কৃষ্ণপক্ষের অন্তিম প্রহর পর্ব-১৯+২০

0
38

#কৃষ্ণপক্ষের_অন্তিম_প্রহর
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

১৯.

নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ চলছে।পাহাড়চূড়ায় শৈত্য প্রবাহ বাড়ছে তিরতির করে।বিকেলের পর আর জ্যাকেট ছাড়া বাইরে বের হওয়া যায় না।রাত একটু গভীর হলেই হাড় কাঁপানো শীতে হাত পা সব জমে যায়।

রাঙামাটির আর্মি ক্যাম্পেও তখন শিশির এসে জমছিলো ঘাসের উপর।সকালে ঘুম থেকে উঠার পরেই শিশিরে ভেজা চকচকে ঘাস দুই চোখে একটা অদ্ভুত আনন্দ দিতো।মাঝে মাঝে এহতেশামের কাছে এই দৃশ্য অপার্থিব বলেই মনে হয়।

এহতেশামের অধীনস্থ রাইডার টিমের প্রশিক্ষণ তখনও চলমান।দৈনিক শ বারের অধিক পুশ আপ,ক্যালিসথেনিকস ব্যায়াম,আত্মরক্ষার প্রয়োজনীয় কৌশল রপ্ত করা,অস্ত্রচালনা,স্নাইপার ট্রেইনিং সবকিছুই এগুচ্ছিলো নিজস্ব গতিতে।দুই দিন পর তাদের প্যারাট্রুপার ট্রেইনিং শুরু হবে।তারপর সারভাইভাল ট্রেইনিং আর সবশেষে গ্রুপ ভিত্তিক প্রশিক্ষণ।

এহতেশাম তার সাতজন ফৌজি কে নিয়ে ভীষণ ব্যস্ততায় দিন অতিবাহিত করছিলো।ভালো ব্যাপার হলো,ইদানিং ছেলে গুলোকে তার মন্দ লাগে না।তারা পারছে না,এই কথা সত্যি।কিন্তু তারা চেষ্টা করছে।এতে কোনো সন্দেহ নেই।এই বার বার চেষ্টা করার ব্যাপারটা ভালো।এহতেশাম তাদের মাঝে একটা ভয়ংকর তেষ্টা খুঁজে পায়।শেখার তেষ্টা,জানার তেষ্টা,কিছু একটা করে দেখানোর তেষ্টা।মেজর মুস্তাফা সেই চোখের ভাষা বোঝে,সেই উদ্যোম একসময় তার ভেতরও ছিলো।অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে অবশেষে সে এইটুকু এসে পৌঁছুলো।আসার পথে সে অনেক কিছু হারিয়েছে।সময় হারিয়েছে,সঙ্গ হারিয়েছে,সঙ্গীও হারিয়েছে।সেইবার একটা অপারেশনে গিয়ে সে কর্ণেল সাবিতকে হারালো।তখন সে সবে ক্যাপ্টেন হয়েছে।বান্দরবানে গেল এক অপারেশনের উদ্দেশ্যে।তার দলনেতা ছিলেন কর্ণেল সাবিত।তরতাজা,সুঠাম দেহের লোকটা হঠাৎ গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।এহতেশাম শুধু বরফের মতো জমে গিয়ে তার মৃ’ত্যুর দৃশ্য দেখেছিল।সাবিতের আর বাড়ি ফেরা হলো না।মৃত্যু কালে তার একটা মেয়ে ছিলো।ছয় বছর বয়স।অথচ সাবিত আর পায়ে হেঁটে মেয়ের কাছে ফিরতে পারলেন না।রক্ত মাংসের মানুষটা চোখের পলকে লা*শ হয়ে গেল।এহতেশাম তো তার সবটাই দেখলো।সেই যে বিয়ে নিয়ে তার ভেতর আতঙ্ক এসে ভর করলো,সে আর দ্বিতীয় বার বিয়ের কথা ভাবে নি।

এই জীবন হলো জুয়ারির জীবন।এখানে অবশ্য টাকা পয়সার বাজি লাগা হয় না।বাজি লাগা হয় জীবনের।বাঁচলে ভালো,তবে শেষ গন্তব্য তো মৃত্যুই।এই এতো গুলো বছরে কতো মৃত্যু দেখেছে এহতেশাম! লাশ দাফনের সময় কতো আহাজারি তার কানে এসেছে! তারপর কঠিন চিত্তের পুরুষ মানুষটি সিদ্ধান্ত নিলো,সে বিয়ে করবে না।কিছুতেই বিয়ে করে গুটিকয়েক জীবন ধ্বংস করে দিবে না।এই মিলিটারি জীবন হলো মরীচিকার মতো।তারা সবাই ছুটছে,তো ছুটছে।অথচ কিসের পেছনে এই নিরন্তর ছুটে চলা,তারা জানে না।

দেশ?একটা টকটকে লাল ফুল?একে রক্ষা করতে এতো মরিয়া তারা?অথচ আনগ্রেটফুল সিটিজেন মনে করে,এই পেশায় থাকা মানুষরা রাজার হালে জীবন যাপন করে।ভাবতেই এহতেশামের তাচ্ছিল্য করে হাসতে মন চায়।কোনোদিন সুযোগ পেলে এদের নিয়ে সে তার তাবুতে আসবে।বেহাল দশায় জীর্ণ হয়ে থাকা তাবুটা দেখিয়ে বলবে,’নাও।দশ দিন এই তাবুতে থাকো।খাবারের মেন্যুতে পাবে শক্ত দুইটা রুটি,আর সামান্য ডাল।তারপর জানতে চাইবে কোন রাজা এমন করে বেঁচে থাকে?’

সূর্য অস্ত গেল আরো কিছুক্ষণ আগে।এখন জোনাক পোকার ডাক কানে আসছে।সবুজ ঘাসের উপর আবারো নিয়ম করে শিশির পড়া শুরু হয়েছে।চারদিক থেকে হু হু করে ঠান্ডা বাতাস ছুটে এসে পাহাড়চূড়ায় ভীড় জমিয়েছে।অফিসার ক্যাডেটরা ক্লান্ত পায়ে হেঁটে যার যার তাবুতে ফিরে গেছে।দু’একজন অবশ্য চা বানাচ্ছিলো কাঠের ভেতর আগুন জ্বালিয়ে।

এহতেশাম পকেটে একটা হাত গুজে পাহাড়ের এদিক সেদিক পায়চারি করছিলো।হাঁটতে হাঁটতে এক সময় ছাই রঙের তাবু গুলোর সামনে এসে থামলো।এদিকে একটু পর পর দূরত্বে কয়েকটা তাবু বসানো।সে আনমনে এর মাঝ দিয়ে হেঁটে যায়।আচমকাই কোনো শব্দ কানে যেতে তার পা জোড়া সতর্কভঙ্গিতে থেমে গেল।মনে হলো কোনো তাবুর ভেতর থেকে অদ্ভুত শব্দ আসছে।কান্না গিলে নিলে কিংবা জোর করে থামিয়ে নিলে যেমন একটা গোঙানির শব্দ হয়,অনেকটা এমন।

এহতেশাম নিঃশব্দে এগিয়ে যায়।তার বুটের শব্দে তাবুর ভেতরের মানুষটা ততক্ষণে সচেতন হয়ে গেছে বোধহয়।কাছে যেতেই আর কোনো শব্দ পেল না।ভেতরটা নিরব,নিস্তব্ধ।একটু আগে যে সেখান থেকে চাপা কান্নার শব্দ এসেছে,সেটা মনেই হলো না।

এহতেশাম গলা খাকারি দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো।ভেতরে কোনো আলো নেই।সবটাই আবছা।কেমন ঘুটঘুটে অন্ধকারে এহতেশামের মুখটা আরো গম্ভীর হয়ে গেলো।তাবুর মাথায় একটা নড়বড়ে বাল্ব ঝুলছিলো।এহতেশাম অনুমানে হাতড়ে তাবুর একপাশে কোনোরকমে পড়ে থাকা সুইচ চেপে বাল্ব জ্বালায়।মুহুর্তেই ছোট্ট তাবুটা নিয়ন বাতির হলদে আলোয় সামান্য উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।

এহতেশাম দেখলো তার সামনে থাকা চৌকিতে কেউ একজন শুয়ে আছে।পা থেকে মাথা অব্দি কম্বল টানা।মুখ দেখা যাচ্ছে না।এহতেশাম নিঃশব্দে এগিয়ে গেল।ছেলেটা টান টান হয়ে শুয়ে আছে।এহতেশামের উপস্থিতি টের পেয়ে বোধহয় নিঃশ্বাসও বন্ধ করে নিয়েছে।

এহতেশাম কম্বল টেনে তাকে জাগালো না।কেবল বগলদাবা করে সটান দাঁড়িয়ে চোখ দু’টো চৌকি পর্যন্ত নামিয়ে আনলো।এটা তন্ময়ের তাবু।ভেতরে পা রেখেই সে তাবুর মালিককে চিনে নিয়েছে।এহতেশাম গম্ভীর হয়ে ডাক দেয়,’তন্ময়।তন্ময়,,তুমি কি শুনতে পাচ্ছো?’

তন্ময়ের দিক থেকে উত্তর এলো না।এহতেশাম দুই চোখে সামান্য কঠোরতা এনে পুনরায় ডাকে,’তন্ময়! এটা ঘুমানোর সময়?সবসময় তুমি রুলস ব্রেক করছো একটার পর একটা।’

বলতে বলতে তার কন্ঠ কাটকাট হয়ে আসে।চোয়ালটাও নিজের মতো করেই শক্ত হয়।থমথমে মুখে সে চেয়ে রয় চৌকির দিকে।

তন্ময় আস্তে করে মুখের সামনে থেকে কম্বল সরালো।এহতেশাম দেখলো,তার চোখ দু’টো টকটকে লাল।দীর্ঘসময় যাবত কান্নার দরুণ চোখ মুখের এই অবস্থা হয়।

সে তড়াক করে উঠে বসল।ব্যতিব্যস্ত হয়ে এদিক সেদিক তাকাচ্ছিল।তার অপ্রকৃতিস্থ আচরণ দেখেই এহতেশাম ছোট করে শ্বাস ছাড়লো।তারপর চেয়ার টেনে তন্ময়ের মুখোমুখি বসলো।

‘কি হয়েছে তন্ময়?কান্না করেছো কেন?’

তন্ময় একটু বিচলিত বোধ করল।একবার অবশ্য অস্থির হয়ে একটা ঢোক গিলল।সে ভেবেছিল তার টিমের অন্য কেউ এসেছে।স্যার যে ঘরে আসবে,সে বুঝতে পারে নি।এখন তার কেমন ভয় ভয় হচ্ছে।স্যার যদি পানিশমেন্ট দেয়?

এহতেশাম ডান দিকে ভ্রু টা উঁচিয়ে ধরে শুধালো,’স্পিক আপ তন্ময়।এই সময়ে শুয়ে শুয়ে কি করছ?এটা নিশ্চয়ই ঘুমানোর সময় না।’

‘জ্বী স্যার।সরি স্যার।’

নিভে আসা ভীতু কন্ঠ।ঘাবড়ে গিয়ে মুখটাও এইটুকু হয়ে গেছে।ডিফেন্সে আলাদা করে মায়া বলতে কিছু নেই।তবে এহতেশামের ভেতরটা একটু নরম হলো তার প্রতি।একটা সূক্ষ্ম অনুভূতি তাকে পুরোপুরি কঠোর হতে দিলো না।এহতেশাম বলল,’কি হয়েছে তন্ময়?কাঁদছিলে কেন?’

তন্ময় চোখ তুলল সহসা।চমকানো দৃষ্টি,অবাক হয়েছে ভীষণ।এহতেশাম স্যার এতো নমনীয় স্বরে কথা বলছেন?বিশ্বাস হলো না পুরোপুরি।একজন কঠোর চিত্তের,নীতিবান,দায়িত্বশীল সেনা সদস্যের কন্ঠে এই কোমলতা সচরাচর দেখা যায় না।

তন্ময় কেমন যেন ভরসা পেল।প্রচন্ড গরমে অতিষ্ঠ হয়ে উঠা মুসাফির বিশালাকার বট বৃক্ষের ছায়াতলে যেমন শান্তি অনুভূত করে,অনেকটা এমন।মনের ভিতর অনেক গুলো বাক্য জমতে জমতে পৃষ্ঠা বাড়ছিলো।অথচ বলার মানুষ ছিলো না।শরীর পোড়ানো দীর্ঘশ্বাস গোনার মতো মানুষের অভাবে তন্ময়কে কাঁদতে হয়েছিল খড়খড়ে কম্বলের নিচে মুখ চেপে।

সে একটু নড়েচড়ে উঠলো।গলাটা বসে গিয়েছিল।দুইবার কাশতেই আগের অবস্থায় ফিরে এলো।তন্ময় সোজা হয়ে বলল,’স্যার।আমার আব্বু কাল রাতে স্ট্রোক করেছে।এখন আইসিইউ তে।’

শেষ বাক্যে এসেই তার কন্ঠ ভেঙে এলো।কি অদ্ভুত যন্ত্রনা! কি ভীষণ হাহাকার! এহতেশাম দেখলো ছেলেটার দুই চোখ ছেপে নোনা জল চিকচিক করছে।তার কন্ঠ কাঁপছিলো।অথচ এহতেশাম ছিলো নির্বিকার।এমন কতো ঘটনার সাক্ষী সে হয়েছে,তার ইয়াত্তা নেই।

সে পুরু স্বরে বলল,’এখন কি অবস্থা?’

‘কোনো উন্নতি নেই স্যার।’

এহতেশাম নিরব থাকে।কেবল বার কয়েক ছেলেটার চোখ মুখ দেখে।কি নিষ্পাপ একটা মুখ! বয়স কতো হবে?বিশের বেশি তো কোনো ভাবেই হবে না।বাচ্চা একটা ছেলে।নিশ্চয়ই বাড়িতে কথা বলার জন্য ভেতরটা ছটফট করছে।অথচ রেস্ট্রিকটশানে ভরপুর মিলিটারি জীবনের জঞ্জাল ছিঁড়ে বাড়িতে ফোন দেওয়া সম্ভব না।

সে হাত বাড়িয়ে তন্ময়ের কাঁধ ছোঁয়।স্বান্তনা দেওয়া তার পেশাদারিত্বের ভেতর পড়ে না।অথচ তন্ময়ের বিষন্ন মুখটা দেখে আপনাআপনি তার ভেতর সহানুভূতির সঞ্চার হয়।এহতেশাম নিরেট স্বরে বলল,’আল্লাহর উপর ভরসা রাখো তন্ময়।যা হবে,ভালোই হবে।’

তন্ময় আচমকাই আগ বাড়িয়ে একটা কাজ করলো।অনধিকার চর্চার মতোই বাজে একটা কাজ।সে দুই হাতে শক্ত করে এহতেশাম কে জড়িয়ে ধরল।বাচ্চাদের মতো কেঁদে উঠে বলল,’আসার আগে বাবার সাথে কথা হয় নি।বাবার সাথে কি আরেকবার দেখা হবে না স্যার?আমি কি আর কখনো আমার আব্বার মুখ দেখতে পারবো না?’

একেবারে জোরালো আলিঙ্গন।এহতেশাম শুরুতে কিছুটা অপ্রস্তুত ছিলো।তারপর সময় গড়াতেই স্বাভাবিক হলো।তবে আগ বাড়িয়ে নিজ থেকে তন্ময়ের পিঠে হাত রাখলো না।এদিকে মায়া দয়ার পাল্লা বেশি ভারি করতে নেই।এহতেশাম ইতোমধ্যেই পাল্লায় ওজনের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে।আর না।

তন্ময়ের হুশ ফিরল আরো পরে।যখন সে অনুধাবন করলো,তার সামনে থাকা মানুষটি একজন মেজর,আর সম্পর্কে তার শিক্ষক,তখনই সে ছিটকে দূরে সরে এলো।দুই চোখ মুছে মুখটা শক্ত করে বলল,’সরি স্যার।সরি।’

এহতেশাম গাঢ় দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায়।তারপর বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে চাপা স্বরে উত্তর দেয়,’ইটস ওকে।উঠে বসো।এখনও ঘুমের সময় হয় নি।’

‘জ্বী স্যার।’

তন্ময় চোখ মুছে আরো একবার।এহতেশাম বুট জুতার ঠক ঠক শব্দ ফেলে তাবু থেকে বেরিয়ে এলো।আজ একবার মা কে ফোন দিতে হবে।সপ্তাহে একদিনই সে বাড়িতে ফোন দেয়।চাইলে রোজই দিতে পারে।কিন্তু একবার দিতেই তার বেশি ভালো লাগে।অনেক কথা জমিয়ে,অনেকটা সময় পর ফোন দিলে কথা বলে শান্তি পাওয়া যায়।

আজ আরো একটা কাজ করতে হবে।ডাক থেকে দু’দিন আগে চিঠি এসেছিলো।সেটা এখনো খুলে দেখা হয়নি।আজ হাতে সময় আছে।সবাই ঘুমানোর পর সেটা খুলে দেখা যাবে।ফিরতি চিঠিও লিখা যাবে।এহতেশাম মুচকি হাসলো।চিঠির ব্যাপারটা মাথায় আসলেই সে কেমন যেন অদ্ভুত আচরণ করে।বয়সটা হুট করেই বিশের কোটায় নেমে আসে।তখন আর তার নিজেকে ভাব গাম্ভীর্যপূর্ণ সেনা অফিসার বলে মনে হয় না।মনে হয় সেও রক্ত মাংসে গড়া একজন সাধারণ সিভিলিয়ান।যার ভেতর অনুভূতি আছে,দুই চারটে জমানো কথা আছে।বড় বড় কয়েকটা দীর্ঘশ্বাস আছে।

সেই রাতে আনুমানিক দেড়টার দিকে খবর এলো,তন্ময়ের বাবা আর বেঁচে নেই।ক্যাপ্টেন আশিক খবরটা এহতেশামের কাছে পৌঁছানো মাত্র এহতেশামের বুক ভারি হয়ে এলো।আনমনে বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাসও বেরিয়ে এলো বোধহয়।সে কেবল ক্ষীণ কন্ঠে বলল,’আপাতত তন্ময় কে কিছু বলার দরকার নেই আশিক।কাল পরশু আমি নিজেই তাকে জানাবো।’

ক্যাপ্টেন আশিক সামনের দিকে এগিয়ে গেলো।এহতেশাম গিয়ে দাঁড়ালো পাহাড়ের একেবারে শেষ মাথায়।পরনে তার আর্মি গ্রীন জ্যাকেট।তবুও সেই আস্তরণ ভেদ করে গা হিম করা প্রবাহ ভেতরে প্রবেশ করছে।এই ক্যাম্প,এই ক্যাম্পের মানুষ,এই মানুষদের শত শত গল্প কেমন যেন ক্ষণস্থায়ী মেঘের মতো,ভাসা ভাসা হয়ে উড়ে যাচ্ছে।সিভিলিয়ান রা জানছে না,টের পাচ্ছে না।পাহাড়ের গায়ে গভীরভাবে হাহাকার আর দীর্ঘশ্বাস গুলো লেপ্টে ছিলো।এই শিশির জমা ঘাস গুলো ছুঁয়ে দিলেই কি সেই দীর্ঘশ্বাস টের পাওয়া যায় না?কঠোর অনুশীলন আর যাযাবর জীবনযাপন করতে করতে অনুভূতিদের বিসর্জন দেওয়ার এই অগণিত গল্প সবুজে ঢাকা অচলের পরতে পরতে লিখে রাখা আছে।কেউ না জানুক,এই পাহাড় আর আকাশ জানুক,একটি ফুলকে বাঁচাতে গিয়ে কতোগুলো ফুল কাঁটা রূপে পরিবর্তিত হয়েছে।
___
.
.
.
‘হামাদ! হামাদ!’

রিনরিনে মেয়েলি স্বরটা সদ্য কেনা টেপরেকর্ডারের মতো একাধারে বাজতেই থাকে।সে কাউকে একবার ডেকেই ক্ষ্যান্ত হয় না।কয়েক দফা একই নাম উচ্চারণ না করলে তার একদমই শান্তি লাগে না।অরুনিমা আরো একবার ডাকে,’হামাদ! ও হামাদ।’

অভি তখন ঘরে।আধশোয়া হয়ে চোখ বুজেছিল।বার বার অরুর ডাক শুনে তার মেজাজ খারাপ হচ্ছিল।এই মেয়ের কিছু বৈশিষ্ট্য অভির প্রচন্ড বিরক্তির কারণ।তার মধ্যে একটা হলো সারাদিন তাকে নাম ধরে ডাকা।সে বাড়িতে পা রাখা মাত্র সে হামাদ হামাদ করতেই থাকে।কি বিরক্তিকর বিষয়!

অরু চঞ্চল পায়ে ঘরে এলো।বলল,’হামাদ! ও হামাদ!’

‘হামাদ ম’রে গেছে।এবার একটু চুপ থাকো।’

অরু থতমত খায়।দুই চোখ সরু করে বলল,’তুমি শুধু শুধু ঘুমের ভান ধরলে কেন?তুমি তো ঘুমাও নি।’

অভি মুখের সামনে থেকে হাত সরালো না।দুই চোখ বুজেই গম্ভীর পুরুষালি কন্ঠে বলল,’যেন তুমি বেহুদা বকবক না করো।তুমি কি এতোদিনেও বুঝতে পারছো না যে আমার বেশি কথা পছন্দ না?’

অরু ঠোঁট বাঁকা করে হাসল।এগিয়ে এসে বলল,’বেশি কথা বলিনি তো।তুমি একবার চোখ খোলো।এদিকে তাকাও।’

অভি চোখ খোলে।পূর্ণ দৃষ্টিতে সামনে তাকায়।অরু তার হাত দু’টো অভির সামনে প্রসারিত করে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে থাকে।অভি দেখলো,তার হাতে আজ সে মেহেদি দিয়েছে।এখনও তোলা হয় নি।তবে কিছুক্ষণেই শুকিয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে।অভি নাক কুঁচকে বলল,’মেহেদি দিয়েছো?’

‘উহু।হৃদি দিয়ে দিলো।’

‘তো আমাকে দেখাচ্ছ কেন?আমি দেখে কি করব?’

অভি মুখটা বিকৃত করে সামনে তাকায়।অরুনিমা দেখলো,তার মুখের পরতে পরতে শুধু বিরক্তি আর বিরক্তি।সে মন খারাপ করে বলল,’তোমাকে দেখাবো না?মেহেদি দিয়ে যদি অন্যজনকে নাই দেখাই,তবে মেহেদি পরে লাভ টা কি?’

অভি গমগমে স্বরে বলল,’বাড়িতে কি দেখানোর মানুষের অভাব আছে?যতোসব আলতু ফালতু কাজ!’

অরুর মন খারাপ হলো।যেমন তেমন মন খারাপ না।ভীষণ ভীষণ মন খারাপ।অভি সবসময় তার সাথে এভাবে কথা বলে।সে মাথা নিচু করে মিনমিন করে বলল,’ঠিক আছে।আর আসবো না তোমার কাছে।’

অভি স্থির চোখে তার দিকে তাকালো।দেখলো মেয়েটা মন খারাপ করে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে।অজ্ঞাত কারণে অভির এই ব্যাপারটা ভালো লাগলো না।কেন যেন তার নিজেরও মন খারাপ হলো কিছুটা।সে খাট থেকে উঠে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়।অরু তাকে দেখতেই সামান্য সরে এলো।

অভি গলা ঝেড়ে বলল,’দেখি তো।হৃদি তোমায় কেমন মেহেদি দিয়েছে দেখি।’

মুহূর্তেই চওড়া হাসিতে অরুর মুখ ভরে এলো।সে সাথে সাথে দুই হাত মেলে দিয়ে বলল,’দেখো দেখো।কেমন হয়েছে বলো?’

অভি তাকালো।দেখলো অরুনিমার দুই হাতের পাতায় বেশ সুন্দর করে মেহেদি দেওয়া।মেহেদি শুকিয়ে এই মুহূর্তে কেমন কালচে দেখাচ্ছে।মেহেদির মাঝখানে গোটা গোটা অক্ষরে A লিখা।
অভি সামনে দেখে বলল,’হাতের মধ্যে বরের নাম লিখা খুবই উদ্ভট একটা ব্যাপার।আমার এটা বিরক্ত লাগে।’

‘বরের নাম কে লিখলো?’

‘এই যে তুমি।Abhi নামের A লিখেছো।কি বিরক্তিকর ব্যাপার!’

অরু খিলখিলিয়ে কতোক্ষণ হাসল।হাসতে হাসতেই অভির দিকে ফিরে বলল,’বোকা! এটা অরুনিমার প্রথম অক্ষর।তোমার নামের প্রথম অক্ষর না।হিহিহি।তুমি কি ভেবেছো,আমি তোমার নাম হাতে লিখে ঘুরছি?’

অভি থতমত খেয়ে অন্য দিকে ফিরে গেল।মন চাইছে মাথার চুল গুলো টেনে ছিঁড়ে ফেলতে।কি দরকার ছিলো আগ বাড়িয়ে কথা বলার?এখন হলো তো অপমান।

অরু হাসি থামিয়ে বলল,’সমস্যা নাই।ঈদে মেহেদি দিলে তোমার নাম লিখেই দিব।’

‘তার কোনো প্রয়োজন নেই।’

‘কেন?তুমি চাও না আমি হাতে তোমার নাম লিখি?’

‘নাহ্।’

‘কেন?’

‘ধ্যাত! বেশি কথা বলো তুমি।’

অরু ব্যাকুল সুরে ডাকে,’হামাদ! শুনো না।’

‘কিহ্?’

‘তুমি কি আমাকে একটুও পছন্দ করো না?’

‘নাহ্।’

‘কেন?’

অভি মাথা নামিয়ে বলল,’এসব পছন্দ টছন্দের বিষয় আমার মধ্যে নাই।’

‘জগলু কে তো তুমি পছন্দ করো।’

অভি কিঞ্চিৎ হাসল।বলল,’তা করি।তুমি এতো বছর সাথে থাকলে তোমাকেও করবো।’

অরুনিমা হাসিমুখে বলল,’আমি থাকবো তো।এই তোমার গা ছুঁয়ে বললাম,আমি থাকবো।’

খুবই সাধারণ একটা কথা।বিস্মিত হওয়া,কিংবা অভিভূত হওয়ার মতো কিছুই এর মাঝে ছিলো না।অথচ অভি সত্যি সত্যি বিস্মিত হলো।একটা মেয়ে তার শরীর ছুঁয়ে বলছে,সে তার সাথে থাকবে।এটা কি অবাক হওয়ার মতো বিষয় না?
যেই মেয়েটা বিয়ের পর অভিকে ছুরি দিয়ে প্রহার করতে চেয়েছিল,সেই মেয়েটা যখন এই কথা বলে,তখন অভির মনে হয় এতে অবাক হওয়ার মতো অনেক কিছুই আছে।সে পাশ ফিরে,ভালো করে চেয়ে দেখে অরুনিমার মুখে স্নিগ্ধ হাসি খেলা করছে।

অভি একটু হাসল।বিদ্রুপের সুরে বলল,’তুমি কিন্তু ভুলে গেলে অরুনিমা।আমার কিন্তু এতটা অতীত আছে।খুবই বাজে অতীত।’

‘হোক।জগলু বলেছে,অতীত ভুলে শুধু চোখের সামনে যা দেখছি,সেটাই বিশ্বাস করতে।’

‘বাহ্।তো চোখের সামনে কি দেখলে?’

অরু একগাল হাসলো।অভির মনে হলো এতো নিষ্পাপ হাসি সে এর আগে দেখেনি।কি অদ্ভুত! এই মেয়েটা এতো বাচ্চা বাচ্চা কেন?বয়স তো কম হয় নি।অথচ তার আচরণ,তার হাসি,তার কন্ঠ,,সবকিছুতেই একটা কিশোরী ভাবের প্রতিফলন পরিলক্ষিত হয়।

‘আমার তো তোমায় ভালোই লাগে।তুমি আমায় বকুনি দাও,কিন্তু মায়ের মতো ঠাস ঠাস মারো না।তুমি আমায় কত্তো সুন্দর নূপুর কিনে দিয়েছো! তুমি আমায় জগলুদের বাড়ি নিয়ে গেছো,তোমার সাথে ঘুমুতে দিয়েছো।’

অভি বিষম খেল।অরু খানিকটা অবাক হয়ে বলল,’সেকি! কাশছো কেন?’

অভি কাশি থামায়।তারপর দ্রুত মাথা নামিয়ে অল্প হাসে।অরুনিমা অবশ্য সেই সূক্ষ্ম হাসি দেখতে পেল না।পরক্ষণেই বেশ গম্ভীর হয়ে অভি বলল,’দয়া করে শেষ কারণ টা আর কারো সামনে বলবে না।বললে আর ঘুমুতে দিবো না আমার সাথে।’

বলা শেষ করেই সে তাড়াহুড়ো করে ঘরে চলে এলো।কি অদ্ভুত! তার আজ এমন হাসি পাচ্ছে কেন?

***

রিজোয়ানা রাতের জন্য হরিণের মাংস রান্না করেছিলেন।অরু সন্ধ্যার পর থেকে রান্নাঘরের আশেপাশে ঘুরঘুর করছিলো,আর টেনে টেনে ঘ্রাণ নিচ্ছিলো।তাদের বাড়িতে একবারই হরিণের মাংস রান্না হয়েছিল।তুতুনের দ্বিতীয় জন্মদিনে।এরপর আর রান্না হয় নি।অথচ শিকদার বাড়িতে দুই একদিন পর পর এই খাবার রান্না করা হয়।অরুর যে কি আফসোস হয়! মন চায় একটুখানি খাবার বাসার জন্য নিয়ে যেতে।

রাত নয়টার দিকে টেবিলে খাবার পরিবেশন করা হলো।অরুর তখন দুই হাতে মেহেদি।হাতের একপাশ শুকিয়ে যাওয়ার পর সে অন্য পাশেও মেহেদি দিয়েছে।হৃদি বলল,’ভাবি! তুমি এখন খাবে কেমন করে?’

অরু বলল,’সমস্যা নেই হৃদি।তোমাদের শেষ হোক।আমি আরেকটু পরে বসবো।’

অভি ডান দিকের চেয়ারটা টেনে টেবিলে বসল।আজ আর তার বাইরে যেতে ইচ্ছে হয়নি।কোনো কারণে মাথাটা ভীষণ ধরে আছে।ঝিম ঝিম করছে বোধহয়।সে চাপা স্বরে বলল,’এখন খাবে না তো কখন খাবে?তুলে ফেলো মেহেদি।’

‘না না।এখন তুললে রং হবে না।’

অভি চোখ বাঁকা করে একবার তার দিকে তাকালো।অরু একটা শুকনো ঢোক গিলে বলল,’রাগ হও কেন?কতোদিন পর মেহেদি দিয়েছি! নিজের বিয়েতেও তো মেহেদি দেই নি।’

‘কেন দাও নি?আমি মানা করেছিলাম?’

‘ভয়ে দেইনি।ভেবেছি তুমি বিয়ের রাতেই মেরে কুচি কুচি করে দিবে আমায়।’

হৃদিতা ফিক করে হেসে দিলো।সাথে সাথেই আবার মুখে ওড়না চেপে খেতে বসলো।জাহানারা নিচে এলেন একটু পরে।হুসেইন সাহেব তাকে ধরে ধরে নিচে নামিয়েছেন।সবাই যার যার চেয়ারে বসতেই অভি গলা খাকারি দিলো।অরুনিমার দিকে চোখ না তুলেই বলল,’এদিকে বসো অরুনিমা।আমি খাইয়ে দিচ্ছি।’

জাহানারা চমকের পিলে দু’জনের দিকে তাকান।রিজোয়ানা নিজেও খানিকটা আশ্চর্য হলেন।অভি একটা মেয়ে কে এই কথা বলছে! বউ হোক আর যাই হোক,এমন অভিভাবকসুলভ আচরণ অভির সাথে যায় নাকি?

অরুনিমা হাসি হাসি মুখ করে অভির বা পাশের চেয়ারে গিয়ে বসলো।অভি আর কারো দিকে তাকানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলো না।সে নিজের খাবার শেষ করে অরুনিমার প্লেটে ভাত নিলো।

খাওয়াতে গিয়েই তার চোখে পড়ল কয়েকটা চুল অরুর মুখের উপর এসে পড়েছে।সে খুব স্বাভাবিক ভাবে হাত বাড়িয়ে চুল গুলো সরিয়ে দিলো।কন্ঠে কিছুটা বিরক্তি ঢেলে বলল,’চুল বাঁধবে সুন্দর করে।কেমন পাগল পাগল লাগে দেখতে।’

বলা শেষেই সে একটা লোকমা তুলে অরুর মুখের সামনে ধরল।অরু খেতে খেতে তৃপ্তির সুরে বলল,’মাংসটা খুব ভালো হয়েছে চাচিজান।আপনার হাতে যাদু আছে সত্যি।’

অভি ঈষৎ ধমকে উঠে বলল,’চুপ করে খাও না।খেতে খেতে এতো বকবক করো কেন?’

জাহানারা ভীষণ তৃপ্তি নিয়ে দু’জনকে দেখলেন।হৃদিতা তার দিকে ঝুঁকে ফিসফিস করে বলল,’ভাইজান কেমন একটু পাল্টে যাচ্ছে।তাই না দিদান?’

জাহানারা হাসলেন।হৃদির মতোই চাপা স্বরে বললেন,’আমার দাদুভাই খারাপ ছিলো কবে?সে তো চিরকালই এমন।গম্ভীর,গোয়ার,কিন্তু যাকে মন থেকে মেনে নেয়,তার জন্য খুব বেশি যত্নবান।’

চলবে-

#কৃষ্ণপক্ষের_অন্তিম_প্রহর
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

১৯.
বর্ধিতাংশ

নিরুপমা মাথা নামিয়ে তার কোলের উপর রাখা হাত দু’টো দেখছিলো।তার ওজন কি আরো কিছুটা কমেছে?হাত দু’টো কেমন যে জীর্ণ দেখাচ্ছে আগের তুলনায়।দু’টো দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে আস্তে করে মাথা তুলল।ঘরের দেয়ালজুড়ে থাকা তৈলচিত্র গুলো বরাবরই তার কাছে বেশ আকর্ষণীয় লাগে।নিরুপমা মনে করে একবার দেয়ালে ঝুলানো বর্ষপঞ্জির দিকে মন দেয়।শেষবার যখন এসেছিলো,তখন সেটা এক বছর পিছিয়ে ছিলো।আশ্চর্য! এখনো সেটা ২০০১ এর অক্টোবরে আটকে আছে।অথচ কিছুদিন বাদেই ২০০২ শেষ হবে।নিরুপমার আবারো ইচ্ছে এলো উঠে গিয়ে ক্যালেন্ডারটা দেয়াল থেকে খুলে আনতে।কিন্তু অনধিকার চর্চায় তার বরাবরই অনীহা।

সে চোখ নামায় পুনরায়।শুভ্র সুন্দর হাতের দিকে দৃষ্টি নত করে রাখাই তার নিকট শ্রেয় মনে হচ্ছে।এই মুহূর্তে সে বসে আছে অরুর প্রকান্ড শ্বশুর বাড়ির বিশালাকার হল ঘরে।

অভি তখন বাড়ি ছিলো না।অরু আর সে নাকি কোথায় গিয়েছে।শোনামাত্র নিরুর ভেতরটা অদ্ভুত আনন্দে নেচে উঠল।বিয়ের দিন মেয়েটা কেমন করে কাঁদছিলো।নিরুপমা তো ভেবেছিলো সে এই সংসার কিছুতেই করতে পারবে না।অথচ সে সংসার করছে।দিব্যি সংসার করছে।নিরু প্রার্থনা করে,এটা যেন প্রকৃত অর্থেই সংসারের মতো সংসার হয়।

বিয়ের পর হয়তো জীবনটা খুব বেশি সুন্দর হয়,নয়তো হয় খুব বেশি বর্বর।নিরুর হয়েছিল খুব বেশি বর্বর।কিন্তু আল্লাহ নিশ্চয়ই অরুর কপালে এমন কিছু রাখবে না।অরুর একটা মিষ্টি সংসার হবে।হামাদ সাহেবের গাম্ভীর্য আর অরুনিমার হাসির ঝংকারে সেই সংসার পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে।নিরুপমা চোখ ভরে সেই দৃশ্য দেখবে।সে সংসার দেখেনি।বিয়ের পর দু’টো ভিন্ন স্বত্তা মিলেমিশে একাকার হলে,তাদের কেমন দেখায়,নিরু জানে না।প্রিয়তম বলতে কি বোঝায়,সেটাও তার জানা নেই।অরুকে দেখে সে আস্তে আস্তে জানবে,বুঝবে।অরুর একটা স্বপ্নের মতো সংসার হবে।আর নিরুপমা ফ্যালফ্যাল করে,আর্দ্র চোখে সেই সংসার দেখবে।অরুকে সুখী হিসেবে দেখা নিরুর এক জনমের সাধ।

অরুনিমা আর অভির বাড়ি ফিরতে আরো এক ঘন্টা দেরি হলো।বাড়িতে নিরুপমা আসার খবরটা কানে যাওয়া মাত্র অরুনিমার চোখ মুখ খুশিতে জ্বল জ্বল করে উঠল।
নিরু আপা এসেছে।কি মজা! কি মজা!
সে উচ্ছ্বসিত মুখে ছুটে যায় বসার ঘরের দিকে।অভি তার আনন্দ উপচে পড়া মুখটা দেখে।তারপর দেখে তার চঞ্চল পদচারণা।চোখে পড়তেই কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলল,’আশ্চর্য! এভাবে ছুটছো কেন?পড়ে যাবে তো।’

অরু পড়লো ঠিকই।একটু সামনে যেতেই কাঠের আসবাবে হোঁচট খেয়ে হুড়মুড় করে মেঝেতে গিয়ে পড়লো।অভি চোখ মুখ শক্ত করে তার কর্মকাণ্ড দেখে।তারপর হনহনিয়ে নিজের ঘরের দিকে পা চালায়।
অরু অবশ্য ব্যাথা নিয়ে মাথা ঘামালো না।এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে সে আগের মতো ছুট দেয় হল ঘরের দিকে।আজ তার বিশাল আনন্দের দিন।আজ বাড়িতে তার আপা এসেছে।

‘নিরু আপা! আমার আপা!’

মেয়েটির কন্ঠস্বর থেমে থেমে আসছিলো।অনেক্ষণ যাবত দৌড়াতে দৌড়াতে শ্বাস উঠে গেছে।গলায় স্বরে কেমন উৎকন্ঠার ভাব।নিরু চকিতে মাথা তুলে।অবাক হয়ে দেখে,অরুনিমা বাচ্চাদের মতো ছুটে ছুটে তার কাছে আসছে।নিরুর হঠাৎই মনে হলো,তার সামনে থাকা মেয়েটা কোনো বিবাহিত রমণী না।বরং তার ছোট্ট বোন অরুনিমা।যে সমতট লেনের আঁকাবাঁকা গলিতে বিকেলের খেলা শেষ করে এক দৌড়ে নিরুপমার বুকে এসে ঝাঁপিয়ে পড়তো।

অরু তাকে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে।ঐ অবিকল ছোট বেলার মতো।তারপরই বাচ্চাদের মতো গদো গদো হয়ে বলল,’আপা গো।তুমি এসেছো।তোমার কথা কতো মনে পড়ে আমার জানো?’

নিরু তার মাথায় হাত বুলায়।কিছুক্ষণ চুপ থেকে তারপর গাঢ় স্বরে বলে,’জানি তো সোনা।সেজন্যই তো তোকে আর হামাদ সাহেব কে নিয়ে যেতে এসেছি।’

অরুনিমা মাথা তুলল প্রায় সঙ্গে সঙ্গে।চোখ জুড়ে বিস্ময়,আবার কিছুটা চাপা আনন্দের আভাস।অবিশ্বাস্য সুরে শুধায়,’সত্যি আপা?তুমি আমাদের নিয়ে যাবে?’

‘তো?বিয়ের পর তো একবারও সেখানে যাসনি।আমরা বুঝি জামাই আদর করবো না।হু?’

অরু তাড়াহুড়ো করে উপরনিচ মাথা নাড়লো।
‘তাই তো?হামাদের তো এখনও জামাই আদর হয় নি।’

নিরুপমা চোখ পাকিয়ে বলল,’কিরে! বর কে নাম ধরে ডাকিস নাকি?’

‘হ্যাঁ।’

‘বাবাহ্।তোর রাগী বর কিছু বলে না।’

‘উহু।’

অরু নিজ থেকেই আগ বাড়িয়ে বলল,’জানো আপা।আমরা মাত্র জগলুদের বাড়ি থেকে এলাম।’

‘জগলুটা কে?’

‘চিনবে না তুমি।হামাদের বন্ধু।আমারও বন্ধু।তাদের বাড়িতে টিভি আছে।আমি সেখানে সিনেমা দেখি।”

‘কি অদ্ভুত! তোদের বাড়িতেই তো এত্তো বড় টেলিভিশন আছে।আরেক বাড়িতে যাওয়ার কি প্রয়োজন?’

‘সে অনেক কথা আপা।কোনোদিন সময় পেলে খুলে বলবো নে।’

নিরুপমা একটা হাত তার মাথায় রেখে আদুরে গলায় জানতে চাইলো,’হ্যাঁ রে অরু,তুই সুখে আছিস তো?’

অরু মিষ্টি করে হাসলো।মুখের হাসি মিলিয়ে যাওয়ার আগেই আমুদে স্বরে বলল,’আছি।হামাদ আমায় একবারও মারে নি আপা।রাহাত ভাই তো তোমায় খুব মারতো।’

নিরুপমার মুখটা হঠাৎই কেমন অন্যরকম হয়ে গেল।দীপ্তিমান মুখশ্রীটা আচমকাই অমাবস্যার ঘোর অমানিশায় গ্রাস হলো।বুকের ভেতর সূক্ষ্ম যন্ত্রণায় নিরুর চোখ ঝাপসা হলো।অরুনিমা কথাটা বলেই অন্যমনস্ক হয়ে গেল।নিরু জানে,অরু ছলনা বোঝে না।মনস্তাত্ত্বিক জটিলতাও সে বোঝে না।বুঝলে তার আপাকে সে কোনোদিনও কষ্ট দিতো না।তবে তার এই মন না বুঝতে পারা, মাঝে মাঝে অন্য মানুষের মন খারাপের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।নিরু তাড়াহুড়ো করে চোখ মুছে।সে কি পাগল?অরু একটা বাচ্চা মেয়ে।ঐটুকু মেয়ের সাথে কেউ অভিমান করতে পারে?

অভি হলঘরে এলো আরো কিছু সময় পরে।বাড়ি ফিরেই সে আগে গোসল সেরেছে।তাকে দেখতেই অরুনিমা ছটফটে হয়ে বলল,’হামাদ জানো?আপা আমাদের দাওয়াত দিতে এসেছে।’

অভি কপাল ভাঁজ করে বলল,’কিসের দাওয়াত?’

‘বিয়ের পর নাকি কিসব দাওয়াত করতে হয়।’

নিরু চোখ রাঙালো ভীষণ করে।অরু সেই রাগান্বিত চোখ জোড়া দেখেই মুখে আঙুল চাপলো।মেঝে থেকে উঠে গিয়ে নিরুপমার পাশাপাশি সোফাতে বসলো।তারপর মিনমিনে স্বরে বলল,’সরি আপা।আর কথা বলবো না।তুমি বলো।’

নিরুপমা সামনে ফিরে।একবার গলা খাকারি দিয়ে কন্ঠ পরিষ্কার করে বলল,’আসলে আপনার আর অরুর বিয়ের পর আপনারা একবারও আমাদের বাড়ি বেড়াতে আসেন নি।তাই মা বলছিলো,এবার যেন কিছুদিনের জন্য এসে আপনি আর অরু আমাদের এখানে থেকে যান।’

নিরুপমা থামলো।একবার চোখ তুলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে অভির দিকে তাকালো।অভি বোধ হয় কিছুটা বিরক্তই হলো।তবে পুরোপুরি প্রকাশ করল না।ভদ্রতা দেখিয়ে চুপচাপ থম মেরে বসে থাকল।শেষে আস্তে করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,’অরুনিমা যাবে না হয়।সমস্যা নেই।তবে আমি যেতে পারবো না।আমার সময় হবে না।’

অরু নখ কামড়াতে কামড়াতে তার কথা শুনে।অদ্ভুত লোক!সময় হবে না মানে?সারাদিনই তো বেকার ঘরে বসে থাকে।নয়তো পাড়ার মোড়ে গিয়ে মারপিট করে।এর আবার সময়ের অভাব হলো কেমন করে?

অরু দুই দিকে মাথা নেড়ে বলল,’না না তুমি যাবে।’

অভি মুখ থমথমে করে বলল,’আমি যাবো না অরুনিমা।তুমি যাও।’

‘তুমি না গেলে আমিও যাবো না।’

‘আচ্ছা যেও না।’

অরুনিমা আশা করেছিল সে দুই তিন বার বললেই অভি যাওয়ার জন্য রাজি হয়ে যাবে।অথচ এতোবার বলেও সে তার মত পাল্টাতে পারলো না।সে না যাওয়া নিয়ে বদ্ধ পরিকর।আর কোনো উপায়ান্তর না দেখে অরুনিমা বসা থেকে উঠে অভির দিকে ছুটে গেল।গিয়েই তার বাম হাতটা চেপে ধরে তীব্র অনুনয় করে বলল,’প্লিজ হামাদ।চলো না।অনেক মজা হবে।’

‘ধ্যাত্।ছাড়ো তো।’

‘তুমি বলো তুমি যাবে।’

‘হাত ছাড়ো।’

‘বলো না।’

অভি চোয়াল শক্ত করে তার দিকে তাকালো।বিরক্তির পারদ আকাশ ছুঁয়েছে তার।দু’জনার দৃষ্টি মিলতেই অভি ধমক দিলো,’তুমি যাও না।আমায় কেন জোর করছো?এগুলো কেমন কথা?’

অরু কান্না কান্না মুখ করে বলল,’পাড়ার লোকেরা আমার বর দেখবে না?’

‘কোনো প্রয়োজন নেই।’

‘হামাদ।’

অভি কেবল আড়চোখে তার দিকে তাকালো।অরু ন্যাকামো করে বলল,’তুমি না ভালো?’

‘আমি ভালো নই।’

‘হামাদ প্লিজ।আর কোনোদিন কিচ্ছু চাইবো না তোমার কাছে।’

অভির মুখটা বিরক্তিতে এতোটুকু হয়ে এলো।সে চটে যাওয়া মেজাজে বলল,’তুমি যাও না আজব।আমায় জোর করছো কেন?’

‘তুমি থাকলে আমার ভালো লাগে হামাদ।’

অভি কেমন যেন চুপ হয়ে গেল সহসা।কিছুক্ষণ আগের মিছেমিছি জেদটাও বোধহয় উবে গেল।কেমন একটা অদ্ভুত নৈঃশব্দ্য,কিঞ্চিত ভালো লাগা তাকে থামিয়ে দিলো।সে আর অরুনিমাকে ফেরাতে পারলো না।প্রত্যাখ্যান করতে গিয়েও কেন যে করতে পারলো না।’যেতে পারব না’ বলার পরিবর্তে অভি মাথা নামিয়ে চাপা স্বরে বলল,’আচ্ছা।যেতে পারি।তবে শর্ত আছে।’

‘সেটা কি?’
প্রশ্ন করতে করতেই অরুর দুই চোখ নেচে উঠে।

অভি গম্ভীর হয়ে বলল,’একদিনের বেশি থাকতে পারবো না আমি।’

অরুনিমা গাল ভর্তি হাসলো।বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নেড়ে বলল,’ঠিক আছে।আমি রাজি।’
.
.
.
.
শিকদার বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাড়ির কাছাকাছি আসতে নিরুপমার আরো বেশ কিছুটা সময় লাগলো।আজ ডিসেম্বরের ছয় তারিখ।শীত বেড়েছে নগরীর।নিরুর গায়ে একটা কালো শাল।চুলে রোজকার মতো একটা বেণি।

দুপুরের দিকে কুয়াশা কিছুটা কম ছিলো।এখন আবার চারদিক ঘোলা করে কুয়াশা পড়ছে।শীতের দাপটে নিরুপমা রহমানের হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল ক্রমশ।

নিরুপমার জন্য আজকের দিনটা ভালো।হামাদ সাহেবকে সে রাজি করাতে সক্ষম হয়েছে।যদিও সে রাজি করাতে পারে নি।অরু রাজি করিয়েছে।কিন্তু মায়ের কাছে তো নিরু উদাস মুখে ফিরছে না।সে বাড়ি গিয়েই হাসি হাসি মুখ করে বলবে,’কাজ হয়ে গেছে মা।তোমার মেয়ে আর তার বর দু’জনই কাল বাড়ি আসছে।’

সমতট লেনের গলিতে পা রাখার আগেই নিরুর সাথে একজনের দেখা হলো।বলা বাহুল্য,লোকটা তার স্বল্প পরিচিত।কিন্তু ভীষণ আকাঙ্ক্ষিত।লোকটার নাম রাশেদ।যে ধূসর রঙের খামে হালকা বাদামি রঙের কিছু কাগজ নিরুর নিকট এনে দেয়।হুহ।হালকা বাদামি রঙের কাগজই তো।জগতের লোক শুধু এইটুক জানুক।বাকিটা আর না জানুক।বাকিটা শুধুমাত্র নিরুপমাই জানুক।এই শুকনো খড়খড়ে চিরকুটের জন্য যে নিরুপমা রহমানের বিশাল অপেক্ষা,সেটা কেউ কখনো না বুঝুক।লোকে বলবে,নিরু কাগজের পৃষ্টা পড়ছে।অথচ নিরু জানে,সে গোটা গোটা কিছু অনুভূতি পড়ছে।অনুভূতি কি পড়া যায়?যায় তো।এই যে,নিরু পড়তে পারছে।

রাশেদ সাইকেলের প্যাডেল চেপে সামনে এগিয়ে এলো।নিরুপমা মাথার ঘোমটা আরো খানিকটা টেনে তুলে সটান হয়ে দাঁড়ালো।রাশেদ কাছাকাছি আসতেই সাইকেল থামিয়ে বলল,’চিঠি এসেছে আপনার।’

নিরু বড্ড স্বাভাবিক মুখে চিঠিখানা হাতে নেয়।ভাব এমন যে এসবে তার বিশেষ কোনো আগ্রহ নেই।অথচ ভেতরে ভেতরে তখন সে নিদারুণ উচ্ছাসে অতিষ্ঠ।প্রকান্ড ঢেউ সবেগে তরঙ্গ তুলে তার বুকে এসে আছড়ে পড়ছিলো।নিরুপমা এক প্রকার নিঃশ্বাস বন্ধ করে চিঠিটা হাতে নেয়।

রাশেদের হাতে আরো কয়েকটা চিঠি ছিলো।সে নিরুপমার থেকে বিদায় নিয়ে সেই চিঠিগুলোর কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে ছুটে গেল।পেছনে পড়ে রইল নিরুপমা,আর তার সিন্ধু সম অনুভূতি।

কয়েকটা প্রজাপতি কি চোখের সামনে দিয়ে ডানা ঝাপটে চলে গেল?সুরেলা সুমিষ্ট কন্ঠে কোকিল গান গাইলো নাকি?সমুদ্রের বড় বড় ঢেউয়ের রাশি তীরে এসে আছড়ে পড়ছিলো?সেই অপার্থিব সৌন্দর্যেই কি বার বার নিরুপমার চিত্ত ব্যাকুল হচ্ছে?
কই না তো।কিছুই তো তেমন হচ্ছে না।প্রজাপতি উড়ছে না,পাখি গান গাইছে না,সমুদ্রের ঢেউ গর্জন তুলে তীরে এসে আছড়ে পড়ছে না।তবে এতো ব্যাকুলতা কিসের?

হাতে ঐটা কি?একটা চিঠিই তো।এর বেশি তো কিছু না।নিরু দুই দিকে মাথা নাড়ে।না না।কেবলই চিঠি না।এটা সিদ্দিক রহমানের বড় কন্যার আবেগ।সদূর রাঙামাটি থেকে কাগজে মুড়ানো স্নিগ্ধ অনুভূতি।যেটা কেবল অনুভব করা যায়,অথচ হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দেখা যায় না।

____

নীলা,
কুয়াশাছন্ন,শিশিরে ঢাকা এক রজনীতে আপনাকে রাঙামাটির ক্যাম্প হতে শুভেচ্ছা পাঠালাম।আজ এখানকার তাপমাত্রা ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস।ঢাকার অবস্থা কেমন?শীত কি খুব বেশি,নাকি গায়ে সওয়া যায়?

তুতুনকে সোয়েটার,হুডি পরাবেন কিন্তু।বাচ্চাদের এই সময় অল্পতেই নিউমোনিয়া বেঁধে যায়।আর একবার যদি এই বয়সে এ্যাজমা কিংবা নিউমোনিয়ার সমস্যা দেখা দেয়,তবে কিন্তু বহু বছর ভোগাবে।নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি।এই বয়সটা অত্যন্ত নাজুক।ছেলের খেয়াল রাখবেন।ছেলে যদি অসুখে পড়ে,মা তবে কেমন করে পড়াশোনা করবে?

চিঠি তে যেই অল্প বিস্তর আত্ম প্রত্যয়ী নিরুপমার ছাপ পেয়েছি,তাতে আমি আনন্দিত।একটু বোধহয় গর্বিতও।আমার ভালো লেগেছে।আপনার চিন্তা,আপনার সিদ্ধান্ত,আপনার উদ্যম দেখতে পেয়ে আমি সত্যি সত্যি খুশি হয়েছি।সবসময় এমন পজেটিভ থাকার চেষ্টা করবেন নিরুপমা।দেখবেন প্রতিকূলতা সব আপনাআপনি কমে এসেছে।

নীলা! আপনি আমার কাছে সময়ের ব্যাপারে জানতে চেয়েছেন।এই ব্যাপারে কোনো তাড়াহুড়ো নেই।প্রয়োজনে নিহাদ আরো একটু বড় হোক।আরো ছয় সাত মাস অপেক্ষা করুন।পরিস্থিতি বুঝে তারপর পুনরায় ভর্তি হোন।আর যেকোনো সাহায্যের জন্য আমি তো আছিই।এবার ছুটিতে আপনার শহরে এলে একবার দেখা করার ইচ্ছে আছে আপনার সাথে।আপনি কি সেই ইচ্ছা পূরণ করবেন?নাকি পর পুরুষ বলে সসম্মানে এগিয়ে যাবেন।কিহ নীলা?যদি আমি আপনার সম্মুখে এসে দাঁড়াই,তবে কি আপনি মুখ ফিরিয়ে নিবেন আপনার মেজরের কাছ থেকে?

যাই হোক।আপনি সেনা সদস্যের জীবন সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন।আপনার এই প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে আমার তাচ্ছিল্য করে হাসতে ইচ্ছে হচ্ছে নীলা।আমি বোধহয় ইতোমধ্যেই হেসে ফেলেছি।এই কথা আপনি জানতে চাইবেন না।কারণ জানার পর ব্যাপারগুলো আপনারা সিভিলিয়ানরা হজম করতে পারবেন না।

আজকের ঘটনাই বলি।আমার সাতজন ক্যাডেটের একজন তন্ময়।তার বাবা গত পরশু স্ট্রোক করে আইসিইউ তে ভর্তি।এই খবরটা যখন মুঠোফোনের মাধ্যমে ছেলেটার কাছে আসলো,তার মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা ঠিক কোন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়ালো আপনি ভাবতে পারছেন?তন্ময় তবুও প্যারেড করছে,ফায়ারিং করছে,পুশ আপ দিচ্ছে।হ্যাহ্।এটাই মিলিটারি জীবন নিরুপমা।
সাথে আরো একটি বিষয় যোগ করি।তন্ময়ের বাবা আজ রাতে পরলোকগমন করেছেন।এই খবরটি আমি কাল পরশু তাকে জানাবো।অতি দুঃখের বিষয়,এমন একটা সংবাদ জানার পরেও তন্ময়কে ভেজা চোখে প্রশিক্ষণ চালিয়ে যেতে হবে।

আমি চাইলে তাকে অন্তত দুই দিনের ছুটি দিতে পারি।সেটুকু ক্ষমতা আমার আছে।আমি তার দলনেতা।কিন্তু আমি ইচ্ছে করেই তাকে সেই সুযোগ দিচ্ছি না।আমি চাই তন্ময় এই ভয়াবহ মানসিক যন্ত্রনা সহ্য করুক।আর সবকিছুর পরিশেষে একটা জীবন্ত পাথর হয়ে উঠুক।

হাহাহা।হাস্যকর বিষয়,তাই না?তবে এটাই বাস্তবতা নিরুপমা।ডিফেন্সের প্রথম কয়েক বছর শুধুমাত্র ভালো সেনাসদস্য,কিংবা ভালো সৈনিক হওয়ার প্রশিক্ষণ দেয় না।ডিফেন্সের শুরুর তিন তিনটে বছর আপনাকে একজন অনুভূতিশূন্য মানুষ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার সুযোগ করে দেয়।আপনি যতোই কোমল হৃদয়ের এবং প্রখর অনুভূতির ধারক হোন না কেন,ডিফেন্স আপনার সমস্ত অনুভূতি পিঁষে দিবে।এমনটাই হয়ে আসছে।সামনেও হবে।আমাদের স্যাররা আমাদের সেভাবেই গড়ে তুলেছেন।আমরাও আমাদের অনুজদের সেভাবেই গাইড করি।আর শুনতে চাইবেন না এসব।আপনি নিতে পারবেন না।কোনো সিভিলিয়ানই নিতে পারবে না।

যাই হোক।সেসব ছাড়ুন।আপনি বলুন আপনি কেমন আছেন?আপনার মা কেমন আছে?আপনার ছোট বোন অরুনিমা কেমন আছে?তার তো নতুন নতুন বিয়ে হয়েছে,তাই না?বর কি করে?আপনার পরিবার নিয়ে মন ভরে লিখতে পারেন।কোনো বাধা ধরা নেই।রাত জেগে জেগে আপনার চিঠি পড়তে বেশ লাগে।

আজ আপাতত কলম থামাচ্ছি।কিছু কিছু বিষয় নিয়ে আমি সামান্য বিচলিত।একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়।জানতে চাইলেও বলা সম্ভব না।আপনি ভালো থাকুন।সবশেষে এটাই আমার একমাত্র প্রত্যাশা।

নীলা! জীবনটা যখন নতুনভাবে শুরু করবেন বলে মনস্থির করেই নিয়েছেন,তাহলে একটা সুন্দর কাজ করা যায় না?

আপনি আজই মার্কেট থেকে গাঢ় নীল রঙের একটি শাড়ি কিনে আনুন।তারপর কাল সারাদিন আপনি সেই শাড়ি পরে রাখবেন।এরপর যতোবার আপনি আয়নায় নিজেকে দেখবেন,আপনি ভাববেন আপনি একটা নতুন নিরুপমা।তখন একটা অদ্ভুত প্রশান্তিতে আপনি বারবার সিক্ত হবেন।আমার উপর ভরসা করে একবার না হয় এমনটা করে দেখুন।দেখবেন ভালো লাগবে।

আজ অনেক এলোমেলো লিখেছি।আপাতত রাখছি।সুস্থ থাকবেন,ভালো থাকবেন,সবার খেয়াল রাখবেন।

ইতি,
আপনার মুস্তাফা
২৫ নভেম্বর ২০০২
আর্মি ক্যাম্প,রাঙামাটি।

***

নিরুপমা চিঠিটা পড়লো রাস্তার এক ধারে দাঁড়িয়ে।বাড়ি গিয়ে পড়ার মতো ধৈর্য তার নেই।সে চিঠিটা কয়বার পড়লো সে জানে না।তবে শেষ সম্বোধন টা পড়েছে শ বারেরও উপরে।

‘আপনার মুস্তাফা’
নিরুপমাকে ভয়াবহ রকমের লজ্জায় ফেলে দেওয়ার জন্য কি এই দু’টো শব্দই যথেষ্ট ছিলো না?কি লজ্জার বিষয়! নিরুর কান লাল হচ্ছে।লজ্জায় পড়ে দুই কান থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে।খুশির আবিরে মুখ হয়েছে রক্তজবার মতো টকটকে লাল।

নিরুপমার মুস্তাফা?লোকটা কি এমনটাই বলল?এতো বড় মাপের ব্যক্তি নিজেকে নিরুর বলে দাবি করল?নিরুর মুস্তাফা তাকে চিঠি লিখেছে।কি অদ্ভুত! এতো আনন্দ কেন হচ্ছে?নিরুপমা মন চাইছে ছাদের উপর শীতলপাটি বিছিয়ে খুব আয়োজন করে কাঁদতে।আয়োজন করে কান্না করা মানে সেজে গুজে ঢং করে কাঁদা।নিরুরও ঠিক সেভাবেই কাঁদতে ইচ্ছে করছে।

জীবন এতো চমৎকার কেন?এর চেয়ে আরো একটু কম চমৎকার হলেও নিরুপমার কোনো অভিযোগ ছিলো না।এখন এতো বেশি চমৎকার হয়ে নিরুর ভোগান্তি বাড়িয়েছে।নিরু এখন রাত দিন কেবল স্বপ্ন দেখে।সেই স্বপ্নের কথা ভাবলেই তার আরো বেশি লজ্জা লাগে।

আকাশ কাঁপলো।এক দুই বার গর্জন তুলে ঝির ঝির বর্ষণ শুরু হলো।ব্যস্ত নগরীর মানুষ সেই বর্ষণে ভীষণ বিরক্ত হলো।ডিসেম্বর মাসে বৃষ্টি হয় নাকি?এ কেমন কথা?
বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে তারা ঠাই নেয় দোকানের উপর থাকা টিনশেডের ছাউনিতে।বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে মাখলে কাপড় নোংরা হবে।অবেলার বৃষ্টি বড্ড বিরক্তিকর জিনিস।

অথচ একটি মেয়ে হুটহাট বৃষ্টির আগমনে বিরক্ত হলো না।বৃষ্টি থেকে বাঁচতে কোথাও গিয়ে আশ্রয়ও নিলো না।দুই হাত ছড়িয়ে সে মহা আনন্দে বৃষ্টির জল গায়ে মাখল।তার আগে হাতে থাকা চিঠিটা আচলের ভাঁজে রেখে গিট দিলো।হয়তো ভিজে যাবে।থাক ভিজুক।নিরু বাড়ি গিয়ে শুকিয়ে নিবে।আপাতত বৃষ্টি বিলাশ জরুরি।

নিরুপমা দু’হাত ছড়িয়ে আকাশ দেখে।নভেম্বরের বৃষ্টিকে যেন কি বলে?ওহ্ হ্যাঁ।নভেম্বর রেইন।প্রেমের বৃষ্টি।কিন্তু এটা তো নভেম্বর না।ডিসেম্বর।আহা! ডিসেম্বর তো না।চিঠিটা যখন লিখা হয়েছে,তখন ছিলো পঁচিশে নভেম্বর।তার মানে এই চিঠির সাথে নভেম্বর রেইনটাও একটু সময় পিছিয়ে এসেছে।

রাস্তায় পথচারী সব ব্যস্ত কদমে হেঁটে যাচ্ছিল।যেতে যেতে অবাক হয়ে তেইশের সেই স্নিগ্ধ সুন্দর রমণীকে দেখলো।সে বৃষ্টিতে ভিজছিলো।তার মুখে হাসির রেখা ছিলো।কিন্তু এরই মাঝে কি হলো কে জানে,সে বাচ্চাদের মতো ঠোঁট ভেঙে কেঁদে ফেলল।একদম হু হু করে কেঁদে উঠা যাকে বলে।বৃষ্টির পানির সাথে সেই কান্নাটুকুও ধুয়ে গেল।কিছু সুপ্ত ব্যাথা,কিছু অপ্রাপ্তি,কিছু তীক্ষ্ণ যন্ত্রনা নিরুপমা কে মুক্তি দিয়ে দূর আকাশে উড়ে গেল।

নিরুপমা রহমান,থুক্কু মেজর মুস্তাফার নীলা সেদিন খুব করে আকাশ দেখলো।আজ তার এত্তো আনন্দের দিন।ফেরার পথে সে পথের ধারে একটা বেড়াল দেখতে পেলো।ছোট্ট বাচ্চা,বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছিলো।নিরুপমা ছুটে গিয়ে তাকে কোলে তুলে বুকে জড়িয়ে নিলো।ছোট্ট সেই বিড়াল ছানা টা পিট পিট করে তার দিকে তাকালো।নিরুপমা খিলখিল করে বলল,’এ্যাই ম্যাও।তুই আমাকে চিনিস?আমি নীলা।ভুলেও তুই আমায় নিরুপমা বলবি না।’

সে একটু সামনে যায়।যেতে যেতেই আবার বলে,’আর আমার নাম নীলা কে দিয়েছে জানিস?মেজর মুস্তাফা।’

আরো চার পাঁচটা কদম সামনে ফেলে আচমকাই নিরুপমা কেমন লজ্জায় মিইয়ে গেল।একেবারে মিহি স্বরে বলল,’মেজর কি বলেছে জানিস?বলেছে সে নাকি আমার।ভাবতে পারিস তুই?নিরুর একটা মেজর আছে।’

চলবে-

#কৃষ্ণপক্ষের_অন্তিম_প্রহর
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

২০.

আজ গুলি ছোড়ার কথা ছিলো বিশ রাউন্ড।প্রশিক্ষণের দিন বাড়ছে,সেই সাথে অনুশীলনের ধরনেও পরিবর্তন আসছে।আগের তুলনায় কসরত এখন একটু বেশিই করতে হয়।

সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো,সকালে ফায়ারিং করবে জিতু,অয়ন,মাহিম আর সাদাফ।
আর বিকেলে করবে তন্ময়,রাফিদ আর ইয়াকুব।সেই সিদ্ধান্ত মোতাবেক সকালে জিতুদের অনুশীলন হয়ে গেল।যদিও তাদের শিক্ষক মুস্তফার সেই অনুশীলন মনঃপুত হয়নি।তবুও তিনি আজ তাদের খুব বেশি বকা ঝকা করেন নি।সবার ফায়ারিং শেষ হতে তিনি কিছুটা গম্ভীর মুখে বললেন,’তোমাদের টার্গেট এখনো পারফেক্ট হয় না।যাই হোক।গো ব্যাক টু ইউর টেন্টস।একটু পরে আবার ডাকবো তোমাদের।’

ক্লান্ত সৈনিকরা মাথা ঝুঁকিয়ে তাবুর দিকে ফিরে গেল।শরীরটা ভেঙে পড়ছে ক্লান্তিতে।মাথায় বোধহয় যন্ত্রনা হচ্ছিল সামান্য।এটা সম্ভবত এমন এক মুহূর্ত যেখানে তারা আশ্চর্য হয়ে আবিষ্কার করে তাদের ক্যারিয়ার চয়েজ কতো জঘন্য।তাদের স্বপ্ন কতো বিচিত্র।যেখানে তারা স্বপ্ন হিসেবে বেছে নিয়েছে নিরন্তর পরিশ্রম আর একটি অনিশ্চিত জীবন।

অয়ন যেতে যেতে তন্ময়ের তাবুর ভেতর উঁকি দিলো।সে তখন জায়নামাজে বসা।দু’হাত তুলে মোনাজাত করছিলো।অয়ন দেখলো মোনাজাতের মাঝেই ছেলেটা ডুকরে কেঁদে উঠছে।সে ভেতরে যাবে যাবে করেও আর গেল না।

‘অয়ন! কি হয়েছে?দাঁড়িয়ে আছো কেন?’

তড়িৎ গতিতে পেছন ফিরলো অয়ন।দেখলো মেজর এহতেশাম দুই হাত আড়াআড়ি করে পেছনে রেখে সটান দাঁড়িয়ে আছেন।অয়ন দ্রুত দুই দিকে মাথা নাড়লো।চটপট জবাব দিলো,’না স্যার।কিছু না।এমনিই।’

সে আর সময় নষ্ট না করে ব্যস্ত কদমে নিজের তাবুর দিকে এগিয়ে গেল।এহতেশাম চুপচাপ হেঁটে তন্ময়ের তাবুর সামনে দাঁড়ালো।কাল তাকে তার বাবার মৃ’ত্যুর খবর জানানো হয়েছে।এরপর থেকে তন্ময় কিছুটা অদ্ভুত,কিছুটা এলোমেলো আচরণ করছে।এহতেশাম তার ব্যাকুলতা,অস্থিরতার সবটাই বুঝলো।তার মনে হলো,তন্ময়ের সময় প্রয়োজন।সে কাল একবারও তার কাছে যায় নি।আজ কেন যে যেতে ইচ্ছে তো।

এহতেশাম ধীর পায়ে তাবুর ভেতর প্রবেশ করলো।তন্ময় তাকে দেখতেই জায়নামাজ ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।এহতেশাম হাত নাড়লো।ইশারায় বোঝালো,যেখানে আছো সেখানেই বসে থাকো।

তাবুর ভেতর একটা রঙচটা কাঠের চেয়ার ছিলো।এহতেশাম গিয়ে চেয়ারে বসলো।একগাল প্রশস্ত হেসে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে বলল,’ইউ আর আ ফ্যান্টাস্টিক সান তন্ময়।তোমার বাবা অবশ্যই তোমাকে নিয়ে গর্ববোধ করবে।’

তন্ময়ের মুখটা আগের চেয়েও মলিন হয়ে এলো।এহতেশাম দেখলো,সে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে কান্না টুকু গিলে নিলো।তার দৃষ্টি মাটির দিকে।তার ভেজা চোখ সে স্যারের সামনে দেখাতে চায় না।এহতেশাম চেয়ার ছেড়ে উঠে তার দিকে এগিয়ে এলো।তার কাঁধে একটা হাত রেখে বলল,’স্রষ্টার উপর ভরসা রাখো তন্ময়।ডেথ ইজ দ্য আলটিমেট ট্রুথ।’

ছোট্ট ছেলেটা এবার সত্যি সত্যি ঠোঁট ভেঙে কেঁদে দিলো।তাও আবার বাচ্চাদের মতো।এহতেশাম চুপচাপ দাঁড়িয়ে তার ক্রন্দনরত মুখখানা দেখে।গাম্ভীর্য বজায় রেখে বলে,’বি স্ট্রং তন্ময়।তোমার প্রোফেশন টাই এমন।কি করবে বলো?’

তন্ময় শান্ত হলো।বেশ কিছুক্ষণ পর সে চোখ তুলে এহতেশামের দিকে তাকালো।তার চোখে কৃতজ্ঞতা ছিলো।এহতেশামের সাথে চোখাচোখি হতেই সে বাচ্চাদের মতো করে বলল,’থ্যাংক ইউ স্যার।আমি হয়তো কোনদিন আপনাকে বোঝাতে পারবো না,আপনার এই রোজ রোজ আমার কাছে আসা আমার জন্য কতোখানি রিলিফের বিষয়।’

এহতেশাম একটু অপ্রস্তুত হলো।একটু নড়ে উঠে ডানে বায়ে দেখে সে বড় বড় কদমে তাবু থেকে বেরিয়ে গেল।সে নিজেও তার আচরণে অবাক।আজকাল সে ছেলে গুলোকে খুব বেশি বকা ঝকা করতে পারছে না।এরা ভুল করলেও নরম গলায় শুধরে দিচ্ছে।অথচ সে একদমই এমন লোক না।ব্যাটেলিয়নের সদস্যদের কাছে এহতেশাম স্যার বরাবরই কাঠখোট্টা স্বভাবের লোক বলেই পরিচিতি পেয়েছে।অথচ এইবারের রেইডার্স টিম কে সে আশ মিটিয়ে বকা ঝকা করতে পারছে না।অদ্ভুত তো! তার হলো টা কি?

___

আশিকের ধারণা,সে এই আর্মি ক্যাম্পের সবচেয়ে অভাগা আর্মি।এই ধারণার পেছনে যথেষ্ট কারণ আছে।সে পদমর্যাদায় ক্যাপ্টেন।টুকটাক ফোন করার অনুমতি তার আছে।ক্যাম্প থেকে বের হওয়ার অনুমতিও আছে।সেদিক থেকে অফিসার ক্যাডেটদের তুলনায় সে ভালো আছে।কিন্তু দুঃখের বিষয়,কেয়ার সাথে সে কোনোভাবেই ঠিকঠাক যোগাযোগ করতে পারছে না।

কেয়ার ব্যাপারে তার তেমন কিছু জানা হয়নি।তাদের প্রেমও চলছে চিঠিতে চিঠিতে।কেয়া শেষ চিঠিতে জানালো তার নাকি সমুদ্র ভালো লাগে।আশিক জবাব দিয়েছে,পাহাড়ের মতো সৌন্দর্য অন্য কিছুতে নেই।পাহাড়ের বুকে মিশে গিয়েই একমাত্র প্রকৃতির আসল রূপ জানা যায়।

কেয়া তার চিঠি গুলো কিভাবে পড়ে সে জানে না।কেয়া মেয়েটা আসলে কেমন?হাসিখুশি?নাকি গম্ভীর?নাকি চাপা স্বভাবের?সেটাও আশিক জানে না।বিয়ে হলো।এক দুইদিন সংসার হলো।তারপরই আশিক সব ছেড়ে ছুড়ে রাঙামাটি চলে এলো।কেয়াকে তার অনেক বেশি জানার বাকি।এইবার ছুটিতে গিয়ে সে কেয়ার সাথে মন ভরে কথা বলবে।কেয়ার কন্ঠটাও তার স্পষ্ট মনে নেই।কি লজ্জার কথা!

এহতেশাম ক্যাম্পের সামনে ফেলে রাখা স্টিলের বেঞ্চ তিনটির একটি তে গিয়ে বসলো।আশিক তাকে দেখেই এগিয়ে এসে বলল,’স্যার।চা খাবেন?’

‘নাহ্।ইচ্ছে নেই।’

এহতেশাম মাটির দিকে ঝুকলো।ভারি স্বরে বলল,’তন্ময় আজ এগারো রাউন্ড গুলি ছুড়েই হাত পা ছেড়ে দিয়েছে।’

‘জ্বী স্যার।দেখেছি।’

এহতেশাম ছোট করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,’এবং আমি তাকে আবার শুরু থেকে শুরু করতে বলি নি।আই পারডনড হিম।’

হাসলো আশিক।বলল,’জ্বী স্যার।’

এহতেশাম বিরক্ত হয়ে বলল,’তুমি খেয়াল করেছো?আজকাল আমি খুব ভালো মানুষ হয়ে যাচ্ছি?দিস ইজ নট মি।এটা আমি হতেই পারি না।আমার আগের টিম জানে,আমি কি জিনিস।’

আশিক হালকা হেসে বলল,’এই ব্যাপারটাও খারাপ না স্যার।’

‘ভালো খারাপের হিসেব করছি না।পরিবর্তনের পরিমান আঁচ করার চেষ্টা করছি।’

মুখে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে আশিক বলল,’আমার মনে হয় নিয়মিত পত্র লিখতে লিখতে আপনার দিল একটু নরম হয়েছে স্যার।’

বলতে বলতেই সে জিভ কাটলো।বেশি হয়ে গেল না?স্যারের সাথে এমন কথা কেউ বলে?সে অপ্রস্তুত হয়ে পাশে তাকায়।অথচ এহতেশাম কে খুব বেশি রাগী দেখালো না।সে একেবারে ঠান্ডা স্বরে বলল,’হতে পারে।অসম্ভব না।সাথে আরো একটা কারণও আছে।’

আশিক কপাল কুঁচকে শুধায়,’সেটা কি?’

এহতেশাম কিঞ্চিৎ হাসলো।সহজ গলায় বলল,’বয়স বাড়ছে তো আশিক।এখন এদেরকে আমার বাচ্চা বাচ্চা লাগে।তুমি ভাবতে পারছো?এদের সাথে আমার বয়সের ব্যবধান চৌদ্দ/পনেরো প্রায়।’

আশিক তার থেকে একটু দূরত্ব বজায় রেখে বসলো।ভেতরটা খচখচ করা স্বত্তেও একগাল হেসে বলল,’স্যার।ক’দিন বাদে এই ছেলেরাও বিয়ে করবে।আমার মনে হয়,এবার আপনার চিরকুমার সংঘ থেকে বেরিয়ে আসা উচিত।’

এহতেশাম ম্লান হাসে।বেঞ্চে ঠেস দিয়ে রাশভারি সুরে উত্তর দেয়,’আর সম্ভব না আশিক।ঐসব বিয়ে শাদি নিয়ে আর ভাবি না।তাছাড়া এখনকার মেয়েদের যা অবস্থা! তাদের উপর আমার আগ্রহ নেই।’

আশিকের ইচ্ছে হলো লজ্জা শরম ভুলে বলে দিতে,’আপনার পত্র মিতা আছে তো স্যার।তার ব্যাপারটাও ভেবে দেখুন।’

সে অবশ্য এতো বেশি সাহস দেখায় নি।স্যার তার পত্র আদান প্রদানের বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে পছন্দ করে না।আশিক আর আগ বাড়িয়ে কিছু বলে না।শুধু বিড়বিড় করে জানতে চায়,’আপনার কি অভিমত?মেয়েদের কেমন হওয়া উচিত?আমি তবে ছুটির সময় বাড়িতে গেলে কেয়ার সাথে একবার মিলিয়ে নিতাম সেগুলো।’

এহতেশাম এবার শব্দ করেই হাসলো।আশিকের দিকে তাকালো না।কেবল মাথা উঠিয়ে আকাশ দেখতে দেখতে দারাজ কন্ঠে বলল,’শোন আশিক! একেক মানুষের একেক রকম পছন্দ।অনেকে চঞ্চলতা পছন্দ করে,অনেকে স্নিগ্ধতা পছন্দ করে,অনেকে আবার নিরবতা পছন্দ করে।আমার ব্যাপারটা আলাদা।আমি চোখের শান্তিতে বিশ্বাস করি।

যেই মানুষ টা কে দেখে আমার চোখ শান্তি পায়,আমার কেবল তার উপরই মুগ্ধতা কাজ করে আশিক।সৌন্দর্যের উপর আমার এক জনমের ঘৃণা।কোনো নির্দিষ্ট কারণ নেই,তবে সমাজের তথাকথিত কিছু স্টেরিওটাইপ আমার একদমই পছন্দ না।
আমি অবলা,নিরীহ,ফ্যাচ ফ্যাচ করে কান্না করা মেয়েদের পছন্দ করি না।অল্পবয়সী মেয়েদের তো আমি অন্য চোখে দেখতেই পারি না।এখন আমার যা বয়স,তাতে আমি শুধু একটি সাধারণ মেয়ের অসাধারণ অভিযাত্রা দেখার বাসনাই করতে পারি বড়জোর।যদিও তার সাথে কোনো কিছুর কল্পনা আমি করছি না।তবে বলতে পারো,এই সুদীর্ঘ পথচলায় কেবল একটি মেয়েই আমাকে চোখের শান্তি দিতে পেরেছে।তাও আবার বিনা কোনো কসরতে।কেবল কয়েকটি কাঠগোলাপ।আর সাদামাটা রঙের একটা শাড়ি।ব্যাস,এহতেশামের মুখ থুবড়ে পড়ার জন্য এইটুকই যথেষ্ট।’

আশিক কেমন বড় বড় চোখ করে তার দিকে তাকালো।বিস্ময়ে তার চোয়াল ঝুলে গেছে।স্যার যে এই কথা বলবে সে আশা করে নি।এতো গুলো বছর।এহতেশাম মুস্তাফা তো কখনো এমন করে কথা বলে নি।বলার সময় তার মুখজুড়ে বিরাজমান স্নিগ্ধ হাসি আশিক বহু বছরেও দেখে নি।সে হতবাক হয়ে বলল,’আপনার পত্রমিতার কথা বলছেন?’

এহতেশাম উত্তর দিলো না।শুধু মাথাটা পেছনে এলিয়ে দিয়ে দুই চোখ বুজে গম্ভীর গলায় হুকুম দিলো,’যাও আশিক।কড়া লিকারের দু’কাপ চা নিয়ে আসো।’

_________________________________________

সৃজনীর বাবা দীর্ঘদিন পর প্রবাস থেকে দেশে ফিরেছেন।সেই উপলক্ষে তিনি সাথে করে অনেক চকোলেট এনেছেন।বিকেলের একটু পর হাফসা আর সৃজনী এলো শিকদার বাড়িতে,সবার জন্য টুকটাক উপঢৌকন নিয়ে।

অরুনিমা ছাদের রেলিংয়ে বসে পা দোলাচ্ছিল।অভি আপাতত বাড়ি নেই।সে বাইরে গিয়েছে।কাল তারা নিরু আপাদের কাছে যাবে।অভিকে অনেক কষ্টে রাজি করানো হয়েছে।আজকের দিনটা অরুর জন্য অন্যরকম।সে সারাটা দিন বাড়ি যাওয়ার আনন্দে বিভোর ছিলো।কত্তো মজা হবে! সামনের দু’টো দিন অরু মা আর আপার সাথে থাকবে।যখন খুশি তুতুনকে কোলে নিবে,চুমু খাবে।অরু সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে আর এসব নিয়ে ভাববে না।ভাবলেই তার দু’চোখ ভরে কান্না আসে।মনে হয় এখনই সব ফেলে ছুটে যেতে।

হৃদি ছাদের দরজায় দাঁড়িয়ে ডাক দিলো,’অরুনিমা।কি করো?’

‘কিছু না।আকাশ দেখি।’

‘নিচে চলো।সৃজনী আর মেঝ ফুফু এসেছে।’

অরু রেলিং থেকে নামলো।সামনে এগোতে এগোতে বলল,’সৃজনীর বাবা দেশে ফিরেছে?’

‘হ্যাঁ।সাথে অনেক অনেক জিনিস এনেছে।তুমি জলদি নিচে আসো।’

__

সবাই বসেছিলো জাহানারা বেগমের ঘরে।হাফসা ব্যাগ থেকে একেকটা জিনিস বের করে খাটের উপর স্তূপ করে রাখছিলেন।জাহানারা অসন্তোষ প্রকাশ করে বললেন,’সেকি হাফসা! সব তো তুই আমাদের জন্যই নিয়ে এলি।এতো কিছু আনার কি দরকার ছিলো?’

‘না মা।উনি এবার দুই লাগেজ ভর্তি জিনিস এনেছেন।এতো কিছু আমি কি করবো?তাছাড়া তোদের জন্য এতোকিছু সে ই মনে করে এনেছে।’

জাহানারা কেবল হাসলেন সামান্য।সৃজনী খাটের এক কোণায় চুপচাপ বসে ছিল।জাহানারা ডাকলেন,’সৃজু! বাবা কি আনলো রে তোর জন্য?’

সৃজনী খুশি খুশি মুখ করে জবাব দেয়,’টাচ মোবাইল এনেছে নানুমণি।’

‘বাপরে!’

সৃজনী লাজুক হেসে বলল,’টাচ মোবাইলে ডিজিটাল ক্যামেরার মতো ছবিও তোলা যায়।তোমাদের সবার একটা ছবি তুলে দিবো আমি।’

‘আচ্ছা বেশ।তুলিস তবে।’

অরুনিমা গোল গোল চোখে ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালো।হাফসা তাকে দেখেই হাত বাড়িয়ে ডাকলেন।হৃদি বলল,’আরে এসো এসো।আজকের মূল চরিত্র তো তুমিই।’

অরু চোখ পাকিয়ে বলল,’কেন কেন?আমি কি করলাম আবার?’

হাফসা হাসি মুখে বললেন,’তুমি কিছু করো নি।এবার চুপচাপ এদিকে এসো।’

অরুনিমা এগিয়ে গেল।রিজোয়ানা ছিলো ঘরের একপাশে।অরু তাকে পুরোপুরি এড়িয়ে গেল।তাকে ইদানিং অরুর বিন্দু পরিমান ভালো লাগে না।সে যেমন অরুকে দেখলে মুখটা একদিকে ঘুরিয়ে নেয়,অরুও একইভাবে তাকে দেখামাত্র মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেয়।

হাফসা লাল রঙের মখমল কাপড়ে মুড়ানো বক্সটা খুলে একটা স্বর্ণের আংটি বের করে আনলেন।তারপর সেটা খুব সুন্দর করে অরুনিমার ডান হাতের অনামিকাতে পরিয়ে দিলেন।অরু মাথা নামিয়ে তার হাত দেখে।আংটিটা খুব সুন্দর।যে কিনেছে,তার রুচি ভালো।স্বর্ণের আংটি তে এমন নজরকাড়া ডিজাইন অরু আগে দেখেনি।

হাফসা বললেন,’তোমার ফুফাজান বিদেশ থেকে এনেছেন তোমার জন্য। তোমার বিয়ে তে তো আসতে পারে নি।তাই তার পক্ষ থেকে তোমার জন্য ছোট্ট একটা উপহার।তোমার পছন্দ হয়েছে মনা?’

অরুনিমা খুব মন দিয়ে হাতের আংটিটা দেখলো।তার মুখ জুড়ে প্রশস্ত হাসি।সে মাথা তুলে কৃতজ্ঞতার স্বরে বলল,’এত্তো সুন্দর আংটি! আর আমার পছন্দ হবে না?খুব সুন্দর হয়েছে ফুফু।ফুফাজান কে আমার হয়ে ধন্যবাদ দিও।’

হাফসা অল্প করে হাসলেন।খাটের উপর থেকে আরেকটা বক্স হাতে নিয়ে বললেন,’নাও।এটাও তোমার।টুকটাক কসমেটিকস আছে।তোমার কাজে লাগবে।’

অরু খুশিতে গদে গদো হয়ে বলল,’থ্যাংকু।অনেক অনেক থ্যাংকু।’

অভি বাড়ি ফিরেছে মাত্র।পকেটে হাত গুজে হেলে দুলে নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছিলো সে।হাফসা তাকে দেখামাত্রই ডাক দিলেন,’অভি! এ্যাই অভি।’

সে থামলো।মোটা স্বরে বলল,’কি?’

‘এদিকে আয়।’

‘পারবো না।’

‘অভি!’

খুবই বিরক্ত মেজাজে অভি ঘরে এলো।হাফসা বললেন,’বাড়িঘর ভালো লাগে না তোর?’

আবারো বিরক্তিতে মুখ ছেয়ে গেল তার।এক কথা সারাক্ষণ শুনতে ভালো লাগে না।মাথা নেড়ে বলল,’কি বলার তাড়াতাড়ি বলো।’

‘তোর ফুফাজান এসেছে।’

অভি শক্ত মুখে দাঁড়িয়ে থাকে।অবান্তর কথাবার্তা।ফুফাজান এসেছে।এটা নিশ্চয়ই তাকে ঘরে ডেকে জানানোর মতো কিছু না।

সৃজনী বলল,’বাবা তোমার জন্য ঘড়ি আর আতর এনেছে।’

অভি বিরক্ত হলো।
‘ওসব আমার লাগে না।’

হাফসা কপাল কুঁচকে বললেন,’কেন?তুই কি জ্বীন-ভূত?অদ্ভুত কথা বলিস।’

জাহানারা দেখলেন অভির মুখটা সময়ে সময়ে কেমন পাল্টে যাচ্ছে।সে বিরক্ত,সাথে আবার কিছুটা রেগেও আছে।তিনি তাড়াহুড়ো করে বললেন,’আহা দাদুভাই।তুমি রাখো জিনিসগুলো তোমার কাছে।লাগলে দিও।নাহয় ফেলে রাখো।তবুও উপহার ফিরিয়ে দিতে নেই।’

অভি চুপচাপ তার জন্য নির্ধারিত বাক্সটি হাতে নেয়।সৃজনী বলল,’চকোলেটও আছে তোমার জন্য।’

অভি খেঁকিয়ে উঠল সহসা।একটা রাম ধমক দিয়ে বলল,’চড় চিনিস?আমি এখন বসে বসে বাচ্চাদের খাবার খাবো?যত্তোসব।যা সর! ঘরে যাবো আমি।’

সৃজনীর মুখটা এইটুকু হয়ে এলো।অভি হনহনিয়ে তার ঘরে চলে গেল।হাফসা তার বড় বড় পদক্ষেপের দিকে কয়েক মুহূর্ত দৃষ্টিপাত করলেন।তারপর একটা শ্বাস ছেড়ে বললেন,’থাক বাদ দাও।এই নাও অরুনিমা।তোমার চকোলেট।’

অরু প্রগাঢ় হাসলো।দুই হাত ভরে সবকিছু নিয়ে বুকের সাথে চেপে ধরলো।তার কন্ঠে কৃতজ্ঞতা ছিলো।সে বরাবরের মতোই মিষ্টি হেসে বলল,’অনেক অনেক ধন্যবাদ ফুফুজান।এত্তোগুলো জিনিস পেয়ে আমার মন ভালো হয়ে গেছে।’

হাফসা বললেন,’যাও সবকিছু গুছিয়ে রেখে এসো।নয়তো পড়ে যাবে।’

সে বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়ে।চঞ্চল কদমে ছুটে যায় তার ঘরের দিকে।

অভি তখন কেবলই গোসল সেরে বেরিয়েছে।মাথা ধরে ছিলো।গোসল করতেই শরীরটা একটু শান্তি পেল।অরু ঘরে ঢুকেই তাকে দেখে হাসলো।অভির বিরক্তি আরো খানিকটা বাড়লো।মানুষ খুশিতে হাসে,আনন্দে হাসে,ভালো খবর শুনলে হাসে।কিন্তু অরুনিমা হুদাই হাসে।কোনো কারণ নাই।অথচ মুখের হাসি তার বন্ধ হয় না।

অরু ঘরে এসেই বলল,’চকোলেট নিলে না কেন?বিদেশি চকোলেট।খেতে ভীষণ মজা।’

‘আমি চকোলেট খাই না।ভালো লাগে না আমার।’

‘আচ্ছা।’

অরু আর কথা বাড়ালো না।চুপচাপ হেঁটে গিয়ে সবগুলো চকোলেট তার ব্যাগের ভেতর রাখলো।অভি সন্দিহান চোখে তার দিকে তাকায়।তার সাথে চোখাচোখি হতেই অরু হাসিমুখে সাফাই দিলো,’বাড়ির জন্য নিয়ে যাচ্ছি।সবাই একসাথে মিলে খাবো।তুতুন যে কি খুশি তবে চকোলেট গুলো পেলে।আর আপার কথা কি আর বলবো!! জীবনেও নিজ থেকে এসবে হাত দিবে না।অনেকটা তোমার মতো।বলবে,এসব নাকি বাচ্চাদের খাবার।আরে বাবা চকোলেট খাওয়ার আবার কোনো বয়স আছে নাকি?তোমার দিদানও চাইলে এখন চকোলেট খেতে পারে।এসবে কোনো বয়স টয়স নেই।’

অভি মুখ কুঁচকে তার দিকে তাকায়।খানিকটা বিদ্রুপ করে বলে,’বাহ! খুব ভালো যুক্তি।’

‘হয়েছে।তুমি আর কথা বলো না।তোমাকে এতোবার সাধলো,তুমি চকলেট গুলো নাও নি কেন?তুমি নিলে তো আজ আমরা ভাগে দুই টা চকোলেট বেশি পেতাম।’

অভি তার কথা শুনলো।কথা শেষ করেই সে আলমারির দিকে এগিয়ে গেল।কাল সকালে তারা অরুদের বাড়ি যাবে।এখনো ব্যাগ গোছানো হয়নি।অরু আলমারি খুলে বলল,’হামাদ! তুমি কি কি কাপড় নিবে বলো তো?আমি সেগুলো সহ বের করে রাখি।সকালে কিন্তু একদম দেরি করবে না বলে দিচ্ছি।’

অভি ধুপধাপ পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।অরু অবাক হয়ে বলল,’সে কি! কি হলো তোমার?’

জাহানারা আর হাফসা মিলে পুরোনো আলাপ করছিলেন।সৃজনী তার নতুন মুঠোফোনের চকচকে স্ক্রিনে চোখ এঁটে বসেছিল।অভি ঘরে এসেই গমগমে স্বরে বলল,’আমার ভাগের চকোলেট গুলো দে তো সৃজু।’

চমকে মাথা তুলল সৃজনী।ভড়কে গিয়ে বলল,’কিহ্?’

অভি নিজেও ভড়কালো।অপ্রস্তুত হয়ে এদিক সেদিক দেখে বলল,’একটু আগে যে চকোলেট গুলো দিয়েছিলি আমায়,সেগুলো দে।’

সৃজনী বোকা বোকা চোখে তার দিকে তাকায়।তারপর চোখ ভর্তি কৌতুহল নিয়ে মুঠোভর্তি চকোলেট তার সম্মুখে বাড়িয়ে দেয়।অভি ছোঁ মেরে সেটা নিজের হাতে নেয়।তারপর যেমন করে তাড়াহুড়ায় ঘরে এসেছিলো,ঠিক তেমন করেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।হাফসা বললেন,’আশ্চর্য তো! এই ছেলের কখন কি হয়,শুধু সে ই জানে।’

অরুনিমা শাড়ি দু’টো খুব যত্ন করে ব্যাগে রাখে।তারপর রাখে দু’টো শাল।সেলোয়ার কামিজ সে দু’টোর বেশি নিবে না।

অভি ঘরে এসেই অরুর ব্যাগে চকোলেট গুলো রাখলো।অরু মাথা তুলে বলল,’সে কি! আমি পেয়েছি তো।আবার কেন দিচ্ছো?’

অভি থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকলো।শেষটায় কিছুটা ইতস্তত করে বলল,’তুমি না বললে তোমাদের ভাগে কম পড়ে যাবে?নাও।আমার টাও দিলাম।এবার তুমি আর তোমার তুতুন মন ভরে চকোলেট খাও।’

অরুনিমার চোখ দু’টো খুশির আনন্দে চিকচিক করে উঠলো।সে হাতের কাছের সবকিছু ফেলে এক দৌড়ে অভির মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়ালো।তার আকস্মিক ছুটে আসায় অভি নিজেই থতমত খেলো।তাকে আরো বেশি হতভম্ব করতেই বোধ হয় অরুনিমা সেদিন তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।

অভি নির্বিকার,বাকহারা।অরুর শক্ত আলিঙ্গনেও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে নি।হাত বাড়িয়ে অরুর পিঠ ছোঁয়ার কোনো বাসনা তার ভেতর কাজ করে নি।তবে হ্যাঁ।ভেতরে যে কোনো পরিবর্তন হয়নি,এ কথা মিথ্যা।অভির অদ্ভুত লাগলো।অরুর মাথাটা বক্ষপিঞ্জরের যেই জায়গায় ঠেকেছে,সে জায়গায় সেকেন্ডের ব্যবধানে অনেক কিছু ঘটে গেল।অভি টের পেল,অথচ পাত্তা দিলো না।

অরু আবেশে চোখ বুজে হাসি মুখে বলল,’থ্যাংকু হামাদ।তুমি কত্তো ভালো তুমি নিজেও জানো না।এই বাড়িতে আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ তুমি।তোমার মতো করে কেউ আমায় বোঝে না।’

একটা স্থির অবিচল পর্বত।শৈলের মতো অটুট,পাথুরে হৃদয়।একটা এলোমেলো,ছন্নছাড়া জীবন।অনুভূতির ডায়রি যার বারবরই ফাঁকা।সেদিন এক লহমায় কি হলো জানা নেই,হামাদ শিকদার কিছু মুহূর্তের জন্যও কেমন থমকে গিয়েছিল।সে ঘোষণা দিয়েছিল,তার হৃদযন্ত্র অকেজো,পাথর হয়ে গেছে।অথচ সেদিন সে স্পষ্ট শুনতে পেল,ধুক ধুক শব্দ করে কিছু একটি প্রতিনিয়ত তার ভেতরে স্পন্দিত হয়ে চলেছে।হামাদ শিকদারের বড়ো কষ্ট হলো।পুরোপুরি পাথর হতে না পারার কষ্ট তাকে কুড়ে কুড়ে খেলো।

চলবে-