কোন প্রিয় নামে ডাকি পর্ব-০১

0
1

#কোন_প্রিয়_নামে_ডাকি [১]
প্রভা আফরিন

ভার্সিটি থেকে ফিরে সবে খেতে বসেছে প্রিয়তি। মাংসের বাটিটার দিকে হাত বাড়াতেই চাচি ভ্রু কুচকে বলে উঠলেন, “চর্বিওয়ালা মাংস খেতে মানা করেছি না তোকে? এগুলো খেলে মেদ বেড়ে যায়। এমনিতেই তোর স্বাস্থ্যটা বাড়তি। বিয়ে দিতে অসুবিধা হচ্ছে। শরীরটাকে একটু বশে আন, মা।”

প্রিয়তির গলায় ভাত আটকে গেল। গতকাল চাচাতো বোনটা আফসোস করে বলল গরুর মাংস খেতে ইচ্ছে করছে। চাচা হিসেবি মানুষ। দিন দিন দাম বেড়ে যাওয়ায় গরুর মাংস কেনায় উনার ভীষণ আপত্তি। ছেলে-মেয়েরা মাংস খেতে চাইলে ডিম এনে দেন। ইলিশ খেতে চাইলে পুটিমাছ এনে দেন কিংবা কখনো শুটকি। এত হিসেব করে চলেছেন বলেই ছাপোষা চাকরি করে একটা বাড়ি তিনি করে ফেলেছেন। না, খুব দম্ভ করে বলার মতো কিছু নয়। এলাকার বিশাল বিশাল অট্টালিকার ফাঁকে নিজেকে মেলে ধরতে না পারলেও অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে একতলা বাড়িটা। ছয়টি রুম, দুটো বারান্দা, প্রশস্ত ছাদবিশিষ্ট একটি বাড়ি। দেয়ালে ক্যাটক্যাটে সবুজ ও গোলাপি রংয়ের চামড়ায় ইতিমধ্যে পোস্টার, পানের পিক, চুনের দাগ ও আবেগী কিশোর-কিশোরীদের অমুক+তমুক লেখার খপ্পরে পড়েছে। তা নিয়ে রোজ সকালে গালমন্দ করে পাড়ার সবার ঘুম ভাঙান বাহারুল সাহেব। বাহারুল সাহেবের মৃত ভাইয়ের মেয়ে প্রিয়তি। স্বভাবে চাচার সম্পূর্ণ বিপরীত। মাস গেলে টিউশনির বেতনটা হাতে এলেই সে হয়ে যায় দিলদরিয়া ও সবার ইচ্ছে-পূরণের চাবিকাঠি। ছোটো বোনের আবদার রাখতে প্রিয়তি গতকাল ছাত্রী পড়িয়ে ফেরার পথে নিজে বাজারে গিয়ে মাংস কিনে এনেছিল। তারও মাংসের ভুনা খাওয়ার সাধ জেগেছিল হঠাৎ। ভুলে গেছিল স্থুল দেহের অতিরিক্ত মাংসের জন্য নিত্যদিন কীভাবে অন্যের চোখের কটাক্ষ সহ্য করতে হয়।

প্রিয়তি মাংসের বাটিটা সরিয়ে রাখল। চাচি আইরিন হয়তো ওর মনের অবস্থা বুঝলেন। পাশে বসে বললেন, “আমার কথায় রাগ করলি? আমি কী তোর খারাপ চাই? এই যুগে বিয়ের বয়সী মেয়ে ঘরে ফেলে রাখা যে কত কষ্টের তা কি তুই জানিস না? তবুও তো সকলের কথার সঙ্গে যুদ্ধ করে তোকে বিএ পড়াচ্ছি। মাঝে মাঝে ওজনটা কমানোর জন্য বলে ফেলি। তাই বলে কি সুহাস-সুজানার চেয়ে কোনো অংশে কম খেতে দেই তোকে? নাকি কম ভালোবাসি?”

প্রিয়তি মন খারাপ লুকিয়ে হাসল। বলল, “তোমরা ছাড়া আর কে আছে আমায় ভালোবাসার? আমি মন খারাপ করিনি। কালোজিরা ভর্তা আর ডালও খুব মজা হয়েছে। আমার এতেই হবে।”

আইরিন সঙ্গে সঙ্গে ছো মেরে মাংসের বাটিটা হস্তগত করে উঠে দাঁড়ালেন। রান্নাঘরের শেল্ফে বাটিটা তুলে রাখতে রাখতে বললেন, “খাওয়া শেষে গোসল করে নে। বিকালে মেহমান আসবে। মাংসখানি মেহমানের পাতে দেওয়ার জন্য তুলে রাখলাম। নয়তো মুখ থাকবে না।”

বিকেলে মেহমান আসবে! ইদানীং মেহমান মানেই তো ঘটক। আর ঘটক মানেই প্রিয়তিকে দেখতে আসা। সকলেই চাইছে ওর বিয়েটা দিয়ে ঝাড়া হাত-পা হতে। প্রিয়তিও চাইছে সকলকে মুক্তি দিতে। কিন্তু না হচ্ছে বিয়ে আর না নিজের পায়ে দাঁড়ানোর একটা বন্দোবস্ত। দাদি সব সময় বলেন ওর মুখে অপার মায়া। এমন চাঁদপানা মুখের মায়ায় যে পড়বে সে কোনোদিন ভুলতে পারবে না। কই, কেউ তো তার মুখের মায়ায় পড়ে না। সকলে দেখে প্রিয়তির স্থুল দেহটাকে। দেহের পরিসর পেরিয়ে মুখ অবধি আসে না।

প্রিয়তি গোসল করে একটা সাদা-সোনালি রঙের শাড়ি পরল। এরপর ভেজা চুল খাটের ওপর মেলে দিয়ে শুয়ে পড়ল বিশ্রামের লোভে। বিকেলে রিনিঝিনি শব্দে পাতলা ঘুমটা ভেঙে গেল ওর। চোখ মেলে দেখতে পেল সুজানা ওর ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় ঝুঁকে চোখে কাজল মাখছে। প্রিয়তিকে উঠে বসতে দেখে দশম শ্রেণি পড়ুয়া কিশোরী হেসে বলল, “বুবু, তোমার কাজলটা একটু নিলাম।”

প্রিয়তি হাই তুলে গা মুচড়ে বলল, “নে। কিন্তু হঠাৎ এত সাজ কীসের?”

সুজানা আমতা আমতা করল, “ফেসবুকে নতুন প্রোফাইল দেব তাই একটু কাজল, লিপস্টিক দিলাম। এটা কী আর এমন সাজ? কিন্তু তুমি শাড়ি পরেছো কেন?”

সুজানার পালটা প্রশ্নে প্রিয়তি চুপ করে গেল। চাচি বলেছে মেহমান আসবে। এলেই শাড়ি পরানোর জন্য পীড়াপীড়ি করেন আইরিন। তাই আগেভাগেই শাড়ি পরে নিয়েছে প্রিয়তি। ঘুমিয়ে পড়েছিল অজান্তেই। চাচি ডাকল না কেন? মেহমান কি তবে আসেনি? লজ্জায় পড়তে চায় না বলে প্রিয়তি ঘুরিয়ে উত্তর দিলো, “রোজ তো সালোয়ার কামিজ পরি। তাই ভাবলাম আজ শাড়ি পরে ছাত্রী পড়াতে যাব।”

সুজানা কাছে এসে শাড়ির আঁচলটা হাতে নিয়ে বলল, “দাদি সব সুন্দর শাড়ির কালেকশনগুলো তোমায় দিয়ে দিয়েছে। আমিও বড়ো হয়ে শাড়ি পরব সেটা কি মনে ছিল না?”

প্রিয়তি হেসে বলল, “তোর শাড়ি লাগলে নিবি আমার থেকে। আমি তো শাড়ি নিয়ে পালিয়ে যাইনি।”

সুজানা খুশি হয়ে বলল, “আচ্ছা এই শাড়িটা দিয়ো আমায়৷ দুটো রিলস বানাবো এটা পরে। দারুণ হবে।”

সুজানা বেরিয়ে গেল। প্রিয়তি হাত-মুখ ধুয়ে ঘুমের ক্লান্তি দূর করল। এরপর চুল আঁচড়ে, সারামুখে একটু পাউডার পাফ বুলিয়ে ঘর থেকে বের হলো ছাত্রীকে পড়াতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে।

আজ বোধহয় প্রিয়তির ঠকে যাওয়ার দিন। প্রথমে মাংস না খেয়ে নিজেকে ঠকাল, এরপর শাড়ি পরে বসে থেকে পাত্রপক্ষ এলো না, এরপর টিউশনিতে গিয়ে শোনে ছাত্রীর ডায়রিয়া হয়ে গেছে বলে আজ পড়বে না। প্রিয়তি একটু ক্ষুণ্ণ সুরে ছাত্রীর মাকে বলল, “আমাকে একটা কল করে জানিয়ে দিতে পারতেন।”

ছাত্রীর মা ঝাঁঝিয়ে উঠল, “অসুখ তো আর আগে থেকে ফোন দিয়া আসে না। মাইয়া কাপড় নষ্ট করছে দুইবার। ঘরে গন্ধ ছড়াইছে। এগুলান সাফ করতে করতেই তো শেষ হইয়া গেলাম। আপনারে কখন জানামু?”

প্রিয়তির কণ্ঠ নরম হলো, “ডাক্তার দেখিয়েছেন? ওষুধ খেয়েছে ও?”

“ডাক্তারের কাছে নেওয়ার ঝুঁকি নেই নাই। পরে যদি আবার কাপড় নষ্ট করে? স্যালাইন পানি খাওয়াইছি শুধু৷ এদিকে মাইয়ার বাপে নাই বাড়িত। আমিও মাইয়ারে ফালাইয়া যাইতে পারতাছি না। তুমি যেহেতু আইসা পড়ছো এই উপকারটা করো। গলির মাথার ফার্মেসিতে যে মহিলা ডাক্তার বসে, সে আমার দূর সম্পর্কের আত্মীয়। তার কাছে গিয়া ফোনে ধরায় দেও। আমি সব বিস্তারিত খুইলা কই এরপর ওষুধটা আইনা দেও।”

প্রিয়তি কথা রাখল। ফার্মেসি থেকে ওষুধ নিয়ে ফেরার পথে ওর তাড়াহুড়া ছিল বেশ। আকাশের অবস্থা বিশেষ ভালো নয়। ফোটা ফোটা বৃষ্টি পড়ছে অথচ রোদেরও দেখা মিলছে। প্রিয়তি হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিল ওর ছাত্রীর মতোই আকাশেরও কি পেট খারাপ হয়েছে নাকি? সময়ে-অসময়ে বিনা নোটিশে ঝরে পড়ছে। সবেগে পা চালিয়ে হাঁটতে গিয়ে আচমকাই প্রিয়তির শাড়ি পরার অভিজ্ঞতা বেইমানি করে বসল। কুচিতে পা আটকে হোঁচট তো খেলই, তাও কিনা সামনের আরেক পথচারীর গায়ে সজোরে ধাক্কা লেগে গেল। প্রিয়তি ভেবেছিল মানসম্মানসহ রাস্তাতেই মুখ থুবড়ে পড়বে। কিন্তু সে পড়ল না। যার গায়ে ধাক্কা লেগেছে সেই লোক ওকে একহাতে সামলে নিল। প্রিয়তি লজ্জায় মাথা তুলল না। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে যেই না ধন্যবাদ দিতে যাবে তখনই লোকটা বলে বসল, “চোখ কই রেখে হাঁটেন, আপা? দিলেন তো আমার জুতোটা নষ্ট করে।”

প্রিয়তির খেয়াল হলো তাকে পড়া থেকে আটকাতে গিয়ে লোকটার এক পা রাস্তার খানাখন্দের জমে থাকা নোংরা পানিতে ডুবে গেছে। তার লজ্জা আরো বাড়ল। লোকটা সুজানার মতো মুখ ফুটে বলে বসবে না তো গায়ের ওপর হাতি পড়েছিল! হাতির ওজন সামলাতে গিয়ে এই অবস্থা! চোখে পানি এসে গেল ওর। সেই পানিকে আড়াল করে বড় বড় বৃষ্টির ফোটা ওর দুর্বল ব্যক্তিত্ব ঢেকে দিলো। নিজেকে ভিজে যাওয়া থেকে বাঁচাতে প্রিয়তি আশ্রয় নিল একটি যাত্রী ছাউনির ভেতর। লোকটাও সেখানেই ছুটে এসেছে। গজগজ করে বলছে, “দিনটাই খারাপ আমার।”

এবার প্রিয়তি লোকটার দিকে চোখ তুলে তাকাল। দাড়ি-গোফে ঠাসা উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের পুরুষটির মুখের দিকে চেয়ে হুট করে মনে হলো কোথাও যেন দেখেছে। প্রিয়তিকে অপলক চেয়ে থাকতে দেখে এবার অচেনা লোকটা বিরক্ত হয়ে বলল, “এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? জীবনে পুরুষ দেখেননি?”

এবার প্রিয়তি লজ্জা পেলেও রাগ জমল মনে। মানছে সে অসাবধানতায় পড়ে গেছিল লোকটার ওপর, সামান্য জুতোতে নোংরা লেগেছে। তাই বলে এমন অপমানসূচক কণ্ঠে কথা বলবে? প্রিয়তি বলল, “দেখুন ঘটনা যা ঘটেছে সবটাই অনিচ্ছাকৃত। আমি ইচ্ছে করে আপনার ওপর পড়ে যাইনি, ইচ্ছে করে জুতো নষ্ট করিনি। তবুও আমার অসাবধানতায় ঘটেছে বলে মনে থেকে সরি ফিল করছি।”

অচেনা লোকটা তাচ্ছিল্য করে আবার বলল, “চোখেমুখে সরিষার ঝাঝ নিয়ে কেউ মন থেকে সরি ফিল করে আপনাকে না দেখলে জানতামই না।”

“এর জন্য আপনিই দায়ী।”

“বাহ! আপনাকে পড়ে যাওয়া থেকে বাঁচাব আমি, জুতো নষ্ট করব আমি। আবার ঝাঁঝও আমিই সইব?”

“উপকার করে যারা বিরক্তি ঝারে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ হালকা হয়ে যায়।”

বলে প্রিয়তি বৃষ্টির মাঝেই বেরিয়ে গেল। এই লোক ঝগড়ুটে সে বুঝে গেছে। সরে যাওয়াই উত্তম।
ছাত্রীর মাকে ওষুধ পৌঁছে দিয়ে প্রিয়তি যখন বাড়ি ফিরল তখন বৃষ্টি থেমে গেছে। সন্ধ্যার মলিন রেখায় ভাসছে সবুজ প্রান্তর। বাড়ির ভেতর পা দিয়ে রীতিমতো একটা ধাক্কা খেল প্রিয়তি। চাচাতো ভাই সুহাসের পাশে বসে আছে যে পুরুষটি, তার সঙ্গেই বিকেলে এক অনাকাঙ্ক্ষিত বিবাদ বেধেছিল ওর।

প্রিয়তিকে প্রথম দৃষ্টিগোচর করল সুহাস। ডেকে বলল, “প্রিয়, ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? এদিকে আয়।”

সুহাসের ডাকে পাশের পুরুষটিও চোখ ঘুরিয়ে তাকাল। চোখাচোখি হতেই প্রিয়তি চোখ নামিয়ে নিল। সুহাস পরিচয় করিয়ে দিতে বলল, “ওর কথা মনে আছে তোর? আমার বন্ধু ঋজু। একসঙ্গে কলেজে পড়তাম। আর ঋজু, এই হলো আমাদের প্রিয়। যাকে তুই ক্ষ্যাপিয়ে মজা করতি।”

প্রিয়তি এতক্ষণে বুঝতে পারল কেন লোকটার চেহারা ওর কাছে চেনা চেনা মন হচ্ছিল। অন্যদিকে ঋজু তীক্ষ্ণ হেসে বলল, “মনে আছে। শুধু চিনতে একটু কষ্ট হলো।”

পাশ থেকে সুজানা বলে উঠল, “হবেই তো। আপু যে ডাবল সাইজের হয়ে গেছে, হি হি!”

এ অপমান প্রিয়তির কাছে নতুন নয়। এখন আর গায়ে মাখে না সব কথা। সৌজন্য রক্ষায় ঋজুকে উদ্দেশ্য করে বলল, “ভালো আছেন, ঋজু ভাই?”

“ভালো আছি, অপ্রিয়। শুধু একজন অসচেতন পথচারীকে পড়ে যাওয়া থেকে বাঁচাতে গিয়ে ডান হাতটা ব্যথা হয়ে গেছে। কে জানে দুই একটা হাড়গোড় ভেঙেছে কিনা!”

ঋজু ডান হাত নাড়তে নাড়তে চোখা হাসল। প্রচ্ছন্ন অপমানটা অন্যকেউ বুঝতে না পারলেও প্রিয় বুঝতে পারল। সঙ্গে সঙ্গে নাকের পাটা ফুলে উঠল ওর। এই লোক সেই আগের মতোই ত্যাদড় রয়ে গেছে!

চলবে…?