#কোন_কাননে_ফুটিবে_ফুল🌸
#Part_25
#Writer_NOVA
খাটে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে শুভ। ভরদুপুরে ওকে শুয়ে থাকতে দেখলে যে কেউ অবাক হবে। হওয়ারই কথা! যে ছেলেকে ভোর সকালে আর মধ্য রাত ছাড়া বাড়িতে পাওয়া যায় না তাকে দুপুর বেলা দেখা যেনো আমাবস্যার চাঁদ দেখতে পাওয়া। কারণ তো অবশেষ আছে। সকালে তার উড়োজাহাজ নিয়ে বেরিয়ে ছিলো। ঠান্ডায় অবস্থা খারাপ। হাঁচি দিতে দিতে নাকের ডগা লাল হয়ে গেছে। বৃষ্টির পানি তার সয় না। সেদিন বৃষ্টিতে গোসল করে বাড়ি ফেরার ফল এটা। দুপুর থেকে শরীরটা জ্বর জ্বর লাগছে। তাই বাড়ি ফিরে এসেছে। এসেই চুপচাপ খাটে শুয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছে।
ফুল খাবারের প্লেট নিয়ে উপরে চলে এলো। অনেক বার ডেকেও শুভর কোন সাড়া না পেয়ে বাধ্য হয়ে চলে এসেছে। শুভর লাল চোখ দেখেই ফুলের মন খচ করে উঠেছিলো। কিছু একটা তো গন্ডগোল আছে। তাছাড়া যেই শুভ কইতরির মা বলে ডাকতে ডাকতে হয়রান হয়ে যায়। আজ সে একটা বার ডাকেওনি। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছোট করে ডাকলো ফুল।
‘শুভ ভাই!’
শুভর দিক থেকে কোন উত্তর এলো না। তবে চাপা স্বরে গোঙানির আওয়াজ ফুলের কানে ঠিকই এলো। হন্তদন্ত পায়ে এগিয়ে এসে ছোট টেবিলের ওপর খাবারের প্লেটটা রেখেই শুভর শিউরে বসলো।
‘তোমার কি খারাপ লাগছে?’
‘হু!’
‘জ্বর এসেছে?’
‘হু!’
‘মাথায় পানি দিয়ে দেই?’
‘নাহ!’
‘কেনো?’
শুভ জ্বরের ঘোরে চোখ তুলে তাকালো। ফুল আৎকে উঠলো। মুখ, চোখ ফুলে গেছে। আগের থেকে চোখ দুটো আরো লাল হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে যেকোনো সময় চোখের পুত্তলী ফেটে যাবে। ফুল কপালে হাত রেখে সাথে সাথে সরিয়ে ফেললো। গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। কপালে হাত রাখা যাচ্ছে না। ফুল ব্যস্ত হয়ে পরলো।
‘তোমার শরীরে তো অনেক জ্বর। মাথায় পানি যখন দিতে দিবে না, জলপট্টি দিয়ে দেই?’
‘লাগবো না।’
‘তাহলে চাচীকে ডাকি?’
‘না।’
‘কি ছোট বাচ্চাদের মতো জেদ শুরু করছো? মাথায় পানি দিতে দিবে না, জলপট্টি দিতে দিবে না, চাচীকে ডাকতে চাইলাম তাও না করছো। তাহলে করবোটা কি? হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবো? আর তোমার জ্বর বাড়তে থাকবে।’
শুভ পলক ফেলে তার মাথাটা ফুলের কোলে তুলে দিলো৷ এহেন কান্ড ফুল অবাক বা বিরক্ত কিছুই হলো না। ফ্যালফ্যাল করে শুভর মুখপানে তাকিয়ে রইলো। শুভ তার দূর্বল হাত দিয়ে ফুলের হাত টেনে কপালে দিয়ে শুকনো গলায় বললো,
‘তোর হাতটা এমনেই রাখ। আমার ভালো লাগতাছে। পারলে মাথার চুলগুলি একটু টাইনা দিস। আমি একটু ঘুমামু।’
‘ঘুমাবে বললেই হলো নাকি? সকালে না খেয়ে বেরিয়েছো। আমি খাবার নিয়ে এসেছি। খেয়ে ঔষধ খেয়ো। জ্বর ছেড়ে দিবে।’
শুভ এই অবস্থায়ও ফুলকে ধমকে উঠলো,
‘বেশি কথা কইস না। চুপচাপ মাথার চুলগুলি টাইনা দে। আমার অনেক ঘুম পাইতাছে।’
বিকেলে অভি, আনোয়ার সর্দারের কামরায় এসে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। চেয়ারম্যান তখন আছরের নামায পরছিলেন। ছেলের শরীর খারাপ শুনে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে দ্রুত ফিরে এসেছেন। আজ আর যাবেন না। শুভর জ্বর এখন একটু কমেছে। সালাম ফিরাতেই বড় ছেলেকে দেখলেন। কিছু না বলে মোনাজাত ধরলেন। অনেক সময় পর্যন্ত মোনাজাতে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া জ্ঞাপন করলেন। মোনাজাত শেষ করে জায়নামাজ ভাজ করতে করতে জিজ্ঞেস করলেন,
‘কিছু কবি?’
‘বলতেই এতখন ধরে দাঁড়িয়ে আছি।’
‘যা কওনের কইয়া ফালা।’
‘তুমি কি আমার বিষয়টা একবারো ভাবছো না?’
আনোয়ার সর্দার জায়নামাজ খাটের এক কোণায় রেখে চোখ সরু করে ছেলের দিকে তাকালো। গলা ঝেড়ে বললো,
‘পেচাইস না। যা কওনের সরাসরি ক।’
‘আমি ফুলকে বিয়ে করতে চাই আব্বা।’
‘তা এহন আর সম্ভব না।’
বাবার কথা বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো অভির মাথায়। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘কেনো?’
‘আমি ঠিক করছি শুভর লগে ফুলের বিয়া দিমু।’
‘আব্বা!’
আহত গলায় চাপা আর্তনাদ করে উঠলো অভি। চোখ মুখে ফুটে উঠলো গভীর অসহায়ত্ব।
‘তুমি এতবড় সিদ্ধান্ত আমাকে না জানিয়ে কি করে নিতে পারো আব্বা?’
‘আমি যতদিন বাইচা আছি ততদিন আমার কথাই শেষ কথা। আমি এমন কোন সিদ্ধান্ত নিমু না যাতে তোগো অমঙ্গল হয়। অনেক ভাইবা চিন্তা কইরাই নিছি। আমি আমার মত পাল্ডামু না।’
‘এমন করতাছো কেন?’
‘এইডা তোর শাস্তি। আমার ফুল মারে কান্দানোর শাস্তি। তুই হেই দিন রাজী হইয়া গেলে আজ এত কিছু ঘটতো না। তাছাড়া আমি সবসময় শুভর লগে দুই নাম্বারি করছি। ওর চাওয়া-পাওয়ার কোন গুরত্ব দেই নাই। পোলায় আমার কাছে এতবছর পর কিছু চাইলো ওরে আমি খালি হাতে ফিরাই কেমনে?’
অভি করুন গলায় বললো,
‘আমার কথাডা ভাবলেন না?’
‘তোর কথা ভাইবাই এই সিদ্ধান্ত নিলাম। শুভর চোখে আমি ফুলরে হারানোর ডর দেখছি। তোর চোখে তা যে আমি খুইজা পাই না বাজান।’
বাবার নরম গলা শুনে চমকে উঠলো অভি। তবে বেশি সময় মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। আহত শাবকের ন্যায় গুটি গুটি পায়ে কামরা থেকে বেরিয়ে গেলো। অভি যেতেই আনোয়ার সর্দার হাঁক ছাড়লেন,
‘ফুল মা, এক কাপ চা দিয়া যাইস।’
আমিন, মারুফ আর তার সাঙ্গপাঙ্গদের দেখেই গলা শুকিয়ে এলো মনোয়ার সর্দারের। কলি বেগম ওদের গাড়ির শব্দ পেয়েই বৃন্ত, পাপড়িকে নিয়ে পাশের বাড়ি ছুটেছে। ছেলেমেয়ে দুটোকে কারো ঘরে লুকিয়ে রেখে সেও ফিরবে স্বামীর কাছে। আমিন চেয়ারে লাথি মারতেই মনোয়ার সর্দার চমকে উঠলো।
‘শ্বশুর আব্বা, কত সুন্দর কইরা ঐদিন বুঝায় গেলাম। তাও আপনে একেবারে চুপচাপ বইয়া রইছেন। এইডা তো ভালো কথা না। আমি এমনি ভীষণ শান্তশিষ্ট পোলা। কিন্তু রাইগা গেলে শ্বশুর, বাপ দেহি না। ধর থিকা কল্লা আলাদা কইরা হালাই। এহন আপনেরে কি কমু তাই কন।’
মারুফ আশেপাশে চোখ বুলাতে বুলাতে সিগারেটে শেষ ফুক দিলো। এরপর নিজেই মোড়া টেনে পায়ের ওপর পা তুলে আরাম করে বসলো। ছোট ভাইকে উদ্দেশ্য করে বললো,
‘বইয়া রইছোত কেন? হালায় দে। বাপের এই অবস্থার কথা হুনলে এমনি মাইয়া দৌড়ায় আইবোনি। তহন তোর পাখিরে তুই খাঁচায় পুরিস। আমার এতে খেচাখেচি ভাল্লাগে না। যা মুখে কবি তা হাতে কলমে দেহায় দিবি। তাইলে না মানুষ ডরাইবো।’
‘শ্বশুর দেইখা সম্মান করতাছি।’
‘রাখ তোর সরমান। এই বেডায় সরমানের যোগ্যই না। এহনো মাইয়াডারে তোর হাতে তুইল্লা দিলো না। এতে বুঝোস না ভালো কথার মানুষ না।’
মনোয়ার সর্দার একদম নিশ্চুপ। মনে হচ্ছে মারুফ, আমিন কোন পাথরের মূর্তির সাথে কথা বলছে। কোন নাড়াচাড়া, টুঁশব্দ কিছু নেই। মাঝে মধ্যে শুধু ঘন পল্লব বিশিষ্ট নেত্র জোড়া কেঁপে উঠছে। কলি বেগম দুরুদুরু বুকে ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালো। তাকে দেখেই আমিন ঠোঁটের হাসি প্রশস্ত করে বললো,
‘এই তো শাশুড়ী মা আইয়া পরছে। আপনে ভালোয় ভালোয় কইয়া দেন তো আমার পরাণ পাখিডা কই আছে। কতদিন ধইরা ওরে দেহি না। মনডা বড় আনচান করে। কতদিন ধইরা আমি ওরে ভালোবাসি। কত পরীক্ষা দিলাম। তারপর কিল্লিগা যে আপনেরা আমারে জামাই হিসেবে নির্বাচন করতাছেন না আমি বুঝতেই পারতাছি না। আমার মতো পোলা একটাও পাইবেন না। হাজারে একখান আমি। আপনের মাইয়া অনেক সুখে থাকবো। কেন ওর সুখটারে পায়ে ঠেইল্লা দিতাছেন?’
কলি বেগম নিজেকে গুটিয়ে নিলো। তার হাত-পা অনবরত কাঁপছে। আমিন, মারুফের সামনে কথা বলতে ভয় পায় না তা এই গ্রামের কেউ নেই। বিশেষ করে মারুফের নীরবতা কলি বেগমকে আরো বেশি ঘাবড়ে দিচ্ছে। মারুফ চুপ থাকা মানে ঝড় আসার পূর্বাভাস। কলি বেগম হাত জোর করে বললেন,
‘বাবা, আমার মাইয়াডার পিছু ছাইড়া দাও। গত এক বছর কম ঝড় যায় নাই ওর ওপর দিয়া। ওরে এবার একটু শান্তি দেও। ও যেনে আছে হেনেই ভালো থাকবার দাও।’
আমিনের আগেই হুংকার দিয়ে উঠলো মারুফ।
‘আবার মুখে মুখে কথা কন। আমিইন্না, তুই এহনো খাড়ায় রইছোত কেন? যা গিয়া হের ছোড মাইয়াডারে তুইল্লা লইয়া আয়। এক মাইয়া হারাইলে আরেক মাইয়া নিজেই সুড়সুড় কইরা বাইর কইরা দিবোনে।’
আমিন চোখ রাঙিয়ে তার এক সাঙ্গকে কঠিন গলায় বললো,
‘যা গিয়া পাপড়িরে লইয়া আয়।’
ছেলেটা আদেশ পেয়ে মাথা নাড়িয়ে ছুটলো ভেতরের দিকে। এবার মুখ খুললেন মনোয়ার সর্দার। চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,
‘দোহাই লাগি তোমাদের, আমাদের পিছু ছেড়ে দাও। আমাদের একটু শান্তিতে বাঁচতে দাও।’
সিগারেটটা মেঝেতে ফেলে পা দিয়ে পিষতে পিষতে মারুফ বললো,
‘আমরাও অশান্তি চাই নাই। কিন্তু আপনেরা তো ভালো কথা হুনলেন না।’
ততক্ষণে আমিনের সাঙ্গপাঙ্গরা পাপড়িকে খুঁজে না পেয়ে চলে এসেছে। এসেই একজন উৎকন্ঠা নিয়ে বললো,
‘ভাইজান, ঘরে কেউ নাই।’
আমিন চিৎকার করে হুকুম দিলো,
‘সারা ঘর তছনছ কইরা ফেল। পাপড়িরে না নিয়া আমি আইজকে যামু না।’
আমিনের হুকুম দিতে দেরী পালন করতে দেরী নয়। হাতে থাকা লাঠি দিয়ে বারি দিয়ে ঘরের প্রত্যেকটা জিনিস ভাঙতে লাগলো। মনোয়ার সর্দার বাঁধা দিতে গেলে এক ছোকড়া জোরে তার মাথায় আঘাত করে বসলো। প্রচন্ড জোরে আর্তনাদ করে মনোয়ার সর্দার মেঝেতে পরে গেলেন।
#চলবে
#কোন_কাননে_ফুটিবে_ফুল🌸
#Part_26
#Writer_NOVA
আনোয়ার সর্দারের কাছে ভাইয়ের অসুস্থতার খবর পৌঁছালো একদিন পর। তখনকার দিনে আমাদের মতো এতো উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিলো না। কাউকে খবর দিতে হলে পায়ে হেঁটে, চিঠিতে কিংবা সাইকেলে চড়ে পৌঁছে দিতে হতো৷ মোটরসাইকেল শুধু ধনীর দুলালদের কাছে ছিলো। যখন খবর এলো তখন আনোয়ার সর্দার ইউনিয়ন পরিষদে ছিলেন। সেই মুহুর্তে তিনি বেরিয়ে গেলেন। তবে একা যাওয়ার সাহস করলেন না। আমিন, মারুফের লোকদের সাথে ষাটের কোঠায় দাঁড়ানো চেয়ারম্যান শক্তিতে কখনোই পারবেন না। খবর পাঠালেন শুভর কাছে৷
শুভ ক্লাবের ভেতরে চেয়ারে বসে সিগারেট ফুঁকছিলো। এক চেয়ারে বসা আরেক চেয়ারে দুই পা তুলে দেওয়া। জ্বর কমতেই ছুটে এসেছে ক্লাবে৷ হানিফ পাশে দাড়িয়ে ফিসফিস করে বললো,
‘শুভ ইউনিয়ন পরিষদ থিকা লোক আইছে।’
শুভর কপাল কুঁচকে গেলো। চোখ তুলে হানিফের দিকে তাকিয়ে রইলো আশ্বস্ত হওয়ার জন্য আসলে সে ঠিক শুনেছে কিনা। হানিফ মাথা নাড়ালো। সিগারেটের বাকি আংশ দূরে ছুঁড়ে মেরে পা নামিয়ে বসলো।
‘কিল্লিগা?’
‘তোর বাপে তোরে এহনই ইউনিয়ন পরিষদ যাইতে কইছে।’
‘কেন? আমি তো কোন মারামারি করি নাই। জ্বরের থোন উইঠা আইলাম দুই দিন পর। আমগো ক্লাবের কেউ কি এর মধ্যে কোন ঝামেলা করছে?’
‘কই না তো।’
‘তাইলে সর্দারের পোলায় ডাকছে কেন?’
‘কইতে পারি না। কইলো এহনই যাইতে৷ তোরে নিয়া কই জানি যাইবো।’
‘কই যাইতে পারে?’
শুভ হানিফের দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বললো। হানিফ মাথা নাড়িয়ে বুঝালো সে জানে না৷ শুভ দোটানায় পরে গেলো যাবে কি যাবে না। একমাত্র তার ক্লাবের ছেলেপেলে কোন হাঙ্গামা করলে অথবা শুভ কেথাও মারামারি করে এলেই আনোয়ার সর্দার ছেলেকে ইউনিয়ন পরিষদে ডাকতেন। তেমন কিছু না করায় শুভ দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছে৷ একবার ভাবে যাবে, আরেকবার ভাবে না। এক সময় দ্বিধাদ্বন্দ এড়িয়ে উঠে গেলো। পকেট থেকে চাবি বের করে মোটরসাইকেল করে ইউনিয়ন পরিষদের দিকে রওনা দিলো। পেছন থেকে হানিফ চেচিয়ে উঠলো,
‘হালার পো হালা, আমারে নিয়া যা।’
শুভ শুনেও শুনলো না। তার ধ্যান জ্ঞান জুড়ে এখন একটাই কথা তার বাপ তাকে কেনো ডেকেছে।
শুভ, আনোয়ার সর্দার হাসপাতালে পৌঁছালো সন্ধ্যার একটু আগে। মনোয়ার সর্দারের মাথায় ব্যান্ডেজ দেখেই শুভর মাথা গরম হয়ে গেলো। পথে আসতে আসতে পুরো কাহিনি শুনেছে সে। টগবগ করে রক্ত ফুটছে। এই মুহুর্তে আমিন কিংবা মারুফ কাউকে পেলে জ্যন্ত কবর দিতো। ভাইকে দেখে উঠে বসলো মনোয়ার সর্দার।
‘আরে করোস কি? হুইয়া থাক।’
‘কেমন আছো ভাইজান?’
‘তোর অবস্থা দেইখা কি ভালো থাকতে পারি?’
মনোয়ার সর্দার স্মিত হাসলো। কলি বেগম ভাসুর ও তার ছেলেকে দেখে ব্যস্ত হয়ে গেলো। বৃন্তকে উদ্দেশ্য করে বললো,
‘যা বাজান সামনের দোকান থিকা চা-বিস্কুট লইয়া আয়।’
‘তার কোন দরকার নাই চাচী। শালাবাবু তুমি আমার কাছে আহো।’
শুভর কথা শুনে দুই ভাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। শুভর থেকে এরকম কিছু তারা আশা করেনি। অবশ্য শুভই তো এমন। কলি বেগম স্বামীর থেকে কমবেশি সবই শুনেছেন। তাই প্রতিত্তোরে কিছু বললেন না। এদিক সেদিক তাকিয়ে শুভ জিজ্ঞেস করলো,
‘পাপড়িরে যে দেহি না চাচী। ও কই?’
‘কলপাড়ে গেছে গোসল করতে।’
‘এতো দেরী?’
‘সারাদিন এইহানে ওর বাপের কাছে আছিলো। আমি বাইতের (বাড়িতের) থিকা রাইন্ধা, হাসপাতালে আইলাম তোমরা আহোনের ইট্টু আগে। তা বাজান, আমার ফুল ভালা আছে?’
‘হো ভালোই আছে। আমার কাছে থাকলে আপনেগো ফুল ভালো থাকবো না তা কি হয়? কারো কোন সাহস আছিনি ওর গায়ে টোকা মারার?’
শুভর ঠাটবাট জবাবে সন্তুষ্ট হলেন মনোয়ার সর্দার। হ্যাঁ, তার মেয়ের জন্য এমন একটা ছেলেই খুঁজছিলেন। যে সবার আগে ফুলকে গুরুত্ব দিবে। আনোয়ার সর্দারের চোখ দুটোতে মুগ্ধতা। এতোদিন কি সে রত্ন চিনতে ভুল করেছে? শুভ একটু বেপরোয়া, কারো কথা মানে না, জেদী, রাগী। নিজের কাছে যেটা ঠিক মনে হবে তাই করবে। কিন্তু অন্যায়ের সাথে কখনও আপোষ করেনি৷ আর রাগ, জিদের জন্য দায়ী তো তারাই। ছোট বেলা থেকে দুই ভাইকে ভিন্ন চোখে দেখেছেন৷ লেখাপড়ায় ভালো বলে অভিকে আদর করেছেন বেশি। শুভকে করেছেন তিরস্কার। তাতে বিগড়ে যাওয়ারই কথা।
শুভ, কলি বেগমের সাথে টুকটাক কথা বলছে। মনোয়ার সর্দার ভাইকে জিজ্ঞেস করলো,
‘আমার অসুস্থতার কথা ফুল জানে?’
‘না, আমি তো বাড়িতে যাই নাই। গেলে জানতো।’
‘তুমি আর ওকে কিছু বলো না। না জানায় ভালো। জানলে আসার জন্য পাগলামো করবে। এখানে আসলেই ওর বিপদ। আমি চাই না ও এখানে আসুক। ও জায়গা থেকে যত দূরে থাকবে তত ভালো।’
‘তুই যা ভালো মনে করোস।’
‘ভাইজান আমি একটা সিদ্ধান্ত নিছি।’
‘কি সিদ্ধান্ত?’
‘এর মধ্যে ফুলের সাথে শুভর বিয়েটা দিয়ে দিবো।’
মনটা দুদিন ধরে কু’ডাকছে ফুলের। কোন কাজে মনোযোগ বসছে না। রাতের রান্না করে না খেয়ে শুয়ে পরছিলো। হঠাৎ মাথায় কারো হাতের স্পর্শ পেতেই হুরমুর করে উঠে গেলো। শিউরের পাশে নিজের দাদীকে দেখে ভীষণ অবাক হলো ফুল।
‘দুপুরে ভালো মতো কিছু খাস নাই। এহনো না খাইয়া ঘুমাইতাছোত কেন ছেমরি?’
‘দাদী আপনি এখানে? কিছু লাগবে?’
‘আমি এহনো ভাত খাই নাই। তোর লগে ভাত খামু আয়৷’
‘শুভ ভাই আসছে?’
‘না আইতে দেরী হইবো। তুই আমার লগে আয়। আমার মন চাইতাছে তোর লগে ভাত খাইতে।’
দাদীর নরম গলার কথা শুনে ফুল অবাকের ওপর অবাক। আজ কোন সুফিয়া বিবির দেখা পেয়েছে সে? এ যেনো ভিন্ন কোন মানুষ। স্বপ্ন ভেবে নিজের গায়ে চিমটি কাটলো ফুল। না সে জেগেই আছে। খাট থেকে নেমে দাদীর পেছন পেছন গেলো৷ একসাথে বসে খাবার খেলো। খাওয়ার সময় ফুলের চোখের নোনাপানি গাল বেয়ে পরছিলো৷ এই কান্না দুঃখের নয় সুখের। সবকিছু এখনো স্বপ্ন মনে হচ্ছে তার।
‘কান্দোস কেন?’
দাদীর কথার উত্তর দিতে পারলো না ফুল। কান্নার তোর বাড়ছে৷ সুফিয়া বিবি নাতনীকে নিজের বাহুডোরে টেনে নিলেন। এতক্ষণ নিঃশব্দে থাকা কান্না এবার শব্দে রূপান্তরিত হলো। সুফিয়া বিবির চোখেও পানি। সেও কাঁদতে কাঁদতে বললো,
‘আমারে মাফ কইরা দিস। তোর লগে কত খারাপ ব্যবহার করছি। তাও আমারে বদদোয়া দেস নাই তুই। হেই দিন খারাপ স্বপ্ন দেখলাম। আমি বোধহয় বেশি দিন বাচমু না। মরণের আগে কোন দায় রাইখা যাইতে চাই না। খুব শীঘ্রই আমি তোর মারেও খবর দিমু। ওরে আমি বউ হিসেবে মাইনা নিছি। ও যেন এহন থিকা হেনেই থাকে।’
ফুল বিস্ময়ে হতভম্ব। আজ যেনো ফুলের অবাক হওয়ার দিন। এক দমকা হাওয়ায় সব যেনো ঠিক হয়ে গেলো। এমনটা তো সে কখনো আশা করেনি।
পরদিন শুভ, আনোয়ার সর্দার যখন ফিরলো তখন তাদের সাথে ফুলের পুরো পরিবারও ছিলো। ফুলের পরিবার দেখে ফুল, ঝুমুর সুফিয়া বিবি খুশি হলেও সোহেলী বেগমের মুখটা কালো হয়ে গেলো। সে গটগট করে দোতলায় উঠে গেছে। অভি বাড়িতে নেই। সে শহরে চলে গেছে গত পরশু। বাবার মুখে শুভর সাথে ফুলের বিয়ের খবর শুনে সে রাগ করে আবারো বাড়ি ছেড়েছে। তবপ এবার চেয়ারম্যান ছেলেকে আটকায়নি।
সুফিয়া বিবি ছেলের অবস্থা দেখে হু হু করে কেঁদে উঠলো। ফুল এগিয়ে এসে বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে বললো,
‘তোমার এসব কি করে হলো বাবা?’
আনোয়ার সর্দার ফুলকে কাছে টেনে নিয়ে বললো,
‘সবেমাত্র আইছে৷ একটি জিরাইতে দে। তারপর বাকি কথা কইবোনে৷’
বৃন্ত, পাপড়ি বোনকে পেয়ে কি খুশি! এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে রইলো কিছুখন। সর্দার বাড়ি আজ খুশির জোয়ার। কত বছর পর সব ঠিক হলো৷ কলি বেগম ভেতরে ঢুকতে নিলেই সুফিয়া বিবি থমথমে গলায় বললো,
‘খাড়াও, তুমি ঢুকবা না।’
খুশির মুহুর্তে সুফিয়া বিবির কথা শুনে থমকে গেলো। ফুল বুঝতে পারলো না হঠাৎ করে তার দাদীর আবার কি হলো। কলি বেগম অসহায় চোখে স্বামীর দিকে তাকালো৷ সুফিয়া বিবি ঝুমুরকে উদ্দেশ্য করে বললো,
‘খাড়ায় রইছোত কেন? যা গিয়া বরণ ডালা সাজায় আন। আমার ছোড বউরে বরণ কইরা ঘরে তুলতে হইবো না?’
সবাই একসাথে হাফ ছাড়লো। তারা কত কি ভেবে ফেলেছিলো। ঝুমুর খুশিতে মাথা নাড়িয় বললো,
‘এহনি যাইতাছি দাদী।’
ঝুমুর বরণ ডালা সাজিয়ে আনতেই বরণ করে নতুন বউয়ের মতো করে কলি বেগমকে ঘরে তোলা হলো। কলি বেগম শাশুড়ীকে জড়িয়ে ধরে সেকি কান্না। বৃন্ত, ফুল, পাপড়িকেও বেশ উৎফুল্ল দেখালো। এত কিছুর মধ্যে ফুল শুভর কথা প্রায় ভুলতেই বসেছিলো। যদি না সে চেচিয়ে কইতরির মা বলে ডেকে না উঠতো।
#চলবে