কৃষ্ণপক্ষের অন্তিম প্রহর পর্ব-২২

0
32

#কৃষ্ণপক্ষের_অন্তিম_প্রহর
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

২২.[প্রথম অংশ]

শিকদার বাড়িতে আজকের কোলাহলের মূল হোতা স্বয়ং শাহরুখ খান।তাকে নিয়ে আজ বাড়ি ভর্তি ছেলেমেয়ে দের উৎসাহ,উদ্দীপনা।বিষয় টা তেমন জটিল কিছু না।বরং একেবারেই পানির মতো স্বচ্ছ।

মধুমিতায় এই বছর একটা সিনেমা বেশ নাম করেছে।দেবদাস নাম।শরৎচন্দ্রের দেবদাস এখন আর বইয়ের পাতায় নেই।সিনেমার বড় পর্দায় পাঠকরা দেবদাস কে চক্ষু মেলে দেখতে পারছে।সেই দেবদাব চরিত্রেই অভিনয় করেছেন বর্তমানের তুমুল জনপ্রিয় অভিনেতা শাহরুখ খান।সেই সিনেমার টিকিট হলো সোনার হরিণ।খুঁজলেও পাওয়া যায় না।খুব সকালে সিরিয়াল দিলে তবে বোধহয় একটু আকটু সুবিধা করা যায়।

হাশিম শিকদার বহু কষ্টে কাল রাতে আটটা টিকিট যোগাড় করেছে।আজ বিকেলে তারা যাবে সিনেমা দেখতে।এই নিয়ে হৃদিতার হম্বিতম্বির শেষ নেই।খুশিতে একটু পর পর সে গদো গদো হচ্ছে।কতোদিন পর তারা সিনেমা দেখতে যাচ্ছে!

অরুনিমা আর অভি গতকাল বাড়ি ফিরেছে।হৃদিতা এক প্রকার লাফাতে লাফাতে অরুর ঘরে গেল।অরু তখন মাত্র গোসল সেরেছে।কাল রাতে ক্লান্তিতে লাগেজ থেকে কাপড় গুলো বের করা হয়নি।এখন করতে হবে।হৃদি এসেই চপলা সুরে বলল,’কি করো অরুনিমা?’

‘কিছু করি না।কাপড় গোছাবো এখন।’

‘ওহ।’

হৃদি আরো একবার প্রগাঢ় হাসলো।অরুনিমা তার হাসি দেখেই কপাল কুঁচকে বলল,’ব্যাপার কি বলো তো?এতো হাসছো কেন?’

‘ব্যাপার অনেক কিছু।তুমি শুনলে শুধু হাসবে না।একদম লাফাবে।’

অরুনিমা ছটফটে হয়ে শুধালো,’বলো না।বলো না।’

হৃদি একগাল হাসলো।হাত দু’টো আড়াআড়ি করে বলল,’হাশিম ভাইজান টিকিট এনেছেন।সিনেমার টিকিট।বললো বিকেলে নাকি সবাই মিলে দেখতে যাবে।’

অরুনিমার চোখ দু’টো খুশির আনন্দে ঝলমল করে উঠলো।কি অদ্ভুত এক দীপ্তি পুরো চোখে ছড়িয়ে গেল।সে এই জীবনে কখনো টিকিট কেটে সিনেমা দেখেনি।সিনেমা হলের নাম সে শুনেছে।তার বান্ধবীদের কয়েকজন গিয়েছিলো।আসার পর তার কাছে গল্প করেছে।সেই তখন থেকেই তার হলে গিয়ে সিনেমা দেখার ইচ্ছে।সে হৃদির হাতটা চেপে ধরে প্রফুল্ল স্বরে বলল,’সত্যি?কোন হলে?’

‘মধুমিতা।’

‘উফফ! ‘
অরুনিমার মনে হলো সে কেঁদেই দিবে খুশিতে।

ডানা মেলা প্রজাপতির মতো অদৃশ্য ডানায় অরু সমস্ত ঘরে ঘুরপাক খেলো।আজ সে প্রথমবারের মতো সিনেমা হলে যাবে।মধুমিতা সিনেমা হল।কতো নাম শুনেছে! অবশেষে সেখানে যাওয়ার সুযোগ হলো।সে আলমারির এক পাশের কপাট খুলতে খুলতে সহাস্য মুখে বলল,’হৃদি।হাশিম কে আমার হয়ে ধন্যবাদ দিবে।তার পছন্দের জিনিস কি?’

‘হুন্ডা।’

‘তাকে বলবে আমি বড়ো হয়ে তাকে একটা হুন্ডা কিনে দিবো।’

হৃদি ঠোঁপ টিপে হাসলো।
‘আর কতো বড়ো হবে তুমি?’

অরুনিমা সে কথা শুনলো না।আলমারি ঘাটতে ঘাটতে চিন্তিত সুরে বলল,’কিন্তু কি রঙের জামা পরবো বলো তো?আমি ভেবেছি আমি আর হামাদ আজ এক রঙের জামা পরবো।’

‘সেকি! কেন?’

অরুনিমা কিছুটা লজ্জা পেলো।মাথা নামিয়ে বলল,’নিরু আপার বান্ধুবি সুজানা আপা সবসময় তার বরের সাথে রং মিলিয়ে জামা পরে।’

‘সুজানা আপার বর তো মনে হয় ভালো মানুষ।তোমার বর তো অতো ভালো মানুষ না।আর তাছাড়া সে যাবে বলেও তো মনে হচ্ছে না। ‘

হৃদি বেশ স্বাভাবিক।অথচ অরুনিমার হৃদয় তখন শোকের ছায়ায় নিমজ্জিত।আধাঁর মুখেই জবাব দিলো,’এভাবে বলো না।তাকে ছাড়া কোথাও যেতে আমার ভালো লাগে না।’

‘বলো কি?প্রেম টেম হয়ে গেল নাকি?’

অরু ঠোঁট উল্টে বলল,’কে জানে! জানি না।হতেও পারে।তাতে কি?বর তো।প্রেমে পড়লে তো আর পাপ হবে না।’

‘তা ঠিক।তবে তার মতো ভয়ংকর লোক কে তুমি পছন্দ করে নিলে?প্রথম কয়দিন তো ভয়ে কাঁদলে।’

অরুনিমা কিঞ্চিৎ হাসলো।খাটে বসে পা দোলাতে দোলাতে বলল,’সে অনেক আগের কথা।সে খুব ভালো লোক।আমায় নূপুর কিনে দিয়েছে।’

বলেই সে আবার পায়ের উপর থাকা কাপড়টা সামান্য উঁচুতে তুলে নিজের পা দু’টো হৃদিতাকে দেখালো।হৃদিতা পঞ্চম বারের মতো সেই নূপুর পরা পা টা দেখলো।তারপর দেখলো অরুনিমার হাসি ভরা মুখ।

বিবাহিত জীবনের প্রথম এবং একমাত্র পুরষ্কার যে কোনো রমণীর কাছে এতো বেশি বিশেষ হতে পারে,হৃদির সেটা জানা ছিলো না।অভি ভাইজানের প্রতি তার সমস্ত অনুভূতির সূচনা রুপালি রঙের এই নূপুর কে ঘিরে।এক জোড়া নূপুর।কেবল এক জোড়া নূপুরই তো।অথচ অরুনিমা রহমান সেই এক জোড়া নূপুরের ক্রেতাকে ভুলতে পারে না।ভুলতে পারে না সেই চমৎকার দৃশ্য।জগলুদের বাড়ির খাটে সে পা তুলে বসেছিল।হামাদ এসে তার পায়ে নূপুরটা পরিয়ে দিলো।কতো যত্ন করে পরালো!অরুনিমা তো এই জীবনে তাকে আর ভুলতে পারবে না।
.
.
.
.
‘চায়ের কাপে দুই টা টান দেওয়ার পরেই জগলুর চোখ গেল সামনের সরু রাস্তার দিকে।তখন সময় সকাল আটটা আঠারো।অভি তার মুখোমুখি অন্য একটা বেঞ্চে বসা,দুই আঙুলের ভাঁজে একটা সিগারেট চেপে রাখা।পর পর দুইবার ধোঁয়া ছেড়ে আবার বড়ো করে টান দিলো।

জগলু দেখলো সামনের রাস্তায় একটা নারী মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে।অবয়ব টা কেমন চেনা লাগলো।কিন্তু স্পষ্ট না।সে তাকাতেই মেয়েটা নড়ে উঠে সামনের দিকে পা বাড়ালো।পায়ের গতি স্বাভাবিক।কিন্তু কদম গুলো দৃপ্ত।খুব আত্মবিশ্বাস নিয়ে পথ চললে যেমনটা হয়,অনেকটা এমন।

সে রাস্তা পেরিয়ে টং দোকানের সামনে এলো।যখন তার আর জগলুর দূরত্ব কয়েক ফুটে এসে থামলো,তখনই জগলুর নিকট তার পরিচয় স্পষ্ট হলো।এই মেয়েটাকে সে চিনে।সাংবাদিক।খুব শিক্ষিত মেয়ে।নামটা হলো….
উহু।কি যেন বলেছিলো?সুচি…সুশ্চি….মিতালি….আহা! কি ছিলো নামটা?

মেয়েটা বরাবরের মতোই মিষ্টি করে হাসলো।বলল,’জনাব জুহায়ের।কেমন আছেন?’

জগলু ফাঁপড়ে পড়ে সামান্য হাসলো।বলল,’জ্বি।ভালো।’

‘আমায় চিনতে পেরেছেন?’

‘জ্বী।’

মেয়েটা হাসলো আগের মতো করেই।অভি মাথা তুলে একবার তার মুখ দেখেই পুনরায় চোখ নামিয়ে নিলো।এসবে তার আগ্রহ কম।জগলুর সাথে কোনো মেয়ে কথা বললে বিনু,টিপু,রনক খুব আগ্রহ দেখায়।অভির এসবে কোনো আগ্রহ নেই।অভির ধারণা জীবনের প্রতিই তার কোনো আগ্রহ নেই।বেঁচে আছে,শ্বাস নিচ্ছে।এর বেশি আর কিছু না।যদিও বেঁচে থাকা আর শ্বাস নেওয়ার পাশাপাশি তার আরো একটা নতুন কাজ যুক্ত হয়েছে, অরুনিমার ঘ্যান ঘ্যান সহ্য করা।

অরুনিমা রোজ কানের কাছে মাছির মতো ভনভন করে।অথচ অভি না পারে তাকে সরাতে,না পারে তার ভনভন সহ্য করতে। এতো কথা সে কেমন করে বলে?অভির হাত দু’টো নিশপিশ করে।মাঝে মাঝে চড় মেরে এর মুখ বন্ধ করতে ইচ্ছে হয়।অথচ আশ্চর্য ব্যাপার হাতেম শিকদারের একমাত্র সন্তান হামাদ,তাকে পারতে ধমকটাও দিতে চায় না।ধৈর্যের বাঁধ ভাঙলে তখন গিয়ে জোর গলায় একটু শাসায়।বাস এইটুকই।

কারণ অভি তার স্বচ্ছতা দেখেছে।সরল,সোজা,প্যাচমুক্ত ব্যক্তিত্ব বলতে সে যা বোঝে,অরুনিমা ঠিক তাই।তাকে প্রহার করা যায় না।বড়জোর রেগেমেগে একটু ধমকানো যায়।সে বসন্তের নতুন পাতার মতোই সতেজ,সুন্দর।অভি চায় না,সেই সৌন্দর্য ক্ষয়ে যাক।অভির জীবনে কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা আছে।সেই ঘটনা গুলো তাকে ক্ষুয়িয়ে দিয়েছে একটু একটু করে।অরুনিমার জীবনে তেমন কোনো ঘটনা নেই।অরুনিমা তার মতো হোক সে চায়ও না।পৃথিবীর কেউ তার মতো হোক,সেটাও সে চায় না।

মেয়েটা বুকে হাত বেঁধে বলল,’তাহলে আমার নাম কি বলুন তো?’

জগলু বোকা বোকা হাসলো।তার চাহনি দেখেই মেয়েটার হাসি পেল।
‘ভুলে গেছেন জুহায়ের?’

‘জ্বী না।আপনাকে ভুলিনি।তবে নামটা ভুলে গেছি।অনেক কঠিন।’

অভি উঠে দাঁড়ালো সোজা।সিগারেটটা হাত বদল করে বড় বড় পা ফেলে সামনে চলে গেল।সুচিস্মিতা তার প্রস্থান দেখে কপাল কুঁচকে বলল,’আপনি তাকে চেনেন?’

‘জ্বী।আমার বন্ধু।’

‘চলে গেল যে?’

‘সে একটু এমনই।’

‘ওহ্।’

জগলু গলা খাকারি দিয়ে বলল,’বসুন আপনি।’

সুচিস্মিতার মুখ ভার।চোয়াল শক্ত করে বলল,’না।বসবো না আমি।আপনি আমার নাম মনে রাখতে পারেন নি।’

জগলু দুখী দুখী মুখ করে বলল,’দুঃখিত।নাম টা খুব কঠিন।এতো কঠিন নাম মাথায় থাকে না।’

মেয়েটা সামান্য হাসলো।অভি যেদিকে বসেছিলো,সেদিকে বসে ভ্যানিটি ব্যাগটা কোলের উপর ফেলে বলল,’সুচিস্মিতা।আমার নাম সুচিস্মিতা।’

‘জ্বী।’

‘বলুন তো,নাম কি?’

‘সুচিস্মিতা।’

‘হয়েছে।ভেরি গুড।’

সুচিস্মিতা গালের নিচে হাত রেখে বসলো।বলল,’বাবা এই নাম রেখেছে।ভারতীয় অভিনেত্রীর নাম।সুন্দর না?আমার দেখা এই নামে আর কাউকে পাইনি আমি।’

জগলু সুর মেলালো।প্রাণোচ্ছল স্বরে বলল,’জ্বী।আমিও এই জনমে এই নাম শুনি নি।’

সুচিস্মিতা এবার প্রাণ খুলে হাসলো।জগলু দেখলো,হাসার সময় তাকে একদম অন্যরকম দেখায়।চুপচাপ থাকলে তাকে খুবই গম্ভীর মনে হয়।অথচ এখন মনে হচ্ছে সে ভীষণ দুরন্ত।তার হাসিতেই একটা স্নিগ্ধ ভাব জড়িয়ে আছে।সুচিস্মিতা হাসি থামিয়ে বলল,’আপনি তাহলে একটা সহজ নাম দিন আমার।সে নামেই ডাকবেন।’

জগলু মাথা চুলকায়।একটু ভেবে নিয়ে তারপর উত্তর দেয়,’মিতা।শুধু মিতাই থাকুক।সুচি বাদ।’

‘আচ্ছা বেশ।আপনি শুধু মিতাই ডাকবেন,জুহায়ের।আমার আপত্তি নাই।’

জগলু চায়ের কাপটা হাতে ধরে বলল,’আপনার চাকরির কি হলো?’

সুচিস্মিতা স্মিত হেসে তাকে তার হাতে থাকা মিষ্টির প্যাকেট টা দেখালো।জগলু বলল,’বাহ! হয়ে গেল তবে।চমৎকার।’

সুচিস্মিতার দৃষ্টি স্থির।শান্ত সুরে জবাব দিলো,’জ্বী না জুহায়ের।চাকরি টা আমার হয় নি।’

‘তবে?মিষ্টি আনলেন যে?’

‘সেটা আপনার প্রাপ্য।আগেই বলেছিলাম।’

‘কথা ছিলো চাকরি হলে তবে আপনি মিষ্টি খাওয়াবেন।’

‘এখন হয়নি তো কি হয়েছে?পরে নিশ্চয়ই হবে।নিন,মিষ্টি খান।’

জগলু চায়ের কাপটা কাউন্টারের পাশে রেখে আবার ফিরে এলো।হাত দু’টো বগলদাবা করে বলল,’তাহলে পরবর্তী পরিকল্পনা কি?’

‘উমম।পরবর্তী পরিকল্পনা অনেক গুলো আছে।প্রভাত পত্রেই আরো কিছু ভ্যাকেন্ট পোস্ট আছে।সেগুলোতে এপ্লাই করবো।আরো কতো প্রেস মিডিয়া আছে।তার কোনো একটাতে আমি ট্রাই করবো।চিন্তা নেই জুহায়ের।হয়ে যাবে একটা না একটা।’

‘জ্বী,আমি জানি।’

সুচিস্মিতা বলল,’মিষ্টি খান জুহায়ের।’

‘একটু পরে।মাত্র চা খেলাম।’

সুচিস্মিতা আর কথা বাড়ালো না।উন্মনা হয়ে একবার রাস্তার দিকে তাকালো।পথচারীরা যার যার মতোন যাওয়া আসা করছে।জগলু চোরা চোখে একবার মিতার দিকে তাকালো।পরনে হালকা গোলাপি রঙের শাড়ি।পাড়ে রুপালি জরি সুতের কাজ।গলায় একটা চেইন।হাতে নীল পাথরের ব্রেসলেট।অন্য হাতে একটা ঘড়ি।চুল গুলো উন্মুক্ত।শুধু সামনে থেকে কিছু চুল নিয়ে পেছনে ক্লিপ দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে।মুখে কোনো প্রসাধনী ছোঁয়ায় নি।কেবল চোখের নিচে একটুখানি কাজল দেখা যাচ্ছে।জগলু দ্রুত চোখ নামিয়ে নিল।তাকে এতোবার দেখার কিছু নেই।তার আর জগলুর সম্পর্ক এমন আড়চোখে দেখাদেখি করার সম্পর্ক না।
.
.
.
.
বোমা নিষ্ক্রিয়করণ প্রশিক্ষণ(Bomb Disposal Training)
সামরিক প্রশিক্ষণের আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রনের প্রশিক্ষণ।মিশনের পূর্ব প্রস্তুতি স্বরূপ ক্যাডেটদের হাতেখড়ি দেওয়া হয়।একদম প্রফেশনাল পর্যায়ের প্রশিক্ষণ না।কিন্তু প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলায় যুতসই,এমন একটা অভিজ্ঞতা অর্জন করানো হয় কেবল।

আজ মেজর এহতেশাম মুস্তাফার সাত সিপাহির পরীক্ষা নেওয়া হবে।কর্ণেল আহাদ ইব্রাহিম তাদের পরীক্ষা নিবেন।দু’টো বোমা সফলভাবে ডিফিউজ করতে পারলে তারা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ বলে বিবেচিত হবে।তাদের পাশাপাশি আজ মেজর এহতেশামেরও পরীক্ষা।তাদের গাইড ছিলো সে।সুতরাং তাদের পারা আর না পারা,দু’টোর দায়ভারই তার।এহতেশাম আজ সকাল থেকেই চাপা উৎকন্ঠা দমন করে রেখেছে।মুখোভঙ্গি স্বাভাবিক।অথচ সাতজন ক্যাডেট কে নিয়ে সে ভীষণ সিরিয়াস।

আশিক তার তাবুর বাইরে এসে ভেতরে আসার অনুমতি চাইলো।এহতেশাম বুট জুতার ফিতা বাঁধতে বাঁধতে বলল,’এসো আশিক।আমি রেডি।’

আশিক ভেতরে এলো।এহতেশামের মনোযোগ তখনো তার সু-লেসের দিকে।পর পর দু’টো গিট দিয়ে বলল,’আমার সাতটা গরু কোথায়?’

আশিক হাসলো।আরাম করে চৌকিতে বসে বলল,’আছে।সব লাইন ধরে দাঁড়িয়েছে।তাদের রাখাল কে খুঁজছে সকাল থেকে।’

মেজর মুস্তাফা সামান্য হাসলেন।প্রসন্ন নির্মল হাসি।শরীর ঝেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে দারাজ কন্ঠে বললেন,’চলো তবে।একটু দেখে আসি এরা আমাকে কিভাবে ডোবায়।’

সে এগিয়ে গেল।যেতে যেতে আনমনে একবার উপরে তাকালো।স্রষ্টার সাথে তার একটা গোপন কথোপকথন হলো।মেজর এহতেশাম মুস্তাফা প্রার্থনা করলেন তার সাতজন দুর্ধর্ষ সৈনিক যেন তাদের কাজে সফল হয়।কর্ণেল আহাদ যেন প্রশান্তির হাসি হেসে বলেন,’এহতেশামের সাতটা ক্যাডেটই একেকটা বাঘ।’
.
.
.
.
অরুনিমার চোখ ভেজা।কেউ যেন কিছু বুঝতে না পারে,এজন্য সে বার বার দুই হাতে চোখ মুছে নিচ্ছে।তার মনে পড়লো,ছোটবেলায় মা বাইরে যাওয়ার সময় সে দরজায় এসে দাঁড়াতো।তাকে সহ নিয়ে যাওয়ার বায়না ধরতো।মা তখন বলতো,’নতুন জুতো নিয়ে আসো।মা নিয়ে যাবো তোমাকে।’

অরুনিমা ছুটে যেত নতুন জুতো আনতে।অথচ আসার পর দেখতো,বাড়ির চৌকাঠ খালি।মা তাকে ফেলে চলে গেছে।সেই সময়টা সে ঠোঁট ভেঙে কাঁদতো।নিরু আপা তাকে কোলে তুলে আদর দিতো তখন।সেই যন্ত্রনা মনে পড়লে এখনো অরুনিমার ভেতরটা চিনচিন করে।

আজ বহু বছর পর অরুনিমার একই অনুভূতি হলো,যখন হাশিম তাকে জানালো টিকিট দু’টো তার জন্য না।এই দু’টো টিকিট সে তার দুই বন্ধুর জন্য কিনেছে।

হৃদি আশ্চর্য হলো।বলল,’ভাইজান তুমি তোমার বন্ধুদের জন্য টিকিট কিনেছো।অথচ অরুনিমার জন্য কিনো নি?’

অরুনিমার মুখ তখন ফ্যাকাশে।চোখ ছলছল করবে বলে।সে নিরু আপার উপহার দেওয়া সুন্দর শাড়িটা পরে নিচে নেমেছিল।হামাদ বাড়ি এলেই সে তাকে জোর জবরদস্তি করে একটা সুন্দর জামা পরিয়ে তার সাথে নিয়ে যেত।অথচ হাশিম কতো নির্বিকার আর দায়সারা হয়ে বলে দিলো,’দুঃখিত! কেনার সময় তাদের কথা মনে ছিলো না।তাদের জন্য কিনি নি টিকিট।’

আর অরুনিমার দু’চোখ তখন নোনাজলে ঠাসা।এতো সহজে! এতো সহজে সবটা বলে দিলো?
সে চোখ মুছে দ্রুত নিজের ঘরে চলে এলো।হৃদি কয়েকবার তাকে ডেকেছে।সে জবাব দেয় নি।জবাব দিয়ে কি হবে?যদি জবাব দেওয়ার মন মানসিকতা থাকতো,তবে সবার প্রথমে হাশিম কে জিগ্যেস করতো,’তোমার তুরান-তিশায়া আর সৃজনী-সামিরের কথা মনে ছিলো।অথচ আমরা বাড়িতে থাকা স্বত্তেও তোমার একবার আমার কথা মনে হলো না?’
কিন্তু অরুনিমা তার কোনোটাই বলে নি।কারণ তার মন আজ ভয়াবহ রকমের খারাপ।একটু আগে বাড়ির বড়ো গাড়িটা করে তারা সব মধুমিতা সিনেমা হলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেছে।

সে ফোঁপাতে ফোঁপাতে নিরুপমাকে ফোন দিলো।অভি বাড়ি ফিরেছে মাত্র।সে ঘরে আসতেই অরু এক দৌড়ে বারান্দায় গেল।অভি পরোয়া করল না।কিন্তু কোনো এক ফাঁকে টের পেল অরুনিমা কথা বলার মাঝে মাঝে হেঁচকি তুলছে।

নিরুপমা ফোন তুলে কানের কাছাকাছি আনতেই অরুনিমা হাউমাউ করে বলল,’নিরু আপা! তোমার কাছে সিনেমা দেখার টিকিট কেনার টাকা হবে?’

নিরুপমা তাজ্জব হলো।বুঝতে না পেরে আরো একবার প্রশ্ন করল,’কিসের টাকা?বুঝিনি তো।আবার বল।’

অরুনিমা হেঁচকি তুলে বলল,’সিনেমা দেখার টিকিট কেনার টাকা।’

‘হবে তো।কিন্তু তুই এভাবে কাঁদছিস কেন?’

‘আপা আমার মন অনেক খারাপ আজ।’

‘কি হয়েছে সোনা?বল না আমাকে।আপা তো আছি।’

‘আপা।ঐ হা শিম….ঐ হাশিম আজ সবার জন্য সিনেমার টিকেট এনেছে।শাহরুখ খানের সিনেমা।খুব নাম করা।আমাকে বলেছে,আমাকে আর হামাদকেও নিয়ে যাবে।কিন্তু আপা….’

অরুনিমা কথা শেষ না করেই পুনরায় ঠোঁট ভেঙে কেঁদে দিলো।নিরুপমা অস্থির হয়ে বলল,’কি হয়েছে সোনা?বল আপাকে।টাকা আছে তো আমার।তোকে দিবো?তোর বাড়ি আসবো আমি?’

অরুনিমা কান্নার ফাঁকেই বলল,’আপা হাশিমের নাকি আমাদের কথা মনেই ছিলো না।সে নাকি তার বন্ধুদের জন্য টিকিট কেটেছে,আমাদের জন্য না।একটু আগে তারা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল গাড়ি নিয়ে।আমাকে নেয় নি আপা।’

নিরুপমার কন্ঠ বুজে এলো।যেই ব্যাথা অরুনিমাকে চোখভর্তি জলে ভাসালো,সেই ব্যাথার কিছুটা বোধহয় নিরুপমাও অনুভব করলো।সংসার,শ্বশুড়বাড়ি,খুব জটিল বিষয়।এই টুকটাক মন খারাপ খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার।অথচ অরুর জন্য বেশ জটিল।নিরুপমা একটা শ্বাস ছেড়ে বলল,’আপা আসবো মনা?টাকা আছে আমার কাছে।কি খেতে চাস বল।আসার সময় নিয়ে আসবো।’

‘কিছু না আপা।আমার কিছু লাগবে না।যা বলেছি,ভুলে যাও।টিকেট লাগবে না আমার।আমি জগলুদের বাড়ি যাবো।সেখানে গিয়ে দেখবো।’

অরুনিমা উত্তর শোনার আগেই ফোন কাটলো।
পেছন ফিরতেই দেখলো অভি বারান্দার দরজায় দাঁড়ানো।অরু নিঃশব্দে তাকে পাশ কাটালো।অভি জলদগম্ভীর স্বরে প্রশ্ন ছুড়লো,’কোন হলে গেল তারা?’

অরুর কন্ঠ তখনও জমাট বাঁধা। একবার কেশে নিয়ে জড়ানো স্বরে বলল,’মধুমিতা।’

অভি দরজা থেকে সরে এলো।অরুনিমা বোধহয় শাড়ির একটা পিনে হাত দিয়েছে মাত্র।অভি তৎক্ষনাৎ সেই হাতটা চেপে ধরল।অরু তার দিকে ফিরতেই চোয়াল শক্ত করে বলল,’কোনো প্রয়োজন নেই খোলার।আমরা বের হবো এখন।’

অরু আশ্চর্য হলো,সাথে কিছুটা খুশিও।দ্রুত চোখের পানি মুছে বলল,’তুমি না বললে দু’দিন পর জগলু দের বাড়ি নিবে।আজই নিচ্ছ যে?’

অভি নিরুত্তর।জবাব দিলো না কোনো।শুধু অরুনিমার রক্তজবার ন্যায় রক্তিম মুখশ্রী টা খুটিয়ে খুটিয়ে দেখলো।অরু মন খারাপ কে তক্ষুনি ছুটি দিলো।দুই হাত মেলে অভিকে জাপ্টে জড়িয়ে ধরে বলল,’তুমি কতো ভালো হামাদ! আমি তো আগেই বলেছি,এই বাড়িতে তুমি আমার সবচেয়ে প্রিয়।কেউ আমার মন খারাপ বুঝে না।শুধু তুমি বোঝো।কে বলে তুমি ভালো না?তুমি জগতের সবচেয়ে ভালো লোক।’

অভি বিরক্তিতে আরেকদফা কপাল কুঁচকালো।সেই পুরোনো সমস্যা।কথা বেশি বলে।প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত বকবক করে।বিরক্তি ধরে যায় মাঝে মাঝে।

সে শক্ত করে অরুনিমার হাতটা চেপে ধরে সদর দরজার পথ ধরলো।যেতে যেতে একবার পেছন ঘুরে বলল,’কি নাম যেন বললে?সিনেমার নাম কি?’

চলবে-

#কৃষ্ণপক্ষের_অন্তিম_প্রহর
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

২২.[দ্বিতীয় অংশ]

সকালের সূর্য এখন ঠিক মাথার উপরে।অদ্ভুত শক্তিতে শরীরের সমস্ত জোর টেনে নিচ্ছে।ক্লান্তি এসে ভর করছে সমস্ত শরীরে।অথচ সময়টা ক্লান্তিতে ঝিমিয়ে পড়ার না।আজ একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন।

অয়ন খুবই বিচলিত চোখে তার হাতে থাকা বোমাটির দিকে তাকালো।খুবই করুণ চাহনি।জিতু আর মাহিম ঠোঁট টিপে হাসলো।তারা দু’জন আপাতত নিশ্চিন্ত।তারা তাদের বোম সফলভাবে ডিফিউজ করতে পেরেছে।জিতু যদিও শেষে এসে ঝামেলা করেছিলো।কিন্তু মাহিম নিজ থেকেই পুরোটা পেরেছে।এখন পালা অয়নের।হাতে থাকা বোমার দিকে তার অসহায় চোখ।

সবার আগে নিশ্চিত করতে হবে বোমার ধরন।টাইমার-বেইজড/রিমোট-কন্ট্রোলড নাকি প্রেসার-সেনসিটিভ?অয়ন প্রথম দেখাতেই সেটা ধরতে পারলো না।বোমার ধরনই যদি না বোঝে,তবে ডিফিউজ করবে কিভাবে?সে একবার চোখ তুলে এহতেশাম স্যারকে দেখলো।স্যার তার থেকে অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন।দূরত্ব বেশি হওয়ায় অয়ন তার চোখের ভাষা বুঝতে পারেনি।যদি কাছে থাকতো,তবে অয়ন দেখতো,স্যার মোটেও তার উপর রেগে নেই।স্যারের চোখে যা ছিলো,তা ছিলো উৎকন্ঠা।ছাত্রদের পরীক্ষা চলাকালীন শিক্ষকের ভেতর যেই উৎকন্ঠা কাজ করে,ঠিক সেটাই।মেজর এহতেশাম তার হাত দু’টো আড়াআড়ি করে পেছনে রেখে স্থির নয়নে তার ছাত্রদের কার্যকলাপ দেখছিলেন।এরা তার সন্তানের মতো।তার এদের প্রতি অল্প স্বল্প মায়া জন্মেছে।মায়া জন্মানের কারণ স্পষ্ট না।কিন্তু তিনি এদের স্নেহ করেন ভীষণ।

অয়ন যখন বিভ্রান্ত চোখে তার দিকে তাকালো,এহতেশাম কেবল এক আঙুলে ঘড়ির ডায়ালার স্পর্শ করলো।ব্যাস,অতোটুকুই।তারপর বোমার ধরন বুঝতে অয়নের সময় লাগলো দু’সেকেন্ড।টাইমার-বেইজড বোম।
পরবর্তী ধাপ,ডেটোনেটর শনাক্ত করা।তারপর ফ্রিকোয়েন্সি ব্লকার ব্যবহার করে রিমোট ডেটোনেশন বন্ধ করা।মূল কাজ বলতে গেলে অতোটুকুই।তারপর সবশেষে টাইমারের সুইচ খুঁজে সেটা বন্ধ করতে হবে।

অয়ন বহুকষ্টে নিজের কাজে সফল হলো।কাজ শেষ হতেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।প্রশান্তি আর স্বস্তি মেশানো শ্বাস।
সেই সাথে এহতেশামের ভেতরটাও হালকা হলো।কর্ণেল আহাদের উপর সে কিছুটা বিরক্ত।যদিও সে বিরক্তি টুকু প্রকাশ করেনি।কিন্তু কিছু কারণে সে আহাদের আচরণে ক্ষিপ্ত।

এই ছেলেগুলো নতুন নতুন জয়েন করেছে।বয়স অনেক অল্প।অনেক কিছুই বুঝে না।সবকিছুরই একটা বয়স থাকে।এই অল্প বয়সে এদের বোম ডিসপোজাল ট্রেইনিং শেখানোর কোনো মানে হয় না।আরো এক দুই বছর পর শেখানো যেতো।এখনই এসব কঠিন কঠিন জিনিসের কি দরকার?

মিলিটারি ট্রেইনিং একটা দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণের মতো।বললেই তো আর হয়ে যায় না।ধীরে ধীরে পুরো শরীরকে সেভাবে ফর্ম আপ করতে হয়।আস্তে আস্তে বছরের পর বছর ট্রেইনিংয়ের দরুন সবকিছু শিখতে পারা যায়।হুট করেই তো সদ্য জয়েন করা ছেলেদের উপর এসব চাপিয়ে দেওয়া যায় না।শুরুতেই যদি একটা পেশার প্রতি মানুষের ঘৃণা ধরে যায়,তাহলে কেমন করে হবে?

এহতেশাম এই নিয়ে কর্ণেল স্যারের উপর কিছুটা ক্ষুব্ধ।যদিও সেটা কোনোভাবেই প্রকাশ করে নি।এখানে চেইন অব কমান্ড খুব গুরুত্বপূর্ণ।উচ্চ পদস্থ অফিসারকে বাধ্যতামূলক সম্মান দিতেই হবে।সে পুনরায় সামনে তাকালো।অয়ন উঠে এসে মাহিম আর জিতুর পাশে দাঁড়িয়েছে।এখন তন্ময়ের পালা।এহতেশাম তীক্ষ্ণ চোখে সেদিকে তাকালো।তন্ময়কে নিয়ে তার ভয় সবচেয়ে বেশি।
.
.
.
.
মধুমিতা সিনেমা হল।হলের বাইরে বড়ো করে নাম লিখা।অরুনিমা সেটা দেখতেই চোখ কপালে তুলল।
‘তুমি সিনেমা হলে আনলে আমায়?’

‘হুম।’

‘কিন্তু আমাদের তো টিকিট নেই।’

অভি শীতল চোখে তার দিকে তাকালো।অরুনিমা আর কথা বলল না।এক আঙুল মুখে চেপে বলল,’আচ্ছা,আর কথা বলবো না।’

অভি তার হাত ধরে রেখেই কাউন্টার পর্যন্ত গেল।তারপর ঘুরে ঘুরে চারপাশ দেখলো।প্রবেশদ্বার থেকে একটু দূরে একটা ছেলে দাঁড়ানো ছিলো।তার মতিগতি দেখেই অভি কিছু একটা আঁচ করলো।সামনে গিয়ে বলল,’ব্ল্যাক?’

ছেলেটা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো।অভি পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করলো।
‘কতো?’

‘একটা তিনশো।’

অভি চোখ তুলল।অত্যাধিক ঠান্ডা গলায় বলল,’আমাকে কি তোমার ভিনদেশী সওদাগর মনে হচ্ছে?একশো বিশ টাকার টিকিট তিনশো চাইছো?’

তার চাহনিতেই বোধহয় ছেলেটা মিইয়ে গেল।আমতা আমতা করে বলল,’সবাই তো তিনশো তেই কিনলো।’

‘সবাই কিনলে আমাকেও কিনতে হবে?ঠিক করো বলো কতো তে দিবে?’

ছেলেটা একটু ভাবলো।শেষে রয়ে সয়ে জবাব দিলো,’দু’টো নিলে চারশো রাখবো।’

অভি মানিব্যাগ থেকে তিনশো পঞ্চাশ টাকা বের করে তার হাতের মুঠোয় ধরিয়ে দিলো।বলল,’নাও,এটা রাখো।আর টিকিট দাও।’

ছেলেটা আর কিছু বললো না।সুবোধ বালকের মতো দুইটা টিকিট তার হাতে তুলে দিলো।অভি পেছন ফিরলো।অরুনিমার চোখে তখন ঝলমলে দীপ্তির ছোঁয়া।অভি হাস্কি গলায় বলল,’চলো।ভেতরে চলো।’

অরুনিমা যেতে যেতে উত্তেজিত স্বরে বলল,’কেমন করে টিকিট পেলে?’

‘ব্ল্যাকের টিকিট।অবৈধ।’

অভি থামলো।পেছন ফিরে বলল,’কেন?অনৈতিক ভাবে কেনা টিকিটে সিনেমা দেখবে না নাকি?’

‘পাগল নাকি?’
অরুনিমা দুই দিকে মাথা নেড়ে বলল,’এতো নৈতিকতা নাই আমার।সিনেমা দেখতে পারছি,এটাই বড় কথা।এসব ব্ল্যাক হোয়াইট বুঝি না।চলো তো।’

ভেতরে যাওয়ার পর অরু সবার আগে দেখলো তিয়াশা কে।উপরের একটা সিটে বসেছিল।অরুনিমার সাথে চোখাচোখি হতেই চমকালো ভীষণ।অস্ফুটস্বরে বলল,’অরুনিমা আর অভি ভাইজান না?’

সৃজনী তার দৃষ্টি অনুসরণ করে ডান দিকে তাকালো।হলের মূল দরজা থেকে একটু দূরেই অরু আর অভি দাঁড়ানো ছিলো।অরুনিমা তাদের দেখতেই একগাল হাসলো।সৃজনী দেখলো অভির হাতের মুঠোয় থাকা অরুর হাত।তারপর আর কোনো কিছু চোখে পড়েনি।চোখটা সেদিকেই আটকে ছিলো।ভেতরে কিছু একটা ধ্বক করে উঠলো।সৃজনী পাত্তা দিলো না।বসার সিটটা শক্ত করে খাঁমচে ধরে কেবল ঢোক গিললো কয়েকবার।

অভি অবশ্য তাদের দিকে তাকায় নি।তাকানোর বিন্দুপরিমান ইচ্ছে হয়নি।একটা চাপা রাগ তার সবসময়ই এদের উপর থাকবে।অরুনিমার স্বভাব সম্পর্কে এরা ভালো করেই অবগত।অভির জন্য এরা টিকিট না আনলেও তার কিছু যায় আসে না।সে সিনেমার মানুষ না।কিন্তু অরুনিমা?সে তো এসব পছন্দ করে।অভির স্ত্রী হওয়ার অপরাধে অরুনিমা যতোকিছু থেকে বঞ্চিত হবে,অভি পণ করেছে তার সবকিছু সে নিজে অরুনিমা কে ফিরিয়ে দিবে।অভির স্ত্রী হওয়া নিশ্চয়ই কোনো পাপ না। সেই পাপে অরুনিমা কেন নিজের শখ আহ্লাদ থেকে বঞ্চিত হবে?

সৃজনী দেখলো,অভি ভাইজান তাকে টেনে নিয়ে একটা সিটে বসিয়েছে।তারপর নিজে তার পাশাপাশি সিটে বসেছে।অথচ…অথচ বাড়িতে বেড়াতে এলে তারা কতোবার তাকে অনুরোধ করতো একবার তাদের সাথে বসে গল্প করার জন্য,একবার তাদের সাথে বসে সিনেমা দেখার জন্য।অভি ভাইজান পাত্তা দিতো না সেসব কথা।খুব তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতো।অথচ অরুনিমাকে ঠিকই পাত্তা দিচ্ছে।তার সাথে বসে ঠিকই সিনেমা দেখছে।তাকে সময় দিতে গিয়ে তার কপাল কুঁচকায় না?মেজাজ গরম হয় না?সৃজনীর ভীষণ জানতে ইচ্ছে করে।

অরু সিটে বসেই মিষ্টি করে হাসলো।পাশ ফিরে বলল,’থ্যাংকু হামাদ।’

অভির মুখ শক্ত।কোনো প্রতিউত্তর করে নি।ক্লান্তিতে মাথাটা পেছনে ফেলে আস্তে করে চোখ বুজলো।একটা দীর্ঘশ্বাস যেন আপনাআপনি ভেতর চিরে বেরিয়ে এলো।অরুনিমা দুই হাত একসাথে করে মাল্টিমিডিয়ার স্ক্রিনের দিকে তাকালো। এই জীবনে প্রথম সে সিনেমা হলে এসেছে।তার আনন্দ আজ আকাশ ছোঁয়া।

অরুনিমা বলল,’হামাদ! নায়িকা টা খুব সুন্দর।তাই না?’

‘হুম।’

‘ঠিক আমার নিরু আপার মতো।’

অভি চুপ থাকলো।অরুনিমার একটা অদ্ভুত স্বভাব আছে।পৃথিবীর সব সুন্দর মানুষকে সে নিরু আপার সাথে তুলনা করে শান্তি পায়।তার ধারণা,নিরু আপা এই জগতের সবচেয়ে সুন্দরী মানুষ।

দেবদাস সিনেমার মূল ঘটনা তখনো পুরোপুরি বোধগম্য হয়নি।অরু খিলখিলিয়ে বলল,’দেবদাসের মা চাচি কে দেখে আমার দাদিজান আর রিজোয়ানা চাচির কথা মনে পড়ছে।এদের কাজই সারাক্ষণ কূটনামি করা।’

‘বাজে বকো না।আমার দিদানের সাথে ঐ রিজোয়ানার তুলনা দিও না।’

‘আচ্ছা দিবো না।’

অরুনিমা খুব মন দিয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকালো। অথচ সময়ে সময়ে তার মন ভয়ংকর রকম খারাপ হয়ে উঠলো।দেবদাস আর পার্বতীর বিয়ে হয়নি শেষ পর্যন্ত।এই কথা অরু কিছুতেই মেনে নিতে পারলো না।ভাঙা সুরে বলল,’এটা কেমন সিনেমা?নায়ক নায়িকার বিয়ে হলো না,বাবু হলো না।কিচ্ছু হলো না।’

অভির মুখে তখন স্পষ্ট বিরক্তি।দাঁতে দাঁত চেপে কেবল বলল,’চুপচাপ দেখতে থাকো না।এতো কথা কেন বলছো?’

অরুনিমা কিছুক্ষণের জন্য চুপ হলো।অথচ চন্দ্রমুখী নামক মেয়েটি স্ক্রিনে আসতেই তার ভেতরটা চিনচিন করে উঠলো।বিড়বিড় করে বলল,’আমার এই গল্পটা ভালো লাগছে না।এতো কষ্ট আমার সহ্য হয় না।’

‘তবে এলে কেন?জানতে না এমন হবে?’

‘না,জানতাম না।’

অরু চট করে পাশ ফিরলো।বলল,’দেবদাসের সাথে তোমার মিল আছে হামাদ।’

অভি বিষম খেলো।
‘কোন দিক দিয়ে?’

‘এই যে তুমি ভীষণ ভবঘুরে।ছন্নছাড়া হয়ে ঘুরো।দেবদাসও তো তাই।’

অভি বরাবরের মতোই নিশ্চুপ।ঘাড়ের একটা রগ চিনচিন করছে।বাড়ি গিয়ে একটু গরম পানি ছ্যাঁক দিতে হবে।অরুনিমা হঠাৎই পাশ ফিরে গোয়ান্দাদের মতো প্রশ্ন করলো,’সত্যি করে বলো হামাদ।তোমার কোনো পার্বতী নেই তো?যেই পার্বতীর শোকে তুমি এমন বাউন্ডুলে হয়েছো।’

অভি পূর্ণদৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো।চাহনিতে কোনোরকম তাড়াহুড়ো নেই।দৃষ্টিতে কোনো প্রশ্ন কিংবা বিস্ময় নেই।যেন প্রশ্নটা খুবই স্বাভাবিক।কয়েক পলক পাশে দেখে অত্যন্ত গম্ভীর স্বরে বলল,’থাকলেও থাকতে পারে।তুমি জেনে কি করবে?’

উত্তরটা অরুনিমার পছন্দ হয়নি।উল্টো শুনতেই কেমন বিচলিত হয়ে উঠলো।বড় বড় চোখ করে বলল,’সত্যি?সত্যি বলছো তুমি?’

‘জানি না।’

অরু কাঁদো কাঁদো হয়ে ডাকলো,’হামাদ!’

‘কিহ্?’

‘বলো তোমার কোনো পার্বতী নেই।’

‘জোর করে বলাবে?’

‘আমি কিন্তু কেঁদে দিবো।’

‘কাঁদো।’

অরুনিমা আর সিনেমায় মনোযোগ দিতে পারলো না।তার সমস্ত মনোযোগ তখন অভির দিকে।কোলের উপর ফেলে রাখা অভির দু’টো হাত দ্রুত লুফে নিয়ে সে হড়বড়িয়ে বলল,’অভি! তুমি জানো এই বাড়িতে তুমি বাদে আর কেউ আমায় বোঝে না।তাহলে তুমি কেন আমার সাথে মজা করছো?’

‘অদ্ভুত!মজা কখন করলাম?’

‘এই যে বললে,তোমারও নাকি কে একটা আছে।’

অভি তার দিকে তাকালো না।সামনে দেখতে দেখতেই গম্ভীর স্বরে বলল,’তোমার চেয়ে বয়সে যথেষ্ট বড়ো আমি।প্রাক্তন থাকতে পারে না বলছো?’
.
.
.
.
‘নীলা,
চিঠির পাশাপাশি এক ডজন কাঠ গোলাপের শুভেচ্ছা নিবেন।আপনি যেন প্রবল উৎসাহে পরবর্তী পত্র লিখেন,তাই এই এক ডজন কাঠ গোলাপ আপনাকে ঘুষ হিসেবে দেওয়া হলো।

শুনেন নীলা,
মিথ্যা বলা একটা পাপ।আবার ক্ষেত্রবিশেষে একটা শিল্প।সবাই মিথ্যা বলতে পারে না।অন্য ভাবে বলতে গেলে সবাই সত্যের মতো করে মিথ্যা বলতে পারে না।আপনি অন্তত পারছেন না।শেষ চিঠিতে মনে এক কথা চেপে কলমে অন্য কথা ফুটিয়েছেন।সেটা ধরতে আমার পাঁচ মিনিটও সময় লাগে নি।আপনি মিথ্যা বলতে কাঁচা।মিথ্যা লিখতেও কাঁচা।চিঠি দিতে বারণ করেছেন।অথচ পুরো চিঠি জুড়ে আপনার ফিরতি চিঠি পাওয়ার আকুলতা স্পষ্ট! কিসের ভয়ে এতো গুটিয়ে যাচ্ছেন নীলা?

আমি একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ।যা করছি,যা বলছি,সম্পূর্ণ নিজের সচেতন মনে বলছি।আমি কোনো ইন্টার পড়ুয়া ছোকরা না।আপনার অন্তত আমার সামনে দ্বিমুখী আচরণ দেখাতে হবে না।আপনি চিঠি লিখতে চাইলে মন খুলে লিখুন।লোকের ভাবনা তে আপনার কি যায় আসে?লোকে কি এখন আপনাকে খুব স্নেহ করে?খুব বেশি সম্মান করে?যদি তাই হয়,তবে আর চিঠি দেওয়ার প্রয়োজন নেই।
__

আজকের দিনটা আমার ভীষণ ব্যস্ততায় কেটেছে।আমার সাত ক্যাডেটের আজ ছোট খাটো একটা পরীক্ষা ছিলো।যদিও খুব ভালো পারফর্ম করেনি,তবে আমি তাদের প্রতি সন্তুষ্ট।

আমার কি মনে হয় জানেন?আমার মনে হয়,এই সাতজনের প্রতি আমি ভীষণ সহানুভূতিশীল।কেউ এদের বকা দিলে আমার খুব গায়ে লাগে।এদের কেউ অপমান করলে,সূক্ষ্ম যন্ত্রনায় আমার ভেতরটা চিনচিন করে।আমি তাদের খুব বেশি স্নেহ করি।

সামনে আমাদের মিশন।এরা কি আদৌ ঠিকভাবে সবকিছু করতে পারবে নাকি জানি না।মাঝে মাঝে রাতের শেষ প্রহরে আমার ঘুম ভেঙে যায়।আমি তাদের নিয়ে ভাবি,নিজেকে নিয়ে ভাবি,বাড়ির কথা ভাবি,কখনো আবার আপনার কথা ভাবি।আপনি যে দ্বৈত স্বত্তা ধারণ করে রেখেছেন,সেটা দ্রুত ঝেড়ে ফেলুন।Be the actual Nirupama(আসল নিরুপমা হয়ে উঠুন)।

ফিরতি চিঠি কি লিখবেন?চাইলে লিখতে পারেন।মিশনের আর খুব বেশি দিন বাকি নেই।আর হয়তো দুই তিন দফা চিঠি পাঠাতে পারবো।এর বেশি না।

ভালো থাকবেন।সবাইকে ভালো রাখবেন।আপনার ছেলে নিহাদকে আমার ভালোবাসা জানাবেন।আল্লাহ হাফেজ।

ইতি,
মেজর মুস্তাফা
রাত তিনটা সাতচল্লিশ,
রাঙামাটি আর্মি ক্যাম্প

.
.
.
.
অরুনিমা গালের নিচে হাত রেখে উন্মনা হয়ে কিছু একটা ভাবছিলো।জগলু মনোযোগী হয়ে বলল,’তোমার কি হলো বলো তো?’

‘কিছু না।’

‘এতো কি ভাবছো?’

অরুনিমার কন্ঠে অসহায়ত্ব।কেমন যেন করুণ মুখে প্রশ্ন করল,’হামাদ কি কাউকে পছন্দ করতো জগলু?’

জগলু কপাল কুঁচকে বলল,’কেন বলোতো?হঠাৎ কেন এমন মনে হলো?’

‘সে বলেছে।তারও নাকি একটা পার্বতী ছিলো।’

জগলু নিঃশব্দে হাসল।নির্বিকার হয়ে বলল,’জানি না ঠিক।সে তো খুব চাপা স্বভাবের।অতো কিছু তো বলে নি আমায়।’

অরুনিমার চোখ তখন স্বাভাবিক নেই।কেমন যেন ঘন কালো মেঘ এসে পাড়ি জমিয়েছিল দু’চোখের মণিতে।জগলু জানতে চাইলো,’তোমার কি তাতে মন খারাপ হয়েছে?’

‘হবে না বলছো?’

ফারহানা টেবিলে রাতের খাবার পরিবেশন করতে করতে আমোদে স্বরে বলল,’অরু! বর কে ভালোবেসে ফেললে নাকি?’

‘উহু।জানি না অতো কিছু।বাসলেও বা কি?পাপ তো আর হবে না।’

‘তা অবশ্য হবে না।’

অরু নিজ থেকেই জানতে চাইল,’হামাদ কি আমাকে একটুও পছন্দ করে না?’

‘উমমম।সে মানুষটা খুব জটিল।এক শব্দেই বলতে পারছি না।’

ফারহানা দেখলো,অরু খুব ব্যাকুল।সে একটুখানি এগিয়ে গেল।অরুনিমার মাথায় একটা হাত রেখে বলল,’অভির মনে কি চলছে সেটা জানার জন্য তো নিজের মনের কথা অভিকে বলতে হবে।’

অরু বাচ্চাদের মতো করে প্রশ্ন করল,’সেটা কিভাবে করবো?’

ফারহানা হাসল।
‘দাঁড়াও ভাবছি।তবে আগেই একটা কথা বলে নিচ্ছি।প্রেমিকা হতে হলে কিন্তু ভয় আর লজ্জা,দু’টোই কমিয়ে আনতে হয়।নয়তো প্রেমিকের মন গলানো দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে।’
____

অভি তখন জগলুদের বাড়ির ছাদে।প্রথম সিগারেট শেষ হয়েছে অনেক আগে।দ্বিতীয় সিগারেটের অবশিষ্ট অংশ দুই আঙুলের ভাঁজে।একবার বড়ো করে টান দিলো ওতে।তারপর সবটা ধোঁয়া বাতাসে ছেড়ে চারপাশ ঘোলাটে করে দিলো।

অরুনিমা ছাদের দরজায় এসে দাঁড়ালো।অভি পেছন ফিরলো না।গম্ভীর স্বরে বলল,’খালি পায়ে ছাদে আসতে বারণ করেছি না তোমাকে?’

অরুনিমা সে কথা গায়ে মাখলো না।নগ্ন পায়ে এগিয়ে এসে অভির পাশাপাশি দাঁড়ালো।একবার গলা খাকারি দিয়ে অভির মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করে বলল,’আমাকে তোমার কেমন লাগে হামাদ?’

অভি এক মুহুর্তও সময় নেয়নি।প্রশ্নটা শেষ হতেই ভারিক্কি স্বরে উত্তর দিলো,’ক্ষেত্রবিশেষে সহনীয়।আবার ক্ষেত্রবিশেষে প্রচন্ড বিরক্তকর।’

‘আর তোমার সেই পারু কে?’

অভির হাসি পেল ভীষণ।গা দুলিয়ে যেমন করে হাসে,ঠিক ওমন করে হাসতে মন চাইলো।অথচ সে পুরোটাই চেপে গেল ভেতরে ভেতরে।জলদগম্ভীর স্বরে বলল,’সেটা তো তোমার জানার বিষয় না।তুমি তোমার চরকায় তেল দাও।’

অরুনিমার দিক থেকেও সহসা কোনো উত্তর আসে নি।তবে অভি একসময় টের পেল,তার চোখ ভেজা।একটা ভয়াবহ মনঃকষ্ট তার স্নিগ্ধ চোখ জোড়ায় শান্ত বর্ষণ নামিয়েছে।সেই ভয়াবহ মনঃকষ্টের কোনো নাম নেই।অভি তাকে ক্ষেপালো,আর সে পুরোদস্তুর ঘরনিদের মতোন অভিমান করে নিলো।

চলবে-