#কোন_কাননে_ফুটিবে_ফুল🌸
#Part_27
#Writer_NOVA
‘আমি ঐ মাইয়ার লগে আমার পোলার বিয়া কিছুতেই দিমু না। আপনে হাজারবার কইলেও না।’
চেচিয়ে বললো সোহেলি বেগম। আনোয়ার সর্দার জানতেন এমন কিছুই হবে তাই সে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। স্ত্রীর রাগের মধ্যে পানি কিংবা ঘি কোনটাই ঢাললেন না। চোখ তুলে মায়ের দিকে তাকালেন। সুফিয়া বিবি ছেলেকে চোখ দিয়ে আশ্বস্ত করে বোঝালেন আমি দেখছি বিষয়টা।
‘কেন রে ফুলের মধ্যে খামতি কি? এই বংশেরই তো মাইয়া। তুই মানবি না কেন বড় বউ?’
‘আপনের দেইখা অবাক হইতাছি আম্মা। যেই আপনে দুইদিন আগেও ফুলরে দেখতে পারতেন না আজকে এতো দরদ কই থিকা আইলো। ছোড বউরে ধান, দূর্বা দিয়া বরণ কইরা নিলেন। আমি অবাক। আপনের হইছে কি তা আগে কন।’
সুফিয়া বিবি বড় কইরা নিঃশ্বাস ছাড়লেন। ছেলের বউয়ের কাঁধে হাত রেখে বললেন,
‘আইজ মরলে কাইল দুইদিন। এতো হিংসা, রেষারেষি কইরা লাভ আছে ক? মরণের আগে আমি সবাইরে এক লগে সুখে শান্তিতে দেখতে চাই। এর লিগা সবাইরে মাইনা নিলাম। দূরে ঠেইলা দিলে দূরত্ব বাড়ে।’
‘এর লিগা সব ভুইল্লা যাইবেন?’
‘এত বছর মনে রাইখা কি লাভ হইলো? আমরা সবাই খালি দুঃখ পাইলাম। এছাড়া কিছু হইছে? ফুল কোন দিক দিয়া হালাইন্না? চেহারা পরীর মতো। তার মধ্যে শুভর থিকা বেশি শিক্কিত (শিক্ষিত)। বছর খানিক নিজের চোখের সামনে সব দেখলি। তোর পোলাও ফুল কইতে অজ্ঞান। তুই কি ভাবছোস ও ফুল ছাড়া অন্য কাউরে বিয়া করবো? জীবনেও না৷ একদিন আগে হউক পরে হউক মাইনা নিতেই হইবো। তুই কি আমার মতো না মাইনা কষ্ট করতে চাস?এমন মাইয়ারা বউ হিসেবে মাইনা না নিলে পরে পস্তাবি। যেমন আমি পস্তাই।’
সোহেলী বেগম নরম হয়ে এলেন। উত্তর দিলেন না। শাশুড়ীর কথা মন দিয়ে ভাবতে লাগলেন। ভুল কিছু বলেনি শাশুড়ী। আনোয়ার সর্দার গলা ঝেড়ে বললেন,
‘আইজকা সন্ধ্যায় ওগো বিয়াডা দিবার চাই। বেশি দেরী করোন যাইবো না। আমি তোমগো অনুমতি নিতে আহি নাই। আমার সিদ্ধান্ত জানাইতে আইছি।’
সোহেলী বেগম গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
‘চেয়ারম্যানের ছোড পোলার বিয়া এতো সাধারণ ভাবে হইবো?’
আনোয়ার সর্দার চমকে স্ত্রীর পানে তাকালেন। সোহেলী বেগম ফিক করে হেসে উঠলেন। আনোয়ার সর্দার ঠোঁট প্রসস্থ করো বললো,
‘বড় পোলা বাকি আছে। তাছাড়া এহন একটু ঝামেলার মধ্যে আছি। ধুমধাম কইরা বিয়া দিবার গেলে সমস্যা হইতে পারে। এহন চুপেচাপে দেই। পরে অভি, শুভ দুইজনেরডা একলগে অনুষ্ঠান করমু।’
সুফিয়া বিবি পানের চিপটি দূরে ছুঁড়ে মেরে ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বললো,
‘তুই যা ভালো বুঝোস বাপ৷ তয় আর দেরী কেন? রমিজরে বিয়ার বাজার করতে পাডা। নূরজাহানরে খবর দে৷ বউর শাড়ি কিনতে হইবো তো।’
সারা বাড়ি সাজ সাজ রব। দুপুরে ঘুম থেকে উঠে ফুল বেআক্কল হয়ে গেলো৷ সবার মধ্যে কেমন একটা তাড়া তাড়া ভাব। সবাই কাজে ব্যস্ত। ঝুমুর কতখন এদিকে ছুটছে তো কতখন ঐদিকে। সুফিয়া বিবি কাজের তদারকি করছেন। নাতি-নাতনীর বিয়ে বলে কথা। নূরজাহান এর মধ্যে এসে মেহেদী, হলুদ বাটতে শুরু করেছে। ময়না ফুলকে দেখেই কাঁধ দিয়ে ধাক্কা দিয়ে বললো,
‘সই, মনের কথা কওনের মানুষ তো পাইয়া গেলি।’
‘বুঝলাম না।’
‘ওরে ঢং। এমন ভাব করতাছোস কিছু জানোসই না।’
ফুল অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘কি?’
‘আইজ তোর বিয়া।’
‘বিয়ে মানে?’
‘বিয়া মানে বিয়া।’
‘কার সাথে?’
ময়না উত্তর দেওয়ার আগেই সোহেলী বেগম গলা ছেড়ে ময়নাকে ডেকে উঠলেন,
‘ময়না একটু এদিকে আহিস তো। কত কাম বাকি আছে।’
ময়না ফুলের দিকে ঘুরে বললো,
‘খাড়া আইতাছি৷ চাচী ডাকে।’
ময়না ছুটলো তার গন্তব্যে৷ ফুলের মাথায় কিছু ঢুকছে না। ঝুমুর যেতে নিলেই ঝুমুরের বাহু খোপ করে ধরে জিজ্ঞেস করলো,
‘বাড়িতে উৎসব কিসের?’
‘বিয়ার।’
‘কার বিয়ে?’
‘ওমা, তোমার।’
‘মজা করো না ঝুমুর আপা।’
‘তোমার কি মনে হয় আমি মজা করতাছি? আমার অনেক কাম আছে। আমি যাই গা।’
ঝুমুরও প্রস্থান করলো। ফুলের মাথা এবার চিন্তায় ফেটে যাবে৷ বৃন্ত সিঁড়ি বেয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে নেমে বলে উঠলো,
‘বুবুর বিয়া, বুবুর বিয়া। কি মজা!’
এরপর দৌড়ে উপরের দিকে চলে গেলো। ফুল হাত বাড়িয়ে ধরতে পারলো না। এই মুহুর্তে তার শুভকে দরকার। একমাত্র শুভ সব উত্তর দিতে পারবে। কিন্তু শুভর টিকিটার দেখা নেই।হঠাৎ কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পেতেই ঘুরে দাঁড়ালো। কলি বেগম নতুন শাড়ি হাতে দাঁড়িয়ে। ফুল মুখ পানসে করে বললো,
‘কি হচ্ছে মা? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’
‘তোর বাপে ডাকে৷ হের কথা হুনলে সব বুঝতে পারবি।’
মনোয়ার সর্দারের সামনে ফুল দাঁড়াতেই হাত বাড়িয়ে কাছে ডাকলো। ফুল মাথা নিচু করে বাবার পাশে বসলো৷ মনোয়ার সর্দার উঠে বসে বালিশে হেলান দিলো।
‘আমি একটা অপরাধ করে ফেলেছি আম্মাজান। এই অপরাধের যা শাস্তি দিবে আমি তাই মাথা পেতে নিবো।’
‘কি অপরাধ বাবা?’
‘তোমার অনুমতি ছাড়া তোমার বিয়ে ঠিক করেছি।’
‘কার সাথে বাবা?’
‘তোমার ভালোবাসার মানুষ শুভর সাথে।’
ফুল চকিতে বাবার দিকে তাকালো। কি শুনছে সে? সবকিছু কি স্বপ্ন? এতো শর্কড তো সে নিতে পারছে না।মায়ের দিকে তাকাতেই মা মাথা হেলিয়ে বললো,
‘তুই ঠিকই হুনছোত। আইজ সন্ধ্যায় তোর বিয়া। এদিকে আয় শাড়িডা পরায় দেই। একটু পর হলুদ দিয়া তোরে গোসল করায় দিবো।’
মনোয়ার সর্দার মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
তোর কোন আপত্তি আছে?’
ফুল মাথা নাড়িয়ে না বুঝালো। খুশিতে বাবাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলো। আনন্দে তার মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের হচ্ছে না।
ব্লাউজের হুকটা ঠিক করতেই দরজায় ঠুকঠুক শব্দ হলো। ফুল আঁচল টেনে বললো,
‘ভেতরে এসো।’
কেউ ভেতরে এলো না। কেচৎ শব্দ করে দরজাটা হা হয়ে গেলো। ফুল কুচিগুলো ঠিক করে দরজা দিয়ে বাইরে তাকালো। আশেপাশে কেউ নেই। আশ্চর্য, তাহলে শব্দ করলো কে। দরজা ভিড়াতে নিলে একজোড়া বলিষ্ঠ হাত বাঁধা দিলো। চোখ তুলে তাকাতেই দেখে শুভ দাঁড়িয়ে। ওমনি ফুল লজ্জায় কুঁকড়ে গেলো। ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘কিরে আজকে নাকি তোর বিয়া, ভাঙ্গা ঢোল দিয়া।’
ফুল কপট রাগ দেখিয়ে চেচিয়ে উঠলো,
‘শুভ ভাই!’
ফুল অসহায় মুখ করে আফসোসের সুরে বললো,
‘আমারে দাওয়াত দিলি না কইতরির মা?’
‘বিয়েটা কি আমার অভি ভাইয়ের সাথে হচ্ছে যে তোমাকে দাওয়াত দিবো?’
‘তাইলে কার লগে হইতাছে?’
‘এক ভাদাইম্মার লগে।’
শুভ চোখ বড় বড় তাকালো। ফুল শব্দ করে হেসে উঠলো। শুভ চোখ সরু করে বললো,
‘আমি ভাদাইম্মা?’
‘ওমা, তোমার লাগলো কেন? আমি তো আমার জামাইকে ভাদাইম্মা বললাম।’
‘আমি কে তাইলে?’
‘তুমি আমার শুভ ভাই।’
‘বেশি পাইক্কা গেছত।’
ফুল মুখ টিপে হেসে উঠলো। তাকে জব্দ করতে এসে শুভ নিজেই কপোকাত। শুভ আড়চোখে ফুলকে দেখছে। লাল পাড়ে হলুদ শাড়িতে ফুলকে অপ্সরি থেকে কম লাগছে না। তা খেয়াল করে ফুল বললো,
‘এভাবে তাকিয়ো না, নজর লেগে যাবে। তখন আমার জামাইয়ের আর আমাকে ভালো লাগবে না।’
‘ওহ, আমি তো বানের জলে ভাইসা আইছি।’
‘তেমনি।’
‘মুখে মুখে কথা ভালোই শিখছোত।’
‘সরো, সরো। যাও এখান থেকে। আমি এখন পরপুরুষের সাথে কথা বলবো না। আজ আমার বিয়ে।’
শুভ গাল ফুলিয়ে ফুলের দিকে তাকালো। সে যে এভাবে অপদস্ত হবে জানলে সে কখনোই আসতো না। শুভ এগিয়ে এসে বললো,
‘আমি পরপুরুষ?’
‘অবশ্যই।’
‘হাচা?’
শুভ এক পা এক পা করে ফুলের দিকে এগুচ্ছে। তা দেখে ফুল শুকনো ঢোক গিলে আমতাআমতা করে বললো,
‘এই তুমি আমার কাছে আসছো কেন দূরে যাও।’
‘এহন ডরাস কেন?’
‘শুভ ভাই ভালো হবে না কিন্তু।’
‘কিয়ের শুভ ভাই। জামাই ক।’
‘এই এই দূরে যাও।’
ফুল শাড়ি খিচে ধরে চোখ বন্ধ করে ফেললো। ফুলের ভয়ার্ত মুখ দেখে শুভ মিটমিট করে হাসছে। গালে ঠান্ডা স্পর্শ পেতেই ফুল চমকে তাকালো। শুভ সরে গেছে। গালে হাত দিতেই দেখে গাল ভর্তি হলুদ। শুভ দূরে দাঁড়িয়ে হাসছে।
‘আমার আগে কেউ তোর গালে হলুদ ছোঁয়াইবো এডা আমার ভালো লাগলো না। এর লিগা আমি আগে দিলাম।’
‘তুমি ভালো হলে না।’
‘জীবনে হমু না। নিচে আয় সবাই ডাকাডাকি শুরু করছে।’
ফুল হাত দিয়ে হলুদ মুছতে নিলে শুভ চোখ পাকিয়ে বললো,
‘খবরদার মুছবি না। তাইলে তোর খবর আছে। রাইতে কিন্তু আমার কাছেই আইতে হইবো।’
ফুলপর কান দুটে গরম হয়ে গেলো। জিহ্বায় কামড় দিয়ে মাথা নিচু করে ফেললো। ফুলের লাজুক রাঙা গাল দুটো দেখে শুভ মুচকি হাসলো। এরপর অনেকটা ঝুঁকে বললো,
‘তুই এই বিয়াতে খুশি তো ফুল।’
‘আমি তো তোমাকে বিয়ে করবো না।’
শুভর চোখ দুটো দপ করে জ্বলে উঠলো। চোখ লাল করে ফুলের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘তুই রাজী থাকলেও করবি, না থাকলেও করবি৷ তোরে আমারই হইতে হইবো৷ শুভর কাননেই ফুটবে ফুল।’
‘জোর করে করবা?’
‘না, যত্ন সহকারে ফুটামু।’
ফুলের আজ ভয় করলো না। বরং শুভর এই অধিকারবোধটা তার মনে অন্য রকম ভালো লাগার দোলা দিয়ে গেলো। এই অগোছালো মানুষটাকেই তো তার চাই। এর চোখে যে ফুল তাকে হারানোর ভয় দেখেছে।
#চলবে