#কোন_প্রিয়_নামে_ডাকি [১১]
প্রভা আফরিন
প্রিয়তি কি কখনো কারো প্রিয়তমা হতে চেয়েছে? চেয়েছে বৈ কি! আর পাঁচটা মেয়ের যেমন ভালোবাসা পাওয়ার সাধ থাকে, ওরও তেমন আছে। বরং অন্যদের চেয়ে বেশিই আছে। কেননা অন্যরা পেয়ে অভ্যস্ত, আর প্রিয়তি না পেয়ে তৃষ্ণার্ত। কারো ভালোবাসা ওকে কেন্দ্র করে থাকবে, কেউ ওকে বিশেষ অনুভব করাবে, ওকে হৃদয়ের সর্বোচ্চ আসনে ঠাঁই দেবে, এমন আকাঙ্ক্ষা মনের গোপন কুঠুরিতে তালাবদ্ধ করা আছে। একদিন বিশেষ একজন সেই তালা খুলে দখল করে নেবে সবটা অনুভূতি। সেই একদিন আদৌ আসবে তো! অন্তরে তার সীমাহীন শঙ্কার রাজত্ব সদা। ঋজুর ছোট্ট প্রশ্নে হুট করেই সেই শঙ্কা বিশালাকার ধারণ করেছে। উত্তরে চট করে হ্যাঁ বলে দেওয়ার ক্ষমতা হলো না। বলল,
“সাধ করার আগে সাধ্যটাও যে দেখতে হয়, ঋজু ভাইয়া।”
“তোমার সাধ্য নেই বলছো কেন?”
“এতদিনেও বোঝেননি? যে মেয়েকে বিয়ে দিতে পরিবারের কষ্ট হয় সে মেয়ের সাধ আর সাধ্য কতটুকু তা কি আর বলার অপেক্ষা রাখে?”
“বিয়ে দিতে কষ্ট কেন?”
“আমি দেখতে হাতি। হয়তো ভাবে সবার খাবার একাই খেয়ে ফেলি। আমার বাবা নেই, মা-ও বলতে গেলে নেই। পরিবার বর্জিত, আশ্রিতাকে দরদ সবাই দেখায়। কিন্তু দরদ দেখানো আর আপন করে নেওয়া এক নয়।”
“এটা তো অন্যের চোখ দিয়ে নিজেকে দেখা। আমি জানতে চাই তোমার চোখে তুমি নিজেকে কিভাবে দেখো? সত্যি করে বলো। নিঃসংকোচে বলো।”
প্রিয়তি অনেকটা সময় চুপ রইল। এরপর বলল, “আমি আমাকে দেখি একটা গোছালো, ভদ্র, সচ্চরিত্রা ও গুণী মেয়ে হিসেবে। যার মেদবহুল শরীরের ভেতর একটি সুন্দর মন আছে। যে তাচ্ছিল্য পাওয়ার কষ্ট জানে বলে কাউকে তাচ্ছিল্য করে না, সকলের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, স্নেহশীল। যে আঘা’ত পেতে পেতে ক্ষয়ে গেছে বলে কখনো কারো মনে আঘা’ত না দেওয়ার চেষ্টা করে। যে অন্যের দায়িত্বহীনতার শিকার হতে হতে ক্লান্ত বলে নিজের ওপর আসা যেকোনো দায়িত্ব গুছিয়ে পালন করতে পারে। আমার একটি আকণ্ঠ তৃষ্ণার্ত মন আছে। যে মনে তৃষ্ণা জাগে ভালোবাসার, তৃষ্ণা আপন ঠিকানার, তৃষ্ণা আপন মানুষের, সর্বোপরি তৃষ্ণা সুখের। কিন্তু আমি বেড়ে উঠেছি গঞ্জনা সহ্য করে। লোকে আমাকে দুইবেলা ট্রমাটাইজড করেছে এই বলে,
‘তোর মা নাকি তোকে ফেলে আরেক লোকের হাত ধরে চলে গেছে! তুই কোন চালের ভাত খাস রে প্রিয়? এক বস্তায় মাস যায়? কুরবানির মোটাতাজা গরুর মতো থুলথুলে শরীর তোর। হাঁটলে মনে হয় মাটি কাঁপছে। শাড়ি পরলে তোকে বস্তার মতো দেখায়। গালে গোশত বেড়ে তোকে বুড়ি বুড়ি লাগে। বুড়ো বর ছাড়া কেউ তোকে নেবে না।’
কেউ জানতে চায় না আমার পছন্দ কি৷ আমি কি চাই। বরং সবাই তাদের রুচির বহিঃপ্রকাশ ঘটায় আমার ওপর। লোকের চোখে সৌন্দর্যের মাপকাঠিতে পড়িনি বলে আমার কি রুচি নেই? আমি ফেলনা? আমার চরিত্রের ইতিবাচক গুণগুলো আমি অর্জন করেছি নিজ যোগ্যতায়। অথচ সেগুলো আড়ালে চলে যায় এই মেদওয়ালা শরীরের পেছনে। এই সমাজের প্রতি আমার বুক ভরা অভিমান। সেই অভিমান শুধু সৃষ্টিকর্তার কাছেই প্রকাশ করি। আমার দাদি সব সময় বলতেন আমি মায়াবী। আমি সেই কথাই মনে প্রাণে বিশ্বাস করে তারপর আয়নায় তাকাই প্রতিবার, যেন নিজের প্রতি বিতৃষ্ণা না জন্মায়। কারণ লোকের কথায় যেদিন থেকে নিজেকে ঘেন্না করতে শুরু করব, সেদিন থেকে বেঁচে থাকাটা আরো কষ্টকর হয়ে উঠবে। তারচেয়ে আমি বাস্তবতা মেনে নিয়েছি। লোকের মুখ তো আটকাবে না, নিজের কানটাই বন্ধ করে নেওয়ার চেষ্টা করছি।”
ঋজু হেসে বলল, “নিজের অবস্থান মেনে নিয়ে খুশি থাকার পথ খোঁজা, এইটুকু পারে না বলে কত মানুষ যে ধুকে ধুকে ম’রে! আমি খুব করে চাইতাম তোমার মাঝে নিজেকে ভালো রাখার আত্মবিশ্বাসটা জন্মাক। জেনে ভালো লাগছে, অবশেষে খুঁজে পেয়েছো। কিন্তু খুঁজে পেলেই তো হবে না প্রয়োগ ঘটাতে হবে। তা পারছো কই?”
“ধীরে ধীরে পারব। আমার খালা একটা কথা বুঝিয়ে গেছেন আজ। জগতে সবাই নিজ স্বার্থটাই দেখে। যে দেখে না, সে হলো বোকা। তাকে সারাজীবন ঠকতে হয়। তাই অন্যের অনিষ্ট না করে, অন্যকে না ঠকিয়ে নিজের ভালোটা বুঝে নেওয়াটাই শ্রেয়। আমি কথাটা মনে-মগজে গেঁথে নিয়েছি।”
ঋজু প্রসন্ন হলো। বলল, “তোমার খালাকে আমার পক্ষ থেকে একটা ধন্যবাদ জানাতে হবে।”
প্রিয় ভ্রুকুটি করল, “আপনার পক্ষ থেকে কেন?”
“আমার কাজ সহজ করে দিলো তাই।”
“তা কোন কাজ?”
“আছে আছে। তার আগে উত্তর দাও। তোমার কি প্রিয়তমা হতে ইচ্ছে করে?”
প্রিয়তি লাজুক হলো। তবুও স্পষ্ট করে কথাটা বলা প্রয়োজন মনে করেই লজ্জা গিলে নিয়ে বলল, “প্রিয়তমা হতে চাওয়ার আগে আগে আমাকে নিশ্চিতভাবে জানতে হবে, আমার প্রতি ব্যক্তিটার অনুভূতিটা আসলে ভালোবাসা নাকি সহানুভূতি থেকে সৃষ্ট দরদ? এটুকু নিশ্চয়তা পেলে বোধহয় উত্তরটাও সহজ।”
এরপর আর কথা এগোলো না। প্রিয় কাজ আছে বলে ফোন রেখে দিলো। ঋজু ডুবে রইল আত্মদ্বন্দে।
________________
অল্প কিছুদিনের মধ্যেই প্রিয়তি অফিসের কাজ বুঝে নিয়েছে। এরপরেও যখন সমস্যা মনে করে চারুর সাহায্য নেয়৷ চারু কখনো বিরক্তি প্রকাশ করে না। মেয়েটি সাহায্যপরায়ণ। অনার্সে ভর্তি হলেও পড়াশোনার সঙ্গে তার সদ্ভাব কম। অফিসের বাইরে সব সময় ‘কেয়ার করি না’ ধরনের একটা মনোভাব নিয়ে চলে। অফিসের ভেতর কেউ দেখলে মনে করে মেয়েটি বেশ ধৈর্যশীল, বাইরে দেখলে অবশ্য ধারণা পালটে যায়৷
ঘটনাটা ঘটল বিকেলবেলা। অফিস টাইম শেষ হলে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিল প্রিয়তি। বাস স্ট্যান্ড অবধি হাঁটা পথ। রাস্তার পাশ দিয়ে সতর্কতার সঙ্গেই হাঁটছিল সে। হুট করে একটা বাইক পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে তাকে পথে ফেলে দিলো। গণপি’টু’নি খাওয়ার ভয় অদক্ষ চালক এক টানে বাইক নিয়ে পালিয়ে গেল।
চারু ঘটনাটা দেখতে পেয়ে ছুটে এলো। পথের ওপর সজোরে ছিটকে পড়েছে প্রিয়। মুখটা ব্যথায় নীল হয়ে গেছে। চারু এসে প্রথমে বাইকওয়ালাকে উদ্দেশ্য করে কিছু কান গরম করা গা’লি ছুড়ে দিয়ে এরপর প্রিয়কে আগলে ধরল। প্রিয় পায়ে ব্যথা পেয়েছে। পড়ে গিয়ে কোমড়েও লেগেছে। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল। চারু হাসপাতালে যাওয়ার কথা বলল। প্রিয়র মনে সংশয় না জানি কত টাকা খরচ হয়। অথচ হাত খালি। তাই হাসপাতালে যেতে রাজি হলো না। হাত-পা ঝাড়া দিয়ে বলল, “আমি ঠিক আছি। বাড়িতে ওষুধ আছে। খেয়ে নিলেই ব্যথা কমে যাবে। কা’টাছেঁ’ড়ার ওষুধও নিজেই লাগিয়ে নিতে পারব।”
মুখে বললেও হাঁটতে গিয়ে প্রিয়র দাম বেরিয়ে যাওয়ার জোগাড়। চারু বুঝতে পেরে একটা রিকশা ডেকে ওকে সঙ্গে নিয়ে উঠল। প্রিয় বলল, “তোমায় কষ্ট করতে হবে না। আমি চলে যেতে পারব।”
“তোমায় ভরসা পাচ্ছি না। সমস্যা নিশ্চয়ই হচ্ছে কিন্তু লুকোচ্ছো। বাড়ি গিয়ে তোমার পরিবারকে জানিয়ে আসব।”
প্রিয়র আপত্তি সত্ত্বেও চারু ওকে বাড়ি পৌঁছে দিতে গেল। বাড়ির সামনে রিকশা থামতেই চারু ওকে ধরে নামিয়ে ভেতরে নিয়ে গেল।
আইরিন মেজাজ খারাপ হয়ে আছে। এটা অবশ্য নতুন কিছু না। যেদিন কাজের চাপ বেশি হয়ে যায় সেদিনই উনার মেজাজ খারাপ থাকে। আজ কাজের চাপ বেশি। কারণ আগামীকাল মেহমান দাওয়াত করেছেন। সেসব রান্নার পূর্বপ্রস্তুতি চলছে আজ। ঋজু ও তার মায়ের আসার কথা ছিল গত শুক্রবার। ডাক্তারের ডেট পড়ায় তারা আসতে পারেনি। এ সপ্তাহে আসবে বলেছে। তাই এত আয়োজন। একগাদা কাজ প্রস্তুত রেখেছেন প্রিয়তি আসলেই তাকে দিয়ে করাবেন বলে।
প্রিয় যখন ঘরে ঢুকল আইরিন ভালোমতো না দেখেই রান্নাঘর থেকে গজগজ করে উঠলেন, “আসছে নবাবজাদী। সারাদিন একলা খেটে মরি, আর তারা রাজকার্য করে বাড়িতে পায়ের ধুলা দিতে আসে। জলদি হাত-মুখ ধুয়ে এসে মাছ-মুরগীগুলো পিস করে কেটে দে। এরপর মশলা বাটতে হবে। অনেক কাজ বাকি আছে। আমি আর একলা পারি না।”
প্রিয় চরম বিব্রত হলো। আইরিন চারুর উপস্থিতি টের পাননি বেশ বুঝেছে। অপ্রস্তুত হেসে বলল, “আমার চাচি হন। কাজের চাপ বেশি বলে মাথা এলোমেলো হয়ে গেছে আরকি।”
চারু প্রিয়কে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে গলা উঁচিয়ে বলল, “আন্টি, প্রিয়তি আপু এক্সি’ডেন্ট করেছে। একটু দেখে যান।”
আইরিন ছুটে এলেন। অবাক হয়ে বললেন, “কি হইছে?”
প্রিয় তড়িঘড়ি বলল, “রাস্তায় পড়ে গিয়ে একটু চো’ট পেয়েছি।”
“একটু না অনেকটাই। বাইকে ধাক্কা দিয়েছে” চারু জোর গলায় বলল। তার ধারণা ছিল চাচি হয়তো চিকিৎসা বা ওষুধের কথা বলবে। কিন্তু আইরিন মুখ বেজার করে বললেন, “ও। হাত-পাও ভাঙে নাই তো?”
“না।” প্রিয় জবাব দিলো।
“তাইলে মাছগুলা কাটতে বস। এখনো তাজা আছে।”
বলে আইরিন চলে গেলেন। চারু বলল, “এ কেমন কথা! একবার পাশে বসে শরীরের অবস্থা জানতে চাইল না?”
প্রিয় হাসিমুখে কথা ঘোরাতে চাইল। সুহাস তখনই বাড়িতে ঢুকল। প্রিয়তি বলল, “আমার চাচাতো ভাই। তুমি তো চেনোই ভাইয়াকে।”
চারু ও সুহাস একে অপরকে দেখে মুখ কুচকে ফেলল। চারু একবার আইরিনের দিকে তাকিয়ে আবার সুহাসকে দেখল। বিড়বিড় করে বলল, “আচ্ছা! তাহলে এই গাছের ফল ওটা। ঠিকই আছে। গাছ যেমন ফল তো তেমনই হবে।”
চলবে…