কেন মেঘ আসে হৃদয় আকাশে পর্ব-০২

0
182

#কেন_মেঘ_আসে_হৃদয়_আকাশে
পর্ব-২

রাতে জয়া কিছুই খেতে পারল না। সারাদিনের ধকলের পর তুমুক শারীরিক উত্তেজনা তার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব হলো না। সে কোনোরকম শরীর ধুয়ে আরাফের আনা পাতলা একটা জামা পরে শুয়ে পড়ল। একটু পরেই তার শরীরের তাপমাত্রা বাড়তে লাগল। আরাফ তখন কোথায় যেন গেছে। সে যখন ফিরল তখন গভীর রাত। জয়ার ঘুমন্ত মুখটা দেখে মন ভরে গেল তার। কাছে এসে কপালে চুমু খেতে গিয়ে সে আবিষ্কার করল জয়ার শরীর আগুনের মতো গরম হয়ে আছে। প্রচন্ড জ্বরে কাঁপছে মেয়েটা। একটা পাতলা কম্বল ছিল জয়ার গায়ে।

এখন বসন্তকাল। শীত খুব একটা নেই, আবার গরমও পড়ে যায়নি। আরাফ আলমারি থেকে মোটা কম্বল বের করে জড়িয়ে দিল জয়ার গায়ে। একটা রুমাল ভিজিয়ে এনে কপালে রাখল। ঔষধ খাওয়ানো দরকার ওকে। কিন্তু জয়া দুপুর থেকে কিছুই খায়নি। বিয়ের পর এক কামড় মিষ্টি জোর করে খাইয়ে দিয়েছিল সে। আর কিচ্ছু নয়।

আরাফ নিচে চলে গেল। ভাত, কয়েক টুকরো গরুর মাংস আর একটা ডিম নিয়ে এলো প্লেটে করে। জয়াকে কোনোরকমভাবে তুলে বালিশে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিল। ভাত মেখে ওর মুখে তুলে দিল আরাফ। বলল, “একটু খাও, জয়া। নইলে ঔষধ খেতে পারবে না।”

জয়া মাথা নাড়ল, খেতে পারবে না সে।

“একটু খাও লক্ষীটি… এক লোকমা..”

জয়া খাবার মুখে নিল। বিস্বাদ লাগছে একেবারে। ভেতর থেকে আর্জি আসতে লাগল মুখ থেকে খাবার ফেলে দেবার। কিন্তু সামনে বসা আরাফের মুখের দিকে চেয়েই বুঝি সে জোর করে গিলে নিল। এভাবে তিন লোকমা খাওয়ার পর সে আরাফের হাত ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বলল, “আর না প্লিজ! আর না।”

আরাফ আর জোর করল না। ওকে প্যারাসিটামল খাইয়ে শুইয়ে দিল। তারপর পাশে একটা চেয়ারে বসে ওর মাথায় জলপট্টি দিতে থাকল। কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ল জয়া। ঘুমের মাঝে এলোমেলো স্বপ্ন দেখতে লাগল। স্বপ্নের কোনো মাথামুন্ডু নেই। দেখল আরাফের হাত ধরে উঁচু পাহাড় থেকে লাফ দিচ্ছে সে। বাতাসে ভাসতে ভীষণ আনন্দ হচ্ছে। আবার পরক্ষণেই সে চলে আসতে একটা নদীর তীরে। একটা নৌকায় দু’জন চড়ে ভাসছে জলে। নৌকোটা ফুটো হয়ে জল ঢুকে যাচ্ছে।

জয়ার ঘুম ভাঙল ভোরের দিকে। সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে। দুটো কম্বল গায়ে প্রচন্ড গরম লাগছে। তবে সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপারটা হলো আরাফ তার সামনে বসে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুমানোর আগ পর্যন্ত ওর মাথায় জলপট্টি দিয়েছে।

জয়ার মনে ঠিক সেই মুহূর্তেই বোধহয় আরাফের জন্য প্রবল আবেগের জন্ম নিল। আরাফের একটা হাত বিছানার ওপর রাখা ছিল। সেই হাতে নিজের হাত ছুঁইয়ে জয়ার মনে হলো, যেভাবেই হোক না কেন সে একটা নির্ভরতার হাত খুঁজে পেয়েছে। সবার জীবন তো আর একরকম হয় না। তার জীবন নাহয় একটু ভিন্ন রকমভাবেই শুরু হলো!
_____________________________

জয়ার জ্বর সারতে আরো তিনদিন লাগল। এই তিনদিন আরাফ সারাক্ষণই তার সাথে থেকে সেবাযত্ন করল। জয়ার মনেও একটু একটু করে ওর জন্য আবেগ বাড়তে শুরু করল। জ্বরের পুরোপুরি কাটার পর জয়া উপলব্ধি করল সে পৃথিবী থেকে পুরোপুরি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। সেই যে সেদিন তাকে তুলে আনা হলো, এরপর থেকে তার পরিচিত কেউ তার খোঁজ জানে না। বাবা মা নিশ্চয়ই চিন্তায় চিন্তায় আধমরা হয়ে গেছেন! তারা কি পুলিশে খবর দিয়েছে? পুলিশ কি তাকে খুঁজছে? তারা কি এখানে আসবে?

পুলিশ তাকে খুঁজে বের করে ফেলবে এটা ভেবে তার কেমন যেন মিশ্র অনুভূতি হতে লাগল। একবার মুক্তির আনন্দে মন পরিপূর্ণ হয়ে যায়, আবার পরক্ষণেই আরাফকে ছেড়ে যেতে হবে ভেবে মনটা শীতল হয়ে আসে।

এতদিন জ্বর থাকায় আরাফ তার কাছে আসেনি। আজ সুস্থ হবার পর রাতে তাকে গোলাপ হাতে আসতে দেখা গেল। আজ জয়া আর কোনো বাঁধা দিল না। অনেকটা নিজ থেকে আরাফকে জড়িয়ে নিল নিজের সাথে।

ভালোবাসাবাসি শেষে জয়া প্রশ্নটা তুলল, “আমার ফোনটা দেবে? আমার বাবা মা নিশ্চয়ই পাগল হয়ে আছেন চিন্তায়?”

আরাফ হাসল। “তোমার বাবা মা নিশ্চিন্তে আছেন।”

“মানে?”

“মানে তারা জানেন তুমি কোথায় আছো। আমি জানিয়েছি। এটাও জানিয়েছি যে তুমি ভালো আছো।”

“কিন্তু তারা তো আমাকে দেখেনি। কথাও হয়নি। যদি পুলিশের কাছে যায়?”

আরাফ বাঁকা হেসে বলল, “যাবে না। নিশ্চিন্ত থাকো সুইটি। এখন আমাকে আরেকটু আদর করো তো…”

জয়ার মনটা আবারও বিতৃষ্ণ হয়ে উঠল। আরাফ কি তার বাবা মাকেও ভয় দেখিয়ে মুখ বন্ধ করিয়ে রেখেছে? ওদের কথা ভেবে ভেতর থেকে কেমন একটা হাহাকার বেরিয়ে এলো জয়ার। এদিকে আরাফ অপেক্ষা করে আছে। জয়ার আর ইচ্ছে করছে না ওর কাছে যাবার। সে আড়ষ্ট হয়ে রইল। আরাফ নিজেই জোর করে টেনে নিল তাকে নিজের দিকে। দ্বিতীয় দফায় জয়া যেন কোনো প্রাণই খুঁজে পেল না। ওর শরীরটা নিয়ে স্রেফ খেলা করে গেল আরাফ। জয়ার নিজেকে মৃত কোনো প্রাণী বলে মনে হতে লাগল। অসহ্য এই অনুভূতির খেলা। তার কি কোনো মানসিক রোগ হয়ে যাচ্ছে? কোনদিকে যাবে বুঝতে পারছে না কেন?

—————————-

দেখতে দেখতে মাসখানেক কেটে গেল। জয়া পুরো পৃথিবী থেকে আলাদা হয়ে একটা ভিন্ন জগতে বাস করছে। এই জগতে একটা উঁচু পাঁচিল ঘেরা বাড়ি, অনেকগুলো কাজের লোক, যারা মোটেও কথাবার্তা বলে না, আর আছে আরাফ। আরাফই এখন যেন তার পৃথিবী হয়ে উঠেছে। জয়া এর মাঝে অনেকবার তার মোবাইল ফেরত চেয়েছে। কিন্তু আরাফ দেয়নি। এমনকি তার নিজের মোবাইলেও পাসওয়ার্ড দেয়া। জয়া ওর অগোচরে চেষ্টা করেও সেটা থেকে কোনো কল বা মেসেজ কোথাও পাঠাতে পারেনি। এই বাড়ি থেকে পালাবারও কোনো উপায় নেই। এত উঁচু পাঁচিল পার হওয়া অসম্ভব। বাড়ির গেটে পালা করে দু’জন দারোয়ান সারাদিন-রাত পাহাড়া দেয়। বাড়িটা নির্জন জায়গায়। ছাদ থেকে আশেপাশের আর কোনো বাড়ি দেখা যায় না। চারদিকে শুধুই গাছপালা।

আস্তে আস্তে ওর মা বাবার কথা মনে পড়া কমে গেল। আরাফই একটা আস্ত পৃথিবী হয়ে উঠল। আরাফের প্রতি ভালোলাগাও জয়ার দিন দিন বেড়েই চলল। আরাফ এত সুন্দর দেখতে যে চোখের সামনে এরকম একটা মানুষকে অপছন্দ বা ঘৃণা করা যায় না। ওরা একটা চমৎকার জীবন যাপন করে। ভোরে ঘুম থেকে ওঠে। একসাথে বাগানে ব্যায়াম করে। আরাফই ওকে শিখিয়ে দেয়। সেই সময় আশেপাশে কোনো কাজের লোকের চিহ্নও থাকে না। শুধু তারা দু’জনই থাকে। এই সময়টা সবচেয়ে ভালো লাগে জয়ার। ভোরের শান্ত বাতাস ওদের খুনসুটি আর ভালোবাসায় ভারে যায়।

এরপর ব্রেকফাস্ট শেষে আরাফ গাড়ি হাঁকিয়ে তার অফিসে চলে যায়। এ সময়টা জয়া কাটায় নানারকম বইপত্র পড়ে, সিনেমা দেখে বা ভিডিও গেমস খেলে। আরাফ তাকে অনেক বই এনে দিয়েছে, তাছাড়া ওর ল্যাপটপে অনেক সিনেমা ডাউনলোড করা আছে। সেসব করে খেয়ে ঘুমিয়ে দিন কেটে যায়। সন্ধ্যায় আরাফ আসে। তারা আবার একসাথে চমৎকার কিছু সময় কাটায়। আরাফ মানুষ হিসেবে ভীষণ ইন্টারেস্টিং। চমৎকার সব কথাবার্তা বলে৷ যে কোনো বিষয়ে ওর অগাধ জ্ঞান। ওর কথা মুগ্ধ হয়ে শোনে জয়া।

মাসিকের দিনগুলোতে জয়াকে একেবারে বাচ্চাদের মতো যত্ন করে আরাফ। এত যত্ন কোনোদিন নিজের বাড়িতে কল্পনাও করেনি জয়া। নিজেকে এই ক্ষুদ্র রাজ্যের মহারাণী বলে মনে হয় তার৷

____________________________

যত আদর ভালোবাসাই থাকুক না কেন, বন্দি পাখি হয়ে মানুষের জীবন কাটতে পারে না। মা বাবার জন্য, মুক্ত পৃথিবীর জন্য মনের একটা কোণ সবসময়ই কাতর হয়ে থাকে। সেটা সে আরাফকে বলেও মাঝে মধ্যেই। ইচ্ছে করেই ভালোবাসাবাসির দুর্বল মুহূর্তে কথাগুলো তোলে সে। অন্য সময় তুললে আরাফ রাগ হয়ে যায়৷ সেই সময় রাগ করে না৷ আদর করে বোঝায়। এমনই একদিন এক দুর্বল মুহূর্তে সে আরাফের থেকে কথা আদায় করে ফেলল তাকে বাইরে ঘুরতে নিয়ে যাবে সে।

এর পরের ছুটির দিনে আরাফ তাকে নিয়ে লং ড্রাইভে বের হলো। কতদিন পর চার দেয়ালের বাইরের পৃথিবী দেখতে পেল জয়া! ভীষণ ভালো লাগল তার পুরোটা সময়৷ আরাফ জয়ার খুশি দেখে নিজেও খুশি হয়ে গেল। নিজে থেকেই বলল, সময় পেলেই তাকে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়ে পড়বে৷ কিন্তু ওর মা বাবার সাথে দেখা করা বা কথা বলার ব্যাপারে আরাফ যেন নড়চড়ই করতে চায় না। জয়াও এখন আর সেসব কথা তোলে না। জীবনটা সে যেন এভাবেই মেনে নিয়েছে৷

এক ছুটির দিনে আরাফের বন্ধুরা বেড়াতে এলো। সেই যে তার বিয়ের সময় উপস্থিত থাকা দুজন ছেলে মিহাদ, আদনান; ওদের মেয়েবন্ধু রিমি। ওদের উপস্থিতিতে বাড়িতে দুপুরের খাবারের আসর বেশ জমে উঠল। খাওয়াদাওয়া শেষে ড্রইংরুমে সোফায় বসে গল্পে মেতে উঠল সবাই। জয়ারও অল্প সময়ের মধ্যেই খাতির হয়ে গেল ওদের সাথে। বিশেষ করে রিমির সাথে। রিমি ওকে জানাল আরাফ নাকি কলেজের হার্টথ্রব ছিল। হাজারো মেয়ের ক্রাশ! অথচ কাউকেই নাকি পাত্তা দিত না সে। মেয়েরা ধর্ণা দিয়ে পড়ে থাকত ওর কাছে। ও তাদের দিকে ফিরেও চাইত না। এমনকি স্বয়ং রিমিরও নাকি প্রথম ক্রাশ ছিল আরাফ। পরে পাত্তা না পাওয়ায় বন্ধু হয়ে গেছে।

এদিকে মিহাদ প্রচন্ড হাসাতে পারে। ওর কথার ধরন এমন যে ‘এক গ্লাস পানি খাব’ বললেও হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়তে হয়। ওর নাকি ইচ্ছে ছিল কমেডিয়ান হবার। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে ইঞ্জিনিয়ার হয়ে গেছে।

ওরা সন্ধ্যা পর্যন্ত রইল। ওরা বের হলে ওদের সাথে আরাফও বেরিয়ে গেল একটা কাজে। বলে গেল ঘন্টাখানেক লাগবে ফিরতে।

আরাফের আসার সময় হলে জয়া ওর জন্য চা বানিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। আরাফ এলো প্রায় দু’ঘন্টা পরে। যখন ফিরল তখন সেই মানুষটা আর নেই। এ যেন অন্য মানুষ হয়ে গেছে। চোখ লাল, মুখে রাগের বহিঃপ্রকাশ স্পষ্ট।

জয়ার মনে করল নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে যার কারনে ও এত রেগে গেছে। কোনো অঘটন ঘটল না তো? সে আরাফের কাছে গিয়ে ওর হাত ধরে নরম স্বরে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে? কোনো সমস্যা?”

আরাফ উত্তরে প্রচন্ড এক চড় কষিয়ে দিল জয়ার গালে। জয়া গাল চেপে টলে পড়ে যেতে যেতে নিজেকে সামলে নিল। চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। গালে আঙুলের দাগ বসে গেছে। আরাফের সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সে চিৎকার করে বলল, “ওর কথা শুনে এত হাসাহাসি করছিলে কেন? ভালো লেগেছে ওকে? কই আমার সাথে তো কোনোদিন এভাবে হাসো না? আমাকে ভালো লাগে না বুঝি? কয়েক ঘন্টায়ই ওকে এত ভালোলেগে গেল?”

জয়া হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইল। আরাফ কী বলছে ও নিজে জানে কি? সে কি পাগল হয়ে গেছে? নাকি আগে থেকেই পাগল ছিল?

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু