো রায়িন। রাব্বি সানজিদের দিকে তাকাতেই সানজিদ রায়িনের পাশে বসে পিঠে আলতো চাপড়ে বললো,
–“কুল! রিলেক্স! কী হয়েছে সেটা বল!”

মাথা তুলে সোজা হয়ে বসে রায়িন। চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে বলে,
–“যার জন্যে আমি এই পরিস্থিতির স্বীকার হয়েছি, তার কথা বলছি আমি। নিথির মাকে ওই শা** হুমকি দিছে, তার বাড়ি তছনছ করে দিবে সাথে নিথিকেও ভার্সিটি থেকে..!”
রায়িন নিজের ক্রোধ চাপতে চোখ শক্ত করে বুজে ফেলে। রাব্বি নড়েচড়ে বসলো। অতঃপর ভ্রু কুচকে কিছু বলতে নিতেই রায়িন পুণরায় বললো,
–“একমাত্র পাপার জন্যে আমি কোনরকম কেস করতে পারছি না। কারণ, কেস করলেই পাপার কানে সব চলে যাবে। পাপা যদি এসব জানে আমার লাইফ হেল করে দিবে। মেয়েটার জীবনও পুরো ন’র’ক বানিয়ে ছাড়বে। আমি চাই না পাপার কানে কোনো খবর যাক!”

রাব্বি মন দিয়ে কিছু একটা ভাবলো। তারপর কী মনে করে আপনমনে শুধায়,
–“তুই কিছু করলেই প্রব্লেম হবে, আমরা করলে তো না?”

রায়িন চোখ তুলে রাব্বির দিকে তাকালো। ভ্রু কুচকে বললো,
–“মানে?”
রাব্বি হাসলো। রহস্যময় হাসি। নিজের কলার ঠিক করতে করতে বলে,
–“যা ব্যবস্থা নেয়ার আমরা নিবো। তুই এতদিনে ভাবীকে নিয়ে হানিমুনে চলে যা। খামাখা ঝামেলায় থেকে ভাবীর মন নষ্ট হবে! আর হ্যাঁ, হানিমুন প্যাকেজ আমাদের পক্ষ থেকে তোর জন্যে গিফট! যা, যা! এঞ্জয় ইওরসেল্ফ ব্রো!”

~চলবে, ইনশাল্লাহ।
ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।