#কৃষ্ণচূড়ার_এক_সন্ধ্যা – [২২+২৩]
লাবিবা ওয়াহিদ
———————
নিথি রায়িনের হাত ধরে বাসে উঠলো। রাত প্রায় সাড়ে ন’টা বাজে। বান্দরবানের উদ্দেশ্যে বাস ছাড়বে দশটায়। রায়িন এক হাতে নিথিকে এবং অন্য হাতে লাগেজ আঁকড়ে ধরে আছে। রায়িন নিথিকে নিয়ে মাঝামাঝিতে গিয়ে বসলো। নিথি এসি বাস সহ্য করতে পারে না বিধায় নান এসি বাসের টিকিট কেটেছে। বর্তমানে নিথির চোখ-মুখে ভর করছে আকাশচুম্বী আগ্রহ, আনন্দ। সে এই প্রথম ঢাকার বাইরে যাচ্ছে৷ ভিষণ এক্সাইটমেন্ট কাজ করছে তার। রায়িন আড়চোখে শুধু নিথিকে লক্ষ্য করছে। নিথিকে খুশি দেখে সে কিছুটা স্বস্তি পেলো। আসলেই, রাব্বির বুদ্ধি আছে ভালো! এই সময়ে একটা ট্যুর দেয়াটা সত্যি দরকার ছিলো। তবে “হানিমুন” শব্দটা বারংবার রায়িনের মাথাতে বাজ ফেলছে। পরমুহূর্তে নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দেয়, হানিমুনে বেশিরভাগ মানুষ ঘুরাঘুরি করেই সময় কাটায়। ওদের হানিমুন স্পট “নীলাচল!” ঠিক রাত দশটায় গাড়ি ছাড়লো। রোডে আসতেই বাসের জানালা দিয়ে হুড়মুড় করে হিমেল হাওয়া প্রবেশ করছে। নিথি হিম হাওয়া এতটাই উপভোগ করছে যে তার অবাধ্য উম্মুক্ত চুল অসমান্তরাল ভাবে উড়ছে। মাথায় আবৃত ওড়নাটা সেই কখন পরে কাঁধ ছুঁয়েছে।
নিথির চুলের নাম না জানা শ্যাম্পুর ঘ্রাণ তীরের ন্যায় রায়িনের নাকে এসে লাগছে। রায়িন যেন মাতাল হয়ে পরবে। সে মাথা ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকালো। তাও নিথির অবাধ্য চুল তাকে শান্তিতে বসতে দিলো না। বাসের লাইটগুলো বন্ধ। বাস লোকালয় ছেড়ে মুন্সিগঞ্জে প্রবেশ করেছে। মুন্সিগঞ্জের পরপরই কুমিল্লায় প্রবেশ করবে। দু’পাশে ঘন গাছপালা, আবার ফাঁকা মাঠ, মাঠের পাশে দু’চারটা গাছ। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় আবছা গাছের অবয়ব দৃশ্যমান। বাসে অনেকে ঘুমন্ত, আবার এক বাচ্চার কান্নার স্বর শোনা যাচ্ছে। বাচ্চার মায়ের বাচ্চাকে শান্ত করার নানান কথাবার্তাও শ্রবণ হচ্ছে। রায়িন একসময় বিরক্ত হয়ে নিথির দিকে তাকিয়ে বলে,
–“চুল বেঁধে রাখো! আমার প্রব্লেম হচ্ছে!”
নিথি চমকে রায়িনের দিকে তাকায়। দ্রুত ভঙ্গিতে চুল খোপা করে মাথায় ওড়না টেনে জড়ালো। আবছা আলোয় নিথির খোপা করার দৃশ্যটা রায়িন নিজের অজান্তেই নজরবন্দি করে ফেললো। ঘোর লাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়। নিথি মুখ ঘুচে বাহিরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রাখলো। মনটা তার বেজার হয়ে গেছে গম্ভীরমুখোর কথায়। আসলেই রায়িনের মনে কোনো ফিলিংস নেই, আর না কোনোদিন আসবে! নিথি সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়, আর কোনদিন রায়িনকে বিরক্ত করবে না। যথাসম্ভব দূরত্ব বজায় রাখবে। ভাবনা অনুযায়ী নিথি রায়িনের থেকে জানালার দিকে কিছুটা চেপে বসলো। মন ভেঙ্গেছে তার। রায়িন অবশ্য বিষয়টি লক্ষ্য করলো। নিথি মুখ ভার করে মিনমিন করে শুধালো,
–“পুরোই নিরামিষ! এর থেকে ভালোবাসা আশা করা বিলাসিতা ব্যতীত কিছুই নয়। গম্ভীরমুখো!”
কর্ণধারে নিথির বাণীটি বেশ ভালোভাবে প্রবেশ করে রায়িনের। রায়িনকে চটতে দেখা গেলো। তারও তো সেল্ফ রেসপেক্ট আছে। যেখানে-সেখানে নিরামিষ বলে অপমান করার মানে কী? রায়িন অসম্ভব রাগ নিয়ে নিথির মাথায় জড়ানো ওড়না কাঁধে ফেলে চুলের ক্লিপ খুলে ফেললো। এতে নিথি একটু নয় বরং অনেকটা চমকে গেলো। হতবুদ্ধিও যেন হারালো রায়িনের এরূপ কর্মে। তার চেয়েও বড়ো ঘটনা ঘটালো রায়িন। নিথির কোমড় জড়িয়ে তার দিকে এক টান দিলো। নিথি সোজা রায়িনের মুখোমুখি। আবছা আলোয় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে রায়িনে রাগাম্বিত মুখশ্রী। বুকের ধুকধুকানি নিথি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। হাঁটুজোড়াও অসম্ভব কাঁপছে। কম্পিত হাত স্পর্শ করলো রায়িনের কোমড় জড়ানো হাতটিতে। নিথি থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে আওড়ায়,
–“ক..কী করছেন?”
–“কথায় কথায় নিরামিষ বলে আখ্যায়িত করো! আমিষ হলে সহ্য করতে পারবে? এইটুকুতেই তো কেঁপে টেঁপে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছো! ফারদার যদি মুখে ওই শব্দটা শুনি!” কিড়মিড় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কাঠকাঠ গলায় রায়িন বললো।
নিথি নিঃশ্বাস ফেলতে পারছে না। রায়িনের উষ্ণ নিঃশ্বাস নিথির মুখশ্রীতে গিয়ে পরছে, যা ভিষণ অস্বস্তিকর। নিথি পুণরায় কম্পিত গলায় বললো,
–“আ..আর বলবো না, ছা..ড়ুন! প্লিজ!”
–“সারা রাত এভাবেই থাকবে তুমি।”
বলেই রায়িন মাথা সোজা করে সিটে মাথা এলিয়ে দিলো। চোখ বুঝলো আরামে। এদিকে নিথি পরলো চিপাতে। না পারছে সরতে, না পারছে সহ্য করতে। এ কোন ঝামেলা? অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রইলো রায়িনের পানে। নিথি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো, মরে গেলেও রায়িনের সামনে ওই ভয়ানক শব্দটি উচ্চারণ করবে না। ভুল করেও না। কস্মিনকালেও না। সারাটা রাত রায়িনের বাহুডোরেই নিথির কাটলো।
রায়িনের ডাকে ঘুম ভাঙতেই নিজেকে রায়িনের কাঁধে একদম গলায় কাছে আবিষ্কার করলো। পিটপিট করে তাকিয়ে নিথি বোঝার চেষ্টা করছে সে কোথায় আছে৷ রায়িনের গলা সে চিনতে পারলো। ফর্সা গলার সামনে শার্টের দু’টো বোতাম খোলা। নিথি নির্নিমেষ চেয়েই রইলো। রায়িনের কথাগুলো তার কান অবধি পৌঁছাচ্ছে না। নিথি একনজরে রায়িনের গলার ঢোঁক গেলা, গলার ওঠা-নামা ভঙ্গি লক্ষ্য করছে৷ প্রথম থেকেই রায়িনের এই গলা নিথির খুব পছন্দ। একসময় রায়িন নিথিকে ঝাকুনি দিতেই নিথির সম্বিৎ ফিরে। তড়িৎ মাথা ওঠাতেই দেখলো যাত্রীরা বাস থেকে নামতে নামতে ওদের দেখছে এবং মুখ টিপে টিপে হাসছে। নিথি চোখ বড়ো বড়ো করে একবাত রায়িন তো একবার যাত্রীদের দিকে তাকাচ্ছে। রায়িনের মুখ-ভঙ্গি অসম্ভব গম্ভীর। পরমুহূর্তে যাত্রীদের মুচকি হাসি লক্ষ্য করতেই নিথির মনে হচ্ছে লজ্জায় গালদু’টো ঝলসে যাবে। আল্লাহ জানে কী অবস্থায় ওনারা নিথি এবং রায়িনকে দেখেছে।
–“তুমি বরং এক কাজ করো। এখানে বসে লাজ-লজ্জা খেলা খেলো, আমি বাস থেকে নেমে যাই!”
রায়িন উঠতেই নিথি রায়িনের হাত ধরে তড়িৎ উঠে দাঁড়ায়। বাসে ততক্ষণে ওরা ব্যতীত কেউ নেই।
–“এই কই যাচ্ছেন আমাকে ফেলে!”
–“তোমাকে ফেলে যাবো না তো কী করবো? কম তো জ্বালাও না আমাকে। এজন্যই বলে স্টুডেন্টদের বিয়ে করতে নেই, এরা মাথা খেয়ে পাবনা পাঠিয়ে ছাড়বে!”
কিহ! এত বড়ো অপমান! রাগে, অভিমানে নিথি কিছুক্ষণ ফুঁসে দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে বলে,
–“এখন দেরী আপনি করছেন, আমি নই! নামুন!”
রায়িন কোণা চোখে নিথিকে দেখে উপরের তাক থেকে লাগেজ নামালো। লাগেজ নামিয়ে বাস থেকে নামতেই বাস কন্ডাক্টরের দাঁত কেলানো হাসি নিথি লক্ষ্য করলো। আশ্চর্য! উনি এভাবে হাসছে কেন তাও ওদের দিকে তাকিয়ে? নিথির কৌতুহল দমাতে কন্ডাক্টর ওদের দিকে এগিয়ে এসে বলে,
–“আপামনি, বাসে একটু কম ঘুমাইয়েন। নইলে দেখা যাইবো ভাই আপনারে ফেলেই চলে যাবে!”
নিথি বেশ লজ্জিত, কন্ডাক্টরের কথাবার্তায়। একমুহূর্ত সেখানে না দাঁড়িয়ে রায়িনের হাত ধরে কিছুটা দূরে আসলো। এখন বান্দরবান শহরে অবস্থান করছে ওরা। এখান থেকে পাহাড়ে ওঠার বিশেষ ধরণের সিএনজি করে নিলাচলের উদ্দেশ্যে রওনা হবে। এখন ভোর সাড়ে ছয়টা বাজে। দূরে আসতেই নিথি রায়িনের হাত ছেড়ে দিলো। রায়িন এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে,
–“এখান থেকে নাস্তা করে যাওয়া ব্যাটার। পাহাড়ি রাস্তা, ওখানে খাবার পাবার আশঙ্কা কম!”
নিথি হ্যাঁ, না কিছুই বললো না। অভিমানের পাল্লা যে ভিষণ ভারী। যদিও জানে অভিকান ভাঙ্গানোর মানুষটা অভিমান ভাঙ্গাতে জানে না। কিন্তু কী করার? অভিমানটা বড্ড অবুঝ, সে সবকিছু জেনেও অবুঝ থাকতে পছন্দ করে। রায়িন নিথির সামনে চুটকি বাজিয়ে বললো,
–“ও হ্যালো ম্যাডাম! বাস্তবে আছেন? বাস্তবে থাকলে চলুন কিছু খেয়ে নেই। এখানে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকলে তো চলবে না!”
নিথি ছোট করে জবাব দেয়,
–“চলুন।”
হালকা নাস্তা করে। পাহাড়ে বা পাহাড়ের চূড়ায় নেটওয়ার্ক না থাকার সম্ভাবনা বেশি তাই রায়িন সেখানেই তার বাবা-মা এবং নিথির মায়ের সাথে যোগাযোগ করলো। নিথিও টুকটাক তার মায়ের সাথে কথা বলে নিলো। তার মা এখনো ঘাবড়ে আছে জামানকে নিয়ে। কথা বলা শেষে রায়িন নিথিকে নিয়ে চলে যায় স্থানীয় সিএনজি ধরতে। রায়িন এবং নিথিসহ আরও কিছু পর্যটক উঠলো সিএনজিতে। রায়িন চেয়েছিলো রিজার্ভ নিবে কিন্তু চালক’রা বেশ ভাড়া চায়। তাই নিথি একদম না করে দেয়। রায়িন নিথির জেদের সাথে পারেনি। বিকট ঘুটঘুট শব্দের সাথে সিএনজি চলতে লাগলো। ভোর হওয়ায় এদিকে কিছুটা কুয়াশা দেখা যাচ্ছে৷ রাস্তা ভেঁজা। নিশ্চয়ই এদিকে বৃষ্টি হয়েছে। মাটির স্যাঁতসেঁতে গন্ধ নিতে নিতে নিথি পাহাড়ি দৃশ্য উপভোগ করছে। পাহাড়ের রাস্তা দিয়েই সিএনজি চলছে। সিএনজির শব্দটা মাথা ধরানোর মতো হলেও আশেপাশের অপরূপ দৃশ্য দেখে সেসব ভুলে যেতে বাধ্য। নিথি সব ভুলে সৌন্দর্য উপভোগ করতে ব্যস্ত।
কিছুক্ষণ ধরে নিথি তার বামপাশে খোঁচা অনুভব করছে। নিথি বিরক্ত হলো, চরম বিরক্ত। রায়িন তো তার ডানপাশে। তাহলে বাম পাশ থেকে খোঁচা খাওয়ার মানে কী? নিথি একবার রায়িনের দিকে তাকালো। সাহেব কানে হেডফোন লাগিয়ে বাহিরের দৃশ্য দেখতে ব্যস্ত। নাহ, রায়িন এরকম করবে না। নিথি তৎক্ষণাৎ পাশে তাকায়। পাশে তাকাতেই নিথি ভিষণ চমকে যায়। চোখ বড়ো বড়ো করে সামনের আগন্তুকের দিকে তাকিয়ে বলে,
–“অর্ণব ভাইয়া তুমি?”
মাত্রই গানটা শেষ হয়ে আসে রায়িনের। নিথির মুখে অন্য ছেলের নাম শুনে এক টানে হেডফোন খুলে ঘাড় বাঁকিয়ে সেদিকে তাকায়। অমায়িক হাসি দিয়ে অর্ণব নিথির দিকে তাকিয়ে।
–“ফাইনালি তাহলে চিনতে পারলি? আমি তো ভাবলাম ভুলেই যাবি!”
–“কী যে বলো না ভাইয়া! কেমন আছো? এছাড়া তুমি এখানে?”
–“আমি তো প্রায় সময়ই এদিকে আসি ট্যুর দিতে। তা তুই কার সাথে এলি? একা নিশ্চয়ই আন্টি আসতে দিবে না?”
বলেই অর্ণব নিথির পাশে বসা রায়িনের দিকে তাকালো। রায়িন বর্তমানে অর্ণবের দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে। হয়তো বোঝার চেষ্টা করছে, ছেলেটি কে? নিথি অপ্রস্তুত হাসি দিয়ে বলে,
–“একচুয়ালি আমি আমার হাসবেন্ডের সাথে এসেছি। এইযে উনি।”
রায়িনের বাহু জড়িয়ে ধরে নিথি। রায়িন সরল চাহনি নিক্ষেপ করলো নিথির দিকে। নিথির কথায় অর্ণবকে ভিষণ চমকাতে দেখা গেলো। বিষ্ময়ে অস্ফুট স্বরে বললো,
–“কী বলছিস? কী কবে করলি?”
–“কেন নয়না তোমাকে কিছু বলেনি?”
–“বলবে কিভাবে? আমি-ই তো ওদের সাথে যোগাযোগ করি না অনেকদিন!”
–“ও আচ্ছা!”
এভাবে সারা রাস্তা কথোপকথন চললো। এদিকে রায়িনের বিরক্ত সীমা অতিক্রম করছে। এত কিসের কথা? রায়িন তো জানেও না এই ছেলে নিথির কী হয়! চরম বিরক্ত রায়িন। ওদিকে নিথির থামার নাম নেই। রায়িন কিড়মিড় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো নিথির দিকে। ইচ্ছে করছে ট্যাপ এনে মুখে লাগিয়ে দিতে। এত বাঁচাল এই মেয়েটা? একসময় অর্ণব রায়িনের মুখ-ভঙ্গি দেখে বললো,
–“আই থিংক ভাইয়ার কোনো প্রব্লেম হচ্ছে!”
নিথি ঘাড় বাঁকিয়ে রায়িনের দিকে তাকালো এবং ভিষণ চমকে উঠলো। ভড়কালোও বটে। এমন গি’লে খাওয়া চাহনি দিয়ে রেখেছে কেন? কী ভয়ংকর! নিথি ঢোঁক গিলে আস্তে করে বললো,
–“কিছু হয়েছে?”
রায়িন দাঁতে দাঁত চেপে মিনমিন করে বললো,
–“মুখ এত চলে কেন? চুপ থাকা যায় না?”
সিএনজির বিকট শব্দে রায়িনের কথাগুলো অর্ণবের কান অবধি পৌঁছায় না। নিথি পুণরায় চমকালো। রায়িনের মুখ-ভঙ্গি দেখে কিছু বোঝার চেষ্টা করলো অনেকক্ষণ। অবশেষে তার মনে এক সন্দেহ প্রকাশ পেলো। সন্দেহ ঠিক নাকি ভুল প্রমাণ করতে নিথি পুণরায় চঞ্চল হয়ে উঠলো। হাসি হাসি মুখ করে বললো,
–“কতদিন পর দেখা হয়েছে। চুপ থাকলে হয়?”
নিথির এমন বাঁকা উত্তরে রায়িন এক হাত শক্ত করে মুঠিবদ্ধ করে ফেললো। নজর সরিয়ে বাহিরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রায়িন। নিথি একগাল হেসে পুণরায় অর্ণবের সাথে কথাবার্তা বলায় ব্যস্ত হয়ে পরলো। একসময় রায়িন সহ্য করতে না পেরে নিথির উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
–“নিথি, বাইরে দেখো। কী সুন্দর দৃশ্য। আমার সিটে এসে বসো, তাহলে সুন্দর দেখতে পারবে!”
নিথি চমকে রায়িনের দিকে ফিরতেই রায়িন নিথিকে উঠিয়ে নিজের সিটে বসিয়ে নিজে নিথির সিটে গিয়ে বসলো। নিথি যেন বিষ্ময়ের শেষ সীমান্তে। সবটা এত দ্রুত ঘটেছে যে নিথি কী করবে, কী করতে হবে সেসব কিছুই ভুলে বসলো। বোকা চাহনি দিয়ে রাখলো রায়িনের পানে। পুরোটা রাস্তা নিথি রায়িনের সিটেই বসে রয়। রায়িন ভুল করেও নিথিকে নিজের সিটে ফিরতে দেয় না। তাই নিথি পুরোটা রাস্তা বাইরের দৃশ্য দেখে কাটিয়ে দিলো। এর মাঝে অর্ণব এবং রায়িনের মাঝে টুকটাক কথা হলো।
দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে অবশেষে পাহাড়ের চূড়ায় এসে পৌঁছায়। বড়ো একটি নেমপ্লেটে বড়ো বড়ো অক্ষরে “নীলাচল” লেখা। তার পাশেই স্বাগতম লেখা আছে। বড়ো গেটের পাশ থেকে দু’জনের জন্যে টিকিট কাটলো রায়িন। নিথিকে অর্ণবের সাথে কথা বলার কোনো প্রকার সুযোগ না দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। গেটের সামনে দারোয়ানকে টিকিট দেখিয়ে দ্রুত পায়ে চলতে লাগলো। নিথির এক হাতে লাগেজ এবং অন্যহাত রায়িন ধরে টানছে। ভাব এমন যেন সে সিনেমার নায়ক। চোখে একটা সানগ্লাস, আর অপরহাত পকেটে ঢুকিয়ে দিব্যি হেঁটে চলেছে। কিছুদূর আসতেই নিথি বলে ওঠে,
–“আরে ছাড়েন! গা’ধার মতো টানছেন কেন? এখানে সম্পত্তি লুকিয়ে রেখেছেন নাকি? এত তাড়াহুড়ো কিসের? পাশাপাশি আস্তে ধীরেও তো হাঁটা যায় নাকি?”
রায়িন চট করে নিথির হাত ছেড়ে দিলো। পিছে একবার লক্ষ্য করে দেখলো অর্ণব আছে কি না! নাহ, নেই। রায়িন নিথির হাত থেকে লাগেজ নিয়ে নিথিকে বলে,
–“আস্তে ধীরে হাঁটো! বৃষ্টির কারণে মাটি পিচ্ছিল হয়ে আছে। এখানে পরলে কিন্তু রক্ষা থাকবে না!”
–“রিসোর্টের জন্যে কতক্ষণ হাঁটতে হবে?”
–“প্রায় পনেরো মিনিট। কমও লাগতে পারে!”
নিথি কান্না অনুভব করলো। পনেরো মিনিট হাঁটলে তার পা আস্ত থাকবে না। এমনেই পরে এসেছে নতুন জুতা। নতুন জুতোয় হাঁটলে যদি ঠোসা পরে যায়? নিথিকে থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রায়িন হাঁক ছেড়ে বললো,
–“কী হলো! দাঁড়িয়ে কেন? চলো!”
নিথি সামনে তাকিয়ে দেখে রায়িন কিছুটা এগিয়ে। নিথি আল্লাহ ‘র নাম নিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হলো। কিছুটা পথ যেতেই নিথি ভিষণ চমকালো। কী সুন্দর দৃশ্য। তুলোর ন্যায় মেঘগুলো নিচে আর তারা মেঘের উপরে। সূর্যের নরম কিরণে কিয়ৎক্ষণ পূর্বের বৃষ্টির পানিতে গাছের লতা পাতা চিকচিক করছে। নিথি ভাবতেই পারছে না, তারা মেঘের উপরে, মেঘের রাজ্যে অবস্থান করছে। এ যেন সৃষ্টিকর্তার এক অপরূপ সৃষ্টি। ওরা এক ঢালাই করা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। নিথি চারপাশের সৌন্দর্য উপভোগ করতে ব্যস্ত। এদের সারাজীবন দেখলেও যেন সৌন্দর্য ফুরাবে না।
–“ভালো লাগছে জায়গাটা?”
নিথির রায়িনের তাকায়। অধরজোড়া প্রসারিত করে বলে,
–“খুব ভালো লাগছে৷ নিজ চক্ষে এই সৌন্দর্য দেখতে পারবো ভাবতে পারিনি।”
রায়িন হাসলো। হেসে নিথির সাথে এগোতে লাগলো। পাঁচ মিনিট হাঁটার পর নিথি তার জুতো জোড়া খুলে ফেলে। এতে রায়িন বেশ চমকায়। থমকে দাঁড়ায় এবং ভ্রু কুচকে বলে,
–“জুতো খুললে যে?”
পা জোড়া জ্বলছে নিথির। ঠোসা থেকে বাঁচতে জুতো খোলা ছাড়া আর কোনো উপায়ন্তর পায়নি। রায়িনের প্রশ্নে মুখে হাসির রেখা টেনে আওড়ায়,
–“ভেঁজা পথে খালি পায়ে হাঁটার আলাদা তৃপ্তি আছে।”
রায়িন কিছু বললো না। নিথির ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিলো। পাশাপাশি হাঁটছে দু’জন কপোত-কপোতী! এই অনুভূতি যেন আকাশচুম্বী। নিথি কিছুক্ষণ পরপর চোখ বুজে অনুভব করছে মুহূর্তটি। সময়টা এখানেই থমকে যাক। পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে নিথি খেয়াল করলো রায়িনের দিকে দুই একটা মেয়ে কেমন করে তাকিয়ে আছে। ওরা হয়তো রিসোর্ট থেকেই আসছে। নিথির খুব জ্বালা অনুভব করলো। অন্যের স্বামীর দিকে ওরা তাকাবে কেন? মেয়ে মানুষদের এত বে’হায়া হতে নেই তা কী এই মেয়েগুলো জানে না? নাকি জানতে চায় না! নিথি নাক ফুলিয়ে বেশ গালমন্দ করলো। হুট করেই রায়িনের হাত জড়িয়ে ধরলো এবং ক্লান্ত ভঙ্গিতে মেয়েগুলোকে শুনিয়ে বললো,
–“শুনুন না। আমার পা ব্যথা করছে। আর কতটা পথ বাকি?”
–“আট-দশ মিনিটের মতো! বেশি ব্যথা করছে?”
–“হুম!”
–“তাহলে ওই বেঞ্চিতে গিয়ে বসি, চলো! মেঘও দেখা হলো, তোমার বিশ্রামও নেয়া হলো!”
নিথি রাজি হলো। দু’জন মেঘের কাছাকাছি বেঞ্চিতে গিয়ে বসলো। পাশাপাশি। নিথি হুট করে তার কাঁধের ব্যাগ থেকে ফোন নিয়ে বলে,
–“সেল্ফি তুলবেন?”
–“চলো!”
নিথি ক্যামেরা চালু করে একদিকে করলো। ক্যামেরার মাধ্যমে দেখলো মেয়েগুলো এখনো এদিকে তাকিয়ে। নিথি মেয়েগুলোকে শিক্ষা দিতে বললো,
–“আমার কাঁধের দিকে থুঁতনি স্পর্শ করান, নয়তো ছবি ভালো আসবে না!”
রায়িন বিনা-বাক্যে নিথির কাঁধে থুঁতনি গুজলো। রায়িনের হাত নিথির পিছ দিয়ে গিয়েছে। মৃদু পিঠে স্পর্শও করছে। নিথি চোখ-মুখ খিঁচে শক্ত হয়ে গেলো। অসম্ভব কাঁপছে তার হৃদপিন্ড। গলা শুকিয়ে কাঠ কাঠ। করতে চাইলো ভালো আর হয়ে গেলো সব উল্টো। কেন বারংবার নিথি এভাবে লজ্জায় পরে আল্লাহ ভালো জানেন। নিথি কম্পিত স্বরে বলে,
–“প…প্লিজ, কা..কাঁধে থুঁতনি রাখা দরকার ন..নেই! আপনি যে..যেভাবে ছিলেন ওভাবেই ঠ..ঠিক আছে!”
~চলবে, ইনশাল্লাহ।
ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।