কৃষ্ণপক্ষের অন্তিম প্রহর পর্ব-২১

0
44

#কৃষ্ণপক্ষের_অন্তিম_প্রহর
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

২১.[প্রথম অংশ]

সকালের মিঠে রোদ আকাশে আলো ছড়িয়েছে ততক্ষণে।সোনালি আলো রান্নাঘরের জানালা ভেদ করে ভেতরে প্রবেশ করলো।চুলায় বসানো পায়েসের উপর আলো পড়তেই সেটার রং একটুখানি পাল্টে গেল।সেই আলো অবশ্য রাধুনির গৌর বর্ণের মুখের উপর এসেও পড়লো।সে কেবল এক হাতে নিজের চুল গুলো মুখের উপর থেকে ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছিলো।

নিরুপমা রহমান আজ রান্নার দায়িত্ব হাতে নিয়েছে।কাল রাত থেকেই সে রান্নাঘরে।মা টুকটাক সাহায্য করেছে।কিন্তু সব কাজ নিরুপমাই করেছে।মা অসুস্থ।এইটুক তো নিরু করতেই পারে।

সব রান্নাই অর্ধ সমাপ্ত।অরু আর হামাদ সাহেব এখনো রওয়ানা দেন নি।তারা আসতে আসতে নিরু সব গুছিয়ে নিবে।

পায়েসটা একবার চেখে নিয়ে নিরুপমা সন্তুষ্ট হয়ে হাসলো।ভালো হয়েছে খেতে।কাল বিকেলেই সে কাজু বাদাম কিনে এনেছে।সাথে আবার জাফরানও কিনেছে।এক গ্রাম জাফরানের দাম পড়েছে সাড়ে তিনশো টাকা।নিরুপমা এই এক গ্রাম এক বছর লাগিয়ে শেষ করবে।

অরুনিমা তার বর কে নিয়ে বাড়িতে এলো দুপুর দুইটা নাগাদ।নিরু ততক্ষণে গোসল সেরে নিহাদ কে খায়িয়ে দিয়ে ঘুম পাড়িয়েছে।নিহাদ কে নিয়ে তার একটা ভয় হচ্ছে।নিহাদ একটু ভীতু প্রকৃতির ছেলে তো তাই।নিরুপমার ছেলে হয়েছে নিরুপমার মতো,বুকে সাহস কম।অরুর বর কে দেখলে সে যে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদবে,তাতে কোনো সন্দেহ নেই।নিরুর ভয়টা সে জায়গাতেই।

হামাদ সাহেব খুব খারাপ মানুষ না।কিন্তু বাড়িতে একটা বাচ্চা তাকে দেখতেই কাঁদছে,ব্যাপারটা কেমন দৃষ্টিকটু না?উনি তো আসতেও চায় নি।জোর করে আনা হয়েছে।এখন আসার পর এসব দেখলে যদি সব ছেড়েছুড়ে চলে যায়?

সবকিছু গুছিয়ে নেওয়ার পরেই অরু আর হামাদ বাড়ি এলো।নিরুপমা দরজা খুলে তাদের দেখতেই প্রশস্ত হাসলো।মনোয়ারা তাদের বসার ঘরে নিয়ে বসালেন।অভি কেমন থম মেরে গোমড়া মুখে বসেছিল।আর অরু ছিলো অতিমাত্রায় প্রাণবন্ত,সেই সাথে উচ্ছ্বসিত।বসার ঘরে এসেই চারদিক দেখে বলল,’সেকি! সোফা টা না বাম পাশে ছিলো নিরু আপা?’

‘হু।কিন্তু ওভাবে রাখলে ঘরটা ছোট ছোট দেখায়।তাই পরিবর্তন করেছি।’

‘বাহ।সুন্দরই লাগছে।’

নিরুপমা শরবতের গ্লাস দু’টো দু’জনের দিকে বাড়িয়ে দিলো।অভি গম্ভীর মুখে বলল,’আমি খাই না শরবত।’

অরুনিমা কয়েক ঢোক শরবত গিলে অভির দিকে ফিরলো।বলল,’অনেক মজা।খেয়ে দেখো।না খেলে আমাকে দিয়ে দাও।’

নিরুপমা চোখ পাকিয়ে তার দিকে তাকালো।অভি গ্লাসটা হাতে নিয়ে সোজাসুজি অরুনিমার দিকে বাড়িয়ে দিলো।অরু বিরক্ত হলো খানিকটা।মুখ কুঁচকে বলল,’এক ঢোক খেয়ে কমিয়ে দাও।’

অভি সুবোধ বালকের ন্যায় তেমনটাই করলো।দুই চুমুকে কাঁচের গ্লাসে শরবতের উচ্চতা বেশ খানিকটা কমিয়ে সেটা অরুনিমার হাতে তুলে দিলো।অরু বলল,’তুমি কি হাত মুখ ধুবে?ঐ যে ডানদিকে গিয়ে বামদিকে যেই ঘরটা,ঐ টা তোমার।ঐখানে গিয়ে আরো একটু বামেই একটা দরজা।দরজা খুলে সামনে গেলেই হাত ধোয়ার বেসিন।আর পাশে গেলে ঝরনা।আরেকটু পাশে গেলে….’

‘অরু! থাম তুই।’

অরুনিমা থামলো।নিরুপমা সত্যি সত্যি রাগী চোখে তার দিকে তাকালো।অরু আর কোনো কথা বাড়ায় নি।অভি চুপচাপ উঠে বাম দিকের সেই ঘরটায় গেল।কাল রাতে অনেক দেরিতে ঘুমিয়েছে সে।কেন যে ঘুম আসে নি।অরুনিমা ঘুমের মাঝে একটা হাত তার বুকের উপর রাখে।অভির সেটা অস্বস্তি লাগে ভীষণ।তবুও কিছু বলতে পারে না।মানে বলতে ইচ্ছে হয় না।মেয়েটা তার বউ।সবকিছুতে ধমকাধমকি করলে বিষয়টা কেমন দেখায় না?

অরুনিমা অভির জীবনের সবচেয়ে অন্যরকম একটি মানুষ।অভি তাকে সব মানুষের কাতারে ফেলার অনেক চেষ্টা করেছে।হৃদি,সৃজু,তিয়াশা,সায়মা-সবার সাথে তাকে মেলানোর চেষ্টা করেছে।অথচ অরুনিমা তাদের কারো মতো না।অরুনিমা সম্ভবত একমাত্র কারণ,যার কারণে অভি বুক চিতিয়ে বলতে পারে না,দুনিয়ার সব মানুষই অমানুষ।অরু সেই কথা ভুল প্রমাণ করে দেয় বার বার।

বিয়ের পর অভি বহুবার তার ভেতর ছলনা,কপটতা খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করেছে।সেটা দেখে অন্তত নিজেকে স্বান্তনা দেওয়া যেত।বলা যেত,যে অরুকে বিয়ে করে সে কোনো পাপ করে নি।অথচ বিগত কিছুদিন যাবত অভির মনে হচ্ছে সে একটা বড়ো মাপের পাপ করেছে।

অরু বলেছিল,অরু তার জুতোর সাথেও অভির বিয়ে করাতে চায় না।কথাটা তার গায়ে লেগেছে।অরুর কথায় সে তাচ্ছিল্যের আভাস পেয়েছিল।এমন ভাবে বলল,যেন হামাদ কোনো বখাটে,অমানুষ।সেই কথার প্রেক্ষিতে সে অরুনিমাকে বিয়ে করে তার কথার যোগ্য জবাব দিয়েছে।

তবে বিবাহের এই গুটি কয়েক মাসে অভির মনে হলো,অরু তাচ্ছিল্য বোঝে না।অরু মানুষকে অপমান করা বোঝে না।কোন কথায় মানুষের কষ্ট হবে,সেটা অরু চট করেই বোঝে না।বোঝে না বলেই সে মনের ভেতরের সবটা প্রকাশ করে দেয়।সে একদম স্বচ্ছ পানির মতো।ফকফকে আর পরিষ্কার।অভি তার ভেতর বিন্দু পরিমান কুটিলতা খুঁজে পায় না।

জীবনের পথ পরিক্রমায় অভি নানারকম মানুষের দেখা পেয়েছে।কেউ কপট,কেউ চতুর,কেউ মিথ্যাবাদী,কেউ অহংকারী,কেউ প্রতারক,কেউ আবার হিংসুটে।অথচ অরুনিমা সেই সমস্ত উপমা ভুল প্রমাণ করে দিয়েছে।সে মিষ্টি।খুব বেশি মিষ্টি।সে সরল,সোজা,স্বচ্ছ।
অভি তো কোনোদিন তার ভেতর সৌন্দর্য খুঁজতে যায় নি।অভি খুঁজেছিল একটা চতুর,স্বার্থপর নারী বৈশিষ্ট্য,যেটা দেখে নিজেকে স্বান্তনা দেওয়া যেত।অথচ খুঁজে পেল একটা মাসুম হৃদয়।
অরুনিমাকে সে খুব জোরে ধমক দিতে পারে না।অরুনিমার হাতটা সে ঝাড়া মেরে সরিয়ে দিতে পারে না।অরুনিমার অনুরোধ সে মেজাজ দেখিয়ে ফিরিয়ে দিতে পারে না।এই মেয়েটার জন্য তার মায়া হয় ভীষণ।

নিরুপমা কে বিয়ে করার প্রস্তাবে সে বেশ বিচলিত বোধ করছিলো।তার মনে হচ্ছিল,নিরুর সাথে তার বিয়ে হলে নিরুর জীবন নষ্ট হবে।অথচ তাকে বিয়ে না করে সে করলো অরুনিমার সাথে বিয়ে।তার মতো বর পেয়ে কি অরুর জীবনে আতশবাজি ফুটছে?

গোসলখানায় গিয়ে ভালো মতো হাত মুখ ধুয়ে অভি ঘরে এলো।সে এখন একটু ঘুমুবে।বিকেলে বাইরে যাবে।খাটে বসামাত্র অরু ঘরে এসে বলল,’হামাদ! চলো খেতে চলো।’

অভি বলল,’আমি ঘুমাবো।পরে উঠে খাবো।’

অরু দুই দিকে তাকালো।তারপর গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এসে খাটের এক কোণায় বসলো।অভি কপাল কুঁচকে বলল,’কি সমস্যা?’
অরু আরো একটু নত হলো।নিচু স্বরে বলল,’নিরু আপা অনেক কষ্ট করে তোমার জন্য রান্না করেছে।তুমি যদি না খাও,তাহলে আপা খুব কষ্ট পাবে।মুখে কিছু বলবে না,কিন্তু সত্যি সত্যি কষ্ট পাবে।’

‘খাবো না তো বলিনি।বলেছি পরে খাবো।’

‘গরম গরম না খেলে মজা পাবে না।প্লিজ চলো।তারপর ঘুমাবে প্লিজ।’

অভি বিকৃত মুখে তার দিকে তাকালো।অরু তার ডান হাত ধরে বলল,’চলো না।তুমি না খেলে আমি খাবো না।’

অভি খাট থেকে নেমে সোজা হয়ে দাঁড়ালো।হনহনিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে থমথমে মুখে বলল,’আসো আসো।আর কাহিনি না করে আসো।’

****

নিরুপমা বুকে হাত রেখে বলল,’অরু!! তোর চুলের এই অবস্থা কেন?’

অরুনিমা আয়নায় নিজের চুল দেখে।বেশ রুক্ষ দেখাচ্ছে তাকে।বহুদিন চুলের যত্ন নেওয়া হয় না।সেই রুক্ষ এলোমেলো চুলে হাত রেখেই নিরুপমার কান্না পেল।বলল,কত্তো আদর করে চুল গুলো বড় করিয়েছিলাম।কতো সুন্দর তেল দিয়ে দিয়ে ঘন করেছিলাম! তুই কয়দিনে কি অবস্থা করেছিস অরু?’

অরু দিরুক্তি করলো।
‘ঐ বাড়িতে কে তেল দিবে আমার মাথায়?আমি নিজের মাথায় নিজে তেল দিতে পারি না।’

‘যাই হোক।কত্তে শখ করে তোর চুলের যত্ন নিয়েছি আমি!তুই এদের এভাবে অবহেলা করতে পারলি অরু?’

নিরুপমার সত্যি সত্যি কান্না পেল।অরু খিলখিল করে বলল,’আপা! চুল নিয়ে এমন মন খারাপের কিছু নেই।চুলের ভেতর কোনো স্নায়ু নেই।চুল একেবারে অপ্রয়োজনীয় একটি জিনিস।’

‘থাক হয়েছে।তোর আর গবেষণা করতে হবে না চুল নিয়ে।’

ঘড়িতে তখন চারটা বেজে কয়েক মিনিট হয়ে গেছে।অভি খেয়ে লম্বা ঘুম দিয়েছে।অরুনিমা তার ঘরের পর্দা টেনে ঘরটা আবছা করে রেখেছে।মনে করে দরজাটাও টেনে এসেছে।অভি যে তার কথা শুনে আসতে রাজি হয়েছে,এটাই তো অনেক।

নিরু তেলের শিশি থেকে সামান্য কয়েক ফোঁটা তেল হাতের তালুতে নিয়ে অরুনিমার মাথায় মালিশ করতে করতে চাপা স্বরে বলল,’হ্যাঁ রে অরু! তোর শ্বশুর বাড়ির লোকজন কেমন রে?’

অরু মুখ ভেঙচায়।
‘একেকটা একেক রকম।কিন্তু রিজোয়ানা সবচেয়ে খারাপ।’

‘ধ্যাত! এমন করে বলে না।’

‘আচ্ছা।বলবো না আর।’

‘রিজোয়ানা যেন কে?তোর চাচি শ্বাশুড়ি না?’

‘হু।’

‘তাকে তো বিয়ের দিন বেশ ভালোই মনে হলো।’

‘ঐ আরকি।লোক দেখানো ভালো।’

নিরুপমা ছোট করে নিঃশ্বাস ছাড়লো।বলল,’হামাদ সাহেব কি সারাদিন বাড়িতেই থাকে?’

‘নাহ্।বাড়িতে তো তাকে পাওয়াই যায় না।সে তো বাইরে বাইরেই থাকে।’

‘কাজের জন্য বাইরে বাইরে থাকে,নাকি এভাবেই?’

অরু ফিক করে হেসে দিলো।পেছনে ফিরে বলল,’তুমি আমার সাথে এতো ভেবেচিন্তে কথা বলছো কেন আপা?সোজাসুজি জিজ্ঞেস করো যে,অরু তোর বর কি করে?আদৌ কোনো কামাই করে নাকি? এটা বলো।’

নিরুপমা ভড়কে গেল।সাথে লজ্জাও পেল ভীষণ।সে কি বেশি বলে ফেলেছে?নিজের সীমারেখা নিয়ে নিরুপমা ভীষণ সচেতন।যখনই তার মনে হয় সে নিজের সীমা ছাড়িয়ে গেছে,তখনই তার কেমন যে অস্বস্তি লাগে।

অরুনিমা হাসি মুখে বলল,’আপা! বুড়ির যা সম্পদ আছে! সেটা দিয়ে আমরা আরো একশো বছর বসে বসে খেতে পারবো।’

নিরুপমা তার মাথায় গাট্টা মেরে ধমক দিয়ে বলল,’এসব কেমন কথা অরু?এভাবে বলতে নেই।’

নিহাদের ঘুম ভেঙেছে।ঘুম থেকে উঠেই সে চোখ ডলতে ডলতে দুই দিকে তাকালো।চোখ দু’টো যাকে খুঁজে যাচ্ছিল,তাকে দেখতে না পেতেই তার ঠোঁট ভেঙে এলো।ভাঙা ভাঙা ক্রন্দনরত স্বরে সে ডাক দিলো,’মা…মা!’

নিরুপমা ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ায়।সে খাট পর্যন্ত যাওয়ার আগেই অরুনিমা নিহাদের কাছে ছুটে গেল।গিয়েই এক খাবলায় তাকে কোলে তুলে নিয়ে তার গালে চুমু খেয়ে বলল,’আমার তুতুন সোনা! কেমন আছো তুমি?’

তুতুন তার দিকে তাকালো।তাকানো মাত্রই লজ্জা পেল।লজ্জায় লাল হয়ে সে মাথা নামিয়ে নিলো।
নিরুপমা হাসতে হাসতে বলল,’দেখেছিস?কি লজ্জাটা পায় দেখেছিস?’

অরুনিমা আরো দুইবার চুমু খেল।চঞ্চল গলায় বলল,’তুতুন! বলো তো এটা কে?’

নিহাদ মাথা তুলল আরেকটু পরে।দুই হাতে অরুনিমার গলা জড়িয়ে ধরে বলল,’তুমি অলু।’
বলেই সে আরেক দফা হাসলো।অরুনিমা তাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বলল,’হ্যাঁ।আমি তোমার অলু।হিহিহি।’

‘নিরু আপা! আমি কিন্তু এখন সারাদিন তুতুনকে আমার সাথে রাখবো।’

‘আচ্ছা রাখিস।’

‘এ্যাই তুতুন।তুমি আমার সাথে খেলবে?’

‘হু।’

‘ঠিক আছে।আমি আর তুমি এই দু’দিন এত্তো এত্তো খেলা করবো।’

____

অভি সন্ধ্যায় একটু বেরিয়েছিল বাড়ি থেকে।তারপর নয়টার ভেতরই আবার ফিরে এসেছে।আজ সে হিসেব করে দেখলো,সে মাত্র একটা সিগারেট খেয়েছে।বিগত কয়েকমাসে সে দিনে মাত্র একটা সিগারেট খেয়েছে,এমনটা হয়নি।তার মনে হচ্ছে,সে কোনো বড় সড় পরীক্ষায় লেটার নম্বর পেয়ে পাশ করেছে।

বসার ঘর তখন ফাঁকা।রান্নাঘর থেকে মনোয়ারা আর তার দুই কন্যার কন্ঠ ভেসে আসছিলো।অভি বসার ঘরে আসতেই খেয়াল করল, ফ্লোর জুড়ে নানারকম খেলনার জিনিস ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।অভির পায়ের নিচে একটা খেলনা এসে পড়তেই সে থেমে পেল।মাথা নামিয়ে দেখলো ফ্লোরের এক কোনায় একটা ছোটো বাচ্চা হাত পা ছড়িয়ে বসে আছে।তার মাথা নুয়ানো।অভিকে এখনো সে দেখে নি।

অভি পায়ের কাছে থাকা খেলনা টা তুলে তার কাছে গেল।মাথা নামিয়ে সেটা তার দিকে বাড়িয়ে দিলো।এবার সে মাথা তুলল।পিটপিট চোখে সামনে থাকা লোকটাকে দেখার চেষ্টা করল।

বাচ্চাটার ছলছল রক্তিম মুখ।অভি ভাবলো,হয়তো খেলনা নাগাল পাচ্ছে না বলেই এমন হয়েছে মুখের অবস্থা।সে আরো একটু ঝুঁকলো।তাতেই বাচ্চাটা গলা ছেড়ে ভ্যাঁ করে কেঁদে দিলো।যেন তেন কান্না না,কানে তালা দেওয়ার মতো বিকট শব্দে কান্না।

অভি ভ্যাবাচেকা খেয়ে একটু সরে দাঁড়ালো।নিহাদ ততক্ষণে খেলনা ফেলে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে এলোপাতাড়ি ছুটছিলো।নিরুপমা তার কান্নার শব্দ শুনেই একপ্রকার দৌড়ে দৌড়ে বসার ঘরে এলো।

নিহাদ মা কে দেখামাত্র তার বুকে ঝাপিয়ে পড়ল।কানতে কানতে তার চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে।বড় বড় ফোঁটার চোখের পানি তার চোখ গড়িয়ে থুতনি পর্যন্ত নেমে এসেছিল।নিরুপমা ছেলের চোখ মুছে বলল,’তুতুন! কি হয়েছে বাবা?’

নিহাদের নিঃশ্বাসের গতি তরতর করে বাড়ছিলো।কান্নার দরুন শ্বাস উঠে গেছে।নিরুপমা কান্নার উৎস খুঁজতেই এদিক সেদিক তাকালো।দেখলো অভি বসার ঘরের মাঝামাঝি সোজা দাঁড়িয়ে আছে।তার হাতে একটা খেলনা।চোখে অবিশ্বাস্য ভাব।ঐ বাচ্চাটা এভাবে কাঁদলো কেন তাকে দেখে?

নিরু দ্রুত তুতুনকে নিয়ে অন্য ঘরে চলে গেল।যেই ভয় টা পেয়েছিল,সেটা সত্যি হয়েছে।তুতুন তাকে ভয় পেয়েছে।যেতে যেতে একবার তুতুন সেদিকে তাকালো।চোখাচোখি হতেই সে ঠোঁট ভেঙে কতোক্ষণ কাঁদলো।নিরু লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যাওয়ার জোগাড়।তুতুনটা তার মান সম্মান বলে কিচ্ছু অবশিষ্ট রাখে নি।নিরু তার মুখটা নিজের কাঁধের সাথে চেপে ধরে অনুনয় করে বলল,’প্লিজ বাবা।দয়া করে চুপ থাক।’

****

অভি চোয়াল শক্ত করে ঘরে বসেছিল।অরু ভেতরে উঁকি দিলো।ঘরে পা না রেখেই জানতে চাইলো,’মন খারাপ?’

‘নাহ্।’

‘তাহলে?’

‘কাল সকালে আমি বাড়ি যাচ্ছি।তুমি থাকো এদিকে।ঐ বাড়ি যেতে মন চাইলে বলবে।এসে নিয়ে যাবো।’

অরুনিমা বড় বড় পায়ে তার সামনে এলো।তার চোখ দু’টো কেমন ছোট দেখাচ্ছে।সে অভির গা ঘেঁষে বসলো।হড়বড়িয়ে শুধু বলল,’কেন?তোমার তো কালকেও থাকার কথা ছিলো।’

‘ইচ্ছে করছে না।কি করবো?’

‘ইচ্ছে করবে।আরেকটা দিন থাকো।’

অভি কোনো কথা বলল না।অরু বলল,’তুতুন কাঁদলো বলে তুমি কষ্ট পেয়েছো?’

‘নাহ্।’

‘বুঝেছি।সেজন্যই।’

অভি কটাক্ষ করে বলল,’তুমি সব বুঝো?অন্তরের কথা বুঝো তুমি?’

অরুনিমা দায়সারা হয়ে জবাব দিলো,’হু।আমি তোমার অন্তরের কথা বুঝি।শোনো হামাদ।ছোট বাবুরা একটু এমনই হয়।তারা যা সামনে দেখে,সেটা থেকেই যা বোঝার বুঝে।তুতুন তোমাকে বুঝতে পারে নি।’

‘তার বোঝার কিছু নেই।আমি এমনই।’

‘মোটেও না।তুমি খুব ভালো।তুতুন কে সেটা বুঝতে হবে।’

অভি বিদ্রুপ করে হাসে।মাথা নেড়ে বলে,’কোনো প্রয়োজন নেই।তোমার তুতুন আমাকে ঠিকই বুঝেছে।তুমিই আমায় বোঝো নি।’

অরুনিমা ব্যথিত চোখে তার দিকে তাকালো।তার কেন কষ্ট হলো সে জানে না।সে নিচু স্বরে মিনমিন করে,’আমি তোমায় বুঝি না?’

‘নাহ্।’

‘তুতুন যদি তোমায় ভালোবাসে,তাহলে তুমি মানবে তুমি যে ভালো?’

অভি শব্দ করে হাসলো।
‘এসব পাগলামিতে সুর মেলানোর কোনো শখ নেই আমার।’

অরু বড় বড় পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।অভি খুব একটা বিকার দেখালো না।সে চুপচাপ মাথা নামিয়ে বসে থাকলো।বসে বসে একবার নিজের দাড়িতে হাত ছোঁয়ালো।সে কি এতোটাই বাজে দেখতে?কে জানে! হয়তো।

অরু ফিরলো তুতুনকে সঙ্গে নিয়ে।তুতুন সামনে তাকাতেই আগের মতো হু হু করে উঠলো।অরু তার কপালে চুমু খেয়ে বলল,’না না সোনা।এটা খুব ভালো।তোমাকে যে অলু চকোলেট দিয়েছি,এগুলো সব সে কিনে দিয়েছে।’

নিরুপমা ভয়ে ভয়ে দুয়ারে এসে দাঁড়ালো।ছেলেটা যে কি করবে বলা যাচ্ছে না।তুতুন কান্নার আওয়াজ সামান্য কমিয়ে আনলো।কিন্তু নাক অবশ্য তখনও টানছিলো।অরু তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,’কাঁদে না পাখি।এই আঙ্কেল অনেক ভালো।না না।আঙ্কেল না।বলো খালু।’

সে তুতুনকে অভির কাছাকাছি বসালো না।তার থেকে আরো একটু দূরে নিয়ে বসালো।তুতুন কান্না থামিয়েছে।কিন্তু ভয়ে সে তখনো তটস্থ।

অরু গিয়ে বসলো অভির গা ঘেঁষে।তারপর তার কাঁধে মাথা রেখে তুতুনের দিকে চেয়ে হাসিমুখে বলল,’এই যে দেখো আমি তার কাঁধে মাথা রেখেছি।সে কি আমাকে বকা দিয়েছে?’

তুতুন আঙুল কামড়াতে কামড়াতে তাদের দিকে তাকায়।শুধু তুতুন না,তুতুনের মা ও খুব মন দিয়ে তাদের দিকে তাকায়।নিরু কিছু দেখেনি।কেবল অরুর হাস্যোজ্জ্বল মুখটা দেখেছে।এই হাসি খাঁটি,এই হাসি নির্ভেজাল।বিয়ের পর নিরুকে জোর করে হাসতে হতো।সেই হাসিতে ছলনা ছিলো।অরুর হাসি স্বচ্ছ।সেখানে কোনো ছলনা মেশানো নেই।নিরুর এই হাসি দেখতে প্রচন্ড ভালো লাগছে।

অভি বসেছিল জড় পদার্থের মতো,কপালের রগ কুঁচকে।মাঝে থমথমে গলায় বলল,’আমি কি কোনো পশু?এমন ভাবে দেখাচ্ছো যেন তোমার তুতুন ভাবছে কাছে এলেই আমি তাকে খেয়ে নিব।তোমার তুতুন কে বলো,আমি এতোটাও খারাপ না।’

অরুনিমা শব্দ করে হাসলো।বলল,’তুতুনকে আপনার প্রেমে ফেলবো।শুধু দুই দিন সময় দিন আমায়।’

‘তুতুনের প্রেমিক হওয়ার কোনো শখ আমার নেই।’

অরুনিমা আরেকদফা খিলখিলিয়ে হাসে।দুই হাতে অভিকে শক্ত করে জাপ্টে ধরে তার কাঁধে মাথা ঠেকিয়ে তুতুনের দিকে চোখ এনে বলল,’দেখো।আমি তাকে জড়িয়ে ধরেছি।সে কিছু করেছে আমাকে?কিচ্ছু করবে না সোনা।তুমি আসো একবার।সে তোমাকে অনেক গুলো চক্কেট কিনে দিবে।’

তুতুন জহুরি চোখে দু’জনের দিকে তাকায়।অরু বোধহয় তার চেষ্টায় সফল হলো।দুই মূহুর্ত নিরব থেকে নিহাদ আধো আধো বুলিতে বলল,’ও আমাকে মাববে না?’

‘না বাবা।ও অনেক ভালো।ও শুধু দুষ্টুদের মারে।তুমি কি দুষ্টু?’

নিহাদ ডানে বায়ে মাথা নাড়ে।তারপর অনেক ভেবে চিন্তে হামাগুড়ি দিয়ে খাটের এক পাশ থেকে অন্য পাশে আসে।অরু তাকে অভয় দেয়,’সে খুব ভালো সোনা।তুমি আসো।এদিকে এসে বসো।’

অবশেষে।অবশেষে অরুনিমা কিছুটা সুবিধা করতে পারলো।নিহাদ বহু টালবাহানার পর শেষে অভির কাছাকাছি এসে বসলো।অরু তাকে টেনে তুলে অভির কোলে বসিয়ে বলল,’বসো।এই দেখো।সে কি তোমায় মেরেছে?সে কিচ্ছু করে নি।সে খুব ভালো।তুমি কেন তাকে ভয় পাচ্ছো?’

নিরুপমা ফ্যালফ্যাল চোখে তার দিকে তাকায়।সে দেখলো অরুর দুই চোখ ভেজা।তুতুন তার বর কে ভয় পাচ্ছে,অপছন্দ করছে,এই কষ্ট তার দুই চোখে ফুটে উঠছে বারবার।শুধুমাত্র তাকে অপছন্দ করাতেই অরুনিমার দুই চোখ ভরে উঠলো?ঐ লোকের জন্য অরুর এতো মায়া?

নিরুপমা কখন যে ছোট ছোট পায়ে ঘরের ভেতরে এসে দাঁড়িয়েছে,সে নিজেও জানে না।ভেতরে এসে সে দেখলো নিহাদ হালকা করে তার মাথাটা অভির বুকের সাথে ঠেকিয়ে আধশোয়া হয়ে আছে।অভি আলতো হাতে একটা হাত তার পিঠে রেখেছে।অরুনিমা আগের মতোই তার কাঁধে মাথা ঠেকিয়ে তুতুনের সাথে গল্প করছিল।অভি হাসে নি।আবার রেগে মেগে তাদের সরিয়েও দেয় নি।সে একটা প্রাণহীন জীবের মতো চুপ করে বসেছিল।মাঝে দিয়ে দুই অলিন্দের স্পন্দন জানিয়ে দিয়ে গেল,অভি বেঁচে আছে।অথচ হৃদস্পন্দন তখন বেড়ে হয়েছে একশো’ত চল্লিশ বিট পার মিনিট।

নিরুপমা সেদিন একটা সুখী পরিবারের চিত্র দেখল।অরুনিমার হাসি,তার আনন্দ সবকিছুতে নিরুপমা শান্তির ছাপ খুঁজে পেল।অরুনিমা সুখে ছিল।সেই সুখ বোঝানোর জন্য অরুর মুখ দিয়ে বলতে হয়নি যে সে সুখী।এক দেখায় কোনো পাগলও বলবে যে সে সুখী ছিলো।

নিরুপমা দেখলো অভি বেশ গম্ভীর হয়ে বসে আছে।হয়তো অরুর বাচ্চামো তে খানিকটা বিরক্ত।কিন্তু তবুও তো একবার সরিয়ে দিলো না।কেন সরিয়ে দিলো না?
উত্তরটা সে নিজে নিজেই পেয়ে গেল।কারণ অরুকে সে সম্মান করে।স্ত্রী হিসেবে যেই সম্মানটুকু একজন মেয়ের প্রাপ্য সেই সম্মান টুকু অরুনিমা রহমান পেয়েছে।

নিরুর চোখ দু’টো অরুর মতো করেই খুশির অশ্রুতে ভরে এলো।সে একটু দূরে সরে এসে দুই চোখ মুছলো।রাহাতের সাথে তার বিয়ের সময় সবাই আশা করেছিল,নিরুপমা খুব সুখে থাকবে।এমন একটা নিরেট ভদ্রলোকের সাথে কি নিরু কখনো অখুশি থাকতে পারে?অথচ নিরুপমা তার সংসার জীবনে সুখী কবে ছিলো,সেটাই তার মনে পড়ে না।সে তো হাসিমুখেই বিয়েটা করেছিল।শেষ পর্যন্ত তো সেই হাসি টিকে নি।

আর অরু বিয়ে করেছিল কাঁদতে কাঁদতে।একেবারে বাচ্চাদের মতো।কতো অনুনয় করেছিল বিয়ে করবে না বলে! কিন্তু সে বিয়ে করেছে।আর আশ্চর্যজনক ভাবে অরুনিমার একটা চমৎকার সংসার হয়েছে।কি আনন্দ! কি আনন্দ!
নিরুপমা আরেকবার তাদের দিকে তাকালো।

সুপুরুষের সংজ্ঞা কি?দেখতে যাকে বড়ো পরিপাটি মনে হয়,সে কি আসলে সুপুরুষ?নাকি সুপুরুষ হওয়ার সাথে দর্শনের কোনো মিল নেই?সুপুরুষ হয় ব্যক্তিত্বে,সুপুরুষ হয় যত্নে,সুপুরুষ হয় আচরণে।স্ত্রীকে সম্মান যে করে,তার চেয়ে বড়ো সুপুরুষ আর কে আছে?থাকুক না হয় গালের উপর একটা গভীর ক্ষত।এলোমেলো চুল নেমে আসুক চোখ পর্যন্ত।চাপ দাড়িতে ঢাকা পড়ুক সমস্ত চোয়াল।তবুও।দিনশেষে অরুনিমাদের অদ্ভুত বায়না পূরণ করে তারা সুপুরুষ হয়েই বেঁচে থাকুক।যেই কাঁধে মাথা রেখে অরু প্রাণ খুলে হাসছে,সেই কাঁধে আর কারো মাথা না পড়ুক।সমাজের চোখে নিন্দে পেয়েও হামাদ শিকদাররা যেন স্বীয় নারীর চোখে প্রাণপ্রিয় হয়ে উঠুক।ব্যাস,এইটুকই তো নিরুপমার চাই।

সে দ্রুত এলোমেলো পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।নজর খুব বাজে জিনিস।নিরুপমার অবচেতন মনও যেন কোনো ভাবে তাদের উপর নজর না দেয়।সে এখন দুই রাকাত নফল নামাজ পড়বে।তারপর খুব দোয়া করবে,অরুর সংসার যেন জগতের সবচেয়ে সুন্দর সংসার হয়।একটা সুন্দর সংসার দেখার ইচ্ছে নিরুপমার চিরকালই থেকে যাবে।

চলবে-

#কৃষ্ণপক্ষের_অন্তিম_প্রহর
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

২১.[দ্বিতীয় অংশ]

অফ হোয়াইট রঙের দেয়ালে দেয়াল ঘড়ি ঝুলছিলো।সেটা টিক টিক করতে করতে রাত এগারোটার ঘরে এসে থামলো।দূর হতে অজানা পাখির ডাক জানান দিলো রাতের গভীরতার।যদিও রাত এখনো তেমন গভীর হয়নি।তবে সিদ্দিক রহমানের বাড়িতে মোটামুটি সবাই বাতি নিভিয়ে যার যার ঘরে চলে গেছে।তুতুন ঘুমিয়েছে একটু আগে।নিরুপমা অতি সন্তর্পণে তার গায়ে একটা চাদর টেনে দিলো।

সবাই যার যার ঘরে।নিরুপমা এখন অবসর।সেদিনের চিঠির জবাব সে এতোক্ষণে দিবে বলে ঠিক করেছে।সেদিন সে চিঠি নিয়ে বাড়ি ফিরলো।তারপরই নানারকম কাজে সেটার জবাব দেওয়া হয়নি।এখন এই নিরব নিশুতি রাত তার পত্র লিখার উপযুক্ত সময়।

ঘরের বড় বাতিটা সে আগেই নিভিয়ে দিয়েছে।তুতুনের ঘুম ভেঙে যেতে পারে যেকোনো সময়।আপাতত ঘরের সমস্ত আলোর উৎস ডেস্কের উপর থাকা টেবিল ল্যাম্প।সেটার আলোতে কেবল টেবিলের একাংশই দেখা যাচ্ছে।আজ আকাশে চাঁদ উঠেনি।তারা আছে হাতে গোনা কয়েকটা।চিঠি লিখার জন্য এর চেয়ে উপযুক্ত সময় আর হতেই পারে না।

নিরুপমা বড়ো শখ নিয়ে কলম হাতে তুলেছিল।অথচ কাগজে সেটা ছোঁয়ানোর সৌভাগ্য তার হয় নি।তার আগেই কেউ দরজায় এসে পর পর তিনটা ধাক্কা দিলো।নিরু আঁতকে উঠে দ্রুত হাতে সামনে থেকে সবকিছু গুছিয়ে নিলো।অরুনিমা এসেছে নিশ্চিত।

সামনে থাকা কাগজগুলো ডেস্কের নিচে রেখে নিরুপমা তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়ালো।এই স্বল্প সময়ে তার কপালে যে দু’ফোঁটা ঘাম জমেছে,সে টেরই পায়নি।

দরজা খুলতেই অরুনিমা হাসি মুখে ভেতরে প্রবেশ করল।জবাবে নিরুপমাও জোরপূর্বক টেনে টেনে হাসল।উদাস,বিষন্ন আর মলিন হাসি।মন পড়ে আছে ধবধবে সাদা কাগজের উপর।সেটাতে কলম ছোঁয়ানোর অভিপ্রায়ে ভেতরটা ছটফট করছে।অথচ নিরুপমা নিরুপায়।কিছুই করার নেই।সে মেকি হেসে বলল,’আয় না।বোস।’

অরু বসলো।ঘাড় ঘুরিয়ে নিহাদের ঘুমন্ত মুখখানা দেখলো।বলল,’এতো দ্রুত ঘুমিয়ে গেল?’

‘রাত কি কম হয়েছে?আজ দুপুরেও ঘুমায়নি।খুব টায়ার্ড।’

‘তা ঠিক।আপা! শুনো না।’

‘বল।’

অরু খাটে হেলান দিতে দিতে বলল,’আমি আজ তোমার সাথে ঘুমাবো।’

মুহুর্তেই নিরুপমার মুখের হাসি বিলীন হলো।গৌর বর্ণের মুখটা ফ্যাকাশে হতে হতে এক পর্যায়ে পাংশু হয়ে গেল।দেখে মনে হচ্ছিল রক্তশুন্যতার রোগী।করুণ সুরে বলল,’আমার সাথে ঘুমাবি?’

বলতে বলতেই তার কন্ঠ নিভে এলো।অরু তার সাথে ঘুমাক।এতে তার আপত্তি নেই।কিন্তু আজ না।আজ নিরুর পত্র লিখার দিবস।আজ কেন এই ঘরটায় অন্য কেউ থাকবে?
সে তবুও প্রতিক্রিয়া দেখায় না।মুখে হাসি ফুটিয়ে অরুনিমার পাশাপাশি বসে বলল,’আচ্ছা ঠিক আছে।ঘুমাবি না হয় আমার সাথে।আমার সমস্যা নেই।’

অরু আরো এক দফা হাসলো।নিরুপমা খেয়াল করলো,হাসি মুখে অরুর স্নিগ্ধতা একটুখানি বেড়ে যায়।অরুনিমা হলো একটা ফুল।পদ্ম সরোবরে ফোটা পদ্মফুল যেমন স্নিগ্ধ,অরুনিমা অনেকটা এমন।নিরুপমা তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,’তোর সংসার সুখের হোক সোনা।তোর এই চোখ দু’টো তে যেন আপা কোনোদিন কষ্ট না দেখি।’

অরুনিমা লজ্জা পেল সামান্য।সেই লজ্জা আবিরের মতো তার সমস্ত মুখে ছড়িয়ে গেল।নিরুপমা সেই লজ্জায় নতুন বউয়ের ছাপ খুঁজে পেল।অরু মিনমিন করে বলল,’আপা জানো,বিয়ে পর আমি হামাদ কে ছু’রি দিয়ে মা’রতে গিয়েছিলাম।’

আপনাআপনি অক্ষিযুগল বড়ো হলো নিরুপমার।ড্যাব ড্যাব করে বোনের দিকে তাকিয়ে অবশেষে সমস্ত কৌতূহল একপাশে চেপে স্বাভাবিক গলায় বলল,’সেকি! তাই?’

‘হ্যাঁ।’

‘এরপর?’

‘এরপর সে আমায় বলল,এসব ছু’রি দিয়ে তাকে ভয় দেখিয়ে লাভ নেই।সে এসব দেখেই বড়ো হয়েছে।এসব ছু’রি চা’পাতি হলো তার বন্ধু।’

নিরুপমা প্রাণখুলে হাসলো।সহাস্যমুখে বলল,’দারুণ বলেছে।তবে আমি কিন্তু দেখেছি,সে তোকে বড্ড স্নেহ করে।’

‘তা করে।’

অরু কেমন উন্মনা হলো।এলোমেলো চোখে চারদিক দেখে নিচু স্বরে বলল,’আপা শোনো!’

লজ্জায় পড়লে মানুষের কন্ঠে পরিবর্তন আসে।কেমন যে অন্যরকম শোনায় তার কন্ঠ।অরুনিমার কন্ঠও পাল্টে গেল।নিরুপমা সেই কিঞ্চিৎ পরিবর্তন অনুভব করলো।গভীর দৃষ্টিতে পাশ ফিরে চাইলো বোনের লাজুক মুখশ্রীর পানে।চোখ দু’টো এক প্রকার কুঁচকে নিয়ে শুধালো,’কিরে! কি বলবি?’

অরু বোধহয় আরো একটু মিইয়ে গেল।সেই আড়ষ্টতায় মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না।কেবল খাটের উপর দু’পা তুলে পরনের কাপড় টা সামান্য উঁচুতে তুলে দু’চোখে সেদিকে ইঙ্গিত করলো।সেই দৃষ্টি অনুসরণ করে নিরুপমা নিজেই সেখানে তাকালো।লক্ষ্য করলো দু’টো রূপার নূপুর অরুনিমার দুই পায়ে চকচক করছে।নিরু প্রফুল্ল স্বরে বলল,’বারে! কি সুন্দর নূপুর! তোর দাদি শ্বাশুড়ি দিলো বুঝি?’

অরুনিমক বিরক্ত হলো।
‘ধ্যাত না।উনি কেন দিবে?’

‘তবে?’

লজ্জায় আবারো কেমন রক্তিম হলো মেয়েটার মুখ।মাথাটা আরো বেশি পালঙ্কের দিকে নামিয়ে সলজ্জ হেসে বলল,’হামাদ দিলো।’

কথাটা শেষ হতেই আবার তাড়াহুড়ায় বলল,’নিজেই পরিয়ে দিলো আপা।আমি কিছু করিনি।’

নিরু আরেকবার তার পায়ের দিকে তাকালো।তারপর তাকালো অরুনিমার মুখের দিকে।বলতে বলতেই যে সীমাহীন আনন্দ অরুর মুখে ছড়িয়ে গেল,সেই আনন্দের পরিমান নিরুপমার মেপে দেখতে ইচ্ছে হলো।সেটা যদিও বা সম্ভব না।কিন্তু কেন যে এতো এতো আনন্দে নিরুপমার ভেতরটাও ভরে উঠল।বর নূপুর পরিয়েছে বলে অরু কি ভীষণ লজ্জাটাই না পেল! এই লজ্জা,এই রক্তজবার ন্যায় মুখশ্রী,এই চাহনি,সবটাই নিরুর কাছে স্বপ্নের মতো।জীবন টা একটু একটু করে রঙিন হচ্ছে অরুনিমার,অথচ অজানা আনন্দে প্রতি মুহূর্তে আবিষ্ট হচ্ছে নিরুপমা।অরুনিমা কে তো সে চিরকাল নিজের সন্তানের মতোই দেখে এসেছে।যেই সুখ টুকু তার হয়নি,সেটা অরু পাবে না কেন?জগতের সমস্ত সুখ অরুনিমার হোক।জগতের সমস্ত সুখ নিহাদের চোখ।নিরু কেবল দু’চোখ ভরে তাদের সেই সুখ দেখবে।

সে আরো একবার অরুর মাথায় হাত বুলালো।তারপর আলতো হাতে তার গাল স্পর্শ করল।আদুরে স্বরে বলল,’আপা তোর জন্য দুই জোড়া নূপুর কিনেছি তো।সেগুলোর কি হবে?’

‘একটা আমার।একটা তোমার।’

‘ধ্যাত।আমি ঐসব নূপুর পরবো নাকি?আমাকে এসব মানায় না।’

অরু জেদ ধরল।
‘কেন?কেন মানায় না শুনি?’

‘এমনিই।’

‘নাহ্।তোমাকে আজ পরতেই হবে। তাও দু’পায়ে।’

‘উহু।আমার পায়ে ওসব ভালো লাগে না।’

‘একবার পরেই দেখো।’

ছোট্ট কাঠের বক্সে দু’জোড়া নূপুর রাখা ছিলো।অরু সেটার নাগাল পেতেই নিরুপমার সামনে এসে বলল,’কথা না বাড়িয়ে লক্ষী মেয়ের মতো এখানে এসে বসো।’

নিরুপমা ভয় পাওয়ার ভান করে চুপচাপ এক জায়গায় গিয়ে বসলো।অরু ঝুঁকলো।খুব যত্নে আপার পায়ে নূপুর জোড়া পরিয়ে দিলো।তারপর আফসোস করে বলল,’ইশশ! আপা।তুমি এতো সাদা।বড়ো হিংসে হয় আমার।’

নিরুপমা মৃদুস্বরে হাসলো।পা দু’টো হাঁটের উপর তুলে দুই হাঁটুর উপর মাথা ফেলে জানতে চাইলো,’তোর ক্লান্ত লাগে না আমার প্রশংসা করতে করতে?’

‘নাহ্।সত্য কথা বলতে আমার ক্লান্ত লাগে না।’

নিরু আগের মতো করেই হাসলো।অরু বলল,’আমার মন বলে,তোমার বর অনেক সুন্দর হবে আপা।তোমরা দু’জন পাশাপাশি দাঁড়ালে মনে হবে রূপকথার গল্প থেকে দু’জন মানুষ পৃথিবীতে চলে এসেছে।’

‘আহা! কতো শখ! তা তোর এই অচল আপাকে কি বিয়ে করবে শুনি?’

‘অচল মানে?’

অরু কি রেগে গেল?নিরুপমা তার মুখ দেখে স্পষ্ট আন্দাজ করতে পারলো না।চাপানো স্বরে কেবল জানতে চাইলো,’রাগ হয়েছিস নাকি?শোন অরু।আমার বিয়ে নিয়ে আর ভাবিস না তুই।ওসব আর আমার হবে না।আমি চাইও না।তুই মন দিয়ে সংসার কর।তবেই আমি খুশি।নিজের জীবনে আর কোনো ঝামেলা আমি চাই না।’

‘বিয়ে কোনো ঝামেলা না আপা।’

‘জ্বী সোনা।আমি জানি বিয়ে কোনো ঝামেলা না।এই যে দেখ,আমার পুরো শরীর সে কথাই বলছে।’

বলেই সে নিজের হাত পায়ের দিকে তাকালো।তার মুখে ব্যাঙ্গাত্মক হাসি।অথচ সেই হাসির আড়ালে চোখ দু’টো যে ছলছল করে উঠলো,সেটা কি অরু দেখেনি?বুকটা আচমকাই কেমন দুমড়ে মুচড়ে গেল।অরুনিমা আর হাসতে পারলো না।কথা বলে প্রসঙ্গ অন্যদিকে টেনে নিতেও ইচ্ছে হলো না।শুধু নিচের ঠোঁট টা কামড়ে ধরে খাট থেকে নামতে নামতে বলল,’না আপা।আমি তোমার কাছে ঘুমাবো না।হামাদের কাছে যাবো আমি।’

‘সেকি! তুই আমার কথায় কষ্ট পেয়েছিস?আচ্ছা সরি।আর বলবো না আপা।’

অরুনিমা দুই দিকে মাথা নাড়লো।বড়ো উদাস মুখে কক্ষ ত্যাগ করতে করতে জবাব দিলো,’না আপা।কষ্ট পাই নি।এমনিই ভালো লাগছে না।’

সে সত্যি সত্যিই চলে গেল।নিরুপমা ফ্যালফ্যাল চোখে তার প্রস্থান দেখলো।তারপর আনমনে ভারি ভারি দু’টো নিশ্বাস ফেললো।

নিরুপমার জীবনের পরিধি বড়ো না।কিন্তু শেখার পরিধি বিশাল।নিরুপমা এই জীবনে শুধু জ্বলে নি।এখন রীতি মতো অঙ্গার হয়ে গেছে।কিছুদিন পর হবে ছাই।আহা! তুতুনের একটা বাবা নেই।তুতুন কারো আঙুল ধরে জীবনে প্রথম স্কুলে যাবে না।ওহহ্,মা তো আছে তার।মায়ের হাত ধরে যাবে।

মানুষ বলে,জগৎ নাকি ভালোবাসার ভান্ডার?এই পৃথিবীর আনাচ কানাচে নাকি শুধুই ভালোবাসা?কই?নিরু যে একটু খানি ভালোবাসার জন্য এতো ছটফট করলো,কেউ তো সামান্য ভালোবাসা দিলো না?কি হতো যদি রাহাত তাকে একটু খানি সম্মান দিতো?কি হতো যদি রাহাত অন্য নারীর দিকে চোখ না দিতো।নিরু বেঁচে যেত।তুতুন বাবা কে পেয়ে যেত।কেন এমন হলো?কেন নিরুপমার সংসারটা এমন করে ভেঙে গেল?
নিরুপমা রহমান সব হারিয়েছে।শেষ ভরসা হিসেবে বুকভর্তি দীর্ঘশ্বাস ছাড়া তার আর কিছুই নেই।
.
.
.
.
অভির চোখ ঘুমের ঘোরে বন্ধ হয়ে আসছিলো।অরু এমন অবস্থাতেই তার কাঁধে মাথা রাখলো।আস্তে করে ডাকলো,’হামাদ!শুনছো?’

অভি ঘুম ঘুম কন্ঠে জবাব দিলো,’হুম।বলো।’

‘তোমার কি খুব ঘুম পেয়েছে?’

‘উমমম!’

‘আচ্ছা।’

অরু থামলো।আবার নিজ থেকেই বলল,’আমার মনটা খুব খারাপ হামাদ।একটু আমার দিকে ফিরো।’

মুখ দিয়ে আপনাআপনি বিরক্তিসূচক শব্দ বের হলো তার।এক ঝাড়ায় অরুনিমাকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে তিতিবিরক্ত মেজাজে বলল,’যাও তো।সারাক্ষণ এতো ঘেঁষাঘেঁষি ভালো লাগে না।’

অরু সরে এলো।আস্তে করে চাপা স্বরে বলল,’আচ্ছা।করবো না ঘেঁষাঘেঁষি।’

অভি তার চোখ দেখেনি।তার মুখের মলিনতাও দেখেনি।অথচ কন্ঠ নিসৃত গুটিকয়েক শব্দ শুনেই তার অভিমান টের পেল।অরুনিমার অভিমান হলো তার উপর?
সে চোখ খুলল।দ্রুত পাশ ফিরে প্রশ্ন করলো,’কেন?তোমার মন খারাপ কেন?কি হয়েছে তোমার?’

‘জানি না।’

অভি আরো একবার তাকে দেখলো।থমথমে মুখে বলল,’এবার চোখ বুজলে কিন্তু আর জবাব দিবো না।বললে বলো,না বললে নাই।’

অরুনিমা আগের মতো করেই মাথাটা তার কাঁধে ঠেকালো।আওয়াজ কমিয়ে এনে বলল,’সরাবে না খবরদার।’

মুখ জুড়ে সামান্য হাসি খেলা করে অভির।বিজ্ঞদের মতো সুরে বলল,’আচ্ছা সরাবো না।বলো এবার।’

‘নিরু আপার হাতের দিকে কখনো খেয়াল করেছো তুমি?’

‘নাহ্।’

‘আপার হাতে দেখবে ছোট ছোট অনেকগুলো দাগ আছে।’

‘ওহহ্।’

‘তুমি জানতে চাইবে না কিভাবে হয়েছে?’

‘কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছি।’

‘কি আন্দাজ করেছো?’

‘চাচাজান বলল,তার আগের প্রাক্তন স্বামী নাকি গায়ে হাত তুলতো।সেটার চিহ্নই হবে হয়তো।’

অরুনিমার কন্ঠ নিজ থেকেই জড়িয়ে এলো।চোখ দু’টো নোনা জলে ভরে টইটুম্বুর হলো।কেমন হু হু করে উঠে সে বলল,’আমার আপা পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মানুষদের একজন।আপার সাথে এমন হলো কেন বলো তো?’

‘তোমাকে কে বলল,যে মানুষ ভালো হলেই তার জীবন ভালো হয়?পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মানুষের জীবনও ফুলে ফুলে ভরা কোনো বাগান ছিলো না।
উল্টো করে বললে,ভালো মানুষেরই কষ্ট বেশি হয়।’

‘তাই?’

‘হুম।’

‘কেন?’

অভি দুই ঠোঁট প্রসারিত করল।অন্যমনস্ক হয়ে বলল,’সেই ব্যাখ্যা জানি না ঠিক।তবে যেটা সবচেয়ে বেশি শুনেছি,সেটাই তোমাকে বলি।’

‘কি?’

‘আল্লাহ যাকে বেশি ভালোবাসে,তাকে বেশি কষ্ট দেয়।যেন সব শাস্তি সে পৃথিবীতেই ভোগ করে নেয়।আখিরাত তখন পরিষ্কার থাকে।’

অরুনিমা অভিমান করে বলল,’আল্লাহ দু’হাত ভরে শুধু বড়োলোকদেরই দেয়।আমাদের কিচ্ছু দেয় না।’

অভি তাকালো তার দিকে।অরু নাক টেনে বলল,’তোমরা বড়লোক মানুষ।তোমরা কি বুঝবে আমাদের কষ্ট?’

সেই প্রশ্নের কোনো উত্তর অভি দেয় নি।তার চোখ তখন সিলিং-এর দিকে।এক মনে কি যেন দেখে যাচ্ছিল।অরু কথা শেষ করতেই সে ভারিক্কি স্বরে বলল,’তোমার ইমান খুব দুর্বল।আমারও তাই।সেজন্যই অল্পতেই স্রষ্টার দিকে আঙুল তুলি।তবে আমি একজন মানুষ কে চিনি,যে তার জীবনের চরম দুঃখের মুহূর্তেও স্রষ্টার প্রতি সন্তুষ্ট ছিলো।’

‘কে?’

অভির চোখ দু’টো শান্ত।চাহনিও স্থির হলো সময়ের সাথে।বুকের ভেতর ধুপধাপ তোলপাড় চলছিলো।সেসব কিছু সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে অভি হাস্কি গলায় বলল,’রেহনুমা রেখা।আমার মা।’
.
.
.
.

**জনাব মুস্তাফা,
আসসালামু আলাইকুম।সালাম নিবেন আমার।আপনার চিঠির ফিরতি চিঠি লিখতে এবার বেশ দেরি হলো।আশা করি ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখবেন।আসলে বাড়িতে আমার বোন এসেছে তো।তাই এ নিয়ে খুব ব্যস্ত।অরু বিয়ের পর এই প্রথম এই বাড়িতে এসেছে।তারা আসতেই বাড়িটা কেমন ঝলমল করে উঠেছে।

আপনি আপনার প্রথম চিঠিতে লিখেছিলেন,আপনি চিঠি লিখতে জানেন না।অথচ আপনাকে আমার তরফ থেকে কখনো জানানো হয় নি যে আমি নিজেও চিঠি লিখতে জানি না।এর আগে দাপ্তরিক চিঠি লিখেছি।কিন্তু অনানুষ্ঠানিক পত্র এই প্রথম লিখছি।সেটাও আপনাকে।

যাই হোক।সেটা মূল বিষয় না।
জনাব,
আপনি বয়সে আমার চেয়ে যথেষ্ট বড়ো।বিচক্ষণতায় আমার চেয়ে যোজন যোজন এগিয়ে।সুতরাং ঐসব নিয়ে কোনো কথা হবে না।আপনি নিশ্চয়ই জানেন,পত্র জিনিসটা খুবই একান্ত।একদম হাতে গোনা কিছু মানুষকেই সেটা নিয়ম করে দেওয়া যায়।আর সেই হাতে গোনা মানুষদের সাথে আমাদের একটা সুনির্দিষ্ট সম্পর্ক থাকতে হয়।

আপনার আর আমার মাঝে তেমন কোনো সম্পর্ক নেই।সেই কথা আপনি জানেন।আমিও জানি।আপনি কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে পত্র লিখছেন,এটাও আমি বলছি না।আপনি দয়া করে ভাববেন না আমি আপনাকে হেয় করে কিছু বলছি।এমনটা ভাবলে আমি খুব কষ্ট পাবো।

আসলে আমার ভয় হচ্ছে মুস্তাফা।নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারানোর ভয়।আমি নিজেকে যেই বাঁধনে বেঁধে রেখেছি,সেটা থেকে মুক্ত হতে আমার ভয় হয়।আমি যেমন জীবনে আছি,তেমনটার সাথেই আমি নিজেকে মানিয়ে নিয়েছি।

আমি ইদানিং লক্ষ্য করেছি,আপনার চিঠিকে কেন্দ্র করে আমার ভেতর কিছু অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে।যেই পরিবর্তন গুলো শুরুতে মধুর লাগলেও এক পর্যায়ে এসে আমার মানসিক অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।আমি ইদানিং প্রচন্ড টানাপোড়েনে ভুগি।

আপনার কাছে কিছুই গোপন করতে চাই না।তাই সবটা খোলাসা করে বলছি।
আপনার রোজ রোজ চিঠি পেয়ে আমি কিছুটা লোভ করে ফেলেছি।নিষিদ্ধ জিনিসের লোভ,অত্যন্ত ভয়ংকর লোভ।সময় থাকতেই টের পেয়েছি ভাগ্যিস।কিন্তু আপনি খুব ভালো করেই জানেন,আমাদের সম্পর্কের কোনো পরিনতি নেই।আমি পরিনতি চাচ্ছিও না।আপনার একটা গোছানো পরিপাটি জীবন।এই জীবনে নিজেকে জুড়ে দিতে আমি ইচ্ছুক না।তাই মনে করুন নিজ থেকেই একটু পিছিয়ে এলাম।

যেই সম্পর্কের কোনো পরিনতি নেই,সেটাকে টেনে নেওয়া হলো জেনেবুঝে নিজের রুহ কে কষ্ট দেওয়া।এক জনমে অনেক কষ্টই তো আমার হলো।এই কষ্টটা না হয় না ই পেলাম।আমি যদি আর কয়েক ধাপও এগিয়ে যাই,তবে আমি এই জীবনে এসব থেকে বের হতে পারবো না।

মুস্তাফা! এই জীবনে আর নতুন করে কষ্ট চাই না।আমাদের দু’জনেরই যথেষ্ট বয়স হয়েছে।আমরা কেন একে অন্যকে চিঠি দিচ্ছি সেটাও আমরা জানি।হয়তো এখনো বিষয়টা মোহ পর্যন্তই আছে।সেটাকে বাড়াবেন না প্লিজ।আমার জীবনটা খুব জটিল।আশা করি আপনি বুঝতে পারছেন।

স্রষ্টা সবাইকে সব দেয় না।আমাকে দেয় নি।আমি তাতে দুঃখিত না।আমি আমার মতো করে সুখ খুঁজে নিয়েছি।অবেলার ঝড়ে আমার জীবনের অনেকটাই বিলীন হয়েছে।এবার কলম হাতে তুলে নিয়ে ক্ষয়ে যাওয়া জীবনের কিছুটা হলেও পুনরুদ্ধার করতে চাই।

আপনি আমার পড়াশোনা শুরুর একমাত্র প্রেরণা।যতোবার কলম হাতে নিব,ততোবার কেবল আপনার কথা মনে পড়বে।আপনি চিরকালই আমার শুভাকাঙ্ক্ষী থাকবেন।আমি আপনার জন্য মন থেকে দুয়া করি।খুব ভালো থাকুন মুস্তাফা।আপনার সাত সিপাহির প্রতি আমার সম্মান আর ভালোবাসা রইল।আপনাদের পেশার প্রতি আমার সীমাহীন সম্মান রইলো।তন্ময়ের জন্য বিশেষ করে ভালোবাসা।আপনারা দেশ নামের ফুলকে রক্ষা করার চেষ্টায় যেই নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন,এর বিনিময়ে রব আপনাদের পুরষ্কৃত করুক।আমার শুভকামনা রইলো।ভালো থাকবেন মুস্তাফা।এই জীবনের মতো আল্লাহ হাফেজ।

নিরুপমা রহমান
সমতট লেন,ঢাকা
***

নিরুপমা চিঠি লিখা শেষ করলো ফোঁপাতে ফোঁপাতে।কান্নার দমকে সে শেষের লাইন গুলো সুন্দর করে লিখতে পারে নি।কেমন যে এলোমেলো হয়ে গেল।
সে কখনো এমন একটা চিঠি লিখতে চায়নি।কিন্তু পরিস্থিতি বিবেচনায় নিরুপমা নিরুপায়।এই ব্যাপারটা টেনে নেওয়ার কোনো মানে নাই।নিরু যথেষ্ট বুঝদার।কৈশোরের ভুল করার বয়স তার এখন নেই।

সে চোখ মুছতে মুছতে খাটে গিয়ে বসলো।তার মনে হলো আপন কোনো মানুষ দূরে চলে গেলে যেমন কষ্ট হয়,তারও ঠিক তেমনই কষ্ট হচ্ছে।আর কি কখনো চিঠি লিখা হবে না?মুস্তাফা কি কোনোদিন আর তার জন্য চিঠি লিখবে না?

রাতের অনেকটা সময় নিরুপমা কেবল ছটফট করলো।কিসের জন্য তার এতো ছটফট সে জানে না।সে শুধু কষ্টটাই অনুভব করলো।তার মন খারাপের অনেক কারণ আছে।মুস্তাফা যদি পেশায় খুব সামান্য কেউ হতো,তবে নিরু পেছাতো না।সমাজের চিন্তাভাবনার পরোয়া না করে চিঠি আদান-প্রদান চালিয়ে যেত।কিন্তু মুস্তাফা একজন সামরিক সদস্য।তার সাথে নিরুপমার যায় না।নিজেকে যথাযথ সম্মান করেই নিরুপমার এই কথা মনে হয়েছে।মুস্তাফার একটা ফকফকে সুন্দর সংসার প্রয়োজন।যেখানে একটা বিশুদ্ধ আর কম বয়সী মেয়ে থাকবে।যার জীবনের প্রথম পুরুষ হবে সে।তারপর দু’জনের একটা সুন্দর সংসার হবে।সেই সংসার দেখার জন্য হলেও নিরুপমার পত্র বিনিময় বন্ধ করা উচিত।

সে রাতের শেষ ভাগে আবার কি মনে করে উঠে এলো।এবার আর চিঠি লিখেনি।পুরোনো খাতার একটা পৃষ্ঠায় গোটা গোটা অক্ষরে লিখলো,

‘মুস্তাফা!
দয়া করে আমার চিঠির কথা কেই আমার মনের কথা ভাববেন না।আমি আসলে মোটেও চাই না যে আপনি আমায় চিঠি দেওয়া বন্ধ করুন।ঐটা আমার মনের কথা না।আমি মিথ্যা বলেছি।আপনি দয়া করে চিঠি লিখা বন্ধ করবেন না।আমি চাই আপনি আমায় রোজ চিঠি দিন।

আমি মিথ্যে বলেছি।আমি এই চিঠি আদান-প্রদান কোনোদিনই বন্ধ করতে চাই না।তবুও পরিস্থিতি এতোটাই প্রতিকূল যে আমি আপনাকে মন খুলে কিছু জানাতে পারছি না।মুস্তাফা! প্লিজ।আপনি চিঠি পাঠানো বন্ধ করবেন না।বিনিময়ে আমাকে শক্ত করে ধমক দিয়ে বলবেন,’এসব কেমন কথা নীলা?আপনি এতো অবুঝপনা করছেন কেন?’

মুস্তাফা! আপনি কি একটা কথা জানেন?থাক।আর জানতে হবে না।কোনোদিন দেখা হলে জানাবো।কলমের কালিতে এই কথা লিখতে ইচ্ছে হচ্ছে না।জানি এই অভিমানের কোনো মূল্য নেই।তবুও অভিমান করছি।আপনি যদি আর ফিরতি পত্র না পাঠান,তবে আমি আর ভাত খাবো না কোনোদিন।’

নিজের লিখা পড়ে নিরুপমার নিজেরই হাসি পেল।বাচ্চামো আর আহ্লাদ ভরা চিঠি।যেটা সে কোনোদিনই ডাকবক্সে ফেলবে না।কিছু কথা গোপনই থাকুক।ঠিক যেমন নিরুপমার গোপন দুঃখ।নিরুপমার কাছেই জমা থাকুক।নিরুপমা সব কিছু মেনে নিয়ে বেশ আছে।
.
.
.
.
‘তুতুন! শোন।আমি লুকাবো এখন,আর তুই আমাকে খুঁজবি।ঠিক আছে?’

তুতুন পিটপিট চোখ করে উপরে তাকালো।অরুনিমা তর্জনী উঁচু করে বলল,’কিরে?শুনতে পেলি আমার কথা?’

নিরুপমা চুলায় কোরমা বসিয়েছে মাত্র।এখনো দুধ ঢালা হয়নি।মাংসের টুকরো গুলো আগেই এক পাশে ভেজে রেখেছে।অরুর কথা কানে যেতেই রান্নার ফাঁকে গলা উঁচিয়ে বলল,’আমার ছেলে ব্যাথা পাবে অরু।এসব খেলা খেলিস না।’

অরুনিমা নাক ছিটকে বলল,’এতো ন্যাকামো কেমন করে করো আপা?তোমার ছেলেকে নিয়ে তোমার আহ্লাদের শেষ নাই।’

নিরুপমা চুলোর আঁচ কমিয়ে বসার ঘরে এলো।হালকা নীল রঙের শাড়ির আঁচলটা একপাশ ঘুরিয়ে তার কোমরে গোজা।ঘরে এসেই সে অরুরিমার দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকালো।কড়া সুরে বলল,’মানা করেছি না অরু?তুতুন একটা ব্যথা পাবে।তখন তো তুইও কষ্ট পাবি।’

‘উহু আপা।তুতুন ব্যথা পাবে না।’

অরুনিমা তুতুনের গাল টেনে বলল,’কিরে তুতুন?তুই ব্যথা পাবি?দৌড়াদৌড়ি করলে কিন্তু ব্যথা পাবি।করবি দৌড়াদৌড়ি?’

তুতুন ডানে বায়ে মাথা নাড়ে।অরু তার গালে চটপট দু’টো চুমু খেয়ে বলল,’আমি লুকাবো,আর তুই আস্তে আস্তে খুঁজবি।বেশি জোরে দৌড়াবি না।আর খাটের নিচে ঢুকবি না।আমি ঐদিকে লুকাবো না।ঠিক আছে?’

নিরুপমা বলল,’তোর কিন্তু ধূলোয় এলার্জি অরু।যেখানে সেখানে লুকাস না বলে দিচ্ছি।’

‘আচ্ছা আপা।তুমি এবার রান্না করো যাও।’

নিরুপমা আগের মতো করেই রসাইঘরে চলে গেল।আজ রাতেই বোধহয় অরু আর হামাদ সাহেব চলে যাবে।উনি তো কালই চলে যেতে চাইছিলেন।অরু অনেক কষ্টে আটকালো।এখন আবার বাইরে গিয়েছে।কখন ফিরবে কে জানে?
নিরুপমা দ্রুত হাতে কাজ গোছাচ্ছিল।যোহরের আযান দিবে যেকোনো সময়।দু’টো বাজার আগেই সব খাবার টেবিলে নিয়ে রাখতে হবে।

এরই মাঝে ঘরের ভেতর কেউ চেঁচালো,’কুক!’

নিরুপমা রান্নার ফাঁকেই হালকা শব্দ করে হাসলো।অরুর কন্ঠ।সে লুকোচুরি খেলছে তুতুনের সাথে।একটু পর পর দু’জনের হাসির শব্দ নিরুপমার কানে আসছে।নিরুর মনে হলো এই বাড়িটা অনেক দিন পরে প্রাণ ফিরে পেয়েছে।অরু আসাতেই বাড়িটা ঝিলমিল করে উঠেছে।নয়তো এই বাড়ি থেকে হাসির ঝংকার প্রতিধ্বনিত হয়না কতকাল ধরে।

অভি আযানের সাথে সাথেই বাড়ি এলো।বসার ঘরে পা রেখেই সে দু’হাত তুলে আড়মোড়া ভাঙলো।তুতুন বসার ঘরে ছুটোছুটি করছিল।কখনো আবার মাটিতে বসে মেঝের দিকে ঝুকে কিছু একটা খুঁজছিল।অভি কপাল কুঁচকে তার কাজকর্ম দেখে।তারপর নির্বিকার চিত্তে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ায়।

তুতুন তাকে দেখলো।প্রথমে সংকোচ আর ভয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিল।পরে আবার কাল রাতের কথা মনে পড়তেই উঠে দাঁড়িয়ে তার কাছে ছুটে গেল।

‘খালু! খালু!’

অভি থামলো।অদ্ভুত সম্বোধনে পেছন ফিরল।তুতুন ছুটে এসেই তার দিকে দু’হাত বাড়ালো।যার অর্থ-কোলে নাও।
অভি সন্দিহান চোখে তার দিকে তাকায়।সত্যিই কোলে আসবে?নাকি আসার পর গতকালকের মতো ভ্যাঁ করে কেঁদে দিবে?সে অপ্রস্তুত হয়ে হাত বাড়ালো।তারপর একটানে তুতুনকে কোলে নিলো।
তুতুন তার কানের কাছে এসে ফিসফিস করলো,’অলু কুতায়?’

অভি ভ্রু কুঁচকে বলল,’আমি কেমন করে জানবো?বাড়িতে তো তুমি ছিলে।’

‘অলু লুকোচুলি খেলচে।’

‘তোমার সাথে?’

‘হু।’

অভি হাসলো।অস্ফূট স্বরে বলল,’বাহ্! খুব কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বী নির্বাচন করেছে তো দেখছি।’

তুতুন চোখ সরু করে তার দিকে তাকালো।দেখে মনে হলো অভির কথার ভাবার্থ সে ধরতে পেরেছে।সে বুঝতে পারছে খালু তার দলে নেই।অভি আরো এক দফা হাসলো।কন্ঠের গাম্ভীর্য ঝেড়ে ফেলে একটু স্বাভাবিক হয়ে বলল,’চলো তুতুন।আমরা অলুকে খুঁজি।’

___

অরুনিমাকে খোঁজা কঠিন কিছু ছিলো না।সে আলমারির পেছনে খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে ছিল।অভি সবার প্রথমে তার ওড়নার সামান্য অংশ দেখলো।তারপর তুতুন কে কোল থেকে নামিয়ে আঙুল দিয়ে সেদিকে ইশারা করলো।

তুতুনের ছোট্ট মুখটা খুশিতে ভরে গেল।সে এক দৌড়ে আলমারির কাছে গিয়ে অরুনিমার ওড়না টা টেনে ধরলো।খিলখিল করে বলল,’অলু! আমি তুমাকে ধলে ফেলেচি।’

অরুনিমা চকিত ভঙ্গিতে তার দিকে তাকায়।তারপর তাড়াহুড়ো করে আলমারির আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে।তুতুন তাকে কি করে খুঁজে নিল?সে তো এতো সহজ জায়গায় লুকায় নি।

অভি ঘরের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে ছিলো,দু’হাত বগলদাবা করে।অরুনিমা কোমরে হাত রেখে চোখ পাকিয়ে বলল,’আচ্ছা! ঘটনা তাহলে এই।হামাদ সাহেব এসবের পেছনে কলকাঠি নেড়েছেন।’

অভি তাচ্ছিল্য করে হাসলো।
‘তোমার তুতুনই এলো আমার কাছে।আবদার করল।’

‘আবদার তো আমিও কতোকিছু করি।তুমি সবগুলো রাখো?’

‘তুতুনের তো গলা ছেড়ে কান্না করার স্বভাব।’

অরুনিমা মেকি রাগ দেখিয়ে বলল,’তাহলে আজ থেকে আমিও কান্না করবো।’

অভি বাঁকা চোখে তার দিকে তাকালো।হাসিটুকু গোপন করে গম্ভীর মুখে বলল,’তুমি কান্না করলে দু গালে ধরে দু’টো চড় দেব।এতো বড়ো মেয়ে নাকি কান্না করবে!’

অরুনিমা গুটি গুটি পায়ে তার দিকে এগিয়ে এলো।নাক টানতে টানতে তার শার্টের কলার অব্দি পৌঁছে মুখ কুঁচকে বলল,’সারা মাসের সিগারেট একদিনেই খেয়ে নিয়েছো নাকি?’

বিরক্ত হলো অভি।একহাতে অরুনিমাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বলল,’দূরে যাও তো তুমি।সারাক্ষণ ঘেঁষাঘেঁষি ভালো লাগে না।’

‘ঘেঁষাঘেঁষি করছি না।’

অরু ওড়নার এক প্রান্ত দিয়ে অভির ঘাম মুছতে মুছতে বলল,’তুতুন আজ তোমায় ভয় পাই নি?’

‘না।’

‘দেখেছো।আমি জানতাম,তুতুন তোমাকে একটুও ভয় পাবে না।তুমি একদমই ভয় পাওয়ার মতো না।’

অভি চুপচাপ বসে থাকলো।বলল,’তোয়ালে দাও লাগেজ থেকে। গোসলে যাবো।’

অরু অলস পায়ে হেঁটে লাগেজ পর্যন্ত যায়।তারপরই আবার কি একটা ভেবে এক দৌড়ে রান্নাঘরের দিকে ছুটে গেল।

‘আপা,আপা।’

অরুনিমা হাপাচ্ছিল।নিরুপমা পেছন ফিরে বলল,’কিরে?কি হয়েছে?’

‘তুমি যে হামাদের জন্য শরবত বানিয়েছেলে,সেটা কোথায়?’

‘ফ্রিজে আছে।উনি কি এসেছেন?’

‘হ্যাঁ,এসেছেন।’

অরুনিমা ফ্রিজ থেকে শরবতের গ্লাস টা বের করে আগের মতো করেই নিজের ঘরের দিকে ছুটলো।নিরুপমা নিজেও চুলোর আঁচ কমিয়ে তাদের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।

অরু বলল,’তোমার জন্য শররত।আপা বানিয়েছ। ঐ বাড়িতে কেউ এমন করে তোমার জন্য শরবত বানিয়ে রাখে?তবুও তুমি ঐ বাড়ি যেতে চাইছো।’

‘বাজে বকো না।’

অরুনিমা কিছু বলল না।লক্ষী মেয়ের মতো চুপ করে অভির পাশাপাশি বসলো।অভি ত্যাছড়া চোখে বলল,’কি চাই আবার?’

অরুনিমা গালের নিচে একহাত রেখে বলল,’কিছু চাই না।এমনিই।তোমার কাছাকাছি থাকতে ভালো লাগে।’

কেমন অদ্ভুত রকমের অস্বস্তিতে অভির শরীর জমে এলো।সে আর অরুনিমার দিকে তাকালো না।এলোমেলো চোখে এদিক সেদিক তাকালো।নিরুপমা মুখের উপর আঁচল চেপে চাপাস্বরে হাসলো।

তুতুন খেলনা হাতে তাদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো।নিরুপমা তার আগেই গুটি গুটি পায়ে তার কাছে এসে এক ছোঁ মেরে তাকে কোলে তুলে নিলো।অরু আর অভি তখনো তাকে দেখেনি।তারা দরজার দিকে পিঠ করে বসেছিল।নিরু দ্রুত পায়ে তুতুনকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।বলল,’এখন যাসনে বাবা।তারা একটু একা থাকুক।’

তুতুন বলল,’আমরা আর লুকুচুকু খেলব না মা?’

‘খেলবো বাবা।আগে খেয়ে নাও তারপর।’

নিরুপমা জানতে চাইলো,’তুতুন সোনা।খালুকে তোমার কেমন লেগেছে?’

‘ভালু।’

তুতুন মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলল,’মা! খালু কাকে বেশি আদল করে?অলুকে না আমাকে?’

‘উমমম,আমার মনে হচ্ছে তোমাকে।’

তুতুন লাজুক হাসলো।নিরুপমা হাসিমুখে তার মুখটা দেখলো।গতকালই তো খালুর ভয়ে কেঁদে কুটে অস্থির হলে।আজ আবার খালুর আদরে ভাগ বসাচ্ছে।নিরু হাসলো।হামাদ সাহেব কি আদর দিতে জানেন?তাকে দেখে তোনিরুরই কেমন ভয় লাগে।সে প্রথমবার তাকে দেখার পর ভেবেছিলো তুতুন আর অরু তাকে ভীষণ ভয় পাবে।অথচ হলো উল্টা।নিরু ভয়ে,জড়তায় তার সাথে একটার বেশি দু’টো কথা বলতে পারে না।অথচ তারা দু’জন রীতিমতো তার কোলে উঠে বসে থাকে।অদ্ভুত ব্যাপার!

চলবে-