কোনো এক গোধুলী বেলায় পর্ব-০৩ এবং শেষ পর্ব

0
2

#কোনো_এক_গোধুলী_বেলায়
[ তৃতীয় ও শেষ পর্ব ]
লেখক – শহীদ উল্লাহ সবুজ

নিলয়কে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কান্না করছে জয়ন্তী। তখনই একটা শব্দ কানে আসতেই জয়ন্তী হতবাক হয়ে যায়।

— বোন কান্না করছ কেন তুমি!

তখনই জয়ন্তী বুঝতে পারে নিলয় শুধুই তার কল্পনা। নিলয় বার বার জয়ন্তীর কল্পনার মধ্যে এসে পড়ে। জয়ন্তীকে ভাবুক দেখে শিরিন বলল,

— আমি তোমার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি। কিন্তু আমাদের নিয়তিকে তো আমাদের মেনে নিতেই হবে। আমি জানি তুমি নিলয়ের অপেক্ষায় আছো, কিন্তু যে মানুষ মারা গিয়েছে সে আর কখনও ফিরে আসতে পারেনা। স্মৃতি নিয়ে কতোদিন বা চলা যায়? তোমার এখনও সুন্দর ভবিষ্যৎ এখনও পড়ে আছে। ভেঙে পড়লে হবে না তোমার। পিয়াসের কথা একবার চিন্তা করো। ও বড় হলে যখন বাবার কথা জিজ্ঞেস করবে তখন কি করবে তুমি? একটা সন্তানের বাবা থাকাটা কতো প্রয়োজন। আমি তাদের কাল আসতে বলব আমাদের বাসায়।

জয়ন্তী তখনও মন খারাপ করে আছে। আসলে সে এখনও নিজের মতামত দিতে পারছেনা। সে নিজের সাথে লড়াই করতে শুরু করে। ছেলের কথা ভেবে সে নিজের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। আর লোকটা ও খারাপ না, খুব ভালো। কিন্তু তার ছেলে কেমন সেটা জয়ন্তী জানেনা। স্বামী যদি খারাপ হয় তাহলে তো বাবা-মা দিয়ে কিছু হয়না। যে স্বামীর সাথে সংসার করবে আগে তাকে দেখতে হবে। জয়ন্তী কাগজে কিছু একটা লিখে শিরিনের রুমে গিয়ে দিয়ে আসে। শিরিন ততক্ষণে ঘুমিয়ে গিয়েছে নিজের রুমে। তাই জয়ন্তী শিরিনকে না ডেকে তার বালিশের পাশে কাগজ রেখে চলে আসে।

সকালে ঘুম থেকে উঠে শিরিন বালিশের পাশে কাগজটা দেখা মাত্র হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করে। যেখানে জয়ন্তী বিয়েতে সম্মতি জানিয়েছে। শিরিন ও খুব খুশি হয়েছে। মেয়েটার কথা ভেবে। শিরিন সেদিন ঐ লোকের কাছে খবর পৌছে দেয়। বিকালে সে তার ছেলেকে নিয়ে আশে জয়ন্তীকে দেখার জন্য। জয়ন্তীকে ছেলের পছন্দ হয়। সে জয়ন্তী আর জয়ন্তীর ছেলে পিয়াসকে মেনে নিবে বলেছে। ছেলেটার ও আগে একবার বিয়ে হয়েছে। কিন্তু তার স্ত্রী বাচ্চার জন্ম দিতে গিয়ে দু’জনেই মারা যায়। জয়ন্তীর কাছে কোনো কিছুই গোপন রাখা হয়নি। লোকটা তার ছেলের সব কিছুই খুলে বলে। জয়ন্তীর হবু স্বামীর নাম রাজ। রাজ পিয়াসকে নিজের কোলে তুলে রেখেছে। রাজ বাচ্চাদের পছন্দ করে দেখেই বুঝা যাচ্ছে। সেদিন বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করে ফেলা হয়। আগামী শুক্রবার সন্ধ্যায় রাজের বাড়িতে বিয়ে হবে। তেমন কোনো বড় অনুষ্ঠান হবেনা। শুধুই কয়েকজন নিজেদের লোক থাকবে। এই টুকু বলে চলে যায় রাজ ও তার বাবা। দেখতে দেখতে বিয়ের দিন চলে আসছে। শিরিন জয়ন্তীর জন্য কেনাকাটা করে। বিকেল হতেই শিরিন জয়ন্তীকে নিয়ে চলে যায় রাজের বাসায়। সেখানে রাজের মা জয়ন্তী আর শিরিনকে একটা রুমে নিয়ে যায়। বাড়িতে কিছু মেহমান এসেছে। শিরিন সেটা খেয়াল করলেও জয়ন্তী তেমন একটা খেয়াল করেনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই শিরিন জয়ন্তীকে খুব সুন্দর ভাবেই সাজিয়ে ফেলে। বাসায় হুজুর নিয়ে আশা হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিয়ের কাজ শুরু হয়ে যাবে। তাই শিরিন জয়ন্তীকে নিয়ে আশে। তারপর জয়ন্তী একটা চেয়ারের উপরে। আচমকা জয়ন্তীর চোখ আটকে যায় নিলয়কে দেখে। নিলয়ও এখানে জয়ন্তীকে দেখে রীতিমতো ভূত দেখার মতো চমকে উঠে। নিলয় তাড়াহুড়ো করে জয়ন্তীর কাছে গিয়ে বলল,

— জয়ন্তী তুমি বেঁচে আছো?

এই কথা শুনে উপস্থিত সবাই হতবাক হয়ে যায়। সব থেকে বেশি হতবাক হয় শিরিন আর জয়ন্তী। জয়ন্তী তো কোনো কথা বলতে পারছেনা তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। শিরিন বলল,

— জয়ন্তী বেঁচে আছে মানে? আপনি কে?

নিলয় বলল — আমি জয়ন্তীর হাসবেন্ড নিলয়।

এই কথা শুনে শিরিন হতবাক হয়ে গেলো। শিরিন জয়ন্তীর কাছে গিয়ে বলল।

— জয়ন্তী এই ছেলে কি তোমার হাসবেন্ড নিলয়?

জয়ন্তী মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে। তখনই নিলয় জয়ন্তীর কাছে এসে জয়ন্তীর মুখ উপরে তুলে বলল,

— জয়ন্তী আমি তো বিশ্বাস করতে পারছিনা তুমি বেঁচে আছো। আমার মা বাবা আমাজে যেদিন তোমার মৃত্যুর খবর দিয়েছে সেদিন থেকে আমি যেনো পাগল হয়ে গিয়েছিলাম।

শিরিন নিলয়কে বলল — জয়ন্তী মারা গেছে মানে কি? জয়ন্তীর কাছে বলা হয়েছে আপনি মারা গেছেন। আপনার মৃত্যুর পনেরোদিনের মাথায় জয়ন্তীকে আপনার মা-বাবা বাসা থেকে বের করে দিয়েছে। মেয়েটা তার ছোট একটা বাচ্চাকে নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছে। তারপর আমি ওকে আমার বাসায় নিয়ে আশি।

এই কথা শুনে নিলয়ের মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পড়লো। এখানে নিলয়ের মা-বাবা ও আছে। তারা দু’জনেই স্তব্ধ হয়ে আছে।

নিলয় তার মায়ের কাছে গিয়ে বলল,

— মা এটা কি সত্যি?

কোনো কথা বলছেনা। সেম প্রশ্ন নিলয় তার বাবাকেও করল সেও কোনো উত্তর দিতে পারেনি। কীভাবে দিবে উত্তর? তাদের তো বলার কোনো মুখ নেই। নিলয়ের মা-বাবা দু’জনের কাছেই মিথ্যা কথা বলছে কিন্তু এই মিথ্যার কারণ কি?

নিলয় তার মাকে বলল — মা আমি কি দোষ করেছি? কি অন্যায় করেছে আমার স্ত্রী সন্তান! কেন আমার থেকে তাদের এতো দিন দূরে রাখা হয়েছে? চুপ করে থাকবেনা মা জবাব দাও।

— আসলে বাবা আমি কখনও জয়ন্তীকে পছন্দ করতাম না। তুই যেদিন জয়ন্তীকে বিয়ে করে বাসায় নিয়ে আসলি তখনই আমি জানতে পারি জয়ন্তী বাক প্রতিবন্ধী। এই মেয়ের সাথে তুই কীভাবে সারাজীবন কাটাবি? তাই তোকে বিদেশে পাঠিয়ে আমি ঠিক করলাম তোদের দুই জনকে আলাদা করব। কারণ আমি তখনও জয়ন্তীকে ছেলের বউ হিসেবে মেনে নিতে পারছিলাম না। তারপর আমি প্ল্যান শুরু করি। তুই চলে যাওয়ার পরে আমি জানতে পারি জয়ন্তী প্রেগন্যান্ট। এটা শুনে আমি প্ল্যান করি এটাই সুযোগ। তাই সেদিনের অপেক্ষায় ছিলাম। তুই কল দিলে আমরা সব সময় জয়ন্তীর আড়ালে তোর সাথে কথা বলি। আর জয়ন্তীকে বলি তোর এক্সিডেন্ট হয়েছে, আর তুই মারা গেছিস। তারপর জয়ন্তী আমরা বাসা থেকে বের করে দেই। আর তোকে বলি জয়ন্তী বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে বাচ্চা সহ মারা গিয়েছে।

— ছিহ মা। তোমার এতোটা নিচ কীভাবে হতে পারলে? নিজের ছেলেকে মৃত বলতে একবার ও বুক কাপেনি? আর তোমরা কীভাবে পারলে একটা নিরুপায় মেয়েকে বাচ্চা সহ বাসা থেকে বের করে দিতে? একবারও কি ভাবোনি এই অসহায় মেয়েটা বাচ্চা নিয়ে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? ওর এই দুনিয়ায় আমরা ছাড়া আর কেউ ছিলাম না। মানুষ এতোটা পাষাণ কীভাবে হতে পারে?

নিলয় জয়ন্তীর কাছে গিয়ে চোখের পানি মুছে বলল,

— জয়ন্তী সব আমার জন্য হয়েছে। আমি যদি তোমাকে ছেড়ে দেশের বাহিরে না যেতাম তাহলে আজ তোমার এমন পরিস্থিতি হতোনা। আমাকে তুমি প্লিজ ক্ষমা করে দাও।

জয়ন্তী কোনো কথা না বলে নিলয়কে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে শুরু করে। কারণ নিলয়ের উপরে তার কোনো অভিযোগ নেই। এই একটা মানুষ সব সময় তার পাশে ছিল। সব সময় জয়ন্তীর খেয়াল রেখেছে।

নিলয় এবার রাজের বাবার কাছে গিয়ে বলল,

— আংকেল আমাকে ক্ষমা করবেন।
রাজের কাছে গিয়ে বলল, রাজ তোর সাথে আমার বন্ধুত্ব না হলে হয়তো আমি কখনও আমার জয়ন্তীকে ফিরে পেতাম না। আমার জয়ন্তীকে আমার কাছে ফিরিয়ে দে।

— নিলয় কেউ না জানলেও আমি তো জানি তুই জয়ন্তীকে ভালোবাসিস। তোর জয়ন্তীর নাম অনেক শুনেছি। কিন্তু আমি জানতাম না এটাই সেই জয়ন্তী। আর জয়ন্তী এখনও তোরি আছে। আমাদের তো বিয়ে হয়ে যায়নি। তুই জয়ন্তীকে নিয়ে যা।

নিলয় জয়ন্তীর কাছে গিয়ে বলল,

— জয়ন্তী তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি কথা দিচ্ছি আর কখনো তোমাকে রেখে আমি কোথাও যাবো না। আমি সারাজীবন তোমার পাশে থাকবো। আমি আর তুমি নতুন করে আমাদের সংসার শুরু করব।

তখনই শিরিন নিলয়ের কাছে এসে বলল,

— জয়ন্তী তো একা না তোমাদের তো একটা ছেলে আছে।

শিরিন পিয়াসকে নিলয়ের কোলে তুলে দিয়ে বলল, এটা তোমাদের ছেলে পিয়াস।

নিলয় পিয়াসকে কোলে তুলে কপালে মুখে চুমু খেতে শুরু করে। আর চোখ দিয়ে পানি পড়তে শুরু করে। নিলয় শিরিনকে বলল,

— আপনাকে ধন্যবাদ দেওয়ার মতো কোনো ভাষা আমার জানা নেই। আপনি না থাকলে হয়তো আমার স্ত্রী সন্তান রাস্তায় থাকতো।

— ধন্যবাদ দিতে হবেনা। আমার বোনের খেয়াল রাখলেই হবে। মেয়েটা তোমার জন্য অনেক কান্না করছে। মেয়েটা মন খুলে নিজের কষ্টের কথা গুলো কখনও কাওকে বলতে পারেনি। সব সময় কান্না করে গিয়েছে। ওকে দেখে রেখো।

এবার সবার থেকে বিদায় নিয়ে পিয়াসকে কোলে তুলে নিলয় জয়ন্তীর কাছে গেলো। জয়ন্তী শিরিনের কাছে গিয়ে শিরিনকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে। শিরিনের চোখেও পানি। তোবে আজকের পানি গুলো কষ্টের না সুখের।

সবার থেকে বিদায় নিয়ে বের হবে এমন সময় নিলয়ের মা বাবা নিলয়ের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,

— আমাদের কি ক্ষমা করা যায়না বাবা? আমরা জানি আমরা অনেক বড় ভুল করেছি। তোদের অনেক কষ্ট দিয়েছি। আমাদের একবার কি সুযোগ দেওয়া যায়না।

— না। তোমাদের ছেলে তো অনেক আগেই মারা গিয়েছে মা। তাহলে আবার কেন এসেছো?

— আমরা আমাদের কাজের জন্য অনুতপ্ত বাবা। আমাদের ক্ষমা করে দে তোরা। জয়ন্তী বউমা তোমার সাথে অনেক অন্যায় করেছি আমরা আমাদের ক্ষমা করে দাও।

রাজের বাবা এসে নিলয়কে আর জয়ন্তী কে উদ্দেশ্য করে বলল,

— দেখো ওনারা তোমাদের মা-বাবা। মা-বাবা অন্যায় করলেও তাদের ক্ষমা করে দেওয়া উচিৎ। জানি ওনারা অনেক বেশি করেছে। কিন্তু এই বয়সে তোমরা ওদের ছেড়ে চলে গেলে ওনাদের কি হবে? মা-বাবা যেমন হোকনা কেন মা-বাবা সব সময় সন্তানকে ভালোবাসে। তোমরা ওনাদের ক্ষমা করে দাও।

লোকটার কথা শুনে নিলয় জয়ন্তীর দিকে তাকালো। জয়ন্তী মুচকি একটা হাসি দেয়। তারপর নিলয়ের মা জয়ন্তীকে জড়িয়ে ধরে। আর এতো দিন পরে নিজের নাতিকে কোলে তুলে নেই নিলয়ের মা-বাবা। নিলয় জয়ন্তীকে জড়িয়ে রাখে নিজের বুকে।

এই সুন্দর মুহুর্তের মধ্যে দিয়েই গল্পের সমাপ্তি হলো।

সমাপ্ত।