#কোন_কাননে_ফুটিবে_ফুল🌸
#Part_21
#Writer_NOVA
পুকুর ঘাট থেকে কলস ভরে পানি নিলো ফুল। পা ধুয়ে কলস কোমড় তুলে পিছু ঘুরতেই চমকে উঠলো। অভি হাত গুজে ঘাটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ফুল বিব্রতবোধ করলো। দ্রুত সেখান থেকে সটকে পরতে চাইলো। কিন্তু অভি তা হতে দিলো না। হাত মেলে পথ আটকে বললো,
‘আমাকে দেখলে এতো পালাই পালাই করো কেন?’
ফুল মুখ থমথমে করে কঠিন স্বরে বললো,
‘পথ ছাড়েন অভি ভাই।’
‘আমার উত্তর না দিলে ছাড়বো না।’
‘আপনার কথার উত্তর দিতে আমি বাধ্য নই।’
অাহত হলো অভি। কথার আঘাতের থেকে ফুলের এড়িয়ে যাওয়ার দৃষ্টি তার বুকে তীরের মতো বিদ্ধ হচ্ছে। ছোট করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। যাতে বিষাদের ছাপ ছিলো। ফুল বুঝেও বুঝলো না। অভিকে নিয়ে মাথা ঘামানোর মতো সময় তার হাতে নেই। অভি এক ঝাটকায় সকল আঘা ঝেড়ে ফেললো। চোখ নাচিয়ে স্বাভাবিক স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
‘শুভকে তুমি বলো, আমাকে আপনি বলো কেন?’
অভির প্রশ্নে ফুলের নকশা বদলে গেলো। রাগ হলেও নিজেকে শান্ত রাখলো। তবে বিরক্তির ছাপ মুখে প্রকাশ পেলে। কিছুটা বিদ্রুপের স্বরে বললো,
‘আমি যাকে তাকে তুমি বলি না।’
‘তাহলে শুভকে বলো কেনো?’
‘আপনাদের মধ্যে তফাৎ যে আকাশ-পাতাল তাই।’
‘কোনো সম্পর্ক আছে নাকি?’
চোখ রাঙিয়ে তাকালো ফুল। অভি বাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাসলো। মোক্ষম জায়গায় আঘাত করেছে৷ এবার ফুল কি উত্তর দেয় তাই দেখার পালা। কিন্তু অভির ভাবনায় এক গামলা পানি ঢেলে সেখানে উপস্থিত হলো ঝুমুর।
‘ফুল তোমারে চাচী ডাকে। কহন পানি আনতে পাডাইছে। তুমি এইহানে খাঁড়ায় রইছো। চাচী দেখলে আঙ্গারের মতো জইলা উঠবো।’
অভি বিরক্ত হলো৷ ঝুমুরের আগমন একেবারে অপ্রত্যাশিত ছিলো। কোথায় ভেবেছিলো এতদিন পর ফুলকে পেয়ে আচ্ছা করো আঘাত করে কতগুলো কথা শুনাবে। তাকে দেওয়া আঘাতগুলো ফেরত দিবে। সেখানে বা হাত ঢুকালো ঝুমুর। চাপা ক্ষোভে দ্রুত পায়ে সেখান থেকে চলে গেলো।
‘অভি ভাইয়ের কি হইলো ফুল? এমন কইরা গেলো গা কেন?’
‘কে জানে ঝুমুর আপা। মানুষের মতিগতি বুঝি না আমি।’
‘আর বুঝতে হইবো না। এহন জলদী কইরা লও। নইলে কুরুক্ষেত্র বাইধা যাইবো। কলসিডা আমারে দাও।’
‘না, লাগবে না। আমি পারবো।’
‘বেশি কথা কইয়ো না।’
ঝুমুর জোর করে ফুলের থেকে পানি ভর্তি কলসটা নিয়ে নিলো। ফুল বারণ করা সত্ত্বেও শুনলো না। তারা চলে যেতেই শুভ নিমের ডাল দিয়ে দাঁত ঘষতে ঘষতে মোটা গাছের গুড়ির আড়াল থেকে বের হলো। ঝুমুরকে এখানে সেই পাঠিয়েছে। নাগ বারান্দা থেকে সে সবটাই দেখেছে। অভি যখন ফুলের পথ আটকিয়েছে তখনই বুঝে ফেলেছে কোন ঘাপলা আছে। তাই ঝুমুরকে ডেকে পাঠিয়ে দিলো। মুখে থাকা ফেনা দূরে ছুঁড়ে ফেলে মুচকি হাসলো শুভ। ছোট সর্দার নামটা তো সে এমনি এমনি পায়নি।
‘অভি তোরে কি কইছে রে?’
ফুলের হাত থেমে গেলো। চোখ সরু করে শুভর পানে তাকালো৷ এক মুহুর্তে নিজেকে সামলে বললো,
‘কি বলবো?’
‘তাই তো জানতে চাইতাছি।’
‘কিছু না।’
‘আমার লগে মিছা কতা শিইখা গেছোত?’
ফুল উত্তর দিলো না। পাতিল থেকে এলুমিনিয়াম বোলে ভাত বেড়ে নিলো। ঘরের ধানের চাল হওয়ায় ভাতের রংটা ভিন্ন। লালচে রংঙের মোটা ভাত দেখে ফুল প্রথম দিন ভয় পেয়ে গিয়েছিলো। তার মনে হয়েছিলো এই ভাত গলা দিয়ে নামবে না। ওর আৎকে ওঠা দেখে সুফিয়া বিবি ভেংচি কেটে বলছিলো,
‘কুয়ারা করে৷ এই ভাত খাইতে পারবো না। জীবনে এই চাউল দেখছোত? এডার স্বাদ কি বুঝবি? আমার ভোলাভালা পোলাডার টেকা তো মিনিকেট চাউল কিনতে কিনতে ফুরাইতাছোত।’
দাদীর কথায় চোখ টলমল করে উঠেছিলো ফুলের। এই কথায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলো আনোয়ার সর্দার স্বয়ং নিজেই। সেদিন বিকেলেই ভাতিজীর জন্য পঞ্চাশ কেজি বস্তার মিনিকেট চালের বস্তা কিনে এনেছিলো। সেটা নিয়ে সোহেলী বেগম কম ঝামেলা করেননি। এরপর থেকে অল্প অল্প করে খেতে খেতে অভ্যাস হয়ে গেছে। এখন ফুলের এই মোটা চালের ভাত ভালোই লাগে।
‘কিরে কই হারালি কইতরির মা?’
ফুল চমকে সজ্ঞানে এলো। মাথা নাড়িয়ে বললো,
‘কোথাও না।’
শুভর ফুলের কথা পছন্দ হলো না। কিছুটা রুক্ষ ভাষায় বললো,
‘কি হইছে তোর ক তো? তহন থিকা না, না উত্তর দিতাছোত। আমার মেজাজ গরম হইলে দিমু নে এক চটকনা। তহন এমনি ঠিক হইয়া যাবি।’
ফুল দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো। তার এখন কোন কিছু ভালো লাগে না। যেদিন থেকে বাবার চিঠি পরেছে সেদিন থেকে মানসিক চাপে আছে। আশেপাশের সবকিছু বিরক্ত লাগে৷ শুভ যে বিষয়টা খেয়াল করেনি তা নয়। ফুলকে চুপচাপ দেখতে তার ভালো লাগে না। ফুল প্রাণোচ্ছল ভাবে বাতাসের তালে তালে দুলবে। সেটাই যেনো শুভর চোখের প্রশান্তি।
‘তোমার ভাত বেড়ে দিছে। খেয়ে নাও।’
‘তুই খাইছোত?’
‘না, পরে খাবো।’
‘কোন পরে টরে নাই। এহন আমার লগে খাইতে বইবি।’
ফুল চোখে চোখ রেখে বললো,
‘জেদ করো না শুভ ভাই।’
‘আমার জেদ দেহস নাই তুই। হের লিগা ভালো কইরা কইতাছি আমারে জেদ করতে বাধ্য করিস না। চুপচাপ প্লেট লইয়া ভাত বাড়। আমার লগে বইয়া খাবি।’
ফুল নিষ্পলক দৃষ্টিতে শুভর দিকে তাকিয়ে রইলো।মনে মনে ভাবলো এই ছেলেটা এতোই যখন ভালোবাসে তাহলে বলে দেয় না কেনো? সে কি জানে ফুল তার মুখ থেকে ভালোবাসি শব্দটা শুনতে কতোটা উৎকন্ঠিত হয়ে আছে।
‘চাইয়া না থাইকা খাইতে বয়।’
‘কারো যখন আমাকে নিয়ে কোন চিন্তা নেই, তোমার এতো চিন্তা কেন শুভ ভাই?’
শুভ উত্তর দিলো না। এক পলক ফুলের দিকে তাকিয়ে বিষম খেলো। ফুল দ্রুত উঠে স্টিলের জগ থেকে মগে পানি ঢেলে শুভর দিকে বাড়িয়ে দিলো। ঢকঢক করে আধা মগ পানি খেয়ে শুভ প্রসঙ্গ পাল্টে ফেললো।
‘শুক্কুরবার আমগো ক্লাবের ক্রিকেট খেলা আছে। দেখতে যাবি?’
রাত বাজে এগারোটার বেশি। আনোয়ার সর্দারের চোখে ঘুম নেই। হাসফাস করছেন তিনি। এপাশ ওপাশ করে অস্থির হয়ে যাচ্ছেন। এক সময় উঠে বসলেন। ঘুলঘুলি দিয়ে চাঁদের আলো এসে সারা কামরা মোহনীয় করে তুলেছে। পূর্ণিমার আলো। সারা কামরার কানায় কানায় বিস্তার করছে। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে দেখলো সে পাশ ফিরে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। আনোয়ার সর্দারের চোখ দুটো আজ বেইমানি করছে৷ ঘুম কিছুতেই ধরা দিচ্ছে না। অতিরিক্ত চিন্তায় চোখের ঘুম উবে গেছে। চোখ দুটো বন্ধ করলেই ছোট ভাইয়ের অসহায় মুখটা ভেসে উঠে। সেদিন মনোয়ার সর্দার এসেছিলো।
রমিজ মিয়া যখন বললো আপনার সাথে কেউ দেখা করতে এসেছে তখন আনোয়ার সর্দার দেরী করেনি। ধীর পায়ে বাড়ির বাইরে চলে গেছে। উঠোনে কাউকে না পেয়ে বড় রাস্তার দিকে গেলো। সেখানেই মনোয়ার সর্দার দাঁড়িয়ে ভাইয়ের অপেক্ষা করছিলো। ভাইকে দেখে চোখ দুটো টলমল করে উঠলো৷ আনোয়ার সর্দার সবুর করতে পারলো না। ভাইকে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কেঁদে উঠলো। তারপর সেখান থেকে আড়ালে গিয়ে সুখদুঃখের কত গল্প করলো। মনোয়ার সর্দার একে একে সব খুলে বললো। আমিন, মারুফের ঘটনাও বাদ দিলো না। সব শুনে আনোয়ার সর্দার একটু চমকে উঠলো। মারুফকে চিনে না এমন মানুষ তাদের উপজেলায় খুব কম মানুষ আছে। মারামারি, খুনাখুনি, কাটাকাটির জন্য মারুফ শেখের নাম সারা উপজেলায় কুখ্যাত। তার সাথে লাগতে যাওয়া কোন বুদ্ধিমানের কাজ নয়৷ ভাইকে সান্ত্বনা দিয়ে পাঠিয়ে দিলেও সে শান্ত হতে পারছে না।
এক গোলক ধাঁধাঁয় আটকে গেছে। এক পাশে বড় ছেলে, আরেক পাশে ছোট ছেলে আর বিপরীতে আমিন দাঁড়িয়ে৷ কোন কাননে ফুটিবে ফুল?
#চলবে
#কোন_কাননে_ফুটিবে_ফুল🌸
#Part_22
#Writer_NOVA
‘কইতরির মা। ঐ কইতরির মা রেএ!’
শুভর গলা ফাটানো চিৎকারে কিঞ্চিত বিরক্ত হলো ফুল। ললাট কুচকে গেছে। চোখ মুখে বিরক্তির আভাস। অকারণে শুভর ডাকাডাকি মাঝে মধ্যে ফুলের মেজাজ খারাপ করে দেয়৷ শুভ জানে এভাবে ডাকলে দাদী, মায়ের তোপের মুখে পরবে ফুল। এখন আবার যুক্ত হয়েছে অভি। তবুও সবকিছুতে গা ঝাড়া ভাব। যেনো কিছুই হবে না।
‘কইতরির মা, এদিকে আহিস।’
শুভর চেঁচানো গলা আবারো শোনা গেলো। সোহেলী বেগম রসুইঘর থেকে বেরিয়ে ফুলের দিকে রক্তিম চাহনি নিক্ষেপ করলেন। ফুল সেদিকে এক পলক তাকিয়ে ছাই দিয়ে পাতিলে নিচের কালি পরিষ্কার করতে লাগলো। ফুল পাত্তা না দেওয়ায় সোহেলী বেগম বিরবির করতে করতে রসুইঘরের ভেতরে চলে গেলো৷ ঝুমুর ওড়না কোমড়ে বাঁধতে বাঁধতে ফুলের সামনে এসে দাঁড়ালো।
‘পাতিল কি এই কয়ডাই ফুল?’
‘হ্যাঁ, এই বেলার জন্য এই কয়টাই।’
‘তাইলে আমারে দেও। আমি করি। তুমি গিয়া দেইখা আহো ছোট ভাইজান কেন ডাকে।’
‘হুদাই!’
‘হুদাহুদি ডাকবো না। তোমারে লাগবো দেইখাই ডাকতাছে।’
ফুল পিড়ি থেকে উঠে বালতির পানিতে হাতের কালি ধুতে ধুতে বললো,
‘এর যন্ত্রণায় বাচি না।’
ঝুমুর ফিক করে হেসে উঠলো। ফুল মুখ ঝামটা মেরে বললো,
‘হেসো না। আমার কপালটাই ফুটা।’
‘হইছে বাড়তি কথা বাদ দিয়া ভাইজানের কাছে যাও। গিয়া জিগাও কি লাগবো। নইলে আবার চিল্লান দিয়া উঠবো। জানোই তো কেমন করে।’
ফুল ধুপধাপ পায়ে উঠোন পেরিয়ে কামরার দিকে রওনা করলো। সিঁড়িতে অভির মুখোমুখি পরলো। অভি কিছু বলার আগে নিজের ওড়নাটাকে ওর সামনে হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে বেশ ভাব নিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। অভি ঘটনার আকস্মিকতায় আহাম্মক বনে গেলো। মিনমিনিয়ে বললো,
‘কি হলো? এমনটা করলো কেনো?’
শুভকে দেখা গেলো বিছানায় উপুড় হয়ে পরে আছে। খালি গায়ে কোমড় অব্দি কাঁথা টেনে দেওয়া। উন্মুক্ত পিঠের দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো ফুল। মুখ ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘কি জন্য ডেকেছিলে?’
‘হপায় (এখন) তোর আহনের সময় হইছে। কহন থিকা ডাকতাছি।’
‘আমার তো কাজকর্ম নেই। সব ফেলে তোমার সামনে সং সেজে বসে থাকবো।’
‘ফুলের কন্ঠ ঝাঁঝালো শুনালো। শুভ বালিশ থেকে মাথা উঠিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে ফুলকে দেখলো। ফুলের মনমেজাজ ভালো না বুঝে গেছে। থেমে থেমে নাকের পাটা ফুলাচ্ছে মেয়েটা। যা দেখে শুভ নিঃশব্দে হাসলো। অতঃপর বালিশে মুখ গুঁজে জড়ানো গলায় বললো,
‘মেরুদণ্ডডা অনেক ব্যাথা করতাছে। একটু বানায় দিবি।’
‘পারবো না।’
চট করে চোখ তুলে তাকালো শুভ। মুখটা পাংশুটে বর্ণ করে জিজ্ঞেস করলো,
‘কেন?’
‘আগে শার্ট পরো।’
শুভর মুখে দুষ্টুমির হাসি খেলে গেলো। ফুলকে জ্বালানোর মোক্ষম সুযোগ সে পেয়েছে। এটাকে হাত ছাড়া করবে না।
‘এমনেই দে না। এহন আর শার্ট পরতে পারমু না। তোর এমনি দিতে হইবো।’
ফুল দাত কিড়মিড় করে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। সে ঢেঢ় বুঝতে পারছে শুভ ইচ্ছে করে এমনটা করছে। তাই সে সিদ্ধান্ত নিলো এখান থেকে দৌড়ে পালাবে। তবুও শুভর খালি গায়ে হাত দিবে না। এই ছেলের মাথা মাঝে মাঝে সত্যি খারাপ হয়ে যায়। নয়তো এমন অসভ্য আবদার কেউ করতে পারে? ফুল ধীর পায়ে দরজার সামনে গেলো। এরপর এক ছুটে নিচে। ফুলের পায়ের ধুপধাপ শব্দ শুনতে পেয়ে শুভর চিৎকার আবারো শোনা গেলো।
‘কইতরির মা! তোরে শুধু কাছে পাইয়া নেই। সুদে আসলে সব ফেরত নিমু। আমার কথার অবাধ্য হইয়া ভালো করলি না।’
কন্ঠে রাগ মিশ্রিত থাকলেও শুভ মিটমিট করে হাসছিলো। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে ফুলকে অকারণে জ্বালাতে তার বেশ ভালো লাগে। ভালোবাসার মানুষকে কারণ ছাড়া জ্বালানোর মাঝেও অন্য রকম প্রশান্তি আছে।
গোধুলির লগ্নে লালচে আলোর ছাপ। আকাশে পাখির ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ। নীড়ে ফেরার সময় যে হয়ে এসেছে। ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত কৃষকরা নিজেদের কাজ সেরে বাড়ি ফিরছে। জানালার সামনে দাঁড়িয়ে তাই অবলোকন করছে ফুল। প্রকৃতি দেখতে এতোই বিভোর যে সন্ধ্যা বাতি জ্বালানোর কোন হুশ নেই। ধ্যান ফিরলো সুফিয়া বিবির চেচামেচিতে।
‘বাড়িতে কি কেউ আছে? সন্ধ্যা পইরা গেলো। এহন বাতি জ্বালানের নাম নাই। আর কারেন্টডাও বহুত জ্বালায়। সন্ধ্যা হইলেই দৌড়ায় যায় গা। ও বড় বউ, ঐ ঝুমুর কই গেলি তোরা? মুখপুড়িডারেও দেহি না। সব কি মরছোতনি রে?’
টেবিলের ওপর ঠাস করে হারিকেনটা রাখলো ঝুমুর। মুখে বিরক্তি। দিয়াশলাইয়ের কাঠি জ্বালিয়ে সলতের আগুন ধরিয়ে দিলো। ফুল তখন জানালার সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে।
‘অভি ভাইয়ের ঘরের বাতিডা একটু ধরায় দিবা? আমার আবার নাগ বারান্দায় হারিকেন দিতে হইবো। নইলে বুড়ি চিল্লায় উডবো। এমনি হারাদিন চিল্লাইয়া মাথা ধরায় হালায়। আমার আর ভাল্লাগে না। মনে চায় এক মিহি (দিকে) হাইটা যাইগা। যত্তসব অশান্তি!’
ফুল নিষ্পলক দৃষ্টিতে একবার ঝুমুরের দিকে তাকিয়ে জানালার কপাট বন্ধ করলো। কিছুটা অসন্তোষের গলায় বললো,
‘তুমি জানো না, আমি অভি ভাইয়ের কামরায় যাই না।’
ঝুমুর ফের অনুনয়ের সুরে বললো,
‘একবার যাও। অভি ভাই ঘরে নাই। বিকালবেলা কই জানি গেছে। আইতে বহুত দেরী। তার সামনে তুমি পরবা না। আমার কতগুলি কাম বাকি আছে। এহনো হাঁস-মুরগির খোয়ার আটকাইন্না বাকি। পুকুর থিকা কলস ভইরা পানি আনতে হইবো।’
ফুল এবার আর মানা করতে পারলো না। ঝুমুরের থেকে দিয়াশলাই নিয়ে ওর আগেই হারিকেন নিয়ে অভির রুমের দিকে পা বাড়ালো ফুল।
আজান হয়েছে বেশ কিছু সময় ধরে। সোহেলী বেগম নামাজ সেরে জায়নামাজে বসে তবজি জপছেন। ফুল তার কামরার সামনে দিয়ে যেতে নিলে হাঁক ছাড়লেন।
‘কেডায় যায়?’
ফুল দাঁড়িয়ে গেলো। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ঘাড় কাত করে উত্তর দিলো,
‘আমি চাচী।’
‘আমি কেডা? নাম নাই?’
‘ফুল।’
‘ওহ, হোন।’
‘জ্বি বলেন।’
‘একটা লাঠি গুলুপ (কয়েল) জ্বালায় দিস তো। কি কাম করছোত আল্লাহ জানে। সন্ধ্যার আগে দরজা-জানালা আটকাস নাই। সারা ঘর মশা দিয়া ভইরা গেছে। কতবার কইছি আগে দরজা জানলা আটকাবি। এরপর বাকি কাম। আমার কথা গ্রেহ্যই করে না। তাগো মন মতো কাম করে।’
‘একটু পরই দিয়ে যাচ্ছি।’
ফুল দাঁড়ালো না। তার মিশন এখন অভির আসার আগে সেই কামরায় হারিকেন জ্বালানো। কামরায় ঢুকে কোনদিকে না তাকিয়ে বেতের মোড়াটার ওপর হারিকেন রাখলো। জানলা আটকে খাটের নিচ থেকে কুপিটা বের করলো। হারিকেন খুঁজেও পেলো না। দিয়াশলাই জ্বালিয়ে কুপিতে আগুন দিলো। কুপি নিয়ে নিচ থেকে উঠে দাঁড়াতেই চমকে গেলো। আচানক কাউকে খাটের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বুক কেঁপে উঠেছে। অভি উচ্চস্বরে হেসে বললো,
‘ভয় পেয়েছো?’
‘মূর্তির মতো হঠাৎ করে দাঁড়িয়ে থাকলে কে না ভয় পায়। কখন আসলেন আপনি?’
‘আমি তো রুমেই ছিলাম।’
ফুল দ্বিগুণ চমকে অভির দিকে তাকালো। কুপিটা উচিয়ে অভির মুখের সামনে ধরলো।
‘আরে আরে কি করছো?’
‘দেখলাম আপনি মানুষ নাকি ভূত।’
‘আজব কথাবার্তা। তা কি দেখতে পেলে?’
‘আপনি মানুষ। ভুত হলে আমার হাতে আগুন দেখে ভয় পেতেন।’
অভি হো হো করে হেসে উঠলো। ফুল কপাল কুঁচকে ঠোঁট উল্টে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। অভির হাসির দমকা কমতেই সে বললো,
‘ভারী মজা করতে পারো তো তুমি।’
ফুল উত্তর দিলো না। ভেংচি কেটে অভির হাতে কুপি ধরিয়ে দিয়ে বললো,
‘এরপর থেকে হুটহাট করে কামরায় ঢুকবেন না। আমি সাহসী মেয়ে দেখে এখনও ঠিক আছি। ঝুমুর আপা হলে ফিট খেতো।’
অভি কিছু বলার আগে সোহেলী বেগমের উচ্চস্বর শোনা গেলো।
‘কহন কইলাম গুলুপ ধরায় দিতে। এহন দিয়া গেলো না। একটা কাম যদি ঠিকমতো করে।’
‘আসতেছি চাচী।’
ফুল হারিকেন নিয়ে দৌড় দিলো নিচের দিকে। অভি কুপি হাতে নিয়ে ফুলের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো। আজ ফুল খোশমেজাজে ছিলো৷ নয়তো অভিকে কতকি শুনিয়ে দিতো।
সিগারেটের ধোঁয়া উপরের দিকে উড়িয়ে আশেপাশে নজর বুলালো শুভ। বট গাছের নিচে পা ছড়িয়ে বসে আছে। শুভর মতিগতি কেউ বুঝতে পারছে না। হাসান, হাফিজ, পলক এক দৃষ্টিতে শুভর দিকে তাকিয়ে চিন্তায় পরে গেছে। নীরবতা ভাঙলো শুভ নিজেই।
‘খেলার কি অবস্থা পলক।’
‘তুই ক্লাবে না গেলে যেই অবস্থা হয় হেই অবস্থাই।’
‘কেন সবসময় আমার যাইতে হইবো কেন?’
শুভর কথার পিঠে জবাব দিলো হাফিজ।
‘প্রেমিকা নিয়া না পইরা থাইকা খেলার দিকেও একটু নজর দে। নইলে এবার কাপ পাওনের আশা ছাইড়া দে।’
শুভ তীক্ষ্ণ নজরে তাকালো হাফিজের দিকে। হাফিজ ইতস্তত হয়ে মাথা নিচু করে ফেললো। হাসান খোঁচা মেরে বললো,
‘এমন ভাব করতাছোত জীবনে মাইয়া দেহস নাই। কি পাইছোত ঐ মাইয়ার মধ্যে? দুই ভাই একটার পিছনে পইরা রইছোত। হুনছিলাম ঐ মাইয়ার বাপ-মায় তোগো বংশের নাক কাটছে৷ এর লিগা এতো পিরিতি কেন? বুঝায় যায় নষ্ট মাইয়া। মার মতো তগো দুই ভাইয়ের কাউরে নিয়া ভাগবো।এসব মাইয়ারে চেনা আছে আমার।’
শুভর চোখ দুটো দপ করে জ্বলে উঠলো। চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। হাসানের খোচা মারা কথায় মাথায় রাগ চেপে ধরেছে। জলন্ত সিগারেটটা দুমড়েমুচড়ে দূরে ছুঁড়ে মারলো। মুখের বলিরেখা ফুটে উঠেছে। রাগে তার সারা শরীর থরথর করে কাপছে। সেটা দেখে পলক ভয় পেয়ে গেলো। আজ হাসানের খবর আছে। কেউ তাকে শুভর হাত থেকে বাঁচাতে পারবে না। হলোও তাই। শুভ, হাসামের শার্টের কলার ধরে নাক বরাবর সর্বশক্তি দিয়ে দুটো ঘুষি মারলো। চেচিয়ে বললো,
‘বাঙ্গির পোলা! চোপার দাঁত ছুটায় ফালামু। চিনোস আমারে? আমার ফুলরে নিয়া এসব কথা কওনের সাহস তোরে কে দিছে? তোর ভাবী হয় ও। কথাবার্তায় লাগাম দে। নয়তো জ্যন্ত কবর দিমু।’
পলক, হাফিজ দুজনে হাসানকে ছাড়াবে কি! নিজেরাই তো শুভর ভিন্ন রূপ দেখে ভয়ে কাঁপছে।
#চলবে