#কোন_প্রিয়_নামে_ডাকি [১৩]
প্রভা আফরিন
সুহাস ব্যক্তিগতভাবে খুব একটা গোছালো না হলেও পরিচ্ছন্নতা নিয়ে খুবই সতর্ক। অফিস থেকে ফিরে ঘর্মাক্ত শরীরটাকে জলে না ধুলে তার চলে না। নিজের প্রতিদিনের পোশাকটা প্রতিদিন ধোয়ার অভ্যাস ছোটোবেলা থেকেই৷ তাই ঘরের ছিটকিনি আটকে শরীরের সমস্ত পোশাক খুলে সুহাস কোমড়ে গামছা প্যাচিয়ে নিল। এরপর পরিধেয় পোশাকগুলো একত্র করছিল ধোয়ার জন্য। অঘটনটা তখনই ঘটে গেল। চারু বাথরুমের ছিটকিনি খুলে বেরিয়ে আসতেই দুজনে মুখোমুখি হলো। দুজনেই ভড়কে গেল। তবে চিৎকারটা শুরুতে দিলো সুহাস। হাতে ধরা ঘামে চিটচিটে হয়ে যাওয়া শার্টটাকে এমনভাবে বুকের ওপর মেলে ধরল যেন তার ইজ্জত লুট হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করছে।
চারু চোখ সরিয়ে ভড়কানো কণ্ঠে বলল, “এই মিয়াঁ, আপনি এখানে কী করেন?”
সুহাস বিপন্ন অবস্থাতেও দাঁতে দাঁত চিপে বলল, “প্রশ্ন আমার। তুমি এই বাথরুমে কী করো?”
চারু চোখ বড় বড় করে চেয়ে বলল, “বাথরুমে কি করে জানেন না? আবার জিজ্ঞেস করেন! ছি! ছি! আপনি এত খারাপ!”
“আরে ভেতরে কি করো সেটা জানতে চেয়েছি নাকি? আমার ঘরে, আমার বাথরুমে কেন এসেছো সেটা জানতে চেয়েছি।
“এটা আপনার বাথরুম! এ জন্যই ব্যাডা ব্যাডা কটূ গন্ধ লাগছিল।”
সুহাস শার্টটা ভালোমতো পরে নিয়েছে ততক্ষণে। চারুর কথায় কপাল কুচকে বলল, “ব্যাডা ব্যাডা কটূ গন্ধ মানে? একে তো বিনা পারমিশনে আমার বাথরুম ইউজ করেছো আবার আমারই সামনে বদনাম করছো!”
সে কথায় চারুর বিশেষ ভাবান্তর হলো না, “সত্যিটাকে যদি বদনাম ভাবেন আমার তো কিছু করার নেই।”
“আসলেই। বদনাম বলছি কেন, তুমি তো অপমান করছো। মিনিমাম ভদ্রতা জ্ঞান থাকলে কারো পক্ষে এমন বলা সম্ভব হতো না। যাইহোক, আমি তো আর বাড়ি বয়ে আসা গেস্টকে অপমান করতে পারি না। তারওপর আমার বোনকে বাড়ি পৌছে দিয়েছো। তোমার সম্মানার্থে সব মেনে নিয়ে বলছি কেউ দেখার আগে ঘর থেকে বেরিয়ে যাও।”
চারু চলে যাওয়ার জন্য রীতিমতো হাঁসফাঁস করছিল। মুখে না বোঝালেও মনে মনে সে চরম বিব্রত। তাই কথা ঘোরাতে অপমানমূলক কথা বলতেই হলো। সে বুকে হাত চেপে হাঁপ ছেড়ে যেই না চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল, অমনি দরজা ধাক্কানোর আওয়াজ পাওয়া গেল। চারু-সুহাস দুজনেই চমকে গেল। চারু বলল, “আপনি দরজা আটকেছেন কেন?”
সুহাস দিশেহারা হলো ক্ষণিকের জন্য। চারু জোরে কথা বলে উঠতেই ওকে আস্তে কথা বলার ইশারা দিয়ে নিজেও নিচু স্বরে নামল, “আওয়াজ কোরো না। বাইরে কেউ জানলে দুজনেই ফেঁ’সে যাব রে বোকা।”
চারু বলল, “হেহ! চারুকে ফাঁ’সা’নো এত সোজা না। আমরা কেউ জানতাম না। সুতরাং এটা দুর্ঘটনা। আমি এক্ষুনি দরজা খুলছি।”
চারু পা বাড়াতেই সুহাস প্রথমবারের মতো চারুর হাত টেনে ধরল। অনুরোধের সুরে বলল, “আবলামি বন্ধ করে কাজের কথা শোনো। খাটের নিচে ঢোকো। রোগা পাতলা আছো, অনায়াসে ঢুকে যাবে।”
চারু রাজি হলো না। বেকে বসে বলল, “কেন? আপনি ঢোকেন। আমি দরজা খুলি।”
“সব বিষয়েই তোমায় জিততে হবে? তোমাকে কেউ ঘরে ঢুকতে দেখেনি বলেই তো আমরা এক ঘরে আটক। কিন্তু আমাকে ঢুকতে দেখেছে বলেই এখন ডাকতে এসেছে। আমার জায়গায় তুমি দরজা খুললে কি হবে ভাবতে পারছো?”
দরজার বাইরে কে ধাক্কাচ্ছে সেটা ওরা জানত না। এবার কণ্ঠস্বর শোনা গেল। প্রিয়তি! চারুর চিন্তার অবসান ঘটল। প্রিয়তি আপুকে বুঝিয়ে বলা কোনো ব্যাপারই না। সে তো জানেই সুহাস ও চারুর ব্যাপারটা কেমন। সুতরাং হাতটা ছাড়িয়ে চারু সোজা ছুট দিলো। দরজা খুলে চারু পাথরের মূর্তি বনে গেল। প্রিয় একা নয়, ওদের দেখতে পেল সুজানাও। প্রিয়তির পেছন দিয়ে যাচ্ছিল সে, ভাইয়ার ঘর থেকে অপরিচিত এক মেয়েকে বের হতে দেখে থমকে গেল। তারচেয়েও বেশি থমকাল সুহাসের পোশাক দেখে। শার্টের সব বোতাম খোলা, নিম্নার্ধ্বে একটা গামছা প্যাচানো। সুজানা সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলল।
______________
সকাল থেকেই প্রিয়তি রান্নাঘরে ব্যস্ত ছিল। মেহমান আসবে দুইজন অথচ রান্নাবান্না হয়েছে প্রায় পঁচিশ জনের। প্রিয় অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছে এত কেন? আইরিন সে কথার জবাব না দিয়ে বলেছেন, “সবুর কর জানতে পারবি।”
এরপর প্রিয় বেশি ঘাটায়নি। গত দিনের এক্সিডেন্টের ধকলে রাতে তার শরীরটা খুব বেশি খারাপ হয়েছিল। সকালে উঠে ভেবেছিল একবার ডাক্তার দেখাবে। এর মাঝেই চাচি এসে হুকুম জারি করলেন আজকের রান্নাটা প্রিয়তিকেই করতে হবে। আইরিন প্রতিবারই কাউকে দাওয়াত করলে প্রিয়কে দিয়ে রান্না করান। কারণ প্রিয়র রান্নার স্বাদ অতুলনীয়। পাশাপাশি আইরিনকেও ঝামেলা পোহাতে হয় না, পরিশ্রম কম হয়। প্রিয়তি আইরিনের হুকুমের ওপর টু শব্দটি করেনি। কোমরের নিচ থেকে পা অবধি ব্যথা নিয়ে দুপুর পর্যন্ত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সমস্ত রান্নাবান্না করেছে।
মেহমান এলো দুপুরে। ঋজু ও রেবেকা ফল, মিষ্টি, দই নিয়ে এসেছে। আইরিন নতুন একটা শাড়ি পরে ছুটে এসে হাসিমুখে বললেন, “কষ্ট করে এতকিছু আনার কি দরকার ছিল?”
রেবেকাও হেসে বললেন, “কষ্ট তো আপনাদের দিতে এসেছি।”
“কষ্ট কীসের? আমি তো খুশি হয়েছি।”
বাহারুল সাহেব আজ বাড়িতে আছেন। কিন্তু ভাবভঙ্গি অত্যন্ত গম্ভীর। মেহমানদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করে তিনি ঘরে চলে গেলেন। রেবেকা এ বাড়িতে নতুন আসলেও ঋজুর যেহেতু বেশ কিছুদিন থাকার অভিজ্ঞতা আছে, তাই মনে হলো বাড়ির পরিবেশ আজ অনেক বেশিই থমথমে। সে চোখ ঘুরিয়ে প্রিয়তিকে খুঁজল। ঋজুর ইচ্ছে আজই মায়ের সঙ্গে প্রিয়তির সাক্ষাৎ করায়। ওরা এসেছে জেনে প্রিয় একবারও বের হলো না কেন? সুহাসকেও দেখা যাচ্ছে না। তবে সুজানা নিজের উপস্থিতি জানান দিলো তীব্রভাবে। বাইরে পা রাখতেই তার পারফিউমের সুবাস, চুড়ির রিনিঝিনি ও হাসির সুর চারপাশ দখল করে ফেলল। সুজানা ছুটে এসে রেবেকাকে জড়িয়ে ধরল। আহ্লাদী সুরে বলল, “আন্টি, আপনাদের অপেক্ষায় ছিলাম।”
রেবেকা সুজানার থুতনি ধরে স্নেহের সুরে বললেন, “মা শা আল্লাহ! সুজানাকে কি মিষ্টি দেখতে লাগছে!”
সুজানা লজ্জা পেল। সরে এসে ঋজুকে জিজ্ঞেস করল, “আমাদের তো ভুলেই গেছেন, ভাইয়া।”
ঋজু মজা করে বলল, “ভুলে গেছি আসলেই। তোমার নামটা যেন কি?”
সুজানা হেসে ফেলল, “আমার নাম সুজি। মনে পড়েছে?”
ঋজুও হাসল, “এবার মনে পড়েছে। তুমি তো সুজি। কিন্তু আজকে সুজিতে ময়দার পরিমাণ বেশিই মনে হচ্ছে!”
সুজানা মুখ গোমড়া করে ফেলল। ঋজু হেসে বলল, “মজা করলাম। তোমায় সুন্দর লাগছে।”
ঋজুরা যতক্ষণ বাড়িতে ছিল, প্রিয়তিকে একবারও দেখা যায়নি। খাওয়ার সময় ঋজু বলল, “সবাইকে ডাকুন, আন্টি। একসাথে বসি।”
আইরিন বললেন, “সবাই তো আছে।”
“সুহাস, প্রিয়তি কোথায়? এসে অবধি দেখলাম না। সুহাসকে কল দিলাম ধরল না।”
আইরিন কিছু বলতে চাওয়ার আগেই সুজানা বলে ফেলল, “আপু অসুস্থ হয়ে গেছে তো তাই ভাইয়া ডাক্তার দেখাতে নিয়ে গেছে।”
ঋজু অস্থিরবোধ করল। তা যেন প্রকাশ না পেয়ে যায় তাই সীমিত সুরে বলল, “কী হয়েছে ওর?”
এবার আর সুজানাকে মুখ খুলতে দিলেন না আইরিন। মেয়েকে চোখে শাসিয়ে এরপর জবাব দিলেন, “জ্বর এসেছে। বলেছে ওষুধ খেলেই ঠিক হয়ে যাবে তাও সুহাস টেনে নিয়ে গেছে ডাক্তারের কাছে।”
রেবেকা প্রিয়তির নাম শুনলেও আগে দেখেননি। আর না তার সম্পর্কে জানে। খাওয়া-দাওয়ার পর যখন পায়েসের বাটি হাতে নিয়ে রেবেকা ও আইরিন গল্প করছিলেন তখন আইরিন জানালেন প্রিয়তির কথা। কীভাবে একটা বাবা ম’রা, মায়ে ফেলে যাওয়া মেয়েকে উনারা বড় করেছেন। কীভাবে তাকে খাইয়ে-পড়িয়ে শিক্ষিত করেছেন। এমনকি সামান্য অসুস্থ হলেও হাসপাতালে নিয়ে যান যেমন আজ সুহাস নিয়ে গেলইত্যাদি…। পুরো বক্তব্যে নিজেদের মহত্ত্বটাই তিনি তুলে ধরলেন। এরপর কথা উঠল সুজানাত ভবিষ্যত নিয়ে। মেয়েটাকে একটা ভালো পাত্রের কাছে বিয়ে দিতে চান। এই নিয়েই চলল তাদের সাংসারিক আলাপ।
অন্যদিকে সুজানাকে তার বাবা পায়েস খেতে ডাকল। সুজানা পায়েস মুখে দিয়েই বলে ফেলল, “আপু আজ মিষ্টি বেশি দিয়ে ফেলেছে।”
ঋজু শুনে ফেলল কথাটা। সুজানা পায়েস খেয়ে ফিরে আসতেই জিজ্ঞেস করল, “তোমার আপু রেঁধেছে পায়েস?”
সুজানা সঙ্গে সঙ্গে কথা ঘোরাল, “না। রান্না তো মা করেছে। আপু শুধু চিনিটা দিয়েছিল।”
ঋজুর আর কিছু বুঝতে বাকি রইল না। ওরা বিদায় নিল বিকেলের কিছুটা আগে। প্রিয়তি বাড়ি ফিরল তারপর। মেহমান যাওয়ার পরেই ফেরার নির্দেশ দিয়েছিল আইরিন। রান্না করতে করতে এক পর্যায়ে প্রিয়তি দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি হারিয়ে বসেছিল। সব রান্না যখন শেষ তখন প্রিয়তি রান্নাঘরের মেঝেতে বসে পা ধরে কাঁদতে শুরু করে। সুহাস সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে যায় ওকে। ডাক্তার দেখিয়ে, ওষুধ নিয়ে ফিরেছে একেবারে।
আইরিন প্রিয়তির ঘরে এসে একটা প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বললেন, “গোসল করে শাড়িটা পরিস। আজকে দেখতে আসবে।”
প্রিয়তির কাছে এবার স্পষ্ট হলো কেন চাচি এত এত রান্না করিয়েছে তাকে দিয়ে। কিন্তু প্রতিবার তো ফল-মিষ্টি দিয়েই কাজ সারেন। এবার হঠাৎ পোলাও, রোস্ট, মাছ, গরুর মাংস, পায়েস এতকিছু করার পেছনে কি কারণ? মনে একগাদা শঙ্কা নিয়েই প্রিয়তি গোসল করল। শাড়িটাও পরল। মাঝে একবার ফোন করল সুহাসের কাছে। সে বাড়ি ফেরেনি। বাড়ি ফেরার মানসিকতা নেই। ফোন রিসিভ করতেই প্রিয় বলল, “ভাইয়া, প্লিজ একটা আবদার করি, রাগ কোরো না।”
“বল।”
“তুমি কি একবার চারুর খোঁজ নেবে? ওর ফোন নম্বর আমার কাছে নেই যে খবর নেব। গতকাল রাত করে মেয়েটা বেরিয়ে গেল, আমার না চিন্তা হচ্ছে।”
“অন্যের চিন্তা করে কাজ নেই। নিজের চিন্তা কর। কোথায় আর যাবে, বাড়ি ফিরে গেছে।”
“বাড়ি নেই তো চারুর। মেয়েটা একা একা বড় হয়েছে। একাই থাকে। আপন বলতে একটা ভাই আছে সে হোস্টেলে থাকে। তাই এত চিন্তা। তুমি বরং ঋজু ভাইয়ার কাছ থেকে চারুর ফোন নম্বরটা নিয়ে দাও। আমি কথা বলব। প্লিজ!”
সুহাস কোনো কথা না বলে ফোন কেটে দিলো। প্রিয়তির মনে জমা হলো দুঃখ। সব তারই জন্য হলো। কেন তার গতকাল এক্সিডেন্ট হলো, কেন চারু তাকে নিয়ে বাড়িতে এলো, আর কেন-ই বা রাতে মেয়েটাকে চরিত্র নিয়ে কথা শুনে অপমানিত হতে হলো। প্রিয় মুখ বুজে কেঁদে ফেলল।
______________
ঋজু প্রিয়র ফোনে কল করছে বিকেল থেকে। প্রিয়তি ফোন ধরছে না। চিন্তায় অস্থির হয়ে সন্ধ্যার পর সে আবার এলো সুহাসদের বাড়িতে। কিন্তু এসে যা দেখল তার জন্য প্রস্তুত ছিল না।
একঘর ভরতি লোকের মাঝে প্রিয়তি বসে আছে। তার পরনে লাল রঙের শাড়ি। প্রিয়তির পাশেই বসে আছে এক পাঞ্জাবি-টুপি পরিহিত পুরুষ। ঋজুর আগমন টের পেয়ে প্রিয় চোখ তুলে তাকাল। তার দুই চোখ ভরা জল। যেন স্রোতের মাঝে মাঝে হাবুডুবু খেতে খেতে খড়কুটো দেখল সে।
সুজানা ঋজুকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে আসতেই ঋজু প্রশ্ন করল, “এখানে কী হচ্ছে?”
সুজানা উত্তর দিলো, “আজ প্রিয়তি আপুর বিয়ে।”
চলবে….