কৃষ্ণপক্ষের অন্তিম প্রহর পর্ব-১৬+১৭+১৮

0
33

#কৃষ্ণপক্ষের_অন্তিম_প্রহর
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

১৬.

হাতে থাকা রাইফেলটা মাটিতে ফেলে সাদাফ হাঁটু গেড়ে বসে গেল।তার বুক ধড়ফড় করছে।শ্বাস উঠে যাচ্ছে বারবার।এত্তো ভারি রাইফেল!সে মাটিতে বসেই টেনে টেনে শ্বাস নেয়।

বুট জুতা পরিহিত এক জোড়া পা ঠক ঠক শব্দে তার সামনে এসে দাঁড়ালো।সাদাফ আর মাথা তুলে চাইলো না।সে এই পা জোড়ার মালিককে চেনে।একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে মনে মনেকিছু কড়া কথা শোনার প্রস্তুতি নেয়।

এহতেশাম সামান্য ঝুঁকলো।তার দৃষ্টি তুখোড়,একেবারে স্থির।সাদাফের কিছুটা নিকটে এসেই সে গাঢ় স্বরে বলল,’আরো দুই রাউন্ড ফায়ারিং করার কথা ছিলো সাদাফ।হোয়াই ডিড ইউ থ্রো দ্য রাইফেল টু দ্য গ্রাউন্ড?’

সাদাফ শ্বাস টেনে বলল,’স..সরি স্যার।’

‘তোমার সরি শুনে আমি কি করবো?যাও আবার শুরু থেকে শুরু করো।’

সাদাফ অবিশ্বাস্য চোখে সামনে তাকায়।অথচ মুখ ফুটে কিছু বলার সাহস পায় না।স্যার কি আদৌ কোনো মানুষ?এতো পাষাণ মানুষ হয়?দশ রাউন্ড ফায়ারিংয়ে তার বাকি ছিলো মাত্র দুই রাউন্ড।পারেনি বলে আবার শুরু থেকে শুরু করবে?সে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,’স…স্যার।কাইন্ডলি…’

‘সাদাফ!এটা কোনো হকার মার্কেট না।আমি তোমার সাথে দরদাম করছি না।টেক ইউর পজিশন এন্ড ডু দিস ফ্রম দ্য বিগিনিং।’

এক বুক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সাদাফ রাইফেলে হাত দেয়।হৃদস্পন্দন এখন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে।সে সোজা হয়ে দাঁড়ায়।ঠান্ডা স্বরে বলে,’জ্বী স্যার।সরি ফর দ্য ডিস্টার্বেন্স।’

এহতেশাম আর কথা বাড়ায় না।চুপচাপ হেঁটে তাবুর কাছে এগিয়ে যায়।এখন সময় বিকাল তিনটা চার।পাহাড় চূড়া থেকে বিকেলের দৃশ্য দুর্দান্ত দেখায়।এহতেশাম যেতে যেতে সেই দৃশ্য দেখে।মেঘেরা এসে চূড়ার কাছে ভিড় জমাচ্ছে।টকটকে লাল সূর্য অস্ত যাওয়ার পথেসেই অপার্থিব সৌন্দর্যে আর্মি ক্যাম্প ঢাকা পড়েছে।যেই আর্মি ক্যাম্পের অবস্থান সাধারণ জনগনের জানা নেই।ফৌজিরা সেখানে ব্যস্ত থাকে কঠোর অনুশীলনে।এহতেশাম একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সামনে এগিয়ে যায়।আনগ্রেটফুল সিভিলিয়ানস! এরা কখনো তাদের আত্মত্যাগ বুঝতে পারবে না।কখনোই না।
.
.
.
.
জগলুদের বাড়িতে অরুনিমার দিন কাটলো বেশ ভালো।একটা মুভি শেষ হতেই অরুনিমা হাসিমুখে বলল,’বিয়ের পর আমার সবচেয়ে ভালো দিন গিয়েছে আজ।’

জগলু গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে জানতে চায়,’তাই?তবে তো আমাদের সৌভাগ্য।বড় বাড়ির বড় বউ আমাদের বাড়ির প্রশংসা করেছে।এটা কি চাট্টিখানি কথা?’

অরু খিলখিল করে হাসে।মাথা নেড়ে বলে,’বা রে! আর বড় বাড়ির বড় ছেলে যে রোজ তোমাদের বাড়ি পড়ে থাকে,তখন?’

‘সে তো পাগল।তার কথা ছাড়ো।’

অরু পানি খেতে খেতে চারপাশ দেখে।জগলুর বাড়িতে সদস্য সংখ্যা মোট চারজন।জগলু,তার মা,তার ভাই জামশেদ,আর সবশেষে জামশেদের স্ত্রী ফারহানা।অরুনিমার তাদের বেশ লেগেছে।তারা ভীষণ মিশুক প্রকৃতির মানুষ।কিছু মানুষ থাকে,যাদের মুখ দেখলেই আমাদের আপন আপন অনুভব হয়।জগলুদের বাড়ির লোকজন তেমনই মানুষ।

অরুনিমা সেদিন দুই দুইটা সিনেমা দেখে শেষ করলো।আর অভি দরজা বন্ধ করে আরামের ঘুম দিলো।কিছুদিন বাদেই শীতের মৌসুম শুরু হবে।জানালা দিয়ে সুড়সুড় করে ঠান্ডা বাতাস ছুটে এসে তারই আগমনী বার্তা দিয়ে যাচ্ছে।অরুনিমা গায়ে থাকা ওড়না টা শালের মতো পেঁচিয়ে জগলুদের খাবার ঘরে যায়।

ফারহানা তাকে দেখতেই মিষ্টি করে হাসলো।তার হাতে একটা ছুরি।সে ফালি ফালি করে আপেল আর আনারস কাটছিলো।অরুনিমা চেয়ার টানতে টানতে শুধায়,’এতোসব কার জন্য?’

ফারহানার ঠোঁট জুড়ে অমায়িক হাসির ছটা।ফল কাটার মাঝেই সে মুখ তুলে বলল,’আর কার জন্য?শিকদার বাড়ির বড় বউয়ের জন্য।’

অরুনিমা খানিকটা বিরক্ত হয়,সেই সাথে কিছুটা লজ্জাও পায়।
‘বার বার শিকদার বাড়ির নাম তুলে পরিচয় দিয়ো না তো।ভালো লাগে না।’

‘সেকি! এতো বড়ো বাড়ির বউ হয়েছো।এটা বুঝি লজ্জার কথা?’

অরুনিমা চঞ্চল হয়ে বলল,’তুমি জানো তারা কতো অদ্ভুত ধরনের মানুষ?’

ফারহানা বিনিময়ে কেবল হাসল।অরুনিমা খেয়াল করলো মেয়েটার মুখটা ভারি মিষ্টি।একটা স্নিগ্ধ ভাব সবসময়ই তার মুখে লেগে আছে।সে যখন হাসে,তখন তাকে চমৎকার দেখায়।এই সূক্ষ্ম হাসি ছাড়া ফারহানা অসম্পূর্ণ।

ফারহানা আপেলের প্লেটটা তার সম্মুখে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,’অরুনিমা! বড় বাড়িতে এমন একটু আধটু ঝামেলা হয়ই।তুমি ধৈর্য ধরে মানিয়ে নিয়ো।দেখবে আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে।’

অরু ঠোঁট উল্টায়।নির্বিকার চিত্তে একটু একটু করে আওড়ায়,’কে জানে! হয়-তো।’

ফরিদা ঘর থেকে বের হলেন আরো একটু পরে।টেবিলের মাঝামাঝি চেয়ারে বসা মেয়ে মানুষটাকে দেখেই তার ভ্রু দ্বয় কুঞ্চিত হয়।তিনি চিন্তিত স্বরে বললেন,’তুমি কে গো মেয়ে?’

অরুর আর আগ বাড়িয়ে জবাব দিতে হলো না।ফারহানা নিজেই তার হয়ে জবাব দেয়,’মা! ওর নাম অরুনিমা।আমাদের অভির বউ।’

ফরিদার দুই চোখ চিকচিক করে উঠে।প্রচন্ড আপ্লুত হয়ে তিনি অরুনিমার নিকট এগিয়ে গেলেন।তার হাত দু’টো আকড়ে ধরে বললেন,’তুমি আমাদের অভির বিবি?’

সে কেবল উপর নিচ মাথা নাড়ে।তার দৃষ্টি ফরিদার সমস্ত মুখের উপর নিবদ্ধ।সে হামাদের বউ,এই কথা জানার পর ঐ মহিলা যেই গভীর মমতায় অরুনিমার দিকে এগিয়ে এলেন,সেই মমতাটুকু অরুর অপার্থিব মনে হলো।অভিকে এই পরিবারের লোকজন খুব ভালোবাসে।অরুনিমা এখানে আসার পরেই বিষয়টা খেয়াল করেছে।এই জায়গায় অভিকে দেখে কেউ আন্দাজ করতে পারবে না,যে অভি আসলে এই বাড়ির সদস্য না।

ফরিদা তার সামনে চেয়ার টেনে বসলেন।তার মুখে পান।পান চিবুতে চিবুতেই তিনি জানতে চাইলেন,’পড়াশোনা কতোদূর করেছো অরুনিমা?’

অরুনিমা আরাম করে পা দোলায়।স্বাভাবিক গলায় উত্তর দেয়,’অনার্স প্রথম বর্ষ শেষ করেছি।আগামী মাসে দ্বিতীয় বর্ষে উঠবো।’

‘বাহ! মাশাআল্লাহ!’

ফরিদা পাশ ফিরে ফারহানার দিকে তাকালেন।খানিকটা বিচলিত হয়ে বললেন,’ফারহানা তুমি তাকে কি খাওয়াবে বলে ভেবেছো?’

ফারহানা বলল,’মাংস বসিয়েছি চুলায়।সাথে ডাল,বেগুন ভাজা আর রুই মাছ ভুনা।চলবে না অরুনিমা?’

অরুনিমা দুই বার পলক ঝাপ্টে বলল,’আমি এক পদ দিয়েই ভাত খাই।খুব বেশি হলে দুই পদ।তুমি শুধু শুধু এতো আয়োজন করলে।’

‘উহু! তুমি বুঝবে না।বাড়িতে প্রথমবার কেউ এলে একটু বেশি করেই আয়োজন করতে হয়।কিন্তু তোমার কপাল খারাপ।তোমার জামশেদ ভাইজান বাজারে গিয়েছিলো চিংড়ি আনতে।পায় নি।শেষ হয়ে গেছে।তাই পদ একটা কম হলো।’

অরুনিমা ছোট বাচ্চাদের মতো শরীর দুলিয়ে তাদের কথা শুনে।কখনো সায় দেয়,কখনো আবার নিজ থেকে জবাব দেয়।আধঘন্টা যেতেই বাড়ির দুয়ারে কেউ এসে কড়া নাড়ল।সেই খটখট শব্দে অরুর ঘাড় আপনাআপনি দরজার দিকে ঘুরে গেলো।

ফারহানা দরজা খুলে দিতেই একটা মেয়ে বাড়ির ভেতর উঁকি দিলো।অরুনিমা জহুরি চোখে তার মুখখানা পর্যবেক্ষণ করে,অনুমানেই তার বয়স ভেবে নেয়।

উজ্জ্বল শ্যামলা,প্রসাধনী মুক্ত একটা সাধারণ মুখশ্রী।বাঙালি মেয়েরা যেমন সরল সোজা হয়,সেও তার ব্যতিক্রম না।চিরায়ত বাঙালি মেয়েদের ভোলাভালা রূপ তার মাঝে বিদ্যমান।সে শ্যামলা না,আবার শুভ্রও না।তার দুই দিকে দুই বেণি ঝুলছে।পরনে তার গোলাপি রঙের সেলোয়ার কামিজ।

ফারহানা বলল,’আরে সায়মা! আয়,ভেতরে আয়।’

সায়মা ভেতরে আসে।অরুর সাথে চোখ মিলতেই কপাল কুঁচকায়।তার কুঁচকে রাখা মুখ দৃষ্টিগোচর হতেই ফারহানা বলল,’ওর নাম অরুনিমা।আমাদের অভির বউ।তুই তো বিশ্বাস করছিলি না অভি যে সত্যিই বিয়ে করেছে।দেখ এবার।এখন বিশ্বাস হচ্ছে তো?’
.
.
.
.
আকাশে আজ চাঁদ উঠেনি।দুই তিনটে তারা অবশ্য দেখা যাচ্ছে।সেই তারার আলোতে চারপাশ ঝলমল করছে না,উল্টো অদ্ভুত অন্ধকারে ডুব দিয়ে সবকিছু।আশপাশ কেমন আঁধার হয়ে আছে।ঠান্ডা বাতাসের সাথে কুয়াশা এসে শরীরে ধাক্কা দেয়।বাতাসে বাতাসে দীর্ঘশ্বাসের পরিমান ভারি হয়,ছুটে আসা কুয়াশার খানিকটা বুকে গিয়েও জমে বোধহয়।ভূমি থেকে হাজার ফিট উপরে থাকা ক্যাম্পের ভেতর তখন জায়গায় জায়গায় কাঠখড় দিয়ে আগুন জ্বালানো হয়েছে।সেই আগুনের ধোঁয়া উড়ে এসে চোখের সামনে ঘুরপাক খায়।সামান্য চোখ জ্বালাপোড়া হয়।তারপর আবার ভেসে ভেসে দূর আকাশে মিলিয়ে যায়।

সময় তখন রাত দুইটা আটান্ন।পুরো ক্যাম্পের সবাই তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।কেবল যাদের নাইট ডিউটি ছিলো,তারাই বন্দুক হাতে ক্যাম্পের চারপাশে টহল দিচ্ছিলো।তারা বাদেও আরো দু’জন মানুষ জেগে ছিলো।প্রথমজন ক্যাপ্টেন আশিক,আর দ্বিতীয়জন মেজর এহতেশাম মুস্তফা।

চন্দ্রবিহীন রাত্তিরে আঁধারে নিমজ্জিত আকাশটা দেখতে দেখতে আশিক বলল,’স্যার! চা খাবেন?’

এহতেশাম হাতে থাকা বন্দুকের বেয়নেট আলতো করে স্পর্শ করে তীক্ষ্ণ চোখে বেয়নেটের সরু প্রান্ত দেখে।আশিকের দিকে সে চোখ নেয় না।উল্টা বেয়নেটের ধাঁরালো প্রান্তে চোখ এঁটে ধরেই গম্ভীর স্বরে বলে,’চা হলে ভালোই হতো।তুমি বানালে আমার জন্যও বানাতে পারো।কড়া লিকারের এক কাপ চা।’

আশিক চলে গেল ক্যাম্পের একেবারে শেষ মাথায়।যেখানে কোনোরকমে একটা ছোট্ট খুপড়ি ঘরের বন্দোবস্ত করা হয়েছে।যেখানে ভাগ্যক্রমে রান্না করার প্রয়োজনীয় উপকরণ গুলো পাওয়া যায়।

আশিক প্রায়ই রাত জাগে।সাধ করে অবশ্য জাগে না।বাধ্য হয়ে জাগতে হয়।তার বিয়ের বয়স আটান্ন দিন।বিয়ের তিনদিন পরেই সে ক্যাম্পে জয়েন করেছে।যার সাথে তার বিয়ে হয়েছে তার নাম কেয়া।কেয়ার বয়স বিশ বছর।ইংরেজিতে অনার্স করছে।কেয়ার প্রিয় রং সবুজ।কেয়া বিয়ের দিন যেই কানের দুল পরেছিল,সেটাতে আটাশটার মতো রুবি পাথর ছিলো।সবগুলোর রং সবুজ।ব্যাস,স্ত্রী সম্পর্কে আশিক এইটুকুই জানতে পেরেছে।এর বেশি কেয়া সম্পর্কে তার আর কিছু জানা হয়নি।ক্যাম্পে ফেরার পর সে তার মিলিটারি জীবনে এতো ব্যস্ত হয়ে পড়েছে যে কেয়াকে তার ফোন দিতে একদমই মনে থাকে না।তারপর সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে,এখন থেকের ঘুমের সময় থেকে কিছুটা সময় কর্তন করে সে কেয়ার সাথে কথা বলবে।কেয়াকে ফোন করা গেলে ভালো হতো।কিন্তু সে যেখানে থাকে,সেখানে নেটওয়ার্ক ভালো না।কথা সব কেটে কেটে আসে।তাই সে মন দিয়ে কেয়ার জন্য চিঠি লিখে।

ইদানিং তার রাত জাগার নতুন সঙ্গী হয়েছে মেজর মুস্তফা।যদিও তিনি রোজ রাত জাগেন না।তবে সপ্তাহে একদিন তাকে তাবুর ভেতর পাওয়া যায় না।কিছু সময় তিনি পত্র লিখেন,কিছু সময় ক্যাম্পের চারপাশে হাঁটাহাঁটি করেন,কখনো আবার তার জলপাই রঙের জিপ নিয়ে পাহাড়ি রাস্তায় ঘুরে বেড়ান।আজ সম্ভবত তেমনই দিন।স্যারকে আগে কখনো পত্র লিখতে দেখেনি আশিক।এই অভ্যাস তার নতুন যোগ হয়েছে।সে কাকে পত্র লিখে,সেটা জানার কৌতূহল আশিকের প্রায়ই হয়।কিন্তু প্রাপকের নামটা তার কখনোই দেখা হয়নি।স্যার চিঠি গুলো নিজে গিয়ে পাঠান।এই কাজে তিনি কারো সাহায্য নেন না।যদিও আশিক একবার ফিরতি চিঠি এনেছিলো তার জন্য।কিন্তু সেখানেও প্রেরকের নাম লাল কালি দিয়ে কেটে দেওয়া হয়েছিলো।আশিক স্পষ্ট করে সেই নাম দেখতে পারেনি।তবে ঠিকানার জায়গা দেখে বুঝতে পেরেছিল চিঠিটা সমতট লেনের কোনো বাড়ি থেকেই এসেছে।

***

ধোঁয়া উঠা চায়ের কাপে একটা চুমুক দিতেই এহতেশামের তন্দ্রাভাব ছুটে গেল।চা টা দারুণ হয়েছে।সমস্ত ক্লান্তি এক লহমায় দূর করে দিচ্ছে।চায়ের কাপে দ্বিতীয় চুমুক বসিয়ে এহতেশাম প্রসন্ন কন্ঠে বলল,’চা টা দারুণ হয়েছে আশিক।তোমাকে ধন্যবাদ।’

আশিক কিঞ্চিৎ হাসলো।নিজের হাতে থাকা কাপটা নিয়ে তাবুর দিকে এগিয়ে গেলো।এহতেশাম চা খেতে খতে গভীর চাহনিতে চারপাশ দেখে।নাহ,আশেপাশে কেউ নেই।পত্র লিখার এটাই উপযুক্ত সময়।টুলের উপর কাগজটা রেখেই সে পকেট থেকে কলম বের করে।অনেক ভাবনা চিন্তার পর কলমের তীক্ষ্ণ প্রান্তটি তার খড়খড়ে কাগজের ত্বক স্পর্শ করে চলতে শুরু করে।

***
নীলা,
আপনার চিঠি দু’দিন আগে হাতে পেয়েছি।চিঠিতে আপনার কাটকাট কথা আমার মন্দ লাগেনি।তবে আপনার উপদেশ কিংবা অনুরোধ কোনোটাই আমি রাখতে পারছি না দুঃখিত।

প্রথম কথা,আপনি ঠিক কি কারণে নিজের সাথে কয়লা অথবা ময়লার ভাগারের তুলনা দিয়েছেন,আমার জানা নেই।কারণ আমার কোনো দিক থেকেই আপনাকে সেরকম কিছু মনে হয়নি।আপনি নিজেও জানেন আপনার গায়ের রং অতিমাত্রায় শুভ্র।তাহলে কয়লা শব্দটা আপনার নামের সাথে যুক্ত হলো কেমন করে?

আপনার ধারণা ভুল।আপনার সন্তান নিহাদের ব্যাপারে আমি অবগত।আপনার প্রাক্তন স্বামীর নাম রাহাত।কোনোটাই আমার অজানা না নিরুপমা।আমাকে একটা কথা বলুন তো?আপনার কেন মনে হলো আমি আপনার ছেলের ব্যাপারটা জানলে আপনাকে আর চিঠি দিবো না?আপনার বিবাহ বিচ্ছেদই কি আপনার এমন বারবার নিজেকে ময়লা বলার কারণ?যদি এমনটা হয়,তবে বলবো আপনি ভীষণ ভুল করছেন নীলা।আপনি নিজেকে হেয় করে অন্যদের চোখে নিজের অবস্থান খুব নিচুতে নামিয়ে আনছেন।

আপনার চিঠির ভাবার্থ অনেকটা এমনই দাঁড়ায় যে আপনি বিবাহিতা,আপনার সন্তান আছে।তাই আপনার মতো মেয়েকে(পড়ুন ধুলা কে)চিঠি দেওয়া যাবে না।কিন্তু আপনার পরিবর্তে রূপবতী(পড়ুন বিশুদ্ধ) মেয়েদের চিঠি দিলে কোনো দোষ নেই।কারণ আর্মি অফিসারের স্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা শুধু তাদেরই আছে।আপনার নেই।তাই না?

নীলা,
নিজেকে অন্যের সামনে ছোট করা,কিংবা নিজেকে সর্বদা তুচ্ছ রূপে উপস্থাপন করা খুবই গর্হিত কাজ।আমাদের ডিফেন্সে এই বিষয়টা খুবই খারাপ চোখে দেখা হয়।ধরুন আপনি একটা মিশনে আছেন।সেখানে আপনার শরীরের কোথাও বুলেট বিঁধেছে,কিংবা আপনি ভয়ংকর ভাবে ইনজুরড।সেই অবস্থায় আপনি যত দুর্বলই হোন না কেন,প্রতিপক্ষের সামনে নিজেকে এতো বেশি আত্মবিশ্বাসী দেখাতে হবে,যেন আপনার আত্মবিশ্বাস দেখেই প্রতিপক্ষ ভড়কে যায়,বিচলিত বোধ করে সামান্য দমে যায়।
ব্যক্তি জীবনও তার ব্যতিক্রম না নীলা।আপনি নিজেকে ধুলা বললে সমাজ আপনাকে চিরকাল সেই স্তরেই নামিয়ে রাখবে।আপনি বরং নিজেকে হীরা ভাবুন।সমাজ তবে আপনাকে সোনা ভাবতে বাধ্য।

আপনি নিজের নামের পাশে নোংরা উপমা ব্যবহার করবেন না।এতে নারী হিসেবে আমার চোখে আপনার অবস্থান নড়বড়ে ঠেকায়।একটি বুদ্ধিদীপ্ত,তেজস্বী,আর সেই সাথে খুব বেশি আত্মবিশ্বাসী নিরুপমার প্রত্যাশা আমি করতেই পারি।সেই প্রত্যাশা কতোখানি পূরণ হবে সেটা নির্ভর করছে আপনার উপর।

নীলা,
আপনি কি জানেন,কয়লা আর হীরা দু’টোই কার্বনের দু’টি ভিন্ন ভিন্ন রূপভেদ?একটির দাম আকাশচুম্বী,আর অন্যটি পথে পথে পাওয়া যায়।অথচ দু’টো জিনিসের গোড়া এক।ধরে নিলাম,আপনি এই মুহূর্তে কয়লা হয়েই আছেন।তাতে সমস্যা কি?আপনি নিজ চেষ্টায়,নিজ যোগ্যতায় হীরা হয়ে উঠুন না।এতে নিশ্চয়ই আপনার সম্মানহানি হবে না।আমি চোখ মেলে সবটা দেখতে চাই।কয়লা থেকে হীরা হওয়ার যে চমৎকার অভিযাত্রা,তা আমি সামনে থেকে দেখতে চাই।আপনি কি পারবেন না নিজের নতুন করে জাগরণ ঘটাতে?

আপনি বললেন আমি যেন আপনাকে চিঠি না দিয়ে বিশুদ্ধ রূপবতীদের চিঠি দেই।এই বাক্যে আপনার ভুল আছে।আপনি এখানে নিজেকে বিশুদ্ধ আর রূপবতীর দল থেকে বাদ দিয়েছেন।অথচ আপনার মতো লাস্যময়ী আর বিশুদ্ধ মেয়ে মানুষ আমি খুব কমই দেখেছি।বিয়ের পর স্বামীর সাথে সুস্থ স্বাভাবিক সংসার জীবন চালিয়ে গেলে কেউ নোংরা হয় না নিরুপমা রহমান।তাহলে জগতের সব বিবাহিতা নিজেদের ময়লার স্তুপ রূপে আবিষ্কার করতো।

যাই হোক।আমার যা বলার ছিলো,আমি তা বলে দিয়েছি।আমার লেখা গুলো কি ভীষণ কঠিন দেখাচ্ছে?দেখুন নীলা,আমি কিন্তু বেশ স্বাভাবিক ভাবেই লিখছি।আপনি ভাববেন না আমি রেগে আছি।আমার বচনভঙ্গিই এমন।মধু মিশিয়ে কথা বলা আমার স্বভাবে নেই।

যাই হোক।আপনি ভালো থাকবেন।নিহাদ কে আমার ভালোবাসা জানাবেন।আর হাসি খুশি হয়ে ফিরতি চিঠি লিখবেন।আমার একটি আধ্যাত্মিক ক্ষমতা আছে।আপনি কেমন মুখ করে চিঠি লিখেন,সেটা আমি আপনার চিঠি পড়ার সময়ই বুঝে যাই।আগের চিঠির লিখাগুলো কঠিন হলেও লিখার সময় যে আপনার মুখে এক টুকরো হাসি লেগেছিল,সেটা আমি জানি।সুতরাং এবার মুখের হাসির সাথে মিলিয়ে তারপর মনের কথা লিখবেন।

আমার নাম না জানানোর পেছনে বিশেষ কোনো কারণ নেই।জানাতে ইচ্ছে হয়নি তাই জানাইনি।যাই হোক,আমার নাম মুস্তাফা।পরবর্তী চিঠিতে মুস্তাফা বলেই সম্বোধন করবেন।আরেকটি বিষয়,আমি আপনার চেয়ে দশ বছর দুই মাস বড়ো।সুতরাং কিভাবে সম্বোধন করলে ভালো হয়,সেটা আপনিই ভালো বুঝবেন।

আল্লাহ হাফেজ।আপনার দিন সুন্দর কাটুক।
ইতি,
মেজর মুস্তাফা।

****

সায়মা মেয়েটার মুখের হাসি অরুনিমার পরিচয় জানামাত্র কেমন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।তার এই পরিবর্তন অরুনিমার চোখ এড়ালো না।অরুনিমা দেখল মেয়েটা হঠাৎই কেমন থম মেরে গেছে।তার চোখের দিপ্তী ফুরিয়ে সেখানে এসে জমাট বেঁধেছে একরাশ হতাশা।

সায়মা এগিয়ে আসে।কাঁপা স্বরে জানতে চায়,’তুমি অভি ভাইয়ের নিকাহ করা বিবি?’

অরুনিমা উপরনিচ মাথা নাড়ে।প্লেটে থাকা আপেলের টুকরো গুলোর একটি নিজের মুখে পুরে চিবুতে চিবুতে উত্তর দেয়,’হ্যাঁ আমিই তোমার অভি ভাইয়ের নিকাহ করা বিবি।’

চিনচিন যন্ত্রনাটা সায়মার বুক ছুঁয়ে গেল।হৃদপিণ্ডটা মনে হলো এসিডের দহনে ঝলসে গেছে।একটা সুক্ষ যন্ত্রনা প্রকট থেকে প্রকটর হলো,তারপর ছড়িয়ে পড়লো সর্বাঙ্গে,সমস্ত শরীরে।সেই যন্ত্রনা একটা হিংস্র শ্বাপদের মতো সায়মা কে গ্রাস করলো।তারই ফলস্বরূপ তার দুই চোখ ভিজে উঠল।

সে দ্রুত পেছন ফিরল।কেউ যেন দেখতে না পায় তেমন করেই চোখ মুছল।তারপর ফারহানার দিকে ফিরে বলল,’অভি ভাই কোথায়?ঘুমুচ্ছে?’

‘হ্যাঁ।’

‘কখন এলো?’

‘আরো অনেক আগে।’

‘ভাত খাবে না?’

‘খাবে তো।’

ফারহানা বলল,’অরুনিমা! যাও তোমার বর কে ডেকে নিয়ে এসো।’

অরুনিমা ভয় পেল।দুই দিকে হাত নেড়ে আতঙ্কিত হয়ে বলল,’বাপরে! আমি যাবো?যদি রেগে যায়?রেগে গিয়ে যদি আমায় কিছু করে?তখন?আমার যেতে ভয় করে।’

সায়মা এক মনে তার কথা শুনল।তার খানিকটা শান্তি হলো।বুকের ব্যাথা পুরোপুরি না গেলেও কিছুটা প্রশম হলো।সে এক গাল হেসে বলল,’তোমার যেতে হবে না।আমিই যাচ্ছি।আমি ডেকে দিচ্ছি অভি কে।’

সে প্রচন্ড উৎসাহের সাথে দক্ষিণ দিকের ঘরটার দিকে পা বাড়ালো।ফারহানা আর ফরিদা একবার চোখ চাওয়া চাওয়ি করলেন।তারপর দেখলেন অরুনিমার দিকে।তার কোনো বিকার নেই।ফারহানার তার জন্য মায়া হলো।নির্ভেজাল প্রকৃতির মানুষ বলেই হয়তো ব্যাপারটার জটিলতা সে বুঝতে পারছে না।

ফারহানা আদুরে স্বরে বলল,’তুমি খুব সরল অরু।’

অরু মাথা তুলে হাসল।আরেকটা আপেল মুখে নিয়ে বলল,’থ্যাঙ্কু তোমাকে।’

‘থ্যাঙ্ক ইউ দেওয়ার কিছু নেই।যাও,তুমিও অভির ঘরে যাও।কিচ্ছু করবে না সে তোমাকে।’

অরুনিমা অবাক হয়ে বলল,’সায়মা তো গেলো।আবার আমি কেন?’

ফরিদা এবার একটু কড়া হলেন।বললেন,’আমি বলেছি তাই যাবে।যাও নতুন বউ।বরের ঘরে গিয়ে তার পাশে পাশে থাকো।তোমার না নতুন বিয়ে হয়েছে?নতুন বিয়ের পর মিয়া বিবির এতো আলাদা থাকতে নেই।ফেরেস্তারা না হয় বদ দোয়া দেয়।’

চলবে-

#কৃষ্ণপক্ষের_অন্তিম_প্রহর
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

১৭.

দরজায় কেউ ক্রমাগত কড়াঘাত করে যাচ্ছে।সেই শব্দ ভেসে ভেসে কর্ণকুহর পর্যন্ত গিয়ে আঘাত করছে।অভির নিরবিচ্ছিন্ন ঘুমে ভাটা পড়ল।অনিয়মিত শব্দরা বারবার মস্তিষ্কে বারি খেয়ে তাকে জাগিয়ে তুলল।সে চোখ মেলল অত্যন্ত বাজে মেজাজে।

দরজার সামনে থেকে একটা রিনরিনে মেয়েলী স্বর ভেসে আসে।
‘অভি ভাই! দরজা খুলুন।’

কন্ঠ চিনতে একটু সময় লাগলো তার।মাথা ধরে আছে।শরীর ঝিমঝিম করছে।টানা ঘুমিয়েও ক্লান্তি কমেনি।অভি আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে কর্কশ গলায় বলল,’সমস্যা কি?কি চাই?’

‘দরজা খুলুন।কয়টা বাজে খেয়াল আছে?খাবেন না আপনি?’

অভি অলস ভঙ্গিতে উঠে বসলো।দরজার দিকে চোখ নিয়ে বলল,’আমার খাবার নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না সায়মা।’

শরীরের অলসতা কাটিয়ে সে দরজার দিকে এগিয়ে যায়।ছিটকিনি নামাতেই কড়কড় শব্দে কাঠের দরজা খুলে গেল।সায়মা মুখোমুখি হলো অভির।ঘুম ঘুম ক্লান্ত মুখটা দেখেই সায়মার মুখে হাসি ফুটলো।দুই ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে সে সামনে তাকায়।অভি অবশ্য বেশিক্ষণ দাঁড়ায় নি।দরজা খুলেই সে সোজা হেঁটে খাটে গিয়ে বসলো।একবার আড়চোখে সায়মা কে দেখে বিরক্ত স্বরে বলল,’তোকে কি আমি চাকর রেখেছি আমার?আমি খাই নাকি না খাই তা নিয়ে তোর কি?’

সায়মা বিন্দু পরিমান অপমান বোধ করল না।উল্টো ঘরের ভিতর প্রবেশ করে হাসি মুখে বলল,’হ্যাঁ।আমি আপনার চাকরই।হয়েছে?খুশি আপনি?’

অভি একটু মুখ কোঁচকায়।বিরক্তির মাত্রা আরো খানিকটা বাড়িয়ে বিড়বিড় করে,’বেলাজা মাইয়া মানুষ!’

সে আড়মোড়া ভেঙে পুরো ঘরটায় চোখ বুলায়।তারপর সায়মার দিকে দেখে প্রশ্ন তুলে,’অরুনিমা কোথায় সায়মা?দেখেছিস তাকে?’

যেই সামান্য হাসির রেখায় সায়মার মুখ ঝলমল করছিলো,অভির কথা কানে যেতেই সে হাসি হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।তার জায়গায় সেখানে এসে ভর করল এক জীবনের বিষন্নতা।সে মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে বলল,’আমি জানি না সে কোথায়।’

‘জানিস না মানে?আমার সাথে আমি তাকে নিয়ে এসেছি।বাড়িতেই থাকার কথা।’

বলতেই বলতেই অভির উৎকন্ঠা বাড়ে।সায়মা শুধু ব্যাথিতই হয় না।সাথে কিছুটা বিস্মিতও হয়।অভি কোনো মেয়ের জন্য ব্যাকুলতা দেখাতে পারে,সেটা তার কল্পনাতীত।এ যাবত কালে সে কখনো কোনো মেয়ের দিকে ফিরেও তাকায় নি।এই যে সায়মা তার জন্য আগে কতো সেজেগুজে আসতো।সে তো ফিরেও দেখতো না।আর তার মতো লোক কি-না একজনকে বিয়ে করতে গিয়ে অন্যজন কে পছন্দ করে নিল?সায়মা কেমন করে এই দুঃখ সইবে?

অরুনিমা ততক্ষণে ছোট ছোট পায়ে দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।অভি তাকে দেখামাত্রই উঁচু কন্ঠে ডাকল,’অরুনিমা! এ্যাই শোনো।তুমি কোথায় ছিলে এতোক্ষণ?’

অরুনিমা তাজ্জব হলো।ভ্রু কুঁচকে বলল,’কোথায় ছিলাম মানে?এখানেই তো ছিলাম।প্রথমে ছিলাম বসার ঘরে,তারপর খাওয়ার ঘরে।’

‘সায়মা যে বলল তার সাথে তোমার দেখা হয়নি।’

অরু আরেক দফা বিস্মিত হয়।বড় বড় চোখে সায়মার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,’সেকি! তোমার সাথে না আমার কথা হলো সায়মা।’

অভি দুইজনকেই একনজর দেখে।সায়মা তখন জড় পদার্থের মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো।অক্ষিকোটরে সামান্য পানি জমেছে তার,ভেতরটা দাউ দাউ করে পুড়ছে।অভি তার মলিন মুখটা দেখেও না দেখার ভান করে।কেবল জলদগম্ভীর স্বরে বলে উঠে,’এতো মিথ্যা বলিস কেন সায়মা?বিরক্ত লাগে আমার।’

অরুনিমা তখনও দরজার চৌকাঠে দাঁড়ানো।একহাত অন্যহাতের মুঠোয় বন্দি।অভি তার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে যথেষ্ট শান্ত স্বরে ডাকলো,’অরুনিমা! এখানে এসো।’

অরু গুটি গুটি পায়ে ভেতরে এলো।অভির থেকে একহাত দূরত্ব বজায় রেখে তার মুখোমুখি বসলো।অভি পালঙ্কে পিঠ এলিয়ে বসল।একটা হাত হাঁটুর উপর রেখে জানতে চাইলো,’এতোক্ষণ কি করেছো?’

অরুনিমার মুখে হাসি ফুটল।সে অতিমাত্রায় চঞ্চল হয়ে উত্তর দিলো,’দু’টো মুভি দেখেছি।তারপর ফারহানা ভাবির সাথে কথা বলেছি।তুমি যে কেন রোজ রোজ নিজের বাড়ি ছেড়ে এই বাড়িতে পড়ে থাকো,সেটা আমি ভালোই বুঝতে পারছি।’

অভি সামান্য হাসলো।যতখানি হাসলে দুই ঠোঁট অবস্থানচ্যুত হয় না,ঠিক অতোখানি।অরুনিমা বোকা বোকা চোখে তার দিকে তাকায়।অভি হঠাৎ একটা অদ্ভুত কাজ করলো।অরুনিমার কপালের কাছে পড়ে থাকা এক ফালি চুল তার কানের পেছনে গুজে দিয়ে বলল,’চুলগুলো এমন এলোমেলো করে রাখো কেন?কেমন পাগল পাগল দেখায়।’

অরু নিজেও দ্রুত মুখের সামনে থেকে চুল সরায়।খাটের বাইরে দুই পা ঝুলিয়ে নরম গলায় বলে,’তুমিই তো টানতে টানতে এখানে নিয়ে এলে।চুল ঠিক করার সময় পেলাম কোথায়?’

অভি শান্ত হয়ে তার মুখশ্রী দেখে।তারপর দেখে সায়মা কে।যে ইতোমধ্যেই পেছাতে পেছাতে দেয়াল পর্যন্ত গিয়ে থেমেছে।তার চোখে মুখে বেদনার ছাপ স্পষ্ট।এই বেদনা হামাদ শিকদারের হৃদয়ে প্রশান্তির মতো কাজ করে।হামাদ চোখের ভাষা বুঝে।হামাদ মন পড়তে জানে।আবার সেই মন ভাঙতেও জানে।

সেদিন সে অরুনিমার সাথে মাত্রাতিরিক্ত ভালো আচরণ করলো।ইশারা ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিতে চাইলো,অরুর সাথে তার দাম্পত্য জীবন বেশ কাটছে।অথচ তখনও তারা নিজেদের বিবাহিত জীবনে ঠিক মতো পদার্পণের সুযোগও পায় নি।

সায়মা সেদিন আর ভাত খেতে পারে নি।খাবার ঘরের টেবিলে অভি ভাই আর তার নিকাহ করা নতুন বউ বসেছিল।অভি ভাই খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকেই তার সাথে কথা বলছিলো।এই দৃশ্য সায়মার ভেতরটা ছাড়খাড় করে দিলো।যদি সংসার বাঁধতেই হতো,তবে সায়মার সাথে কেন বাঁধলো না?ঐ মেয়েটার গায়ের রং উজ্জ্বল।সেই ধবধবে সাদা রঙ দেখেই সায়মার সমস্ত শরীর জ্বলে উঠে।সব ছেলেই ঘুরেফিরে এক।তারা সবাই রূপের পাগল।ভেতরের ভালোবাসা টা কেউ আর দেখে না।যদি দেখতো,তবে অভি ভাই কোনোদিন সায়মা কে ফেলে ঐ মেয়েকে বিয়ে করতো না।সায়মার দুই চোখ ক্রমশ ঝাপসা হয়।অভি ভাই চিরকাল তাকে অবহেলা করে আসছে।অথচ সায়মার মতো যত্ন তাকে কেউ করে নি।

সেদিনের পর দুই দিন অরু আর বাড়ি থেকে বের হয়নি।নিরু আপার সাথে কয়েক দফা ফোনে কথা হয়েছিল।আপা তাকে বাড়ি আসতে বলেছে।অথচ অরুনিমা কোনো মন মতো ছুতো বানাতে পারছে না।

দুই দিন পর এক সকালে অভি যখন বাইরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো,অরুনিমা তখন তার পেছন পেছন এসে দাঁড়ালো।অভি আয়নায় তার বিষন্ন মুখের প্রতিবিম্ব দেখে।ভ্রু কুঁচকে বলে,’কি সমস্যা?কি চাই?’

অরু আমতা আমতা করে বলল,’হামাদ! তুমি কি আজ আমাকে জগলুদের বাড়ি নিয়ে যাবে?আমার খুব যেতে ইচ্ছে করছে।’

অভি পেছন ফিরল।তার মুখে বিরক্তি।কপালে ভাঁজ ফেলেই সে বলল,’সেদিনই তো গেলে।দুইটা দিন মাত্র গেল।আর কয়েকদিন পর আবার যেয়ো।’

অরুনিমা জেদ ধরে।দুই দিকে মাথা নেড়ে বলে,’না না।আজই নিয়ে যাও।কয়দিন পর আমার ক্লাস শুরু হলে আর কোথাও যেতে পারবো না।’

অভির মেজাজ গরম হলো।সেই চটে যাওয়া মেজাজের প্রতিচ্ছবি তার মুখে ফুটে উঠলো।সে সামনে যেতে যেতে তিরিক্ষি স্বরে বলল,’পারবো না নিয়ে যেতে।তুমি প্রচন্ড জ্বালাতন করো আমায়।’

‘কিহহ! আমি জ্বালাতন করি?’

‘হু।’

অরুনিমা কোমরে হাত রেখে শুধায়,’কেন?কি করি আমি?’

অভি গোমড়া মুখে বলল,’ঘুমের ভেতর তুমি খুব নড়াচড়া করো।বিরক্ত লাগে আমার।’

অরুর চোয়াল ঝুলে গেল।হামাদের কথা তার বিশ্বাস হয়নি।সে চোখ সরু করে বলল,’আমি নাড়াচাড়া করি?’

‘খুব।’

‘তুমি মিথ্যে বলছো।’

‘তোমার সাথে মিথ্যে বলে আমার লাভ?’

অরুনিমা চুপ হয়ে যায়।অভি দেখল তার মন খারাপ হয়েছে।পকেটে হাত দিয়ে বাইকের চাবির উপস্থিতি নিশ্চিত হতেই সে বাড়ি থেকে বের হতে হতে বলল,’নিচে গিয়ে দাঁড়াচ্ছি।দুই মিনিটে নেমে এসো।এর বেশি দেরি করলে ফেলে রেখে চলে যাবো।’

মুহূর্তেই বিদ্যুৎের ঝলকানির মতো অরুনিমার চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।খুশির আবির ছড়িয়ে পড়লো সমস্ত গাত্রে।হামাদ তাকে সত্যিই তার সাথে নিবে?বাড়ি থেকে বের হওয়ার খুশিতে তার দুই চোখ চকচক করে উঠে,আনন্দে নেচে উঠে মন।সে গায়ে থাকা ওড়নাটা মাথায় চাপিয়ে ঘর থেকে বের হওয়ার জন্য দৌড় লাগায়।যেতে যেতে খাটের পায়ায় হোঁটচ খেয়ে তার গতিরোধ হয়।তারপর উঠে দাঁড়িয়ে সে পুনরায় দরজার দিকে ছুট লাগায়।তার এত্তো এত্তো আনন্দ হচ্ছে! শিকদার বাড়ি থেকে বের হতে পারাই তার আনন্দের মূল কারণ।

****

জগলু বসেছিল বাড়ির বসার ঘরে।তার হাতে দৈনিক ইত্তেফাকের সংবাদপত্র।সে অবশ্য এই মুহূর্তে সেটি পড়ছে না।এই মুহূর্তে তার দৃষ্টি সামনের দিকে।সেখানে একটি মেয়ে সোফার উপর দুই পা তুলে বসে আছে।জগলু দেখলো তার মুখে একটা সুন্দর হাসি লেপ্টে আছে।বাড়ি আসার পরেই সে স্টার প্লাস নামের ভারতীয় চ্যানেল খুলে বসেছে।

জগলু তার মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য তার সামনে হাত নাড়ল।অরুনিমা টিভির স্ক্রীন থেকে চোখ সরিয়ে তার দিকে তাকায়।জগলু বলল,’ম্যাডাম অরুনিমা।আপনার কি দুই মিনিট আমার সাথে কথা বলার সময় হবে?’

অরুনিমা শব্দ করে হাসলো।মাথার দুই পাশে ঝুলানো দুই বেণিতে হাত রেখে বলল,’অবশ্যই।বলো কি বলবে।’

জগলুকে এই পর্যারে খানিকটা ভাবুক আর গম্ভীর দেখায়।সে এক জায়গায় স্থির হয়ে ভারি স্বরে বলল,’অভির যদি আরেক জায়গায় বিয়ে হয়ে যায়,তবে তোমার কেমন লাগবে বলো তো?’

অরু বিষম খায়।ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে থাকে জগলুর মুখের দিকে।জগলুর কথা সে শুনেছে।তবে অর্থটা পরিষ্কার না।সে অবাক দৃষ্টিতেই প্রশ্ন করে, ‘আরেক জায়গায় বিয়ে করবে মানে?’

‘উহু।প্রশ্নের উত্তরে প্রশ্ন করবে না।যেটা জানতে চেয়েছি,সেটা বলো।’

অরু মুখ কুঁচকে বলল,’অনেক কষ্ট লাগবে।কোন মেয়ে চায় তার বর আরেকটা বিয়ে করুক?আমি তো চাই না বাপু।তা সে খুনী হোক আর যাই হোক।বর শুধু আমারই হোক।’

জগলু নিজেও শব্দ করে হাসল।মাথা চুলকে সহজ গলায় বলল,’নিজের জিনিস কে নিজের করে রাখার জন্য যত্নশীল হতে হয় অরুনিমা।আমার বিচার তুমি এই সম্পর্কে যত্নশীল না।উপরন্তু আমার বন্ধু এতো বেশি উদাসীন স্বভাবের হওয়া স্বত্তেও তোমার ব্যাপারে যথেষ্ট যত্নশীল।সে আজও তোমার খাওয়ার খোঁজ নিয়েছে।অথচ তুমি তার কোনো খোঁজ নাও নি।বিষয়টা আমার চোখে লেগেছে।’

অরু মুখের উপর হাত চাপে।তার মন খারাপ হয়েছে হুট করে।জগলুর কথায় সে কষ্ট পেয়েছে।জগলুর উপর রাগ হয়নি,নিজের উপরই হয়েছে।সে ভেঙে পড়া কন্ঠে বলল,’আমি কি অভির সাথে খুব খারাপ আচরণ করি?’

‘তা করো না।তবে তার প্রতি মায়াও তো দেখাও না।’

‘মায়া দেখাবো কি করে?তাকে দেখে তোমার মায়া লাগে?’

জগলু সোফায় পিঠ হেলান দিয়ে বলল,’অভি বাদে আমার আর কারো জন্যই মায়া হয় না।তুমি যদি ভালোবেসে অভিকে দশ দাও,তবে অভি তোমায় সহস্র দিয়ে সেটা ফিরিয়ে দিবে।এ কথাটা সবসময় মনে রেখো।’

অরু মাথা নামিয়ে নিল।বিড়বিড় করে কেবল বলল,’আচ্ছা।’

জগলু একটা গভীর শ্বাস ছেড়ে মেঝের দিকে চোখ নামিয়ে বলল,’শোনো অরুনিমা! মানুষের চোখের ভাষা বুঝতে পারা একটা বড়ো গুন।কে কাকে কেমন চোখে দেখছে,সেটা তোমার বোঝা উচিত।তুমি চাও তোমার বর তোমার থাকুক,অথচ তুমি তাকে সময় দিবে না,তার গোপন কষ্ট গুলো জানার চেষ্টা করবে না,তবে কেমন করে তুমি তার কাছের মানুষ হবে বলো তো?তোমাকে অবশ্যই নিজের এমন একটা জায়গা তৈরি করে নিতে হবে,যেই জায়গায় অভি তোমাকে বাদে আর কাউকেই স্থান দিতে পারবে না।তাই না অরু?’

অরুনিমা গালের নিচে হাত দিয়ে গভীর মনোযোগে তার কথা শুনে।সে থামতেই করুন সুরে বলে,’তার মানে এতোদিন আমি খুব বাজে বউয়ের মতো কাজ করেছি জগলু?’

জগলুর গম্ভীর মুখে সামান্য হাসির দেখা মিলল।পরক্ষণেই সে সেই হাসি মিলিয়ে নিয়ে বলল,’নাহ।তুমি এতোদিন অবুঝপনা করেছো,বাচ্চামো করেছো।এবার বুঝদারদের মতো কাজ করবে।ঠিক আছে?’

অরু বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়ে।ছোট্ট করে জবাব দেয়,’আচ্ছা।’

অভি তখন পাড়ার সামনের টং দোকানে।অরুনিমা বলল,’আমি কি এখন তার সামনে গিয়ে তাকে সরি বলে আসবো?’

‘তার কোনো প্রয়োজন নেই।তুমি তার প্রতি যত্নবান হবে।তাহলেই চলবে।সায়মা তাকে রেঁধে বেড়ে খাওয়াচ্ছে,অথচ তুমি বউ হয়ে তার আশপাশে গিয়ে দাঁড়াচ্ছো না,বিষয়টা কেমন দৃষ্টিকটু না বলো?’

অরুনিমা গালের নিচে হাত রেখে অনুতপ্ত সুরে বলল,’হ্যাঁ অনেক।’

সে আর টিভি দেখলো না সেদিন।জগলুর সাথে কথা শেষ হতেই সে টিভি বন্ধ করে দৌড়ে দৌড়ে রসাইঘরে গেল।সে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই ফরিদা সেখানে উঁকি দিলেন।জগলুর সাথে চোখাচোখি হতেই বললেন,’কিরে?বোঝাতে পারলি?’

জগলু মাথা নেড়ে উত্তর দেয়,’বুঝিয়েছি অল্প অল্প।আমার ধারণা বাকিটা সে নিজ থেকেই আস্তে আস্তে বুঝে যাবে।’

‘বুঝলেই হলো।মেয়েটা বড়ো অবুঝ! আমার তাকে নিয়ে ভয় হয়।’

ফরিদার সত্যিই তাকে নিয়ে ভয় হয়।কোন মানুষটা তার স্বামীর দিকে কি চোখে তাকাচ্ছে,সেটা বোঝার মতো বিচক্ষণতা তার নেই।সায়মা যে একশো রকমের ছুতো বানিয়ে অযোচিতভাবে অভির ধার ঘেঁষছে,সেটা অরুনিমার চোখে পড়ছে নিশ্চয়ই?হয়তো পড়েছে,কিন্তু সে তেমন করে ভেবে দেখেনি।এই জায়গাতেই ফরিদার দুঃশ্চিন্তা।

পুরুষ মানুষরে আল্লাহ বানাইছে একভাবে।তাদের মধ্যে স্রস্টা কিছু দোষ গুন আগে থেকেই দিয়ে দিসে।মাইয়া মানুষের প্রতি তাদের আকর্ষণ চিরন্তন।সেই জায়গায় একটা প্রাপ্ত বয়স্ক যুবতী মেয়ে প্রতিনিয়ত ধার ঘেঁষলে কোন পুরুষটা ঠিক থাকে?ফরিদার এই নিয়ে চিন্তার অন্ত নেই।সায়মা কে সে প্রচন্ড স্নেহ করে।তবে সায়মা যা করছে,বা যা করার চেষ্টা করছে,ফরিদা তার পক্ষে নাই।বিয়ার পর মানুষের জীবনে আলাদা কইরা কোনো প্রেম টেম থাকে না।আবেগ অনুভূতি যা থাকে,সব মিয়া বিবির মাঝেই থাকে।সায়মা কেন এই সহজ কথা বুঝতে চায় না?

যাক গে।সায়মার বুঝতে হবে না।ফরিদা ঠিক করেছে এখন থেকে সে অরুনিমাকে একটু একটু করে সবটা বুঝিয়ে দিবে।অরু মেয়েটা কেবল ভালো না,অনেক বেশি ভালো।তার ভেতর একটা স্বচ্ছ,নির্ভেজাল আর ফকফকা হৃদয় আছে।এই মেয়েটা প্রথম দিনেই ফরিদার মন জয় করেছে।তাকে দেখলেই ফরিদার মনে হয় খোদা তায়ালা অভির জীবনে প্রদীপ রূপেই অরুনিমাকে পাঠিয়েছে।অভি হলো ঘোর অমানিশা।আর অরুনিমা হলো প্রভাতের সেই প্রথম আলো,যেই আলোতে সমস্ত অন্ধকার উবে যায়।
.
.
.
.
প্রেম বিষয়টা অদ্ভুত।অদ্ভুত না ঠিক,কেমন যেন অন্যরকম।আমরা মুখে বলতে পারি না,লিখে প্রকাশ করতে পারি না,এঁকে দেখাতে পারি না।তবে ভেতর থেকে ঠিকই অনুভব করতে পারি।

প্রেম কি?বুকের একেবারে গহীনে উৎপন্ন হওয়া চিন চিন ব্যাথা?যা আস্তে আস্তে পুরো শরীরে ছড়িয়ে যায়।নাকি অন্য কিছু?প্রেমের সংজ্ঞা কি?অকারণেই ঠোঁট ভেঙে আসাকেই প্রেম বলে নাকি?নিরুপমার জানা নেই।তবে সে এইটুক জানে,তার সাথে যা হচ্ছে সেটা স্বাভাবিক কিছু না।

সিদ্দিক রহমানের বড় কন্যাকে আজকাল কিছু বিষয় নিয়ে বেশ অস্থির দেখায়।সেই অস্থিরতার ছাপ তার মুখের উপর এসে পড়ে।তাকে সর্বদাই কেমন বিচলিত আর এলোমেলো মনে হয়।সে বাস্তবিক অর্থেই এলোমেলো।

রাঙামাটি থেকে আগত শেষ চিঠিটা হাতে পাওয়ার পর থেকেই নিরুপমা কেমন অন্যরকম হয়ে গেছে।মনে হলো এক চিঠিতেই এক সমুদ্র পরিবর্তন তার ভেতর ঘটে গেল,অথচ নিরু টেরও পেল না।এই নিয়ে নিরুপমা খানিকটা লজ্জিত।

নিরুপমা সংসার করেছে বছর দুয়েকের মতো।সময়ের হিসেবে অল্প হলেও একজন কে মন দিয়ে ভালোবাসার জন্য সেই সময়টা যথেষ্ট।দুই বছর এক সাথে সংসার করার পর খুব স্বাভাবিক ভাবেই দু’টো মানুষ পরস্পরের প্রেমে পড়ে।কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়,নিরুপমা কোনোদিন রাহাতের প্রেমে পড়ে নি।

রাহাত বিয়ের দিন রাতেই কথায় কথায় নিরুপমাদের আর্থিক অবস্থার প্রসঙ্গ টেনে আনলো।নিরুর মনে হলো,শুধুমাত্র খোঁচা দেওয়ার জন্যই সে এই প্রসঙ্গ টেনে এনেছে।স্বামী কে নিয়ে নিরুপমার মন জুড়ে যেই প্রজাপতিরা ডানা মেলার আয়োজন করছিল,রাহাতের সাথে তিন চারদিন সংসার করার পর সেগুলো তাদের ডানা হারিয়ে ধপাস করে মাটিতে গিয়ে পড়লো।তারপর নিরু আর কখনো উড়তে শেখার স্বপ্ন দেখেনি।

রাহাতের সাথে সে সংসার করেছে অনুভূতি শূন্য পাথরের মতো।রাহাত নিজের দাবি নিয়ে তার কাছে আসতো,সে বিনা বাক্যে রাহাতের কাছে নিজের সবটা উন্মুক্ত করতো।সে কোনোদিন রাহাতকে বাঁধা দেয়নি।দিতে ইচ্ছে হয়নি।নিরুপমা তখন স্রেফ একটা পাথর।রাহাত কাছে আসুক,বা দূরে যাক,নিরুপমার মধ্যে বিশেষ কোনো অনুভূতির সঞ্চার হতো না।তবে হ্যাঁ,নিহাদের জন্মের পর সে খুব চেষ্টা করেছে ঘর করার।নিরু বহুবার নিজের আত্মসম্মান খুয়িয়ে সংসার টেকাতে চেয়েছে।কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর পারেনি।

নিরু জানালার ধারে বসে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।তার হাতে একটা চিঠি।মা আর তুতুন আপাতত বাড়ি নেই।মা বাজারে গিয়েছে সবজি কিনতে।নিরুপমা সেই সুযোগে আবারো চিঠিটা ট্রাঙ্ক থেকে বের করেছে।

এই দুই পৃষ্ঠার চিঠিটা নিরুপমা কয় শতো বার পড়েছে সে নিজেও জানে না।পড়তে গিয়েই সে অনুভব করলো এর প্রতিটা বাক্যে,প্রতিটা শব্দে সে অদ্ভুত রকমের উদ্যম অনুভব করে।তার অবসন্ন হয়ে উঠা শরীর কেমন অদ্ভুত রকমের তেজ খুঁজে পায়।নিজেকে দুর্বার মনে হয়।বিষয়টা একান্তই ব্যক্তিগত।

নিরুপমা অবচেতন মনেই বুঝে গেল,তার ভেতর সম্পূর্ণ অন্যরকম কিছু পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে।প্রতি নিয়ত ঘটছে।যেই পরিবর্তন রাহাতের সাথে বিয়ের পর কোনো একদিনের জন্যও তার ভিতর ঘটে নি।সেই চিঠিটা হাতে পাওয়ার পর নিরু ভেতর থেকে যা অনুভব করলো,সেই অনুভূতি একেবারে নতুন।ফকফকে একটা অনুভূতি,আবার খানিকটা বেদনারও।বুকের ভেতরটা কেমন ছ্যাৎ করে উঠে পুরো পত্র পড়ার সময়।নিরুপমা সেই সূক্ষ্ম যন্ত্রনা নিয়েই চিঠি পড়ে।এই যন্ত্রনা টা তার ভালো লাগে।ঠিক যেন আফিমের মতো।খেলে ভেতরটা ছটফট করে,অথচ কিছুতেই খাওয়া বন্ধ করা যায় না।নিরু এই চিঠি পড়ার সময় যা অনুভব করে,তেইশ বছরের জীবনে নিরুপমা তার কিঞ্চিৎও অনুভব করেনি।

আচ্ছা,নিরু কি কোনো দ্বিচারিতা?নাকি ভ্রষ্টাচারী?সমাজ যদি জানতে পারে এতোগুলো দিনেও নিরুপমা তার বিয়ে করা বরকে ভালোবাসতে পারেনি,অথচ কোথাকার কোন মেজরের চিঠি রোজ রোজ এতোবার করে পড়ছে,তাহলে তাকে নিয়ে কি ভাববে?তাকে খুব খারাপ মেয়ে বলে ভাববে?নিরুপমা গালের নিচে হাত রেখে কিছুটা অন্যমনস্ক হয়।

সে আরো একবার চিঠি খুলে।আলতো হাতে প্রতিটা অক্ষর স্পর্শ করে।মনে হয় কেউ সামনে থেকে বলছে-আপনি নিজেকে ধুলা বললে সমাজ আপনাকে চিরকাল সেই স্তরেই নামিয়ে রাখবে।আপনি বরং নিজেকে হীরা ভাবুন।সমাজ তবে আপনাকে সোনা ভাবতে বাধ্য।

নিরুপমার চিত্ত ব্যাকুল হয়।বুক ধড়ফড় করে নিশ্বাস উঠানামা করে।উৎকন্ঠায় নাড়ির গতি বাড়তে থাকে অকস্মাৎ।এই চিঠি হাতে পাওয়ার পর নিরু কিছু পাগলামি করেছে।সেদিন মা করবী কাকিদের বাড়ি যাওয়ার পর নিরু একটা টকটকে লাল শাড়ি গায়ে জড়িয়েছে।তারপর খোলা চুলে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে।দাঁড়ানোর পরেই সে স্তব্ধ হয়ে গেল।কি হলো তার?এমন পাগলামি কেন করছে সে?

নিরুপমা চিঠিটা হাত ছাড়া করে না।আরো একবার পুরোটা চিঠি পড়ে।তারপর বুকের বা পাশটায় হাত রাখে।লোকটা তাকে হীরা বলল?নিরুপমা সত্যিই হীরা?লোকটা বলল সে বিশুদ্ধ।সত্যিই কি তাই?
চিঠিটা বুকের সাথে চেপে ধরে সে বড় করে শ্বাস টানে।

সেই রাতে নিরুপমা চিঠির উত্তর দিবে ভেবেও আর উত্তর দেয়নি।বিগত সাতদিন যাবত সে ভেবেই যাচ্ছে যে সে উত্তর দিবে।অথচ লিখতে গিয়ে সে বারবার ফিরে আসছে।নিরু জানে,তার ভেতর যা কিছু হচ্ছে,যেই অনুভূতিরা দলা পাকাচ্ছে,সবগুলোই তার জন্য নিষিদ্ধ।এই নিষিদ্ধ অনুভূতিদের লাই দেওয়া কি উচিত?নাহ,এটা অন্যায়।নিরুপমা ফিরতি চিঠি পাঠিয়ে ব্যাপারটা ঘেটে দিতে চায় না।লোক জানাজানি হলে নিরুর আর কোনো অস্তিত্বই থাকবে না।

তুতুন ঘুমাচ্ছে দুই হাত ছড়িয়ে।নিরু খাটে বসে আলতো করে তার ছোটোখাটো বুকটায় মাথা রাখে।তুতুনের শ্বাস প্রশ্বাস চলছে দ্রুত গতিতে।হৃদস্পন্দনের শব্দ নিরুপমার কান পর্যন্ত আসছে-ধ্বক ধ্বক ধ্বক।নিরুপমা নিরব হয়ে সেই শব্দ শুনে।

আচমকাই তার অল্প বয়সী মেয়েদের মতো ঠোঁট ভেঙে কান্না পেল।নতুন নতুন প্রেম হলে মেয়েরা যেমন করে কাঁদে,ঠিক এমন করেই।তার কান্নার শব্দ বাইরে যেতে পারে,এই ভয়ে সে দ্রুত মুখে হাত চাপে।সেদিন রাতে নিরুপমা মুখের উপর বালিশ চেপে দীর্ঘসময় কেবল ফুঁপিয়ে গেল।তার মনে হলো সে একটা নীড় হারা পাখি।যার সুন্দর বাড়িটা ঝড়ো হাওয়ায় দুম করে ভেঙে গেছে।সুন্দর বাড়ি হারানোর কষ্টে নিরুর বুক ভার হয়ে আসে।আর কখনো চিঠি লিখবে না ভাবলেও তার মন খারাপ হয়।তবুও নিরু কলমে হাত দেয় না।নিজের ধ্বংস ডেকে আনার মতো ভুল নিরুপমা আর কখনো করবে না।
.
.
.
.
সায়মা তরকারির বাটিটা হাতে নিয়ে বলল,’অভি ভাই! আপনার প্লেট টা দিন।’

অরুনিমা তৎক্ষণাৎ তার দিকে ছুটে গেল।একটানে বাটিটা নিজের হাতে নিয়ে বলল,’না না।আমাকে দাও,আমি দিচ্ছি।’

সায়মা মুখ কুঁচকে এক কদম পিছিয়ে গেল।অরু মহা আনন্দে অভির প্লেটে তরকারি তুলে দিলো।দুইবার দিতেই অভি হাত তুলে থামার ইশারা করলো।অরু তবুও তাকে আরো একবার দিলো।অভি বিরক্তিতে মুখ তুলে।

‘বললাম না আর লাগবে না?’

‘উহু।আমি নিজ থেকে দিয়েছি।না খেলে শক্তি হবে কেমন করে?’

জগলু খাওয়ার মাঝেই ফিক করে হাসে।ফারহানা মুচকি হেসে দু’জনের মুখ দেখে।

অভি খেতে খেতে বলল,’তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেন?বসে যাও।’

অরুনিমা দুইদিক দেখে আনত স্বরে জবাব দেয়,’আমি ফারহানা ভাবি আর ফরিদা চাচির সাথে খাবো।’

অভি আরেক লোকমা মুখে তুলে বলল,’আমার পাশে জায়গা খালি আছে অরুনিমা।সেখানে বসে যাও।’

‘আর সায়মা?সে তো বলল তার নাকি খুব খিদে পেয়েছে।’

অভি মুখ তুলে।থমথমে আর গম্ভীর চাহনি।ভেতরের অবস্থা বোঝা দুষ্কর।অরুনিমা গোল গোল চোখে তার দিকে তাকাতেই সে বরফ শীতল কন্ঠে বলল,’সায়মা কে না,তোমাকে পাশে বসতে বলেছি।চলে এসো অরুনিমা।’

অরুনিমা কাচুমাচু মুখে সায়মার দিকে তাকায়।তার কাঁধে হাত রেখে নরম সুরে বলল,’সরি সায়মা।তুমি আরো কিছুক্ষণ খিদা সহ্য করো।’

বলেই সে তাড়াহুড়ো করে অভির পাশে বসে।অভি প্লেটের থেকে চোখ না তুলেই ইষৎ ধমকের সুরে বলে,’হাতটা ধুয়ে আয় খাচ্চর।’

অরু জিভ কাটলো।তাড়াতাড়ি চেয়ার ছেড়ে উঠে বেসিন পর্যন্ত গিয়ে হাত ধুয়ে এলো।জগলু দেখলো অভির গম্ভীর মুখ।তারপর নিজের মুখটা তার কাছাকাছি এনে বলল,’কিরে! তুই না কেবল সহমর্মিতা দেখাস অভি?তা বউকে হাত ধুতে বলা কোন ধরনের সহমর্মিতা শুনি?’

চলবে-

#কৃষ্ণপক্ষের_অন্তিম_প্রহর
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

১৮.
[প্রথম অংশ]

সকালের সূর্য উঠেছে।তবে ধরণী বুকে উত্তাপ ছড়াতে পারেনি।ডিসেম্বরের সাথে সাথে শীতের আগমন ঘটে গেছে।ইদানিং মাফলার,সোয়েটার আর শাল ছাড়া রাত দশটার পর বাইরে বের হওয়া যায় না।সকালে কিছু সময়ের জন্য মাথার উপর সূর্যের দেখা মিললেও সেই সূর্য শীতের ঠান্ডা আমেজ দূর করতে পারে না।

জগলু বসেছিল বিনুদের দোকানে।মস্তক নুয়ানো,পায়ের কালো ফিতার জুতোর দিকে তার নজর আটকে আছে।হাতে থাকা কাপে এখনো কিছুটা চা অবশিষ্ট আছে।কিন্তু তার খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না।একটু আগেই সে সকালের নাস্তা সেরেছে।

বিনুর দোকানে তখন পাড়ার আরো ছেলেপুলেরা এসে ভিড় জমিয়েছে।বিনু কাউন্টারে দাঁড়িয়ে টাকার হিসেব করছিল।জগলু চায়ের কাপে থাকা অবশিষ্টাংশ দোকানের পিছন দিকে ছুড়ে মেরে কাপটা কাউন্টারের এক পাশে রাখল।তার মুখটা সে গোমড়া করে রেখেছে।অকারণেই আজ সে বিরক্ত।সেই বিরক্তভাব একেকবার একেকজনের উপর প্রকাশ পাচ্ছে।

জগলু পকেটে হাত গুজে বলল,’বিনুদা! একটা সিগারেট দাও।ভালো লাগছে না কিছু।’

বিনু একটা সিগারেট প্যাকেট থেকে বের করে তার দিকে বাড়িয়ে দিলো।জগলু সেটা হাতে নিয়ে দোকানের একপাশে ঝুলানো লাইটার থেকে সিগারেটের এক প্রান্তে আগুন ধরালো।

সিগারেটটা দুই ঠোঁটের সাহায্যে চেপে ধরে বড়ো বড়ো দুইটা টান দিয়েই সে চোখে মুখে ধোঁয়া ছাড়লো।সে ধোঁয়ায় চারপাশ খানিকটা ঘোলাটে হলো।রমিজ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল,’কিরে জগলু?তোর বন্ধু কোথায়?এখনো আসলো না যে?’

জগলু নির্বিকার।কেবল ঘাড়টা সামান্য বাঁকিয়ে বলল,’জানি না।ঘুম থেকে উঠে নি বোধ হয়।’

শীত টা ইদানিং বেড়েছে খুব।জগলু এখন আর কেবল শার্ট পরেই পাড়া বেড়াতে পারে না।সাথে একটা শাল অথবা সোয়েটার রাখতে হয়।আজ সে গায়ের উপর কালো রঙের একটা শাল চাপিয়ে এসেছে।যদিও শালটা তার নিজের না।ভাইজানের ঘরে দেখেছিল।তার ভালো লাগাতে সেটাই গায়ে দিয়ে এসেছে।

তখন সময় সকাল দশটা থেকে একটু বেশি।জগলু সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে চারপাশ ঘোলাটে করে রেখেছিল।হঠাৎই সে দেখলো দূর থেকে একটি মেয়ে ছোট ছোট পায়ে তার দিকে এগিয়ে আসছে।ধোঁয়ার ফাঁকে ফাঁকে অল্প অল্প করে তার প্রতিচ্ছবি দেখা যাচ্ছে।সে মুখের সামনে থেকে সিগারেট টা নামিয়ে নিল।হাতটা রাখলো একেবারে হাঁটুর পাশাপাশি এনে।তারপর অন্যহাতে চারপাশে হাত নেড়ে ধোঁয়াটুকু সরিয়ে নিল।

একজন তরুনী দৃপ্ত কদমে তার দিকে এগিয়ে আসছে।মুখজুড়ে তার খেলা করছে একটু খানি হাসি।তার পরনে কুচকুচে কালো শাড়ি।হাতে একটা কালো ফিতার ঘড়ি।অন্যহাতে একটা কালো ভ্যানিটি ব্যাগ।চুলগুলো উঁচু করে খোঁপা করা।চোখে একটা কালো ফ্রেমের চশমা চাপানো।হাঁটতে হাঁটতে সে একবার চশমাটা ঠিক করে নিল।নাকের কাছে নেমে আসা অংশটা এক আঙুলের সাহায্য ধাক্কা দিয়ে দুই চোখের মাঝামাঝি অবস্থানে এনে রাখলো।

বিনুর দোকানের সামনে এসেই সে এদিক ওদিক দেখে একেবারে বিনীত স্বরে বলল,’এক্সকিউজ মি! আপনারা কেউ কি আমাকে “প্রভাত-পত্র” প্রেস মিডিয়ার খোঁজ দিতে পারবেন?আমি আসলে ঠিকঠাক এড্রেসটা খুঁজে পাচ্ছি না।’

জগলু ত্যাছড়া চোখে তার আগাগোড়া পরোখ করে।সে কথা শেষ করার একটু পরে স্বাভাবিক স্বরে উত্তর দেয়,'”প্রভাত-পত্র”র অফিস এখান থেকে আরো দূরে।পাঁচ টাকা সিএনজি ভাড়া দিতে হবে।”

মেয়েটা ব্যস্ত হয়ে বলল,’সমস্যা নেই।আমার কাছে টাকা আছে।আপনি কেবল বলুন সিএনজি পাবো কোথায়?’

মেয়েটা থামল।হঠাৎই কিছু একটা মনে পড়তে প্রশ্ন করলো,’আচ্ছা ভাইয়া,আপনার নামটা একটু বলবেন?আসলে নাম না জানলে আমি কোনো মানুষের সাথে ঠিক মতো কথা বলতে পারি না।’

জগলু উত্তর দেওয়ার জন্য মুখ খোলার আগেই পাশ থেকে রমিজ বলে উঠে,’ওর নাম?ওর নাম হইলো জগলু।’

জগলুর ব্রহ্মতালু ছ্যানছ্যান করে উঠলো।সে কটমট চোখে কিছুক্ষণ রমিজকে ভস্ম করলো।তারপরই চোয়াল শক্ত করে বলল,’আমার নাম জুহায়ের।জুহায়ের ইবনে ফিরোজ।’

রমিজ ভ্র নাচিয়ে বলল,’সেটা তো ভালো নাম।লোকে তো তোকে জগলু বলেই চেনে।’

জগলুর সমস্ত শরীর আরো এক দফা ক্রোধের আগুনে জ্বলেপুড়ে ছাড়খাড় হলো।রমিজের সমস্যা কি?যখন সে দেখছে যে জগলু তার নাম জুহায়ের বলতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে,তখন বার বার কানের কাছে জগলু জগলু করছে কেন?জগলু ভেবে নিল পরের বার দেখা হলেই সে রমিজের কানের নিচে টস টস করে দু’টো চড় দিবে।যতোসব ফালতু লোক!

মেয়েটা একবার জগলুকে,একবার রমিজকে দেখে।তারপর অল্প হেসে বলে,’আমার নাম সুচিস্মিতা।সুচিস্মিতা হোসেইন।’

জগলুর সেই নাম উচ্চারণ করতেই দাঁত ভেঙে এলো।মনে মনে সে আচ্ছা মতোন রাগ ঝাড়লো।একি অদ্ভুত নাম।সুচ…না না সুচিমমি….ধ্যাত না…..সুমি….ধুর ছাই।সে কোনোদিনও তাকে নাম ধরে ডাকবে না।সে তাকে ডাকবে-এ্যাই মেয়ে! শোনো তো।

সুচিস্মিতা নিজ থেকেই বলল,’জনাব জুহায়ের! আপনি যদি আমায় বলতেন যে সিএনজি কোথায় দাঁড়ায়,তবে খুব উপকার হতো।’

জগলু মাথা নাড়ল।হাতে থাকা সিগারেটটা মাটিতে ফেলে বাম পা দিয়ে সেটা পিষে নিল।তারপর কন্ঠে সামান্য খানিকটা মধু ঢেলে বলল,’জ্বী চলুন।আমি দেখিয়ে দিচ্ছি।’

তার সৌজন্যসূচক আচরণে মেয়েটার মুখে হাসি ফুটল।জগলু তখনও মনে মনে তার নামটা স্মরণ করার চেষ্টা করছিলো।কি যেন বলল?সূচনা?সুচি….সুমিতা…ধুরুহহ।আর মনেই করবে না।

জগলু সামনে হাঁটতে হাঁটতে বলল,’প্রভাত পত্রের অফিসে কেন যাচ্ছেন?কোনো বিশেষ প্রয়োজন?’

মেয়েটা দ্রুত হেঁটে তার গতির সাথে গতি মেলানোর চেষ্টা করল।ব্যাপারটা বুঝে আসতেই জগলু পায়ের গতি কমালো।মেয়েটা কিছুটা সহজ হয়ে বলল,’জ্বী।চাকরির ইন্টারভিউ।বারোটার দিকে সেখানে থাকতে হবে।’

জগলু জানতে চাইলো,’এখন সময় কতো?’

‘দশটা এগারো।’

‘নিশ্চিন্ত থাকুন।সময় মতো পৌঁছে যাবেন।’

সুচিস্মিতা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।কৃতজ্ঞতা স্বরূপ একগাল হেসে বলল,’ধন্যবাদ।আপনি আমার জন্য নিজের সময় নষ্ট করছেন।’

জগলুর মন চাইলো উত্তর দিতে,’ধন্যবাদের কিছু নেই আপা।আমি চব্বিশ ঘন্টাই নষ্ট করি।আপনার সাহায্য করে কিছুটা সময় নষ্টের খাতা থেকে বের করতে চাই।’

অথচ সে মুখে বলল অন্য কথা।খানিকটা গম্ভীর সুরে প্রতিউত্তর করলো,’না না।কোনো সমস্যা নেই।’

সে নিজ থেকেই জানতে চাইলো,’আপনার সাংবাদিক হওয়ার শখ?’

সুচিস্মিতা জ্বল জ্বল চোখে তার দিকে ফিরে।তার উজ্জ্বল চোখ জোড়া দেখেই জগলু বুঝতে পারে সাংবাদিক হওয়ার শখ তার কতো বেশি প্রকট।সুচিস্মিতা খুব গর্ব করে বলল,’আমার জীবনের একমাত্র স্বপ্ন সাংবাদিকতা করা।আমি খুব ভালো সাংবাদিক হতে চাই জুহায়ের।আপনি আমার জন্য দুয়া করবেন।’

জগলু একগাল হাসল।গাঢ় স্বরে উত্তর দিলো,’জ্বী অবশ্যই।আমি দোয়া করছি আজকের ইন্টারভিউ আপনার ভালো হোক।আর আপনি এই চাকরিটা পেয়ে যান।’

সুচিস্মিতা আগের মতো করেই হাসে।সামনে হেঁটে যেতে যেতে নিজ থেকে বলে,’চাকরি টা হলে আমি আপনাকেও মিষ্টি খাওয়াবো জুহায়ের।’

‘জ্বী।আমি আপনার মিষ্টির অপেক্ষায় থাকবো।’

অনেকটা রাস্তা হেঁটে মেইনরোডের কাছাকাছি এসে জগলু আঙুলের ইশারায় কয়েকটা সিএনজি দেখিয়ে বলল,’এই যে এগুলো সব ঐ রোড দিয়েই যায়।আপনি এগুলো তে করে যেতে পারবেন।গিয়ে বলবেন প্রভাত পত্রের সামনে নামিয়ে দিতে।তাহলেই হবে।’

সুচিস্মিতা আরো একবার কৃতজ্ঞতার হাসি হেসে সিএনজি গুলোর দিকে এগিয়ে যায়।জগলু প্রথমে গম্ভীর হয়ে রাস্তার অন্যপাশে দাঁড়িয়ে থাকলো।শেষে কি ভেবে আবার সুচিস্মিতার পিছু পিছু হাঁটা দিলো।

চারটা সিএনজির মাঝে তিনটা মানুষে ভর্তি।এক্ষুনি ছেড়ে দিবে দিবে অবস্থা।আর যেটা বাকি আছে সেটাতেও সব পুরুষ মানুষ।সিট খালি আছে দুইটা।সুচিস্মিতা ইতস্তত করতে করতে পেছনের সিটে তাকায়।একটা মাঝবয়সী লোক বসে আছে।তার চোখের দৃষ্টি কেমন যেন।সুচিস্মিতার ঠিক মনঃপুত হলো না।

জগলু এগিয়ে এসে তার পাশাপাশি দাঁড়ায়।ভেতরে উঁকি দিয়ে একবার ভেতরের অবস্থা দেখে।সুচিস্মিতা চমকের পিলে তার দিকে তাকায়।জগলু বেশ সহজ গলায় বলল,’আপনি একা যেতে পারবেন?নয়তো আমি আপনাকে প্রভাত পত্রের অফিস পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারি।প্রথম দিন তো।এজন্য বলছি।পরের বার থেকে আপনি নিজেই পারবেন।’

তার কথা শুনতেই সুচিস্মিতার দুই ঠোঁট প্রশস্ত হাসলো।তার চোখ দু’টো কৃতজ্ঞতায় ভরপুর।সে দ্রুত উপরনিচ মাথা নাড়লো।চঞ্চল সুরে বলল,
‘জ্বী অবশ্যই।অনেক উপকার হবে আমার।চলুন প্লিজ।’
___

সিএনজি ছেড়েছে এক মিনিট আগে।জগলু মাঝখানে।তার একপাশে একজন লোক।অন্য পাশে সুচিস্মিতা।সুচিস্মিতার সাথে তার দূরত্ব দুই ইঞ্চির মতো।সুচিস্মিতা বসেছে বেশ আরাম করে।যাত্রাপথে জগলু কেবল দুইবার তার মুখ দেখলো।

প্রভাত পত্রের বিশালাকার ভবনের সামনে আসতেই জগলু নেড়েচেড়ে উঠল।জলদগম্ভীর স্বরে বলল,
‘গাড়ি থামান।আমরা নামবো।’

গাড়ি থামতেই জগলু নেমে সবার আগে দু’জনের ভাড়া মেটালো।সুচিস্মিতা ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলল,’আরে আরে করছেন কি?ভাড়া তো আমার দেওয়ার কথা ছিলো।আপনি দিলেন কেন?’

জগলু ভারি স্বরে বলল,’সমস্যা নেই।ঐটুকু টাকা আমার ছিলো।’

‘তবুও।’

জগলু মুখে সামান্য হাসি ফুটিয়ে বলল,’সমস্যা নেই।আপনি চাকরি পেলে মিষ্টি খাওয়াবেন।তবেই শোধবোধ হয়ে যাবে।’

সুচিস্মিতা হাসলো।যেতে যেতে শেষ একবার বলল,’আমার জন্য দু’য়া করবেন জুহায়ের।চাকরিটা যেন আমার হয়।পেশা হিসেবে সাংবাদিকতা ছাড়া আর কোনো কিছু আমি কল্পনাই করতে পারি না।’

বিনিময়ে জগলু কেবল মাথা নাড়ে।দুই হাত বগলদাবা করে দেখে,কথাটা শেষ করার পরই সুচিস্মিতা বড় বড় পা ফেলে প্রভাক পত্রের বিশালাকার ভবনের ভেতর প্রবেশ করলো।জগলু তক্ষুনি গেল না।কোনো এক অজানা কারণে জুহায়ের অর্থাৎ জগলু আরো আধ ঘন্টা দেখানে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো।

___________________________________________

পাখিদের নীড় হয় খুব নড়বড়ে আবাস।যেখানে অল্প বাতাসেই নীড় ভেঙে সবটা এলোমেলো হয়ে যায়।ঝড়ের রাতে স্থায়ী নিবাস হারিয়ে পাখির ছানাদের যেমন মুমূর্ষু অবস্থা হয়,টানা এগারোদিন চিঠির জবাব দিতে না পারার যন্ত্রনায় নিরুর অবস্থাও হলো তেমন।নিরুপমা বহুবার চিঠি লিখতে গিয়েও ফিরে এসেছে।কোনো একটা কিছু তাকে পেছন থেকে টেনে ধরতো বার বার।নিরুপমা চাইলেও কলম চালাতে পারতো না।

আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে সে বার বার প্রশ্ন করতো-সে কি আসলেই নিঃশেষ হয়ে যাওয়া কোনো বস্তু?নাকি নিরুপমার সাধ্যি আছে নতুন করে সবটা শুরু করার।

নিরু একদিন দুরু দুরু বুক নিয়ে মায়ের সামনে গেল।দৃঢ় কন্ঠে জানালো আমি আবার পড়াশোনা শুরু করতে চাই মা।

মা চোখ পাকালেন।কিছুটা শাসালেন বোধহয়।বললেন,’এতোকিছুর পর তুই আবার বাড়ির বাইরে গিয়ে পড়াশোনা করবি?কোনো দরকার নেই নিরু।’

নিরুপমা সেই বিকেলে খুব বেশি সাহসী হয়ে বলল,’দুঃখিত মা।তুমি রাজি না থাকলেও আমি পড়াশোনা টা চালিয়ে যাবো।তোমার টাকা দিতে হবে না।আমার জমানো টাকা দিয়েই কাজ চলে যাবে।’

তারপর মুখের মধ্যে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে নিরুপমা মায়ের ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।তার মনে হলো সে কোনো বাঁধনহারা পাখি।তার ভেতরটা তখন চাপা উত্তেজনায় ভরপুর।সে পড়বে,অনেক বেশি পড়বে।তাকে সাহস দেওয়ার মানুষ সে পেয়ে গেছে।

সমাজের যেই শেকল নিরুপমা রহমানের পা জড়িয়ে রেখেছিল,সেদিন সন্ধ্যার পর নিরুপমা সেই শেকলদের গোড়া থেকে উপড়ে ফেলল।তার খুব শান্তি লাগছে,হালকা হালকা লাগছে ভীষণ।

নিহাদ ঘুমানোর পর সে দরজা বন্ধ করে চেয়ার টেনে বসলো।তার বুক ধ্বক ধ্বক করছে।মনে হচ্ছে পেটের ভেতর কোনো কিছু গুড়গুড় করছে।নিরুপমা টেনে টেনে শ্বাস নেয়।তারপর মহা উৎসাহে লিখতে শুরু করে।

জনাব মুস্তাফা,
সালাম নিবেন।আপনার আর আমার বয়সের ব্যবধান শুনে রীতিমতো হতচকিত হয়েছি।আপনার বয়স তেত্রিশ?আমি ভেবেছিলাম আপনি আমার কাছাকাছি বয়সের।

যাই হোক,আপনার চিঠি আমি পড়েছি।জানি না আপনার কোনো বিশেষ যাদুবল আছে নাকি,কিন্তু চিঠিটা পড়ার পর থেকে আমার কেমন যেন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে।

মুস্তাফা,
আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি আবার পড়াশোনা শুরু করবো।এই নিয়ে আপনার মত কি?কাজটা ভালো হবে নাকি বেশি হঠকারিতা হবে?
নিহাদ এখনো খুব ছোট।আমি অতোটা সময় বাইরে থাকলে তার দেখভাল করবে কে?আমি এই নিয়ে কিছুটা দ্বিধায় ভুগছি।

তবে পড়াশোনা আমি করবো বলেই মনঃস্থির করেছি।কিন্তু কবে নাগাদ শুরু করবো তার কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারছি না।আপনি একটু বলুন তো,কখন শুরু করলে ভালো হয়?

আরেকটা বিষয়।আমার সবসময়ই সেনাসদস্য দের জীবন নিয়ে জানার শখ।আপনি পরের পত্রে আপনার রাঙামাটির জীবনের অল্প বিস্তর বর্ণনা দিবেন।ঠিক আছে?আপনারা কিভাবে থাকেন,কিভাবে চলাফেরা করেন,সেসব নিয়ে আমার ভীষণ কৌতূহল কাজ করে।

মা আমার উপর একটু রেগে আছে।কিন্তু আমি সেসবের পরোয়া করছি না।নিরুপমা সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে আজ থেকে কিছুটা হলেও নিজেকে নিয়ে ভাববে।

আগের চিঠিতে যে আমি নিজেকে ধুলা বলেছিলাম,সেই কথা ফিরিয়ে নিলাম।নিরুপমা ধুলা না,সে কখনোই সেটা ছিলো না।

আপনার ফিরতি চিঠির অপেক্ষায় থাকলাম।আপনি ভালো থাকবেন।মন দিয়ে দেশের সেবা করবেন।আপনি এবং আপনার অধীনস্থ সাতজন ক্যাডেটের জন্য নিরুর পক্ষ থেকে অনেক অনেক শুভকামনা।’

এইটুকু লিখতেই নিরুপমার হাত জমে গেল।পরের কথাটা সে আর লিখতে পারছিলো না।অনেকক্ষণ হাঁসফাঁস করে অবশেষে নিরুপমা কাঁপা হাতে লিখলো-

ইতি,
আপনার নীলা

ছোট্ট এই সম্বোধন টা দেখেই নিরুপমার সমস্ত মুখ লজ্জায় রক্তিম হলো।সে আবির ছড়ানো মুখে আরো একবার চিঠিটা পড়লো।তারপরই ঠোঁট চেপে হাসল।জানালার ধারে বসে একটা চড়ুই কিচিরমিচির করছে।নিরুপমা লাজুক হেসে বলল,’আপনার চিঠির অপেক্ষায় থাকলাম মুস্তাফা।’

****
__________________________________________

[দ্বিতীয় অংশ]

হৃদিতার কিছুদিন আগে পরীক্ষা শেষ হয়েছে।পরীক্ষা শেষে সে আর রিজোয়ানা দু’দিনের জন্য রিজোয়ানার বাবার বাড়ি বেড়াতে গেছে।হাশিম গেছে তার এক বন্ধুর বাড়িতে।পুরো বাড়ি বলতে গেলে ফাঁকা।অরুনিমা সকাল থেকে বাড়ির এই মাথা ঐ মাথা ঘুরপাক খাচ্ছিল।অভি কাল থেকে বাইরে।রাতেও আসেনি।অরুনিমা তার মতো ভবঘুরে লোক আর দু’টো দেখে নি।তার যখন মন চায় বাড়ি আসে।কিছুক্ষণ থেকে আবার চলে যায়।সংসার নিয়ে তার কোনো বিকার নেই।

ইদানিং অরুর সাথে একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটছে।ব্যাপারটা নিয়ে সে খুশি হবে নাকি কষ্ট পাবে,সে ভেবে পায় না।সে লক্ষ্য করেছে,অভি বাড়িতে থাকলে তার মন ভালো থাকে।যতোটা সময় অভি বাড়ি থাকে,ততোটা সময় অরুর খুব সুখ সুখ লাগে। মনে হয় চাপা একটা আনন্দ তার সমস্ত শরীরে দৌড়ে বেড়াচ্ছে।কিন্তু অভি চলে গেলেই চিনচিন কষ্টে তার সমস্ত শরীর বিষিয়ে উঠে।অভি যে তার সাথে খুব একটা কথা বলে তা না।কিন্তু যেইটুকুই বলে,অরুর বড়ো ভালো লাগে।

অভি সামনে এলেই তার মনে হয় সে আসলে বাড়ির ভেতর কোনো ঘরে নেই।সে আছে ফুলে ফুলে ভরা একটা বাগানে।যেখানে প্রজাপতিরা উড়ে বেড়াচ্ছে।পাখিরা কিচিরমিচির করে গান গাইছে।আর অভি মুখভর্তি হাসি নিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।অরুর কল্পনা কল্পনাই থেকে যায়।না তার পাশ দিয়ে প্রজাপতি উড়ে,আর না অভি তাকে দেখে হাসে।কি কষ্টের কথা!

সেদিন বিকেলে জাহানারা তাকে তার ঘরে ডেকে পাঠালেন।অরু চুপচাপ তার ঘরে গেল।জাহানারা পান চিবুতে চিবুতে বলল,’অভি দাদুভাই কোথায়?তোমার ঘরে?’

অরু নির্বিকার হয়ে বলল,’না ছাদে।’

‘কি করে?’

‘বিড়ি খায়।’

জাহানারা বেগম থতমত খেলেন।এভাবে সোজাসাপটা কথা বলার কোনো মানে আছে?তিনি থম মেরে বললেন,’তোমার না বর লাগে।এভাবে মানুষ বর রে নিয়া কথা কয়?’

‘অদ্ভুত! ভুল কি বললাম?’

অরুনিমা নিজেও খানিকটা অবাক হলো।এই বাড়িতে সোজা সরল কথার কোনো দাম নাই।স্পষ্ট বাক্য এই বাড়ির মানুষ হজম করতে পারে না।ইনিয়ে বিনিয়ে বললে আবার ঠিকই সহ্য করে নেয়।অদ্ভুত ধাঁচের বাড়ি।

বুড়ির সাথে তার কথা এগোয় না।সে বলার মতো কিছু পায় না।অনেক চেষ্টার পরেও সে তার সাথে ভাব জমাতে ব্যর্থ।হৃদিতা ছাড়া এই বাড়িতে অরুনিমা কারো সাথেই দু’টোর বেশি তিনটে কথা বলে না।

সে বসেছিল চুপচাপ।একেবারে লক্ষী মেয়ের মতো।অভি এলো কিছুক্ষণ পর,এক হাতে ঘাড় মালিশ করতে করতে।ঘরে ঢুকতেই সে সবার প্রথমে অরুনিমাকে দেখে।অথচ এমন ভান ধরল যেন সে তাকে একদমই দেখেনি।অরুকে পাশ কাটিয়ে সে জাহানারার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।ভারিক্কি স্বরে বলে,’দিদান! টাকা দাও।বাইরে যাবো।’

জাহানারা বেগম চোখ পাকালেন।
‘কাল সারারাত তুমি বাইরে ছিলে।এখন আবার বাইরে থাকবে?’

অভি বিরক্তিতে কপাল কুঁচকায়।
‘হ্যাঁ।থাকবো।তোমার সমস্যা কি?টাকা দাও।’

জাহানারা মন খারাপ করে বললেন,’টাকার জন্যই তুমি আমার কাছে আসো।নয়তো তোমার কাছে দিদানের কোনো দাম নাই।’

‘ধ্যাত দিদান।নাটক করো না তো।জলদি টাকা দাও।দেরি হচ্ছে আমার।’

জাহানারা নাক টানতে টানতে বললেন,’তোমার বিয়ে হয়েছে।বউটা সারাদিন বাড়িতে একা একা থাকে।তাকে একটু সময় দিতে পারো না দাদুভাই?’

বিরক্তিতে অভির মুখ খিঁচে আসে।তার সেই কুঁচকানো মুখটা দেখেই অরুনিমা ভেঙচি কাটে।এমনিতেই গুন্ডা মাস্তানদের মতো চেহারা।তার উপর আবার চোখ মুখ কুঁচকে রেখেছে। অরু কে একটু সময় দেওয়ার কথা শুনতেই তার চেহারার এই অবস্থা হয়েছে।কেন?অরু কি কোনো শুয়োপোকা?নাকি বিষধর কাঁকড়া?যত্তোসব!

জাহানারা কড়া গলায় বললেন,’তুমি আজ যেখানে যাবে,তোমার বউকেও সাথে নিয়ে যাবে।আমি আর কিছু জানি না।নয়তো তুমি বাড়ি থাকবে।’

অভি চ কারান্ত শব্দ করল।খুবই রুক্ষ স্বরে বলল,’তুমি রোজ রোজ নতুন নাটক করো দিদান।অসহ্য লাগে।’

সে কথা শেষ করে অরুনিমার দিকে তাকায়।তারপর শ্বাস ছেড়ে বলে,’আচ্ছা ঠিক আছে।নিয়ে যাবো সাথে।’

জাহানারা কিঞ্চিৎ হাসলেন।অভির বউকে তার তুলনামূলক কম পছন্দ।কিন্তু তিনি চান,তাদের একটা সুন্দর সংসার হোক।অভি সারাদিন বাইরে বাইরে থাকলে সংসার হবে কেমন করে?
তিনি বালিশের নিচ থেকে চাবির ছড়া বের করে অভির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,’আলমারির ভেতর দ্বিতীয় তাকে আছে টাকা।নিয়ে নাও যতো লাগে।’

অভি চাবিটা হাতে নিলো।তারপর অবলীলায় হেঁটে গিয়ে আলমারি খুলে তাক থেকে টাকার বান্ডেলটা হাতে নিলো।সেখান থেকে পাঁচশো টাকা বের করে জাহানারার দিকে দেখে বলল,’আমার তিনশোই লাগতো।সাথে অরুনিমা যাচ্ছে বলে আরো দু’শো নিয়েছি।’

জাহানারা বললেন’আরো একশো নাও।’

অভি কথা বাড়ায় না।আরো দু’টো পঞ্চাশ টাকার নোট বের করে আলমারি বন্ধ করে।তারপর জাহানারার কাছে চাবির ছড়া ফিরিয়ে দেয়।

হঠাৎ কিছু মনে আসতেই সে পকেট হাতড়ায়।তারপর দুই পাতা ঔষধ বের করে জাহানারার দিকে এগিয়ে দেয়।তার চোখে মুখে আগের মতোই রাজ্যের বিরক্তি।সে মুখ খিঁচে বলল,’তোমার ঔষধ।আগের পাতা যে শেষ,বলো নি কেন?’

জাহানারা বেগম অভিভূত হলেন।কেমন চমকে গিয়ে ফ্যালফ্যাল করে অভির দিকে চেয়ে থাকলেন।তারপর আস্তে করে বললেন,’তুমি খেয়াল করেছো আমার যে ঔষধ শেষ?’

‘খেয়াল করিনি।টাকা খুঁজতে গিয়ে দেখলাম ঔষধের বক্স খালি।’

একেবারে অকপট স্বীকারোক্তি।হাসবে না হাসবে না করেও অরুনিমা খিলখিলিয়ে হেসে ফেললো।অভি চোখ মুখ শক্ত করে তার দিকে তাকায়।আজব তো! এই মেয়ে এভাবে হাসে কেন?

জাহানারা নিজেও হাসলেন।অথচ তার দুই চোখে ততক্ষণে পানি জমেছে।তিনি খুব যত্ন করে ঔষধের পাতা দু’টো হাতের মুঠোয় নেন।তার ঘরে তো কতোজনই আসে।কিন্তু কেউ তো তার ঔষধের বক্স খুলে দেখে না।যদি সে টাকার জন্যই আসতো,তবে বক্সে কোন ঔষধটা আছে,আর কোনটা নেই সেটা কেমন করে জানতো?

জাহানারা জানে,সে জেনেবুঝেই ঔষধের বাক্সে হাত দিয়েছে।সে এক অদ্ভুত কিসিমের গোয়ার লোক।নিজের অনুভূতি প্রকাশে তার ভয়াবহ কৃপনতা।যাকে সে ভালোবাসে,তাকে সে সবচেয়ে বেশি অবহেলা করে।
.
.
.
.
জগলু দরজা খুলেই প্রশস্ত হাসলো।অরুনিমা নিজেও তাকে দেখে হাসলো।অথচ অভির মুখ থমথমে।জগলুর সাথে চোখাচোখি হতেই বলল,’দিদান বলল একেও যেন সাথে নিয়ে আসি।কি বিরক্তিকর বিষয়! মানা করতে পারি নি।’

জগলু দরজা ছেড়ে দাঁড়ালো।হাসিমুখে বলল,’ভালো হয়েছে।ভালো করেছিস।আয় ভেতরে আয়।’

অভি ভেতরে এলো।শার্টের হাতা গুটিয়ে অরুনিমার দিকে ফিরে বলল,’টিভি দেখবে?’

সে উপরনিচ মাথা নাড়ে।তার মুখে খুশির ঝিলিক।আজ রাতে সে এখানেই থাকবে।ভাবতেই আনন্দ হচ্ছে তার।

জগলু বলল,’আসো অরুনিমা।বসার ঘরে আসো।টিভি ছেড়ে দিচ্ছি।’

টিভি ছাড়তেই অরুনিমা চওড়া করে হাসলো।মুখের খুশি খুশি ভাব বিলীন হলো না একটুও।

‘জগলু! আমি নিজেই চ্যানেল আনতে পারবো।রিমোট দাও তুমি আমাকে।’

জগলু স্মিত হেসে রিমোট টা তার দিকে বাড়িয়ে দিলো।অভি দাঁড়িয়েছিলো খাবার ঘরের সামনে।জগলু তার কাছে যেতেই সে রুক্ষ স্বরে বলল,’দেখ!কেমন গা দুলিয়ে টিভি দেখছে।এর বয়স কি দশ?নাকি পনেরো?এমন বাচ্চা বাচ্চা কাজ কেন করে সে?’

জগলু উত্তরে শুধু হাসে।অভির মুখটা থমথমে।অরুর উপর সে বিরক্ত।অথচ জগলুর মনে হলো এই বিরক্তির মাঝেও বিশেষ কিছু ছিলো।অভি তো তার বিরক্তির ভাগও যাকে তাকে দেয় না।অরুনিমাকে কেন দিচ্ছে?
সে ছাদের সিঁড়িটার দিকে এগিয়ে যায়।যেতে যেতে বলে,’উপরে আয়।ছাদে দাঁড়িয়ে কথা বলবো।’

****
জগলুদের ছাদ টা বেশ ভালো।খুব বেশি গাছ নেই।আবার একেবারে খালিও না।মোট চারটার মতো ফুলের টব আছে।বেলি,নয়নতারা,গোলাপ আর রঙ্গন।দূর থেকে দেখতে ভালো দেখায় খুব।

জগলু গিয়ে রেলিংয়ে পা ঝুলিয়ে বসলো।অভি দাঁড়ালো কার্ণিশ ঘেঁষে।পকেটে সিগারেটের প্যাকেট ছিলো।একটা সিগারেট বের করেই জগলু কে দেখে বলল,’লাইটার দে।’

জগলু বুক পকেট হাতড়ায়।লাইটার পেতেই সেটা অভির সম্মুখে এগিয়ে দেয়।অভি সিগারেটের এক প্রান্তে আগুন ধরিয়ে বড়ো করে টান দিলো।তার সিগারেটের ধোঁয়ায় চারদিক ঝাপসা হয়ে উঠছে।

জগলু আনমনে হাসে।একবার কেশে নিয়ে বলে,’সায়মা আজ সকালে বাড়ি এসেছিলো।তোর খোঁজে।’

অভির ঠোঁটের ভাঁজে তখন সিগারেট,চেপে রেখেছিল আলতো করে।জগলুর কথায় কোনো বিকার দেখালো না।আচরণে বোঝালো,এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।

জগলু রয়ে সয়ে বলল,’সায়মার বুঝজ্ঞান কম।আশা করি ধীরে ধীরে ব্যাপারটা বুঝে যাবে।’

অভি মুখ থেকে সিগারেট সরায়।ফালা ফালা ধোঁয়া আকাশের দিকে ছেড়ে দিয়ে বলে,’শালা মেয়ে মানুষ কি দেখে প্রেমে পড়ে কে জানে।এদের রুচি জঘন্য।’

‘তোকে পছন্দ করে বলে এই কথা বলছিস?’

অভি দীর্ঘশ্বাসে পরিবেশ ভারি করলো।ঘুরে গিয়ে রেলিংয়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালো।ছাদের দরজায় চোখ রেখে বলল,’সেটা মূখ্য বিষয় না।মূখ্য বিষয় হলো আমার বিয়ে।সায়মা জানে আমার বিয়ে হয়েছে।তারপরেও এই দরদ আমার অসহ্য লাগে।’

জগলু ভ্রু তুলে বলল,’তুই ইচ্ছে করে সায়মার সামনে অরুনিমার সাথে বেশি ভালো ব্যবহার করিস।তাই না?’

অভি হাসলো।তাচ্ছিল্য করে হাসা যেটাকে বলে।তারপর ঘাড় কাত করে জগলুকে দেখে বলল,’তবুও তো পিছু ছাড়ছে না।”অভি ভাই” “অভি ভাই” করে হেদিয়ে মরছে।’

জগলুর হাসি পেল আচানক।অভি মুখ শক্ত করে বলল,’হাসবি না।কৌতুক করিনি।’

জগলু মুখে আঙুল চেপে বলল,’আচ্ছা ঠিক আছে।’

অভি নিশ্বাস ছাড়ে শব্দ করে।মাথাটা সামান্য উপরে তুলে আকাশ দেখতে দেখতে বলে,’নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের তীব্র আকর্ষণ।মেয়েদের বোধহয় একটু বেশিই।যেমনটা সায়মার সাথে হচ্ছে,যেমনটা সৃজনীর সাথে হচ্ছে।’

জগলু বলল,’সবটা বুঝেও এমন নির্বিকার থাকিস কেমন করে?’

অভি তার কথার জবাব দিলো পুরোটা সিগারেট শেষ করে।অবশিষ্ট অংশটা ছাদের মেঝেতে ফেলে পা দিয়ে পিষতে পিষতে বলল,’আমি তো এখানে অস্থির হওয়ার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছি না।তারা জেনে বুঝে অগ্নিকুণ্ডে ঝাপ দিচ্ছে।নিজেরাই পুড়ছে,নিজেরাই ভস্ম হয়ে ছাই হচ্ছে।তারপরেও নতুন করে কয়লা হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।এতে আমার কি করার আছে?আমি তাদের আমন্ত্রণ জানাই নি।’

অভির কন্ঠ থেমে এলো।একটু নেড়ে চেড়ে উঠে বরফ শীতল গলায় বলল,’আমি তাদের সসম্মানে মুক্তি দিয়েছি।আমার ধার ঘেঁষার,আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখার সমস্ত পথ বন্ধ করে দিয়েছি।এরপরেও কে আমায় নিয়ে কি ভাবছে তার দায় আমার না।’

বড়ো কঠিন কঠিন কথা।জগলু আর কথা বাড়ায় না।অভিকে একটু গম্ভীর দেখাচ্ছে।সে এমনই।হঠাৎই কেমন অন্যমনস্ক হয়ে উঠে।কিছুক্ষণ ছাদে থেকে সে গা ঝাড়া দিয়ে বলল,’নীচে চল।চাদর আনিনি সাথে।শীত শীত করছে।’

***

জগলুদের বাড়িতে একটা টেলিফোন ছিলো।কালো আর সোনালি রঙের সুন্দর একটা টেলিফোন।অরু সেটা হাতে নিয়ে ফারহানা কে দেখিয়ে বলল,’কাজ করে এই টেলিফোন?’

ফারহানা ঘর গোছানো তে ব্যস্ত।এরই মাঝে এক ঝলক অরুকে দেখে বলল,’অবশ্যই কাজ করে।কাউকে ফোন দিতে চাও?’

‘চাই।আপাকে ফোন দিতে চাই।’

‘দিতে পারো।’

অরু খুব আশা নিয়ে ডায়াল করে।প্রথমবারে কলটা কেউ তুলেনি।দ্বিতীয়বারে তুলেছিল।ফোনের অন্যপাশ থেকে একটা রিনরিনে কন্ঠ ভেসে আসে।নিরু আপার সুমিষ্ট স্বর।অরুনিমা ডাকে,’নিরু আপা! চিনেছো আমায়?’

নিরুপমার কন্ঠে চাঞ্চল্যে এলো হঠাৎ।যেন ঝিমিয়ে পড়া কোনোকিছু ঘুম থেকে জেগে উঠলো।নিরু ফোনটা কানের সাথে চেপে ধরে বলল,’অরু!কেমন আছিস তুই?’

‘ভালো।তুমি কেমন আছো?মা কেমন আছে?আর আমার তুতুন?সে কেমন আছে?’

জড়ানো স্বর টা থেমে থেমে জবাব দেয়,’আছে।সবাই ভালো আছে।’

অভি তখন মাত্রই ছাদ থেকে নেমেছে।আনমনে এদিক সেদিক দেখতেই অরুনিমার দিকে তার চোখ পড়ল।সে লাল নীল শতরঞ্জিতে বসেছিলো।অভির দিকে পিঠ করা।মুখ দেখা যাচ্ছিলো না।টেলিফোন দেখে অভি বুঝলো কারো সাথে কথা বলছে।সে এগিয়ে গেল নিঃশব্দে।

অরু বলল,’আপা! আমার কিন্তু তোমার কাছে একটা জিনিস চাই।’

‘কি?’

অরুনিমার কন্ঠে বেদনার ছাপ।সেই কন্ঠে আরেকটু দুঃখ মিশিয়ে বলল,’জানো আপা! হৃদির পরীক্ষা শেষে সবাই মেলায় গিয়েছিলো।কতোরকমের জিনিস কিনেছে! সবার জন্য উপহারও এনেছে।সৃজনী,তিয়াশা সবার জন্য কিছু না কিছু এনেছে।তারা সবাই কত্ত সুন্দর সুন্দর নুপুর কিনেছে।কিন্তু আমার জন্য কিচ্ছু আনেনি।আমি খুব কষ্ট পেয়েছি আপা।আমাকেও এক জোড়া নূপুর দিতো।তাতে কি তাদের খুব বেশি খরচা হতো?তারা সবাই সেগুলো নেড়েচেড়ে দেখছিলো।আমার বুকে খুব লেগেছে আপা।তুমি তোমার জমানো টাকা থেকে আমায় এক জোড়া নূপুর কিনে দিবে?’

নিরুপমার দিক থেকে জবাব এলো না।অরু অন্যপাশ থেকেই বুঝলো আপা ঠোঁট কামড়ে ধরে কান্না থামাচ্ছে।অরু বলল,’বলো না আপা।দিবে তো?’

নিরু ভাঙা স্বরে বলল,’কে দিব না?অবশ্যই দিবো।বাড়ি আয় সোনা।তোকে আপা দুই জোড়া নূপুর দিবো।কথা দিচ্ছি।’

অরু আলগোছে হাসে।ছোট্ট করে বলে,’আচ্ছা আপা।ধন্যবাদ।এবার বলো আমার তুতুনের কি খবর?কথা শিখেছে সে?’

অভির পা দু’টো মাটিতে গেঁথে ছিলো।সে সম্বিৎ ফিরে পেলো আরো কিছুক্ষণ পরে।তারপরই কেমন অন্যরকম চোখে অরুনিমাকে দেখলো।সে টের পেল তার প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। সেই রাগে তার শরীর জ্বলে যাচ্ছে।একটা চাপা ক্রোধ তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছুটে গেল।সে বড় বড় পায়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।তার রাগ বাড়ছে তরতর করে।দমন করার উপায় অজানা।
.
.
.
.
জগলু আজ বসার ঘরে তোষক বিছিয়ে ঘুমাবে।অরু আর অভি ঘুমাবে তার ঘরে।অরু খাটে বসেই হাই তুলে।অভি এখনো বাড়ি ফিরেনি।সবাই তার অপেক্ষা করছে।সে আসলে খেতে বসবে।অথচ মহাশয়ের কোনো হদিস নেই।তার অপেক্ষায় সবাই না খেয়ে বসে আছে।

অভি আসলো রাত বারোটা বাজার কিছু সময় পূর্বে।হাতে একটা ছোট্ট কাঠের বক্স নিয়ে।বাক্সটা বেশ ছোট,হাতের মুঠোয় জায়গা হয়ে যায় এমন।

সে শোয়ার ঘরে গেল।অরুনিমা তাকে দেখতেই প্রশস্ত হাসলো।অভি তাকালো গম্ভীর হয়ে।অরুর হাসি রোগ আছে।সে চব্বিশ ঘন্টা মুখে হাসি ঝুলিয়ে রাখে।মাঝে মাঝে সেই হাসিতে অভির বিরক্তি ধরে যায়।এই যেমন আজ সে অভির সাথে মহল্লার একটা দোকানে গেল।দোকানদার তাকে কি যেন জিজ্ঞেস করলো।সে খুব হাসিমুখে উত্তর দিলো।অভির পিত্তি জ্বলে উঠল এই দৃশ্য দেখে।দোকানের লোকের সাথে এতো হেসে হেসে কথা বলার কি আছে?দোকানের লোক তার কি লাগে?

সে শব্দ করে বক্সটা কাঠের আসবাবের উপর রাখলো।অরুনিমা একবার সেদিকে দেখে আবার অন্যদিকে ফিরে গেল।কি যে রাগ হলো অভির! সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুইবার শ্বাস নিলো।তারপর বিশাল বিশাল কদমে অরুর সামনে এসে তার একহাত তুলে বাক্সটা তার হাতে ধরিয়ে দিলো।অরুনিমা তাজ্জব হয়ে বাক্সটা দেখে।এটা তাকে দিচ্ছি সে?

কাঠের বাক্সের উপরের অংশ খুলতেই সীমাহীন বিস্ময়ে অরুনিমা থমকে গেল।সে মুখ হা করে আবিষ্কার করল বাক্সের ভেতর এক জোড়া রুপার নুপুর।কি সুন্দর চিকচিক করছে!সে হা হয়েই উপরে তাকায়।ঠোঁট গোল করে বলে,’এগুলা কার?’

অভির কপাল কুঁচকানো।একটু পিছিয়ে গিয়ে বলল,’তোমার।’

‘সত্যিই?আমার?’

অভি খেয়াল করলো প্রচন্ড আনন্দে মেয়েটির দুই চোখ ঝলমল করে উঠেছে।মরিচ বাতি দিয়ে বাড়ি সাজানোর পর পুরো বাড়ি যেমন ঝলমল করে উঠে,অনেকটা ওমন।সে পকেটে হাত গুজে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো।

অরু কতোক্ষণ নূপুর দু’টো হাতে নিয়ে মন ভরে দেখলো।তারপর খুশিতে গদো গদো হয়ে ডাকলো,
‘হামাদ!ও হামাদ! এদিকে এসো না।’

অভি কপালে কয়েকটা ভাঁজ রেখে তার সামনে এলো।তিতিবিরক্ত স্বরে বলল ‘আবার কি?’

অরু হাসে,প্রাণবন্ত মন খোলা হাসি।পা দু’টো খাটের উপর রেখে সালোয়ার টা টান দিয়ে গোড়ালি থেকে সামান্য উঁচুতে তুলে।তারপর বাচ্চাদের মতো স্বরে বলে,’পরিয়ে দাও হামাদ।’

অভি ভ্যাবাচেকা খেল।হতবিহ্বল হয়ে বলল,’কি?কি করবো?’

অরুনিমার কন্ঠ স্বাভাবিক।
‘পরিয়ে দাও।’

‘পাগল নাকি?নিজের টা নিজে পরো।’

‘উহু।আমি হুক খুলতে পারি না।’

‘তাহলে পরতে হবে না।বাড়ি গিয়ে অন্য কাউকে নিয়ে পরিয়ে নিবে।’

অরু দুঃখী দুঃখী মুখে বলল,’তুমি পরালে কি তোমার জাত যাবে?’

‘হ্যাঁ যাবে।’

অভি হনহনিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল।সায়মা এসে মাত্রই দুয়ারে দাঁড়িয়েছে।অভি তাকে দেখতেই থেমে গেল।তার পদযুগল স্থির হলো সহসা।দুই সেকেন্ডের ব্যবধান।তারপর অভি সাথে সাথে ঘুরে দাঁড়ালো।মুখে একটা জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে অরুর দিকে এগিয়ে গেল।অরু তাকে দেখেই প্রশস্ত হাসলো।একবার চোখ ঝাপটা দিয়ে বলল,’তুমি কতো ভালো হামাদ!’

অভি বসলো তার মুখোমুখি।আলতো করে তার একটা পা তুলে নিজের উরুর উপর রাখল।সায়মা ফ্যালফ্যাল করে শুধু দু’জনকে দেখল।

অভি একেবারে ধীরে সুস্থে অরুনিমার দুই পায়ে নুপুর পরায়।পড়াতে গিয়েই তার মনে হলো তার হাত সামান্য কাঁপছে।বুকটাও ধড়ফড় করছে খানিকটা।কিসের এতো ব্যাকুলতা?সে নিবিড় চোখে পা জোড়া দেখে।

একেবারে ফর্সা দু’টো পা।আঙুলের কাছটা টকটকে লাল হয়ে আছে।অভির শ্যাম বর্ণের হাতটা পাশাপাশি নেওয়ায় সেই পায়ের উজ্জ্বলতা আরো বেড়েছে।রূপালি রঙের নূপুরটা পায়ে পরানো মাত্র কেমন চিক চিক করে উঠলো।অভি চোখ তুলে না,সরেও এলো না নিজ থেকে।

অরু হাঁটুতে মাথা ফেলে অভির দিকে তাকিয়ে বলল,’হামাদ! আমাকে কেমন লাগছে বলো তো?’

অভি একটু অপ্রস্তুত হলো।তারপরই একটা শ্বাস ছেড়ে অরুর পা জোড়া খাটের উপর রেখে টেনে টেনে হেসে বলল,’ভালোহ।বেশ ভালো দেখাচ্ছে অরুনিমা।’

চলবে-